Posts Tagged ‘ ইংল্যান্ড ’

যে ম্যাচটা নাড়িয়ে দিয়েছিল ইউরোপের মনোজগত

১৯৫৩ সালের ২৫ নভেম্বর। ফুটবলের তীর্থস্থান ওয়েম্বলি স্টেডিয়ামে মুখোমুখি হয়েছিল তৎকালিন ইউরোপিয়ান ফুটবলের দুই পরাশক্তি ইংল্যান্ড ও হাঙ্গেরি। সেসময় ঘরের মাঠে ইংল্যান্ড ছিল অদম্য। ইউরোপের কোনো দেশই ইংল্যান্ডে গিয়ে তাদেরকে হারাতে পারেনি। অপরদিকে ‘মারভেলাস ম্যাগিয়ার্স’ নামে খ্যাত হাঙ্গেরি ছিল অবধ্য। টানা তিন বছর ধরে তারা ছিল অপরাজিত। হাঙ্গেরি আর ইংল্যান্ডের এই লড়াইটা বিশ্ব গণমাধ্যমে পরিচিত পেয়েছিল ‘শতাব্দীর সেরা ম্যাচ’ হিসেবে। তবে শুধু ফলাফল বা মাঠের পারফরম্যান্সের জন্যই ম্যাচটা স্মরণীয় না। ৬০ বছর আগের এই লড়াইটা নাড়িয়ে দিয়েছিল ইউরোপের মনোজগত। চূর্ণ করেছিল সাম্রাজ্যের অহঙ্কার আর নিপীড়িত মানুষের মনে জাগিয়েছিল স্বাধীন হওয়ার স্বপ্ন।

1953

ম্যাচ শুরুর আগে অধিনাক বিলি রাইট, স্ট্যানলি ম্যাথুউ, আলফ রামসেসহ অন্যান্য ইংলিশ খেলোয়াড়রা নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে ছিলেন প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাসী। ইংলিশ সাম্রাজ্যের মতো তাঁরাও তখন আছেন নিজেদের সর্বোচ্চ শিখরে। নভেম্বরে এই ম্যাচটির কয়েক মাস আগেই ইংল্যান্ড পরিচালিত অভিযাত্রায় সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ এভারেস্টের চূড়ায় উঠেছেন এডমুন্ড হিলারি। তার কিছুদিন পরেই রাজ্যাভিষেক হয়েছে রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথের। পুরো ইংল্যান্ড জুড়েই তখন বইছে সাম্রাজ্য দাম্ভিকতার হাওয়া। ১৯৪৭ সালে উপমহাদেশের শাসন ছেড়ে দিতে হলেও সেসময় আফ্রিকার একটা বড় অংশ ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের দখলে।

অপরদিকে হাঙ্গেরির অবস্থা পুরোপুরিই ভিন্ন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে দেশটি বেশ কয়েক বছর ধরেই পার করছিল দুর্বিসহ সময়। জার্মানির নাৎসি শাসন থেকে মুক্ত হতে না হতেই আবার পড়তে হয়েছিল স্টালিনের সোভিয়েত শাসনের খপ্পরে। হাঙ্গেরির তৎকালিন রাষ্ট্রপতি কমিউনিস্ট নেতা রাকোস্কি, স্টালিনের আদর্শে কায়েম করেছিলেন একটা পুলিশি রাষ্ট্র। সোভিয়েত সেনাবাহিনীর প্রত্যক্ষ উপস্থিতিও ছিল পূর্ব ইউরোপের দেশটিতে। হাজার হাজার হাঙ্গেরিয়ানকে পাঠানো হয়েছিল জেলে বা কনসেনন্ট্রেশন ক্যাম্পে। হাঙ্গেরি ও সোভিয়েত সরকারের কাছে খেলাধুলা, বিশেষত ফুটবলটা ছিল কমিউনিজমের আদর্শ প্রতিষ্ঠার লড়াই। হাঙ্গেরির জাতীয় দল ছিল পুরোপুরি সরকারের কর্তৃত্বাধীন। সেসময়ের কোচ গুসতাভ সেবেস ছিলেন সরকারের একজন সদস্য। তিনি বলেছিলেন, ‘পুঁজিবাদ ও কমিউনিজমের লড়াইটা শুধু আমাদের সমাজেই না, চালাতে হবে ফুটবল মাঠেও।’
চেকোস্লোভাকিয়ার বিপক্ষে একটা ম্যাচে হারের পর আজীবনের জন্য বহিস্কার করা হয়েছিল হাঙ্গেরির অধিনায়ক ফেরেঙ্ক পুসকাসকে। তাঁর বিরুদ্ধে আনা হয়েছিল ‘মাঠে গা ছেড়ে দিয়ে খেলার’ অভিযোগ। কয়েক মাস পরে অবশ্য ক্ষমাও করা হয়েছিল। কারণ হাঙ্গেরিকে ফুটবল জগতের শিখরে নিয়ে যাওয়ার পেছনে সবচেয়ে বড় অবদান ছিল এই বাম পায়ের জাদুকরের। শতাব্দীর সেরা ম্যাচটা ইংল্যান্ড হেরেওছিল কিংবদন্তি এই ফুটবলারের দুর্দান্ত পারফরম্যান্সের কারণে।

Soccer - World Cup Switzerland 54 - Final - Hungary v West Germany
হাঙ্গেরি আর ইংল্যান্ডের ম্যাচটা শুরুর ঠিক আগমুহূর্তে এক ইংলিশ ধারাভাষ্যকার পুসকাসকে দেখে বলেছিলেন, ‘ছোট, বেঢপ খেলোয়াড়’। তাদের তখন বিন্দুমাত্রও ধারণা ছিল না যে এই ছোট্ট মানুষটাই কিভাবে তাদের তারকা ফুটবলাদের জীবন দুর্বিসহ করে দেবে। খেলা শুরুর ৪৫ সেকেন্ড পরেই ইংল্যান্ড হজম করেছিল প্রথম গোলটা। ২৭ মিনিট পরেই স্কোর: হাঙ্গেরি ৪ : ০ ইংল্যান্ড। পরের দুইটি গোলই করেছিলেন পুসকাস। তাঁর দ্বিতীয় গোলটা এখনো ফুটবল বিশ্বে বিখ্যাত হয়ে আছে ‘ড্রাগ ব্যাক গোল’ নামে।
দ্বিতীয়ার্ধের ৫৭ মিনিট পরে হাঙ্গেরি এগিয়ে ছিল ৬-৩ গোলে। বাকি ৩৩ মিনিটে তারা আরও তিন-চারটা গোল অনায়াসেই দিতে পারত। কিন্তু ম্যাচটা শেষ হয় ঐ ৬-৩ গোলের ব্যবধানেই। লজ্জাজনক এই হারের পর ইংল্যান্ডের ডিফেন্ডার সিড ওয়েন হতাশ কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘মনে হচ্ছিল আমরা অন্য গ্রহের মানুষের সঙ্গে খেলছি।’
ওয়েম্বলির এই ম্যাচ ভেঙ্গে দিয়েছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের দম্ভ। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের পতনের শুরুর সময় হিসেবেও ৫০-এর দশকের শুরুকেই ইঙ্গিত করেন ইতিহাসবিদরা। এই একটা ম্যাচের কারণেই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের পতনের শুরু হয়েছিল এটা বলাটা হয়তো বাড়াবাড়িই হয়ে যাবে কিন্তু ইংলিশদের শ্রেষ্ঠত্বের অহঙ্কারে সত্যিই নাড়া দিয়েছিল এই হারটা। সাম্রাজ্যের পতন হয়েছিল তখন, যখন ইংল্যান্ডের নাগরিকরা নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব-অপরাজেয়ত্বের ওপর আর বিশ্বাস রাখতে পারেননি। কয়েক মাস বাদে ইংল্যান্ড ফুটবল অঙ্গনের পরিস্থিতিটা হয়েছিল আরও করুণ। ১৯৫৪ সালের মে মাসে হাঙ্গেরির মাঠে গিয়ে ইংল্যান্ড হেরেছিল ৭-১ গোলের ব্যবধানে। এটাই তাদের সবচেয়ে বড় ব্যবধানে হারের রেকর্ড। অল্প কয়েকদিনের ব্যবধানে টানা দুইটি হারের ফলে দুনিয়া সম্পর্কে নতুন করে ভাবতে বাধ্য হয়েছিল ইংলিশরা।
ফুটবলের আবিষ্কারক হিসেবে ইংল্যান্ডের ধারণা ছিল খেলাটার প্রতি স্বাভাবিকভাবেই তাদের দখল অন্যদের চেয়ে অনেক বেশি। বাইরের কোনো দেশের খেলোয়াড়দের সঙ্গে খেলাটাকেও একসময় তারা নিজেদের মর্যাদার জন্য হানিকর বলেই ভাবত। ১৯৫০ সালের আগে ইংল্যান্ড বিশ্বকাপেও অংশ নেয়নি। কিন্তু নাক উঁচু ইংলিশদের বাস্তবতার মাটিতে নামিয়ে এনেছিল হাঙ্গেরি। ইংলিশ ফুটবলে এসেছিল আমূল পরিবর্তন।
১৯৫৪ সালের আগ পর্যন্ত ইংল্যান্ড ফুটবল দল খেলত বহুদিনের পুরোনো ডব্লিউএম ফরম্যাটে (৩-২-২-৩)। হাঙ্গেরির কাছে হারের পর প্রথমবারের মতো কৌশল পরিবর্তনেও বাধ্য হয় ইংল্যান্ড। বিদেশি ফুটবলারদের বিপক্ষে আরও বেশি করে খেলার ওপরও জোর দিয়েছিলেন অনেকে। হাঙ্গেরির খেলার ধরন, কোচিং পদ্ধতি অনুসরণ করেছিল লিভারপুল, টটেনহাম ও ওয়েস্টহামের মতো ইংলিশ ক্লাবগুলোও।
ইংল্যান্ডের জ্যাত্যাভিমান যখন ধুলোয় লুটিয়েছে, তখন হাঙ্গেরির কমিউনিস্ট শাসকরা মেতেছেন বিজয়োল্লাসে। তাদের দৃষ্টিতে এটা ছিল কমিউনিস্ট সমাজব্যবস্থারই বিজয়। যদিও এই দৃষ্টিভঙ্গিটাও ছিল নিছকই ভ্রান্তধারণা। পুসকাসদের ইংল্যান্ড বধের কীর্তিটা আসলে রচনা করেছিল হাঙ্গেরির নিপীড়িত মানুষের অভ্যুত্থানগাথা। তাদের মনে জাগিয়েছিল অসম্ভবকে সম্ভব করার প্রেরণা। হাঙ্গেরির সাধারণ মানুষ ভেবেছিল যদি আমরা ওয়েম্বলিতে ইংল্যান্ডকে হারাতে পারি তাহলে হয়তো দখলদার সোভিয়েত বাহিনীকেও হটিয়ে দিতে পারব। ১৯৫৬ সালের হাঙ্গেরিয়ান বিপ্লবের সঙ্গে ওয়েম্বলির সেই ম্যাচটির প্রত্যক্ষ যোগসূত্র ছিল বলেই দাবি করেছিলেন দেশটির প্রখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক পিটার টিমার। ১৯৯৯ সালে তাঁর পরিচালিত ‘৩-৬’ সিনেমাটিতে দেখানো হয়েছিল, রেফারির শেষ বাঁশি বাজার পর রাজনৈতিক বন্দীদের সঙ্গে কোলাকুলি করে বিজয় উদযাপন করেছিলেন কারাগারের রক্ষীরা। দুই বছর পরে অনেকেই একজোট হয়ে লড়েছিলেন সোভেয়েত ট্যাঙ্কের বিরুদ্ধে।

Hungarian Revolution-C
১৯৫৬ সালের সেই গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে সোভিয়েত বাহিনীকে হটিয়েও দিয়েছিল হাঙ্গেরির সাধারণ মানুষ। দুঃখের বিষয় বিপ্লবী সেই অভ্যুত্থানটা স্থায়ী হয়েছিল মাত্র কয়েকদিন। হাঙ্গেরি ছেড়ে চলে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েও আবার ফিরে এসেছিল সোভিয়েত সেনাবাহিনী। আক্ষরিক অর্থেই গুঁড়িয়ে দিয়েছিল  মানুষের মুক্তিমুখীন আকাঙ্ক্ষা। সেটা ইতিহাসের এক বেদনাময় আর করুণ অধ্যায়।

ওয়েম্বলিতেই কেন চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনাল?

২০১১ সালে চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনালের ভেন্যু ছিল ওয়েম্বলি স্টেডিয়াম। সেই আসর শেষ হওয়ার পর যখন ২০১৩ সালের ফাইনাল ভেন্যু হিসেবেও ঐ একই স্টেডিয়ামের নাম ঘোষণা করা হয়েছিল, তখন হয়তো অনেকেই অবাক হয়েছিলেন। কারণ এর আগে কখনোই এত অল্প সময়ের ব্যবধানে একই ভেন্যুতে ইউরোপিয়ান ক্লাব ফুটবলের সবচেয়ে বড় এই প্রতিযোগিতার ফাইনাল অনুষ্ঠিত হয়নি। বিশেষ অগ্রাধিকার দিয়ে লন্ডনের এই ওয়েম্বলি স্টেডিয়ামকেই কেন নির্বাচন করা হয়েছিল এবারের চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনালের ভেন্যু হিসেবে?

Wembley-Stadium_All german final

বিশ্ববাসীকে ফুটবল নামক খেলাটির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল ইংল্যান্ড। ১৮৬৩ সালে ইংল্যান্ডই তৈরি করেছিল বিশ্বের প্রথম ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন। সেসময়ই গড়ে উঠেছিল আধুনিক ফুটবলের অনেক নিয়ম-কানুন। এবছর উদযাপিত হতে যাচ্ছে সেই ঐতিহাসিক মুহূর্তটির ১৫০তম বার্ষিকী। ফুটবল ইতিহাসের প্রথম অ্যাসোসিয়েশন গঠনের ১৫০তম বার্ষিকীটি স্মরণীয় করে রাখার জন্যই, ব্যতিক্রমী উদাহরণ গড়ে এবছরের চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনালের ভেন্যু নির্বাচন করা হয়েছে ওয়েম্বলি স্টেডিয়ামকে। ২০১১ সালের জুনে এই সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে উয়েফা সভাপতি মিশেল প্লাতিনি বলেছিলেন, ‘১৮৬৩ সালে প্রতিষ্ঠিত ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনই (এফএ) ইতিহাসের সবচেয়ে পুরোনো জাতীয় ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন। আর ২০১৩ সালে এটি উদযাপন করবে তার ১৫০তম বার্ষিকী। এটা ফুটবল ইতিহাসেরই একটা স্মরণীয় মুহূর্ত। এই বছর আমরা এই খেলাটির অনেক নিয়মকানুনেরও ১৫০তম বার্ষিকী উদযাপন করব। এসব মাথায় রেখে  বিশেষ উপায়ে এই বার্ষিকীটা উপযাপন করা আমাদের দায়িত্ব বলে মনে করেছি। একারণেই আমরা চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনালটাকে ফুটবলের মাতৃভূমি ইংল্যান্ডে ফিরিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। বিশেষভাবে ওয়েম্বলি স্টেডিয়ামে, যেটা ইংল্যান্ড ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের মূল স্টেডিয়াম।’ মিশেল প্লাতিনি আরও বলেছিলেন, ‘আমার মনে হয় ইতিহাসের প্রথম ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন গঠনের ১৫০তম বার্ষিকী উদযাপনটাকে সম্মান জানানোটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমরা আজ এখানে সমবেত হয়েছি কারণ ১৫০ বছর আগে ইংল্যান্ডেরই কিছু মানুষ ফুটবলের নিয়ম-কানুনগুলো তৈরি করেছিলেন। আমি বিশ্বাস করি, এটা একটা সম্মান জানানোর মতো মুহূর্ত। যদি আমরা ইতিহাসকে স্মরণ না করি, তাহলে আমরা কোন ভবিষ্যত্ও পাব না।’

_67727320_zepwemb

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অন্যতম আকর্ষণীয় স্থাপনা হিসেবে নির্মান করা হয়েছিল ওয়েম্বলি স্টেডিয়াম। সেসময় এটি পরিচিত ছিল এম্পায়ার স্টেডিয়াম হিসেবে। ১৯২৪ সালের ২৩ এপ্রিল এই স্টেডিয়ামের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেছিলেন ইংল্যান্ডের রাজা জর্জ-৫। তারপর থেকে ইংলিশ ফুটবলের মূলকেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায় এই স্টেডিয়াম। ২০০৩ সালে নতুনভাবে গড়ে তোলার জন্য ভেঙ্গে ফেলা হয় পুরোনো স্টেডিয়ামটি। নতুন স্থাপনার কাজ শেষ হয় ২০০৭ সালে। এটি ইউরোপের দ্বিতীয় বৃহত্তম স্টেডিয়াম।

এর আগে ওয়েম্বলি স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত হয়েছিল ছয়টি চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনাল। শেষবার ২০১০-১১ মৌসুমে স্বাগতিক ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডকে হারিয়ে শিরোপা জয়ের স্বাদ পেয়েছিল স্প্যানিশ জায়ান্ট বার্সেলোনা।

আয়ারল্যান্ড থেকে গ্রীস: ইউরোর অঘটনগুলো

প্রতিটা ফুটবল প্রতিযোগিতাতেই থাকে ‘চুনোপুঁটি’ হিসেবে বিবেচিত কিছু ছোট দল। আন্ডারডগ বলেও ডাকেন অনেকে। ভাবা হয় যে, এই দলগুলোর জন্য শুধু অংশগ্রহণ করাটাই যথেষ্ট। কিন্তু এই চুনোপুঁটিরাই ইউরো চ্যাম্পিয়নশীপের আসরে রীতিমতো নাকাল করে ছেড়েছে অনেক বড় দলকে। ইউরো কাপের এই অঘটনগুলো নিশ্চিতভাবেই মনে করিয়ে দেয় যে শুধু সংখ্যা বাড়ানোর জন্যই অংশ নেয়না এই আন্ডারডগরা। বড় কিছু করার সামর্থ্য ও সম্ভাবনাও সুপ্ত থাকে তাদের মধ্যে।

১৯৮৮ সালের গ্রুপ পর্ব
১৯৮৮ সালের ইউরো কাপে প্রথমবারের মতো অংশ নিয়েছিল আয়ারল্যান্ড। আর ইংল্যান্ডের জন্য সেটা ছিল তৃতীয় আসর। একেবারেই নবাগত আয়ারল্যান্ড গ্রুপ পর্বের খেলায় ঘটিয়েছিল ইউরোর প্রথম অঘটন। ১-০ গোলে হেরে মাঠ ছেড়েছিল ইংল্যান্ড। সেসময় তাদের এই দলে ছিলেন গ্যারি লিনেকার, পিটার শেলটন, জন বার্নেসদের মতো কিংবদন্তী ফুটবলাররা। কিন্তু তারপরও হারের স্বাদ পেতে হয়েছিল ইংলিশদের। প্রথমার্ধের ৬ মিনিটে আয়ারল্যান্ডকে জয়সূচক গোলটি এনে দিয়েছিলেন আইরিশ মিডফিল্ডার রে হুজটন। এরপর পুরো খেলায় গোল শোধের আপ্রাণ চেষ্টা করলেও সফল হয়নি ইংল্যান্ড। কারণ আয়ারল্যান্ডের এই ১-০ গোলের জয়ের নেপথ্যে বেশ বড় ভূমিকা পালন করেছিলেন গোলরক্ষক প্যাট্রিক বোনার।

১৯৯২ সালের গ্রুপ পর্ব আগের আসরের মতো এবারও অঘটনের শিকার হয়েছিল ইংল্যান্ড। এবার তাদেরকে ২-১ গোলে হারিয়েছিল আন্ডারডগ সুইডেন। আর এই হারের ফলে গ্রুপ পর্ব থেকেই বিদায় নিতে হয়েছিল ইংল্যান্ডকে। গ্রুপ পর্বে নিজেদের শেষ ম্যাচে প্রথমার্ধের মাত্র ৪ মিনিটেই ইংল্যান্ডকে এগিয়ে দিয়েছিলেন ডেভিড প্লাট। প্রথমার্ধটা ১-০ গোলে এগিয়ে থেকেই শেষ করেছিল ইংলিশরা। কিন্তু দ্বিতীয়ার্ধে চমত্কারভাবে ঘুড়ে দাঁড়ায় স্বাগতিক সুইডেন। ৫১ মিনিটে গোল শোধ করে খেলায় সমতা ফেরান ডান এরিকসন। আর ৮২ মিনিটে দলকে জয়সূচক গোলটি এনে দেন সুইডিশ স্ট্রাইকার টমাস ব্রোলিন।

১৯৯২ সালের ফাইনাল
একই আসরের ফাইনালেও অঘটনের জন্ম দিয়েছিল ডেনমার্ক। সেবারের আসরে তারা বাছাই পর্বের বাধাই পেরোতে পারেনি। কিন্তু চূড়ান্ত আসর শুরুর মাত্র দুই সপ্তাহ আগে যুগোশ্লোভিয়াকে টপকে ইউরো কাপে খেলার সুযোগ পায় তারা। আর একমাস পরে তারাই পায় শিরোপা জয়ের স্বাদ। ফাইনালে তারা ২-০ গোলে হারিয়েছিল সেবারের অন্যতম ফেভারিট জার্মানিকে। প্রথমার্ধের ১৮ মিনিটে ডেনমার্কের পক্ষে প্রথম গোলটি করেছিলেন জেনসেন। আর দ্বিতীয়ার্ধের ৭৮ মিনিটে ডেনমার্কের ইতিহাসগড়া ম্যাচটির জয় নিশ্চিত করা গোলটি এসেছিল কিম ভিলফোর্টের পা থেকে।

১৯৯৬ সালের গ্রুপ পর্ব
ইউরো কাপের এই আসরে প্রথম ম্যাচটাতেই জার্মানির কাছে ২-০ গোলে হারের মুখ দেখেছিল চেক রিপাবলিক। দ্বিতীয় ম্যাচে তাদের প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী ১৯৯৪ সালের ফাইনালিস্ট ইতালি। এই ম্যাচটা হয়তো চেকদের জন্য ছিল কিছু একটা করে দেখানোর। আর সেটা খুব ভালোমতোই করেছিল তারা। ইতালিকে হারিয়েছিল ২-১ গোলে। এই হারের ফলে ইতালি ছিটকে পড়ে গ্রুপ পর্ব থেকেই। আর চেক রিপাবলিক শুধু পরবর্তী পর্বেই না, চলে গিয়েছিল সেই আসরের ফাইনাল পর্যন্তও। ইতালির বিপক্ষে এই ম্যাচটাতে প্রথমার্ধের ৫ মিনিটে চেক রিপাবলিককে এগিয়ে দিয়েছিলেন পাভেল নেদভেদ। কিন্তু ১৩ মিনিট পরেই খেলায় সমতা ফেরান ইতালিয়ান স্ট্রাইকার এনরিকো চিয়েসা। ৩৫ মিনিটে আবার চেক রিপাবলিককে চালকের আসনে বসান রাদেক বেজবেল। এই গোলটাই শেষপর্যন্ত ম্যাচের জয়সূচক গোল হিসেবে থেকে যায়।

২০০৪ সালের গ্রুপ পর্ব
এই আসরে প্রথমবারের মতো বড় কোন ফুটবল প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার সুযোগ পায় দক্ষিণ ইউরোপের ছোট্ট দেশ লাটভিয়া। গ্রুপ পর্বের প্রথম ম্যাচেই চেক রিপাবলিকের কাছে হেরেছিল ২-১ গোলে। দ্বিতীয় ম্যাচে যখন তারা তিনবারের ইউরো ও তিনবারের বিশ্বকাপশিরোপাজয়ী জার্মানীর মুখোমুখি হয়েছিল, তখন সবাই হয়তো অনুমান করেছিলেন যে, গোলবন্যায় ভাসতে যাচ্ছে লাটভিয়া। কিন্তু সবাইকে হতবাক করে দিয়ে জার্মানিকে রুখে দিয়েছিল তারা। সেই ম্যাচের গোলশূণ্য ড্র ফলাফলটাই ছিল একটা বিশাল অঘটন। জার্মানিকেও এই অঘটনের মাশুল দিতে হয়েছিল ভালোভাবেই। সেবার গ্রুপ পর্ব থেকেই বিদায় নিতে হয়েছিল ইউরোপের এই ফুটবল পরাশক্তিকে।

২০০৪ সালের ফাইনাল
১৯৯২ সালে ডেনমার্ক যেমন স্বাগতিক হওয়ার ফায়দা তুলে শিরোপা জয়ের স্বাদ পেয়েছিল, এক যুগ পরে ঠিক তেমনই একটা সুযোগ পেয়েছিল পর্তুগাল। সেসময়টা ছিল পর্তুগিজ তারকা লুইস ফিগো, রুই কস্তাদের সোনালি যুগ। ডেকো, রিকার্দো কারভালহোরা ছিলেন দুর্দান্ত ফর্মে। ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোও তখন প্রতিশ্রুতিশীল তরুন তুর্কি। নিজেদের মাটিতে আয়োজিত এই আসরই ছিল পর্তুগালের ইউরোপসেরা হওয়ার সবচেয়ে সুবর্ণ সুযোগ। স্বপ্নপূরণের দ্বারপ্রান্তেও চলে এসেছিল পর্তুগিজরা। কিন্তু ফাইনালে এসে অঘটনের শিকার হতে হয় স্বাগতিকদের। গ্রীসের কাছে ১-০ গোলে হেরে শেষ হয় তাদের শিরোপা জয়ের স্বপ্ন। দ্বিতীয়ার্ধের ৫৭ মিনিটে গ্রীসের পক্ষে জয়সূচক গোলটি করেন অ্যাঙ্গেলোস চারিস্তেস।

ইউরো কাপের আদিকথা ও চিনপরিচয়

১৯৬০ সালে প্রথম উয়েফা ইউরোপিয়ান ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপটা যখন বাস্তবে মাঠে গড়িয়েছিল, তখন আসলে পূরণ হয়েছিল হেনরি ডুলানির আজন্ম লালিত একটা স্বপ্ন। দীর্ঘদিন ফ্রান্স ফুটবল ফেডারেশনের অগ্রণী ব্যক্তি হিসেবে কাজ করা ডুলানিই ১৯২৭ সালে প্রথমবারের মতো প্রস্তাব করেছিলেন ইউরোপভিত্তিক জাতীয় এই ফুটবল প্রতিযোগিতা আয়োজনের। এরপর দীর্ঘদিন বর্তমানের এই ইউরো কাপটার বাস্তব রুপ দেওয়ার জন্য কাজ করে গেলেও সফল হননি তিনি। ১৯৫৫ সালে চিরনিদ্রায় শায়িত হন এসময়ের অন্যতম শীর্ষ এই ক্রীড়া প্রতিযোগিতার স্বপ্নদ্রষ্টা। তাঁর মৃত্যুর তিন বছর পরে, ১৯৫৮ সালে সিদ্ধান্ত হয় সেসময়ের উয়েফা ইউরোপিয়ান ন্যাশনস কাপ। ডুলানির স্মরণে ১৯৬০ সালে প্রথমবারের আসরটি আয়োজন করা হয়েছিল ফ্রান্সে। শিরোপাজয়ী দলকে যে শিরোপাটা তুলে দেওয়া হয় তাতেও ছিল ডুমিনির নাম। প্রথম আসরে এক উত্তেজনাপূর্ণ ফাইনালে যুগোস্লোভিয়াকে ২-১ গোলে হারিয়ে প্রথমবারের শিরোপাটা জিতেছিল তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন।
তৃতীয় আসর (১৯৬৮) থেকে প্রতিযোগিতাটির নাম দেওয়া হয় উয়েফা ইউরোপিয়ান ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপ। আর গত আসর থেকে সংক্ষেপে সালভিত্তিক নামকরণের প্রচলন হয়। ইউরো ২০০৮ এর মতো এবারের আসরকেও ডাকা হচ্ছে ইউরো ২০১২। আর মাত্র ১৬ দিন পর থেকে পোল্যান্ড ও ইউক্রেনের মাটিতে শুরু হতে যাচ্ছে ইউরোপের সবচেয়ে বড় এই জাতীয় ফুটবলের প্রতিযোগিতা। স্বাগতিক দুই দেশ ছাড়াও এবারের আসরে অংশ নিতে যাচ্ছে ক্রোয়েশিয়া, চেক রিপাবলিক, ডেনমার্ক, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, গ্রীস, ইতালি, জার্মানি, নেদারল্যান্ড, পর্তুগাল, আয়ারল্যান্ড, রাশিয়া সুইডেন ও গতবারের শিরোপাজয়ী স্পেন। চারটি করে গ্রুপে ভাগ হয়ে প্রথমে গ্রুপ পর্বে অংশ নেবে মোট ১৬টি দেশ। গ্রুপের প্রতিটি দলের মুখোমুখি লড়াইয়ের পর গ্রুপ তালিকার শীর্ষ দুইটি করে দল অংশ নেবে কোয়ার্টার ফাইনালে। এরপর সেমিফাইনাল এবং চূড়ান্ত ও অন্তিম লড়াই, ফাইনাল। এখানেই নির্ধারিত হবে যে, কোন দেশ পাবে আগামী চার বছরের জন্য ইউরোপসেরার খেতাব।
বিগত ১৩টি আসরের ইউরো কাপ শিরোপা জয়ের স্বাদ পেয়েছে মোট নয়টি দেশ। সবচেয়ে বেশি, তিনবার শিরোপা জিতেছে জার্মানি। ফ্রান্স ও স্পেন শিরোপার দেখা পেয়েছে দুইবার করে। আর একবার করে জিতেছে ইতালি, চেকোস্লোভিয়া, নেদারল্যান্ড, ডেনমার্ক, গ্রীস ও তৎকালিন সোভিয়েত ইউনিয়ন। কিন্তু সবচেয়ে মজার ব্যাপার হচ্ছে, এখন পর্যন্ত টানা দুইটি শিরোপা জিততে পারেনি কোন দেশই। এ থেকে এই প্রতিযোগিতার চরম প্রতিদ্বন্দ্বীতাপূর্ণ পরিস্থিতি সম্পর্কেও বেশ ভালোই অনুমান করা যায়। তবে এইবার সেই নতুন ইতিহাস গড়ার সুযোগ আছে স্পেনের সামনে। ২০০৮ সালে গত আসরের শিরোপা জিতেছিল বর্তমানে ফুটবলের এই এক নম্বর দলটি। দুই বছর পর বিশ্বকাপ জিতে বিশ্ব ফুটবলেও নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করেছেন ক্যাসিয়াস-জাভি-ইনিয়েস্তারা। আর এবারের ইউরো কাপেও তারা নিশ্চিতভাবেই বিবেচিত হবে শিরোপার অন্যতম প্রধান দাবিদার হিসেবে। এখন যদি তারা এক মাসের হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের পর শেষ হাসি হাসতে পারে, তাহলে স্পেনই হবে টানা দুইটি ইউরো চ্যাম্পিয়নশীপ জয়ী প্রথম দল।

শফিউলের স্বপ্নযাত্রা

মাত্র দুই বছর আগেও হয়তো বাংলাদেশ জাতীয় দলে সুযোগ পাওয়াটা একটা স্বপ্নই ছিল শফিউল ইসলামের কাছে। ছোটবেলা থেকেই বাংলাদেশের জার্সি পরে পাড়ায় পাড়ায় ক্রিকেট খেলতেন আর স্বপ্ন দেখতেন, একদিন হয়তো সত্যিকারের জাতীয় দলের জার্সিটাই গায়ে উঠবে। সেই স্বপ্নটা আজ বাস্তব। এতটাই জলজ্যান্ত বাস্তব যে পুরো বাংলাদেশই শামিল হয়েছে তাঁর এ স্বপ্নযাত্রায়। ঘরের মাঠের বিশ্বকাপে দুর্দান্ত পারফরমেন্স দেখিয়ে তিনি বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষের চোখেই পুরে দিয়েছেন রাশি রাশি স্বপ্ন।

বিশ্বকাপের শুরুটা অবশ্য খুব একটা ভালো হয়নি শফিউলের। ভারতের বিপক্ষে প্রথম ম্যাচটায় খুব বেশি কিছু আসলে করারও ছিল না তাঁর। শেবাগ, টেন্ডুলকার, বিরাট কোহলিদের দুর্দমনীয় ব্যাটিংয়ের সামনে দাঁড়াতেই পারেননি বাংলাদেশের এ তরুণ পেসার। শেবাগের ক্যারিয়ার-সেরা ইনিংসের দিনে অসহায় হয়েই থাকতে হয়েছিল তাঁকে। ৭ ওভার বল করে দিয়েছিলেন ৬৯ রান। ভারতীয় ইনিংসের শেষ বলে সান্ত্বনা হিসেবে পেয়েছিলেন ইউসুফ পাঠানের উইকেটটা। কিন্তু দ্বিতীয় ম্যাচে আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে চমত্কারভাবে ঘুরে দাঁড়ালেন শফিউল। আগে ব্যাট করে ২০৫ রানেই গুটিয়ে যাওয়ার পর বাংলাদেশ যখন হারের শঙ্কায় দুলছে, সেই মুহূর্তেই জ্বলে উঠলেন তিনি। শেষ পাঁচ ওভারে মাত্র ১১ রান দিয়ে তুলে নিলেন চারটি উইকেট। বাংলাদেশকে এনে দিলেন ২৭ রানের অসাধারণ এক জয়। পুরো দেশকে মাতালেন বিশ্বকাপ উন্মাদনায়।

ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে পরের ম্যাচটা নিয়ে বলার কিছুই নেই। পুরোটাই একটা দুঃস্বপ্ন হয়েই থেকে গেছে বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষের কাছে। সেই ম্যাচে তিনি বলও করেছিলেন মাত্র দুই ওভার।

চট্টগ্রামে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে আবারও চলা শুরু করল শফিউলের স্বপ্নরথ। এবার তিনি নিজেকে চেনালেন নতুন করে। ইংল্যান্ডের ছুড়ে দেওয়া ২২৬ রান তাড়া করতে নেমে ১৬৯ রানেই ৮ উইকেট হারিয়ে বাংলাদেশ তখন দিশেহারা। অনেকেই বেরিয়ে গিয়েছিলেন স্টেডিয়াম থেকে। হার নিশ্চিত ধরে নিয়েছিলেন প্রায় সবাই। কিন্তু এবার ঝলসে উঠল শফিউলের ব্যাট। নবম উইকেট জুটিতে মাহমুদউল্লাহ সঙ্গে ৫৮ রানের অবিচ্ছিন্ন জুটি গড়ে বাংলাদেশকে উপহার দিলেন এক মহাকাব্যিক জয়। খেললেন ২৪ বলে ২৪ রানের এক লড়াকু ইনিংস। ফিরিয়ে আনলেন গত বছর ব্রিস্টলে ইংল্যান্ড বধের স্মৃতি। জোরদার করলেন টাইগারদের কোয়ার্টার ফাইনালে যাওয়ার সম্ভাবনা।

আগের ম্যাচগুলোতেই নিজেকে অপরিহার্য হিসেবে প্রমাণ করার কাজটা ভালোভাবে করে ফেলেছিলেন শফিউল। কিন্তু তিনি থামলেন না এখানেই। গতকাল হল্যান্ডের বিপক্ষে দেখা গেল অন্য এক শফিউলকে। এতটাই পরিণত বোলিং করলেন যে কখনো কখনো মনে পড়ে গেল ম্যাকগ্রা-ডোনাল্ডদের নিখুঁত লাইন-লেংথের কথা। কোনো উইকেট না পেলেও হল্যান্ডকে মাত্র ১৬০ রানে বেঁধে ফেলার পেছনে তাঁর ১০টি ওভারের মূল্য কোনো অংশেই কম না। ৯.২ ওভার বল করে তিনি দিয়েছিলেন মাত্র ১৫ রান। ম্যাচ শেষে হল্যান্ড অধিনায়ক পিটার বোরেনকেও আলাদাভাবে স্বীকার করতে হয়েছে শফিউলের বোলিং নৈপুণ্যের কথা। বলেছেন, ‘শফিউল আজ খুবই চমত্কার বোলিং করেছে। কোনো খারাপ বল করেনি। আমরা রান বের করার অনেক চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছি। আমরা আসলে অসহায় হয়ে পড়েছিলাম। সে কোনো উইকেট পায়নি বটে, কিন্তু তার বেশ কয়েকটি উইকেটই প্রাপ্য ছিল।’

তবে শফিউলের এ দুর্দান্ত পারফরমেন্সের পর অনেকেরই আফসোস একটাই। সবগুলো ম্যাচে বাংলাদেশ তাঁর হাত ধরে জয় পেলেও কোনো ম্যাচেই ম্যাচ-সেরার পুরস্কারটা ওঠেনি এই পেসারের হাতে। শফিউল নিজে অবশ্য এতে কিছুই মনে করছেন না। গতকাল হল্যান্ডের বিপক্ষে ছয় উইকেটের জয়ের পর তিনি বলেছেন, ‘ঠিক আছে। এটা কোনো ব্যাপার না। সবচেয়ে বড় কথা হলো, আমরা জিততে পেরেছি। ম্যাচ-সেরার পুরস্কারটা তো শুধুই একটা অলংকার।’

শফিউলের এ স্বপ্নযাত্রা অব্যাহত থাকুক, এটা বোধহয় শফিউলের চেয়েও এখন বাংলাদেশের মানুষই আরও বেশি করে চায়। ওয়েবসাইট।

ধোনির আফসোস

বিশ্বকাপের শুরু থেকেই অনেকের চোখ ছিল হরভজন সিংয়ের দিকে। উপমহাদেশের স্পিনারবান্ধব উইকেটে ভারতের শিরোপা জয়ের লক্ষ্য পূরণে এই অফস্পিনার একটা ভালো ভূমিকা পালন করতে পারবেন এমনটাই আশা করেছিলেন সবাই। কিন্তু প্রথম চার ম্যাচে সবাইকে হতাশই করেছিলেন ‘ভাজ্জি’। পেয়েছিলেন মাত্র ২ উইকেট। কিন্তু গতকাল দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে গ্রুপের গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে ফিরেছিলেন পুরোনো রুপে। একটু খরুচে প্রমাণিত হলেও দক্ষিণ আফ্রিকার তিন বিধ্বংসী ব্যাটসম্যান হাশিম আমলা, ডি ভিলিয়ার্স ও জে পি ডুমিনির উইকেট তুলে নিয়ে জয়ের আশা জাগিয়েছিলেন ভারতীয় শিবিরে। কিন্তু শেষটা আশানরুপ হলো না হরভজনের। টেন্ডুলকারের অনবদ্য শতকের মতো বৃথা গেল তাঁর এই প্রত্যাবর্তনও।

শ্বাসরুদ্ধকর ম্যাচে দুই উইকেটের জয় দিয়ে ভারতীয় শিবিরকে হতাশায় ডোবালেন প্লেসিস, পিটারসেনরা। হতাশাটা হয়তো হরভজনের আরেকটু বেশিই হতে পারে। শেষ ওভারে ধোনি যদি বলটা আশিস নেহরার হাতে না দিয়ে তাঁর হাতে দিতেন, তাহলে হয়তো শেষ হাসিটা তাঁরাই হাসতে পারতেন। কী হতে পারত, এ নিয়ে আলাপ করে অবশ্য এখন খুব বেশি লাভ নেই। কিন্তু শেষ ৬ বলে যখন ১৩ রান দরকার, সেসময় হরভজনকে বোলিংয়ে না এনে, নেহরাকে দিয়ে বল করানোর সিদ্ধান্তটা অনেককেই অবাক করেছে। সমালোচনার মুখেও পড়তে হয়েছে ভারতীয় অধিনায়ককে। ম্যাচ শেষে তাই আফসোস করা ছাড়া আর কিছুই করার ছিল না ধোনির। ম্যাচ পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে ধোনির সাফাই, ‘শেষ ওভারের জন্য আশিসই উপযুক্ত ছিল। সে ভালো বোলিং করেছিল। আমি ভেবেছিলাম তাকে দিয়েই কাজ হবে। আমাকে এই সিদ্ধান্তের জন্য দোষারোপ করতে পারেন। কিন্তু আমার মনে হয়েছিল, পেসার দিয়েই আমাদের জয়ের কাজটা ভালোভাবে হবে।’

ধোনির আফসোস শুধু এই একটা জায়গাতেই না। ব্যাটিংয়েও তাঁর আস্থার প্রতিদান দিতে পারেন নি সতীর্থরা। শচীনের ৪৮তম ওয়ানডে সেঞ্চুরি, শেবাগের ৭৩ ও গৌতম গম্ভীরের ৬৯ রানের লড়াকু ইনিংসের সুবাদে মাত্র ৪০ ওভারেই ভারতীয় স্কোরবোর্ডে যুক্ত হয়েছিল ২৬৮ রান। সবাই ভাবছিলেন ভারতের রান বুঝি ৩৫০ ছাড়িয়ে যাবে। কিন্তু শেষ ১০ ওভারে শুধু আসা-যাওয়াই করেছেন বাকি ব্যাটসম্যানরা। উইকেটের অপর প্রান্তে দাঁড়িয়ে শুধু আফসোসই করতে হয়েছে ধোনিকে। ১০ বল বাকি থাকতে ২৯৬ রানেই গুটিয়ে যাওয়ার পর শুধু হতাশ হওয়া ছাড়া আক্ষরিক অর্থেই আর কিছুই করার ছিল না তাঁর। মাঠ ছেড়েছেন ১২ রানে অপরাজিত থেকে। শেষ তিন ওভারে মাত্র চার রানের বিনিময়ে পাঁচটি উইকেট নিয়ে ম্যাচসেরার পুরস্কারটা ঝুলিতে ভরেছেন ডেল স্টেইন। ভারতকে দিয়েছেন এবারের বিশ্বকাপের প্রথম পরাজয়ের স্বাদ।

ইংল্যান্ড ও দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে গ্রুপ পর্বের দুইটা বড় ম্যাচেই একেবারে শেষমুহূর্তে জয়বঞ্চিত হতে হয়েছে ভারতকে। গতকাল ম্যাচটা জিততে পারলে কোয়ার্টার ফাইনাল নিশ্চিতই করে ফেলতে পারত ধোনি-বাহিনী। এই হারের ফলেও হয়তো শেষ আটে যাওয়া আটকাবে না স্বাগতিকদের। কিন্তু বড় দলগুলোর বিপক্ষে এই শেষ মুহূর্তের আফসোসগুলো নিয়ে সত্যিই ভাবতে হবে ধোনিকে। রয়টার্স

ফিরে আসুক ব্রিস্টলের স্মৃতি

বাঁচা-মরার লড়াইয়ে আজ চট্টগ্রামের জহুরুল হক স্টেডিয়ামে ইংল্যান্ডের মুখোমুখি হতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে গত ম্যাচের ভয়াবহ লজ্জার দুঃসহ স্মৃতি মুছে দেওয়ার প্রত্যয় নিয়েই নিশ্চয়ই মাঠে নামবেন সাকিব-তামিমরা। বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষও সেই প্রত্যাশা নিয়েই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে।

অন্যদিকে অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে অ্যাশেজ সাফল্যের পর এবারের বিশ্বকাপের অন্যতম ফেভারিটের তকমা আাঁাটা ইংল্যান্ড এখনও পর্যন্ত খুব বেশি সুবিধা করে উঠতে পারে নি। ভারতের সঙ্গে টাই আর আয়ারল্যান্ডের কাছে হারের পর বেশ টলোমলো অবস্থায় পড়ে গিয়েছিল স্ট্রাউস বাহিনী। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে গ্রুপ পর্বের অতি গুরুত্বপূর্ণ খেলাটাতে তারা শেষপর্যন্ত হারতে হারতেও পেয়েছে ৬ রানের অবিশ্বাস্য জয়। তার উপর পিটারসেন আর স্টুয়ার্ট ব্রডের ইনজুরিতেও কিছুটা ছন্দপতন হতে পারে ইংল্যান্ড শিবিরে।

চট্টগ্রামের জহুরুল হক স্টেডিয়ামে এই বাংলাদেশ-ইংল্যান্ড ম্যাচটা প্রথমবারের মতো অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে ফ্লাডলাইটের আলোয়। দিবা-রাত্রির এই গুরুত্বপূর্ণ লড়াইটার ক্ষেত্রে টসে জিতে ব্যাট করতে পারাটা একটা বাড়তি সুবিধা আনতে পারে বলে ধারণা করছেন ক্রিকেট বোদ্ধারা। গতকাল দুপুরে অনুশীলনের সময় বেশ কিছুক্ষণ ধরে চট্টগ্রামের হালকা বাদামী এই উইকেটটা পর্যবেক্ষণ করেছেন ইংলিশ অধিনায়ক অ্যান্ডি স্ট্রাউস, বোলিং কোচ মুশতাক আহমেদ, গ্রান্ড ফ্লাওয়াররা। স্পিনাররা এই পিচে নিশ্চিতভাবেই একটা বড় ভূমিকা পালন করবে বলে ধারণা করছেন অনেকে। সেক্ষেত্রে পিটারসেনের অফ স্পিনের অভাবটা কিছুটা টের পেতে পারেন স্ট্রাউস। আজ জিততে পারলেই কোয়ার্টার ফাইনালের টিকিটটা অনেকখানিই নিশ্চিত করে ফেলতে পারবে ইংলিশরা।

অন্যদিকে বাংলাদেশের লড়াইটা প্রত্যাবর্তনের। ভয়াবহ দুঃসময়ের ঘোর কাটিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর। আজ নিশ্চিতভাবেই বাংলাদেশের প্রধান প্রেরণা হিসেবে কাজ করবে গত বছর ব্রিস্টলে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ৫ রানের সেই অসাধারণ জয়। সেই ম্যাচের জয়ের নায়ক মাশরাফি-বিন-মোর্তজাকে অবশ্য আজ মাঠে পাওয়া যাবে না। তবে এবারের ম্যাচটা কিন্তু হতে যাচ্ছে নিজেদের মাঠে। সাকিবরা পাশে পাবে বাংলাদেশের হাজার হাজার দর্শককে। এটাও নিশ্চয়ই বাড়তি শক্তি জোগাবে বাংলাদেশ শিবিরে।

আব্দুর রাজ্জাক, সাকিব আল হাসানের স্পিন আক্রমণ দিয়ে ইংলিশ ব্যাটসম্যানদের অল্প রানেই বেঁধে ফেলার পরিকল্পনা করছে বাংলাদেশ। কিন্তু টাইগারদের প্রধান দুশ্চিন্তার জায়গা নড়বড়ে ব্যাটিং অর্ডার। প্রথম ম্যাচে ভারতের বিপক্ষে ২৮৩ রানের বড় স্কোর গড়ে আশা জাগালেও পরের দুইটা ম্যাচে শুধু ভয়াবহ হতাশাই উপহার দিয়েছেন বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা। কোচ জিমি সিডন্সও গতকাল অনুশীলনে আলাদাভাবে সময় দিয়েছেন ইমরুল কায়েস, জুনায়েদ সিদ্দিকীদের। আজ মিডলঅর্ডারে আশরাফুলের পরিবর্তে মাঠে নামতে পারেন মাহমুদুল্লাহ। সেক্ষেত্রে বোলার মাহমুদুল্লাহর থেকে ব্যাটসম্যান মাহমুদুল্লাহর উপরই প্রত্যাশাটা বেশি থাকবে বাংলাদেশ সমর্থকদের।

গত বছর ব্রিস্টলে ইংল্যান্ডকে হারিয়েই টেস্ট খেলুড়ে সবগুলো দেশকে পরাজয়ের স্বাদ দেওয়ার গৌরব অর্জন করেছিল টাইগাররা। আজ বাংলাদেশ ক্রিকেটের অসময়ে আবারও সেই ব্রিস্টলের মধুর স্মৃতিটাই ফিরে আসুক— এই আশাতেই প্রহর গুনছে গোটা বাংলাদেশ।