শ্রমিকদের স্ব-ব্যবস্থাপনা: আর্জেন্টিনার বসবিহীন কারখানা!

একুশ শতকের শুরুতেই বড় ধরনের অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মুখে পড়েছিল আর্জেন্টিনা। ২০০১ সালের ডিসেম্বরে দেশজুড়ে শুরু হয়েছিল বিক্ষোভ, দাঙ্গা পরিস্থিতি। সেসময় অনেক মানুষ, বিশেষত শ্রমিকশ্রেণীর মানুষ তাদের চাকরি খুইয়েছিল। হাজারো শ্রমিক আকস্মিকভাবে পড়ে গিয়েছিলেন এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের সামনে।


এমন পরিস্থিতিতে মুষড়ে পড়া, আবার নতুন করে চাকরির সন্ধান, কৃচ্ছতাসাধনের পথেই যেতে হয় শ্রমিকদের। আর্জেন্টিনাতেও তেমনটাই হয়েছিল। ব্যতিক্রম ছিল অবশ্য একটি কারখানা। দক্ষিণ আর্জেন্টিনার প্যাটাগোনিয়ার একটি কারখানার শ্রমিকরা হাহাকার করা বাদ দিয়ে সবকিছু নিজেদের হাতে তুলে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।
জ্যানোন নামের এই সিরামিক টাইল কারখানার শ্রমিকরা চাকরি হারানোর খবর শোনার পর সহজে সেটা ছেড়ে দিয়ে আসতে চাননি। তারা কারখানা দখল করে নিয়েছিলেন। সরকারী কর্তৃপক্ষ, কারখানার ম্যানেজারদের পক্ষ থেকে অনেক চেষ্টা চালানো হয়েছিল শ্রমিকদের কারখানা থেকে বের করে দেওয়ার জন্য। কিন্তু সব চেষ্টাই বিফলে গেছে।


নিজেরাই কারখানা দখল করে উৎপাদন চালিয়ে যেতে থাকেন শ্রমিকরা। এবং কিছুদিন যেতে না যেতেই দেখা যায় যে উৎপাদন কোটা ঠিকঠাক রেখেই খুব নিঁখুতভাবে কারখানাটা চালাচ্ছেন শ্রমিকরা, নিজেরাই। আর এটার মধ্য দিয়ে তারা নিজেদের চাকরি তো বাঁচালেনই, সেই সঙ্গে তৈরি করলেন কারখানায় স্ব-ব্যবস্থাপনার উজ্জ্বল এক দৃষ্টান্ত। 


শুরুতে আঞ্চলিকভাবে, তারপর জাতীয়ভাবে এবং শেষপর্যন্ত পুরো বিশ্বজুড়ে সাড়া জাগিয়েছে আর্জেন্টাইন শ্রমিকদের এই স্ব-ব্যবস্থাপনার ঘটনাটি। ২০০৯ সালে আর্জেন্টিনার আঞ্চলিক আইনসভায় কারখানাটিকে শ্রমিকদের কোঅপারেটিভের হাতে আইনিভাবে হস্তান্তর করে দেওয়ার ভোট পাস হয়। তিন বছর ঝুলিয়ে রাখার অবশেষে সেটির আইনি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেছে দেশটির কেন্দ্রীয় সরকার।
কোঅপারেটিভের কাছে আইনিভাবে মালিকানা হস্তান্তরের পর সেটার নতুন নাম দেওয়া হয়েছে Fasinpat। Factoria Sin Patrones- এর সংক্ষিপ্ত রূপ হচ্ছে Fasinpat। যার অর্থ Factory Without Bosses, বসবিহীন কারখানা। মালিকানা হস্তান্তরের পর থেকে কারখানাটি আরও লাভজনক হয়ে উঠেছে। 


মুনাফার অংশ দিয়ে এলাকার নানা উন্নয়নমুখী প্রকল্পে হাত দিয়েছে শ্রমিকদের এই কোঅপারেটিভ। গড়ে তুলেছে একটি হাসপাতাল। কারখানার কাঁচামাল, কাদামাটি কেনার জন্য তারা স্থানীয় আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সঙ্গেও গড়ে তুলেছে একটা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। যেখান থেকে দুই পক্ষই সমানভাবে লাভবান হতে পারছে।
শ্র

জিন্দা-মুর্দা পার্ক: শান্তিকানন আর রাজউক উন্নয়ন!

গুগল ম্যাপের সুবাদে এখন পাখির চোখে খুব চমৎকার দেখা যায় “উন্নয়ন”-এর চিত্র। ছবিতে ধুসর হয়ে যাওয়া অংশটা হচ্ছে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অধীনে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) ‘পূর্বাচল নতুন শহর’ প্রকল্পের জায়গা। চারদিকে যথেষ্ট সবুজ। একসময় যে আরও অনেক সবুজ-শ্যামল ছিল– তা শোনা যায় মুরুব্বিদের কথায়। এখন সেসব ধু ধু মরুভূমি। এখানে নগর হচ্ছে। আধুনিক জীবনযাপন হবে। মানুষ উন্নত হবে। সভ্যতা বিকশিত হবে।

এই আধুনিক শহর প্রকল্পের ঠিক পাশেই আছে একটা সবুজঘেরা মনোরম জায়গা। যেটিকে সবাই এখন চেনেন ‘জিন্দাপার্ক’ নামে। ১০০ বিঘার মতো এই জায়গাটিরও মালিক এখন কাগজে-কলমে রাজউক। অসাধারণ কিছু চিন্তাভাবনা আর দীর্ঘদিন ধরে তিল তিল করে গড়ে ওঠা এই জায়গাটি রাজউক অধিগ্রহণ করে ১৯৯৫ সালে। এরপর এই জায়গাটির দখল নেওয়ার জন্য দফায় দফায় রাজউকের সঙ্গে সংঘর্ষ-উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে জড়িয়েছে সেখানকার এলাকাবাসী। ‘পার্ক’টিকে ঘিরে আশা-স্বপ্নের বাতি জ্বালানো হাজারো মানুষ।

‘জিন্দাপার্ক’ নামে পরিচিত এই জায়গাটি আসলে পরিচালিত হয় একটি সমিতির মাধ্যমে। অগ্রপথিক পল্লী সমিতি। ১৯৮০ সালের দিকে সেসময় স্কুলপড়ুয়া ৫ কিশোরের উদ্যোগে যাত্রা শুরু হয়েছিল এই সমিতির। মাত্র ৬০ টাকা পুঁজি আর মাসিক ১০ টাকা চাঁদা দিয়ে শুরু হয়েছিল পথ চলা। এখন সেই কম্পাউন্ডের মধ্যে আছে অসাধারণ নির্মানশৈলির একটি স্কুল-লাইব্রেরী-মসজিদ-কটেজ। আছে একটি স্বাস্থ্যসেবাকেন্দ্র। খেলার মাঠ। লেক। মন শান্ত করে দেওয়ার মতো সবুজের সমারোহ। নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত শিক্ষার উদ্দেশে তৈরি হচ্ছে নতুন আরেকটি স্কুল ভবন। চলছে একটি রেস্টুরেন্ট-রেস্ট হাউজ তৈরির কাজ। ভবিষ্যতে কাজী নজরুল ইসলামের নামে একটি সঙ্গীত বিশ্ববিদ্যালয় নির্মান ও পরিচালনার পরিকল্পনাও আছে এই সমিতির।

দেশের অনেক জায়গায় যেরকম রিসোর্ট টাইপ জিনিস দেখা যায়– এই ‘জিন্দাপার্ক’টা বোধহয় সেগুলোর চেয়ে একেবারেই আলাদা কিছু। প্রকৃতির সঙ্গে তাদের সহাবস্থানের বিষয়টি বুঝতে পারা যায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই। কোথাও কখনো কোনো গাছ কাটেননি তাঁরা। এখন সেখানে আড়াইশ প্রজাতির প্রায় ২৫হাজার গাছ আছে। শান্ত পরিবেশটা ভয়াবহভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয় বলে সেখানে কোনো পিকনিক পার্টি ঢুকতে দেয়না সমিতি।

জিনিসটা তথাকথিত পার্ক হিসেবে পরিচালনার কোনো রূপকল্প এই সমিতির আদি পরিকল্পনায় ছিল না। এখনো নেই। পুরো জিনিসটাই তাঁরা চিন্তা করেছিলেন ও তিল তিল করে বাস্তবায়ন করে যাচ্ছেন একটা কমিউনিটির স্বার্থ চিন্তা করে। একারণেই হয়তো দেখা যায়– একবার একটা চিড়িয়াখানা তৈরির উদ্যোগ নিয়েও সেটি তাঁরা বাস্তবায়ন করেননি। এখনো একটা অংশে শুধু কিছু পিলার দেখতে পাওয়া যায়। যেটা ওভাবেই পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। ঘন গাছপালা অচিরেই হয়তো গ্রাস করে নেবে সেই কনক্রিটের পিলারগুলোকে।

দেয়াল দিয়ে ঘিরে দিলে কেমন বন্দী বন্দী ভাব আসে– সেই চিন্তা থেকে পুরো কম্পাউন্ডটার তিন দিক তাঁরা পরিকল্পিতভাবে ঘিরে দিয়েছেন লেক দিয়ে। এই পেঁচিয়ে থাকা জলাধারগুলোই এলাকার সীমানা নির্ধারণ করে। সামনে একটা দিকে আছে ইটের দেয়াল। তাঁরা এই এলাকাকে ডাকতে পছন্দ করেন ‘ঐক্যতান’ হিসেবে। আদিতে এই পুরো প্রকল্পটিকে শান্তিনিকেতনের আদলে গড়তে করতে চেয়েছিলেন সমিতির উদ্যোক্তারা। এই লক্ষ্যে তাঁরা নাম ঠিক করেছিলেন ‘শান্তিকানন’। এখন সেসব ঐক্যতান, শান্তিকানন, অগ্রদূত পল্লী সমিতি– সবকিছু চাপা পড়েছে ‘জিন্দাপার্ক’-এর আড়ালে।

সেটাও তো ঠিকঠাক চালাতে পারলে হতো। রাজউক-এর উন্নয়নের ঠেলা সামলাতে হচ্ছে তাদের এখন পর্যন্ত। ২০১৪ সালে পাকাপাকিভাবে সাইনবোর্ড-ফাইনবোর্ড টাঙিয়ে এটাকে নিজেদের দখলীকৃত জায়গা বলে ঘোষণা করে দিয়ে গেছেন কর্তারা। রাজউক আর জিন্দাপার্কের এই লড়াই চলেছে দীর্ঘদিন ধরে। এখনো চলছে। তবে অনেক সংগ্রাম করে এটা পরিচালনার ভার নিজেদের দখলেই রাখতে পেরেছে সমিতি। আর এই সমিতি চালাচ্ছে বলেই মনে হয় এখনো সেটি চলছে খুব ভালোভাবে। আগ্রহীরা গিয়ে দেখে আসতে পারেন।

মোদ্দা কথা যেটা, তা হলো: কী চাই আসলে আমরা? রাজউকের পূর্বাচলের মতো অত্যাধুনিক ধুসর হয়ে যাওয়া শহর? নাকি শান্তিকাননের শান্ত, সবুজ-শীতল প্রাকৃতিক নৈসর্গ্য? কিসে শান্তি মানুষের? কিসে হয় উন্নয়ন?

এখনো ভাবায়, সুকুমার রায়!

বেড়ালটা এখনো ফ্যাঁচ্‌ ফ্যাঁচ্‌ করে হেসেই চলেছে! জোরে জোরে বানান করছে চশমার, “চন্দ্রবিন্দুর চ, বেড়ালের তালব্য শ, আর রুমালের মা- হল চশমা । কেমন, হল তো?'”

হিজিবিজ্‌বিজ্‌-এর হাসি থেমেছে ভাবছ? হাহ! সে হেসেই চলেছে পেট ফাটিয়ে। কখনো তকাই নামে, কখনো বিস্কুট নামে…

শ্রীব্যাকরণ শিং, বি. এ. খাদ্য বিশারদ এখন পত্রিকায় কলাম লেখেন। সভা-সেমিনার-সিম্পোজিয়ামে তাঁর নিত্য উপস্থিতি।

রাগ করে তো কোনো লাভ নেই। ন্যাড়াটাও তাই গান শুনিয়ে চলেছে। “মিশিপাখা শিখিপাখা আকাশের কানে কানে” — দারুন হিট করেছিল গত মৌসুমে!

‘মানহানির মোকদ্দমা’ও চলছে। “কালো ঝোল্‌লা-পরা হুতোম প্যাঁচা”র চোখ এখনো বোজা। তা-ই বলে মনে করেন না যে, তিনি ঘুমোচ্ছেন। উনার চোখে ব্যারাম আছে। সবাই সেটা বোঝে। শুধু হিজিবিজ্‌বিজ্‌টা বোঝে না। এখনো সে বেআক্কেলের মতো বলে ওঠে, “আরও অনেক জজ দেখেছি, তাদের সক্কলেরই চোখে ব্যারাম।”

উধো-বুধোর ফাইট আর দোস্তি– সেও কী আর থামবার মতো জিনিস? তাদের বয়স কতবার কমল-বাড়ল হিসেব রাখাও দায়। সত্যিই তো। বয়স বাড়তে বাড়তে শেষটায় বুড়ো হয়ে মরবে নাকি!! বালাই ষাট! তাই ১০ থেকে ৪০ বছরের মধ্যেই তাদের নিত্য ওঠানামা।

আর শ্রীকাক্কেশ্বর কুচ্‌কুচে? দারুণ জমে উঠেছে তার হিসেবের ব্যবসা। কার মন ভালো করা চিঠিতে এক ফোটা কান্নার জল পড়েছিল– সেই হিসেবটা নিয়েই যা একটু হয়েছিল ভ্যাজাল। এছাড়া কিন্তু দারুণ চলছে তার। সমস্যা শুধু একটাই। প্রায়ই সে অভ্যাসবসে বলে বসে, ‘লেগে যা, লেগে যা- নারদ নারদ !’

অ্যাঁ? আর কার কতা কইচ? সুকুমার? সে আবার কী? মৃত্যু? দিবস? এসব আবার কী? কেউ কখনো মরে নাকি? আ মলো যা!!! কী আদিখ্যেতা!!!
—————-
হযবরল– শুনিয়েছেন প্রতুল মুখোপাধ্যায়– https://youtu.be/G_W0obTSLEw

সুবোধের বোধ ও বাংলাদেশের প্রাক-রূপায়নের রাজনীতি

ধানমন্ডির আবাহনী মাঠ সংলগ্ন এলাকায় চোখে পড়েছিল এই ছবিটি। পলায়নরত সুবোধকে এভাবে ঢেকে দেওয়া হয়েছিল পোস্টার দিয়ে। সুবোধের এই গ্রাফিতিতে লেখা ছিল, ‘এখানে সাপ ভরা চাপ চাপ রুচি! কাপ ভরা পাপ পাপ চা! সুবোধ… তুই পালিয়ে যাহ!’

তো এই ‘চাপ চাপ রুচি’র দারুণ প্রয়োগই ঘটিয়েছিলেন পোস্টার লাগানেওয়ালারা। এই একটা গ্রাফিতি ঢেকে দেওয়ার প্রয়াসে তারা সফল হয়েছিলেন খুব সফলভাবে! কিন্তু ঢাকা শহরে তো সুবোধ ছড়িয়ে গিয়েছিল ততদিনে। মানুষের মনে ততদিন প্রশ্ন উঠে গেছে যে, কে এই সুবোধ? কেন পালাতে বলা হচ্ছে তাকে? ‘এখন সময় পক্ষে না’ যে বলা হচ্ছে, তো এটা কোন সময়? কেমন সময়? যে সময়ে সূর্যকে খাঁচাবন্দী করে পালিয়ে যেতে হচ্ছে সুবোধকে? এসব প্রশ্ন আর খোদ এই সুবোধের খোঁজ করতে গিয়ে কিছু বন্ধু মিলে বানানো হয়েছিল এই ভিডিওটি।

ঢাকার রাস্তায় কে বা কারা এই সুবোধকে চিত্রিত করেছেন তা জানা যায়নি আজ অব্দি। চেষ্টা হয়তো হয়েছেও কিছু, সুবোধের ঠিকুজি-কুলজি জানার। কিন্তু সেই সন্ধান পাওয়া গেছে- এমন খবর পাওয়া যায়নি এখন পর্যন্ত। #হবেকি নামধারী এই অচেনা চিত্রকর পচে-গলে যাওয়া, দমবন্ধকরা এক মৃত্যুপুরির শহরে যেন হঠাৎ করেই কিছু ফুল ছড়িয়ে দিয়েছিল। দেয়ালে দেয়ালে পলায়নরত সুবোধকে চিত্রিত করে। মানুষ মুগ্ধ হয়েছিল এর অঙ্কনশৈলি দেখে। কী এটা? সুবোধ আবার কী?- শুরুতে এমন প্রশ্ন। এরপর একটু একটু করে প্রশ্ন গাঢ় হতে শুরু করল। সুবোধ কী তবে সু-বোধ? মানুষেরই, আমার-আপনারই বোধশক্তি? নাড়া পড়ল চেতনায়।
মনোচৈতন্যে নাড়া দেওয়ার এই কাজটা সুবোধ সিরিজের গ্রাফিতিগুলো খুব ভালোভাবেই করতে পেরেছে বলে প্রতিয়মান হয়। সুবোধ খুব অল্প সময়ের মাঝে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। সুবোধকে নিয়ে বাঁধা হয়েছে গান-কবিতা। বানানো হয়েছে টি-শার্ট*** (এ প্রসঙ্গে কিছু কথা ডিসক্লেইমার আকারে নিচে বলা আছে)। সুবোধের বোধ কাঁটাতারের গণ্ডিও পেরিয়ে গেছে অনায়াসেই। কোনো পাসপোর্ট-ভিসার ধার ধারতে হয়নি সুবোধকে।

কলকাতার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সেখানকার শিক্ষার্থীরা সুবোধকে দেখেছেন লড়াইয়ের প্রতীক হিসেবে। তারা সুবোধকে দিয়েছেন ইতিবাচকতা। সুবোধকে বলেছেন তৈরি হতে, ঘুরে দাঁড়াতে, ছড়িয়ে যেতে। হয়েছেও তো খানিকটা সেরকমই। ২০১৮ জুলাই-আগস্টে কিশোর বিদ্রোহের তোলপাড় করা সেই দিনগুলোতে একটি ছবি অনেকেরই নজর কেড়েছিল। বাংলাদেশের কিশোররা যে অসাধারণ কল্পনাশক্তির পরিচয় দিয়েছিল তাদের প্ল্যাকার্ডগুলোতে- সেখানে ঠাঁই হয়েছিল এই সুবোধেরও। একজনের হাতে ধরা প্ল্যাকার্ডে লেখা হয়েছিল, ‘সুবোধ এখন রাস্তায়’।

হ্যাঁ! সুবোধ তো ঐ কয়েকটা দিন রাস্তাতেই ছিল। সেই সুবোধগুলোকেও শেষপর্যন্ত ঘা খেয়ে পালাতে হয়েছে। কারণ “পাপবোধ (এখনও) নিশ্চিন্তে করছে বাস মানুষের হৃদয়ে।“ সুবোধকে তাই আবারও পালাতে হয়েছে। আর কত পালাবে সুবোধ? কবে আসবে সময় পক্ষে?
সময় পক্ষে আসতে পারে। সেজন্য সময়টাকে বুঝে নেওয়াটাও মনে হয় জরুরি। এই সময়ে এমন সমাজ-পরিবেশ কিভাবে গড়া যায় যেখানে সুবোধকে পালিয়ে বেড়াতে হবে না? সুবোধের ভাগ্যেই শিকে ছিঁড়বে? সব কিছু নষ্টদের দখল থেকে আবার ফিরে আসবে সুবোধের দ্বারে? মুক্তির নিশান-স্বরূপ সূর্যটা আবার খাঁচা থেকে মুক্ত করে দিতে পারবে সুবোধ? ভোরের অপেক্ষায় থাকা মোরগটা ডেকে উঠবে তীব্র স্বরে? সুবোধও তার কোলের পাশে বসে থাকা কিশোরী মেয়েটিকে বলবে, ভোর হয়ে গেছে রে পাখি! ও যে আকুল হয়ে জানতে চায়, “সুবোধ! কবে হবে ভোর?”
এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হলে আমাদের দিতে হবে নতুন দৃষ্টি। আর এখানেই আসে প্রিফিগারেটিভ পলিটিক্স বা প্রাক-রূপায়নের রাজনীতি প্রসঙ্গ। অচেনা দাগ বইয়ে এর ইতিহাস-ধারণা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন সেলিম রেজা নিউটন। “প্রিফিগারেটিভ পলিটিক্স বা প্রাক-রূপায়নের রাজনীতি: রাজনীতির অরাজপন্থা” (পৃষ্ঠা ১৭৭-১৮৬)। আগ্রহীরা অনলাইনে বসেই পড়তে পারেন এখান থেকে: https://goo.gl/zPRg1m
বিষয়টির মূল বক্তব্য হচ্ছে, যেরকম সমাজ আমরা কামনা করি, আকাঙ্ক্ষা করি—তেমন সমাজ নির্মানের লক্ষ্যে কর্মতৎপরতাটাও হতে হবে সেই কাঙ্ক্ষিত সমাজের আদলে। ১৯ শতকের অরাজপন্থী James Guillaume বলেছিলেন, “একটা কর্তৃত্বপরায়ন সংগঠন থেকে কিভাবে দেওয়া যেতে পারে সাম্য ও মুক্তির সমাজ গড়ার ডাক? এটা অসম্ভব।” ইতিহাসের পৃষ্ঠাগুলো তো এই কথারই সাক্ষ্য দিচ্ছে বারবার… বারবার। ২০১১ সালের অকুপাই মুভমেন্টে খুব বড় করে উঠেছিল এই প্রিফিগারেটিভ পলিটিক্স সংক্রান্ত কথাবার্তা। David Graeber দের লেখালেখি দিয়ে।
ভীষণরকমের কর্তৃত্বপরায়ন, পুরস্কার-তিরস্কার-বহিস্কারে মত্ত ও অভ্যস্ত; এমন সংগঠন থেকে শোনা যায় গণতন্ত্র-সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আহ্বান। দেশের সব রাজনৈতিক দল; সেটা ডানই হোক আর বামই হোক। যে বাদই হোক, যে তন্ত্রই হোক—সংগঠন বানানোর সময় প্রেসিডেন্ট-সেক্রেটারি লাগবেই। এমনকি পাড়ায় ১০ জন মিলে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা সমর্থকগোষ্ঠী কমিটি করলেও সেখানে থাকে প্রেসিডেন্ট-সেক্রেটারি। এই ফরম্যাটের বাইরেও যে কোনো সংগঠন হতে পারে— এই জিনিসটা যেন ভাবতেই পারি না আমরা।
নতুন সমাজটা যদি আমরা সাম্যেরই চাই, স্বাধীনতারই চাই—তাহলে এখনকার সংগঠনেও সেটা প্র্যাকটিস করব না কেন আমরা? প্র্যাকটিস করতে গিয়ে অনেক ভুল হবে; সেই ভুল থেকে শেখাও হবে — নতুন সমাজের রূপটা আরও মূর্ত হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা বামপন্থী ছাত্র সংগঠনে কতজন সদস্য থাকে? ৪০-৫০ জন সর্বোচ্চ? এই কয়জন মানুষ মিলে সম্মিলিতভাবে একটা সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় না?
যায়। ইচ্ছা থাকলে যায়। কিন্তু ইচ্ছাটাই বোধহয় হয় না কারও। কারণ ইচ্ছা হতে থাকলেই বেরিয়ে আসবে তাদের অনেক অজানা ইতিহাস। উঠতে থাকবে অনেক অপ্রিয় প্রসঙ্গ। সেগুলোর মুখোমুখিই হয়তো হতে চান না তারা। সংগঠনে কোনো কর্মী এসব কথা তুললেও তাই অনেককে পড়তে হয় বহিস্কারের মুখে। নিদেনপক্ষে তিরস্কারের মুখে। তিরস্কার শুনে যারা আবার সামলে নেন, লাইনে হাঁটেন—তাদের সামনে থাকে পুরস্কারের হাতছানি। এই করেই চলছে সংগঠনগুলো।
কিন্তু সুবোধের উপযোগী একটা সমাজ যদি আমরা গড়তে চাই; তাহলে আমাদের বেরোতে হবে এই চিরাচরিত চিন্তাভাবনাগুলো থেকে। করতে হবে নতুনের সন্ধান। পুরাতনকেও আবিস্কার করতে হবে নতুন করে। সুবোধ যেমন নতুন কিছু নিয়ে হাজির হয়েছে- তেমনি পরিবর্তনকামী প্রতিটি মানুষকে সক্রিয় হতে হবে। অন্ততপক্ষে চিন্তাভাবনার ক্ষেত্রে।
কেন্দ্রীয় একটা কমিটি, পদাধিকার বলে নেতা, নেতার হাতা, অনেকগুলো মুখের একজন পাত্র; (যিনি শুধু মাইকে হুমহাম করবেন আর আমাদের-মামুদের ইচ্ছেমতো ফুল-পাতা-পায়রা ওড়াবেন, মোম জ্বালাবেন) ইত্যাদি হওয়া ছাড়াও আন্দোলন-সংগ্রাম সংগঠিত হতে পারে। সফল আন্দোলন-সংগ্রাম হতে পারে। ২০০৮ সালে রাবিতে কর্তৃত্ববিরোধী শিক্ষার্থীবৃন্দ মঞ্চের কর্মী হিসেবে কাজ করার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা লাভের সৌভাগ্য হয়েছিল। সেই অভিজ্ঞতা থেকে জানি যে, একক কোনো নেতা বা নেতার বিশেষ ক্ষমতা বা কোনো কেন্দ্রীয় কমিটি ছাড়াও কিভাবে একটা আন্দোলন গড়ে উঠতে পারে এবং সেটা দারুণভাবে সফল হতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয়ে মুক্ত পরিসর তৈরি করতে পারে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এই আন্দোলন সম্পর্কে আগ্রহী হলে পড়তে পারেন: আগস্ট বিদ্রোহ।। মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় আন্দোলন : জরুরি পর্ব https://goo.gl/aVM26U

রাবির কর্তৃত্ববিরোধী মঞ্চের মূখ্য কিছু সংগঠক আগে থেকেই অরাজপন্থার ধারণার সঙ্গে পরিচিত ছিলেন। ফলে ২০০৮ সালের এই আন্দোলনটি ছিল বিকল্প কোনো পথে নামার সচেতন প্রয়াস। আর অচেতন প্রয়াসটা আমরা খুব সম্প্রতি দেখলাম কিশোর বিদ্রোহে। কিভাবে একটি কেন্দ্র না থেকেও, একক নেতৃত্ব তো দূরের কথা; দৃশ্যমান কোনো নেতৃত্ব না থেকেও কিভাবে রাজধানীর রাজপথ দাপিয়ে বেড়ানো যায়— সে শিক্ষাটা খুব দারুণভাবে দিয়েছে বাংলাদেশের কিশোররা। এবং এভাবে জনগণ সক্রিয় হয়ে উঠলে, জনগণ নিজের কাজের ব্যাপারে নিজে সচেতন হলে যে সব কিছু অনেক ভালোভাবে চলতে পারে—সেই শিক্ষাটাও দিয়েছে স্কুল-কলেজের ছেলেমেয়েগুলো।

এ প্রসঙ্গে পড়তে পারেন…
>> সবুজের অভিযান: সকল ক্ষমতা চাই শিশুদের কল্পনার হাতে (https://goo.gl/VvQteH)
>> রাস্তার পাঠশালায় চলে ‘এসো নিজে করি’ ক্লাস; বড়রা অংশ নেবে কি? (https://goo.gl/WnrsHu)
>> লাইসেন্স আছে?: কিশোর বিদ্রোহ যে বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখায় (https://goo.gl/JsVtjA)

এগুলো গেল খুব নিকট উদাহরণ। প্রত্যক্ষ উদাহরণ। পার্টি-পলিটিক্সের বাইরে স্বাধীন সংগঠন গড়ে ওঠার অজস্র নজির পৃথিবীতে দেখা গেছে। বহু প্রাচীনকালের সেসব ঐতিহাসিক উপাদানের উল্লেখ নাহয় তোলা থাকল। শিল্প-বিপ্লবের সময় থেকেও সমাজতান্ত্রিক রাজনীতির একেবারে শুরুর দিকেই অনেক আলাপ উঠেছিল কাঙ্ক্ষিত সমাজ ও তা রূপায়নের পদ্ধতি-কৌশল নিয়ে। সেসব ইতিহাসের গায়ে পড়া বহু বছরের ধুলো ঝাড়ার সময় বোধহয় চলে এসেছে। এ জায়গায় এসে আবারও সেলিম রেজা নিউটনের অচেনা দাগ বইয়ের “প্রিফিগারেটিভ পলিটিক্স বা প্রাক-রূপায়নের রাজনীতি: রাজনীতির অরাজপন্থা” (পৃষ্ঠা ১৭৭-১৮৬) এই অধ্যায়টির কথা উল্লেখ করছি। আগ্রহীরা অনলাইনে বসেই পড়তে পারেন এখান থেকে: https://goo.gl/zPRg1m

সুবোধ যেন আর পালিয়ে না বেড়ায়, সময়টা যেন সুবোধের পক্ষে আসে — সেই লক্ষ্যে কাজ করতে হবে সবাইকেই। এটা কোনো ভ্যানগার্ড, একক ব্যক্তি-সংগঠনের করে দিয়ে যাওয়ার বিষয় না। সুবোধের বোধ উদ্বোধনের সময় এখন। #হবেকি?

———————————————————————–
*** টি-শার্ট সম্পর্কিত ডিসক্লেইমার: সুবোধের এই গ্রাফিতিগুলোর আইডিয়া খুব বেশিমাত্রায় পছন্দ হওয়ায় দুইটা গ্রাফিতি দিয়ে মোট ৩০০ টি-শার্ট করার উদ্যোগটা আমি নিয়েছিলাম। কিছু বন্ধুর সঙ্গে মিলে সেগুলো বানানো হয়েছিল। এর পেছনে কোনো বাণিজ্যিক উদ্দেশ্য ছিল না। অধিকাংশ টি-শার্টই বিলানো হয়েছে বন্ধু-স্বজনদের মধ্যে। হ্যাঁ, শুরুতে এমন ভাবনা ছিল যে, যা খরচ হয়েছে- সেই টাকাটা যদি তুলে আনা যায়; তাহলে ভালো হয়। কিন্তু সেটাও শেষপর্যন্ত হয়নি। ১৫-২০ হাজার টাকা নিজের গাঁট থেকেই গিয়েছিল। এ নিয়ে অনেককে বলতে শুনেছি যে, টি-শার্ট বানিয়ে ব্যবসা হচ্ছে। সুবোধকে নিয়ে ব্যবসা হচ্ছে। আহত হয়েছিলাম। তাই এই লেখার সুবাদে এই কথাটুকু ডিসক্লেইমার আকারে দেওয়ার লোভ সংবরণ করতে পারলাম না। সুবোধকে নিয়ে ব্যবসা করার রুচি কখনো ছিল না, ভবিষ্যতেও আশা করি হবে না।

রাবি ছাত্রলীগ: মিউমিউ করা বিড়াল থেকে বাঘ হওয়ার ইতিহাস

র‍্যাব-পুলিশের মতো ছাত্রলীগেরও একটা মুখস্ত প্লট আছে। তারা শিবির প্রতিহত করতে যান। যেখানে-সেখানে তারা শিবির খুঁজে পান। এমনকি নিজেদের দলের মধ্যেও খুঁজে পান। ছাত্রলীগের মধ্যে কেউ কোনো আকাম করলে বলা হয় সেটা শিবিরের অনুপ্রবেশকারী।
———————–
র‍্যাব-পুলিশের ক্রসফায়ার গপ্পো মানুষ যেমন আর খাচ্ছে না, তেমনি ছাত্রলীগের এই ‘শিবির জুজ’ও আর খাওয়ার যোগ্য থাকছে না। সেজন্যই তারা এভাবে তোতলাচ্ছেন।
———————–

শিবির কী জিনিস দেখেছেন আপনারা? কোনোদিন গেছেন শিবির প্রতিহত করতে? শিবিরের স্বর্গখ্যাত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছি। শিবিরের রমরমার সময়। জীবনে কোনোদিন ছাত্রলীগকে শিবির প্রতিহত করতে যাইতে দেখি নাই। এখন তারা যেটা করছেন সেটা ক্ষমতার নির্লজ্জ আস্ফালন। এই জিনিস বেশিদিন টেকার না।
————————-
২০০৫ সালে ভর্তি হয়েছিলাম রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। তখন শিবিরের বিশাল বিশাল সব মিছিল দেখতাম। এ মাথায় দাঁড়ালে ও মাথা দেখা যাইত না। ক্লাস নিতে নিতে শিক্ষককে থেমে থাকতে হতো মিনিট দশেক। এখনকার এইসব লুটপাটের চেতনায় উদ্বুদ্ধ ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা সম্ভবত সেসব দেখেননি।
তো, সেই শিবির রাজত্বে ছাত্রলীগ ছিল বিড়ালের মতো। মিউমিউ করত। এখনকার ক্ষুদ্র কোনো বাম ছাত্র সংগঠন যে অবস্থায় আছে- ছাত্রলীগের অবস্থাও কমবেশি একই রকম ছিল। শিবিরের সঙ্গে গ্যাঞ্জাম কিছু হলে, সেটা হতো ছাত্রদলের।
কিন্তু রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় সেসময় সাংস্কৃতিকভাবে ছিল প্রচণ্ড তৎপর। প্রাণবন্ত-উচ্ছল একটা পরিবেশ ছিল ক্যাম্পাসের। প্রতি সপ্তাহেই এখানে-ওখানে হতো পথনাটক। শহীদ মিনারে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। সভা-সেমিনার; পত্র-পত্রিকা, গান-আড্ডায় মুখর থাকত বিশ্ববিদ্যালয়। শিক্ষার্থীদের স্বাধীনতার পরিসরটা ছিল অনেক বড়। যার ছিটেফোটাও কিছু নেই এখন মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ সরকারের আমলে।
—————————
এরপর আসল ২০০৭ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকার। এখনকার ছাত্রলীগ নেতারা, যে নেত্রীর নাম নিতে নিতে, মহামান্য বলতে বলতে মুখে ফেনা তুলে ফেলেন- সেই শেখ হাসিনা কারাবন্দী হয়েছিলেন। তাদের আরও অনেক নেতা গিয়েছিলেন গারদের ওপাশে। কিন্তু ছাত্রলীগের কোনো নেতাকর্মীকে আওয়াজ তুলতে দেখিনি। আওয়াজ কি— তারা ছিলেনই না অত্র অঞ্চলে।
এরপর আগস্ট বিক্ষোভ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রেপ্তারকৃত শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মুক্তির দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলনে তাদের কেউ কেউ যোগ দিয়েছিলেন সাধারণ শিক্ষার্থীদের তৈরি করা পাটাতনে।
আমরা, বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীরা- যারা বন্ধুত্বের সূত্রে, রাজনৈতিক চিন্তা-চর্চার সূত্রে সংগঠিত হয়েছিলাম, তারাই আওয়াজ তুলেছিলাম সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অনায্য-অগণতান্ত্রিক কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে। ছাত্রলীগের কেউ কেউ আমাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন মাত্র।
————————-
ছাত্রলীগ নামের এই বিড়ালটা দুম করে গায়ে ডোরাকাটা দাগ কেটে বাঘ হয়ে গেল ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের পর। সেই ‘ভোট বিপ্লবের’ চেতনীয় জোশে তারা মারামারি বাধিয়ে দিলেন শিবিরের সঙ্গে। কারণ তখন তাদের জানাই ছিল যে, পুলিশ তাদের সঙ্গে আছে। প্রকাশ্যে অস্ত্র নিয়ে ঘুরলেও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তাদের কিছু বলবে না। অনেক ক্ষমতার বলে বলিয়ান হয়ে তারা শিবির প্রতিহত করতে গেলেন!!!
————————-
ছাত্রলীগের কাছে ব্যাপারটা ছিল শুধুই ক্যাম্পাসে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার। শিবির প্রতিহত করার নামে সেসময় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন জারি করেছিল নয়া জরুরি অবস্থা। নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল সব ধরণের স্বাধীন তৎপরতার বিরুদ্ধে। সভা-সেমিনার-মিছিল-সমাবেশ-লিফলেট সব বন্ধ।
অন্যদিকে ছাত্রলীগকে দেওয়া হয়েছিল অবাধ স্বাধীনতা। কোমড়ে অস্ত্র গুঁজে প্রক্টরের সঙ্গে হাঁটা শুরু করেছিলেন ছাত্রলীগ নেতারা। সেই যে শুরু… ২০০৯ সালের দিক থেকে… তারপর থেকে সেভাবেই প্রশাসনের ছত্রছায়ায়-প্রশ্রয়ে দানব হয়ে উঠেছে ছাত্রলীগ। আরও বিস্তারিত জানার আগ্রহ থাকলে পড়তে পারেন: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ফ্রাংকেনস্টাইন’ কাহিনী

—————————-
কিন্তু শিবির কি প্রতিহত করতে পেরেছে তারা? ২০১৩ সালে গণজাগরণ মঞ্চের শুরুর দিকে যখন পুরো দেশ কেঁপে কেঁপে উঠছিল- তখন অভিভাবকশূণ্য হয়ে পড়ছিল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। শিবির সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করছিলেন সেসময়ের কর্মকর্তা-হর্তাকর্তারা। তারা ভয়ে ছিলেন। আরও বিস্তারিত জানার আগ্রহ থাকলে পড়তে পারেন: কেমন আছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়?

তো, এই হলো তাদের শিবির প্রতিহত করার নমুনা। এই হচ্ছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেক্ষিতে গত এক যুগে ছাত্রলীগের ইতিহাস। মিউমিউ করা বিড়াল থেকে বাঘ হয়ে ওঠার ইতিহাস।
—————————-
বিশ্ববিদ্যালয়ের সুষ্ঠ পরিবেশ, জ্ঞানচর্চা, তর্ক-বিতর্ক, গান-্আড্ডার পরিবেশ তৈরি হতে পারে শুধুমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীদের মুক্ত-স্বাধীন তৎপরতার মাধ্যমে। শিক্ষার্থীরা যত বেশি কথাবার্তা বলবেন, নানাবিধ তৎপরতার সঙ্গে যুক্ত হবেন- তত বাড়তে থাকবে স্বাধীনতার পরিসর। কমতে থাকবে দানবদের দৌরাত্ম।

বিশ্ববিদ্যালয় সংক্রান্ত আরও লেখাপত্র

মুক্ত-বিশ্ববিদ্যালয় নাকি মুক্ত-বাজার?

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা… শিখব কি?

কলিম খানের প্রতি শ্রদ্ধা ও তাঁর বইয়ের হদিশ

মানুষের মৃত্যু দুই ধাপে হয়। প্রথমটা শরীরের। প্রানটা বেরিয়ে যায়। দ্বিতীয়বারের মৃত্যুটা হয় স্মৃতিতে… যিনি যত পুণ্য সঞ্চয় করেন, তিনি জনমানসে ততদিন বেচে থাকেন। যার পুণ্য কম, তিনি দ্রুতই মিলিয়ে যান বিস্মৃতির অতলে…

গত ১১ জুন পরলোকে চলে যাওয়া কলিম খান আমাদের ভাবিয়েছেন। খুব কম লেখক-চিন্তকই এভাবে ভাবাতে পারেন।

ভদ্রলোকের শারিরিক মৃত্যু হয়েছে… কিন্তু তাকে আমরা বাচিয়ে রাখতে পারি। আমাদের চিন্তা-কর্ম দিয়ে। তার রচনা পাঠ করার মাধ্যমে। সেটাই বোধহয় উচিত হবে। এতো দ্রুত তাকে মরতে দেওয়াটা ঠিক হবে না… আপনার পুন্য এতো কম না কলিম খান…

এই কথাগুলোও তো আপনারই ভাবনাপ্রসুত…

অনলাইনে কলিম খানের গ্রন্থগুলো পাওয়া যাবে এখানে


কলিম খানের মৃত্যু সংবাদ জানিয়ে Subhasis Chirakalyan Patra ফেসবুকে লিখেছিলেন:

গভীর দুঃখের সঙ্গে জানাই যে, ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক শব্দার্থবিধির অন্যতম রূপকার, বঙ্গীয় শব্দার্থকোষের অন্যতম প্রণেতা, ভাষাবিদ ও দার্শনিক কলিম খান আর আমাদের মধ্যে নাই। কিছুদিন যাবৎ তিনি দুরারোগ্য রক্তের ক্যান্সারে (AML) ভুগছিলেন।
আজ (১১.০৬.২০১৮) রাত ৮টা ৫৫ মিনিটে কলকাতার বাঁশদ্রোণী এলাকায় নিজের বাসভবনে তিনি প্রয়াত হয়েছেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৬৮ বছর।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও সুকুমার রায় ছাড়া আর যে বাঙালী লেখক আমার মনকে গভীরভাবে আলোড়িত ও আপ্লুত করতে সক্ষম হয়েছিলেন তিনি কলিম খান। তাঁর কাছ থেকেই আমি বুঝতে শিখেছি শব্দার্থের দর্শন, প্রাচীন ভারতের ইতিহাস ও ভারতীয় দর্শনকে। তিনি যে কাজের সূচনা করে গেলেন সেই কাজকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব আমাদের সকলের। তাঁর মৃত্যুতে আমি হারালাম আমার এক পথপ্রদর্শক, সুহৃদ এবং অত্যন্ত শ্রদ্ধেয় ও প্রিয় মানুষকে। তাঁকে আমার অন্তরের প্রণতি জানাই।

আইসল্যান্ডের ইতিহাসে পুলিশের গুলিতে মারা গেছেন মাত্র একজন!

আইসল্যান্ড নামটা উচ্চারিত হচ্ছে বেশ। প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ খেলতে এসেই তাঁরা চোখ ধাঁধিয়ে দিয়েছে অনেকের। ছোট্ট এই দ্বীপটির সামাজিক রীতি-নীতিও চোখ ধাঁধানো। অন্তত আমাদের চোখ তো ধাঁধিয়েই যাওয়ার কথা, যারা প্রতিদিন অসংখ্য বন্দুকযুদ্ধ-হত্যা-গুম-খুন দিয়ে অভ্যস্ত হয়ে গেছি।
———————————————————————–


২০১৩ সালের ডিসেম্বরে অদ্ভুত ধরণের একটা সংবাদ শিরোনাম দেখেছিল আইসল্যান্ডবাসী। ‘পুলিশের গুলিতে এক ব্যক্তি নিহত’। সত্যিই অবাক হয়ে গিয়েছিল আইসল্যান্ডের মানুষ। কারণ ১৯৪৪ সালে স্বাধীনতা অর্জনের পর এমন ঘটনা ঘটেছিল সেবারই প্রথমবারের মতো।

আইসল্যান্ডিক ন্যাশনাল ব্রডকাস্ট সার্ভিসের নিউজ এডিটর Thora Arnorsdottir বলেছিলেন, ‘পুরো দেশ থমকে গিয়েছিল। এমনটা আমাদের দেশে কখনো ঘটেনি।’ সেই ঘটনায় শোক পালন করা হয়েছিল জাতীয়ভাবে।

২০১৩ সালের ডিসেম্বরে পুলিশের গুলিতে মারা গিয়েছিলেন ৫৯ বছর বয়সী এক বৃদ্ধ। পত্রপত্রিকার খবরে জানা যায়, তিনি কিছুটা মানসিক ভারসাম্যহীন অবস্থায় ছিলেন। পুলিশকে নিজের বাড়িতে ঢুকতে দেখে তিনিই আগে গুলি চালিয়েছিলেন। পরে পুলিশও আত্মরক্ষার্থে গুলি চালালে তিনি নিহত হন। সেই ব্যক্তির প্রতিবেশীরা এই অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেছিলেন যে, তাঁরা যেন হলিউডের কোনো চলচ্চিত্রের দৃশ্য দেখছেন। কারণ এমন দৃশ্য তাঁরা শুধু টেলিভিশনের পর্দাতেই দেখে অভ্যস্ত। তারপর থেকে এমন ঘটনা আর কখনো ঘটেওনি। সেটাই প্রথম, সেটাই শেষ।

ছোট্ট দেশ আইসল্যান্ডে সহিংস ঘটনা সেভাবে ঘটেনা বললেই চলে। পুলিশও সাধারণত নিজেদের কাছে কোনো অস্ত্র রাখে না। Arnorsdottir বলছিলেন, ‘আমাদের দেশে আমরা চাই না যে, পুলিশ কোনো অস্ত্র বহন করুক। কারণ এটা বিপদজনক। এটা অন্যদের জন্য হুমকির কারণ। এটা আমাদের সংস্কৃতির অংশ না। বন্দুক অনেকে ব্যবহার করে শিকারের জন্য। কিন্তু এছাড়া আপনি কোথাও বন্দুক দেখবেন না।’

সেদিনের সেই ঘটনার সঙ্গে জড়িত পুলিশ কর্মকর্তাদের পরবর্তীতে যেতে হয়েছিল মনোবিদদের কাছে। অনুশোচনা করার জন্য। পুলিশ বিভাগ সঙ্গে সঙ্গেই ক্ষমা চেয়েছিল মৃত ব্যক্তির পরিবারের কাছে। এত কিছু তারা করেছিল এটা জেনেও যে, তারা কোনো দোষ করেনি।

কেন এত বিচলিত হয়ে গিয়েছিল দেশটির পুলিশ সদস্যরা? কারণটা জানিয়েছেন Arnorsdottir, ‘এটা শ্রদ্ধা জানানোর বিষয়। কারণ এখানে কেউই আরেকজন ব্যক্তির প্রাণ হরণ করতে চায় না।’

কেন পুলিশ গুলিতে নিহত সেই মানুষটির অনুমতি না নিয়েই তাঁর বাড়িতে প্রবেশ করেছিল- এ নিয়েও আলাপ উঠেছিল বিস্তর। হয়েছিল তর্ক-বিতর্ক। কেন পুলিশ সেটা করেনি, তেমন একটা অনুমানও দাঁড় করিয়েছেন Arnorsdottir। যা থেকে দেশটির স্বাধীনতা চর্চার পরিধি সম্পর্কেও একটা ভালো ধারণা পাওয়া যায়।

তিনি বলেছিলেন, ‘এই দেশে থাকার একটা দারুণ মজার ব্যাপার হলো আপনি যে কোনো জায়গায় যেতে পারবেন। এমনকি পার্লামেন্টেও। সেখানে ঢোকার সময় আপনাকে শুধু একটা ছোট্ট অনুরোধ করা হবে। মোবাইলটা বন্ধ করা। যেন সংসদ সদস্যদের কার্যক্রমে কোনো বিঘ্ন না ঘটে। আমাদের এখানে প্রধানমন্ত্রী বা প্রেসিডেন্ট সবসময় সশস্ত্র দেহরক্ষী নিয়ে ঘোরেন না। শান্তির এই সমাজে এটা একটা দারুণ ব্যাপার। আমরা এটা পরিবর্তন করতে চাই না।’

কোনটা মাদক, কোনটা না? বাজারের বিবেচনা!

মাদকবিরোধী অভিযান চলছে। কিন্তু কোনগুলো মাদক আর কোনগুলো না- সেগুলো নিয়ে কোনো আলাপ হচ্ছে?

মাদক কী আসলে? যা নেশা তৈরি করে- সেগুলো মাদক? নেশা তো অনেক রকম আছে। ফেসবুকে ঘন্টার পর ঘন্টা স্ক্রল করে যাওয়া, ভার্চুয়াল বন্ধুদের সাথে গল্পগুজব করা- এ-ও তো নেশা। সমাজবিজ্ঞানী-মনোবিজ্ঞানীরা এ নিয়ে গবেষণা করছেন। কথাবার্তা বলছেন (https://goo.gl/dSrN1p)। টাকা কামানো, ক্ষমতা দখল- এগুলোও নেশারই মতো। এগুলো নিয়ে আলাপ হবে না?

আচ্ছা ওগুলা বাদ। মদ-ভাঙ-গাঁজা-তারি-সিগারেট-ইয়াবা-হেরোইন-কোকেন; এগুলো নিয়েই আলাপ হোক তাহলে।

বঙ্গ অঞ্চলের মানুষ প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে তালের তাড়ি, গাঁজা-ভাঙ, ভাত পচানো চোলাই- ইত্যাদি খেয়ে আসছে। এত সামাজিক অবক্ষয়, বিকারগ্রস্থ অবস্থা হয়নি তো কখনো। বরং তালের তারির অনেক উপকারের কথাই শুনেছি বয়োবৃদ্ধদের কাছ থেকে। সাম্প্রতিক সময়ে তো দেখা যাচ্ছে বর্জ্রপাত থেকে বাঁচার জন্য বেশি বেশি করে তালের গাছ লাগানোর পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।

গাঁজার ক্ষেত্রেও কমবেশি একই কথা প্রযোজ্য। গাঁজার চল চলে আসছে অনাদিকাল থেকে। সেই শিবঠাকুরের সময় থেকে। এখনও এই উপমহাদেশের অনেক জায়গায় গাঁজা খাওয়ার সঙ্গে আধ্যাত্মিক চর্চার একটা যোগ আছে। গাঁজা বৈধ করার দাবিতে ইউরোপ-আমেরিকার বিভিন্ন জায়গায় ঘোর আন্দোলন হচ্ছে। কোথাও কোথাও তো সেটা বৈধ করাও হয়েছে।

গাঁজা, তালের তারি, চোলাই- এগুলো নিয়ে কোনো রাখঢাকও ছিল না কখনো। লুকোছাপার কোনো ব্যাপার ছিল না। এগুলোকে কেউ দোষ বলেও মনে করত না। কবে থেকে এগুলোর গায়ে মাদকের ছাপ্পা লাগল? অনুসন্ধান করা দরকার।

সহজ বুদ্ধিতে যেটা বুঝতে পারি তা হলো: যখনই দেখা যায় এগুলো দিয়ে ব্যবসা করা সম্ভব না তখনই সেগুলোর বিরুদ্ধে খড়্গহস্ত হয় এই পুঁজিবাদী সমাজ। কারণ তালের গাছ তো বাড়ির পাশেই হয়। সেটা তো আর দোকান থেকে কিনতে হচ্ছে না। ফলে ব্যবসার সুযোগ কই? গাঁজার ক্ষেত্রেও একই কথা।

এগুলো খেয়ে কেউ শারীরিক অসুস্থতার শিকার হন- এমন কথাও প্রায় শোনা যায় না বললেই চলে। বরং ভালোমতো অনুসন্ধান করলে এগুলোর হাজারো উপকারিতাই বেরিয়ে আসার সম্ভাবনা আছে।

আচ্ছা… এবার মদ-সিগারেট-হিরোইন-ইয়াবা-কোকেনের প্রসঙ্গে আসা যাক। শুরুতেই এই সব কিছুর মধ্যে একটা মিল চোখে পড়ে। এই সব কিছুই উৎপাদন করার ব্যাপার। পুঁজিপতিদের পুঁজি লগ্নি আর মুনাফা কামোনোর ব্যাপার। কৃত্রিম এই নেশাগুলো এই বাংলার মাটিঘনিষ্ঠও না। বর্হিদেশীয় উৎপাদ-উৎপাত।

হিরোইন-কোকেন-ইয়াবা তো খুব বেশিদিন হয়নি এই বঙ্গ সমাজে আমদানি হয়েছে। ইয়াবা তো আসল সেই সেদিন। মেরেকেটে ১০-১৫ বছর হয়তো হবে খুব বেশি হলে। সেই ইয়াবারই এখন কী রকরমা! ইয়াবাসহ হিরোইন-কোকেন ইত্যাদি প্রভৃতি সব কৃত্রিম, কারখানায় বানানো বিকারগ্রস্থ নেশারই আগমন ইতিহাস খুব অল্প সময়ের মামলা।

লক্ষ্য করার মতো বিষয় যে, সবগুলোরই আমদানি ঘটেছে কিন্তু বড়লোকদের হাত ধরে। ‘বড় বাপের পোলারা’ ফুর্তি করার জন্য, ‘ডিফারেন্ট কিছু ট্রাই’ করার জন্য এসব শুরু করে। খুব সম্প্রতি ইয়াবার বঙ্গে আবির্ভাবের ইতিহাস ঘাঁটলে তা ভালোমতোই বুঝতে পারা যায়।

থাইল্যান্ড-ইন্দোনেশিয়া থেকে অনেক অর্থের বিনিময়ে ইয়াবা প্রথমে ঢুকেছিল বড়লোকদের ফুর্তিখানায়। সেখান থেকেই বিস্তার-বিস্তৃতি। আর এখন গ্রামেগঞ্জে ২০০-৩০০ টাকা দিয়েও পাওয়া যায় ইয়াবার প্যাকেজ। কিভাবে সম্ভব হলো? বিকৃত একটা জিনিশের আরও নানা বিকৃতি ঘটিয়ে, নিম্নমানের কেমিক্যাল মিশিয়ে বাজারে ছাড়া হলো মধ্যবিত্ত-নিম্ন মধ্যবিত্তদের জন্য।

আচ্ছা… এবার সমাজের বৈধ আর উপরিভাগে থাকা বহুল প্রচলিত দুটির নেশার প্রসঙ্গ। সিগারেট আর মদ। এগুলো ক্ষতিকর দিক নিয়ে আর নতুন করে বলার কী আছে। সবাই সব জানি-বুঝি। তারপরও সেগুলো বৈধ কেন? সেগুলো নিয়ে কথাবার্তা নেই কেন? কারণ সেগুলো বাজারে বিকোনো যায়। সেগুলো নিয়ে ব্যবসা করা যায়।

তালের তারি-গাঁজা ছোটলোকের জিনিস বলে সেগুলোর ওপর স্টিমরোলার চালাব! আর মদ-সিগারেট বড়লোকদের জিনিস বলে সমাজে বুক ফুলিয়ে চলতে থাকবে!

বারে গিয়ে গলা অব্দি মদ খেয়ে মাতলামো করবো! কোনো সঙ্কোচ হবে না। বরং বুক ফুলিয়ে গল্প করব যে, বোতলটা কোন দেশ থেকে ইনটেক এসেছিল! এক বোতলের দাম কত হাজার টাকা! আর গাঁজা খাবো চিপা-চুপায় গিয়ে! কেউ দেখে ফেললে? প্রেস্টিজ পাংচার। ছিঃ গাঁজাখোর!

আর কতো হিপোক্রেসি করব আমরা?

 

‘প্রশ্ন করো সব কিছুকেই’- কেন?

কী ছিল জিনিসটা? কিছু শব্দতরঙ্গ?! কিছু ধ্বনি, কিছু শব্দ, কিছু চিৎকার, কিছু আর্তনাদ?! ‘আব্বু, তুমি কানতেছো যে’- বুক চিরে দেওয়া এই প্রশ্ন আর নিজের মৃত্যু-নিয়তি জেনে ফেলা এক বাবার নির্মম অসহায়ত্ব ফুটে উঠেছিল যে শব্দতরঙ্গগুলোতে, তা আসলে আরও অনেক কিছু ছিল।

১৪-১৫ মিনিটের ফোন রেকর্ডিং অডিওটা মানুষের কানে যেন বিষ ঢেলে দিয়েছে। সেই বিষ কারো হৃদয়ে রক্তক্ষরণ ঘটাচ্ছে, কারো মাথায় আগুন ধরিয়ে দিচ্ছে। নিদেনপক্ষে বলা যায়, অগ্রাহ্য করতে পারছেন না কেউই। রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসী বাহিনীর প্রতিটা ক্রসফায়ার-এনকাউন্টারের গল্পই যে কমবেশি এমন- সেটা এতদিন ছিল ওপেন সিক্রেট। কাউন্সিলর একরাম হত্যার অডিওটা সিক্রেসির চাদরটা সরিয়ে দিয়েছে পুরোপুরি।

ফলে জিনিসটা অগ্রাহ্য করা সত্যিই কঠিন হচ্ছে। আমাদের পিঠ দেয়ালে ঠেকিয়ে দিয়েছে অডিওটা। এমন ঘটনা গত কয়েক বছর ধরেই অনেক ঘটে গেছে। নানা কারণে সেগুলো নিয়ে তেমন সোরগোল হয়নি। কিন্তু এবার লক্ষ্য করা যাচ্ছে একধরণের গণ-চৈতন্য জাগ্রত হওয়ার মতো বিষয়। মানুষ কথা বলতে শুরু করেছেন।

কথা না বলে আর থাকা যাচ্ছে না আসলে। আমাদেরকে মনুষ্যত্বের শেষ সীমায় এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে একরাম হত্যার অডিওটা। এরপরও কথা না বললে নিজেদের মনুষ্য সত্ত্বাটাই আর থাকে না মতো অবস্থা। প্রবল সরকারপন্থী হিসেবে পরিচিত- এমন ১০ বিশিষ্ট নাগরিকও ক্রসফায়ারের নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন।

আর এই কথাবার্তা একবার যখন উঠেছে, তখন তা আরও বেশি করে হওয়া দরকার। শুধু বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডেরই বিরোধীতা করব নাকি সবধরণের হত্যাকাণ্ডেরই বিরোধীতা করব? সমাজের প্রতিটি পর্যায়ে, পদে পদে যে নীতিহীনতা, দুর্নীতি, লুটতরাজ, সন্ত্রাস, সাধারণ মানুষের সীমাহীন ভোগান্তি- এ থেকে উত্তরণের পথ কি? সব কিছু নিয়ে প্রশ্ন তুলতে শুরু করা দরকার। এক এক করে পরীক্ষা দেব, এক পরীক্ষার সময় অন্য পরীক্ষার উত্তর লিখব না- এই ধরণের যুক্তিপদ্ধতি আসলে কাজের কিছু না। দেখাই গেছে হাতেনাতে।

সব কিছুই আসলে সব কিছুর সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। ধর্ষণ কেন হয়, ক্রসফায়ারের নামে রাষ্ট্রীয় হত্যা কেন হয়, ৫ম শ্রেনীর সমাপণী পরীক্ষার প্রশ্নপত্রও কেন ফাঁস হয়, ব্যাংক থেকে কোটি কোটি টাকা কিভাবে ঋণের নামে হাপিশ হয়ে যায়, রানা প্লাজা-তাজরিন গার্মেন্টস কেন ধ্বসে পড়ে-আগুনে কয়লা হয়, বিশ্বজিৎ-এর ওপর কেন প্রকাশ্য দিবালোকে চাপাতির কোপ নেমে আসে, পাহাড়ে-সমতলে আদিবাসী-সংখ্যালঘুদের ঘরবাড়ি কেন পুড়িয়ে দেওয়া হয়, সুন্দরবন কেন ধ্বংসের পথে যায়, সরকার কেন ক্রমশ স্বৈরাচারী হয়ে ওঠে ইত্যাদি প্রভৃতি নানা প্রশ্নই আসলে একে অপরের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। কোনোটাকে এগিয়ে কোনোটার সমাধান সম্ভব না।

ক্রসফায়ারে হত্যার প্রতিবাদে শুধু একদিনের প্রতিবাদ সমাবেশ করার চেয়ে বরং এই কথাবার্তাগুলোই বেশি করে আলাপ হওয়া দরকার। কী ধরণের সমাজ চাই? সেটা কেন চাই? কিভাবে সেখানে পৌঁছানো যাবে বা সেই পথে হাঁটা শুরু করা যাবে- এ জাতীয় প্রচুর প্রশ্ন তোলা দরকার। আলাপ-আলোচনা করা দরকার।

প্রশ্ন তুলতে শুরু করা উচিৎ সব কিছু নিয়ে। ‘প্রশ্ন করো সব কিছুকেই’। এই বাক্যকেও প্রশ্ন করে বলব, ‘কেন?’ কে জানে! উত্তরও হয়তো লুকিয়ে আছে এই ‘কেন’-র মধ্যে।

বিপ্লব মানে আনন্দ, বিপ্লব মানে ‘টোটাল অর্গাজম’!‍

আহ! কী অদ্ভুত এক সময়ই না কাটিয়েছেন প্যারিসের মুক্তিকামী মানুষেরা। ৫০ বছর আগে, ঠিক এই সময়টাতেই স্বপ্নের এক সমাজ গড়ার নেশায় বুঁদ হয়ে ছিলেন লাখো মানুষ। ছাত্র-শ্রমিক-জনতা, এক কাতারে দাঁড়িয়ে ভাঙতে চেয়েছিলেন পুরোনো অনড়-অনায্য-অসাম্যের ঘুনে ধরা সমাজটাকে। গড়তে চেয়েছিলেন নবতর ভবিষ্যত। যেখানে সাম্যের প্রতিশ্রুতি ছিল। স্বাধীনতার প্রতিশ্রুতি ছিল।

বিপ্লব-বিদ্রোহের এক বাঁধভাঙা জোয়াড় খুলে দিয়েছিল সৃজনশীলতা, কল্পনাপ্রতিভার দ্বার। অসাধারণ সব কাব্যিক স্লোগান-গ্রাফিতিতে জীবন্ত হয়ে উঠেছিল ১৯৬৮ সালের প্যারিস। ‘সব ক্ষমতা চাই কল্পনার হাতে’ – এই স্লোগানটি থেকেও বুঝতে পারা যায়, ফ্রান্সের তরুণ সেই প্রজন্ম কল্পনাশক্তি আর সৃজনশীলতার বিকাশকে কতটা গুরুত্ব দিয়েছিলেন। তাঁরা বলেছিলেন, ‘ক্রিয়া যেন স্রেফ প্রতিক্রিয়া না হয় – ক্রিয়া মানে সৃজনক্রিয়া’।

তাঁরা বলে দিয়েছিলেন, ‘মানা করা নিষেধ’! এমন কোনো বিধিনিষেধ দেওয়া যাবে না, যা কল্পনার ডানা ছেঁটে দেয়, সৃজনশীলতার পায়ে বেড়ি পড়ায়। ৬৮-র সেই ফরাসী তরুণ প্রজন্মের উদাত্ত আহ্বান ছিল, ‘যা কিছু শিখেছ ভুলে যাও, শুরু করো তোমার স্বপ্নের হাত ধরে’।

আর তাঁরা সেই কাঙ্ক্ষিত স্বপ্নের সমাজ গড়তে চেয়েছিলেন ‘প্রেমে আর প্রেমে; প্রতিবাদে-প্রতিরোধে’**। উপলব্ধি করেছিলেন যে, ‘যত বেশি আমি প্রেম করি, তত বেশি আমি রচনা করতে চাই বিপ্লব; আর যত বেশি আমি রচনা করি বিপ্লব, তত বেশি আমি প্রেম করতে চাই।’

সর্বোপরি ১৯৬৮ সালের প্যারিস বসন্ত তুলেছিল আনন্দের অধিকারের দাবি। জীবনের সুখ আস্বাদনের আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করেছিলেন প্যারিসের শিক্ষার্থীরা। শুধু শাসন-শোসন দিয়েই না, বুর্জোয়া শাসকশ্রেণী যে মানুষের সুখহরণ করছে, সেটা খুব স্পষ্টভাবে বলেছিলেন প্যারিস বসন্তের তরুণরা, ‘সমস্ত সুখের বারোটা বাজানো ছাড়া বুর্জোয়াদের অন্য কোনো সুখ নেই।’

সাম্য-স্বাধীনতার দাবি তুলে আসলে সুখময়, আনন্দে পূর্ণ এক জীবনযাপনের আহ্বান এসেছিল ৫০ বছর আগের প্যারিস থেকে। স্বপ্নাতুর সেই প্রজন্মের কাছে ‘সুখ একটা নতুন আইডিয়া’ ছিল। তাঁরা ঘোষণা করেছিলেন, ‘স্থায়ী সুখের অবস্থা’। কমিউনিস্ট মেনিফেস্টোর আদলে তাঁরা লিখেছিলেন, ‘দুনিয়ার মজদুর- আনন্দ করো!’ ’একঘেঁয়েমি ছাড়া আমাদের হারাবার কিছুই নেই – জয় করবার জন্য রয়েছে আস্ত এক আনন্দ-পৃথিবী।’

সুখ, আনন্দ! এই-ই তো আসলে মানুষের আত্মিক আকাঙ্ক্ষা। আমরা যেন তা ভুলতেই বসেছি। তাই বারবার মুগ্ধ দৃষ্টি ফিরে যায় ৬৮-র প্যারিস বসন্তের দিকে। কী দুর্দান্তভাবেই না তারা বলেছিলেন এই মর্মকথাগুলো। পুরো বিশ্বের মানুষকে এক আনন্দময় পৃথিবীর স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন, এখনও দেখাচ্ছেন।

প্যারিস বসন্তের তরুণ প্রজন্ম ছুঁড়ে ফেলতে চেয়েছিল একঘেঁয়ে জীবনের জঞ্জালকে। ঘোষণা করেছিলেন, ‘এমন পৃথিবী আমরা চাই না যেখানে ক্ষুধায় না মরার গ্যারান্টি পেতে গিয়ে একঘেঁয়েমিতে মরার ঝুঁকি তৈরি হয়।’ তাঁরা বাঁচতে চেয়েছিলেন প্রতি মুহূর্তে। বলেছিলেন, ‘বাঁচার অধিকার চেয়ে বেড়ায়-ও না – বাঁচতে শুরু করো।’

তাঁরা চেয়েছিলেন উত্তেজনা, রোমাঞ্চ, অ্যাডভেঞ্চারে পরিপূর্ণ এক জীবন। আর যখন তাঁরা দেখেছিলেন যে, পুরোনো সমাজটা এসবের কিছুই করতে দেবে না তখন তাঁরা লিখেছিলেন, ‘সকল প্রকার অ্যাডভেঞ্চার বিলুপ্ত করেছে যে সমাজ, একটাই যে অ্যাডভেঞ্চার তার বাকি আছে তা হলো এই সমাজটাকেই বিলুপ্ত করে দেওয়া।’

কোনো মহান কেউ এসে এমন স্বপ্নের একটা সমাজ গড়ে দিয়ে যাবে, এমন ভাবনাও প্রত্যাখ্যান করেছিল প্যারিস বসন্ত। তারা আগেই বলে দিয়েছিল, ‘আমাকে মুক্ত করতে এসো না – তার ব্যবস্থা আমি নিজেই করব’। বিপ্লব-বিদ্রোহটা তাদের কাছে ছিল নিজ নিজ উপলব্ধির প্রশ্ন। তাই তারা উচ্চারণ করেছিলেন, ‘বিপ্লবের মালিক কোনো অমুক কমিটি-তমুক কমিটি নয় – বিপ্লব তোমার’। কমিটি গড়ার আহ্বানও অবশ্য ছিল, ‘গড়ে তোল স্বপ্ন দেখা কমিটি’! তাঁদের কাছে ‘স্বপ্ন থেকে বাস্তবে পৌঁছানোর সক্রিয় রাস্তাটুকুই [ছিল] বিপ্লব’।

আবার শুধু আত্মত্যাগ আর বলিদান দেওয়ার সেকেলে বিপ্লবের ধ্যানধারণাতেও আস্থা রাখতে পারেননি, বিশ্বাস স্থাপন করতে পারেননি প্যারিসের তরুনরা। তারা চেয়েছিলেন বিপ্লবের প্রতিটি মুহূর্ত উদযাপন করতে। বলেছিলেন, ‘যে বিপ্লবের জন্য দরকার আমাদের আত্মবলিদান তা আসলে আব্বুদের বিপ্লব।’ আকাঙ্ক্ষিত সমাজ আর সেই সমাজ বাস্তবে রূপ দেওয়ার লড়াই; উভয় ক্ষেত্রেই গৎবাঁধা সব ধ্যানধারণা বিসর্জন দিয়েছিল প্যারিস বসন্ত।

উদ্ধৃতিচিহ্নের মধ্যে থাকা প্রায় সব বাক্যই নেওয়া হয়েছে সেলিম রেজা নিউটনের অচেনা দাগ বইয়ের ‘বন্ধুত্ব-বসন্ত-বিপ্লব: প্যারিস থেকে শাহবাগ’ শীর্ষক অংশ থেকে। নিউটনের লেখার কিছু অংশ নিয়েই ইতি টানি।

“খোদ বিপ্লব সংক্রান্ত মুখস্থ-যান্ত্রিক-ছকবাঁধা চিন্তাপ্যারেডের পক্ষীবুলিকে বদলে দিয়েছিল প্যারিস বসন্ত। বদলে দিয়েছিল খোদ বিপ্লবের কমনসেন্স। আমরা কি কোনোদিন ফিচেল বা রাশভারি কোনো পার্টি আমলার মুখে ভুলেও শুনেছিলাম যে বিপ্লব মানে আনন্দ? হ্যাঁ। বিপ্লব মানে আনন্দ। বিপ্লব মানে ‘টোটাল অর্গাজম’। বিপ্লব চায় পূর্ণাঙ্গ পুলকে ভরে উঠুক আমাদের যাপিত জীবন – আজ, আগামীকাল, প্রতিদিন।”

——————————–

সেলিম রেজা নিউটনের অচেনা দাগ বইয়ে আরও বিস্তারিত আলাপ আছে প্যারিস বসন্ত নিয়ে। পৃষ্ঠা (৩৭-৪৪)। আগ্রহীরা চাইলে অনলাইনেও পড়তে পারেন এই লিংকে গিয়ে: https://goo.gl/o1x8QX

খুবই সংক্ষেপে প্যারিস বসন্তের ইতিহাস জানতে পড়ুন: প্যারিস বসন্ত: ‘বাস্তববাদী হও, অসম্ভবের দাবি তোলো’! ; প্যারিস ১৯৬৮ লিফলেট: “সংস্কার? না; বিপ্লব? হ্যাঁ

** মামুনুর রশিদের লেখা ‘ফিলিস্তিনের গান’ থেকে। পুরো কবিতা: https://arts.bdnews24.com/?p=4852

প্যারিস ১৯৬৮ লিফলেট: “সংস্কার? না; বিপ্লব? হ্যাঁ

১৯৬৮ সালের মে মাসে বিপ্লবের উত্তাল হাওয়ায় উড়ছিল প্যারিসসহ পুরো ফ্রান্স। বিশ্ববিদ্যালয় দখল করে নিয়েছিলেন শিক্ষার্থীরা। সমাজে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা কী, শিক্ষার্থীসমাজের ভূমিকা কী, কিভাবে বৈষম্যমুক্ত স্বাধীন জীবনযাপন করা যায়- এমন সব প্রশ্নে-বিতর্কে তোলপাড় হয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। শিক্ষার্থীদের ডাকে কলকারখানা বন্ধ করে আন্দোলনে সামিল হয়েছিলেন ফ্রান্সের শ্রমিকরা। গড়ে উঠেছিল শত শত বিপ্লবী কমিটি। ওপরের লিফলেটটি তেমনই এক Revolutionary Action Committee- থেকে প্রকাশ করা হয়েছিল। তারা দখল করেছিল প্যারিসের বিখ্যাত ওদেওন থিয়েটার।

 

আমাদের এই আন্দোলন কোনো ‘ইজম’ অনুসারী না। আমাদের কোনো তকমা নেই। আর আমরা সেটা চাইও না। আমাদের মূল কথা একটাই: বিপ্লব।

একারণেই আমাদের কোনো পতাকা নেই। ওদেওন থিয়েটারের মাথায় যে লাল পতাকাটা ঝুলছে, তার সঙ্গে কমিউনিজমের কোনো সম্পর্ক নেই। এটা একটা সতর্কতার প্রতীক মাত্র। একই রকমভাবে কালো পতাকাটাও নৈরাজ্যবাদীদের প্রতীক না। এটা দিয়ে আমরা বলতে চেয়েছি: থামো।

আমরা নিজেদের উপস্থিতি জানান দিতে চাই আর নিজেদের তৎপরতা জারি রাখতে চাই। বর্তমান এই সমাজের উদ্দেশে, এর সংস্কারকারীদের উদ্দেশে, ও এটাকে টিকিয়ে রাখতে যারা কাজ করে যাচ্ছেন তাদের উদ্দেশে আমরা বলছি: ‘যথেষ্ট হয়েছে’।

আমাদের কোনো মতবাদ নেই। আছে শুধু একটা সহজ নীতি: সমাজকে পরিচালিত হতে হবে ব্যক্তির ভালো-মন্দ ও ইচ্ছা অনুযায়ী। এর উল্টোটা না। পরিণামে, ব্যক্তির নানা পদক্ষেপই গড়বে নতুন সমাজ।

বর্তমানে সমাজই ব্যক্তিমানুষের সব কিছুর আদল গড়ে দেয়। শেষপর্যন্ত ব্যক্তি হয়ে দাঁড়ায় একটা উপকরণ মাত্র, যে কিনা শুধু পুঁজিবাদের দাসত্ব করে যায়- পরিণত হয় উৎপাদন ও ভোগের একটা কলকব্জায়।

সংস্কার দিয়ে (সেটা যত বড় আকারেরই হোক না কেন) এই সমস্যার গোড়ায় আঘাত করা যাবে না। খুব বেশি হলে সেই সংস্কার কয়েক মাস বা বছরের জন্য বদলাতে পারে ব্যক্তির শোষণ, বৈষম্য ও বিচ্ছিন্নতার চেহারা। কিন্তু এরপর মানুষ আরও বেশি করে আজ্ঞাবহ হয়ে পড়ে পুঁজিবাদী শাসনে।

আমাদের যা দরকার তা হলো: এই সমাজের আমূল পরিবর্তন। এই রূপান্তরের জন্য যা-ই করতে হোক না কেন- সেটা আমাদের করতে হবে। আমাদের অন্য কোনো বিকল্প ভাবনা বা মঞ্চ নেই। কারণ আমরা বিপ্লব চাই, সংস্কার না। আমাদের আন্দোলনের মাধ্যমে তৈরি করতে হবে সেই বৈপ্লবিক বাস্তবতা। পঙ্গু-অচল, বিচ্ছিন্নতা তৈরি করা এই সমাজটা আমাদের ধ্বংস করতে হবে।

শিক্ষার্থীরা সেই প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছিলেন তাদের বিদ্যায়তনিক জগতে নানাবিধ প্রশ্ন উত্থাপন করে। আর এখন সেই কাজটা বাস্তবে করতে চান শ্রমিক, শিল্পী, দিনমজুর, চাকরিজীবীসহ সকল স্তরের জনতা। তারা এই স্বপ্ন বাস্তব করতে চান জাতীয়ভাবে। তারপর ছড়িয়ে দিতে চান আন্তর্জাতিক অঙ্গনে।

বৈপ্লবিক বিভিন্ন ধ্বংসাত্মক কাজকে আমরা অনেক ক্ষেত্রেই সৃজনশীল বলে মনে করি। বিদ্যমান নানা কাঠামোকে চ্যালেঞ্জ জানানোর মাধ্যমে আমরা নতুন সেই সমাজের নানা তত্ত্বগত কাঠামো নির্দিষ্ট করতে পারি, যে সমাজে বিপ্লবের জন্ম হবে।

আমরা বর্তমানে আছি একটা প্রাক-বৈপ্লবিক সময়ে, যেটা একই সঙ্গে ধ্বংসাত্মক। এই স্থায়ী সংগ্রামটাই সমাজের সকল সত্যিকারের প্রগতি নিয়ে আসে। বিপ্লবের সময় এটা নিয়ে আসবে একটা ইতিবাচক বাস্তবতা। কিন্তু সেটা কোনোভাবেই সুনির্দিষ্ট কিছু হবে না। কারণ প্রথাগত বা প্রমাণিত বিপ্লব বলে কিছু নেই।

আর তাই আমরা বলি: বিপ্লব হতে হবে দীর্ঘস্থায়ী অথবা তা একেবারেই হবে না। প্রতিবাদ-আন্দোলনও একইভাবে হবে দীর্ঘস্থায়ী।”

প্যারিসের ১৯৬৮ বিদ্রোহ সম্পর্কে আরও জানতে পড়ুন: প্যারিস বসন্ত: ‘বাস্তববাদী হও, অসম্ভবের দাবি তোলো’!

প্যারিস বসন্ত: ‘বাস্তববাদী হও, অসম্ভবের দাবি তোলো’!

৫০ বছর আগের এই রকম এক বসন্তে, ফ্রান্সে উঠেছিল বিদ্রোহ-বিপ্লবের উতাল হাওয়া। সংগঠিত হয়েছিল দেশটির ইতিহাসের অন্যতম বড় শ্রমিক ধর্মঘট। প্রচলিত রাষ্ট্র-সমাজের ভিত্তি ধরে টান দিয়েছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। শ্রমিকরা দখল করে নিয়েছিলেন কারখানাগুলো। দাবি তুলেছিলেন নতুন শ্রম-সম্পর্কের। বিশ্ববিদ্যালয় দখল করে শিক্ষার ভিত্তি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন শিক্ষার্থীরা। সমাজের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সম্পর্ক কী, সমাজের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পর্ক কী- এসব প্রশ্ন তুলে পুরো সমাজকেই ঢেলে সাজানোর স্বপ্ন ছিল অনেকের চোখে।

১৯৬০-এর দশকে বিশ্বজুড়েই দেখা গেছে বিদ্রোহ-বিপ্লবের পরিস্থিতি। যুক্তরাষ্ট্রে চলছিল নাগরিক অধিকার আন্দোলন, ভিয়েতনাম যুদ্ধবিরোধী আন্দোলন। পশ্চিম ইউরোপজুড়ে উঠেছিল নারী অধিকার, সমকামীতার অধিকারের দাবি। শ্রমিক আন্দোলনও দানা বাঁধছিল নতুন তৎপরতার সঙ্গে। ১৯৬৮ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের আধিপত্য চ্যালেঞ্জ করে বিদ্রোহ শুরু করেছিলেন চেকোস্লোভাকিয়ার মানুষ। যা স্মরণীয় হয়ে আছে প্রাগবসন্ত হিসেবে। বৈশ্বিক রাজনীতির কথা চিন্তা করলে ৬০-এর দশকে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা হিসেবে হয়তো চিহ্নিত করা হবে ভিয়েতনাম যুদ্ধকে। কিন্তু ১৯৬৮ সালের প্যারিস বিদ্রোহ এখনও ভাবিয়ে তোলে সমাজচিন্তক, পরিবর্তনকামীদের। রাজনৈতিক অভিজাত শ্রেণী, কর্তৃত্বপরায়নতা ও প্রাত্যহিক জীবনের নানা রাষ্ট্রীয় আমলাতান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠেছিলেন ফ্রান্সের মানুষ।

১৯৬৮ সালের মে মাসের শুরু থেকে ফ্রান্সে দৃশ্যমান হয়ে ওঠে শিক্ষার্থীদের স্বতঃস্ফূর্ত বিদ্রোহ। যার বীজটা আসলে রোপন করা হয়েছিল ১৯৬৭ সালে। সে বছর নঁতের বিশ্ববিদ্যালয় (Nanterre University) কর্তৃপক্ষ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল মেয়েদের হলে ছেলে শিক্ষার্থীদের যাতায়াতের ওপর। এই নিষেধাজ্ঞার প্রতিবাদেই ক্ষোভ দানা বাঁধতে শুরু করেছিল বিশ্বাবদ্যালয়ের তরুণ-তরুণীদের মনে।

শিক্ষার্থী-পুলিশের সংঘর্ষ

১৯৬৮ সালের মার্চে ঘটে যায় আরও একটি ঘটনা। নঁতের বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু প্রগতিশীল চিন্তক-সংগঠক দখল করেছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি প্রশাসনিক ভবন। আর বিশ্ববিদ্যালয়ের কাউন্সিল রুমে একটি সভা করেছিলেন। যেখানে তাঁরা ফরাসী সমাজের শ্রেণী বৈষম্য, রাজনৈতিক আমলাতান্ত্রিকতা, বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার নীতি, অর্থবরাদ্দ ইত্যাদি বিষয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। প্রাণবন্ত তর্ক-বিতর্ক চালিয়েছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন পরে পুলিশ ডেকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার চেষ্টা চালায়। তবে সে যাত্রা সেখানে কোনো সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেনি। শিক্ষার্থীরা তাদের দাবিদাওয়া সম্বলিত একটি প্রকাশনা তৈরি করে বিশ্ববিদ্যালয় ভবন ছেড়ে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। এই ঘটনাটি পরবর্তীকালে পরিচিতি পায় ‘২২ মার্চের আন্দোলন’ হিসেবে।

কোনো সংঘর্ষের ঘটনা না ঘটলেও নঁতের বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন পরে এই ‘২২ মার্চ আন্দোলন’-এর নেতৃস্থানীয়দের বিরুদ্ধে শৃঙ্খলামূলক ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ নেয়। বহিষ্কারের ঘোষণা দেওয়া হয় বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থীকে। এ নিয়ে প্রশাসন ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে দ্বন্দ্ব-টানাপোড়েনের জের ধরে ২ মে নঁতের বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করা হয়। এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ফুঁসে ওঠেন প্যারিসের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। পরের দিন ৩ মে একটি প্রতিবাদ সভা আয়োজন করা হয় সরবোন বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানে তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দেওয়া ও শিক্ষার্থীদের বহিস্কারের হুমকি দেওয়ার বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলেছিলেন।

এই স্ফূলিঙ্গই পরে রূপান্তরিত হয় দাবানলে। ৫ মে থেকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দখল নিতে থাকেন শিক্ষার্থীরা। গড়ে উঠতে থাকে ছোট ছোট অ্যাকশন কমিটি। দেয়ালগুলো জীবন্ত হয়ে উঠতে থাকে স্লোগান আর ছবিতে। রাষ্ট্র-প্রশাসনের দিক থেকেও চলতে থাকে পাল্টা-প্রতিক্রিয়া। বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে সংঘর্ষে জড়ায় শিক্ষার্থী ও পুলিশ। গ্রেপ্তার করা হয় পাঁচ শতাধিক শিক্ষার্থীকে। একপর্যায়ে সরবোন বিশ্ববিদ্যালয়ও বন্ধ ঘোষণা করার পর ১০ মে রাতে পুলিশের সঙ্গে তীব্র সংঘর্ষে জড়ান শিক্ষার্থীরা। যে রাত পরে পরিচিত হয়েছে ‘ব্যারিকেডের রাত’ নামে। ১১ তারিখ সকাল থেকে আবার শুরু হয় দফায় দফায় সংঘর্ষ।

ততদিনে শিক্ষার্থীদের দাবি আর শুধু বিশ্ববিদ্যালয় বা শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কার বা যৌনতার অবদমনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি। দীর্ঘ সময় ধরে রাষ্ট্র-সমাজ নিয়ে যে ক্ষোভ শিক্ষার্থীদের মধ্যে জমা হয়েছিল, সেগুলোর বহিঃপ্রকাশ ঘটতে থাকে। পুরো সমাজটাই ঢেলে সাজানোর দৃপ্ত প্রত্যয় নিয়ে রাজপথ কাঁপাতে থাকেন তাঁরা। প্যারিসের অনেক দেয়ালে দেখা যেতে থাকে এক কাব্যিক শ্লোগান: ‘বাস্তববাদী হও, অসম্ভবের দাবি তোলো।’

ফ্রান্সের রাস্তায় লেখা: ‘বাস্তববাদী হও, অসম্ভবের দাবি তোলো।’

১০ মে’র ‘ব্যারিকেডের রাত’-এর কয়েক দিন পর থেকে ফ্রান্সের শ্রমিকরাও সাড়া দেয় শিক্ষার্থীদের আহ্বানে। লাখ লাখ শ্রমিক কাজ বন্ধ করে যোগ দেন শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে। শুরু হয় ফরাসী ইতিহাসের অন্যতম বড় শ্রমিক ধর্মঘটের। ফ্রান্সের কমিউনিস্ট পার্টি ও তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকা ট্রেড ইউনিয়নগুলো শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে শ্রমিকদের বিচ্ছিন্ন রাখার ও একটা সম্ভাব্য বিপ্লবের পথ রুদ্ধ করার যাবতীয় সব চেষ্টাই করেছিল। কিন্তু সফল হতে পারেনি।

১৩ মে ধর্মঘট ও বিক্ষোভ সমাবেশের আহ্বান করেন শ্রমিকরা। প্যারিসের রাস্তায় সেদিন একসঙ্গে হেঁটেছিলেন লাখ লাখ মানুষ। এক কাতারে দাঁড়িয়েছিল ছাত্র-শ্রমিক-জনতা। গত কয়েকদিন ধরে পুলিশের সঙ্গে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের ঘটনা চললেও সেদিন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা চলে গিয়েছিলেন দৃশ্যপটের বাইরে। প্রধানমন্ত্রী জর্জ পম্পিদ্যু (Georges Pompidou) ব্যক্তিগতভাবে ঘোষণা করেছিলেন যে, আটককৃতদের মুক্তি দেওয়া হবে আর সরবোন বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দেওয়া হবে। কিন্তু ততদিনে জল অনেকদূরই গড়িয়ে গেছে। প্রধানমন্ত্রীর এসব আশ্বাসে সন্তুষ্ট হওয়ার বদলে বরং আরও তৎপর হয়ে ওঠেন আন্দোলনকারীরা।

সরবোন বিশ্ববিদ্যালয় দখল করে সেটিকে ‘পিপলস ইউনিভার্সিটি’ নামে ঘোষণা দেন শিক্ষার্থীরা। গড়ে তোলেন অকুপেশন কমিটি অব সরবোন। প্যারিস জুড়ে গড়ে ওঠে এরকম পাঁচ শতাধিক অ্যাকশন কমিটি।

সরবোন বিশ্ববিদ্যালয়ের মিলনায়তনে শিক্ষার্থী সমাবেশে বক্তৃতা দিচ্ছেন ফরাসী দার্শনিক জঁ পল সার্ত্রে

১৪ মে থেকে শুরু হয় শ্রমিকদের কারখানা দখল। নান্তেস শহরের অদূরে একটি কারখানায় ধর্মঘট শুরু করেন শ্রমিকরা। অবরুদ্ধ করে ফেলেন কর্তৃপক্ষের লোকজনদের। একই রকম ঘটনা ঘটে রুয়েন, সেইন ভ্যালি, বুলোন-বিলানকোর্ট ইত্যাদি অনেক অঞ্চলের কারখানায়। ১৫ মে প্যারিসের ন্যাশনাল থিয়েটার দখল করে সেখানে পাকাপাকিভাবে জনতার অধিবেশন বসানো হয়। চলতে থাকে সমাজবদলের নানা রূপরেখা নিয়ে নিরন্তর তর্ক-বিতর্ক ও আলোচনা।

১৬ মে নাগাদ দেখা যায় প্যারিস ও আশেপাশের এলাকার ৫০টি কারখানার শ্রমিক ধর্মঘটে চলে গেছেন। ১৮ মে নাগাদ ২০ লাখ শ্রমিক সামিল হন ধর্মঘটে। ২০ মে আসতে আসতে দেখা যায়, সংখ্যাটা এক কোটি ছাড়িয়ে গেছে। যা ছিল ফ্রান্সের পুরো শ্রমশক্তির তিনভাগের দুইভাগ।

এই পর্যায়ে শ্রমিকদের দেওয়া হয় বেতন-ভাতা বৃদ্ধির আশ্বাস। ফ্রান্সের কমিউনিস্ট পার্টি এই শ্রমিক আন্দোলনের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করে। ট্রেড ইউনিয়নের নেতারা শ্রমিকদের আশ্বাস দেন সর্বনিম্ন মজুরি ৩৫ শতাংশ বৃদ্ধির। কিন্তু তাতেও আন্দোলন থেকে সরে যেতে অস্বীকৃতি জানান শ্রমিকরা। তাঁদের চোখে তখন যেন ছিল বিপ্লবের স্বপ্ন। নতুন সমাজ গঠনের অঙ্গীকার।

ফ্রান্সের একটি কারখানার ধর্মঘটে যাওয়া শ্রমিকরা

২৪ মে প্যারিস স্টক এক্সচেঞ্জে আগুন ধরিয়ে দেন আন্দোলনকারীরা। পুঁজিবাদের অন্যতম প্রধান এই প্রতিষ্ঠানটিতে আগুন দেওয়ার এই ঘটনা থেকে স্পষ্টই বোঝা যায় যে, তাঁরা পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থার গোড়ায় আঘাত হানতে চেয়েছেন।

শিক্ষার্থী-শ্রমিকদের এই স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন-তৎপরতায় ভীত হয়ে রাষ্ট্রও হাঁটার চিন্তা করে ভয় দেখানোর রাস্তায়। বলপ্রয়োগের মাধ্যমে প্যারিসের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার কথা ভেবে প্রস্তুত করা হয় ২০ হাজারের বেশি সেনাসদস্যকে। অন্যদিকে শ্রমিকদের শান্ত করার জন্য ২৫ ও ২৬ মে সামাজিক বিষয়াদি সম্পর্কিত মন্ত্রণালয় একটি চুক্তি সাক্ষর করে। যেখানে শ্রমিকদের সর্বনিম্ন মজুরি বাড়ানো হয় ২৫ শতাংশ। আর নিয়মিত বেতন বৃদ্ধি করা হয় ১০ শতাংশ। কিন্তু সরকারের এই প্রচেষ্টাও বিফলে যায়। এই প্রস্তাবও প্রত্যাখ্যান করে ধর্মঘট চালিয়ে যেতে থাকেন শ্রমিকরা।

ফ্রান্সের কমিউনিস্ট পার্টি ও তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন ট্রেড ইউনিয়নগুলোকে এই পুরো ঘটনায় দেখা যায় একটি প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী হিসেবে। যারা একটি সম্ভাব্য সমাজবিপ্লব ঠেকানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়েছে শুরু থেকে। শ্রমিকশ্রেণী বা গণমানুষের পার্টি বলে বিবেচিত হলেও ১৯৬৮ সালের মে বিদ্রোহে ফ্রান্সের কমিউনিস্ট পার্টি দাঁড়িয়েছিল শাসকদের কাতারে। বলা যায় একরকম বিশ্বাসঘাতকতাই করেছিল শ্রমিক-শিক্ষার্থীদের যৌথ বিদ্রোহের বিরুদ্ধে।

শ্রমিকরা যেন ধর্মঘট ভেঙে কাজে ফিরে যান, তা নিশ্চিত করার জন্য মিথ্যার আশ্রয়ও নিয়েছিলেন ট্রেড ইউনিয়নের নেতারা। উদাহরণ হিসেবে প্যারিসের মেট্রো স্টেশনের কথা বলা যায়। সেখানে একটি স্টেশনে গিয়ে নেতারা শ্রমিকদের মিথ্যা বলছিলেন যে, অন্যান্য স্টেশনের শ্রমিকরা আবার কাজ শুরু করেছে। এই মিথ্যা তাঁরা বারবার আওড়েছেন প্রতিটা স্টেশনে গিয়ে। কিন্তু এত কিছুর পরেও নেতারা ভাঙতে পারেননি শ্রমিক ঐক্য।

পরিস্থিতি এতটাই খারাপ হয়ে যায় যে, ২৯ মে পালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন প্রেসিডেন্ট শার্ল দ্য গল। সেদিন সকাল ১১টার পর থেকে কারো সঙ্গেই কোনো যোগাযোগ না করে আত্মগোপন করেন ফরাসী প্রেসিডেন্ট। এমনকি প্রধানমন্ত্রী পম্পিদ্যু ঘোষণা করেন যে, ‘তিনি দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন।’ স্থবির হয়ে পড়েছিল রাষ্ট্রীয় কার্যকলাপ। সরকারের অনেক বড় কর্মকর্তাই সেসময় ভীত হয়ে পড়েছিলেন সম্ভাব্য এক সমাজবিপ্লবের আশঙ্কায়। প্রাণ হারানোর ভয়ও চেপে বসেছিল অনেকের মনে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয় থেকে একের পর এক পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছিল পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের। কিন্তু কিছুই তাদের মনমতো হচ্ছিল না।

১০ মে রাতে (ব্যারিকেডের রাত) পুলিশ-শিক্ষার্থীদের ভয়াবহ সংঘর্ষের পরের সকালে প্যারিসের একটি রাস্তার চিত্র।

অবশেষে ৩০ মে প্রধানমন্ত্রী পম্পিদ্যুর অনুরোধ-সুপারিশে জাতীয় সংসদ ভেঙে দিয়ে নতুন নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করেন প্রেসিডেন্ট দ্য গল। এর পরপরই একটা বড় র‍্যালি রাস্তায় নামে এই ঘোষণাকে স্বাগত জানিয়ে। এটি মূলত ছিল সরকার ও দ্য গলের সমর্থকগোষ্ঠী। শ্রমিকশ্রেণীর একটা বড় অংশও এই ঘোষণাকে স্বাগত জানায়। ও নিজেদের বেতন-ভাতা বৃদ্ধি নিয়ে সন্তুষ্টি প্রকাশ করে। কমিউনিস্ট পার্টি রাজি হয়ে যায় নির্বাচনে অংশ নিতে। ফলে ধীরে ধীরে মিইয়ে যায় একটি সমাজবিপ্লবের আকাঙ্ক্ষা।

আর জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে শেষ হয়ে যায় এই আন্দোলন-বিক্ষোভ-বিদ্রোহের রেশ। শ্রমিকরা ধীরে ধীরে আবার কাজে ফিরতে শুরু করেন। সরবোন বিশ্ববিদ্যালয় দখল করে রাখা শিক্ষার্থীদের বের করে দিকে সক্ষম হয় পুলিশ।

১৯৬৮ সালের মে মাসে ফ্রান্সের শিক্ষার্থী-শ্রমিক-জনতার অনেকের বুকেই হয়তো জমা হয়েছিল বিপ্লবের স্পৃহা। চোখে জেগেছিল নতুন সমাজ গঠনের স্বপ্ন। শেষপর্যন্ত তেমনটা হতে না পারলেও এক মাসের উত্তাল আন্দোলন পাকাপাকিভাবে কিছু পরিবর্তন এনেছিল ফরাসী সমাজে।

জুনের জাতীয় নির্বাচনে আবার গলই প্রেসিডেন্ট হিসেবে ক্ষমতায় আসতে পারলেও আগের মতো দমবন্ধকরা রক্ষণশীল পরিস্থিতি তৈরি হয়নি। তৈরি হয়েছিল একটা মুক্ত পরিসর। ফ্রান্স অনেকখানি এগিয়ে গিয়েছিল একটি সহনশীল-ধর্মনিরেপক্ষ সমাজ গঠনের দিকে। নারী অধিকারের প্রশ্নে এসেছিল বড় কিছু পরিবর্তন। আগে ফরাসী নারীরা কর্মক্ষেত্রে প্যান্ট পরতে পারতেন না। ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খুলতে গেলে স্বামীর অনুমতির প্রয়োজন হতো। এই বিষয়গুলো আর থাকেনি ৬৮ সালের প্যারিস বসন্তের পর।

৫০ বছর পরে এসেও প্যারিস বসন্তের স্মৃতি শিহরণ জাগায় মুক্তিকামী মানুষের বিদ্রোহী সত্তায়। অনেক সমালোচনা-নেতিবাচক কথাবার্তা দিয়েও স্তব্ধ করে দেওয়া যায়নি ৬৮-এর লড়াকু মনোভাবকে। এখনও সেই উত্তাল দিনগুলি অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করে অনেকের মনে। অনেকেই এই ভেবে আশায় বুক বাঁধেন যে, আবার এমন এক প্রজন্ম আসবে। তরুণ সেই প্রজন্ম আবার মুষ্ঠিবদ্ধ হাতে উচ্চারণ করবে স্পর্ধার শব্দ। চিৎকার করে বলবে, “বাস্তববাদী হও, অসম্ভবের দাবি তোলো”।

প্রথম প্রকাশ: এনটিভি অনলাইন

আরও পড়ুন: প্যারিস ১৯৬৮ লিফলেট: “সংস্কার? না; বিপ্লব? হ্যাঁ

মহীনের ঘোড়াগুলি

Rock Revolution

MoheenerGhoraguli-group

আমরা যাইনি মরে আজো– তবু কেবলই দৃশ্যের জন্ম হয়ঃ
মহীনের ঘোড়াগুলো ঘাস খায় কার্তিকের জ্যোৎস্নার প্রান্তরে,
প্রস্তরযুগের সব ঘোড়া যেনএখনও ঘাসের লোভে চরে
পৃথিবীর কিমাকার ডাইনামোর পরে

জীবনানন্দ দাশের ‘ঘোড়া’ কবিতাটির অন্য একটা বিশেষত্ব আছে। এটি লেখার দু-তিন দশক পরের এক কার্তিকের জ্যোৎস্নার প্রান্তর থেকে কলকাতায় নেমে এসেছিলো সংবিগ্ন একদল ঘোড়া। সেই তখন থেকেই ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’র নালহীন খুরের আওয়াজ, হ্রেষাধ্বনি, টগবগানো শুনছে বাংলা গানের গলিতে পায়চারী করা অসংখ্য পথচারী।

বাংলা ব্যান্ড-মিউজিকের ইতিহাসে অন্যতম জনপ্রিয়, শ্রোতাপ্রিয়, প্রবাদপ্রতিম ব্যান্ড ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’। তারা সত্তরের দশকের মাঝামাঝি সময়ে এসেছিলো বাংলা গানে এক নতুন ধারার সঙ্গীত নিয়ে। ষাটের দশকে বব ডিলানের হাত ধরে যে ‘আরবান ফোক’ ধারার প্রচলন ঘটেছিলো, মহীনের ঘোড়াগুলিকে বাংলা গানে সেই জনরারই অনুসারী বলা হয়ে থাকে৷ সেই সময়টাতে সারা পৃথিবীতে বব ডিলান, বিটলস, জিম মরিসনরা গতানুগতিক সংগীতবোধের বাইরে গিয়ে রাজত্ব করছিলেন কিন্তু বাংলা গান তার গতানুগতিকতাকে ছাড়তে পারছিলো না। তখনকার সময়ে শ্রোতারা রোমান্টিক সুরেলা ঘরানার…

View original post 1,500 more words

হাঙরের কামড় খেয়ে হাঙর বাঁচানোর আন্দোলন!‍

সবাই তাঁকে ডাকে ‘শার্ক বয়’ বা ‘শার্কি’ বলে। বিশ্বজুড়ে হাঙর নিধনের বিরুদ্ধে সোচ্চার কণ্ঠ দক্ষিণ আফ্রিকার আচমাত হাশেইম। গত বছর জাতিসংঘের পক্ষ থেকে পেয়েছেন ‘গ্লোবাল শার্ক গার্ডিয়ান’-এর খেতাব। অথচ এটা জানলে চমকে যেতে হবে যে, বছর দশেক আগে এই হাঙরের কামড় খেয়েই প্রাণ হারাতে বসেছিলেন হাশেইম। অনেক কষ্টে জীবন বাঁচাতে পারলেও ডান পা-টা হারিয়েছেন হাঙরের কামড়ে। তবে কোনো কিছুতেই দমে যাননি দক্ষিণ আফ্রিকার এই সাঁতারু। এখন তিনি দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন প্যারা-অলিম্পিকের সুইমিং পুল।

shark-boy

২০০৬ সালের ১৩ আগস্ট ঘটেছিল হাশেইমের জীবন বদলে দেওয়া সেই ঘটনা। দক্ষিণ আফ্রিকার মুইজেনবার্গ সমুদ্রসৈকতে সাঁতার কাটছিলেন তিনি। হঠাৎ করেই দেখতে পান কিছু একটা ধেয়ে আসছে তাঁর ভাই তারিকের দিকে। শুরুতে ভেবেছিলেন সেটা ছিল ডলফিন। কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই বুঝতে পারেন যে সেটা আসলে একটা হাঙর। ছোট ভাইকে বাঁচানোর জন্য পানিতে শব্দ করে হাঙরটির দৃষ্টি আকর্ষণ করেন হাশেইম। কিছুক্ষণের মধ্যেই সেটি ধেয়ে আসে তাঁর দিকে। অনেক চেষ্টা করেও হাঙরের কামড় থেকে বাঁচতে পারেননি তিনি। ডান পায়ের প্রায় পুরোটাই চলে গেছে ১৫ ফুট দীর্ঘ সেই হাঙরের পেটে।

হাশেইমের স্বপ্ন ছিল পেশাদার ফুটবলার হওয়ার। কিন্তু ডান পা হারানোর ফলে শেষ হয়ে যায় তাঁর ফুটবল ক্যারিয়ার। পরবর্তী সময়ে হাশেইমকে সুইমিং পুলে নামার পরামর্শ দেন দক্ষিণ আফ্রিকার প্যারা-অলিম্পিক সাঁতারু নাতালি দু টোইট। অনুপ্রেরণা দেন প্যারা-অলিম্পিকে অংশ নিতে।

টোইটের এই পরামর্শই বদলে দেয় হাশেইমের জীবন। এক পা নিয়েই শুরু করেন সাঁতার। অলিম্পিক পর্যন্ত আসতেও খুব বেশি অপেক্ষা করতে হয়নি হাশেইমকে। ২০০৮ সালে বেইজিং প্যারা-অলিম্পিকে প্রথমবারের মতো দেখা গিয়েছিল তাঁকে। ২০১২ সালে লন্ডন প্যারা-অলিম্পিকে জিতেছিলেন ব্রোঞ্জপদক। এখনো প্রতিবার সুইমিং পুলে নামার সময় সেই হাঙরের কথাই স্মরণ করেন হাশেইম, ‘সাঁতারের সময় আমি সেই ভয়টাকেই কাজে লাগাই। কল্পনা করি যে ১৫ ফুট লম্বা হাঙরটি আমার দিকে ধেয়ে আসছে। আমার ওপরে উঠে যাওয়ার চেষ্টা করছে।’

এবারের রিও প্যারা-অলিম্পিক শেষেই সুইমিং পুলকে বিদায় বলবেন হাশেইম। এর পর নেমে পড়বেন হাঙর রক্ষা আন্দোলনে। যে হাঙরের কামড় খেয়ে প্রাণ হারাতে বসেছিলেন, তার প্রতি বিন্দুমাত্র ঘৃণা বা রাগ নেই হাশেইমের। বরং বিশ্বজুড়ে যেভাবে হাঙর নিধন করা হচ্ছে তাতে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছেন তিনি, ‘পরিসংখ্যান খুবই ভয়াবহ। প্রতিবছর প্রায় ১০ কোটি হাঙর মারা হচ্ছে।’ এভাবে চলতে থাকলে সমুদ্রের খাদ্য শৃঙ্খলেও নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে মন্তব্য করেছেন হাশেইম।

হেলমেট এলো কেমন করে?

হেলমেট ছাড়া ব্যাটিং করতে নামার কথা হয়তো কল্পনাও করেন না এখনকার ব্যাটসম্যানরা। ২০১৪ সালে অস্ট্রেলিয়ান ব্যাটসম্যান ফিলিপ হিউজের মৃত্যুর পর আরও সতর্ক হয়ে গেছে ক্রিকেট অঙ্গন। ব্যাটসম্যানদের মাথায় উঠছে আরও শক্তিশালী-সুরক্ষিত হেলমেট। অথচ একটা সময় ক্রিকেটে এই হেলমেটের কোনো অস্তিত্ব ছিল না। মাথায় কোনো কিছু না পরেই জোয়েল গার্নার, জেফ থমসন, ম্যালকম মার্শালদের মতো দুর্ধর্ষ পেসারদের মুখোমুখি হতেন ব্যাটসম্যানরা। কিন্তু কবে থেকে শুরু হয়েছিল হেলমেট পরার চল? কে পরেছিলেন প্রথম হেলমেট? কেমন ছিল তার ধরনধারন?

helmets

১৯৩২-৩৩ মৌসুমের কুখ্যাত বডিলাইন সিরিজের কথা ক্রিকেটপ্রেমীরা কমবেশি সবাই জানেন। ডন ব্রাডম্যানের দুর্দান্ত অস্ট্রেলিয়ান দলকে বেঁধে রাখার জন্য সরাসরি ব্যাটসম্যানের শরীর লক্ষ্য করে বোলিং করার কৌশল গ্রহণ করেছিলেন ইংলিশ বোলাররা। সেই সিরিজে অস্ট্রেলিয়ার বেশ কয়েকজন ব্যাটসম্যান আহত হয়েছিলেন বলের আঘাতে।  তখনও ক্রিকেট অঙ্গনে আসেনি হেলমেটের ভাবনা। ১৯৩০-এর দশকে অবশ্য ইংল্যান্ডের এক ব্যাটসম্যান প্যাটসি হেনড্রেন বানিয়েছিলেন বিশেষ এক ধরণের টুপি। কাউকে কাউকে মাথায় তোয়ালে জড়িয়েও দেখা গেছে ব্যাট হাতে মাঠে আসতে। ভারতের কিংবদন্তি ব্যাটসম্যান সুনিল গাভাস্কারও মাথা বাঁচানোর জন্য বানিয়েছিলেন বিশেষ এক ধরণের টুপি। কিন্তু কোনো কিছুকেই হেলমেটের উত্তরসূরি বলা যায় না।

ব্যাটসম্যানের মাথায় প্রথমবারের মতো হেলমেট সদৃশ বস্তু দেখার জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছে ১৯৭০-এর দশক পর্যন্ত। সে সময় ক্রিকেট অঙ্গন কাঁপিয়ে তুলেছিলেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের পেসাররা। জোয়েল গার্নার, মাইকেল হোল্ডিং, অ্যান্ডি রবার্টস, ম্যালকম মার্শাল, কলিন ক্রফটরা কাঁপন ধরিয়ে দিয়েছিলেন ব্যাটসম্যানদের মনে। অস্ট্রেলিয়ার পেস জুটি ডেনিস লিলি ও জেফ থম্পসনও ছিলেন দুর্দান্ত ফর্মে। বল না, ব্যাটসম্যানদের দিকে যেন একেকটা আগুনের গোলাই ছুঁড়ে দিতেন দুর্ধর্ষ এই পেসাররা। তাঁদের ভয়ঙ্কর সব ইয়র্কার থেকে বাঁচার জন্যই মাথায় হেলমেট পরার কথা ভাবতে হয়েছিল সেসময়ের ব্যাটসম্যানদের।

dennisক্রিকেট ইতিহাসের প্রথম হেলমেট অবশ্য কোনো আন্তর্জাতিক ম্যাচে না, দেখা গিয়েছিল কেরি পেকারের বাণিজ্যিক টুর্নামেন্ট ওয়ার্ল্ড সিরিজ ক্রিকেটের সৌজন্য। ১৯৭৭ সালে ওয়ার্ল্ড সিরিজের প্রথম মৌসুমে অ্যান্ডি রবার্টের বাউন্সারে চোয়াল ভেঙে গিয়েছিল অস্ট্রেলিয়ার ব্যাটসম্যান ডেভিড হুকসের। এই ঘটনার পরেই নিজের মাথা বাঁচাতে হেলমেট পরে ব্যাট করতে আসেন ইংলিশ ব্যাটসম্যান ডেনিস অ্যামিস। সেটা ছিল একটা মোটরসাইকেলের হেলমেট। সেসময় অনেকেই কাপুরুষ বলে গালি দিয়েছিলেন অ্যামিসকে। কিন্তু অ্যামিসের সেই সিদ্ধান্তটিই অনেকটা বদলে দেয় ক্রিকেট বিশ্বকে। তার দেখাদেখি টনি গ্রেগসহ আরও অনেকে পরা শুরু করেন হেলমেট।

grahamআন্তর্জাতিক ম্যাচে প্রথমবারের মতো হেলমেট পরেছিলেন অস্ট্রেলিয়ার গ্রাহাম ইলোপ। ১৯৭৮ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরের সময়। সেটিও ছিল মোটরসাইকেলের হেলমেটের মতো। বলাই বাহুল্য যে, শুরুর দিকের সেই হেলমেট পরে খেলতে বেশ কষ্টই হতো ব্যাটসম্যানদের। অনেক ভারী সেই হেলমেটগুলোয় বাতাস চলাচলের সুবিধা ছিল না বললেই চলে। সামনে মোটা প্লাস্টিকের গ্লাস থাকায় বল দেখার ক্ষেত্রেও পড়তে হতো অসুবিধায়। তারপরও মহামূল্যবান মাথা বাঁচানোর তাগিদে সেগুলোই মাথায় দিয়ে মাঠে নামতে শুরু করেছিলেন সে যুগের ব্যাটসম্যানরা। এরপর ধীরে ধীরে গ্লাভস-প্যাডের মতো হেলমেটটাও হয়ে ওঠে ব্যাটসম্যানদের একটি আবশ্যিক সুরক্ষা উপাদান।

ভিভ রিচার্ডসের মতো কিছু ব্যাটসম্যান অবশ্য আছেন যাঁরা কখনোই মাথায় চাপাতে চাননি হেলমেট নামের এই ‘বোঝা’টিকে। ১৯৭৪ থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত ১২১টি টেস্ট ও ১৮৭টি ওয়ানডে খেলা রিচার্ডস সব সময়ই মাঠে নেমেছেন টুপি পড়ে।