Posts Tagged ‘ শাহবাগ আন্দোলন ’

ব্লগার গ্রেপ্তার প্রসঙ্গে কিছু বললেন না ইউনুস

Yunus+In+US-18.04.13

২০০৬ সালে শান্তিতে নোবেল জয়ের পর ড. মুহাম্মদ ইউনুস এবার পেয়েছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা, কংগ্রেশনাল স্বর্ণপদক। ক্ষুদ্রঋণভিত্তিক গ্রামীন ব্যাংকের মাধ্যমে তিনি যা করে আসছেন সেটা যুক্তরাষ্ট্রের বিবেচনায়, ‘মানুষকে শ্রেয়তর জীবনের পথে এগিয়ে নেবে’। একারণেই ড. ইউনুসকে এই পুরস্কার দেওয়ার জন্য মনোনিত করেছে যুক্তরাষ্ট্র। সাম্প্রতিক সময়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করার দাবিতে বাংলাদেশে যে আন্দোলন গড়ে উঠেছে, সে প্রসঙ্গে কোন মন্তব্য শোনা যায় নি ড. ইউনুসের কাছ থেকে। এবার হেফাজতে ইসলামের দাবিমাফিক সরকার যে তথাকথিত চার ‘নাস্তিক’ ব্লগারকে গ্রেপ্তার করেছে, সে বিষয়েও কোন মন্তব্য করেননি শান্তিতে নোবেলজয়ী প্রথম বাংলাদেশী।
পুরস্কার গ্রহণ অনুষ্ঠানে ব্লগারদের গ্রেপ্তার প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে ড. ইউনুস বলেন, ‘আমি এখন এই রকম ইস্যু নিয়ে কোন মন্তব্য করতে চাই না। আজকের সমস্ত আলোচনার কেন্দ্রে এই অনুষ্ঠানটাই থাকা উচিৎ।’ একথা বলেই তিনি দ্রুত সেখান থেকে চলে যান।
ইউনুসের আনুষ্ঠানিক বক্তব্য সীমাবদ্ধ ছিল গ্রামীন ব্যাংককে ঘিরেই। দারিদ্র দূরীকরণে এই প্রতিষ্ঠানটি কত ‘চমৎকার’ ও ‘উদ্ভাবনী চিন্তাভাবনা’ নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে, সেটা বর্ণনা করেছেন তিনি। এছাড়া ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় মার্কিন  সিনেটরদের সঙ্গে লবিং করার কথা উল্লেখ করেছেন ইউনুস। সেসময় তিনি আমেরিকায় থাকতেন। এবং এ কথা স্মরণীয় যে, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতা করেছিল এবং পাকিস্তানের আত্মসমর্পণের বিষয়টা প্রায় একদিন ঝুলিয়ে রেখেছিল
নারীর ক্ষমতায়ন প্রশ্নে ডেমোক্রাট, রিপাবলিকান, উভয় পার্টিরই ভূয়সী প্রশংসা পেয়েছেন ইউনুস। পুরস্কারটাও তিনি বাংলাদেশের লাখো নারীর পক্ষ থেকেই গ্রহণ করছেন বলে জানিয়েছেন। নারীরাই মূলত দারিদ্র দূরীকরণের এই স্বপ্নপূরণের পথে অগ্রণী ভূমিকা রাখবে বলে উল্লেখ করেন ইউনুস। অথচ সাম্প্রতিক সময়ে হেফাজতে ইসলাম নামধারী একটি সংগঠন নারীদের স্বাধীনতা হরণের লক্ষ্যে আন্দোলন শুরু করলেও সে বিষয়ে কোন মন্তব্য আসেনি ইউনুসের কাছ থেকে। শাহবাগ আন্দোলন সম্পর্কেও তিনি নিরব।
এইরকম পরিস্থিতির মধ্যে ইউনুসের নতুন এই পুরস্কারপ্রাপ্তির খবরটি সমালোচিত হয়েছে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে। অনলাইন অ্যাকটিভিস্টদের অনেকেই ভেবে পাচ্ছেন না যে, সমাজের খুবই গুরুত্বপূর্ণ সব ইস্যুতে কোন মতামত না দেওয়া সত্ত্বেও তিনি কিভাবে একের পর এক পুরস্কার জিতে যাচ্ছেন?
গত ২৫ বছরে অন্তত ১০৩টি পুরস্কার পেয়েছেন মুহাম্মদ ইউনুস। ২০০৬ সালে শান্তিতে নোবেল ও যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা ছাড়াও ২০০৯ সালে ইউ.এস প্রেসিডেনশিয়াল মেডেল অব ফ্রিডম পুরস্কার পেয়েছেন ইউনুস।  ইউনুসের দর্শন প্রচারের জন্য ২০০৬ সালে প্রতিষ্ঠা হয়েছে ইউনুস সেন্টার।- হাফিংটন পোস্ট

রক্ত নিয়ে হোলি-খেলা, ফুরিয়ে গেছে তোদের বেলা

ছোট আকারে হলেও গতকাল ৬ এপ্রিল মুখোমুখি সংঘর্ষে জড়িয়েছে হেফাজতে ইসলাম ও শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চ। পুরো দেশজুড়ে এমন ঘটনা আরও কিছু ঘটেছে। গতকাল ৬ এপ্রিল যখন শাহবাগ আন্দোলনের কর্মীরা হেফাজতে ইসলামের হামলা প্রতিহত করার জন্য উত্তেজিতভাবে লাঠি-বাঁশ সংগ্রহ করছিলেন, ঠিক সেই সময় মঞ্চ থেকে নতুন এই শ্লোগানটি শুনতে পেলাম: ‘রক্ত নিয়ে হোলি-খেলা, ফুরিয়ে গেছে তোদের বেলা’। শুনে খুবই ভালো লাগল। আসলেই, রক্তের হোলি-খেলা বন্ধ করার সময় এখন। অপশক্তির দিক থেকে আক্রমণ আসলে সেটা প্রতিহত করার শক্তি আমাদের যেমন অর্জন করতে হবে, তেমনি যখন সংঘর্ষ চলছে না, সেসময় এই পেশিশক্তির লড়াই কিভাবে এড়ানো যায়, সেকথাও আমাদের চিন্তা করতে হবে। সমান গুরুত্ব দিয়ে। বর্তমান তরুণ প্রজন্মের যে মেধাবী সন্তানরা জীবন তুচ্ছ করে লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে, তাদের রক্তাক্ত লাশ কোন পরিস্থিতিতেই কাম্য না। তাদের মগজটাই আজকের লড়াইয়ে বেশি জরুরি।

17206_551344121575076_1574400579_n

কেন তৈরি হলো সাংঘর্ষিক পরিস্থিতি?

পেশিশক্তির সাংঘর্ষিক পরিস্থিতি এড়ানো যায় নি। তবে একটা বিষয় স্পষ্ট যে, এই মুখোমুখি সংঘর্ষের জন্য কোনভাবেই গণজাগরণ মঞ্চ বা শাহবাগ আন্দোলনের কর্মীদের দায়ি করার সুযোগ নেই। শাহবাগ আন্দোলনের কর্মীরা আগ বাড়িয়ে হেফাজতে ইসলামের উপর আক্রমণ করতে যায়নি। শাহবাগ যখন আক্রান্ত হয়েছে, তখন অনেকেই নিজ উদ্যোগে নিজেদের আত্মরক্ষার স্বার্থে লাঠি হাতে নিয়েছে।

অনেকেই হয়তো গণজাগরণ মঞ্চ ও ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি, সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর ঢাকা হরতাল-অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণাকে সমর্থন করতে পারেননি। কিন্তু যখন একথা বেশ ভালোভাবেই প্রতিষ্ঠা করা গেছে যে, হেফাজতে ইসলাম আসলে জামায়েতী ইসলামকেই হেফাজত করতে চাচ্ছে, দেশের সব ভাস্কর্য-শহীদ মীনার ভেঙ্গে ফেলার কথা বলছে, নারী-পুরুষের প্রকাশ্য মেলামেশা বন্ধ করার দাবি তুলছে তখন তাদেরকে প্রতিহত করার দায়িত্ব কি মুক্তমনা-স্বাধীনচেতা মানুষরা অনুভব করবেন না? যেখানে আওয়ামী লিগ সরকারও তাদের কথা অনুযায়ী ৪ জন বগারকে গ্রেফতার করেছে এবং ১৩ দফার অধিকাংশ দাবি মেনে নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে, তখন এই হরতাল-অবরোধের পক্ষে যুক্তি দেখানোর অনেক জায়গা আছে।

২৬ মার্চ জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধ সংক্রান্ত আল্টিমেটাম শেষ হওয়ার পর যখন গণজাগরণ মঞ্চ থেকে কোন কঠোর কর্মসূুিচ আসেনি, শাহবাগে কিছুটা দ্বিধা-বিভক্তি, মতানৈক্য ইত্যাদি তৈরি হয়েছে। শহীদ রুমী স্কোয়াড আমরণ অনশনের ঘোষণা দেওয়ার পর আবার আশার আলো জ্বলছিল শাহবাগ চত্বরে। এরই মধ্যে বেশ কাঁপাকাঁপি দিয়ে ময়দানে আবির্ভাব ঘটে হেফাজতে ইসলামের। মধ্যযুগীয় কায়দার ১৩ দফা দাবি দিয়ে। ‘নাস্তিক ব্লগারদের’ ফাঁসির দাবি নিয়ে। সরকারও তাদের দাবির প্রতি নতজানু হয়ে ৪ জন ব্লগারকে গ্রেফতার করে। নজীরবিহীন কায়দায়। আমারব্লগ বন্ধ করে দেয়। অন্যদিকে শহীদ রুমী স্কোয়াডের সঙ্গে একরকম প্রতারণা করেই তাদের অনশন কর্মসূচি স্থগিত করানো হয়। প্রতারণা বললাম এই কারণে যে, মাননীয় পরিকল্পনামন্ত্রী এ কে খন্দকার বলেছিলেন জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধের দাবি মেনে না নিলে তিনি নিজেই অনশনে বসবেন। কবে সেটা? জানা যায় নি। ফলে অনেকেই মনে হয় কিছুটা হলেও আশাহত হয়েছিলেন, উদ্যোম হারিয়েছিলেন। ফলে সরকারও হয়তো ভাবতে শুরু করেছিল যে, ওদেরকে তো শান্ত করাই গেছে, এখন তাদের দাবির দিকে না তাকালেও হবে। বরং অন্যদিকটাই ট্যাকল দিই। এই পর্যায়ে শাহবাগ আন্দোলনের পক্ষ থেকেও সরকারকে জানিয়ে দিতে পারাটা দরকার ছিল যে, আমরাও আমাদের দাবি থেকে একচুল নড়িনি। আবার সবাইকে স্মরণ করিয়ে দেওয়ার দরকার ছিল যে, ‘আমরা বাড়ি ফিরছি না/রাজাকারদের ছাড়ছি না’। নিজেদের শক্তিমত্তা সম্পর্কে জানান দেওয়ার দরকার ছিল। নাহলে সবাই মনে করত যে, শাহবাগ আন্দোলন সতিই শেষের পথে।

আর রুমী স্কোয়াডের ৮দিনের আমরণ অনশন কর্মসূচিতেও যে সরকারের কোন ভ্রুক্ষেপ হয়নি সেটা তো বোঝাই যায়। এই পরিস্থিতিতে শাহবাগের অস্তিত্বের কথা সরকারকে মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য কঠোর কর্মসূচিরই প্রয়োজনীয়তা ছিল। দেশ পরিচালনায় নিযুক্ত রাজনীতিবিদরা এখনো হয়তো বুঝতে পারছেন না যে, শাহবাগ আন্দোলন ও হেফাজতে ইসলাম পুরোপুরি বিপরীতধর্মী দুইটা পক্ষ। দুই পক্ষ পরস্পরের পুরোপুরি উল্টাপথে হাঁটতে চায়। একপক্ষ চায় সামনে এগোতে, আরেক পক্ষ চায় পেছনে ফিরে যেতে। দুইটি আদর্শের মতভিন্নতা এতটাই বেশি যে, এটার মধ্যে কোন সমন্বয়ও সম্ভব কিনা, সন্দেহ আছে। ফলে সরকার যদি সবসময় ভোটবুদ্ধি না খাটিয়ে একটু যুক্তিবুদ্ধি খাটাতো তাহলে হেফাজতে ইসলামকে আস্কারা দেওয়ার আত্মঘাতি সিদ্ধান্ত কখনোই নিত না। আফসোস যে, তারা সেটা করছেন না। ফলে শাহবাগ আন্দোলনের পক্ষ থেকে নব উদ্যোমে সংগঠিত হওয়ার এই সুযোগটা ইতিবাচকই হয়েছে বলে আশা করছি।

 শুধু হাতইয়ার নামনইয়ারও চাই

এই একবিংশ শতাব্দির পৃথিবীতে হেফাজতে ইসলাম যে ধরণের দাবিদাওয়া উঠিয়েছে, সেটা মেনে দেওয়া প্রায় অসম্ভব রকমের ব্যাপার। কিন্তু তাদেরকে সহিংস উপায়ে হাতিয়ারের সাহায্যে মোকাবিলা করার পথ বেছে নেওয়া মোটেই মনে হয় উচিত্ হবে না দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধের সৈনিকদের। একথা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই যে, হেফাজতে ইসলামের ডাকে রাস্তায় বেরিয়ে আসা লোকের সংখ্যাও বাংলাদেশে কম না। এবং ধর্ম বিষয়টা আসলেও খুব স্পর্ষকাতর ইস্যু। তাই খুবই সাবধানতার সাথে এই পরিস্থিতি মোকাবিলা করা প্রয়োজন।

হেফাজতে ইসলামের লংমার্চে যারা অংশ নিয়েছিলেন তাদের অধিকাংশই জীবনে কখনো ইন্টারনেট, ফেসবুক-ব্লগ ব্যবহারের সুযোগ পেয়েছেন কিনা সন্দেহ আছে। তারা ধর্মভিত্তিক বইগুলো ছাড়া অন্য কোন বই পড়ারও সুযোগ পেয়েছেন কিনা সন্দেহ আছে। ফলে শিক্ষিত-শহুরে মানুষদের থেকে তাদের মানসিক ব্যবধানটা যে অনেক বেশি থাকবে, এতে আশ্চর্যের কি আছে। কিন্তু ‘আমরা জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা করি, আমরা মুক্তমনা’ এই বলে আত্মপ্রসাদের ভোগাটাও বিপদজনক হবে অপর পক্ষের জন্য। বরং দুই পক্ষের সাংস্কৃতিক-মানসিক মেলবন্ধনটা কিভাবে হতে পারে সেটাই বিবেচনা করা দরকার।

গতকাল খুব অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম, আমার এক স্কুলবন্ধুর মনে জন্মেছে প্রচণ্ড ইসলাম বিদ্বেষ। ইসলাম ধর্ম মানবকল্যানের জন্য, শান্তির জন্য কোন অবদান রাখতে পারে না বলেই সে মনে করে। এই ধরণের আলট্রা মডার্ন দৃষ্টিভঙ্গিও কিন্তু আখেরে সমাজের কোন কল্যান বয়ে আনবে না। এই রকমের দৃষ্টিভঙ্গি বরং ঘৃণার বিপরীতে আরও ঘৃণাই ছড়াবে। সমাজকে শান্তির পথে নিয়ে নিয়ে যাবে না। স্বাধীনতা-সমবেদনার পথে নিয়ে যাবে না।

ধর্মচিন্তা-ধর্ম সংক্রান্ত আলাপ-আলোচনাকে পরিহার-পরিত্যাগ করে অনেকদিন থাকা হয়েছে। প্রগতিশীলদের পক্ষ থেকে ধর্মীয় আলাপ দূরে সরিয়ে রাখার যে প্রবণতা, এতদিন সেটারই ফায়দা নিয়েছে কট্টরপন্থী, রক্ষণশীলরা। তারা নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য ইসলাম ধর্ম বা অতীতে আরও অনেক ধর্মের অপব্যাখ্যা দিয়েছে, এখনো দিচ্ছে। একদল মানুষ কিছু না বুঝেই মোল্লা-পুরোহিতদের সাথে সাথ মিলিয়ে গেছেন, পরকালের ভয়ে। অপরদিকে কিছু মানুষ এসব দেখে পুরো ধর্মটাকেই অবজ্ঞা করতে শুরু করেছেন। এটা এক ভয়াবহ দুষ্টচক্র। পুরো সমাজের কল্যানেই এর অবসান ঘটানো প্রয়োজন।

দুই পক্ষের সামজিক-সাংস্কৃতিক ব্যবধানটা ঘোঁচাতে হবে। সেটা জ্ঞান-বিজ্ঞানের দিক থেকেও, ধর্মীয় বা আধ্যাত্মিকতার দিক থেকেও। মানুষের জন্য, সমাজের জন্য বিজ্ঞানভিত্তিক অগ্রগতিটা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি মনুষ্যজন্মের মহিমা বোঝার জন্য আধ্যাত্মিক চর্চাটাও সমান গুরুত্বপূর্ণ। সেই আধ্যাত্মিকতার চর্চা ইসলাম ধর্ম দিয়েও হতে পারে, অন্যান্য ধর্ম-মতবাদ দিয়েও হতে পারে। আধ্যাত্মিক শূণ্যতা (Spiritual Vacuum) যে সামগ্রিকভাবে সমাজের জন্য ক্ষতিকর সেটা নিয়ে পশ্চিমে বেশ কথাবার্তা শুরু হয়েছে। কারণ তারা এটা টের পাওয়া শুরু করেছে। বাজার সংস্কৃতিতে সব কিছু কিনতে পাওয়া গেলেও মনের শান্তিটা এখনও পর্যন্ত কোন কোম্পানি বাজারজাত করে নাই। আর এই মনের শান্তি লাভের উপায়-উপাদানগুলো অনেকাংশে সংরক্ষিত আছে বিভিন্ন ধর্মীয় মতবাদগুলোর মধ্যে। পুরো ধর্মকেই খারিজ করে দেওয়ার প্রবনতা থেকে সরে এসে আমাদের বরং ধর্মীয় মতবাদগুলোর মুক্তিকামী উপাদানগুলো খুঁজে বের করা দরকার। সেগুলো প্রচার-প্রসার করা দরকার।

আর এটা করতে গেলে আমাদের ওঠাতে হবে মন-ইয়ার। অস্ত্রে নয়, শান দিতে হবে যুক্তিতে। মানবতার পক্ষে, সাম্য-স্বাধীনতার পক্ষে নিরন্তর প্রচারণা চালাতে হবে। সমাজের সুবিধাবঞ্চিত মানুষদের কাছে যেমন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে যেতে হবে, জ্ঞান-বিজ্ঞান অগ্রগতির খবর নিয়ে যেতে হবে, তেমনি ইসলামসহ প্রতিটা ধর্মে বিরাজমান সাম্য-শান্তি-সমবেদনার বার্তাও পৌঁছে দিতে হবে। বর্তমানে দেশের যা পরিস্থিতি তাতে, ব্যাপক আকারের সাংস্কৃতিক প্রচারণার মাধ্যমেই কেবল রক্ত নিয়ে হোলি খেলা বন্ধ করা সম্ভব।

নতজানু আর নয়

পূর্বপরিকল্পিত পথেই হাঁটছে জামায়াত-শিবির

২০০৯ সালে জামায়াতে ইসলামীর করা কিছু পরিকল্পনা-কর্মপদ্ধতি সম্পর্কে জানা যায় উইকিলিকসের কল্যানে। এগুলো তারা বলেছিল ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে। নিজেদের লক্ষ্য সম্পর্কে জামায়াত নেতারা বলেছিল, জামায়াত পরবর্তী নির্বাচনে জয়ী হওয়া বা জাতীয় সংসদে আসনসংখ্যা বাড়ানোর মতো স্বল্পমেয়াদি অর্জন নিয়ে চিন্তিত নয়, তাদের দৃষ্টি চূড়ান্ত লক্ষ্যের দিকে। চূড়ান্ত লক্ষ্যটা কি? ইসলামি রাষ্ট্র কায়েম করা। পাকিস্তানে যেমনটা ছিল-আছে।
২০০৮ সালে আওয়ামী লিগ সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করার অঙ্গীকার নিয়ে ক্ষমতায় এলে খানিকটা কোনঠাসা বোধ করে জামায়াত-শিবির। যদি সরকার তাদের নিষিদ্ধই করে, তাহলে কী করা হবে সেটাও তখনই ভেবে রেখেছিল তারা। উইকিলিকসে জামায়াতে ইসলাম ২০১০ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রদূত মরিয়ার্টি একটি গোপনীয় তারবার্তায় লেখেন: জামায়াতের নেতা ব্যারিস্টার রাজ্জাক ১০ ফেব্রুয়ারি বৈঠকে তাঁকে বলেন, জামায়াতে ইসলামী ‘সাংবিধানিক পথে’ বিশ্বাস করে, দলটি আদালতের সিদ্ধান্ত মেনে চলবে। বাংলাদেশে যদি ধর্মভিত্তিক দলগুলো নিষিদ্ধ হয়ে যায়, তাহলে জামায়াত তুরস্কের ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর দৃষ্টান্ত অনুসরণ করবে। জামায়াত দলের নাম পরিবর্তন করবে, দলীয় গঠনতন্ত্র থেকে ধর্মীয় মতবাদগুলো বাদ দেবে; কিন্তু একই সঙ্গে তিনি বলেন যে জামায়াত রুলিংটিকে আদালতে চ্যালেঞ্জ করবে। রাজ্জাকের ভাষ্য অনুসারে, ধর্মভিত্তিক দলগুলোর ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হলে জামায়াতে ইসলামী দলের নামে ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ও ট্রাস্টে যে অর্থ আছে, দলটি তা হারাবে, কিন্তু দল টিকে থাকবে। রাজ্জাক বলেন, একটি ক্ষত সৃষ্টি হবে, তবে সেই ক্ষত সারানো যাবে। (সূত্র: উইকিলিকসে বাংলাদেশ: ‘জামায়াতে ইসলামী- খরগোশ নয়, কচ্ছপ’)
দুই বছর পরে এখন তাহলে জামায়াত কি সেই কর্মপরিকল্পনা অনুসারেই হাঁটছে না? হেফাজতে ইসলাম যে জামায়াতেরই মদদপুষ্ট এবং মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ সেকথা কি এখনো কারও বোঝার বাকি আছে? পরিস্কারভাবে দেখা যাচ্ছে যে, তারা হেফাজতে ইসলামের নামে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচাল, জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধের দাবির কণ্ঠরোধ করতে চায়।
জামায়াত তুরস্কের ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর দৃষ্টান্ত অনুসরণ করবে সেকথাও বলেছে। সকলের বোধহয় মনে আছে যে, ট্রাইবুন্যালের বিচার কার্যক্রমকে প্রশ্নবিদ্ধ করে এই বিচার বন্ধ করার প্রস্তাব দিয়েছিল তুরস্কের সরকার। ফলে তুরস্ক তো জামায়াতের আদর্শ উদাহরণ হবেই। সেই পথেই তারা এগিয়ে যাচ্ছে এবং হেফাজতে ইসলাম ব্যানারের আড়ালে নতুনভাবে সংগঠিত হতে চাচ্ছে।

হেফাজতে ইসলাম + জামায়াতে ইসলামী = হেফাজতে জামায়াতে ইসলামী

জামায়াতে ইসলামী ও হেফাজতে ইসলাম যে একই মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ এটা তাদের কর্মকা-ের মাধ্যমেও বোঝা যায়।
শাহবাগ আন্দোলন শুরুর সঙ্গে সঙ্গে এটাকে নাস্তিকদের আন্দোলন বলে মিথ্যা প্রচারণা চালিয়েছিল জামায়াত-শিবির। তারা ব্লগার রাজীব হায়দারকে হত্যা পর্যন্ত করেছে। ধর্মভীরু মানুষদের মাঝে তারা প্রচারণা চালিয়েছে যে, শাহবাগে সবাই নাস্তিক, ওখানে বেলেল্লাপনা হয়, ওরা ‘বিজাতীয় সংস্কৃতি’র ধারকবাহক। এই প্রচারণা দিয়ে এখনো সারাদেশে তা-ব চালিয়ে যাচ্ছে জামায়াত-শিবির। এদিকে ধুম করে দৃশ্যপটে হাজির হওয়া এবং সবাইকে ভীতসন্ত্রস্ত করে তোলা হেফাজতে ইসলামের দাবিগুলোও কিন্তু একই রকম। জামায়াত-শিবিরও মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্য, শহীদ মিনার, মন্দিরে মূর্তি ভাঙ্গছে, আগুন দিচ্ছে। হেফাজতে ইসলামীও তাদের মতো করে মূর্তি-ভাস্কর্য স্থাপনের বিরোধীতা করছে।
হেফাজতে ইসলামের ১৩ দফা দাবি দেখলেই বোঝা যায় যে তারা কেমন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করতে চায়। এগুলো মধ্যে কয়েকটি হলো: ব্যক্তি ও বাক-স্বাধীনতার নামে সকল বেহায়াপনা, অনাচার, ব্যভিচার, প্রকাশ্যে নারী-পুরুষের অবাধ বিচরণ, মোমবাতি প্রজ্বলনসহ সকল বিজাতীয় সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ বন্ধ করতে হবে, মসজিদের নগরী ঢাকাকে মূর্তির নগরীতে রূপান্তর এবং দেশব্যাপী রাস্তার মোড়ে ও কলেজ-ভার্সিটিতে ভাস্কর্যের নামে মূর্তি স্থাপন বন্ধ করতে হবে, পার্বত্য চট্টগ্রামসহ দেশব্যাপী ইসলাম বিরোধী কর্মকা-ে জড়িত এনজিও এবং খ্রিস্টান মিশনারীদের ধর্মান্তকরণসহ সকল অপ-তৎপরতা বন্ধ করতে হবে, কথিত শাহবাগী আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী স্বঘোষিত নাস্তিক-মুরতাদ এবং প্রিয় নবী (সা.)-র শানে জঘন্য কুৎসা রটনাকারী কুলাঙ্গার ব্লগার ও ইসলাম বিদ্বেষীদের সকল অপপ্রচার বন্ধসহ কঠোর শাস্তিদানের ব্যবস্থা করতে হবে ইত্যাদি ইত্যাদি।
এ কেমন বাংলাদেশ বানানোর দাবি জানাচ্ছে হেফাজতে ইসলাম? এটা কি বাংলাদেশকে পাকিস্তান বা আফগানিস্তান বানানোরই রুপকল্প না? এই দাবি বাস্তবায়ন হলে নারী-পুরুষ অবাধে মেলামেশা করতে পারবে না। মূর্তি-ভাস্কর্য স্থাপন করা যাবে না। মোমবাতি প্রজ্জলন এদের কাছে বিজাতীয় সংস্কৃতি। হেফাজতে ইসলামের কল্পিত বাংলাদেশে সবাইকেই এক অর্থে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে হবে। আর যদি অন্য ধর্মাবলম্বী কেউ থাকেও তাহলে তারা নিজেদের আচার পালন করতে পারবেন না। এবং এই মুসলিমটাও হতে হবে তাদের তরিকা অনুযায়ী। কারণ তারা কাদিয়ানীদেরও অমুসলিম ঘোষণা করেছে। হেফাজতে ইসলাম যে বাংলাদেশ কায়েম করতে চায় সেটা হবে চরম আকারের সাম্প্রদায়িক, রক্ষণশীল,  গুমোট একটা পরিবেশ। সেখানে কারও স্বাধীন মত প্রকাশের স্বাধীনতা থাকবে না, গণতান্ত্রিক চর্চার সুযোগ থাকবে না। ৪২ বছর আগে মুক্তিযোদ্ধারা জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করেছিলেন কি এই বাংলাদেশের জন্য?

হেফাজতে ইসলাম কেন ইসলামী নিদর্শন ধ্বংস নিয়ে কোন কথা বলে না?

হেফাজতে ইসলাম কতিপয় কিছু কথিত নাস্তিক ব্লগারদের পেছনে লেগেছে। কিন্তু যখন সৌদি আরবে মহানবী হজরত মোহাম্মদ (সাঃ) এর সময়কার, তাঁর স্মৃতিবিজরিত মসজিদসহ অন্যান্য স্থাপনা ভেঙ্গে ফেলা হয় তখন কোথায় থাকেন হেফাজতে ইসলামের লোকজনেরা? সেটাকে তাহলে তারা ইসলামের কোন ক্ষতি বলে মনে করছে না? মহানবীকে নিয়ে কটুক্তি করলে ব্লগার গ্রেপ্তার আর মহানবীর নিদর্শন, যেখানে মহানবী নামাজ পড়েছেন, সেই মসজিদ ভেঙ্গে দিলে কোন সমস্যা নেই?

Macca

বাংলাদেশেও খুবই প্রাচীন একটা মসজিদের সন্ধান পাওয়া গেছে রংপুরের রামজাপুর গ্রামে। ধারণা করা হচ্ছে এটা দক্ষিণ এশিয়ারই প্রথম মসজিদ হতে পারে। কিন্তু সেখানকার গুরুত্বপূর্ণ প্রতœতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলো সরকারী অবহেলায় নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। সে ব্যাপারে হেফাজতে ইসলামের কোন কথাবার্তা নেই কেন? তাহলে এটা কি খুবই পরিস্কার না যে, হেফাজতে ইসলাম আসলে কী হেফাজত করতে চাচ্ছে? তারা প্রকৃতঅর্থেই জামায়াতের হেফাজতকারী। যুদ্ধাপরাধীদের হেফাজতকারী। এদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর সময় এখনই।

আওয়ামী লিগ সরকারের ডিগবাজি

১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত ধর্মের নামে পাকিস্তানী ঔপনিবেশিক শাসকরা এই বাংলাদেশ ভূখ-ের মানুষদের শোষণ করেছিল, নির্যাতন-নিপীড়ণ চালিয়েছিল, খুন-ধর্ষণ করেছিল। সেই অভিজ্ঞতা থেকেই সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে যখন সংবিধান রচিত হয় তখন রাষ্ট্র পরিচালনার চারটি মূলনীতির মধ্যে স্থান দেওয়া হয় ধর্মনিরপেক্ষতাকে। কিন্তু অবাক করে দেওয়ার মতো বিষয় হলো, যে আওয়ামী লিগের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়েছিল, যে আওয়ামী লিগ ১৯৭২ সালে প্রথম সংবিধানটি রচনা করেছিল সেই আওয়ামী লিগই ৪২ বছর পর নতজানু হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধী হেফাজতে ইসলামের কাছে। সরকার নাকি জামায়াতের লেবেলধারী হেফাজতে ইসলামের বেশ কিছু দাবি আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে মেনে নিতে যাচ্ছে। কিছুতেই বোঝা যায় না যে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা হয়ে বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কিভাবে হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে আপোষ করতে পারেন। জয় বাংলার পরে জয় বঙ্গবন্ধু না বললে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ঠিকমতো প্রতিষ্ঠিত হয় না বলে মনে করেন অনেক আওয়ামী লিগার। কিন্তু এখন তো আপনারা বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলার স্বপ্নের বিপরীতেই হাঁটছেন। এ কেমন স্ববিরোধীতা?
হেফাজতে ইসলামের কাছে সরকার যেন নিজের মাথাটাই পেতে দিয়েছে। অত্যন্ত অন্যায়ভাবে গ্রেফতার করা হয়েছে তিনজন ব্লগারকে। তাঁরা কি অবমাননা করেছেন, কিভাবে অবমাননা করেছেন সেগুলো এখনো কারো কাছে স্পষ্ট না। ব্লগ-ব্লগার বলতে হেফাজতে ইসলামই বা কি বোঝেন আর সরকারই বা কি বোঝেন সেটা নিয়েও যথেষ্ট সন্দেহ আছে। সরকার আমারব্লগ বন্ধ করে দিয়েছে। হেফাজতে ইসলামের কথা বাদ দিলাম, ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়তে চাওয়া সরকার কি জানে যে ব্লগগুলোতে শুধু ঐ দুই-তিনজনই লেখেন না। আরও অনেকেই লেখেন। শুধু ধর্ম নিয়েই না, সেখানে রাজনীতি-অর্থনীতি-সমাজ নিয়েও আরও অনেক লেখা ছিল? সেগুলো তাহলে আমরা কিভাবে পড়ব? স্বাধীন মতপ্রকাশের পথ এভাবে কেন বন্ধ করা হবে?
দেশ পরিচালনায় নিযুক্ত ব্যক্তিবর্গ, আপনারা কিভাবে ভুলে যান যে, জামায়াতে ইসলাম ১৯৭১ সালে কিভাবে এদেশের সূর্য্যসন্তানদের হত্যা করেছে। এই একই ধর্মের দোহাই তুলে। ৪২ বছর পরে এবারও স্বাধীনতাবিরোধী গোষ্ঠী সেই একই কায়দায় রুদ্ধ করতে চাইছে এদেশের মুক্ত চিন্তা-স্বাধীন মতপ্রকাশের পথ। আর সরকার মহোদয়রা সেই কাজেই আরও সহায়তা করছেন। এর চেয়ে দুঃখজনক আর কি হতে পারে? বিএনপি যদি এই কাজটা করত তাহলে এটাকে দুঃখজনক বলে আখ্যায়িত করার প্রয়োজন পড়ত না। কারণ তারা তো সেটা করবেই, ঐতিহাসিকভাবে তারা এটা করে এসেছে। এখনো তারা হেফাজতে ইসলামের প্রতি, প্রকারান্তরে জামায়াত শিবিরের প্রতি নৈতিক সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আওয়ামী লিগ? তারা না মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি? এই আওয়ামী লিগই না ১৯৭২ সালে ‘গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতাকে মূল নীতি করে সংবিধান রচনা করেছিল?’ মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকার-চেতনা সব কি ভেসে গেল ভোটের চিন্তায়? পক্ষ নিন সরকার- মানবতা না মুনাফা?

নতজানু আর নয়

শাহবাগ আন্দোলনের শুরুর দিকে অনেকেই ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করে, ১৯৭২ সালের সংবিধান অনুযায়ী ধর্মনিরপেক্ষতার পথে হাঁটার আওয়াজ তুলেছিলেন। সেসময় কৌশলগত কারণে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি বাদ দিয়ে শুধু জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধের দাবিতে সরে আসা হয়েছিল। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে এতে জামায়াত-শিবিরের কর্ম-পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করার পথ প্রসারিত হয়েছে। নিষিদ্ধ হয়ে যাবে বুঝতে পেরেই তারা হেফাজতে ইসলামের ব্যানারে সংগঠিত হচ্ছে। ফলে জামায়াত-শিবিরকে শুধু নিষিদ্ধ করলেই হবে না। নিষিদ্ধ করতে হবে তাদের রক্ষণশীল-সাম্প্রদায়িক মতাদর্শকেও। যেমনটা করা হয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর হিটলারের নাৎসি পার্টিকে। এমনভাবে তাদেরকে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল যে এখনও, ৬২ বছর পরে নাৎসি ভঙ্গিতে স্যালুট দেওয়ার দায়ে আজীবনের জন্য নিষিদ্ধ করা হয় প্রতিভাবান তরুণ ফুটবলারকে। এইরকম কঠোরভাবেই বন্ধ করে দিতে হবে জামায়াত-শিবিরের এখানে সেখানে গজিয়ে ওঠার পথ। তাহলেই কেবল একটি অসাম্প্রদায়িক, মানবিকতার সমাজের পথে অগ্রসর হওয়া সম্ভব বাংলাদেশের পক্ষে। যেমন বাংলাদেশের স্বপ্ন বুকে নিয়ে মুক্তির সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন পুরো দেশের স্বাধীনতাকামী মানুষ। ফলে শাহবাগ চত্বরে দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছে, একথা যদি স্বীকার করে নিই, তাহলে বিজয় অর্জন করতে গেলে সেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নের পথেই হাঁটতে হবে শাহবাগ আন্দোলনকে। ষ্পষ্টভাবে বলতে হবে, ৭১ এ স্বাধীনতাবিরোধী গোষ্ঠী যে আদর্শ-মতবাদের প্রেক্ষিতে রাজনীতি করছে, স্বাধীন বাংলাদেশে সেই মতাদর্শ বাস্তবায়নের কোন অধিকার থাকতে পারবে না। সাংবিধানিকভাবে তাদের রাজনৈতিক অধিকার বিলোপ করতে হবে।

সরকারের স্ববিরোধীতা উন্মোচিত হচ্ছে

যুদ্ধাপরাধীদের সংগঠন জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধের দাবিতে আমরণ অনশনে বসেছিলেন রুমী স্কোয়াডের স্কোয়াডের কিছু স্বপ্নবাজ তরুণ-তরুণী। সরকারের তরফ থেকে তাদের দাবিটা উপেক্ষা করা হয়েছিল টানা ৬টা দিন। এর আগে সরকারকে জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধের প্রক্রিয়া শুরু করার জন্য এক মাসেরও বেশি সময় দিয়েছিল গণজাগরণ মঞ্চ। অনশনের সময় বেশ কয়েকজন অনশনকারী কয়েক দফায় হাসপাতালে গিয়েছে, প্রচণ্ড ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে একটি পুরো রাত পার করেছে। অনুমান করতে পারি যে, এই কয় দিনে অনেক অনেক বাধা-বিপত্তির মুখে তাদের পড়তে হয়েছে। মৃত্যুকে তুচ্ছ করে কেন করছিলেন তাঁরা এইসব? কারণ তাঁরা মনে করছেন, নতুন বাংলাদেশ গঠনের কাজে হাত দেওয়ার আগে দেশের ক্যান্সারস্বরুপ জামায়াত-শিবিরকে আগে নির্মূল করা প্রয়োজন। আর দাবি আদায়ের জন্য তাঁরা কোন জ্বালাও-পোড়াও করছেন না, কাউকে হুমকি-ধামকি দিচ্ছেন না, নিজেদের কথা সরকারের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য তারা নিজেদেরকেই কষ্ট দিচ্ছেন। গতকাল ১ এপ্রিল পরিকল্পনা মন্ত্রী ও  মুক্তিযুদ্ধের সেকেন্ড-ইন-কমান্ড এ.কে.খন্দকারের  আশ্বাসের প্রেক্ষিতে অনশন কর্মসূচি স্থগিত করেছে শহীদ রুমী স্কোয়াড।

rumi

অন্যদিকে সহিংসতা-হরতাল-অবরোধের হুমকি আসছে হেফাজতে ইসলামের তরফ থেকে। যাদেরকে অনেকেই, এমনকি ইসলামী লোকজনই বলেছেন, জামায়াতেরই অন্য রুপ। তারা আসলে ইসলাম না, জামায়াতেরই হেফাজত করতে নেমেছে। ‘নাস্তিক’ ব্লগার ও ধর্মানূভূতিতে আঘাত দেওয়ার শাস্তির দাবিতে চলছে এই আন্দোলন। তাদের ১৩টি দাবি হলো:

১। সংবিধানে ‘আল্লাহ্‌্‌র উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস’ পুনঃস্থাপন এবং কোরান-সুন্নাহ্‌্‌ বিরোধী সকল আইন বাতিল করতে হবে।
২। আল্লাহ্‌, রাসুল (সা.) ও ইসলাম ধর্মের অবমাননা এবং মুসলমানদের বিরুদ্ধে কুৎসা রোধে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে জাতীয় সংসদে আইন পাস করতে হবে।

৩। কথিত শাহবাগী আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী স্বঘোষিত নাস্তিক-মুরতাদ এবং প্রিয় নবী (সা.)-র শানে জঘন্য কুৎসা রটনাকারী কুলাঙ্গার ব্লগার ও ইসলাম বিদ্বেষীদের সকল অপপ্রচার বন্ধসহ কঠোর শাস্তিদানের ব্যবস্থা করতে হবে।

৪। ব্যক্তি ও বাক-স্বাধীনতার নামে সকল বেহায়াপনা, অনাচার, ব্যভিচার, প্রকাশ্যে নারী-পুরুষের অবাধ বিচরণ, মোমবাতি প্রজ্বলনসহ সকল বিজাতীয় সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ বন্ধ করতে হবে।

৫। ইসলামবিরোধী নারীনীতি, ধর্মহীন শিক্ষানীতি বাতিল করে শিক্ষার প্রাথমিক স্তর থেকে উচ্চ মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত ইসলাম ধর্মীয় শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করতে হবে।

৬। সরকারিভাবে কাদিয়ানিদের অমুসলিম ঘোষণা এবং তাদের প্রচারণা ও ষড়যন্ত্রমূলক সকল অপ-তৎপরতা বন্ধ করতে হবে।
৭। মসজিদের নগরী ঢাকাকে মূর্তির নগরীতে রূপান্তর এবং দেশব্যাপী রাস্তার মোড়ে ও কলেজ-ভার্সিটিতে ভাস্কর্যের নামে মূর্তি স্থাপন বন্ধ করতে হবে।

৮। জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমসহ দেশের সকল মসজিদে মুসল্লিদের নির্বিঘ্নে নামাজ আদায়ে বাধা-বিপত্তি ও প্রতিবন্ধকতা অপসারণ এবং ওয়াজ-নসিহত ও ধর্মীয় কার্যকলাপে বাধাদান বন্ধ করতে হবে।

৯। রেডিও, টেলিভিশনসহ বিভিন্ন মিডিয়ায় দাড়ি-টুপি ও ইসলামী কৃষ্টি-কালচার নিয়ে হাসি-ঠাট্টা এবং নাটক-সিনেমায় খল ও নেতিবাচক চরিত্রে ধর্মীয় লেবাস-পোশাক পরিয়ে অভিনয়ের মাধ্যমে তরুণ প্রজন্মের মনে ইসলামের প্রতি বিদ্বেষমূলক মনোভাব সৃষ্টির অপপ্রয়াস বন্ধ করতে হবে।

১০। পার্বত্য চট্টগ্রামসহ দেশব্যাপী ইসলাম বিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িত এনজিও এবং খ্রিস্টান মিশনারীদের ধর্মান্তকরণসহ সকল অপ-তৎপরতা বন্ধ করতে হবে।

১১। রাসুলপ্রেমিক প্রতিবাদী আলেম-ওলামা, মাদরাসা ছাত্র এবং তৌহিদী জনতার ওপর হামলা, দমন-পীড়ন, নির্বিচার গুলিবর্ষণ এবং গণহত্যা বন্ধ করতে হবে।

১২। সারা দেশের কওমী মাদরাসার ছাত্র-শিক্ষক, ওলামা-মাশায়েখ এবং মসজিদের ইমাম-খতিবকে হুমকি-ধামকি ও ভয়ভীতি দানসহ তাদের বিরুদ্ধে সকল ষড়যন্ত্র বন্ধ করতে হবে।

১৩। অবিলম্বে গ্রেপ্তারকৃত সকল আলেম-ওলামা, মাদরাসা ছাত্র ও তৌহিদী জনতাকে মুক্তিদান, দায়েরকৃত সকল মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার এবং আহত ও নিহতদের ক্ষতিপূরণসহ দুষ্কৃতকারীদেরকে বিচারের আওতায় এনে কঠোর শাস্তি দিতে হবে।

এই দাবি নিয়ে আগামী ৬ মার্চ ঢাকামুখী লংমার্চ করার ব্যাপক প্রস্তুতি নিচ্ছেন হেফাজতে ইসলামের নেতা-কর্মীরা। এর ভেতরে বেশ কিছু দাবিই নাকি মেনে নেওয়ার বিষয় বিবেচনা করা হচ্ছে

পরষ্পরবিরোধী দুই পক্ষই আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের চিন্তাচেতনাই শুধু না, দাবি আদায়ের লক্ষ্যে কর্মসূচি বেছে নেওয়ার ধরণেও স্পষ্ট পার্থক্য বিদ্যমান। চট্টগ্রামে একবার হেফাজতে ইসলামের নেতৃবৃন্দকে আলোচনায় বসার আহ্বানও জানানো হয়েছিল গণজাগরণ মঞ্চের পক্ষ থেকে। তারা কিন্তু সেবার আলোচনা করতে রাজি ছিলেন না। অহিংস ও সহিংস, দুই পক্ষেরই দাবি সরকারের কাছে। প্রশ্ন হচ্ছে, সরকার কাদের দাবির কথাটা আগে বিবেচনা করবে? জামায়াতের লেবেলধারী সহিংসতাপন্থী হেফাজতে ইসলামের নাকি মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারী অহিংস শাহবাগ আন্দোলনের?

জামায়াত-শিবিরকে নিষিদ্ধের বিষয়ে সরকার এখনো আনুষ্ঠানিক কোন বক্তব্য দেয়নি। সরকারদলীয় ব্যক্তিবর্গের কথাতে স্ববিরোধীতাও স্পষ্ট। দুই দিন আগেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছিলেন, পুরো দেশে দাবি উঠলে জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধ করব। আজ ২ এপ্রিল আওয়ামী লিগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল হক হানিফ বলেছেন, সমগ্র দেশে এখন জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার দাবি উঠেছে। এই দলকে নিষিদ্ধ করা এখন সময়ের ব্যাপার। তাদের নিষিদ্ধ করার প্রক্রিয়া খুব দ্রুত শুরু হবে।’
খুব দ্রুতটা যে কবে, সেটা কিন্তু এখনো জানা গেল না। শুধু তাই না, শাহবাগ আন্দোলন নিয়ে উষ্মাও প্রকাশ করেছেন দেশ পরিচালনার সঙ্গে জড়িত রাজনীতিবিদেরা।

অন্যদিকে হেফাজতে ইসলামের দাবি দ্রুত মেনে নেওয়ার উদ্যোগ দেখিয়েছে সরকার। ৬ এপ্রিলের লংমার্চের আগেই সরকার ‘আমারব্লগ’ বন্ধ করে দিয়েছে, তিনজন ব্লগারকে গ্রেফতার করে রিমান্ডে নিয়েছে। এবং এই ক্ষেত্রে জনমত যাচাইয়েরও কোন প্রয়োজনীয়তা মনে করেনি সরকার। এটা কি সরকারের স্ববিরোধীতা নয়? ত্বরিতগতিতে তিন ব্লগারকে গ্রেপ্তার-রিমান্ড, ব্লগ বন্ধ ইত্যাদি আলামত থেকে আশঙ্কা হয় যে. সরকার হেফাজতে ইসলামের দিকেই বেশি ঝুঁকে গেছে। কেন এমন হলো? আওয়ামী লিগ না মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি? আওয়ামী লিগ কি তাহলে শুধু ভোটের জন্যই তাহলে মুক্তিযুদ্ধের কথা বলে? সরকারের কর্মকাণ্ড মানুষের মনে এমন অনেক প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে। গণজাগরণ মঞ্চের পক্ষ থেকে ইমরানও ছয়টি প্রশ্ন রেখেছেন সরকারের উদ্দেশ্যে,

 ১. জামায়াত-শিবির চক্র ব্লগে এবং ফেইসবুকে মওদুদীবাদ প্রচারের মাধ্যমে ইসলাম ধর্মকে নানাভাবে যখন প্রশ্নবিদ্ধ করে, তখন কোথায় থাকে রাষ্ট্রীয় বিজ্ঞপ্তির ধর্মানুভূতি?

২. যখন জামায়াত জাতীয় মসজিদে ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ করে তখন কী রাষ্ট্রের ধর্মানুভূতি শীতনিদ্রায় থাকে?

৩. যখন চট্রগ্রামে আলেম সমাজকে হত্যার হুমকি দেয় জামায়াত-শিবিরের শ্বাপদরা, তখন কি রাষ্ট্রের অভিধানে ধর্মানুভূতি শব্দটি অনুপস্থিত থাকে?

৪. যখন জামায়াত-শিবির পুলিশের উপরে নির্বিচারে হামলা চালায়, তাদের হত্যা করে, চিকিৎসককে আগুনে পুড়িয়ে মারে, রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে গৃহযুদ্ধের হুমকি দেয়, রাষ্ট্র তখন কেন তদন্ত কমিশন বানায় না? তখন কি রাষ্ট্র আঘাতপ্রাপ্ত হয় না?

৫. হরতালের নৈরাজ্য সৃষ্টি করে জামায়াত-শিবির যখন দেশকে অস্থিতিশীলতার দিকে ঠেলে দেয়, ব্লগের ক্ষুদ্র গণ্ডি থেকে যে সব গণমাধ্যম ধর্মীয় অবমাননাকর বিষয়গুলো সামনে নিয়ে আসে, তখন রাষ্ট্র কেন কমিশন করে ‍উদ্যোগ নেয় না?

৬. যখন অনলাইন এবং ব্লগে জামায়াত-শিবির বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অপপ্রচার চালায়, তখন কেন মহাজোট সরকার তার বিরুদ্ধে উদ্যোগ নেয় না? আজ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু এবং জাতীয় চার নেতা, মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করার বিরুদ্ধে সরকার কি কোনো উদ্যোগ নিয়েছে?

সরকার এখন এইসব প্রশ্নের জবাব দেবে নাকি এই প্রশ্নগুলোর ড্রাফট কে লিখে দিয়েছে, সেটা তদন্ত করতে বসবে, সেটাই দেখার বিষয়।

সরকার শাহবাগ আন্দোলনের গণদাবির প্রতি কোন ভ্রুক্ষেপ তো করছেই না, উল্টো হেফাজতে ইসলামের রক্ষণশীল দাবিগুলোকে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করছে। সেই দাবি বাস্তবায়নের জন্য পদক্ষেপ নিচ্ছে। সরকার একটি ব্লগ পর্যবেক্ষণ কমিটি বানিয়েছে, সেখানে ইসলাম বিশেষজ্ঞ হিসেবে দুইজন আলেমকে স্থান দেওয়া হলেও কোন ব্লগার সেখানে অন্তর্ভূক্ত হননি। কেন? সরকার শুধু তাদের দিকটাই শুনবে? আর সেটা শুনে যখন যেভাবে যাকে খুশি তুলে নিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারবে? এটা তো ভয়াবহ পরিস্থিতি। ককটেলবাজি-বোমা বিস্ফোরণ, খুন, গাড়ি পোড়ানো, ট্রেনের বগি লাইনচ্যুত করা, ভিন্নধর্মাবলম্বীদের বাড়িঘরে আগুন দেওয়া এইসব সহিংস ঘটনার সঙ্গে যারা জড়িত তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে ধীরেসুস্থে। যারা এগুলো করছে, তাদের নিষিদ্ধ করা হবে ধীরেসুস্থে আর কারো সাথে পাঁচে না থেকে শুধু নিজের মতটা প্রকাশের জন্য দণ্ড পেতে হবে ব্লগারদের? বন্ধ করে দেওয়া হবে মুক্তচিন্তার প্ল্যাটফর্মগুলো? এটা কিধরণের ন্যায়বিচার হলো? এটা তো পুরোপুরি স্বেচ্ছাচারী আচরণ। ডিজিটাল ফ্যাসিবাদের আগমনবার্তা।

এইটাই কি আওয়ামী লিগ সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার নমুনা? ব্লগ বন্ধ করে দিয়ে, ইন্টারনেটের উপর নিয়ন্ত্রণ এনে কিভাবে ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠন করতে চান আপনারা? ব্লগ-ওয়েবসাইট-ফেসবুক পেজের মাধ্যমে তো জামায়াত-শিবিরও ব্যাপক মিথ্যা প্রচারণা চালাচ্ছে। সেগুলোর ব্যাপারে তো সরকারের কোন বক্তব্য নেই। সেই মিথ্যা প্রচারণাগুলো কি কারও অনুভূতিতে আঘাত দেয় না? ধর্ম ছাড়া কি মানুষের আর কোন অনুভূতি নেই?

exposed

বিষয়গুলো প্রশ্ন আকারে উত্থাপিত হলেও সরকারের অবস্থান হয়তো ইতিমধ্যেই অনেকের কাছে স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে। কারণ জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে আঁঁতাত করার ইতিহাস আওয়ামী লিগের আছে। ২০০৬ সালে খেলাফতে মজলিশের সঙ্গে তাদের চুক্তির কথাও আমরা জানি।

425125_10200974897117592_328957520_n

অতীতের এই ঘটনাগুলো আমাদের ইঙ্গিত দেয় যে, আওয়ামী লিগ সরকার আরও একবার আপোষরফা করেছে বা করতে চলেছে রক্ষণশীল গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে। দুর্ভাগ্যবশত, এই আশঙ্কা যদি সত্যি হয় তাহলে শাহবাগ আন্দোলনকে আরও কঠোর-বন্ধুর পথ পাড়ি দেওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। যেহেতু প্রত্যেক ক্রিয়ারই একটি সমান এবং বিপরীত প্রতিক্রিয়া আছে, তাই সরকারকেও বিবেচনা করতে হবে শাহবাগ আন্দোলনের বিপরীতে দাঁড়ানোর পরিনামের কথা। মুক্তচিন্তা-মত প্রকাশের স্বাধীনতার উপর হস্তক্ষেপের পরিণামটা কি হবে, সেটার কথা।

শহীদ রুমী স্কোয়াডের ‘স্পিরিটকে’ শ্রদ্ধা জানাই

শাহবাগের পরিস্থিতিতে নিশ্চিতভাবেই খানিকটা পরিবর্তন এসেছে। অনেকেই অনেক রকমভাবে পরিস্থিতিটাকে বুঝতে চাইছেন, সামগ্রিক আন্দোলনের ক্ষেত্রে পরিস্থিতিটা ইতিবাচক হবে না নেতিবাচক হবে, এই বোঝাপড়া দাঁড় করানোর চেষ্টা করছেন। এককথায় বর্তমান পরিস্থিতিটাকে শাহবাগ আন্দোলনের একটা উল্লেখযোগ্য সময় বলে বিবেচনা করা যেতে পারে।

600237_508446495881318_1053862566_n

যুদ্ধাপরাধী সংগঠন জামায়াত-শিবিরকে নিষিদ্ধের প্রক্রিয়া শুরুর আল্টিমেটাম দেওয়া হয়েছিল গত ২১ ফেব্রুয়ারী। সরকারকে সময় দেওয়া হয়েছিল গত ২৬ মার্চ পর্যন্ত। একমাসেরও বেশি সময়। নিষিদ্ধের প্রক্রিয়াটা কিভাবে হবে সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য সময়টা মনে হয় পর্যাপ্তও ছিল। কিন্তু সরকার এ বিষয়ে একটা কার্যকরী বাক্যও এখন পর্যন্ত উচ্চারণ করেনি। এতদিন ধরে আওয়ামী লিগ স্বাধীনতাবিরোধী গোষ্ঠীকে প্রতিহত করার রাজনীতিই করে এসেছে। এখনই কি সেই জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ করার মোক্ষম সময় নয়? যেখানে পুরো দেশের মানুষের এই পরিমাণ সমর্থন সরকার পাচ্ছে, তখন এই ৩৩ দিনের মধ্যেও সরকারের কাছ থেকে কেন কোন বক্তব্য পাওয়া গেল না? তাহলে কি তারা মুখেই শাহবাগের গণজাগরণের সঙ্গে একাত্মতা জানিয়েছিলেন? জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধ করার সদিচ্ছা তাদের নেই? এই প্রশ্নগুলো আমার ধারণা গতকাল শাহবাগ চত্বরে উপস্থিত অনেকের মনেই ছিল।

এর মধ্যেই শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চ থেকে প্রধানমন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপি প্রদানের কর্মসূচি শোনা যায়। উপস্থিত অনেকেই তখন প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। পরে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ঘেরাওয়ের কর্মসূচি ঘোষণা করে শাহবাগ চত্বরে মিছিল করে আন্দোলনরত বেশ কয়েকটি সংগঠন। আরও কিছুক্ষণ পরে রাত ১০:৩০ টার দিকে জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধের দাবিতে আমরণ অনশনের ঘোষণা দেয় শহীদ রুমী স্কোয়াড। গণজাগরণ মঞ্চের সঙ্গে শুরু থেকেই সম্পূরক-সহায়ক ভূমিকা অব্যাহত রেখেছিল আন্দোলনের ভেতর থেকেই গড়ে ওঠা এই সংগঠনটি। চার রাস্তার মোড়ে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের প্রতিকৃতিটি স্থাপন করে শাহবাগের নৈতিক ভিত্তিটাই যেন আরও পাকাপোক্ত করেছে শহীদ রুমি স্কোয়াডের সংগঠকেরা। তাহলে এখন কেন তাঁরা এমন একটা সিদ্ধান্ত নিলেন যেটা গণজাগরণ মঞ্চের সঙ্গে খানিকটা হলেও দ্বন্দ্বে জড়ায়?

579304_472954829441030_1378672163_n

গতকাল গণজাগরণ মঞ্চ থেকে ঘোষিত পরবর্তী কর্মসূচি মেনে নিতে না পারা থেকেই এসেছে এই আমরণ অনশনের ঘোষণা। শহীদ রুমী স্কোয়াডের ফেসবুক স্ট্যাটাসে লেখা হয়

“আরো এক স্মারকলিপি প্রদাণের ঘোষণা শুনলাম। আলটিমেটাম শেষ হল আজকে আর প্রধাণমন্ত্রীর কাছে পত্র নিয়ে-নিবেদন নিয়ে-কাকুতি মিনতি নিয়ে যাবেন ৪এপ্রিল, এইটা যদি হয় সর্বোচ্চ কঠোর কর্মসূচী, আমরা মনে করি সেটা এই তরুণ প্রজন্মের স্পিরিটের প্রতি অপমান।”

কি এই তরুণ প্রজন্মের স্পিরিট? কোথায় থেকে আসে এই স্পিরিট? কেন তারা কঠোর কর্মসূচি ঘোষণা না করাটাকে এই স্পিরিটকে অপমান করার সামিল মনে করছে? এই “স্পিরিট” জিনিসটা কি? এটা কী সেই স্পিরিট যেখান থেকে ১৯৭১ সালে বিলাসবহুল জীবনযাপনের হাতছানি ছেড়ে দিয়ে জীবন বাজি রেখে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন রুমীরা? এটা কি সেই স্পিরিট যেখান থেকে শহীদ জননী জাহানারা ইমাম তাঁর প্রাণপ্রিয় ছেলেকে কোরবানি করে দিয়েছিলেন দেশের নামে? এটা কি সেই স্পিরিট যেখান থেকে পুরো দেশের মানুষ কোন আগে-পিছে না ভেবে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন মুক্তির সংগ্রামে? আজকের এই শহীদ রুমী স্কোয়াড আর ১৯৭১ সালের রুমিদের স্পিরিটের মধ্যে কি তাহলে সাদৃশ্য আছে? মনে হয়, শহীদ রুমী স্কোয়াডের এই কর্মসূচির রাজনৈতিক বিশ্লেষণের পাশাপাশি তাদের সেই স্পিরিট অনুসন্ধানের কাজটাও সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ।

শহীদ রুমী স্কোয়াডের আমরণ অনশনের কর্মসূচি সামগ্রিক আন্দোলনের ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে কিনা, এটা গণজাগরণ মঞ্চের সাথে দ্বন্দ্বে জড়ায় কিনা, এমন প্রশ্নের জবাব অনশনকারীরা বেশ স্পষ্টভাবে দিয়েছেন।

“স্কোয়াডের পক্ষ থেকে স্পষ্টভাবে জানানো হচ্ছে, আল্টিমেটাম না মানায় পরবর্তী সময়ের জন্য গণজাগরণ মঞ্চের তরফ থেকে যে সকল কর্মসূচির ঘোষণা দেওয়া হয়েছে, তার প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধা এবং সমর্থন দলটির আছে। বরাবরের মতোই প্রতিটি কর্মসূচিতে স্কোয়াডের প্রতিনিধিদের অংশগ্রহণ থাকবে সক্রিয়ভাবেই।”

শুধু শহীদ রুমী স্কোয়াডের অনশনকারীরাই নয়, শাহবাগ চত্বরে আন্দোলনরত আরও অনেক সংগঠন গণজাগরণ মঞ্চের কর্মসূচির সঙ্গে একমত হতে পারেননি। আল্টিমেটামের পর আর স্মারকলিপি দেওয়ার কোন অর্থ হয় না মন্তব্য করে ঘেরাও কর্মসূচির দাবি জানিয়েছিলেন অনেকে। আগামী ৪ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ঘেরাওয়ের কর্মসূচি ঘোষণাও করা হয়েছে। কেন তৈরি হলো এই কর্মসূচি নিয়ে মতভিন্নতা? এতদিন তো এ নিয়ে কোন দ্বিধা-বিভক্তি ছিল না! এখন কেন তৈরি হলো?

কারণ সরকারের ভূমিকা নিয়ে মানুষের মনে অনেক প্রশ্ন জমা হয়েছে। গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ইমরান সরকারই বলেছেন, “দুঃখজনক হলেও সত্য, আল্টিমেটামের সময় পেরিয়ে গেলেও সরকারের টনক নড়েনি।” শুধু আল্টিমেটামের ক্ষেত্রেই না, আরও অনেক ক্ষেত্রে সরকারের টনক নড়েনি।  পত্রপত্রিকার প্রতিবেদনে জানা যাচ্ছে যে, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুন্যালে রাষ্ট্রপক্ষের গাফিলতি-প্রস্তুতিহীনতা ছিল। প্রসিকিউটর তালগোল পাকিয়ে ফেলেছেন। এবং এসময় বলা হয় রাষ্ট্রপক্ষ যদি যুক্তি দিয়ে বিচারকদের সন্তুষ্ট করতে না পারেন, তাহলে রায়ে তার প্রতিফলন ঘটবে। তাহলে যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করার জন্য এরকম যেন ভবিষ্যতে না হয়, সে ব্যাপারে রাষ্ট্রপক্ষকে সচেতন করে দেওয়ার কাজটা কি শাহবাগ আন্দোলনের কর্মীদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না? ট্রাইবুন্যাল গঠনের ৩ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে গত ২৫ মার্চ প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায় যে, ট্রাইবুন্যাল এখনো জনবল ও অবকাঠামোর দিক থেকে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে পারেনি। মানবতাবিরোধী অপরাধের সাড়ে পাঁচশ অভিযোগ এখনো তদন্তের অপেক্ষায় পড়ে আছে। তদন্ত সংস্থার পূর্ণাঙ্গ অবকাঠামো কার্যকর না থাকায় সেই কাজগুলো করা যাচ্ছে না। তদন্ত সংস্থার জন্য ৩৫১ জনের জনবলকাঠামো অনেক কষ্টে অনুমোদন হলেও সেটা শুধুই আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে আটকে আছে গত চার মাস ধরে। তিন বছরেও ট্রাইবুন্যালের জন্য একটা ওয়েবসাইট তৈরি হয়নি। সরকার গত চার বছরে অনেক বিরোধী মতামতকে  যুদ্ধাপরাধের বিচার বানচালের ষড়যন্ত্র বলে আখ্যায়িত করেছে। কিন্তু তারা কি যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করার জন্য নিজেরা যথেষ্ট কর্মতৎপরতা দেখিয়েছেন? এখন তো দেখা যাচ্ছে তারা এতদিন অনেক গাফিলতি করেছেন যুদ্ধাপরাধের বিচারের ক্ষেত্রে। অন্য অনেক জায়গায় যেখানে গণহারে নিয়োগবাণিজ্যের অনেক খবর আমাদের চোখে পড়ে সেখানে ট্রাইবুন্যালে কেন নিয়োগকার্য সম্পন্ন করা হচ্ছে না? কেন প্রয়োজনীয় জনবল নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে না সবকিছু ঠিকঠাক থাকার পরও? এটা কি যুদ্বাপরাধের বিচার বাধাগ্রস্থ করছে না? এই বিষয়গুলো নিয়ে কি সরকারকে প্রশ্ন করার জায়গা নেই?

শাহবাগ আন্দোলন শুরু হয়েছিল প্রশ্ন করার প্রবণতা থেকেই। সরকার যেভাবে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকার্য্যে অংশগ্রহণ করেছে এবং তার প্রেক্ষিতে আদালতে যে রায় ঘোষিত হয়েছিল তার প্রতিবাদ করতে, ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতেই তৈরি হয়েছিল শাহবাগ চত্বর। পুনরুদ্ধারিত হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, জয় বাংলা শ্লোগান। শহীদ রুমী স্কোয়াডের অনশনকারীরা তো এই চেতনা থেকে, মূল দাবি থেকে দূরে সরে যায়নি। তাহলে তাদেরকে মূল আন্দোলন থেকে পৃথক বা আলাদা কিছু ভাবা হবে কেন? তাদের পাশে দাঁড়াবো না কেন? বরং শহীদ রুমী স্কোয়াডের এই কর্মসূচি এটাই প্রমাণ করে দিল যে, ন্যায়বিচার না পাওয়া পর্যন্ত, দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত তরুণ প্রজন্মের প্রতিবাদী চেতনা হারিয়ে যাবে না। কেউ যদি এই ‘দৃশ্যত পৃথক’ এই কর্মসূচিটির বিরোধীতাও করেন, তাদের প্রতি অনুরোধ সমালোচনা করার আগে প্লিজ অনশনকারীদের ‘স্পিরিট’কে শ্রদ্ধা জানাবেন, সম্মান জানাবেন। অনশন কর্মসূচির রাজনৈতিক ব্যবচ্ছেদ করার আগে বোধহয় এই ‘স্পিরিট’-এর উৎস অনুসন্ধানটাই জরুরি।

524931_457840020952511_1059102782_n

ইতিহাস নির্ধারণী মুহূর্তের সামনে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ

bangladesh_illus_20130318

বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও শাহবাগ চত্বরের আন্দোলন নিয়ে বেশ কয়েকটি ভুল ধারণা চালু হয়েছে। শাহবাগ চত্বর থেকে সরকারকে চাপ দেওয়া হচ্ছে দ্রুত জামায়াত-ই-ইসলামী নিষিদ্ধ করার কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুন্যালের সমালোচকেরা এই বিচারপ্রক্রিয়া নিয়ে আপত্তি তুলেছেন। কেউ কেউ এটাকে আখ্যায়িত করছেন ‘পক্ষপাতদুষ্ট’ বলে। আরেকটি অভিযোগ হলো, এই বিচার করা হচ্ছে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ও বিরোধীদলীয় নেতাদের ঘায়েল করার জন্য। এই উদ্বেগ-আশঙ্কাগুলো পশ্চিমা গণমাধ্যমের ফিল্টার গলে প্রকাশিত হয়েছে। আর এর পেছনে আছে কিছু সুসংগঠিত জনসংযোগ তত্পরতা, যেগুলো চালানো হচ্ছে কিছু নেতৃস্থানীয় জামায়াত নেতাদের তরফ থেকে।

এই নিন্দুকেরা যা বুঝতে ব্যর্থ হয়েছেন সেটা হলো, ১৯৮৯ সালে গণঅভ্যুত্থানের মধ্যে দিয়ে সামরিক শাসনের অবসান ঘটানোর পর এবার বাংলাদেশ ফিরে পাওয়ার চেষ্টা করছে তার জন্মকালীন আদর্শগুলোকে। বাঙ্গালী সংস্কৃতির অপহূত বহুমতভিত্তিক অসাম্প্রদায়িক মূল্যবোধকে। ৭১’র মুক্তিযুদ্ধের সময়কে ঘিরে গড়ে ওঠা বিতর্কিত ঘটনাগুলোর অবসান ঘটানোর কাজটাও তাদের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। এটা বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষের কাছেই একটা আবেগীয় ইস্যু। দেশের ভেতরে ও প্রবাসী, উভয়ের জন্যই। আর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুন্যাল গঠন এই লক্ষ্যপূরণের পথে একটা বিশাল ধাপ।

এই দেশ বা রাষ্ট্র ফাঁসির দাবিতে উন্মত্ত জনতা বা কোন ডেথ স্কোয়াড তৈরি করে নি। বা শুধু বিরোধীদলীয় নেতৃবৃন্দকে মেরে ফেলার জন্য এই বিচারপ্রক্রিয়া শুরু করেনি। যুদ্ধাপরাধের দায়ে বিচারাধীনদের মধ্যে অনেকেই স্বীকার করেছে যে, তারা ১৯৭১ সালে নৃশংশতার সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত ছিল। পুরোপুরি নিখুঁত না হলেও আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুন্যাল প্রতিষ্ঠিত মানদণ্ডের ভিত্তিতে, আইনের রীতিনীতি মেনেই ক্রিয়াশীল আছে। এছাড়াও, এটা আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে, পুরো বিশ্বজুড়েই এই ধরণের বিশেষ ট্রাইবুন্যাল গঠনের ঘটনাগুলো অনেক বিতর্কের মুখে পড়ে। বিচারিক কর্মকাণ্ডগুলো প্রশংশিত বা নিন্দিত হয় কোন পক্ষের দিকে দিকে রায় যাচ্ছে, তা বিবেচনা করে।

এই বিষয়টা নিয়ে ভারতীয় বা আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে দেখা যাচ্ছে খুবই সাধারণীকৃত বিবরণী। কিন্তু শাহবাগের বিশাল লোকসমাগমটা শুধুই কিছু জামায়াত নেতার ফাঁসির দাবিতে হয়নি। এটা এর চেয়েও অনেক বেশি কিছু। এটা নির্ধারণ করবে বাংলাদেশ ভবিষ্যতে কোন পথে হাঁটবে। বহুমতভিত্তিক অসাম্প্রদায়িক চেতনার পথে নাকি জামায়াত প্রবর্তিত ভীনগ্রহের মতবাদস্বরুপ ধর্মীয় মৌলবাদের পথে।

চলমান এই আন্দোলনের নেতৃস্থানীয়দের অনেকে নিজেদেরকে ডাকছেন ‘প্রজন্ম ৭১’ নামে। এরা কেউই ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ ও পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসর জামায়াতের নেতৃত্বে রাজাকার-আলবদরদের নৃশংস-নির্মম সহিংসতা দেখেননি। কিন্তু বর্বর আক্রমণের সেই স্মৃতি, এই জাতির সামগ্রিক চেতনার সঙ্গে গেঁথে গেছে আজীবনের জন্য। এই তরুণ প্রজন্ম স্মৃতি-ইতিহাস থেকে শুধু অনুপ্রেরণাই সংগ্রহ করছে না; এটা সবার মাথায় রাখা দরকার যে, এই প্রজন্মের অনেকেই মুক্তিযুদ্ধের সময় তাদের খুবই কাছের মানুষদের খুন হওয়ার কথা জেনেছে, রাজাকারদের হাতে। ফলে ১৯৭১ সালের নৃসংশ সহিংসতার জন্য দায়ী যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি যে বাংলাদেশীদের চেতনাগত জায়গায় নাড়া দেবে, এটাতে বিস্ময়ের কিছু নেই। আর তারা শাহবাগ চত্বরে আসতেই আছেন।

একদিক থেকে, এই তরুণ প্রজন্ম ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের চেতনারও পুনরুজ্জীবন ঘটাতে সক্ষম হয়েছে। যেটা গড়ে উঠেছিল বাংলা ভাষাভাষী তত্কালিন পূর্ব পাকিস্তানের মানুষদের উপর জোর করে রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসেবে উর্দু চাপিয়ে দেওয়ার প্রবল প্রতিবাদে। সেইসময়ই এই ভূখণ্ডে রোপণ হয়েছিল একটি অসাম্প্রদায়িক দেশ গঠনের স্বপ্ন। সেই স্বপ্ন পূর্ণতা পায় ১৯৭১ সালে নয়মাসব্যাপী রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে। একইভাবে, ১৯৮৯ সালের ডিসেম্বরে জনসাধারণের ঢল নামে রাজপথে। সেবার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে সামরিক স্বৈরতন্ত্রকে ক্ষমতাচ্যুত করেছিল তারা।

বাংলাদেশের ইতিহাসের এই গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলো এটাই প্রমাণ করে যে, যখনই দেশের রাজনীতি তার মূল ভিত্তি উদারনৈতিক বহুমতবাদের মূল জায়গা থেকে সরে যাচ্ছে, তখন রাজনীতিকে সঠিক পথ দেখানোর একটা অসাধারণ ক্ষমতা  এই দেশের মানুষের আছে।

সালাফি মতবাদের একটি সংযোজিত রুপ হচ্ছে জামায়াত। এবং এই সংগঠনটি বাংলাদেশী চিন্তাচেতনার সঙ্গে মিলতে পারে না। পুরো ৮০ ও ৯০এর দশক জুড়ে জামায়াত ও তাদের সহযোগী সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর (যেমন জেএমবি, জেএমজেবি, হরকাতুল জিহাদ) হামলার শিকার ছিল সমাজের প্রগতিশীল, অসাম্প্রদায়িক উপাদানগুলো। এবং এনজিও-র দ্বারা ক্ষমতায়িত গ্রামের নারীরা।

জামায়াতও এখন করছে একটা বাঁচামরার সংগ্রাম। তারা এটা অনুধাবন করতে পারে যে, জনগণের মনোভঙ্গি তাদের বিরুদ্ধে চলে যাচ্ছে। সেকারণে তারা রাষ্ট্রের সঙ্গে সংঘর্ষমূলক অবস্থানে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বাংলাদেশে বসবাসরত হিন্দু ও ভারতকে দোষারোপ করে, সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর উপর সহিংস হামলা চালিয়ে তারা মূল ইস্যুটা থেকে সবার দৃষ্টি ফেরাতে চাইছে।

সমাজের অভিজাত, মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত তথা আপামর জনসাধারণের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা শাহবাগ চত্বরের গণজাগরণ, বাংলাদেশকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে ইতিহাস নির্ধারণী মুহূর্তের সামনে। বিশ্ব এই মুহূর্তে ইতিহাসের একটা গতিপথ সংশোধন প্রক্রিয়ার স্বাক্ষী হয়ে থাকছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় তারা এটার গুরুত্বটা সঠিকভাবে অনুধাবন করতে পারছে না। ১৯৫২, ১৯৭১-এর মতো এই গণজাগরণই একটা সংকেতরুপে দেখা দেবে, যা নির্ধারণ করে দেবে বাংলাদেশের ভবিষ্যত্।

নাফিস আফরোজের এই লেখাটি ভারতের আউটলুক পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে লেখক বিবিসি ওয়ার্ল্ডের দড়্গিণ ও পশ্চিম এশিয়ার সাবেক নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন

নাস্তিকতার বিভ্রান্তি দূর হবে কিভাবে?

556684_10151485313048104_1449525823_n

প্রচণ্ড কোনঠাসা অবস্থার মধ্যে পড়েও জামায়াত-শিবিরই মনে হয় এখন পর্যন্ত কৌশলগত দিক থেকে সফল। শুরুতেই তারা রাজীব হায়দারকে খুন করে শাহবাগ আন্দোলনটাকে ‘আস্তিক-নাস্তিক’ পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছে। ভেবেছিলাম এই কৌশলটা ধোপে টিকবে না। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে যে, এই পরিকল্পনা দারুণভাবে সফলতা অর্জন করেছে। এখন জামায়াত-শিবিরের বদলে হেফাজতে ইসলামকে আদর্শিকভাবে মোকাবিলা করাটাই একটা বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিভাবে দূর করা যাবে এই নাস্তিকতার বিভ্রান্তি? কি পরিকল্পনা গণজাগরণ মঞ্চের? সরকারের?

ধোঁয়াশাপূর্ণ সব বক্তব্য দিয়ে আন্দোলন-কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে হেফাজতে ইসলাম। জিজ্ঞাসা করলে কোন প্রশ্নের উত্তর তাঁরা স্পষ্ট করে দিতে পারবেন কিনা সন্দেহ আছে। ‘নাস্তিক ব্লগার-নাস্তিক ব্লগার’ রব তুলে তারা সবার মনোযোগ কেড়ে নিয়েছে ঠিকই, কিন্তু ব্লগিং বা নাস্তিকতা সম্পর্কে তাদের কোন স্বচ্ছ ধারণাই নেই বলে প্রতিয়মান হয়।

গতকাল রাতে বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাতকারে হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা জুনায়েদ বাবু বলেন, ‘আমাদের দাবি হলো, বর্তমানে যে ব্লগাররা আছে, যারা রাসুল (সা.)-এর অবমাননাকারী, ইসলামের বিদ্বেষী, নাস্তিক্যবাদী, তাদের শাস্তি হওয়া উচিত। সরকার যেন তাদের উচিত শাস্তি দেয়।’ আপনি যেসব ব্লগারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করছেন, তারা অসলে কী লিখেছে, আপনি কি একটা বলতে পারবেন? আপনি নিজে তা পড়েছেন? বিবিসির এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘না, পড়ি নাই। না পড়লেও সমস্যা নাই, আমার যারা কর্মী আছে, কর্মীদের আমরা দায়িত্ব দিছি। তারা পড়েছে। তারা আমাদের শুনাইছে। তারা তো সেইগুলা আমাদের সামনে নিয়া আসছে।’ সেই সব ব্লগারের উচিত শাস্তিটি কী—বিবিসির এই প্রশ্নের উত্তরে মাওলানা জুনায়েদ বাবু বলেন, ‘আমাদের দাবি হলো উচিত শাস্তি দিতে হবে, তারা যেন এই সমস্ত কাজ আর না করে।’

আগে জানতাম নেতারাই পড়াশোনা করে কর্মীদের হেদায়েত দান করেন, সবার নানারকম প্রশ্নের জবাব দেন। এখন তো দেখা যাচ্ছে হেফাজতে ইসলামের কর্মীরাই নেতাদেরকে সবকিছু জানানোর দায়িত্বটা পালন করছে। ভালো কথা, তা করুক। কিন্তু কোন সুনির্দিষ্ট যৌক্তিক বক্তব্য কিন্তু পাওয়া যাচ্ছে না এই নেতা-কর্মীদের কাছ থেকে। তারা দাবি করছে যারা এই সমস্ত কাজ করে তাদের উচিত্ শাস্তি দিতে হবে। ব্যাপারটা এমন দাঁড়িয়েছে যে, কি কাজ, কে করেছে, কবে করেছে, প্রমাণ কিছু আছে কিনা— কোন কিছুই বুঝি না, তারপরও বিচার চাই। এর চেয়ে হাস্যকর-অযৌক্তিক কোন বিষয় এই একবিংশ শতাব্দীর পৃথিবীতে হতে পারে?

এখন পুরো ব্যাপারটা দেখা হচ্ছে জামায়াত-শিবিরের সঙ্গে হেফাজতে ইসলামের সংযুক্তি-সম্পৃক্ততার বিষয় হিসেবে। কিন্তু এই দিক দিয়ে জিনিসটা মোকাবিলা করতে গেলে আরও প্যাঁচ লেগে যাওয়ার আশঙ্কা আছে। বাংলাদেশে ধর্মভীরু মুসলমানের সংখ্যা কম নয়। কয়েকদিন আগেই সাঈদীকে চাঁদে দেখিয়ে অনেক মানুষকে উন্মত্ত করে তুলেছিল জামায়াত-শিবির। ভবিষ্যতে যদি হেফাজতে ইসলামের বিরুদ্ধেও শাহবাগ আন্দোলনের প্রকাশ্য বিরোধ শুরু হয়ে যায়, তাহলে তার পরিণাম বোধহয় ভালো হবে না। গণজাগরণ মঞ্চের পক্ষ থেকে ধর্ম বিষয়ক বিভ্রান্তি দূর করার সর্বোচ্চ চেষ্টাই আমার ধারণা করা হয়েছে। শাহবাগ চত্বরে বারবার উচ্চারিত হয়ে যে, ‘এই আন্দোলনের সঙ্গে ধর্মের কোন বিরোধ নেই, ধর্ম যার যার, দেশ সবার’ ইত্যাদি। যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে ইসলামপন্থী ওলামা-মাশায়েখ ঐক্য পরিষদের নেতৃবৃন্দও সোচ্চার হয়েছেন। তাঁরাও দৃঢ়কণ্ঠে জানিয়েছেন যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবি। তারপরও এই ধর্ম-নাস্তিকতার কার্ড খেলে যাচ্ছে হেফাজতে ইসলাম। গণজাগরণ মঞ্চের সঙ্গে কোন আলোচনাতে যেতেও রাজি নয় তারা। তাহলে এখন এই বিভ্রান্তিমূলক পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের উপায় কি?

285661_586128814749514_2133248007_n

এখন বোধহয় এ বিষয়ে সরকারের অনেক কিছু করার আছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা থেকে শুরু করে দেশ চালানোর কাজে নিযুক্ত সব্বাই তো শাহবাগের গণজাগরণকে সমর্থন জানিয়েছিলেন একবাক্যে। তারা কি করছেন আসলে? কেন দূর করছেন না এই বিভ্রান্তি? বাংলাদেশের ধর্ম মন্ত্রণালয় কি করছে? তাদের দিক থেকে কোন বিবৃতি নেই কেন? সরকারের পক্ষ থেকে সুনির্দিষ্টভাবে শুনতে চাওয়া হোক হেফাজতে ইসলামের অভিযোগসমূহ। কোন ব্লগারের বিরুদ্ধে তারা ব্যবস্থা নিতে বলছেন? কোন ব্লগগুলোকে তারা “প্রিয় নবীজির (সা.) শানে বেয়াদবির” সামিল বলে মনে করছে? কোন বিষয়গুলোকে তারা “জনগণের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার” সামিল বলে মনে করছে? সুনির্দিষ্টভাবে শুনতে চাওয়া হোক। তাহলেই তো সকলের কাছে স্পষ্ট হয়ে যাবে তাদের অবস্থান। অযথাই কান নিয়ে গেছে চিলে বলে দিশাবিহীন দৌড়াদৌড়ি করার কি দরকার?

এই মুহূর্তে হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে জামায়াত-শিবিরের সংশ্লিষ্টতা খোঁজার চেয়ে এই প্রশ্নগুলোর উত্তর জানতে চাওয়াটাই তো মনে হয় বেশি জরুরি। কারণ জামায়াত-শিবির আজ হেফাজতে ইসলামের আড়ালে কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে, কাল অন্য কিছুর আড়ালে আশ্রয় নেবে। এর মূলে হাত দেওয়াটাই কি জরুরি না?

ব্লগ বনাম বোমা: শাহবাগ-জামায়াতের সাইবার যুদ্ধ

shibir-hacked1s

বাংলাদেশের প্রগতিশীল জনগোষ্ঠী ও মৌলবাদীদের মধ্যে সুস্পষ্ট একটা রেখা টেনে দিয়েছে শাহবাগ আন্দোলন।  আর এই দুইটা বিপরীতমুখী চিন্তাধারার দ্বন্দ্ব, সমাজের প্রতিটা ধাপে, প্রতিটা শ্রেণীর মানুষের উপরেই প্রভাব ফেলছে।

জামায়াতে ইসলামী ও শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের কর্মীদের মধ্যে একটা পুরোদস্তুর সাইবার যুদ্ধ চলমান আছে। এই দ্বন্দ্বটা এতটাই ঘনীভূত হয়েছে যে, অনলাইন তত্পরতা নজরদারিতে রাখার জন্য সরকার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে ৯ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেছে। কোন ব্লগে বা ফেসবুকে উস্কানিমূলক কোন পোস্ট দেওয়া হচ্ছে কিনা, সে ব্যাপারে নজর রাখছে এই কমিটি।

৭১-এর গণহত্যার সঙ্গে জড়িত যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে চলমান শাহবাগ আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে ব্লগাররা। [যুদ্ধাপরাধী সংগঠন] জামায়াত ই ইসলামী ও তাদের রাজনৈতিক মিত্র দলগুলো এখন এই গণজাগরণ মঞ্চের বিরুদ্ধে অনলাইন প্রচারণা চালানো শুরু করেছে। তারা শাহবাগ আন্দোলনের প্রগতিশীল নেতাকর্মীদের আখ্যা দিয়েছে ‘ইসলামের শত্রু’ হিসেবে।

জামায়াতের কর্মীরা শাহবাগ আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত অনেক ব্লগারের ব্লগ-ওয়েবসাইট হ্যাক করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। চট্টগ্রামের একজন অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট বলেছেন, ‘জামায়াত-শিবির প্রায়শই আমাদের ওয়েবসাইট-ব্লগগুলো হ্যাক করে সেগুলোর লেখাপত্র বিকৃত করছে।’ শাহবাগ আন্দোলনের আরেক সংগঠক শাহ আসিফ বলেছেন, ‘চট্টগ্রামে  গণজাগরণ মঞ্চের সমাবেশের বিরোধীতাকারী ধর্মীয় সংগঠন হেফাজত-ই-ইসলাম আমাদের অভিযুক্ত করেছে নাস্তিক/ধর্মের নিন্দাকারী হিসেবে। আমরা আমাদের কিছু ব্লগ খুলে দেখি, সেগুলো হ্যাক করে ভিতরের পোস্টগুলো বিকৃতি করা হয়েছে।’ বিপরীতে এই সাইবার আক্রমণ প্রতিরোধের জন্য একই রকম রণকৌশল অবলম্বন করছে শাহবাগপন্থী অ্যাক্টিভিস্টরা। তারা হ্যাক করছে জামায়াতের ব্লগগুলো।

বাংলাদেশের প্রধানতম অনলাইন সংবাদপত্রের সম্পাদক তৌফিক ইমরোজ খালেদি অবশ্য শাহবাগের এই সাইবার অ্যাক্টিভিজমকে শুধুই একটা ভার্চুয়াল জগতের আন্দোলন হিসেবে দেখতে রাজি নন। তাঁর মতে, অনলাইন মিডিয়া এখন বাংলাদেশের মূলধারার গণমাধ্যমের পরিপূর্ণ অংশ। মালয়েশিয়ায় চারজন ব্লগারের সংসদ নির্বাচনে জয়লাভ করার উদাহরণ দেখিয়ে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে, প্রায় ৩২ মিলিয়ন মানুষের ইন্টারনেট প্রাপ্যতা আছে। নেটিজেন জনগোষ্ঠীর একটা বড় অংশ ইন্টারনেট সংযুক্ত হন তাদের সেলফোন দিয়ে।’

শাহবাগ আন্দোলনের কর্মী ও চলচ্চিত্রনির্মাতা ইমরান ফেরদৌস স্বীকার করেছেন যে, অনলাইন প্রচারণা দিয়ে সত্যিই একটা পরিবর্তন আনা সম্ভব। বিপরীতদিকে জামায়াতও এত সহজে হাল ছেড়ে দেবে না। কারণ তাদের খুবই শক্তিশালী অর্থনৈতিক সহায়তা আছে। এছাড়াও আছে একটা সুসংগঠিত ক্যাডারবাহিনী। জামায়াতের এই সুসংবদ্ধ সংগঠন ও অর্থনৈতিক ক্ষমতাকে মোকাবিলা করাই শাহবাগ আন্দোলনের অন্যতম কঠিন চ্যালেঞ্জ।

– লেখাটি টাইমস অব ইন্ডিয়ায় প্রকাশিত হয়েছে ১৪ মার্চ, ২০১৩ তারিখে

সাবাশ বাংলাদেশ, এ পৃথিবী অবাক তাকিয়ে রয়

এই মুহূর্তে মনে হয় সত্যিই পৃথিবী তাকিয়ে আছে বাংলাদেশের দিকে। বা বলা যায় তাকানো শুরু করেছে, কিছুটা সংশয়, কিছুটা আশাবাদ, কিছুটা কৌতুহল-বিস্ময় নিয়ে। গত ৫ ফেব্রুয়ারি শাহবাগ আন্দোলন শুরু হওয়ার পর আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনগুলো থেকে আমরা সেরকমই একটা ইঙ্গিত পেয়েছি। আন্তর্জাতিক মিডিয়ার কাভারেজের পরিমাণ বা ধরণ নিয়ে অনেকেরই অনেক সমালোচনা আছে। আমার নিজেরও আছে। কিন্তু এর মধ্যেও, বাংলাদেশের এই গণজাগরণ যে পুরো বিশ্বের সামনেই একটা বিকল্প রুপকল্প দাঁড় করিয়েছে, সে কথা উঠেছে বর্হিবিশ্ব থেকেই। এবং বাংলাদেশ যে বিশ্বকে আরও অনেক শিক্ষা-বার্তা দিতে পারে; শাহবাগ চত্বর যে পুরো বিশ্বের সামনেই নতুন এক দিগন্ত উন্মোচন করতে পারে, তেমন সম্ভাবনার কথাও উচ্চারিত হয়েছে বর্হিবিশ্বের মানুষদের মুখে। এবং তারা এই সম্ভাবনার কথা বলেছেন সম্ভ্রমের সঙ্গে, আশার সঙ্গে। কিন্তু কেন এই সম্ভ্রম, আশাবাদ?  পুরো বিশ্ব কেন তাকিয়ে আছে শাহবাগ চত্বরের ঐক্যবদ্ধ তারুণ্যের দিকে?

1

১৯৭১ সালে যে হানাদার পাকসেনাদের বিরুদ্ধে রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছিলাম, ৪২ বছর পর শাহবাগ আন্দোলন তার প্রথম শিক্ষাটা দিয়েছে এই পাকিস্তানকেই। দীর্ঘ ৪২ বছর ধরে পাকিস্তানের শাসকেরা তাদের নাগরিকদের-শিক্ষার্থীদের শিখিয়েছে ভুল ইতিহাস। বাংলাদেশ নামক ভূখণ্ডের এই মানুষগুলো যে সবক্ষেত্রে প্রচ্ল অনাচার-বৈষম্য-নির্যাতন-নিপীড়ণের শিকার হওয়ার পর স্বাধীনতার ডাক দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, সেই ইতিহাসটা পাকিস্তানের বেশিরভাগ মানুষ জানে না। বা যারা জানে, তাদের বৃহদাংশ মনে করে শুধুমাত্র সেনাবাহিনীর প্রশাসনিক ব্যর্থতার কারণে বাংলাদেশ একটা স্বাধীন দেশ হিসেবে দাঁড়াতে পেরেছে। এবং অনেকেই মনে করেন যে, স্বাধীন বাংলার জন্ম না হলেই ভালো হতো।

কিন্তু এই রকমের ইতিহাস বিকৃতির ফলাফল যে ভালো হয় না সেটা খুব স্পষ্টভাবে বলেছেন পাকিস্তানের এক ইতিহাসের শিক্ষক। ১৮ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের ট্রিবিউন পত্রিকায় প্রকাশিত এক লেখায় ইয়াকুব খান বাঙগাস লিখেছেন,

‘১৯৭০-৭১ সালের ঘটনাগুলোর দিকে আমাদের দৃষ্টি দিতে না চাওয়ায় আমরা এখনো আমাদের অন্যান্য সাংবিধানিক প্রদেশগুলো নিয়ে অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে আছি। এবং আমরা নিজেদের পৃথক পৃথক পরিচিতি নিয়ে গর্ব বোধ করতে পারি না। আমরা ভয় পাই যে, সিন্ধু আমাদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে কারণ সেখানকার মানুষেরা উর্দুর পাশাপাশি তাদের ভাষাটারও স্বীকৃতি চায়। আমরা বেলুচিস্থানে একটা সামরিক অপারেশন চালিয়েছি তার প্রধান কারণ হলো, সেখানকার মানুষেরা তাদের প্রদেশটি নিজেরাই পরিচালনা করতে চেয়েছে। আমরা অস্বস্তিতে আছি এটা ভেবে যে, দক্ষিণ পাঞ্জাব ও বাহাওয়ালপুর আলাদা প্রদেশ হয়ে যায় কিনা। সেখানে একটা আকস্মিক অভ্যুত্থান ঘটে যায় কিনা, এই ভয়ে আমরা ব্যাপারগুলো নিয়ে আলাপ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছি এবং আমরা গিলগিট-বালিস্তানের মানুষদের পূর্ণ নাগরিক অধিকার দেই নি। এগুলোর বেশিরভাগই হচ্ছে ঐ বিগত দিনের ঘটনাগুলোর ভূত। আমরা সেগুলো নিয়ে ভাবতে চাই না, অগ্রাহ্য করি আর আশা করি যে, আলৌকিকভাবে সেগুলো নিজে থেকেই গায়েব হয়ে যাবে।’

কিন্তু তেমনটা যে বাস্তবে হয় না, সেকথাও পরিস্কারভাবেই বলেছেন ইয়াকুব খান। এবং পাকিস্তান যদি এই সমস্যাগুলোর কার্যকর সমাধান করতে চায়, তাহলে দেশটির শাসকদের বাংলাদেশের কাছ থেকেই শিক্ষা নিতে হবে বলে মত দিয়েছেন ইতিহাস বিভাগের এই শিক্ষক। তিনি বলেছেন, ‘ ইতিহাস খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শুধু এই কারণে না যে, সেটা নিজে থেকেই পুনরাবৃত্তি ঘটায় বা ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা আছে। বরং ইতিহাস এইজন্যও গুরুত্বপূর্ণ যে, বারংবার ঐতিহাসিক ঘটনাগুলো অগ্রাহ্য করা একটা দেশের জাতিগত চেতনায় প্রভাব ফেলে। এবং পুরো দেশটাই পুরোনো ঐ ঘটনাগুলোর কবলে জিম্মি হয়ে থাকে।’ সমাধান হিসেবে তিনি পাকিস্তান সরকারকে দেখিয়েছেন ভুল স্বীকার করার পথ। লিখেছেন, ‘পাকিস্তানি সরকারের জন্য এটাই সুবর্ণ সময়, তত্কালিন পূর্ব পাকিস্তানের মানুষদের উপরে তারা যে বর্বরতা চালিয়েছিল সেটা আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার করার। সত্য ঘটনাকে সামনে নিয়ে আসবে এমন ঐতিহাসিক দলিলগুলো এতদিন ধরে তারা লুকিয়ে রেখেছে। সেগুলো সবার জন্য উন্মুক্ত করতে রাজি হতে হবে। সেমময়কার যেসব অপরাধী এখনো বেঁচে আছে তাদেরকে আইনের আওতায় এনে ন্যায়বিচার করতে হবে। জনসমক্ষে ঘোষণা দিতে হবে যে, ১৯৭০-৭১ সালে আমরা একটা জাতি হিসেবে, হ্যাঁ, আমরা, সামগ্রিকভাবে যা করেছি সেটার জন্য আমরা দুঃখিত।’ সেটা পাকিস্তান সরকার করবে কিনা, সেটা তাদের ব্যাপার।

আমাদেরকে তো এই মুহূর্তে দেশের পরিস্থিতি নিয়েই ভীষণভাবে উদ্বিগ্ন থাকতে হচ্ছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার ৪২ বছর পরেও আমাদেরকে জিম্মি হয়ে থাকতে হচ্ছে খোদ স্বাধীনতাবিরোধী গোষ্ঠীটির সহিংস হুমকির কাছে। যেখানে খোদ পাকিস্তানেই মুক্তিযুদ্ধের সময়কার যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আওতায় হাজির করার দাবি উঠছে, সেখানে স্বাধীন বাংলাদেশে এখনো তাণ্ডব চালিয়ে যেতে পারছে পাক বাহিনীর সহোদর জামায়াত-শিবির। এই কি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অর্জন?

যেখানে খোদ পাকিস্তানেই আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে এবারের একুশে ফেব্রুয়ারি পালিত হয়েছে বেশ সমাদরের সঙ্গে, সেখানে বাংলাদেশের একুশে ফেব্রুয়ারিতে জামায়াত-শিবির বিভিন্ন জায়গায় শহীদ মিনার ভেঙ্গেছে। ইতিহাসের কি নির্মম পরিহাস! মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্য ভেঙ্গে, বাস-ট্রেনে আগুন দিয়ে, বোমাবাজি-ককটেলবাজি করে জনমনে ত্রাস ছড়িয়েছে এই পাকিস্তানের প্রেতাত্মারা। আর গণজাগরণকে অস্বীকার করে, পুরো দেশের মানুষের নায্য দাবীর আন্দোলনকে অস্বীকার করে নব্য রাজাকারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে প্রধান বিরোধীদল বিএনপি। তারা যে শুধু নিজেরা ক্ষমতায় যাওয়ার জন্যই আন্দোলন করে, সেকথা এখন পুরোপুরি স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে দেশের মানুষের কাছে। তাহলে কি দেশে শুধু আওয়ামী লিগেরই রাজনীতি থাকবে? তখন বিরোধী দল কে হবে? বামদলগুলো নাকি ইসলামপন্থী দলগুলো? তৃতীয় শক্তির আবির্ভাব হবে? নাকি শক্তিশালী বিরোধী দলের অনুপস্থিতিতে দেশ চলে যাবে ফ্যাসিবাদী শাসনের কবলে? উত্তর এখন জানা নেই, ভাবতে হবে সবাইকেই।

তবে এই প্রশ্নগুলোর উপস্থিতি এটাই ইঙ্গিত দেয় যে, বর্তমানে বাংলাদেশ একটা সংকটপূর্ণ পরিস্থিতি পার করছে। কিন্তু অনেক খারাপ সংবাদ, মেনে নিতে না পারার মতো পরিস্থিতির মধ্যেও এবারের সংকটটা তৈরি হয়েছে অনেক অনেক আশা নিয়ে, অনেক অনেক স্বপ্ন নিয়ে। ৫২, ৬৯, ৭১, ৯০-এর মতো ২০১৩ সালের ইতিহাসটাতেও লিপিবদ্ধ হচ্ছে জনমানুষের উপস্থিতি। জনগণের সংঘবদ্ধতা, তারুণ্যের তীব্র দীপ্তি, মুক্তিকামী মানুষের সংহতি-সৃজনশীলতা দিয়ে ২০১৩-র ইতিহাস রচিত হচ্ছে। এটাই অনেক আশার কথা। অনেক বড় স্বপ্ন দেখার জায়গা। সত্যিকারের গণজাগরণে, মানুষের মুষ্ঠিবদ্ধ হাতের ঐক্যবদ্ধতায় ভুল হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে। এখন আমাদের সামনে, সাধারণ জনগণের সামনে সুবর্ণ সুযোগ এসেছে রাজাকার-যুদ্ধাপরাধীদের নিমূল করে ‘সোনার বাংলা’ গড়ার স্বপ্ন দেখার। দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে দেশকে সত্যিকারের স্বাধীন করার সময় বোধহয় এখনই। এবারের এই জেগে ওঠা তারুণ্য যদি আবার প্রতারিত হয়, তাহলে তার চেয়ে হতাশার বোধহয় আর কিছুই থাকবে না। আর আমাদের সামনে অনুপ্রেরণা হিসেবে তো অনেককিছু আছে। ৫২ আছে, ৬৯ আছে, ৭১ আছে, ৯০ আছে। আমরা তো অনেকখানি এগিয়েই গেছি। এখন আমাদের শুধু ইতিহাস থেকে শিক্ষাটা নিয়ে শুরু করে দিলেই হয়। তবে তার আগে আত্মসমালোচনা দরকার। আত্মশুদ্ধির প্রক্রিয়া দরকার। ভুল স্বীকার করে নিতে পারার মানসিকতা দরকার। সবারই। ব্যক্তিমানুষেরও, সংগঠনেরও। সরকারেরও। এটাই বোধহয় আমাদের প্রকৃত মানবিকতার দিকে নিয়ে যেতে পারে। ভুল কারো হতেই পারে। কিন্তু ভুল প্রমাণিত হওয়ার পরে সেটা স্বীকার করে নিতে পারার মতো বিনীত আমাদের হওয়া উচিত্।

জামায়াত-শিবির এখন পর্যন্ত যেসব নাষকতা চালিয়েছে, তার সবকিছুই তারা করছে বিভ্রান্তিমূলক, প্রতারণামূলক প্রচারণার মাধ্যমে। যেগুলো কিছু কিছু ক্ষেত্রে হাস্যরসেরও উপাদান হয়। কিন্তু এটা তো তারা করতে পারছে। কেন করতে পারছে? এটা কি আমাদেরই ব্যর্থতা না? কেন স্বাধীনতার ৪২ বছর পরেও যুদ্ধাপরাধীদের সংগঠন জামায়াত-ই-ইসলামি এইভাবে ধর্মের নামে মানুষকে ক্ষেপিয়ে তুলতে পারছে? শাহবাগের এই নায্য দাবী, এখানকার তরুণেরা একুশ-মুক্তিযুদ্ধের চেতনা দ্বারা যেভাবে অনুপ্রাণিত হয়েছে, ২য় মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে যেভাবে ‘সোনার বাংলা’ গড়ার স্বপ্ন দেখছে, সেটা কি পুরো দেশের মানুষ অনুধাবন করছেন? সবার কাছে কী গণজাগরণের দৃপ্ত তারুণ্যের দিপ্তী পৌঁছাচ্ছে? আমরা কি ১৬ কোটি মানুষের বাংলাদেশে বিরাজমান শিক্ষাগত-সাংস্কৃতিক ব্যবধান-বৈষম্য ঘোঁচানোর কথা ভাবছি?

জামায়াত-শিবির স্বাধীনতার পর গত ৪২ বছরে যেভাবে পুরো দেশজুড়ে তাদের বহুবিধ বিস্তার ঘটিয়েছে সেটা হুট করে গায়েব করে দেওয়া সম্ভব না। নিষিদ্ধ করার মাধ্যমে তাদেরকে অনেকটাই দুর্বল করে দেওয়া যায় কিন্তু পুরোপুরি নির্মুল হয়তো করা যাবে না। কারণ আজ চাঁদের গায়ে সাঈদী দেখাচ্ছে, কাল মেঘের গায়ে মওদুদীকে দেখাবে। এবং কে জানে, সেটা দেখেও হয়তো অনেক ধর্মভীরু মানুষ প্রাণের তোয়াক্কা না করে রাস্তায় বেরিয়ে আসবে বাস-ট্রেন পোড়াতে, বোমাবাজি করতে। সেধরণের পরিস্থিতি মোটেই কাম্য নয়। অহিংস গণজাগরণের মানসিকতায় সেই পরিস্থিতির ঠাঁয় নাই। ফলে আমার মতে, জামায়াত-শিবির নির্মূল করার জন্য শিক্ষা ও সংস্কৃতির বৈষম্য ঘোঁচানোর কাজ শুরু করাটা খুবই জরুরি। সত্যিকার অর্থেই দেশের প্রতিটি কোনায় কোনায়, গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে দেওয়া উচিত্ ৭১-এর এই পুনরুদ্ধারিত চেতনার আগুন। মানুষ শুধু একবার এই শাহবাগের তরুণদের কথা শোনার অপেক্ষায় আছে। দেশ গড়ার যে তেজী প্রত্যয় নিয়ে অনেক তরুণ শাহবাগে পড়ে আছে দিনের পর দিন, তাদের দৃপ্ত মুখটা দেখলেই হয়তো এই শাহবাগ আন্দোলন নিয়ে সংশয়ে ভোগা অনেক মানুষ প্রাণপণে দাঁড়িয়ে যাবেন জামায়াত-শিবিরের নাষকতার বিরুদ্ধে। দেশে একমাত্র সাংস্কৃতিক প্রচার দিয়েই শান্তির পায়ড়া ওড়ানো সম্ভব, অহিংস উপায়ে। এখন আমরা সম্মিলিতভাবে এই দায়িত্ব পালন করতে পারব কিনা, সেটাই হচ্ছে প্রশ্ন।

এই মুহূর্তে আসলে শুধু বাংলাদেশই না, পুরো বিশ্বই একটা সংকটপূর্ণ পরিস্থিতি পার করছে। আর সত্যিই হয়তো এই যুদ্ধপিড়ীত, বিপন্ন বিশ্ব তাকিয়ে আছে বাংলাদেশের দিকে। এখন হয়তো বর্হিবিশ্বে এই শাহবাগ আন্দোলন নিয়ে অনেকের মধ্যে বিভ্রান্তি-সংশয়-নেতিবাচকতা  আছে। ভবিষ্যত্ নিয়ে উত্কণ্ঠা আছে। কিন্তু অনেকেই শাহবাগ আন্দোলনের ভবিষ্যত্ দেখার জন্য তাকিয়ে আছেন প্রচ্ল কৌতুহল নিয়ে। তারা এখান থেকে পাচ্ছেন নতুন দিনের ইঙ্গিত, তারা খুঁজে বের করছেন এই আন্দোলনের অনন্যতা, এই আন্দোলনের সম্ভবনা। কে জানে!

02-21-2013motherlanguage

এই আশাবাদের কারণ হচ্ছে, পুরো বিশ্বকেই পথ দেখানোর নজির বাংলাদেশের ইতিহাসে আগেও আছে। ভাষা যে মনুষ্য সমাজের খুবই গুরুত্বপূর্ণ উপাদান, এবং এই ভাষার অধিকার ছাড়া যে একটা জাতির বিকাশ সম্ভব না, এই সত্যটা পুরো পৃথিবীকে রক্তের বিনিময়ে জানিয়েছিলেন ভাষা শহীদেরা। মনুষ্যবিকাশের পথে ভাষা-সংস্কৃতির যে অপরিহার্যতা, তার প্রতি এখন সহমত পোষণ করেছে পুরো বিশ্ব। ১৯৯৯ সালে ২১শে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেওয়া হয়। আর তারপর থেকে পুরো বিশ্বে নানাভাবে বেড়েছে ভাষা বিষয়ক গবেষণা, প্রতিবেদন, চিন্তাভাবনা। ২০০০ সালের পর থেকে এখন পর্যন্ত মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষ্যে ভাষিক বৈচিত্র্য, বিপন্ন বা বিলুপ্তির হুমকির মুখে থাকা ভাষাগুলো সংরক্ষণ, মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের প্রয়োজনীয়তা, ব্রেইল ও সংকেত ভাষার উন্নয়ন, তথ্যপ্রযুক্তি ও ভাষার সম্পর্ক, বহুভাষিক শিক্ষা ইত্যাদি বিষয় নিয়ে কাজ করেছে জাতিসংঘ। ফলে, বাংলাদেশ আরও একবার নতুন কিছু দিতেই পারে পুরো বিশ্বকে। শাহবাগ আন্দোলন থেকে আরও অনেক শিক্ষাবার্তা, সংকেত-ইশারা হয়তো আগামীতেও পেতে পারেন বর্হিবিশ্বের মুক্তমনা উত্সুক ব্যক্তি/সংগঠন। কে জানে, তারা বোধহয় তেমন কিছু একটা আশাও করছেন?

‘৭১-এর জ্বলছে আগুন, সারা বাংলায় ছড়িয়ে দাও’

শাহবাগ আন্দোলনের ২৪তম দিনে অর্জিত হলো আরও একটি বিজয়। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুন্যাল-১ থেকে ঘোষিত হলো দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর রায়— ফাঁসি। রায়ের খবরটা শাহবাগ চত্বরে আসা মাত্রই হাজার হাজার মানুষ পিলপিল করে ছুটে আসেন মূল মঞ্চের কাছে। সবাই নেচে-গেয়ে উদযাপন করেন সাঈদীর ফাঁসির খবর। ‘এই মুহূর্তে খবর এলো, সাঈদীর ফাঁসি হলো’ শ্লোগানে মুখরিত হয় শাহবাগ।

04

৭১-এর ‘দেইল্লা রাজাকার’ স্বাধীন বাংলাদেশে রুপান্তরিত হয়েছিলেন আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীতে। খুন-ধর্ষণ-লুটপাট করা এই ঘৃণ্য মানুষটি পরবর্তীতে পরিচিত পেয়েছিলেন প্রখ্যাত মওলানা হিসেবে। এবং এখন তার এই ধার্মিক পরিচয়টা ব্যবহার করে দেশের ধর্মভীরু মানুষের মধ্যে নতুনভাবে বিভ্রান্তি ছড়ানোর চেষ্টা করবে কুচক্রী স্বাধীনতাবিরোধী গোষ্ঠী জামায়াত-শিবির। কিন্তু বাংলাদেশে এখন যে এই ধর্ম কার্ডটা খেলে খুব বেশি লাভ হবে না, সেটা প্রমাণিত হয়েই গেছে। শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চ থেকে খুব স্পষ্টভাবেই ঘোষণা দেওয়া হয়েছে যে, চলমান এই আন্দোলন শুধু যুদ্ধাপরাধী-স্বাধীনতাবিরোধীদের বিরুদ্ধে। তাদের সংগঠন জামায়াত শিবিরের বিরুদ্ধে। ইসলামের সঙ্গে এই আন্দোলনের কোন বিরোধ নেই। এবং শাহবাগের তরুণদের এই দাবির প্রতি নৈতিক সমর্থন দিয়েছেন দেশের ধর্মীয় নেতা, ওলামা-মাশায়েখেরাও। তাঁরাও যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবি তুলেছেন।

প্রথম পর্যায়ে গত ১৫ ফেব্রুয়ারী ব্লগার রাজিব হায়দারকে নৃশংশভাবে হত্যা করে জামাত-শিবির চক্র বাংলাদেশের এই গণজাগরণটাকে ইসলামবিরোধী বলে প্রচার করার অপচেষ্টা করেছিল। পুরো বিষয়টিকে তারা উপস্থাপন করতে চেয়েছিল ‘নাস্তিক বনাম ইসলাম’ আকারে। এখনো পর্যন্ত তারা ধর্মটাকেই ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে যাচ্ছে। কিন্তু সেইটা করে তারা খুব বেশি সুবিধা করতে পারবে না। শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চ থেকে খুব স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে যে, ধর্ম যার যার, দেশ সবার। কারও ব্যক্তিগত ধর্মবিশ্বাসের সঙ্গে এই আন্দোলনের কোন দ্বন্দ্ব-বৈরিতা নেই। তরুণ প্রজন্ম যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চায়। সত্যিকারের ন্যায়বিচার।

আজ সাঈদীর বিরুদ্ধে ফাঁসির রায় ঘোষণা শুরুর আগেই ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান ফজলে কবীর বলেন- রায় ঘোষণার আগে আমরা কিছু কথা বলতে চাই।তিনি বলেন, ‘আসামি দেলোয়ার হোসেন সাঈদী গোটা বাংলাদেশে সুপরিচিত। তার বর্তমান নাম আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী। তিনি প্রখ্যাত মাওলানা এবং দুই বার জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। তার রাজনৈতিক পরিচয় তিনি জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির। তবে আমরা কি আজ সেই প্রখ্যাত মাওলানার বিচার করছি? না। আমরা কি জামায়াতের নায়েবে আমীরের বিচার করছি? না। আমরা কি সংসদ সদস্যের বিচার করছি? না।’ আমরা আসলে বিচার করছি, ৭১-এর খুনি-যুদ্ধাপরাধীর। আমরা সোচ্চার হয়েছি তাদের বিরুদ্ধে, যারা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতা করেছে। পাক হানাদার বাহিনীদের সঙ্গে যোগ দিয়ে নির্মমভাবে গণহত্যা চালিয়েছে। এই বিষয়টা স্পষ্ট করতে হবে দেশের সব মানুষের কাছে। বর্হিবিশ্বের কাছেও।

কিন্তু বাংলাদেশের অনেক মানুষ সাঈদীর ওয়াজ-মাহফিলের সঙ্গে পরিচিত। আজ এক বন্ধু ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছেন, ‘খুন-ধর্ষণ-লুটপাটের মতো অপরাধের অপরাধী এই লোকটাই পবিত্র ধর্মগ্রন্থ কোরআনের তাফসির করত। বেতার-টেলিভিশনে মানুষকে ইসলাম শেখাতো। ধর্মীয় উন্মাদনার ডাক দিত বিভিন্ন ওয়াজে।’ ঘটনা আসলেও তাই। ফলে বাংলাদেশের অনেক ধর্মভীরু মানুষই সাঈদীর দ্বারা প্রভাবিত হয়ে আছেন। এতে কোন সন্দেহ নেই। জামায়াত-শিবিরও এটার ফায়দা লোটার পুরো চেষ্টা করবে। সেটা তারা করেও যাচ্ছে। জামায়াত-শিবিরের এই অপচেষ্টা রুখে দিতে হবে সাংস্কৃতিক তত্পরতা অব্যাহত রেখে। সারা দেশের মানুষের কাছে খুব ভালোভাবে স্পষ্ট করতে হবে যে, ইসলাম বা ধর্মের সঙ্গে তরুণ প্রজন্মের এই আন্দোলনের কোন বিরোধ নেই।

শাহবাগে গণজাগরণ চত্বরের মূলমঞ্চের একটু দূরে, (পাবলিক লাইব্রেরির সামনে) ফুলে ফুলে লেখা হয়েছে, ‘৭১-এর জ্বলছে আগুন, সারা বাংলায় ছড়িয়ে দাও’। এই আগুন ৭১-এর চেতনার আগুন। মুক্তিযুদ্ধের সময় মানুষের চোখে যে সোনার বাংলার স্বপ্ন ছিল, তা বাস্তবায়ন করতে হলে ফিরিয়ে আনতে হবে লুট হয়ে যাওয়া সেই ৭১-এর চেতনা। ছড়িয়ে দিতে হবে সারা বাংলায়। সেই লক্ষ্যে কাজও ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গেছে।  আজ শাহবাগ আন্দোলনের ২৪তম দিনে জন্ম নিয়েছে গণজাগরণ সংস্কৃতি মঞ্চ। আন্দোলনের লক্ষ্য পূরণের জন্য দীর্ঘমেয়াদী লড়াইয়ের প্রস্তুতি হিসেবেই গণজাগরণ মঞ্চের সাংস্কৃতিক এবং সামাজিক সংগঠনগুলোর সম্মিলিত ফোরাম ‘গণজাগরণ সংস্কৃতি মঞ্চ’ গঠন করা হয়েছে বলে জানান এই মঞ্চের নেতা-কর্মীরা।

gonojagoron-culturela-stage20130228014806

সাঈদীর রায় ঘোষণার পর সারাদেশে সহিংস তাণ্ডব শুরু করেছে জামাত-শিবির। আগামী রবি-সোমবার ডেকেছে হরতাল। স্বাধীন বাংলার মাটিতে তাদের ঘৃণ্য প্রতারণামূলক রাজনীতির দিন যে শেষ হয়ে আসছে, সেটা হয়তো বেশ ভালোমতোই বুঝতে পেরেছে জামাত-শিবিরের নেতাকর্মীরা। শেষ সময়ে সহিংসতার মাধ্যমে, নানাবিধ হুমকি দিয়ে নিজেদের পিঠ বাঁচানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে এই স্বাধীনতাবিরোধী চক্র। তাদের মুখোশ উন্মোচিত করতে হবে জনসাধারণের সামনে।

তরুণ প্রজন্মের এই নতুন মুক্তিযুদ্ধে চূড়ান্ত বিজয় কবে আসবে সেটা এখনই বলা মুশকিল। দীর্ঘদিন ধরে জামাত-শিবির অনেক পরিকল্পিত সাংগঠনিক তত্পরতা চালিয়ে বেশ ভালো শক্তিমত্তা অর্জন করেছে। এখন তাদেরকে নির্মূল করার জন্য দরকার সম্মিলিত প্রতিরোধ। এই প্রতিরোধ জনসাধারণকেই গড়তে হবে। শুধু আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বা সরকারের হাতে সবকিছু ছেড়ে দেওয়ার ভুল মোটেই করা যাবে না। আর এই প্রতিরোধটা করতে হবে সাংস্কৃতিকভাবে। জামাত-শিবিরের সহিংসতা কিছু ক্ষেত্রে সহিংসতা দিয়েই রুখতে হবে। কিন্তু সত্যিকারের সোনার বাংলা, একটা অসাম্প্রদায়িক সমাজ গঠনের উদ্দেশ্যে চালাতে হবে দীর্ঘমেয়াদি সাংস্কৃতিক প্রচারণা। ‘গণজাগরণ সংস্কৃতি মঞ্চ’ গঠিত হওয়াটা এই কারণেই খুব আনন্দের বিষয়।

শাহবাগ আন্দোলনের ২৪তম দিনে এসে নিশ্চিত হওয়া গেছে যে, বাংলাদেশ সত্যিই নতুন দিনের সূচনা করতে যাচ্ছে। শুধু দেশের ভেতরেই না, বাংলাদেশ পথ দেখাতে পারে পুরো বিশ্বকেই। এতগুলো মানুষ যেখানে একসঙ্গে আছেন, সেখানে ভুল হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। ভরসা রাখতে চাই লাখো মানুষের ঐক্যবদ্ধতায়। সাঈদীর মতো দুবৃত্তরা যেভাবে ইসলামের অপব্যাখ্যা হাজির করেছে, রাজনীতির স্বার্থে মানুষের ধর্মীয় অনুভূতি নিয়ে খেলেছে,  তার বিপরীতে আমাদেরও তো আছে পীর-সুফি-আউলিয়াদের মুক্তির গান। আমাদের আছেন লালন ফকির। কলিযুগে যে মানুষই অবতার হবেন, সেকথা তো লালন অনেকদিন আগেই বলে গেছেন। এই বিশ্বাস আরও দৃঢ় হচ্ছে। জয় বাংলা, জয় জনতা।

বাংলাদেশ বসন্ত: ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল

২৬ তারিখে ওয়াল স্ট্রিট জার্নালে ছাপা হওয়া এই লেখাটিতে জনাব আহমেদ একটা বিষয় খুব চমৎকারভাবে সনাক্ত করেছেন যে, বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখন আর ধর্মের কার্ডটা অনায়াসে খেলা যায় না। খুব একটা ভালো কার্যকরীতা আশা করা যায় না। সেটা সত্যিই প্রমাণ হলো আজকের মতিঝিল মহাসমাবেশে। ধর্মীয় নেতারা, ওলামা-মাশায়েখেরাও যুদ্ধাপরাধী জামায়েতের নেতাদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছেন। এর চেয়ে আনন্দের খবর আর কী হতে পারে? জামায়াত যেভাবে নানা ধরণের ছল-চাতুরি, প্রতারণার মাধ্যমে পুরো আন্দোলনটিকে নাস্তিক বনাম ইসলাম হিসেবে উপস্থাপন করতে চেয়েছিল। দেশের মধ্যে এবং বর্হিবিশ্বে। সেই অপপ্রচেষ্টাটিতে তারা পুরোপুরিই ব্যর্থ হয়েছে। এখন পুরো দেশেই এই ধরণের সাংস্কৃতিক প্রচারণা চালাতে পারলে আমরা হয়তো সত্যিই একটা অসাম্প্রদায়িক চেতনার সমাজ গড়তে পারব।

জনৈক মৌলভী, ওলামা-মাশায়েখ ঐক্য পরিষদের নেতা স্পষ্টতই জানিয়ে দিলেন খুন, ধর্ষন, লুট ইসলাম সমর্থন করেনা। কাদের মোল্লার ৩৪৪ জন হত্যার সাথে সম্পৃক্ততা শরীয়া আইনেও মৃত্যুদন্ড প্রাপ্তির যোগ্য, তারাও সমস্বরে দাবি তোললেন যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির।
তারা শ্লোগান ধরলেনঃ
ওলামা-মাশায়েখ-জনতা
গড়ে তোল একতা…
এক দফা এক দাবি
ফাঁসি ফাঁসি…

ঢাকার আন্দোলনকারীরা উচ্চকণ্ঠে দাবি জানাচ্ছে অসাম্প্রদায়িক চেতনা ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার জন্য।

চলতি মাসে টানা ২২ দিন ধরে প্রতিবাদকারীরা কাঁপিয়ে দিয়েছেন পুরো বাংলাদেশকে। তরুণ ব্লগার-অ্যাক্টিভিস্টরা রাজধানী ঢাকার মূল জংশন শাহবাগ দখল করে এই প্রতিবাদের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তাঁরা যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করার  দাবি জানাচ্ছেন। এখানে প্রায়শই দেখা যাচ্ছে হাজার হাজার মানুষের ঢল। যেটা বিবেচিত হচ্ছে গত দুই দশকে দেশটিতে সাধারণ মানুষের সবচেয়ে বড় জমায়েত হিসেবে। কাছাকাছি সময়ে যেখানে অন্যান্য মুসলিম অধুষ্যিত গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে (তুরস্ক, মালয়েশিয়া, মিশর, তিউনিসিয়া) ইসলামি ভাবধারা প্রভাবের উত্থান দেখা যাচ্ছে, সেখানে বাংলাদেশের নাগরিকেরা উচ্চকিত হচ্ছেন অসাম্প্রদায়িক সমাজ গঠনের লক্ষ্যে।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় যারা যুদ্ধাপরাধ করেছিল বলে অভিযুক্ত, তাদেরকে কখনোই বিচারের আওতায় আনা যায়নি। এই ঘটনাটায় দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের মানুষ তীব্র মনোকষ্টে ভুগেছে। সেসময় পাকিস্তানি বাহিনী ৩০ লাখ মানুষ হত্যা করেছিল। ধর্ষণ করেছিল প্রায় ২ লাখ নারীকে। পাক হানাদার বাহিনীকে সহায়তা করেছিল বাংলাদেশেরই কিছু নাগরিক। যারা পরিচিত রাজাকার নামে। এদের অনেকেই দেশের সবচেয়ে বড় ইসলামি দল জামায়েত-ই-ইসলামির সদস্য।
এই রাজাকারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের পরেই ব্যবস্থা নেওয়া উচিৎ ছিল। কিন্তু ৭০ ও ৮০-এর দশকের স্বৈরতান্ত্রিক শাসন এদেরকে রাজনৈতিকভাবে পূর্নবাসিত করেছে। যার ফলে পরবর্তী সময়ে এই যুদ্ধাপরাধীদের অনেকে মন্ত্রী হয়ে গাড়িতে রাষ্ট্রীয় পতাকা লাগিয়ে ঘুরতে পেরেছে। এই ব্যাপারটাকে যুদ্ধের সময় এই রাজাকারদের বর্বরতার শিকার হওয়া মানুষেরা গণ্য করেছিলেন অপমান হিসেবে। এই ঘটনা ঘটেছিল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)-র শাসনামলে। যাদের সঙ্গে জামাতের খুব ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে।
বিএনপির প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লিগ, যারা ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশকে নেতৃত্ব দিয়েছিল, তারাও ৯০-এর দশকের শেষদিকে ক্ষমতায় এসে এই যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ইস্যুটি সামনে আনেনি। সেসময় সংসদে তাদের আসনসংখ্যা বেশি ছিল না। কিন্তু ২০০৯ সালে আবার ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লিগ গঠন করে আন্তর্জাতিক যুদ্ধ অপরাধ ট্রাইবুন্যাল। এর পেছনে একটি কারণ ছিল জনমতের চাপ, আরেকটি কারণ ছিল এইবার তারা সংসদে দুই তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার গঠন করতে পেরেছে।
গত ৫ ফেব্রুয়ারী এই ট্রাইবুন্যাল থেকে ঘোষিত একটি রায়ের পরেই শুরু হয় প্রতিবাদ আন্দোলন। এই আদালত প্রথম রায় দিয়েছিল গত জানুয়ারীতে। সেটা ছিল আব্দুল কালাম আজাদের (বাচ্চু রাজাকার) ফাঁসি। কিন্তু এইবার জামায়াতের নেতা আব্দুল কাদের মোল্লাকে দেওয়া হয় শুধু যাবজ্জীবন কারাগারের দ-। রায় ঘোষণার পর মোল্লা আদালত থেকে বের হয়ে বিজয়সূচক চিহ্ন প্রদর্শন করেন। এর পরপরই জনগণ ফুঁসে ওঠে। তাদের মতে, কাদের মোল্লাকে দেওয়া হয়েছে গুরু পাপে লঘু দণ্ড।
চলমান এই আন্দোলনের প্রতি ব্যপক জনসমর্থন আওয়ামী লিগ সরকারকে বাধ্য করে আইন সংশোধন করতে। এই মাসে পাস হওয়া এই সংশোধনীতে যুদ্ধাপরাধী সংগঠন হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর বিচার করার ধারাও অন্তর্ভূক্ত হয়। এইটাকে সফলতা ধরে নিয়ে, গত বৃহস্পতিবার সংগঠকেরা শাহবাগে জমায়েত হওয়াটা সাময়িকভাবে স্থগিত করার আহ্বান জানান। যদিও আন্দোলন অব্যাহত রাখার কথাও বলা হয়।
কিন্তু শুক্রবার, জামায়াত উন্মত্তভাবে সহিংসতা দেখানোর ফলে পাঁচজন নিহত ও বেশ কয়েকজন আহত হন। এর আগে গত ১৬ ফেব্রুয়ারী, একজন পরিচিত ব্লগার, রাজীব হায়দারকে তাঁর বাড়ির পাশে হত্যা করা হয়। খুন করার পদ্ধতিটা জামায়াতের ছাত্র সংগঠন শিবিরের সঙ্গে মিলে যায় বলে প্রতিবাদকারীরা এই খুনের দায় জামায়াতের উপরেই চাপান। এরপর গত শুক্রবার থেকে জামায়াতের উস্কানিতে সংঘটিত সংঘর্ষে সাতজন নিহত হয়েছে।
সহিংসতার হুমকি দিয়ে বহুদিন ধরেই ন্যায়বিচারের ক্ষেত্রে বাধা দিয়ে আসছে এই গোষ্ঠি। বাংলাদেশের নাগরিকেরা অবশ্য তারপরও এই সহিংসতার হুমকির কাছে নত হবেন না বলে দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। গত শুক্রবার জামায়াতের উন্মত্ততার কয়েক ঘন্টার মধ্যেই শাহবাগ আবার উত্তাল হয়ে ওঠে হাজারো মানুষের জমায়াতে।
সাধারণ মানুষদের দিক থেকে যুদ্ধাপরাধীদের শুধু সাজা নয়, ফাঁসি দেওয়ার দাবিটা ওঠার পেছনে বেশকিছু সমন্বিত কারণ আছে। অনেকেই আশঙ্কা করেন যে, কাদের মোল্লার মতো মানুষেরা মুক্ত হয়ে বেরিয়ে আসবে যদি আগামী নির্বাচনে বিএনপি ক্ষমতায় আসে। বাংলাদেশের মানুষ রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির জন্য ন্যায়বিচারকে বলি দেওয়ার ঘটনা আর দেখতে রাজি না। কাদের মোল্লা কারাগার থেকে বেরিয়ে যেরকম বিজয় চিহ্ন দেখানোর দুঃসাহস দেখিয়েছিলেন, সেরকম দৃশ্য মানুষ আর সহ্য করতে রাজি না।
শাহবাগ আন্দোলন বাংলাদেশকে চিহ্নিত করিয়েছে উদারনৈতিক জাতীয়তাবাদের চমৎকার দৃষ্টান্ত হিসেবে। এই চত্বরে, অনেক নারীকে নেতৃত্বের ভূমিকায় দেখা যাচ্ছে। তারা গভীর রাত পর্যন্ত পুরুষদের সঙ্গে স্বাধীনভাবে মেলামেশা করছেন, কোনরকম হয়রাণির ভয় ছাড়াই।
একইসময়ে জামায়াত, শাহবাগের এই আন্দোলনটিকে ইসলামবিরোধী আন্দোলন হিসেবে রুপ দেওয়ার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছে। তারা এতটাই নিচে নেমেছে যে, রাজীব হায়দারের নামে ভুয়া ব্লগ অ্যাকাউন্ট খুলে সেখানে ধর্মের নামে কুমন্তব্য প্রকাশ করতেও দ্বিধা করেনি। যদিও তারপরেও তারা মানুষের সমর্থন আদায়ে ব্যর্থ হয়েছে।
একসময় বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভালো একটা প্রভাবের আশা করে এই ধর্ম কার্ডটা খেলা যেত। কিন্তু এখন জাতীয় পরিচয়ের সঙ্গে ধর্মীয় বিশ্বাসের যে কোন প্রতিযোগিতা নেই, এটা বলার মানুষ বাংলাদেশে ক্রমশই বাড়ছে। জাতীয় ও ধর্মীয়, দুই ক্ষেত্রেই যে জামায়াতের ধ্বংসাত্মক প্রবণতাটাই যে বেশি দেখা যায়, সেটা উচ্চকণ্ঠে বলেছেন দেশের অন্যান্য ইসলামিক ইমামরাও। এটা একটা পরিস্কার সংকেত যে, বাংলাদেশ ইসলামিক চরমপন্থাকে প্রত্যাখান করেছে।
কিন্তু শুধু জামায়াতই না, মূলধারার বেশিরভাগ রাজনীতিবিদই এই গণমানুষের আন্দোলনের মুখে খানিকটা বেসামাল অবস্থায় প্রকাশিত হয়েছেন। বাংলাদেশের মানুষ এখন শুধু ঐতিহাসিক ন্যায়বিচারই না, নিজেদের জাতীয় মর্যাদা পুনরুদ্ধারের দাবিও জানাচ্ছে।
অসাম্প্রদায়িকতাকে সমাজের চিরন্তন চেতনা হিসেবে স্বাগত জানাচ্ছে তরুণ প্রজন্ম। আর তারা চাইছে তাদের নেতারাও যেন এটা করেন। সাধারণ একজন মানুষ শুধু অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেই না, মতাদর্শিক ইস্যুতেও যেভাবে আগ্রহ দেখাচ্ছে, এবং এত বড় আকারের একটা আন্দোলন সংগঠিত করার ক্ষমতা যে তাদের আছে, এই ব্যাপারগুলো হয়তো জনসম্পৃক্ততার একটা নতুন যুগের সূচনারই ইঙ্গিত দিচ্ছে। রাজনীতিবিদেরা নিজেদের বিপন্নতার মুহূর্তেও  ক্রমবর্ধমাণ এই মধ্যবিত্ত শ্রেণীর আওয়াজটা বরাবরই অগ্রাহ্য করে গেছে।