৮৩ বিশ্বকাপ: অঘটনের নেপথ্যে
প্রতিটি বিশ্বকাপেই একটা দুইটা অঘটন ঘটেই থাকে। ৯৬ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ৭৩ রানে হারিয়ে সবাইকে চমকে দিয়েছিল কেনিয়া। ৯৯ বিশ্বকাপের ফাইনালিস্ট পাকিস্তানকে ৬২ রানে হারিয়ে হইচই ফেলেছিল বাংলাদেশ। ৮৩ সালে বিশ্বকাপে নিজেদের প্রথম ম্যাচেই অস্ট্রেলিয়াকে ১৩ রানে হারিয়ে বিশ্বকাপের অন্যতম বড় অঘটনটার জন্ম দিয়েছিল জিম্বাবুয়ে। আসলে ৮৩ বিশ্বকাপের শুধু ঐ একটা ম্যাচ না, পুরো বিশ্বকাপটাকেই বলা যায় একটা অঘটন। ভারতের বিশ্বকাপ জয়টাই আসলে একটা বড় অঘটন। আর এই অঘটনটাই বদলে দিয়েছিল পুরো ক্রিকেট বিশ্বের মানচিত্র। তৈরি করেছিল ক্রিকেটের সুপার পাওয়ার হিসেবে ভারতের আত্মপ্রকাশের পাটাতন। ভারতের এই পটপরিবর্তনের নেপথ্যে ভালোভাবে নজর দিলে এটা বলাই যায় যে, ৮৩ বিশ্বকাপে কপিল দেবের ১৭৫ রানের মহাকাব্যিক সেই ইনিংসটার হাত ধরেই উন্মোচিত হয়েছিল ভারতীয় ক্রিকেটের নতুন দিগন্ত।
বিশ্বকাপের প্রথম দুইটি আসরে ওয়েস্ট ইন্ডিজ, অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ডের দুর্দান্ত দাপটের কাছে একেবারেই পাত্তা পায় নি ভারত। দ্বিতীয় বিশ্বকাপেও একই অবস্থা। বিশ্বকাপের দুই আসর মিলিয়ে ভারত খেলতে পেরেছিল মাত্র ছয়টি ম্যাচ। জিতেছিল মাত্র একটিতে। পূর্ব আফ্রিকার বিপক্ষে। এইরকম অবস্থায় তৃতীয় বিশ্বকাপে কপিল দেবের নেতৃত্বে ভারতের ইতিহাস গড়া ক্রিকেটাররা যখন ইংল্যান্ডে পৌঁছালেন, তখন কেউই তাদের কোন গোনায় আনেন নি। কিন্তু এবার যে ক্রিকেট দুনিয়ায় উইন্ডিজ আধিপত্যের অবসান ঘটাতেই ভারতের আবির্ভাব সেটা তারা বুঝিয়ে দিল প্রথম ম্যাচেই। ক্লাইভ লয়েড, ভিভ রিচার্ডস, গর্ডন গ্রিনীজরা ধরাশায়ী হলো ৩৪ রানের ব্যবধানে। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে পরের ম্যাচটাতেও পাঁচ উইকেটের সহজ জয় পেল ভারত। কিন্তু তারপর অস্ট্রেলিয়া ও ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে টানা দুইটি ম্যাচে শোচনীয়ভাবে হেরে বসল কপিল-বাহিনী। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে নিজেদের পঞ্চম ম্যাচটাতে হারলে হয়তো টুর্নামেন্ট থেকেই ছিটকে যেত তারা। সেই ম্যাচের শুরুটাও ভারত যেভাবে করেছিল, তাতে হারটাই তাদের অবধারিত নিয়তি বলে ধরে নিয়েছিল সবাই। কিন্তু অকল্পনীয়ভাবে ম্যাচের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিলেন কপিল দেব। খেলেছিলেন হার না মানা ১৭৫ রানের অসাধারণ একটি অধিনায়কোচিত ইনিংস।
৮৩ বিশ্বকাপের ২০তম ম্যাচ ছিল সেটি। টসে জিতে ব্যাট করতে নেমে শুরুতেই ভয়াবহ ব্যাটিং বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ে যায় ভারত। স্কোরবোর্ডে মাত্র ১৭ রান জমা হতেই একে একে ফিরে যান গাভাস্কার, শ্রীকান্ত, অমরনাথ, সন্দীপ পাতিল ও ইয়াসপাল শর্মা। মাথার উপর আকাশসম চাপ নিয়ে ব্যাট হাতে মাঠে নামেন কপিল দেব। ষষ্ঠ উইকেটে রজার বিনিকে নিয়ে যোগ করলেন ৬০ রান। কিন্তু ৭৭ রানের মাথায় বিনি আর রবি শাস্ত্রী দুজনই সাজঘরে ফিরলে আবারও হতাশায় ডুবে যায় ভারতীয় শিবির। কিন্তু হার মানবেন না, এমন একটা পণ করেই যেন মাঠে নেমেছিলেন কপিল দেব। একাই তাণ্ডব চালিয়ে যেতে থাকলেন জিম্বাবুয়ের বোলারদের উপর। অষ্টম উইকেট জুটিতে মদনলালকে নিয়ে যোগ করলেন ৬২ রান। দলীয় ১৪০ রানের মাথায় মদনলালও বিদায় নেওয়ার পর ভারত ২০০ রানের কোটা ছুঁতে পারবে কিনা তা নিয়েই সংশয় প্রকাশ করতে লাগলেন অনেকে। কিন্তু সবাইকে বিস্মিত করে দিয়ে নবম উইকেটে কপিল দেব আর সৈয়দ কিরমানি যোগ করলেন ১২৬ রান। স্কোরবোর্ডে ভারতের রানের পাশে লেখা হল ২৬৬। ১৬টি চার ও ৬টি ছয়ে সাজানো ১৭৫ রানের ইনিংসটা কপিল খেলেছিলেন মাত্র ১৩৮ বলে। ভারতের পক্ষে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রান করেছিলেন কিরমানি। ২৪!
শুধু ব্যাট হাতেই না, বল হাতেও সেদিন জ্বলে উঠেছিলেন কপিল দেব। উইকেট পেয়েছিলেন শুধু একটি। কিন্তু তাঁর কৃপণ বোলিং ভারতের জয়ের পথে বড় একটা অবদান রেখেছিল। ১১ ওভার বল করে তিনি দিয়েছিলেন মাত্র ৩২ রান। ম্যাচটা ভারত জিতেছিল ৩১ রানে। এই অকল্পনীয় জয়টা ভারতকে এতটাই অনুপ্রেরণা যুগিয়েছিল যে, পরের ম্যাচে অস্ট্রেলিয়াকে তারা হারিয়েছিল ১১৮ রানের বিশাল ব্যবধানে। পরের ইতিহাসটা তো সবারই জানা। ফাইনালে মহাশক্তিধর ওয়েস্ট ইন্ডিজের ম্যাচটার পর লর্ডসের ব্যালকনিতে আগের দুই বিশ্বকাপের মতো ক্লাইভ লয়েডকে না, দেখা গিয়েছিল হাস্যোজ্জ্বল কপিল দেবকে।