Posts Tagged ‘ পাকিস্তান ’

হুদহুদের নাম “হুদহুদ” কেন?

হুদহুদ। অদ্ভুত! সত্যিই, নামটা একটু অদ্ভুতই বটে! সম্প্রতি যে ঘূর্ণিঝড়টি ভারত-বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকার লাখো মানুষের জীবন বিপন্ন করে তুলেছে -এটা তারই নাম। কিন্তু বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট এই ঘূর্ণিঝড়টি কিভাবে পেল এই নাম? এর মানেই বা কী? কিভাবে করা হয় এই ঘূর্নিঝড়গুলোর নামকরণ?

Hudhud1

বঙ্গোপসাগরের দক্ষিণ আন্দামান সাগরে সৃষ্টি হয়ে মহা শক্তিশালী এই ঘূর্ণিঝড় আঘাত হেনেছে ভারতের অন্ধ্রপ্রদেশে। প্রায় স্থবির হয়ে পড়েছে বাংলাদেশ ও ভারতের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের উপকূলীয় এলাকা। ১৭০ কিলোমিটার বেগে ধেয়ে আসা এই ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলায় নেওয়া হয়েছে নানা পদক্ষেপ। অথচ প্রবল এই ঘূর্ণিঝড়ের নামটি কিন্তু এসেছে ওমান থেকে।
হুদহুদ আসলে একটি পাখির নাম। আফ্রিকা, ইউরোপ ও এশিয়ার অনেক অঞ্চলেই দেখতে পাওয়া যায় আকর্ষণীয় পালক, ঝুঁটি ও লম্বা ঠোঁটের এই পাখিটিকে। ‘হুপি’ নামের এই পাখিকেই ওমান ভাষায় ডাকা হয় হুদহুদ বলে। এটি ইসরায়েলের জাতীয় পাখিও বটে। ২০০৪ সালে যখন আরব সাগর ও বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড়গুলোর নামকরণের আহ্বান জানানো হয় তখন অন্য আরও কিছু নামের সঙ্গে এই হুদহুদ নামটাও যোগ করেছিল ওমান।

Hudhud
আটলান্টিক মহাসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড়গুলোর নামকরণ করা হয় ১৯৫৩ সাল থেকে। শুরুটা মিয়ামির জাতীয় হারিকেন সেন্টারে হলেও পরবর্তীতে এই নামকরণ প্রক্রিয়া পরিচালিত হয় বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থার (ডব্লিউএমও) তত্ত্বাবধানে। কিন্তু দক্ষিণ এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলের ঘূর্ণিঝড়গুলোর নামকরণ প্রথা চালু হয়েছে ২০০৪ সাল থেকে। তার আগে এই অঞ্চলের ঘূর্ণিঝড়গুলো যা করার সেটা বেনামেই করত।
ঘূর্ণিঝড়গুলোর গতিপ্রকৃতি বোঝা, কার্যকরীভাবে সতর্কতা জারি, ক্ষয়ক্ষতির পরিমান নির্নয় ইত্যাদির জন্য ঘূণিঝড়গুলোর নামকরণ করা উচিৎ বলে শক্ত পদক্ষেপ নেন আবহাওয়াবীদরা। অবশেষে ২০০৪ সালে আরব সাগর ও বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড়গুলোর নামকরণের জন্য একজোট হয় আটটি দেশ। ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, মালদ্বীপ, মিয়ানমার, ওমান, শ্রীলঙ্কা ও থাইল্যান্ড। প্রতিটি দেশ প্রস্তাব করে আটটি করে নাম। দেশের নামের আদ্যাক্ষর অনুযায়ী একের পর এক আসে র্ন্বিাচিত নামগুলো।
এ বছরের জুনে আরব সাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড়, নানাউকের নামকরণ করেছিল মিয়ানমার। এবার এসেছে ওমানের পালা। ২০০৭ সালের প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় সিডরের নামটিও এসেছিল ওমান থেকে। এই অঞ্চলের পরবর্তী ঘূর্ণিঝড়টির নাম হবে নিলোফার। এটি এসেছে পাকিস্তান থেকে।
বাংলাদেশের প্রস্তাবকৃত পাঁচটি নাম ইতিমধ্যেই ব্যবহৃত হয়ে গেছে। অনিল (২০০৪), অগ্নি (২০০৬), নিশা (২০০৮), গিরি (২০১০) ও হেলেন (২০১৩)। বাংলাদেশের দেওয়া আরও তিনটি নাম ভবিষ্যতে ব্যবহার হবে। সেগুলো হলো: চপলা, অক্ষি ও ফনি।

Cyclone Names

Cyclone Names2
২০০৪ সাল পর্যন্ত যে এই ঘূর্ণিঝড়গুলোর নামকরণ করা যায়নি তার একটা অন্যতম প্রধান কারণ সনাক্ত করতে গিয়ে ভারতের ঘূর্ণিঝড় সতর্কতা সেন্টারের প্রধান ড. এম মহাপত্র বলেছেন, ‘এই ধরণের বৈচিত্র্যময় একটা সাংস্কৃতিক অঞ্চলে ঘূর্ণিঝড়ের নামকরণ করতে গিয়ে সবাইকে খুবই সতর্ক আর নিরপেক্ষ থাকতে হয়, যেন এটা কারও অনুভূতিতে আঘাত না করে।’
তবে অনেক সতর্কতা অবলম্বন করার পরেও বিপত্তি যে বাধেনি, তা কিন্তু নয়। ২০১৩ সালের ঘূর্নিঝড় মহাসেনের নামকরণ করেছিল শ্রীলঙ্কা। কিন্তু এই নামটা নিয়ে প্রবল আপত্তি জানিয়েছিলেন দেশটির অনেক মানুষ। তারা বলেছিলেন যে, মহাসেন ছিলেন একজন শ্রীলঙ্কান রাজা, যিনি সেখানে এনেছিলেন শান্তি ও সমৃদ্ধি। তাঁর নামে এমন একটা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের নামকরণ করাটা একেবারেই অনুচিত। পরবর্তীতে শ্রীলঙ্কান কর্তৃপক্ষ ঘূর্ণিঝড়টির নাম বদলে রেখেছিল ভিয়ারু।

সাবাশ বাংলাদেশ, এ পৃথিবী অবাক তাকিয়ে রয়

এই মুহূর্তে মনে হয় সত্যিই পৃথিবী তাকিয়ে আছে বাংলাদেশের দিকে। বা বলা যায় তাকানো শুরু করেছে, কিছুটা সংশয়, কিছুটা আশাবাদ, কিছুটা কৌতুহল-বিস্ময় নিয়ে। গত ৫ ফেব্রুয়ারি শাহবাগ আন্দোলন শুরু হওয়ার পর আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনগুলো থেকে আমরা সেরকমই একটা ইঙ্গিত পেয়েছি। আন্তর্জাতিক মিডিয়ার কাভারেজের পরিমাণ বা ধরণ নিয়ে অনেকেরই অনেক সমালোচনা আছে। আমার নিজেরও আছে। কিন্তু এর মধ্যেও, বাংলাদেশের এই গণজাগরণ যে পুরো বিশ্বের সামনেই একটা বিকল্প রুপকল্প দাঁড় করিয়েছে, সে কথা উঠেছে বর্হিবিশ্ব থেকেই। এবং বাংলাদেশ যে বিশ্বকে আরও অনেক শিক্ষা-বার্তা দিতে পারে; শাহবাগ চত্বর যে পুরো বিশ্বের সামনেই নতুন এক দিগন্ত উন্মোচন করতে পারে, তেমন সম্ভাবনার কথাও উচ্চারিত হয়েছে বর্হিবিশ্বের মানুষদের মুখে। এবং তারা এই সম্ভাবনার কথা বলেছেন সম্ভ্রমের সঙ্গে, আশার সঙ্গে। কিন্তু কেন এই সম্ভ্রম, আশাবাদ?  পুরো বিশ্ব কেন তাকিয়ে আছে শাহবাগ চত্বরের ঐক্যবদ্ধ তারুণ্যের দিকে?

1

১৯৭১ সালে যে হানাদার পাকসেনাদের বিরুদ্ধে রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছিলাম, ৪২ বছর পর শাহবাগ আন্দোলন তার প্রথম শিক্ষাটা দিয়েছে এই পাকিস্তানকেই। দীর্ঘ ৪২ বছর ধরে পাকিস্তানের শাসকেরা তাদের নাগরিকদের-শিক্ষার্থীদের শিখিয়েছে ভুল ইতিহাস। বাংলাদেশ নামক ভূখণ্ডের এই মানুষগুলো যে সবক্ষেত্রে প্রচ্ল অনাচার-বৈষম্য-নির্যাতন-নিপীড়ণের শিকার হওয়ার পর স্বাধীনতার ডাক দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, সেই ইতিহাসটা পাকিস্তানের বেশিরভাগ মানুষ জানে না। বা যারা জানে, তাদের বৃহদাংশ মনে করে শুধুমাত্র সেনাবাহিনীর প্রশাসনিক ব্যর্থতার কারণে বাংলাদেশ একটা স্বাধীন দেশ হিসেবে দাঁড়াতে পেরেছে। এবং অনেকেই মনে করেন যে, স্বাধীন বাংলার জন্ম না হলেই ভালো হতো।

কিন্তু এই রকমের ইতিহাস বিকৃতির ফলাফল যে ভালো হয় না সেটা খুব স্পষ্টভাবে বলেছেন পাকিস্তানের এক ইতিহাসের শিক্ষক। ১৮ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের ট্রিবিউন পত্রিকায় প্রকাশিত এক লেখায় ইয়াকুব খান বাঙগাস লিখেছেন,

‘১৯৭০-৭১ সালের ঘটনাগুলোর দিকে আমাদের দৃষ্টি দিতে না চাওয়ায় আমরা এখনো আমাদের অন্যান্য সাংবিধানিক প্রদেশগুলো নিয়ে অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে আছি। এবং আমরা নিজেদের পৃথক পৃথক পরিচিতি নিয়ে গর্ব বোধ করতে পারি না। আমরা ভয় পাই যে, সিন্ধু আমাদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে কারণ সেখানকার মানুষেরা উর্দুর পাশাপাশি তাদের ভাষাটারও স্বীকৃতি চায়। আমরা বেলুচিস্থানে একটা সামরিক অপারেশন চালিয়েছি তার প্রধান কারণ হলো, সেখানকার মানুষেরা তাদের প্রদেশটি নিজেরাই পরিচালনা করতে চেয়েছে। আমরা অস্বস্তিতে আছি এটা ভেবে যে, দক্ষিণ পাঞ্জাব ও বাহাওয়ালপুর আলাদা প্রদেশ হয়ে যায় কিনা। সেখানে একটা আকস্মিক অভ্যুত্থান ঘটে যায় কিনা, এই ভয়ে আমরা ব্যাপারগুলো নিয়ে আলাপ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছি এবং আমরা গিলগিট-বালিস্তানের মানুষদের পূর্ণ নাগরিক অধিকার দেই নি। এগুলোর বেশিরভাগই হচ্ছে ঐ বিগত দিনের ঘটনাগুলোর ভূত। আমরা সেগুলো নিয়ে ভাবতে চাই না, অগ্রাহ্য করি আর আশা করি যে, আলৌকিকভাবে সেগুলো নিজে থেকেই গায়েব হয়ে যাবে।’

কিন্তু তেমনটা যে বাস্তবে হয় না, সেকথাও পরিস্কারভাবেই বলেছেন ইয়াকুব খান। এবং পাকিস্তান যদি এই সমস্যাগুলোর কার্যকর সমাধান করতে চায়, তাহলে দেশটির শাসকদের বাংলাদেশের কাছ থেকেই শিক্ষা নিতে হবে বলে মত দিয়েছেন ইতিহাস বিভাগের এই শিক্ষক। তিনি বলেছেন, ‘ ইতিহাস খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শুধু এই কারণে না যে, সেটা নিজে থেকেই পুনরাবৃত্তি ঘটায় বা ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা আছে। বরং ইতিহাস এইজন্যও গুরুত্বপূর্ণ যে, বারংবার ঐতিহাসিক ঘটনাগুলো অগ্রাহ্য করা একটা দেশের জাতিগত চেতনায় প্রভাব ফেলে। এবং পুরো দেশটাই পুরোনো ঐ ঘটনাগুলোর কবলে জিম্মি হয়ে থাকে।’ সমাধান হিসেবে তিনি পাকিস্তান সরকারকে দেখিয়েছেন ভুল স্বীকার করার পথ। লিখেছেন, ‘পাকিস্তানি সরকারের জন্য এটাই সুবর্ণ সময়, তত্কালিন পূর্ব পাকিস্তানের মানুষদের উপরে তারা যে বর্বরতা চালিয়েছিল সেটা আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার করার। সত্য ঘটনাকে সামনে নিয়ে আসবে এমন ঐতিহাসিক দলিলগুলো এতদিন ধরে তারা লুকিয়ে রেখেছে। সেগুলো সবার জন্য উন্মুক্ত করতে রাজি হতে হবে। সেমময়কার যেসব অপরাধী এখনো বেঁচে আছে তাদেরকে আইনের আওতায় এনে ন্যায়বিচার করতে হবে। জনসমক্ষে ঘোষণা দিতে হবে যে, ১৯৭০-৭১ সালে আমরা একটা জাতি হিসেবে, হ্যাঁ, আমরা, সামগ্রিকভাবে যা করেছি সেটার জন্য আমরা দুঃখিত।’ সেটা পাকিস্তান সরকার করবে কিনা, সেটা তাদের ব্যাপার।

আমাদেরকে তো এই মুহূর্তে দেশের পরিস্থিতি নিয়েই ভীষণভাবে উদ্বিগ্ন থাকতে হচ্ছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার ৪২ বছর পরেও আমাদেরকে জিম্মি হয়ে থাকতে হচ্ছে খোদ স্বাধীনতাবিরোধী গোষ্ঠীটির সহিংস হুমকির কাছে। যেখানে খোদ পাকিস্তানেই মুক্তিযুদ্ধের সময়কার যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আওতায় হাজির করার দাবি উঠছে, সেখানে স্বাধীন বাংলাদেশে এখনো তাণ্ডব চালিয়ে যেতে পারছে পাক বাহিনীর সহোদর জামায়াত-শিবির। এই কি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অর্জন?

যেখানে খোদ পাকিস্তানেই আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে এবারের একুশে ফেব্রুয়ারি পালিত হয়েছে বেশ সমাদরের সঙ্গে, সেখানে বাংলাদেশের একুশে ফেব্রুয়ারিতে জামায়াত-শিবির বিভিন্ন জায়গায় শহীদ মিনার ভেঙ্গেছে। ইতিহাসের কি নির্মম পরিহাস! মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্য ভেঙ্গে, বাস-ট্রেনে আগুন দিয়ে, বোমাবাজি-ককটেলবাজি করে জনমনে ত্রাস ছড়িয়েছে এই পাকিস্তানের প্রেতাত্মারা। আর গণজাগরণকে অস্বীকার করে, পুরো দেশের মানুষের নায্য দাবীর আন্দোলনকে অস্বীকার করে নব্য রাজাকারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে প্রধান বিরোধীদল বিএনপি। তারা যে শুধু নিজেরা ক্ষমতায় যাওয়ার জন্যই আন্দোলন করে, সেকথা এখন পুরোপুরি স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে দেশের মানুষের কাছে। তাহলে কি দেশে শুধু আওয়ামী লিগেরই রাজনীতি থাকবে? তখন বিরোধী দল কে হবে? বামদলগুলো নাকি ইসলামপন্থী দলগুলো? তৃতীয় শক্তির আবির্ভাব হবে? নাকি শক্তিশালী বিরোধী দলের অনুপস্থিতিতে দেশ চলে যাবে ফ্যাসিবাদী শাসনের কবলে? উত্তর এখন জানা নেই, ভাবতে হবে সবাইকেই।

তবে এই প্রশ্নগুলোর উপস্থিতি এটাই ইঙ্গিত দেয় যে, বর্তমানে বাংলাদেশ একটা সংকটপূর্ণ পরিস্থিতি পার করছে। কিন্তু অনেক খারাপ সংবাদ, মেনে নিতে না পারার মতো পরিস্থিতির মধ্যেও এবারের সংকটটা তৈরি হয়েছে অনেক অনেক আশা নিয়ে, অনেক অনেক স্বপ্ন নিয়ে। ৫২, ৬৯, ৭১, ৯০-এর মতো ২০১৩ সালের ইতিহাসটাতেও লিপিবদ্ধ হচ্ছে জনমানুষের উপস্থিতি। জনগণের সংঘবদ্ধতা, তারুণ্যের তীব্র দীপ্তি, মুক্তিকামী মানুষের সংহতি-সৃজনশীলতা দিয়ে ২০১৩-র ইতিহাস রচিত হচ্ছে। এটাই অনেক আশার কথা। অনেক বড় স্বপ্ন দেখার জায়গা। সত্যিকারের গণজাগরণে, মানুষের মুষ্ঠিবদ্ধ হাতের ঐক্যবদ্ধতায় ভুল হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে। এখন আমাদের সামনে, সাধারণ জনগণের সামনে সুবর্ণ সুযোগ এসেছে রাজাকার-যুদ্ধাপরাধীদের নিমূল করে ‘সোনার বাংলা’ গড়ার স্বপ্ন দেখার। দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে দেশকে সত্যিকারের স্বাধীন করার সময় বোধহয় এখনই। এবারের এই জেগে ওঠা তারুণ্য যদি আবার প্রতারিত হয়, তাহলে তার চেয়ে হতাশার বোধহয় আর কিছুই থাকবে না। আর আমাদের সামনে অনুপ্রেরণা হিসেবে তো অনেককিছু আছে। ৫২ আছে, ৬৯ আছে, ৭১ আছে, ৯০ আছে। আমরা তো অনেকখানি এগিয়েই গেছি। এখন আমাদের শুধু ইতিহাস থেকে শিক্ষাটা নিয়ে শুরু করে দিলেই হয়। তবে তার আগে আত্মসমালোচনা দরকার। আত্মশুদ্ধির প্রক্রিয়া দরকার। ভুল স্বীকার করে নিতে পারার মানসিকতা দরকার। সবারই। ব্যক্তিমানুষেরও, সংগঠনেরও। সরকারেরও। এটাই বোধহয় আমাদের প্রকৃত মানবিকতার দিকে নিয়ে যেতে পারে। ভুল কারো হতেই পারে। কিন্তু ভুল প্রমাণিত হওয়ার পরে সেটা স্বীকার করে নিতে পারার মতো বিনীত আমাদের হওয়া উচিত্।

জামায়াত-শিবির এখন পর্যন্ত যেসব নাষকতা চালিয়েছে, তার সবকিছুই তারা করছে বিভ্রান্তিমূলক, প্রতারণামূলক প্রচারণার মাধ্যমে। যেগুলো কিছু কিছু ক্ষেত্রে হাস্যরসেরও উপাদান হয়। কিন্তু এটা তো তারা করতে পারছে। কেন করতে পারছে? এটা কি আমাদেরই ব্যর্থতা না? কেন স্বাধীনতার ৪২ বছর পরেও যুদ্ধাপরাধীদের সংগঠন জামায়াত-ই-ইসলামি এইভাবে ধর্মের নামে মানুষকে ক্ষেপিয়ে তুলতে পারছে? শাহবাগের এই নায্য দাবী, এখানকার তরুণেরা একুশ-মুক্তিযুদ্ধের চেতনা দ্বারা যেভাবে অনুপ্রাণিত হয়েছে, ২য় মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে যেভাবে ‘সোনার বাংলা’ গড়ার স্বপ্ন দেখছে, সেটা কি পুরো দেশের মানুষ অনুধাবন করছেন? সবার কাছে কী গণজাগরণের দৃপ্ত তারুণ্যের দিপ্তী পৌঁছাচ্ছে? আমরা কি ১৬ কোটি মানুষের বাংলাদেশে বিরাজমান শিক্ষাগত-সাংস্কৃতিক ব্যবধান-বৈষম্য ঘোঁচানোর কথা ভাবছি?

জামায়াত-শিবির স্বাধীনতার পর গত ৪২ বছরে যেভাবে পুরো দেশজুড়ে তাদের বহুবিধ বিস্তার ঘটিয়েছে সেটা হুট করে গায়েব করে দেওয়া সম্ভব না। নিষিদ্ধ করার মাধ্যমে তাদেরকে অনেকটাই দুর্বল করে দেওয়া যায় কিন্তু পুরোপুরি নির্মুল হয়তো করা যাবে না। কারণ আজ চাঁদের গায়ে সাঈদী দেখাচ্ছে, কাল মেঘের গায়ে মওদুদীকে দেখাবে। এবং কে জানে, সেটা দেখেও হয়তো অনেক ধর্মভীরু মানুষ প্রাণের তোয়াক্কা না করে রাস্তায় বেরিয়ে আসবে বাস-ট্রেন পোড়াতে, বোমাবাজি করতে। সেধরণের পরিস্থিতি মোটেই কাম্য নয়। অহিংস গণজাগরণের মানসিকতায় সেই পরিস্থিতির ঠাঁয় নাই। ফলে আমার মতে, জামায়াত-শিবির নির্মূল করার জন্য শিক্ষা ও সংস্কৃতির বৈষম্য ঘোঁচানোর কাজ শুরু করাটা খুবই জরুরি। সত্যিকার অর্থেই দেশের প্রতিটি কোনায় কোনায়, গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে দেওয়া উচিত্ ৭১-এর এই পুনরুদ্ধারিত চেতনার আগুন। মানুষ শুধু একবার এই শাহবাগের তরুণদের কথা শোনার অপেক্ষায় আছে। দেশ গড়ার যে তেজী প্রত্যয় নিয়ে অনেক তরুণ শাহবাগে পড়ে আছে দিনের পর দিন, তাদের দৃপ্ত মুখটা দেখলেই হয়তো এই শাহবাগ আন্দোলন নিয়ে সংশয়ে ভোগা অনেক মানুষ প্রাণপণে দাঁড়িয়ে যাবেন জামায়াত-শিবিরের নাষকতার বিরুদ্ধে। দেশে একমাত্র সাংস্কৃতিক প্রচার দিয়েই শান্তির পায়ড়া ওড়ানো সম্ভব, অহিংস উপায়ে। এখন আমরা সম্মিলিতভাবে এই দায়িত্ব পালন করতে পারব কিনা, সেটাই হচ্ছে প্রশ্ন।

এই মুহূর্তে আসলে শুধু বাংলাদেশই না, পুরো বিশ্বই একটা সংকটপূর্ণ পরিস্থিতি পার করছে। আর সত্যিই হয়তো এই যুদ্ধপিড়ীত, বিপন্ন বিশ্ব তাকিয়ে আছে বাংলাদেশের দিকে। এখন হয়তো বর্হিবিশ্বে এই শাহবাগ আন্দোলন নিয়ে অনেকের মধ্যে বিভ্রান্তি-সংশয়-নেতিবাচকতা  আছে। ভবিষ্যত্ নিয়ে উত্কণ্ঠা আছে। কিন্তু অনেকেই শাহবাগ আন্দোলনের ভবিষ্যত্ দেখার জন্য তাকিয়ে আছেন প্রচ্ল কৌতুহল নিয়ে। তারা এখান থেকে পাচ্ছেন নতুন দিনের ইঙ্গিত, তারা খুঁজে বের করছেন এই আন্দোলনের অনন্যতা, এই আন্দোলনের সম্ভবনা। কে জানে!

02-21-2013motherlanguage

এই আশাবাদের কারণ হচ্ছে, পুরো বিশ্বকেই পথ দেখানোর নজির বাংলাদেশের ইতিহাসে আগেও আছে। ভাষা যে মনুষ্য সমাজের খুবই গুরুত্বপূর্ণ উপাদান, এবং এই ভাষার অধিকার ছাড়া যে একটা জাতির বিকাশ সম্ভব না, এই সত্যটা পুরো পৃথিবীকে রক্তের বিনিময়ে জানিয়েছিলেন ভাষা শহীদেরা। মনুষ্যবিকাশের পথে ভাষা-সংস্কৃতির যে অপরিহার্যতা, তার প্রতি এখন সহমত পোষণ করেছে পুরো বিশ্ব। ১৯৯৯ সালে ২১শে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেওয়া হয়। আর তারপর থেকে পুরো বিশ্বে নানাভাবে বেড়েছে ভাষা বিষয়ক গবেষণা, প্রতিবেদন, চিন্তাভাবনা। ২০০০ সালের পর থেকে এখন পর্যন্ত মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষ্যে ভাষিক বৈচিত্র্য, বিপন্ন বা বিলুপ্তির হুমকির মুখে থাকা ভাষাগুলো সংরক্ষণ, মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের প্রয়োজনীয়তা, ব্রেইল ও সংকেত ভাষার উন্নয়ন, তথ্যপ্রযুক্তি ও ভাষার সম্পর্ক, বহুভাষিক শিক্ষা ইত্যাদি বিষয় নিয়ে কাজ করেছে জাতিসংঘ। ফলে, বাংলাদেশ আরও একবার নতুন কিছু দিতেই পারে পুরো বিশ্বকে। শাহবাগ আন্দোলন থেকে আরও অনেক শিক্ষাবার্তা, সংকেত-ইশারা হয়তো আগামীতেও পেতে পারেন বর্হিবিশ্বের মুক্তমনা উত্সুক ব্যক্তি/সংগঠন। কে জানে, তারা বোধহয় তেমন কিছু একটা আশাও করছেন?

যে যুদ্ধ বাংলাদেশ কোনদিন ভুলবে না

৪০ বছর আগে মুক্তিযুদ্ধে গর্জে ওঠা বন্দুকের আওয়াজ থেমে গিয়েছে কিন্তু স্বাধীনতাকামী সেই রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের ক্ষতচিহ্ন এখনো রয়ে গেছে বাংলাদেশের বুকে

C2

বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা একটা কোলাহলপূর্ণ, উত্তেজনাময় শহর। এখানে আছে প্রচুর প্রাণপ্রাচুর্য আর তর্ক-বিতর্ক। নিশ্চল হয়ে থাকা ট্রাফিক জ্যামের বিশাল বিশৃঙ্খলার মধ্যে প্রায়শই দেখতে পাওয়া যায় হরতাল-মিছিল-প্রতিবাদ। এগুলো বিশাল সংখ্যক মানুষের জন্যই হয়তো দুঃখ-দুর্দশার কারণ। কিন্তু এই দেশটা জন্মানোর সময় এমন এক জাতীয় চেতনা গড়ে দিয়েছে যেটা কখনোই পুরোপুরি সনাক্ত করা হয়নি। সেই চেতনা দিয়েই সবাই তাড়িত হচ্ছে। শাহবাগে জাতীয় জাদুঘরের সামনে এখন যে প্রতিবাদটা জারি আছে, সেটা একটা অভূতপূর্ব প্রকৃতির। একটা নজীরবিহীন আকারের।

গত ৫ ফেব্রম্নয়ারি থেকে, বাংলাদেশ অবশ হয়ে আছে এই চলমান, বিশালাকারের প্রতিবাদের কারণে। হাজার হাজার মানুষ শাহবাগ চত্বর দখল করে প্রতিবাদ জানাচ্ছেন ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় সংঘটিত যুদ্ধাপরাধেদের বিচারের জন্য গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুন্যালের ঘোষিত একটি রায়ের বিরুদ্ধে। এই যুদ্ধাপরাধীদের একজন আবুল কালাম আজাদকে এর আগে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। এরপরে, আরেকজন যুদ্ধাপরাধী, ৭১-এর গণহত্যার সঙ্গে জড়িত সংগঠন জামায়াতে ইসলামীর সহযোগী সাধারণ সেক্রেটারী আব্দুল কাদের মোল্লাকে দেওয়া হয়েছে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের সাজা। এর প্রতিবাদে শুরু হওয়া ও এখনো চলমান প্রতিবাদটার নেতৃত্ব দিচ্ছেন সমাজের চিন্তাশীল আর উদার মন মানসিকতার মানুষেরা। তারপরও তাঁরা কাদের মোল্লাসহ অন্যান্য অভিযুক্ত যুদ্ধাপরাধীদের অবিলম্বে ফাঁঁসির রায় কার্যকর করার দাবি জানাচ্ছেন।

৭১ এ সংঘটিত গণহত্যাটি সম্পর্কে পশ্চিমের মানুষ খুব কমই জানে। তাছাড়াও পার্টিজান তার্কিক ও স্বার্থান্বেষী ইতিহাসবিদদের মধ্যে বিষয়টি অস্বীকার করার প্রবণতা দেখা যায় বিস্ময়কর মাত্রায়। ১৯৭১ সালের আগে, বাংলাদেশ বা তত্কালিন পূর্ব পাকিস্তান মূল পাকিস্তানের সঙ্গে ভৌগলিকভাবে যুক্ত ছিল না। এই রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতারা বিশ্বাস করতেন যে, ধর্মের ঐক্যই এই পৃথকীকৃত দুই অঞ্চলের মানুষকে একসঙ্গে ধরে রাখবে। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে সংস্কৃতির বৈপরীত্য তীব্রভাবে বেড়ে উঠতে থাকে। পাকিস্তানি শাসকদের একটি বড় অংশ বাঙ্গালিদের বিবেচনা করত ঘৃণ্য সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে।

১৯৬৭ সালে একটি আত্মকথায়, জেনারেল আইয়ুব খান লিখেছিলেন, ‘পূর্ব বাঙ্গালিদের মধ্যে উত্পীড়িত জাতির সবগুলো প্রবৃত্তিই আছে… তাদের জটিলতা, নতুন কিছুর প্রতি অনীহা আর নিরাপত্তামূলক আগ্রাসন… উদ্ভুত হয়েছে এই ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট থেকে।’ অত্যন্ত সমৃদ্ধ একটি সেকুলার সংস্কৃতির প্রতি (পাকিস্তানি শাসকদের) সাধারণ এই শত্রুভাবাপন্ন মনোভাবটা একটা মীমাংসাকারক/চরম পর্যায়ে পৌঁছায় যখন আওয়ামী লীগের নেতা শেখ মুজিব জাতীয় নির্বাচনে জয়লাভ করেন। তাঁকে সেসময় কারাবন্দী করা হয় আর মার্চ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশের অধিবাসীদের উপর বর্বর গণহত্যা চালায় পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী।

C1

পাকিস্তান কখনোই তারা যা ঘটিয়েছিল সেটার দায়দায়িত্ব স্বীকার করেনি। আর এর বাইরেও, ইতিহাসবিদ ও সাংবাদিকেরা বিপদজনকভাবে এই গণহত্যাটাকে অস্বীকারই করে গেছেন। বা নিহত হওয়া মানুষদের সংখ্যা কমিয়ে বলার প্রবণতা তাদের মধ্যে দেখা গেছে। পাকিস্তানের আনুষ্ঠানিক হিসাব থেকে দেখা যায় নিহতের সংখ্যা মাত্র ২৬ হাজার। উদ্বাস্তু হয়েছিলেন মাত্র ২০ লাখ মানুষ। সম্প্রতি অক্সফোর্ডের এক ইতিহাসবিদ ঘোষণা দিয়েছেন যে, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় নিহতের সংখ্যা দুই পক্ষ মিলিয়ে ৫০ হাজার থেকে এক লাখের বেশি কোনভাবেই না। অবশ্য এই ইতিহাসবিদের গবেষণাপদ্ধতি তীব্র নিন্দার মুখে পড়েছিল।

এটা যদি সত্যি হয় তাহলে বলতে হবে, পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী তাদের উচ্চাকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী মানুষ হত্যা করতে পারেনি। ১৯৭১ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি এক বৈঠকে পাকিস্তানের তত্কালিন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ক্ষুব্ধস্বরে বলেছিলেন, ‘ ৩০ লাখ বাঙ্গালিকে মেরে ফেল, তারপর বাকিরা এমনিতেই আমাদের হাতে খাবে।’ এক কোটি মানুষ উদ্বাস্তু হয়ে ভারতে পাড়ি জমিয়েছিল, ৩ কোটি মানুষ শহর ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন গ্রামের বাড়িতে।

যুদ্ধের প্রথম ধাপে, হত্যার জন্য টার্গেট করা হয় তরুণ, হিন্দু, আওয়ামী লিগের সদস্য, শিক্ষার্থী- বুদ্ধিজীবী-চিন্তকদের। যুদ্ধের দ্বিতীয় ধাপে, টার্গেট বানানো হয় নারীদের। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের দোসররা সেসময় অন্তত দুই লাখ নারীকে ধর্ষণ করে। পরবর্তীতে ধর্ষণের শিকার প্রায় ২৫ হাজার নারী নিজেদের আবিস্কার করে গর্ভবতী অবস্থায়। কাজেই এই ক্রোধ কোনভাবেই শান্ত করা যায় না। এমন অনেক প্রত্যক্ষদর্শী আছেন যাঁরা বলেছেন যে, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী সেসময় অনেক ‘ধর্ষণ-ক্যাম্প’ স্থাপন করেছিল। ধর্ষিতা নারীদের সংখ্যা ও তাদের নাম-পরিচয় নিয়ে প্রায়শই বিতর্ক হয়। বাংলাদেশের প্রথম নেতা শেখ মুজিব এই তালিকা নষ্ট করে ফেলার আদেশ দিয়েছিলেন, যেন এই লজ্জা সেই নারীদের আজীবন বয়ে বেড়াতে না হয়।

মুক্তিযুদ্ধের শেষ সপ্তাহে, যখন পাকিস্তানের পরাজয় সুনিশ্চিত আর একটা নতুন দেশের জন্ম অনিবার্য, তখন ১২-১৪ ডিসেম্বরের মধ্যে দেশের বুদ্ধিবৃত্তিক নেতাদের (যতো জনকে সম্ভব) হত্যা করার একটা নৃশংশ পরিকল্পনা করে পাকিস্তান। অন্তত একজন পাকিস্তানি অফিসারের ডায়েরিতে ভবিষ্যত্ রাষ্ট্রটির সম্ভাবনাময় নেতাদের নাম পাওয়া গিয়েছিল।

সশস্ত্র বাহিনী গঠন করে পাকিস্তানিদের সহায়তা করেছিল বাঙ্গালী বিশ্বাসঘাতকেরা। আল শামস ও আল বদর নামের সংগঠন দুইটি এই নৃশংশ হত্যাকাণ্ডের নেতৃত্ব দিয়েছিল। বাংলাদেশের বিজয় অবশ্যম্ভাবী এটা জেনে যাওয়ার পরও চূড়ান্ত বিজয়ের মাত্র দুই দিন আগে তারা এই ঘৃণ্য কাজটা করেছিল।

সত্যিকারের নিহত সংখ্যাটা জানা সত্যিই অসম্ভব ব্যাপার। ইতিহাসবিদ আর জে রুমেল ঐ সময়ের ঘটনাটিকে অন্যান্য যে কারো চাইতে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন। তিনি এভাবে ইতি টেনেছেন, ‘পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যার শিকার হতে পারে ৩ থেকে ৩০ লাখ পর্যন্ত। বা খুব সাবধানী হয়ে বললে, বলা যায় সংখ্যাটা দেড় লাখ।’ স্কলার বিনা ডি’কস্তার মতে,  মুক্তিযুদ্ধের সময় নিহতের এই সংখ্যাটা পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিকভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। বাংলাদেশের সরকারের জন্য, নিহতের সংখ্যা বেশি থাকলে সেটা নবগঠিত নতুন দেশটিকে অধিকতর নায্যতা দেবে। আর অপরদিকে পাকিস্তানের জন্য সংখ্যাটা কমাতে পারলে বা সেটাকে উপেক্ষা করতে পারলে তারা একটা অবিশ্বাস দেখাতে পারবে। যেটা তারা এখনো করে যাচ্ছে। সত্যিকারের সংখ্যাটা যাই হোক, হাজার হাজার মানুষকে পাকিস্তানি বাহিনী যেরকম  নির্মমভাবে হত্যা করেছে, সেটা হয়তো কারও কল্পনাতেও আসা সম্ভব না। হাজার হাজার ঘটনার মধ্যে, সবার একটা জিনিস পড়া উচিত্। ট্রাইবুন্যালে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সময় এক সাহসী নারী নিজের অভিজ্ঞতার কথা বলেছেন। তিনি তাঁর পরিবারের একমাত্র জীবিত ব্যক্তি। তিনি বলেছিলেন, কিভাবে চোখের সামনে তিনি বাবা-মা, দুই বোন ও মাত্র দুই বছর বয়সী ভাইকে হত্যা করতে দেখেছেন। তারপর নিজে ১২ জনের সম্মিলিত ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। সেসময় তাঁর বয়স ছিল মাত্র ১৩ বছর।

এগুলো ৪০ বছর আগের ঘটনা। যুদ্ধাপরাধী পাকিস্তানি সেনাদের কখনোই বিচারের আওতায় আনা হয়নি। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর, পাকিস্তানের দিক থেকে বলা হয়েছিল যদি তাদের একজন সৈন্যকেও ধরে রাখা হয় তাহলে পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্থিত কোন বাঙ্গালিকে যেতে দেওয়া হবে না। খুব সম্প্রতি পাকিস্তানি বাহিনীর সহায়তা করা বাংলাদেশীদের বিচার শুরু হয়েছে। ট্রাইবুন্যালের এই বিচারকাজ চলছে এখন পর্যন্ত সক্রিয় থাকা জামায়েতী ইসলামের অব্যাহত সহিংস হুমকির মুখে। কিছু যুদ্ধাপরাধী বিদেশে পালিয়ে গেছে। ১৯৯৫ সালে, এরকমই কিছু অভিযুক্ত যুদ্ধাপরাধীদের দিকে বৃটিশ কর্তৃপক্ষের নজর ফিরিয়েছিলেন ঢাকার সাংবাদিক ডেভিড বার্গম্যান, একটি প্রামাণ্যচিত্রের মাধ্যমে। এদের মধ্যে একজন চৌধুরি মুইনউদ্দিন এখন কাজ করছেন এনএইচএস প্রশাসক হিসেবে। এই মানুষদেরকে কেবল বিচারের অধিনে আনার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।

গত শতকের অন্যতম নিষ্ঠুর কিছু গণহত্যাকারী শান্তিপূর্ণ অবসর পালন করতে পেরেছেন সাধারণ ক্ষমা আর কূটনৈতিক ঔদ্ধত্যের কারণে। ব্যাপারটা প্রায়শই প্রতিবাদের মুখে পড়লেও সেই প্রতিবাদকারীরা কোন সফলতা পাননি। ১৯৯২ সালে শহীদ জননী জাহানারা ইমাম যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের উদ্যোগ নিয়েছিলেন গণমানুষকে সঙ্গে নিয়ে। কিন্তু সফলতার মুখ দেখতে পারেননি। অবশেষে ২০০৮ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুন্যাল গঠিত হয়। এটার কর্মপ্রক্রিয়া ধীরগতির। আর সবাই অনুভব করেছে যে, আগামী নির্বাচনের আগেই এই বিচারকাজ শেষ করতে হবে। কারণ বিরোধীদলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার উপর মানুষের কোন আস্থা নাই। তিনি প্রকাশ্যেই জামায়াতে ইসলামীর রাজনৈতিক সহযোগী হিসেবে ভূমিকা পালন করেন। তিনি যে ট্রাইবুন্যালের কাজ চালিয়ে যেতে দেবেন বা এখন পর্যন্ত যাদের সাজা দেওয়া হয়েছে সেগুলো টিকে থাকতে দেবেন, সেটা মানুষ বিশ্বাস করে না।

cov

কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায় শুনে জনগণ ফুঁসে উঠেছিল কারণ তারা জানত, যেমনটা আগেও দেখা গেছে, যে পরিমাণ সাফল্য অর্জন করা সম্ভব সেটা শেখ হাসিনার সরকার অর্জন করতে পারেনি। আর সরকারের পরিবর্তন হলে সেটা প্রায় নিশ্চিতভাবেই কারাবন্দী যুদ্ধাপরাধীদের ক্ষমা করার দিকে মোড় নেবে। এরকমটা অতীতেও কয়েকবার দেখা গেছে। তাই বাংলাদেশের আপামর জনগণ যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবি উঠিয়েছেন, যেন কোন রাজনীতিবিদই এটা উল্টিয়ে দিতে না পারেন।

ফাঁসির দাবিতে জনগণের এই প্রতিবাদ এই দীর্ঘদিনের নৈরাশ্য থেকেই উত্থিত হয়েছে। এই মানুষগুলো এতদিন আবেগপূর্ণভাবেই আইনের শাসনের উপর বিশ্বাস রেখেছে। বিগত সময়ে তারা বেশ কয়েকবার দেখেছে যে, বিচারকার্য অনেকক্ষেত্রে সম্পাদিত হয়ে থাকে রাজনীতিবিদদের আদেশে। অনেক ক্ষেত্রে সম্পন্নও হতে পারে না। কিন্তু কাদের মোল্লার বিচারকার্য নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে পর্যবেক্ষকেরা ও চিন্তক বাঙ্গালীরা। শাহবাগ আন্দোলনের চাপের ফলে শেখ হাসিনা সরকার ট্রাইবুন্যালের বিচারকার্যে হস্তক্ষেপ করেছে। সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে রাষ্ট্রপক্ষের দিক থেকে রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের সুযোগ তৈরি করেছে। সবকিছুর উপরে, এটা গুরুত্বপূর্ণ যে, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলো বর্বর হত্যাকারীদের তুলনায় নিজেদেরকে আরও উন্নত অবস্থায় নিয়ে যাবে। তারপরও এই সম্ভাবনা থেকে যায় যে, ইতিহাসের কিছু ঘৃণ্য যুদ্ধাপরাধী কখনোই বিচারের অধীনে আসবে না। তাদেরকে সহায়তাকারী দালালদের হয়তো মাত্র এক বা দুই বছরের কারাদণ্ড ভোগ করতে হবে। এই বিষয়টিই প্রতিবাদকারীদের হতাশার দিকে ঠেলে চিয়েছে।

তাহলে এর সমাধান কী? যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কর্মকাণ্ড নিয়ে গুরুতর সংশয় তৈরি হয়েছে। আর এই ফাঁসির রায়ও কোন সঠিক সমাধান হতে পারে না। কিন্তু গণহত্যাকারীদের যাবজ্জীবন সাজার রায়টাও বাংলাদেশী নাগরিকদের জন্য কোন সম্মান বয়ে আনে না।

এখন আরেকটি সম্ভাবনা থেকে যায়। লাইবেরিয়ার যুদ্ধাপরাধী চার্লস টেলরকে লাইবেরিয়াতে কারাদণ্ড দেওয়া হয়নি। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের কয়েকটি ধারার অধীনে তাকে কারাবন্দী করা হয়েছিল হেগ-এ। আন্তর্জাতিক আইনপ্রণেতাদের হস্তক্ষেপ বাংলাদেশের ক্ষেত্রে কাম্য হতে পারে। এতে করে গণহত্যাকারীদের জাতীয় রাজনীতিবিদদের নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত করা যাবে। এরকমটা করা গেলে, শুধু বাংলাদেশের রাজাকারদেরই না, মূল যুদ্ধাপরাধীদের বিচারও করা সম্ভব হবে।

৭১ সালে যে বাংলাদেশ যে নৃশংশ হামলার শিকার হয়েছিল সেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আর সরকার পরিবর্তনের সাথে সাথে যেন সেটা কেউ নিজ স্বার্থে ব্যবহার করতে না পারে সেটাও জরুরি বিষয়। এখন এমনটাই মনে হচ্ছে যে, এই বিক্ষুব্ধ জাতীয় চেতনা যদি সফলতার মুখ দেখতে চায়, যদি ন্যায়বিচার পেতে চায় তাহলে সেটা বর্হিবিশ্বের চোখের সামনে করতে হবে। বর্হিবিশ্বের মতামতও নিতে হবে। আর গোটা বিশ্বের মানুষদের প্রতি বলছি, আমরা অনেকদিন মুখ ঘুরিয়ে থেকেছি। এই প্রায় ভুলে যাওয়া গণহত্যাটি সম্পর্কে জানা আমাদের কর্তব্য। আর এখানে আমাদের অনেক দায়দায়িত্বও গ্রহণ করতে হবে। গণহত্যাকারীদের আশ্রয় দেওয়া যাবে না। অগ্রাহ্য করা যাবে না। ভুলে যাওয়া যাবে না।

মিরপুরের কসাই

বাংলাদেশ জামায়েতী ইসলামের সহকারী জেনারেল সেক্রেটারী আব্দুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে ঘোষিত যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায় জনগকে বিক্ষুব্ধ করে তোলে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি যে ঘৃণ্য কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেছিলেন তার বিচারকার্য শেষে গত ৫ ফেব্রুয়ারী তাকে এই সাজা দেওয়া হয়। আদালতের এই রায়ে তিনি স্পষ্টতই খুশি হয়েছিলেন। কোর্ট থেকে বাইরে যাওয়ার সময় তিনি সমর্থকদের উদ্দেশ্যে দেখিয়েছেন বিজয় চিহ্ন। কিন্তু মিরপুরের কসাইখ্যাত কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে এই রায়ে মুহূর্তের মধ্যেই ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বাংলাদেশের সাধারণ জনগণ। ৭১ সালে কাদের মোল্লা এক কবির মাথা কেটে নেন, ১১ বছর বয়সী এক মেয়েকে ধর্ষণ করেন। আর হত্যা করেন ৩৪৪ জনকে। এখন এই কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসির রায় ঘোষণা করার দাবি জানাচ্ছেন বাংলাদেশের মানুষ। আরেক অভিযুক্ত যুদ্ধাপরাধী আবুল কালাম আজাদকে যেমনটা দেওয়া হয়েছে।

ফিলিপ হেনশার

লেখাটি গত ১৯ ফেব্রুয়ারী ছাপা হয়েছিল যুক্তরাজ্যের দৈনিক ইনডিপেনডেন্ট পত্রিকায়।

শাহবাগ স্কয়ার আমাদের তাড়িয়ে বেড়াবে

শাহবাগ চত্বর নিয়ে আওয়াজ উঠেছে খোদ পাকিস্তানেও। প্রথমে দেখা গিয়েছিল অবসরপ্রাপ্ত এক পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপকের লেখা। সেখানে তিনি বলেছিলেন যে, শাহবাগ আন্দোলন নিয়ে পাকিস্তানের মানুষদের কোন মাথাব্যাথা নেই। কেন নেই, পাকিস্তানি ছেলে-মেয়েদের ছোট থেকে যে ভুল ইতিহাস শেখানো হয়, সেটা তিনি বলেছিলেন  “শাহবাগ স্কয়ার: পাকিস্তান কেন জানতে আগ্রহী নয়” শিরোনামের লেখাটিতে। আর একদিন পরে ঐ ট্রিবিউন পত্রিকাতেই এসেছে আরও একটি লেখা। এবার ইতিহাসের শিক্ষক ইয়াকুব খান বাঙগাস বলছেন যে, কেন শাহবাগ চত্বরের হাজারো মানুষের সম্মিলিত প্রতিবাদ ধ্বনি পাকিস্তানের নাগরিকদের শোনা প্রয়োজন। ইতিহাসকে এতদিন ধরে ভুলভাবে উপস্থাপন করার ফলেই যে আজ পাকিস্তানের এত করুণ অবস্থা সেটা লেখক বেশ স্পষ্টভাবেই বলেছেন। একই সঙ্গে ১৯৭০-৭১ সালে তৎকালিন পাকিস্তানি শাসকেরা যে অন্যায়-অবিচার করেছিল, জনগণের নায্য দাবিকে অগ্রাহ্য করে নিষ্ঠুর দমন-পীড়ণ চালিয়েছিল, সেজন্য যেন পাকিস্তান সরকার বাংলাদেশের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চায়, সেই দাবিও জানিয়েছেন ইয়াকুব খান।

Shahbag Square will haunt us_ImageShahbag Square will haunt us_Image2

ফেব্রুয়ারির ১৬ তারিখে পারভেজ হুদভয় এই ট্রিবিউন পত্রিকাতেই একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন। যেখানে তিনি বলেছিলেন যে, কেন পাকিস্তানের শিক্ষার্থীরা শাহবাগ স্কয়ার নিয়ে কোন কথা বলতে চায় না বা এটা সম্পর্ক কিছু জানতেও চায় না। কাকতালীয়ভাবে, আমিও যখন কয়েকদিন আগে আমার কিছু ছাত্র-ছাত্রীকে এই প্রসঙ্গে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, তখন আমিও পেয়েছিলাম এই একইরকম ফাঁকা দৃষ্টি। প্রথম প্রশ্নটা হচ্ছে, কেন আমাদের গণমাধ্যম ঢাকার এই প্রতিবাদের ব্যাপারটাকে প্রকাশ করছে না। কিন্তু এর থেকেও গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে, কেন আমরা শাহবাগের তরুণদের প্রতিবাদটা সম্পর্কে জানার পরও এটা নিয়ে আগ্রহ দেখাচ্ছি না বা ভাবতে চাচ্ছিও না।
গত দশকে বা আরেকটু বেশি সময়ে আমাদের দেশের গণমাধ্যম খুব বিকশিত হয়েছে। আর এখন এটা অনেকাংশেই মুক্ত- কিন্তু সেটা কুখ্যাতভাবে। যদিও গণমাধ্যমের ক্ষেত্রে ‘মুক্ত’ শব্দটির পাশাপাশি চলে আসে পক্ষপাতহীনতার ব্যাপার। আর যদি একটা গণমাধ্যম একইসঙ্গে ‘মুক্ত ও নিরপেক্ষতার’ বিচারে পরিচালিত না হয়, তাহলে সেই গণমাধ্যমের স্বাধীনতাটা হয়ে যায় ফাঁপা/ধোঁয়াশে। শাহবাগ স্কয়ারের প্রতিবাদ বা ১৯৭০-১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধের বিচার করতে বাংলাদেশ সরকার যে ট্রাইবুন্যাল গঠন করেছে, এই ঘটনাগুলো সরাসরিই পাকিস্তানের সঙ্গে জড়িত। আর তাই এই বিষয়গুলোকে ক্রমাগত উপেক্ষা করে যাওয়াটা শুধু অন্যায্যই না, অনৈতিকও বটে। আমি আশা করব, এখন অন্তত পাকিস্তানের ‘মুক্ত ও নিরপেক্ষ’ গণমাধ্যমের পতাকাবাহকেরা শাহবাগ স্কয়ারের খবরগুলোর অনুপস্থিতির বিষয়টি এড়িয়ে যাবেন না এবং সেগুলো সংশোধনের দায়িত্ব নেবেন।
বলা হয়েছে যে, সত্যিকারের সমস্যা হচ্ছে, পাকিস্তানের নাগরিকেরা ১৯৭০-৭১ সালের ঘটনাগুলো নিয়ে আলাপ করতে আগ্রহী না। যেন ব্যাপারটা এমন যে, তখন কী ঘটেছিল সেটাকে এড়িয়ে যেতে পারলে বা সেটার সঙ্গে সংযুক্ত না হলেই সেগুলো উবে যাবে। না, দুঃখিত, তেমনটা হবে না। ইতিহাস খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শুধু এই কারণে না যে, সেটা নিজে থেকেই পুনরাবৃত্তি ঘটায় বা ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা আছে। বরং ইতিহাস এইজন্যও গুরুত্বপূর্ণ যে, বারংবার ঐতিহাসিক ঘটনাগুলো অগ্রাহ্য করা একটা দেশের জাতিগত চেতনায় প্রভাব ফেলে। এবং পুরো দেশটাই পুরোনো ঐ ঘটনাগুলোর কবলে জিম্মি হয়ে থাকে। আমরা যেমন এখনো ১৯৪৭ সালের ঘটনাগুলোর কাছে জিম্মি হয়ে আছি। আর এখনো আমরা সেগুলোকে মোকাবিলা করতে অস্বীকার করে যাচ্ছি। তেমনিই আমরা এখনো ১৯৭০-৭১ সালে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোর সামনা-সামনি দাঁড়াচ্ছি না। ১৯৪৭ সালের ঘটনাগুলো মোকাবিলা না করার ফলে এখন ভারতের সম্পর্কে আমাদের একটা বাজে ধারণা গড়ে উঠেছে। আমরা ভারতীয় মুসলিমদের (আমাদেরকে শেখানোও হয়েছে এইভাবে। ভারতের অগ্রগামী মুসলিমরা ‘সত্যিকারের মুসলিম নন’) অর্জনগুলো সহ্য করতে পারি না। আর দেশের মধ্যে আমরা এই অগ্রাহ্য করার সংস্কৃতি ও বিচ্ছিন্নতামূলক পাকিস্তানের দাবি জিইয়ে রেখেছি। যেগুলোর প্রভাব আমরা প্রায়শই পরিস্কারভাবে দেখতে পাই আহমাদি, শিয়া, খৃষ্টান ও হিন্দুদের উপর হামলার ঘটনাগুলোর মধ্যে।
একইভাবে, ১৯৭০-৭১ সালের ঘটনাগুলোর দিকেও আমাদের দৃষ্টি দিতে না চাওয়ায় আমরা এখনো আমাদের অন্যান্য সাংবিধানিক প্রদেশগুলো নিয়ে অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে আছি। এবং আমরা নিজেদের পৃথক পৃথক পরিচিতি নিয়ে গর্ব বোধ করতে পারি না। আমরা ভয় পাই যে,  সিন্ধু আমাদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে কারণ সেখানকার মানুষেরা উর্দুর পাশাপাশি তাদের ভাষাটারও স্বীকৃতি চায়। আমরা বেলুচিস্থানে একটা সামরিক অপারেশন চালিয়েছি তার প্রধান কারণ হলো, সেখানকার মানুষেরা তাদের প্রদেশটি নিজেরাই পরিচালনা করতে চেয়েছে। আমরা অস্বস্তিতে আছি এটা ভেবে যে, দক্ষিণ পাঞ্জাব ও বাহাওয়ালপুর আলাদা প্রদেশ হয়ে যায় কিনা। সেখানে একটা আকস্মিক অভ্যুত্থান ঘটে যায় কিনা, এই ভয়ে আমরা ব্যাপারগুলো নিয়ে আলাপ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছি এবং আমরা গিলগিট-বালিস্তানের মানুষদের পূর্ণ নাগরিক অধিকার দেই নি। এগুলোর বেশিরভাগই হচ্ছে ঐ বিগত দিনের ঘটনাগুলোর ভূত। আমরা সেগুলো নিয়ে ভাবতে চাই না, অগ্রাহ্য করি আর আশা করি যে, আলৌকিকভাবে সেগুলো নিজে থেকেই গায়েব হয়ে যাবে।
সম্প্রতি, আমি আমার শিক্ষার্থীদের প্রশ্ন করেছিলাম যে, কেন তারা চার বছরেরও বেশি সময় ধরে পাকিস্তানের ইতিহাস বিষয়ক একই পাঠ্যসূচি পড়ে যাচ্ছে? যখন বছরের পর বছর ধরে একই ঘটনাগুলোর পুনরাবৃত্তিই তাদেরকে করে যেতে হচ্ছে, তাহলে সেটা তারা করছে কেন? খুবই অল্প কিছু শিক্ষার্থী এটার কারণ চিহ্নিত করতে পেরেছিল যে, এই পুনরাবৃত্তি একজনের মধ্যে  বিরক্তি ও ক্লান্তি তৈরি করে। এবং তারা একসময় এসব বিষয়ে কোনরকম প্রশ্ন করা বন্ধ করে দেয়। একারণেই, একজন শিক্ষার্থী বলেছিল, পাকিস্তান স্টাডিজের সব উত্তরই এক।
কিছু ঘটনা সম্পর্কে মিথ্যার পুনরাবৃত্তি আর সেটাকে জোর করে গায়েব করে দেওয়ার চেষ্টা করার মাধ্যমে ইতিহাসকে যদি এতো সহজে পুরোপুরি মুছে ফেলা সম্ভব হতো, তাহলে হয়তো আমি ইতিহাসের শিক্ষক হিসেবে চাকরি পেতাম না, আর আমার বিভাগ বন্ধ হয়ে যেত।
পাকিস্তানি সরকারের জন্য এটাই সুবর্ণ সময়, তৎকালিন পূর্ব পাকিস্তানের মানুষদের উপরে তারা যে বর্বরতা চালিয়েছিল সেটা আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার করার। সত্য ঘটনাকে সামনে নিয়ে আসবে এমন ঐতিহাসিক দলিলগুলো এতদিন ধরে তারা লুকিয়ে রেখেছে। সেগুলো সবার জন্য উš§ুক্ত করতে রাজি হতে হবে। সেমময়কার যেসব অপরাধী এখনো বেঁচে আছে তাদেরকে আইনের আওতায় এনে ন্যায়বিচার করতে হবে। জনসমক্ষে ঘোষণা দিতে হবে যে, ১৯৭০-৭১ সালে আমরা একটা জাতি হিসেবে, হ্যাঁ, আমরা, সামগ্রিকভাবে যা করেছি সেটার জন্য আমরা দুঃখিত।
হাজার হাজার বাংলাদেশি, যারা একসময় আমাদের সঙ্গে একই দেশের নাগরিক ছিলেন, তারা এখনো শাহবাগ স্কয়ারে আমাদের উত্তরের অপেক্ষায় রয়েছে।

ইয়াকুব খান বাঙগাস লাহোরের ফ্যোরম্যান ক্রিস্টিয়ান কলেজের ইতিহাস বিভাগের সভাপতি।

“অবয়বহীন” মহেঞ্জোদারো, বিভ্রান্তিতে প্রত্নতাত্ত্বিকরা

খুবই সুন্দরভাবে পরিকল্পিত রাস্তাঘাট ও একটা সুনির্মিত পানি/বর্জ্য নিস্কাশন প্রক্রিয়া আমাদের এটাই ইঙ্গিত দেয় যে, প্রাচীন সিন্ধুসভ্যতার মহেঞ্জোদারো নগরীর বাসিন্দারা খুবই দক্ষ নগর পরিকল্পনাকারী ও পানি নিয়ন্ত্রণের সামর্থ্য অর্জন করেছিল। কিন্তু বর্তমান পাকিস্তানে অবস্থিত প্রায় ৩০০০ খৃষ্ট পূর্বাব্দের প্রাচীন এই নগরের বাসিন্দা কারা ছিল, তা এখনও একটা রহস্যই থেকে গেছে। পেনসালভেনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ধুসভ্যতার গবেষক গ্রেগরি ফোসেলের ভাষায়, ‘এটা অনেকটাই অবয়বহীন।’

প্রাচীন বেশিরভাগ সভ্যতার মতো এই নগরীতে নেই কোন জমকালো প্রাসাদ, মন্দির বা ভাস্কর্য। সমাজ পরিচালনার জন্য নেই কোন কেন্দ্রীয় সরকার পদ্ধতি। এমনকি কোন রাজা বা রানী থাকারও কোন প্রমাণ পাওয়া যায় না মহেঞ্জোদারো নগরীতে। পরিমিতিবোধ, শৃঙ্খলা ও পরিস্কারপরিচ্ছন্নতা তাদের কাছে অধিকতর গ্রহণযোগ্য ছিল বলেই প্রতীয়মান হয়। মৃিশল্পের ব্যপক প্রসার ছিল সেই সমাজে। প্রচলিত ছিল পাথর ও তামার তৈরি অনেক হাতিয়ার বা অন্যান্য সামগ্রী। সিলমোহর ও ওজন মাপার ব্যবস্থা দেখে অনুমান করা যায় যে সেখানে ছিল খুবই সুনিয়ন্ত্রিত বাণিজ্যিক ব্যবস্থা। প্রাচীন এই নগরের ঐশ্বর্য্য ও উচ্চ গুনসম্পন্নতার প্রমাণ নিশ্চিতভাবেই পাওয়া যায় অনেক নৃতাত্ত্বিক নিদর্শনে। পোড়া ইটের নির্মান কাঠামোগুলো বাদেও নীলকান্তমণি, হাতির দাঁতের সামগ্রী, সোনার পুঁতিমালা ইত্যাদি পাওয়া গেছে মহেঞ্জোদারোর ধ্বংসাবশেষে।
পোড়া মাটির ইট দিয়ে ঘেরা একটি কৃত্রিম জলাশয়ই কোন প্রাচীন সভ্যতার উপাসনালয়ের কাছাকাছি নির্মানকাঠামো। গ্রেট বাথ নামে পরিচিত এই স্নানাগারটি নগরের অপেক্ষাকৃত উঁচু একটা স্থানে অবস্থিত। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের ফোসেলের মতে, ‘এ থেকে আমরা ইঙ্গিত পেতে পারি যে, মহেঞ্জোদারোর বাসিন্দারা পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতাবোধ দ্বারা পরিচালিত এক মতাদর্শ লালন করত।’ এছাড়াও পুরো নগরজুড়েই অসংখ্য কুয়া ও প্রায় প্রতিটা বাড়িতেই একটা স্নানাগার ও বর্জ্য নিস্কাষণ ব্যবস্থা ছিল।

১৯১১ সালে প্রথম এই মহেঞ্জোদারো সভ্যতার হদিশ পান প্রত্নতাত্ত্বিকরা। তবে বেশিরভাগ খোঁড়াখোঁড়ির কাজটা করা হয় ১৯২০ থেকে ১৯৩১ সালের মধ্যে। পরবর্তীতে ১৯৫০ ও ১৯৬৪ সালের দিকেও বর্তমান পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশের লারকানা জেলায় সুপ্ত প্রাচীন এই নগরের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের খোঁজে খোঁড়াখোঁড়ি চালানো হয়। ফোসেলের মতে, ২৫০০ থেকে ১৯০০ খৃষ্টপূর্ব সময়ই এই সভ্যতার স্বর্ণযুগ ছিল। এসময়ে সিন্ধু সভ্যতার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নগর ছিল এই মহেঞ্জোদারো। তবে ঠিক কী কারণে এই ঐশ্বর্য্যপূর্ণ প্রাচীন নগরটি পরিত্যক্ত হয়েছিল, তা এখনো রহস্যই থেকে গেছে। প্রত্নতত্ত্ববীদ জোনাথন নেনোয়ারের মতে, ‘সিন্ধুসভ্যতার শেষমুহূর্তে যারাই এখানে এসেছিল, তারা নিশ্চিতভাবেই এখানকার উত্তরসূরীদের মতো ছিল না বা তাদের প্রতিনিধিত্বও করেনি।’ সিন্ধু নদীর গতিপরিবর্তনের ফলেও এই কৃষিভিত্তিক সভ্যতার পতন হয়ে থাকতে পারে বলে মত দিয়েছেন কেনোয়ার। তবে কোন বন্যা বা নদীর গতিপরিবর্তনই যে এই নগরকে পরিত্যক্ত করেছে, এমন কোন শক্ত প্রমাণও পাওয়া যায় না। পুরো সিন্ধু উপত্যকা জুড়েই সংস্কৃতির অনেক লেনদেন-অদলবদল হয়েছে বলে জানিয়েছেন ফোসেল। তিনি বলেছেন, ‘১৯০০ খৃষ্টপূর্বাব্দে এই মহেঞ্জোদারো নগরী কোন না কোনভাবে একটা বড় প্রত্নতাত্ত্বিক সফলতা অর্জন করেছে। কিন্তু এটা কিভাবে সম্ভব হয়েছে, তা কেউই জানে না।’— ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক

পাকিস্তানের আত্মসমর্পণ এক দিন ঝুলিয়ে রেখেছিল যুক্তরাষ্ট্র

১৯৭১ সালে উপমহাদেশে পরিস্থিতি রাজনৈতিকভাবে যে বেশ উত্তেজিত ছিল, তা সর্বজনবিদিত। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর স্বাধীনতা অর্জন করে বাংলাদেশ। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জড়ায় ভারতও। তবে সে সময় পরিস্থিতি যে আরও অনেক উদ্বেগজনক হয়ে উঠেছিল, তা এতদিন সবার অগোচরেই ছিল।

সদ্যপ্রকাশিত গোপনীয় এক দলিলের সুবাদে জানা গেছে, ওই সময় ভারতকে আক্রমণের মাধ্যমে যুদ্ধে জড়ানোর পরিকল্পনা ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেরও। মার্কিন বিমানবাহী জাহাজ ইউএসএস এন্টারপ্রাইজের ওপর ভারতীয় সেনাবাহিনীকে আক্রমণের নির্দেশ ছিল। এ ছাড়া ঢাকায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্তটাও প্রায় এক দিন ঝুলিয়ে রেখেছিল তত্কালীন নিক্সন প্রশাসন। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্প্রতি এই ছয় পাতার দলিলটি প্রকাশ করেছে বলে দ্য টাইমস অব ইন্ডিয়ার খবরে বলা হয়।

গোপনীয় এই দলিল অনুযায়ী, ১৯৭১ সালে পরিষ্কারভাবেই পাকিস্তানকে সমর্থন জুগিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। সে সময় ভারত বা পাকিস্তান—উভয় দেশকে কোনো ধরনের সামরিক অস্ত্র বা সহযোগিতা দেওয়ার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা ছিল যুক্তরাষ্ট্রের ওপর। তা সত্ত্বেও পাকিস্তানকে অস্ত্রশস্ত্রের জোগান দিয়ে গেছে নিক্সন প্রশাসন। এ ছাড়া বঙ্গোপসাগরে সপ্তম নৌবহর পাঠিয়ে ভারতীয় সেনাবাহিনীর ওপর আক্রমণ চালাতে চেয়েছিল ওয়াশিংটন।

১৯৭১ সালের জুনে মার্কিন অস্ত্রবাহী তিনটি পাকিস্তানি জাহাজ আটক করার সম্ভাবনা তৈরি করেছিল ভারত। সেটা তারা করতে পারত জাহাজগুলো করাচি পৌঁছানোর আগেই—সেখানে আক্রমণ অথবা বঙ্গোপসাগরে অবরোধ জারি করে। এগুলোর কোনো একটা পদক্ষেপ নিলেই ভারতকে আক্রমণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল মার্কিন সেনাবাহিনীকে। সে রকম কিছু করা হলে ভারতকে ‘আগ্রাসী’ আখ্যা দিয়ে সপ্তম নৌবহরকে এই আক্রমণ চালানোর নির্দেশটা দিয়েছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সন নিজেই। সদ্যপ্রকাশিত এই দলিলে বলা হয়েছে, ‘যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত ভারতীয় দূতাবাস আঁঁচ করেছিল যে যদি প্রয়োজন হয়, তাহলে মার্কিন বিমানবাহিনী ভারতের ওপর হামলা চালাতে পারে। আর এ জন্য তাদের কাছে প্রেসিডেন্টের অনুমোদন আছে।’

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তানে আটকে পড়া মার্কিন নাগরিকদের উদ্ধার করার জন্য এই সপ্তম নৌবহর বঙ্গোপসাগরে পাঠানো হয়েছিল বলে আনুষ্ঠানিকভাবে সবাইকে জানানো হয়েছিল। কিন্তু আসলে এটা ব্যবহার করে ভারতীয় সেনাবাহিনীকে আক্রমণের পরিকল্পনা ছিল ওয়াশিংটনের। ১৪ ডিসেম্বর তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তানের সেনাপ্রধান জেনারেল নিয়াজি ঢাকায় আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্ত নেন। তাঁর এই আকাঙ্ক্ষার কথা তিনি ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে জানান। পাল্টা জবাব পেতে ১৯ ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়েছিল তাঁকে। ভারতের জ্যেষ্ঠ রাষ্ট্রদূতদের সন্দেহ, হয়তো ভারতের বিরুদ্ধে সামরিক পদক্ষেপ নেওয়ার সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্যই ওই কালক্ষেপণ করা হয়েছিল।

বিন লাদেনের মৃত্যুতে নোম চমস্কির প্রতিক্রিয়া

 মে ৬, ২০১১

এটা খুবই স্পষ্ট যে, লাদেন হত্যার মার্কিনি অভিযানটা একটা পরিস্কার গুপ্তহত্যা। একই সঙ্গে এটা আন্তর্জাতিক অনেক আইন-আচরণবিধির লঙ্ঘনও বটে। তারা নিরস্ত্র লাদেনকে গ্রেফতার করার কোন চেষ্টাই করেনি। ৮০ জনের কমান্ডো দলের জন্য যেটা ছিল খুবই সহজ একটা কাজ। আর তাদেরকে তো সেখানে কোনরকম প্রতিরোধের মুখেও পড়তে হয়নি। তাদের দাবি অনুসারে, একমাত্র প্রতিরোধটা এসেছিল লাদেনের স্ত্রীর কাছ থেকে। আইনের প্রতি বিন্দুমাত্র শ্রদ্ধা আছে, এমন দাবিওয়ালা সমাজে তো সন্দেহভাজন অপরাধীকে গ্রেফতার করে বিচারের আওতায় আনার কথা। আমি কিন্তু ‘সন্দেহভাজন’ শব্দটার উপরে বিশেষভাবে জোর দিচ্ছি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে সবচেয়ে গভীর অনুসন্ধানের পর ৯/১১ হামলার পরিকল্পনাটা যে আফগানিস্থানেই করা হয়েছিল, এটা এফবিআই শুধু ‘বিশ্বাস’ থেকে করা, কোন তথ্য ছিল না। পরিকল্পনার বাস্তবায়নটা আবার হয়েছিল সৌদি আরব ও জার্মানিতে! ২০০২ সালের এপ্রিলে, এফবিআই প্রধান রবার্ট মুলার সংবাদমাধ্যমগুলোকে এই তথ্য জানিয়েছিলেন। এপ্রিল ২০০২ সালে তারা শুধু যেই জিনিসটা বিশ্বাস করলো, স্পষ্টতই তার ৮মাস আগে সেটা করতো না, যখন কিনা তালেবানরা ওয়াশিংটনকে প্রস্তাব করেছিল যে বিন লাদেনের বির’দ্ধে প্রমাণ হাজির করতে পারলে তারা তাকে বিচারের জন্য হস্তগত করবে। ওয়াশিংটন এই প্রস্তাব শোনেনি। তাই যখন ওবামা তাঁর হোয়াইট হাউজ বিবৃতিতে বলেন যে, ‘আমরা খুব তাড়াতাড়িই জানতে পেরেছিলাম, ৯/১১ হামলাটা আল কায়েদাই করেছিল’, তখন তিনি যে পুরোপুরি মিথ্যা কথা বলছেন, এটা বোঝাই যায়।

তখন থেকে এখন পর্যন্ত কোন আমাদের কাছে কোন গুরুতর প্রমাণই হাজির করা হয়নি। বিন লাদেনের ‘স্বীকারোক্তি’ নিয়ে অনেক কথাবার্তা হয়েছে। কিন্তু সেরকম স্বীকারোক্তি তো আমারও আছে। বোস্টন ম্যারাথন জিতলেও আমি সেরকম স্বীকারোক্তি দিব! তিনি যেটাকে একটা বিশাল অর্জন বলে মনে করেছেন, সেটাই তিনি শুধু প্রকাশ্যে স্বীকার করেছেন।

এখন পাকিস্তানের উপর ওয়াশিংটনের ক্ষোভ নিয়ে মিডিয়াতে অনেক কথাবার্তা হচ্ছে যে, কেন তারা লাদেনকে যুক্তরাষ্ট্রের হাতে তুলে দিল না। যেখানে আব্বোটাবাদে লাদেনের উপস্থিতির কথা পাকিস্তানি মিলিটারি ও নিরাপত্তাকর্মীরা জানত বলে ধারণা করা হচ্ছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের উপরও পাকিস্তানের যে অনেক ক্ষোভ, সেটা নিয়ে কোনই কথাবার্তা নেই। যুক্তরাষ্ট্র যে তাদের সার্বভৌমত্বকে বুড়ো আঙ্গুল দেখাল, রাজনৈতিক গুপ্তহত্যা করার জন্য তাদের এলাকায় প্রকাশ্যে হামলা করল— এগুলো নিয়ে কোন আলাপই নেই। আমেরিকা বিরোধী অনুভূতি আগে থেকেই পাকিস্তানে প্রবল মাত্রায় ছিল। এই ঘটনাটা যে সেটাকে আরও উস্কে দেবে, সেটা বলাই বাহুল্য। লাদেনের মৃতদেহ সমুদ্রে ভাসিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্তটাও নিশ্চিতভাবে মুসলিম বিশ্বের সংশয় এবং ক্রোধ দুটোই অনেক বাড়িয়ে দেবে।

আমাদের এখন নিজেদেরই প্রশ্ন করা দরকার যে, ইরাকি কমান্ডোরা যদি জর্জ ডব্লিউ বুশের বাড়িতে নেমে, তাকে হত্যা করে, লাশটা অ্যাটলান্টিকে ফেলে দেয়, তাহলে আমাদের কেমন লাগবে। বুশের অপরাধের পরিমাণ নিশ্চিতভাবেই লাদেনের গুলোকে পেছনে ফেলবে। কোন বিতর্ক ছাড়াই এ কথা বলা যায়। এবং বুশ ‘সন্দেহভাজন’ও না। কিন্তু অবশ্যই ‘‘সিদ্ধান্তদানকারী’’ যে কিনা অন্য যেকোন যুদ্ধাপরাধ থেকে আলাদা করে একটি মহান আন্তর্জাতিক অপরাধ করতে নির্দেশ দিয়েছিল সব শয়তানদের এরমধ্যে সম্পৃক্ত করে (নুমেনবার্গ ট্রায়াল থেকে উদ্ধৃত)। যেকারণে নাজি অপরাধীদের ফাঁসিতে ঝোলানো হয়েছিল- হাজার হাজার মৃত্যু, লক্ষ লক্ষ শরনার্থী, দেশে দেশে ধ্বংসযজ্ঞ, তীক্ত দ্বন্দ্ব, যা এখনো বেশিরভাগ জায়গায় ছড়িয়ে আছে।

কিউবার এয়ারলাইন বোমারু অরল্যান্ডো বস্ককে নিয়ে তো নতুন করে কিছুই বলার নাই। ইনি ১৯৭৬ সালে কিউবার একটা বেসামরিক বিমানে বোমা হামলা চালিয়ে ৭৩জন নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করেছিলেন। মাত্র কিছুদিন আগেই তিনি ফ্লোরিডায় শান্তিপূর্ণভাবে মৃত্যুবরণ করেছেন। ‘বুশ মতবাদ’ অনুসারেই, যারা সন্ত্রাসীদের লালন-পালন করে বা আশ্রয় দেয়, তারাও সন্ত্রাসীদেরই সমতুল্য এবং তাদের সঙ্গে সেরকম আচরণই করা উচিত্। কেউ এটা খেয়ালই করল না যে, একথা বলে বুশ নিজেই নিজের ধ্বংস এবং যুক্তরাষ্ট্রে বহিরাক্রমনের দাওয়াত দিচ্ছেন।

অপারেশন জেরোনিমো। এই নামটার ক্ষেত্রেও একই কথা। তারা এটার মধ্য দিয়ে লাদেনকে আরও বেশি মহান হিসেবে উপস্থাপন করছে। লাদেনকে তারা দেখাচ্ছে হানাদার-বাহিনীর গণহত্যার বিরুদ্ধে সাহসী প্রতিরোধের প্রতীক হিসেবে। পশ্চিমা সমাজে সাম্রাজ্যবাদী মনোভাবটা এত গভীরভাবে প্রোথিত যে কেউ এটা উপলব্ধিই করে না। এটা হলো আমাদের অপরাধগুলোর শিকার হওয়া মানুষদের নামে প্রাণঘাতি অস্ত্রের নামকরণ করার মতো ব্যাপার: অ্যাপাচি, টোমাহক…। চিন্তা করেন, জার্মান বিমানবাহিনী লুফটওয়াফে তাদের জঙ্গি বিমানগুলোকে ডাকছে “ইহুদি” বা “জিপসি” নামে!

আরও অনেক ব্যাপার নিয়ে কথা বলার আছে। কিন্তু এই মৌলিক ব্যাপারগুলোও আমাদেরকে চিন্তার অনেক ভালো খোরাক যোগাতে পারে।

আকমলের সর্বনাশা ভুল!

শোয়েব আকতার-আফ্রিদির হতাশ মুখগুলোই বলে দিচ্ছে কামরান আকমলের সর্বনাশা ভুলটার কথা।

পাকিস্তানের ১১০ রানের হারটার পেছনে সবচেয়ে বড় অবদান কার? রস টেলরের বিধ্বংসী ব্যাটিংয়ের নাকি কামরান আকমলের অবর্ণনীয় বাজে উইকেট কিপিংয়ের? শূণ্য ও চার রানের মাথায় টেলরের দুইটা অতি-সহজ ক্যাচ আকমল না ফেলে দিলে ম্যাচের পরিস্থিতিটা যে অন্যরকম হতো একথা হলফ করেই বলা যায়। পাকিস্তানি সমর্থকরা এখন হয়তো গালাগালি ছাড়া আকমলের নাম উচ্চারণই করতে পারবেন না। তবে খুব ভদ্র-বিনয়ী ভাষায় আকমলের গতকালের পারফরমেন্সটা বর্ণনা করেছেন ইয়ান চ্যাপেল, ‘আকমল উইকেটের পেছনে যে কীর্তিগুলো করেছে, সেটা ডন ব্রাডম্যানের মতো ব্যাটিং করেও পুষিয়ে দেওয়া সম্ভব না।’

গতকাল ক্যান্ডিতে শুরুটা বেশ ভালোমতোই করেছিল পাকিস্তান। ১৩ ওভারের মধ্যেই মাত্র ৫৫ রানেই তুলে নিয়েছিল ব্রেন্ডন ম্যাককালাম ও জেমি হাউয়ের উইকেট। কিন্তু ১৪তম ওভারটাতেই পাকিস্তানকে দুঃস্বপ্নের চাদরে মুড়ে দিলেন কামরান আকমল। শোয়েব আকতারের দ্বিতীয় বলে টেলরের ব্যাটের কানায় লেগে বল চলে গেল আকমল আর স্লিপে দাঁড়ানো ইউনুসের মাঝখান দিয়ে। দুই বল পর এবার যেন টেলরকে জন্মদিনের উপহার দিলেন আকমল। ক্যাচটা ধরেও আবার ফেলে দিলেন মাটিতে। দুই দুইবার জীবন পেয়ে বার্থডেবয় রস টেলর হয়ে উঠলেন দুর্দমনীয়। খেললেন ১২৪ বলে ১৩১ রানের দানবীয় এক ইনিংস। শেষ চার ওভারে জ্যাকব ওরামকে সঙ্গে নিয়ে স্কোরবোর্ডে যোগ করলেন ৯৪ রান। ম্যাচ নিয়ে গেলেন পাকিস্তানের ধরাছোঁয়ার বাইরে।

৩০৩ রানের লক্ষ্য নিয়ে ব্যাট করতে নেমে অবর্ণনীয় ভুলগুলোর ক্ষতি পুষিয়ে দেওয়া তো দূরে থাক, কামরান আকমল পাকিস্তান সমর্থকদের আরো হতাশ করে সাজঘরে ফিরলেন মাত্র ৮ রান করে। পাকিস্তান হারল ১১০ রানের বিশাল ব্যবধানে। ম্যাচ শেষে এই বাজে পারফরমেন্সের জন্য কোন অজুহাতও খুঁজে পেলেন না আফ্রিদী। বললেন, ‘আমার কোন অজুহাত নেই। আমরা ভালো বল করতে পারি নি। ভালো ফিল্ডিংও করতে পারি নি।’

কামরান আকমলের এই ধরণের কীর্তি কিন্তু এবারই প্রথম না। গত বছরের শুরুতে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সিডনি টেস্টেও একই রকমের কাণ্ড করেছিলেন এই পাকিস্তানি উইকেট রক্ষক। সেবার খুব অল্প সময়ের মধ্যেই তিনবার ফেলেছিলেন মাইক হাসির ক্যাচ। সে ম্যাচেও ১৩৪ রানের হার না মানা ইনিংস খেলে অস্ট্রেলিয়াকে ৩৬ রানের জয় এনে দিয়েছিলেন হাসি। সেই ম্যাচ শেষে ম্যাচ পাতানোর অভিযোগও উঠেছিল আকমলের বিরুদ্ধে। কিন্তু তিনি বলেছিলেন, ‘আমি ক্রিকেটটা ভালোবেসেই খেলি। টাকার জন্য না। আমি অস্ট্রেলিয়াকে জেতানোর জন্য ক্যাচ ফেলি নি। এগুলো ঘটেই থাকে। ক্রিকেটে সব দিনই সমান যায় না।’ হ্যাঁ, আকমলের কথা ঠিকই। সব দিন সমান যায় না। তবে ভুলগুলো কী একটু বেশিই হয়ে যাচ্ছে না কামরান আকমলের? আর তাঁর সর্বনাশা ভুলগুলোর মাশুল কিভাবে দিতে হয়, সেটাও নিশ্চয়ই খুব ভালোমতোই টের পাচ্ছেন তিনি।— দ্য টেলিগ্রাফ