Posts Tagged ‘ কাতালান ভাষা ’

বার্সেলোনার রাজনীতি, রাজনীতির বার্সেলোনা

 

ইউরোপের অন্যতম সেরা ফুটবল ক্লাব বার্সেলোনার খেলাগুলোতে দর্শকসারিতে প্রায়ই দেখা যায় একটা ব্যানার: “কাতালোনিয়া স্পেন না”। হ্যাঁ, স্পেন থেকে আলাদা হয়ে স্বাধীন একটা রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্ন দেখছে কাতালোনিয়ার মানুষ। সত্যিই তেমনটা হয়ে গেলে ছোট আকারের একটা সশস্ত্র সামরিক বাহিনী গড়ার পরিকল্পনাও করছেন কাতালান রাজনীতিবিদরা। তবে কাতালোনিয়ার একটা নিরস্ত্র সেনাদল দীর্ঘদিন ধরে ছিল এবং এখনও আছে। আর তা হলো বার্সেলোনা ফুটবল ক্লাবের সমর্থক। যারা প্রতি সপ্তাহান্তে ৯৯ হাজার দর্শক ধারণক্ষমতাসম্পন্ন ন্যু ক্যাম্প স্টেডিয়ামকে সাজিয়ে দেন লাল-নীলের প্রতীকি সাজে। যেটা কাতালোনিয়ার জাতীয় পতাকাকে ইঙ্গিত করে। নতুন রাষ্ট্র হিসেবে কাতালোনিয়ার নাম সত্যিই যদি আসে, তাহলে বার্সেলোনা শহর হবে এই নতুন দেশের রাজধানী।

&MaxW=640&imageVersion=default&AR-150929622

আগামী রোববার (২৭ সেপ্টেম্বর) অনুষ্ঠিত হবে কাতালোনিয়া প্রদেশের পার্লামেন্ট নির্বাচন। ভোটাভুটিতে স্বাধীন কাতালোনিয়ার পক্ষের শক্তি জিতে গেলে আগামী ১৮ মাসের মধ্যে স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র গঠনের কর্মকাণ্ড শুরু করা হবে বলে জানানো হয়েছে স্বাধীনতাকে ‘হ্যাঁ’ বলা জোটের নেতারা। কাতালোনিয়া যদি স্বাধীন হয়ে যায় তাহলে বার্সেলোনা আর স্প্যানিশ লিগে খেলতে পারবে না বলে জানিয়েছেন লা লিগার প্রেসিডেন্ট।

আন্তর্জাতিকভাবে যেভাবেই দেখানো হোক না কেন, বার্সা দীর্ঘদিন ধরেই বহন করছে কাতালান জাতীয়তাবাদের পতাকা। ন্যু ক্যাম্পে বার্সেলোনার খেলাগুলোতে দর্শকসারিতে দেখা যায় কাতালোনিয়ার পতাকার মতো লাল-নীলের আধিক্য। বার্সার প্রধান তারকা লিওনেল মেসির চেয়ে বেশি উচ্চারিত হয় স্বাধীনতার ধ্বনি। সর্বশেষ স্প্যানিশ কাপ ফাইনালে ন্যু ক্যাম্পে স্পেনের জাতীয় সঙ্গীত বাজানোর সময় দুয়োধ্বনি দিয়েছিলেন বার্সার সমর্থকেরা। এজন্য ৭৪ হাজার ডলার জরিমানা করা হয়েছিল বার্সাকে। ন্যু ক্যাম্প স্টেডিয়ামের এক পার্শ্বে পাকাপাকিভাবে একটা ব্যানার লাগানো থাকে। যেখানে লেখা আছে: “কাতালোনিয়া স্পেন না”।

catalonia

স্প্যানিশ লেখক মানুয়েল ভাজকেজ মোনতালবান বার্সাকে বর্ণনা করেছেন একটা ‘প্রতিকী ও নিরস্ত্র কাতালান সেনাবাহিনী হিসেবে।’। বিশেষত ১৯৩৯ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত, জেনারেল ফ্রাঙ্কোর সামরিক শাসনের সময়। ফ্রাঙ্কো চরমভাবে অবদমিত করে রেখেছিলেন কাতালান জাতীয়তা, ভাষা-সংস্কৃতির চর্চাকে। ইতিহাসবিদ চার্লেস সান্তানা বলেছেন, ‘বার্সেলোনা ক্লাব ছিল কাতালানদের স্বাধীনতার ঘাঁটি। এখানে এসে মানুষ নির্ভয়ে কাতালান ভাষায় কথা বলতে পারত। এমনকি গানও গেতে পারত।’ ১৯১৮ সালে কাতালোনিয়াকে স্ব-শাসনের ব্যবস্থা দেওয়ার দাবিও জানানো হয়েছিল বার্সেলোনার পক্ষ থেকে। ২০০৩ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত জোন লোপার্তা, বার্সেলোনার সভাপতি থাকার সময়ও স্বাধীন কাতালোনিয়ার পক্ষে সক্রিয় অবস্থায় দেখা গেছে ইউরোপের অন্যতম সফল ক্লাবটিকে। লোপার্তা খোলাখুলিভাবে স্বাধীন কাতালোনিয়ার সমর্থনে কথাবার্তা বলতেন। ২০১২ সালেও স্পেনের কেন্দ্রিয় সরকার দেশের প্রতিটি স্কুলে স্প্যানিশ শিক্ষা বাধ্যতামূলক করার প্রস্তাব তোলার পর কড়াভাবে এর সমালোচনা করেছিল বার্সেলোনা ফুটবল ক্লাব

তবে সাম্প্রতিক সময়ে কিছুটা ভিন্ন অবস্থানে দেখা যাচ্ছে বার্সেলোনাকে। আগামী ২৭ সেপ্টেম্বরের নির্বাচনের জন্য বার্সেলোনা কোনো পক্ষ নেবে না বলে জানিয়েছেন ক্লাব সভাপতি হোসেপ মারিয়া বার্তেমোউ। তিনি বলেছেন, ‘বার্সেলোনা এটা দেখিয়েছে যে তারা এই নির্বাচনী প্রচারণার বাইরে আছে। যা করার সেটা রাজনীতিবিদেরই করতে হবে। বার্সা নিরপেক্ষ থাকবে।’ বার্সার কিংবদন্তি ফুটবলার জাভিও মত দিয়েছেন ক্লাবকে রাজনীতির বাইরে রাখার পক্ষে। তিনি বলেছেন, ‘আমার মনে হয় বার্সাকে রাজনীতির সঙ্গে জড়ানো ঠিক হবে না। এই ক্লাবকেও না, ফুটবলকেও না। কিন্তু পরিস্থিতি ব্যাপারটাকে অনিবার্য করে তুলেছে।’

তবে বার্সার আরেক তারকা জেরার্ড পিকে বেশ জোরেসোরেই কথা বলছেন কাতালোনিয়ার স্বাধীনতার পক্ষে। ১১ সেপ্টেম্বর কাতালোনিয়ার জাতীয় দিবসের র‍্যালিতে দেখা গেছে পিকেকে। সেসময় বার্সার এই ডিফেন্ডার বলেছিলেন, ‘এখানে খুবই বড় একটা আন্দোলন হচ্ছে। আর এটা সবার শোনা উচিৎ।’ সম্প্রতি স্পেনের জাতীয় দলের জার্সি গায়ে খেলার সময় পিকেকে দুয়োধ্বনিও শুনতে হয়েছে স্পেনেরই সমর্থকদের কাছ থেকে।

11setembre-14-pique

কাতালোনিয়া সত্যিই আলাদা হয়ে গেলে ইউরোপের ফুটবল অঙ্গনে বেশ বড় ধরণের তোলপাড় শুরু হবে। স্পেনের জাতীয় দলে খেলেন বেশ কয়েকজন বার্সেলোনার খেলোয়াড়। তারা তখন আর খেলতে পারবেন না স্পেনের হয়ে। বার্সেলোনাও যে তাহলে লা লিগায় অংশ নিতে পারবে না সেটাও স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছেন স্প্যানিশ পেশাদার ফুটবল লিগের প্রেসিডেন্ট হাভিয়ের তেবাস, ‘খেলার আইন খুব পরিস্কার: লা লিগায় স্পেনের ক্লাবগুলো ছাড়া অংশ নিতে পারবে শুধু আনডোরান ক্লাবগুলো। লা লিগা অনুষ্ঠিত হবে কাতালান ক্লাবগুলোকে বাদ দিয়েই।’ বার্সেলোনার সঙ্গে লা লিগার আরেক ক্লাব এসপানিওলেরও হবে একই দশা।

তাহলে কি সত্যিই আর দেখা যাবে না দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ক্লাব রিয়াল মাদ্রিদ ও বার্সেলোনার ঐতিহ্যবাহী দ্বৈরথ? ফুটবল বিশ্ব কী বঞ্চিত হবে ‘এল ক্লাসিকো’র রোমাঞ্চ থেকে? উত্তরের জন্য তাকিয়ে থাকতে হবে বার্সেলোনার রাজনীতির দিকে।

কাতালোনিয়ার স্বাধীনতা, ইউরোপের মাথাব্যাথা

ইউরোপের ফুটবল অঙ্গনের সবচেয়ে আকর্ষণীয় লড়াই, স্পেনের দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী রিয়াল মাদ্রিদ ও বার্সেলোনার দ্বৈরথ। বিশ্ব ফুটবলে যা পরিচিত ‘এল ক্লাসিকো’ নামে। ইউরোপের সবচেয়ে সফল দুইটি ক্লাবও রিয়াল-বার্সা। ফলে ফুটবলের কারণে পুরো বছরজুড়েই বিশ্বের অনেক মানুষের নজর থাকে স্পেনের দিকে। এবার বিশ্বের দৃষ্টি স্পেনের দিকে পড়তে পারে রাজনৈতিক কারণেও। এখানেও একে-অপরের প্রবল প্রতিপক্ষ মাদ্রিদ (স্পেন) ও বার্সেলোনা (কাতালোনিয়া)।

Screen-Shot-2015-03-31-at-16.40.53

সম্প্রতি দীর্ঘদিন ধরে জারি থাকা স্বাধীনতার দাবিতে আবার মুখরিত হয়েছে কাতালোনিয়ার রাজপথ। ২৭ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে কাতালোনিয়ার পার্লামেন্ট নির্বাচন। আর এই ভোটাভুটিকে দেখা হচ্ছে স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষ নির্ধারণী নির্বাচন হিসেবে। পার্লামেন্ট নির্বাচনে কাতালোনিয়ার স্বাধীনতার পক্ষ জয়ী হলে জোরতালে শুরু হবে স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কর্মকাণ্ড। বার্সেলোনা হবে সেই নতুন দেশের রাজধানী।

অন্যদিকে সমূহ বিপদের আশঙ্কায় কাতালানদের এই দাবি মেনে নিতে নারাজ স্প্যানিশ সরকার। কাতালোনিয়া স্বাধীন হয়ে গেলে খুবই ঝুঁকির মুখে পড়ে যাবে আগে থেকেই টালমাটাল অবস্থার মধ্যে থাকা স্প্যানিশ অর্থনীতি। খুব কাছেই সতর্কবার্তা হয়ে ঝুলে আছে গ্রীস ট্রাজেডি। গ্রীসের মতো ঋণগ্রস্থ স্পেনও আছে দেউলিয়া ঘোষণা হবার আশঙ্কায়। স্পেনের পাশাপাশি ইউরোপের মোড়লরাও হয়তো চাইবেন না কাতালোনিয়ার আলাদা হয়ে যাওয়া। কারণ তাহলে নতুন করে আরেকটি বড় সংকটের মধ্যে পড়তে হবে ইউরোপের নীতিনির্ধারকদের। এমনিতেই গ্রীস ও সাম্প্রতিক অভিবাসী পরিস্থিতি বেশ জর্জরিত করে রেখেছে তাদের। কিন্তু কাতালানরাও নাছোড়বান্দা। বহু দিনের লালিত স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষাকে এবার বাস্তবে রূপ দিতে বদ্ধপরিকর কাতালোনিয়ার মুক্তিকামী মানুষ।

catalonia-map

১১৬৪ সাল পর্যন্ত খুবই শক্তিশালী একটা স্বাধীন রাষ্ট্র ছিল কাতালোনিয়া। তারপর এটি যুক্ত হয় অ্যারাগনের সঙ্গে। আর ১৪৬৯ সালে অ্যারাগনের রাজা ফার্দিনান্দ ও স্পেনের রানী ইসাবেলার বিবাহবন্ধনের মধ্য দিয়ে স্পেনের সঙ্গে মিলন ঘটে অ্যারাগন ও কাতালোনিয়ার। তখন থেকেই ধীরে ধীরে স্পেনের কেন্দ্রীয় শাসনের নিয়ন্ত্রণে চলে যেতে থাকে কাতালানরা। ১৭১৪ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে বিলুপ্ত করে দেওয়া হয় কাতালান রাষ্ট্র। তারপর থেকেই নিজেদের স্বকীয় সংস্কৃতি-ঐতিহ্য-ভাষা চর্চার স্বাধীনতা হারাতে হয়েছে বলে অভিযোগ কাতালোনিয়ার মানুষদের। যে নিপীড়ণের চরম রূপ দেখা গেছে জেনারেল ফ্রাঙ্কোর সামরিক শাসনের (১৯৩৯-১৯৭৫) সময়। ১৯৭০-এর দশকের শেষে স্পেনে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পর কাতালোনিয়াকে দেওয়া হয় স্পেনের ১৭টি স্বায়ত্বশাসিত অঞ্চলের মর্যাদা। তবে ভেতরে ভেতরে স্বাধীনতার সুপ্ত বাসনাটাও সবসময় লালন করে গেছে কাতালানরা। সেই দাবি আরও জোড়ালো হয়েছে ২০০৭-০৮ সালের অর্থনৈতিক ধ্বসের পর। নানাবিধ কৃচ্ছতানীতি যারপরনাই অসন্তোষ তৈরি করেছে কাতালোনিয়ায়। ২০১০ সালে কাতালানরা স্প্যানিশ সরকারকে কর দিয়েছে ৬১.৮৭ বিলিয়ন ইউরো। আর তাদের কাছে এসেছে ৪৫.৩৩ বিলিয়ন। কেন্দ্রীয় স্প্যানিশ সরকারের হাতে বিপুল পরিমাণ টাকা চলে না গেলে আরও উন্নয়ন করা যেত বলে কড়া মন্তব্য করেছিল কাতালোনিয়া সরকার।

গত বছরের নভেম্বরে কাতালোনিয়ার স্বাধীনতা নিয়ে আয়োজন করা হয়েছিল একটি অনানুষ্ঠানিক গণভোট। মাদ্রিদে স্পেনের কেন্দ্রীয় সরকার অনেক চেষ্টা করেছিল সেটা রুখে দিতে। কিন্তু শেষপর্যন্ত সফল হয়নি। ২.২ মিলিয়ন ভোটারের ভোটে বিপুলভাবে জয়ী হয়েছিল স্বাধীনতার দাবি। ৮০.৭ শতাংশ মানুষ ভোট দিয়েছিলেন কাতালোনিয়ার স্বাধীনতার পক্ষে।

এবারের পার্লামেন্ট নির্বাচনে অনেকখানি আনুষ্ঠানিক রূপ পেতে যাচ্ছে সেই স্বাধীনতার দাবি। কাতালোনিয়ান পার্লামেন্টের ১৩৫টি আসনের মধ্যে ৬৮টি আসনে জয়লাভ করলেই স্পেন থেকে পৃথক হওয়ার কাজ আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু করে দেবে স্বাধীনতার পক্ষের শক্তিরা। ইতিমধ্যে তারা গঠন করেছে ‘জান্টস পেল সি’ বা ‘টুগেদার ফর ইয়েস’ নামের একটি জোট। যেখানে আছে কাতালোনিয়ার বর্তমান ও সাবেক তিন তিন প্রধানমন্ত্রীর পার্টি। এই জোট থেকে নির্বাচনে দাঁড়াচ্ছেন বার্সেলোনার সাবেক কোচ পেপ গার্দিওলাও। এই জোটের সঙ্গে আলাদাভাবে কাজ করবে বামপন্থী দল সিইউপি। আর স্বাধীনতার বিপক্ষে লড়বে স্পেনের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী মারিনো রাহোর পার্টি পার্তিদো পপুলার (পিপি) ও কাতালোনিয়ার সোশ্যালিস্ট পার্টি (পিএসসি)।

২৭ সেপ্টেম্বরের নির্বাচনে জয়ী হলে দ্রুতই স্বাধীন হওয়ার কাজ শুরু করে দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন ‘টুগেদার ফর ইয়েস’ জোটের প্রার্থী রাউল রোমেভা। এল পাইস পত্রিকাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ‘আমরা স্বাধীনতার ব্যাপারে খুবই আন্তরিক। আর সবাইকে এটা বুঝতে হবে যে আমরা সত্যিই এই প্রক্রিয়া শুরু করব। আমরা সম্ভাব্য সকল উপায়ে এটা করার চেষ্টা করেছি। কিন্তু তারা (স্পেনের কেন্দ্রীয় সরকার) এটা আমাদের করতে দেয়নি। ২০১৪ সালের ৯ নভেম্বরের গণভোটের পর আমরা যেটা করতে পারিনি সেটা করার সময় এবার এসে গেছে।’ নিজেদের স্বাধীন সব প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হবে বলে দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন কাতালোনিয়ার প্রেসিডেন্ট আর্থার মাস। কেন্দ্রীয় ব্যাংক, কর কর্তৃপক্ষ, কূটনৈতিক প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি ছোট আকারের একটা সেনাবাহিনীও গড়ে তোলার কথা ভাবছেন মাস।

গত ১১ সেপ্টেম্বর কাতালোনিয়ার জাতীয় দিবসে বার্সেলোনার রাজপথ আবার মুখরিত হয়েছিল স্বাধীনতার দাবিতে। প্রায় ১.৪ মিলিয়ন মানুষ কাতালোনিয়ার পতাকা নিয়ে বর্ণিল র‍্যালি করেছিলেন বার্সেলোনার রাজপথে। তরুণ-তরুণীরা নেচে-গেয়ে উদযাপন করেছিলেন কাতালানদের স্বকীয় ঐতিহ্য-সংস্কৃতি। স্বাধীনতার দাবিতে গলা চড়িয়েছেন অনেক প্রবীনও। ফ্রাঙ্কোর একনায়ক শাসনামলে স্বাধীনতার কথা বলতে গিয়ে দীর্ঘদিন জেল খাটতে হয়েছিল ৯১ বছর বয়সী জোয়াকিম ব্যাটলকে। এখন তিনি হাঁটেন ক্রাচে ভর দিয়ে। কিন্তু তাতে বিন্দুমাত্রও কমেনি তাঁর স্বাধীনতার স্পৃহা। ব্যাটল বলেছেন, ‘আমি প্রবল আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছি কাতালোনিয়ার স্বাধীনতার দিকে। আমরা এজন্য অনেক শতক ধরে অপেক্ষা করছি। আর আমার বিশ্বাস এখন সেই সময় চলে এসেছে।’

Demonstrators wave "Esteladas" (pro-independence Catalan flag) during celebrations of Catalonia's National Day (Diada) which recalls the final defeat of local troops by Spanish king Philip V's forces in 1714, in Barcelona on September 11, 2015. Hundreds of thousands of Catalans were set to pour into the streets today demanding independence, ahead of a regional election billed as an indirect vote on breaking away from Spain. AFP PHOTO/ GERARD JULIEN

২৭ সেপ্টেম্বরের নির্বাচনের পর স্পেন যদি সত্যিই স্বাধীনতার পথে হাঁটা শুরু করে তাহলে আবার বিপর্যয়ের মুখে পড়তে পারে স্প্যানিশ অর্থনীতি। কেন্দ্রীয় সরকারের অর্থমন্ত্রী লুইস ডি গুইনডোস অবশ্য সবাইকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করছেন যে, এমন কিছু হওয়া কখনোই সম্ভব না। কিন্তু বিনিয়োগকারীরা এতে আস্থা পাবেন কিনা, শেয়ারবাজারে অস্থিরতা শুরু হবে কিনা, সেটা নিশ্চিত করে বলার উপায় নেই। কাতালোনিয়ার স্বাধীনতা তখন শুধু স্পেনের সমস্যা হয়ে থাকবে না। পুরো ইউরোপকেই আবার পড়তে হবে নতুন টালমাটাল পরিস্থিতির মধ্যে।

কাতালোনিয়ার স্বাধীনতা নতুন করে ভাবাবে ইউরোপিয়ান ফুটবল অঙ্গনকেও। কাতালোনিয়া স্বাধীন রাষ্ট্র হয়ে গেলে বার্সেলোনা-ভ্যালেন্সিয়ার মতো দলগুলো স্প্যানিশ লিগে খেলবে কিনা, বার্সেলোনা ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নস লিগে অংশ নিতে পারবে কিনা- ইত্যাদি প্রশ্ন ঝুলে আছে ইউরোপের মাথাব্যাথার কারণ হয়ে।

প্রাসঙ্গিক: 

রাজনীতিতেও চলছে বার্সা-রিয়াল লড়াই

স্বাধীন কাতালোনিয়ার দাবি বার্সেলোনারও

এল ক্লাসিকো কি শুধুই ফুটবলীয় লড়াই?

যখন বার্সার ওপর ছিল মাদ্রিদের রাজত্ব

 

স্বাধীন কাতালোনিয়ার দাবি বার্সেলোনারও

Barcelona_2419869b‘ক্লাবের চেয়েও বেশি কিছু’ এটাই ইউরোপের অন্যতম শীর্ষ ক্লাব বার্সেলোনার প্রধান শ্লোগান। সম্প্রতি সেটা বেশ ভালোমতোই প্রমাণ করেছে এই স্প্যানিশ জায়ান্ট। স্পেনে স্বাধীন কাতালোনিয়া রাষ্ট্রের দাবিতে চলমান আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা পোষণ করেছে তারা। সেই সঙ্গে কাতালান ভাষাভাষী মানুষের উপরে অনায্যভাবে কেন্দ্রিয় ভাষা (স্প্যানিশ) চাপিয়ে দেওয়ারও কড়া সমালোচনা করেছে বার্সেলোনা কর্তৃপক্ষ।

এক সপ্তাহ আগে স্পেনের শিক্ষামন্ত্রী বলেছিলেন যে, দেশের সব স্কুলে যেন স্প্যানিশ ভাষা শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা হয়,  সেই প্রস্তাব তৈরি করা হচ্ছে। কেন্দ্রীয় সরকারের এই সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে কাতালোনিয়ার মানুষেরা। এই সিদ্ধান্তের ফলে কাতালান ভাষার উপর অনায্যভাবে রাষ্ট্রীয় আগ্রাসন চালানো হচ্ছে বলে মনে করেন তাঁরা। বার্সেলোনা ফুটবল ক্লাবও স্পেনের কেন্দ্রীয় সরকারের এই ভাষিক আধিপত্যের বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান নিয়েছে। এক বিবৃতিতে ক্লাবটি বলেছে, ‘আমাদের স্বাধীন দেশের (কাতালোনিয়া) পরিচয় তৈরির একটা গুরুত্বপূর্ণ উপাদান আমাদের ভাষা। ঠিক যেমনটা আমাদের ক্লাব। বিগত ৩৪ বছর ধরে আমাদের স্বাধীন ভাষাচর্চা বাধার মুখে পড়েছে। আমরা খুবই দৃঢ়ভাবে কাতালান ভাষা চর্চা ও শিক্ষার অধিকার রক্ষা করতে চাই।’

বর্তমানে কাতালোনিয়া রাজ্যের স্কুলগুলোতে কাতালান ভাষাতেই পাঠ দান করা হয়। আলাদাভাবে স্প্যানিশ শেখার ব্যবস্থা সেখানে আছে। কিন্তু সেটা প্রতিটি শিক্ষার্থীর জন্য বাধ্যতামূলক না। ইউরোপের ম্যাপে স্বাধীন একটি দেশ হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য দীর্ঘদিন ধরেই আন্দোলন-বিক্ষোভ করে আসছে কাতালোনিয়া। স্পেনের আর্থিক সংকটের কারণে সাম্প্রতিক সময়ে আরও জোরদার হয়েছে কাতালোনিয়ার স্বাধীন রাষ্ট্রের দাবি। এরই মধ্যে নতুন এই ভাষানীতি প্রনয়নের ঘোষণা দিয়েছেন স্পেনের কেন্দ্রীয় সরকারের শিক্ষা, সংস্কৃতি ও ক্রীড়ামন্ত্রী জোসে ইগনাসিও ওয়ের্ট। প্রতিটি স্কুলে স্প্যানিশ শিক্ষা বাধ্যতামূলক করার এই প্রস্তাবের তীব্র নিন্দা জানিয়ে মন্ত্রণালয় থেকে বেরিয়ে এসেছেন কাতালোনিয়া রাজ্যের শিক্ষা উপদেষ্টা ইরেনে রিগাউ। টুইটারের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় মন্ত্রণালয়ের এই সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেছেন বার্সেলোনার অধিনায়ক কার্লোস পুয়োল।

বার্সেলোনার এই রাজনৈতিক পদক্ষেপটি এসেছে স্প্যানিশ ইতিহাসের এক বিশেষ মুহূর্তে। ইউরো অঞ্চলের আর্থিক সংকটের সর্বশেষ শিকারে পরিণত হয়েছে স্পেন। যার ফলে এখন আন্তর্জাতিক সাহায্য চাওয়ার দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে ইউরোপের অন্যতম বড় অর্থনীতির এই দেশটি। নানা ধরণের কৃচ্ছনীতি আরোপের ফলে স্পেনের কেন্দ্রিয় সরকারও হয়ে পড়েছে ব্যপকভাবে অজনপ্রিয়। আর এই সংকটময় পরিস্থিতি আরও উস্কে দিচ্ছে স্বাধীন কাতালোনিয়া রাষ্ট্রের দাবি। কাতালানরা মনে করে, এই অঞ্চলটি স্পেন থেকে বেরিয়ে এসে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবেই বেশি অগ্রগতি করতে পারবে। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারবে।

নভেম্বরের ২৫ তারিখে অনুষ্ঠিত হয় কাতালোনিয়া রাজ্যের সংসদীয় নির্বাচন। যেখানে ফলাফল নির্বাচনী প্রধান ইস্যু ছিল স্বাধীন কাতালোনিয়ার দাবিতে গণভোট অনুষ্ঠিত হবে কিনা। আর বলাই বাহুল্য, নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়ী হয়েছে গণভোট-পন্থী প্রার্থীরা। কিন্তু এই গণভোট কিভাবে আয়োজন করা যাবে, তা এখনও নিশ্চিত হওয়া যায়নি। কারণ স্পেনের সংবিধান অনুযায়ী দেশটির কোন রাজ্য আলাদাভাবে একটি গণভোট আয়োজন করতে পারে না। তবে বার্সেলোনা ফুটবল ক্লাবের এই সাম্প্রতিক বিবৃতি চলমান কাতালোনিয়া রাষ্ট্রের দাবি যে আরও জোরদার করবে, তা সহজেই অনুমান করা যায়।

বার্সেলোনা ক্লাবের সঙ্গে স্পেনের কেন্দ্রিয় সরকারের বিরোধটা অবশ্য নতুন কোন ব্যাপার না। ১৯৩৬ থেকে ১৯৩৯ সাল পর্যন্ত স্প্যানিশ গৃহযুদ্ধের সময়ও দেখা গিয়েছিল এই দ্বন্দ্ব। সেসময় স্পেনের কুখ্যাত একনায়ক ফ্রাঙ্কোর অন্যায় আধিপত্যের শিকার হয়েছিল বার্সেলোনা। ১৯৩৬ সালে ক্লাবটির সভাপতি জোসেফ সুনিয়োলকে গ্রেপ্তার করে হত্যা করেছিল ফ্রাঙ্কোর সেনাবাহিনী। ফ্রাঙ্কোর শাসনামলে কাতালান ভাষার ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। এমনকি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল কাতালান ভাষায় লেখা বহু বই।— টেলিগ্রাফ