Posts Tagged ‘ জার্মানি ’

আয়ারল্যান্ড থেকে গ্রীস: ইউরোর অঘটনগুলো

প্রতিটা ফুটবল প্রতিযোগিতাতেই থাকে ‘চুনোপুঁটি’ হিসেবে বিবেচিত কিছু ছোট দল। আন্ডারডগ বলেও ডাকেন অনেকে। ভাবা হয় যে, এই দলগুলোর জন্য শুধু অংশগ্রহণ করাটাই যথেষ্ট। কিন্তু এই চুনোপুঁটিরাই ইউরো চ্যাম্পিয়নশীপের আসরে রীতিমতো নাকাল করে ছেড়েছে অনেক বড় দলকে। ইউরো কাপের এই অঘটনগুলো নিশ্চিতভাবেই মনে করিয়ে দেয় যে শুধু সংখ্যা বাড়ানোর জন্যই অংশ নেয়না এই আন্ডারডগরা। বড় কিছু করার সামর্থ্য ও সম্ভাবনাও সুপ্ত থাকে তাদের মধ্যে।

১৯৮৮ সালের গ্রুপ পর্ব
১৯৮৮ সালের ইউরো কাপে প্রথমবারের মতো অংশ নিয়েছিল আয়ারল্যান্ড। আর ইংল্যান্ডের জন্য সেটা ছিল তৃতীয় আসর। একেবারেই নবাগত আয়ারল্যান্ড গ্রুপ পর্বের খেলায় ঘটিয়েছিল ইউরোর প্রথম অঘটন। ১-০ গোলে হেরে মাঠ ছেড়েছিল ইংল্যান্ড। সেসময় তাদের এই দলে ছিলেন গ্যারি লিনেকার, পিটার শেলটন, জন বার্নেসদের মতো কিংবদন্তী ফুটবলাররা। কিন্তু তারপরও হারের স্বাদ পেতে হয়েছিল ইংলিশদের। প্রথমার্ধের ৬ মিনিটে আয়ারল্যান্ডকে জয়সূচক গোলটি এনে দিয়েছিলেন আইরিশ মিডফিল্ডার রে হুজটন। এরপর পুরো খেলায় গোল শোধের আপ্রাণ চেষ্টা করলেও সফল হয়নি ইংল্যান্ড। কারণ আয়ারল্যান্ডের এই ১-০ গোলের জয়ের নেপথ্যে বেশ বড় ভূমিকা পালন করেছিলেন গোলরক্ষক প্যাট্রিক বোনার।

১৯৯২ সালের গ্রুপ পর্ব আগের আসরের মতো এবারও অঘটনের শিকার হয়েছিল ইংল্যান্ড। এবার তাদেরকে ২-১ গোলে হারিয়েছিল আন্ডারডগ সুইডেন। আর এই হারের ফলে গ্রুপ পর্ব থেকেই বিদায় নিতে হয়েছিল ইংল্যান্ডকে। গ্রুপ পর্বে নিজেদের শেষ ম্যাচে প্রথমার্ধের মাত্র ৪ মিনিটেই ইংল্যান্ডকে এগিয়ে দিয়েছিলেন ডেভিড প্লাট। প্রথমার্ধটা ১-০ গোলে এগিয়ে থেকেই শেষ করেছিল ইংলিশরা। কিন্তু দ্বিতীয়ার্ধে চমত্কারভাবে ঘুড়ে দাঁড়ায় স্বাগতিক সুইডেন। ৫১ মিনিটে গোল শোধ করে খেলায় সমতা ফেরান ডান এরিকসন। আর ৮২ মিনিটে দলকে জয়সূচক গোলটি এনে দেন সুইডিশ স্ট্রাইকার টমাস ব্রোলিন।

১৯৯২ সালের ফাইনাল
একই আসরের ফাইনালেও অঘটনের জন্ম দিয়েছিল ডেনমার্ক। সেবারের আসরে তারা বাছাই পর্বের বাধাই পেরোতে পারেনি। কিন্তু চূড়ান্ত আসর শুরুর মাত্র দুই সপ্তাহ আগে যুগোশ্লোভিয়াকে টপকে ইউরো কাপে খেলার সুযোগ পায় তারা। আর একমাস পরে তারাই পায় শিরোপা জয়ের স্বাদ। ফাইনালে তারা ২-০ গোলে হারিয়েছিল সেবারের অন্যতম ফেভারিট জার্মানিকে। প্রথমার্ধের ১৮ মিনিটে ডেনমার্কের পক্ষে প্রথম গোলটি করেছিলেন জেনসেন। আর দ্বিতীয়ার্ধের ৭৮ মিনিটে ডেনমার্কের ইতিহাসগড়া ম্যাচটির জয় নিশ্চিত করা গোলটি এসেছিল কিম ভিলফোর্টের পা থেকে।

১৯৯৬ সালের গ্রুপ পর্ব
ইউরো কাপের এই আসরে প্রথম ম্যাচটাতেই জার্মানির কাছে ২-০ গোলে হারের মুখ দেখেছিল চেক রিপাবলিক। দ্বিতীয় ম্যাচে তাদের প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী ১৯৯৪ সালের ফাইনালিস্ট ইতালি। এই ম্যাচটা হয়তো চেকদের জন্য ছিল কিছু একটা করে দেখানোর। আর সেটা খুব ভালোমতোই করেছিল তারা। ইতালিকে হারিয়েছিল ২-১ গোলে। এই হারের ফলে ইতালি ছিটকে পড়ে গ্রুপ পর্ব থেকেই। আর চেক রিপাবলিক শুধু পরবর্তী পর্বেই না, চলে গিয়েছিল সেই আসরের ফাইনাল পর্যন্তও। ইতালির বিপক্ষে এই ম্যাচটাতে প্রথমার্ধের ৫ মিনিটে চেক রিপাবলিককে এগিয়ে দিয়েছিলেন পাভেল নেদভেদ। কিন্তু ১৩ মিনিট পরেই খেলায় সমতা ফেরান ইতালিয়ান স্ট্রাইকার এনরিকো চিয়েসা। ৩৫ মিনিটে আবার চেক রিপাবলিককে চালকের আসনে বসান রাদেক বেজবেল। এই গোলটাই শেষপর্যন্ত ম্যাচের জয়সূচক গোল হিসেবে থেকে যায়।

২০০৪ সালের গ্রুপ পর্ব
এই আসরে প্রথমবারের মতো বড় কোন ফুটবল প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার সুযোগ পায় দক্ষিণ ইউরোপের ছোট্ট দেশ লাটভিয়া। গ্রুপ পর্বের প্রথম ম্যাচেই চেক রিপাবলিকের কাছে হেরেছিল ২-১ গোলে। দ্বিতীয় ম্যাচে যখন তারা তিনবারের ইউরো ও তিনবারের বিশ্বকাপশিরোপাজয়ী জার্মানীর মুখোমুখি হয়েছিল, তখন সবাই হয়তো অনুমান করেছিলেন যে, গোলবন্যায় ভাসতে যাচ্ছে লাটভিয়া। কিন্তু সবাইকে হতবাক করে দিয়ে জার্মানিকে রুখে দিয়েছিল তারা। সেই ম্যাচের গোলশূণ্য ড্র ফলাফলটাই ছিল একটা বিশাল অঘটন। জার্মানিকেও এই অঘটনের মাশুল দিতে হয়েছিল ভালোভাবেই। সেবার গ্রুপ পর্ব থেকেই বিদায় নিতে হয়েছিল ইউরোপের এই ফুটবল পরাশক্তিকে।

২০০৪ সালের ফাইনাল
১৯৯২ সালে ডেনমার্ক যেমন স্বাগতিক হওয়ার ফায়দা তুলে শিরোপা জয়ের স্বাদ পেয়েছিল, এক যুগ পরে ঠিক তেমনই একটা সুযোগ পেয়েছিল পর্তুগাল। সেসময়টা ছিল পর্তুগিজ তারকা লুইস ফিগো, রুই কস্তাদের সোনালি যুগ। ডেকো, রিকার্দো কারভালহোরা ছিলেন দুর্দান্ত ফর্মে। ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোও তখন প্রতিশ্রুতিশীল তরুন তুর্কি। নিজেদের মাটিতে আয়োজিত এই আসরই ছিল পর্তুগালের ইউরোপসেরা হওয়ার সবচেয়ে সুবর্ণ সুযোগ। স্বপ্নপূরণের দ্বারপ্রান্তেও চলে এসেছিল পর্তুগিজরা। কিন্তু ফাইনালে এসে অঘটনের শিকার হতে হয় স্বাগতিকদের। গ্রীসের কাছে ১-০ গোলে হেরে শেষ হয় তাদের শিরোপা জয়ের স্বপ্ন। দ্বিতীয়ার্ধের ৫৭ মিনিটে গ্রীসের পক্ষে জয়সূচক গোলটি করেন অ্যাঙ্গেলোস চারিস্তেস।

ইউরো কাপের আদিকথা ও চিনপরিচয়

১৯৬০ সালে প্রথম উয়েফা ইউরোপিয়ান ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপটা যখন বাস্তবে মাঠে গড়িয়েছিল, তখন আসলে পূরণ হয়েছিল হেনরি ডুলানির আজন্ম লালিত একটা স্বপ্ন। দীর্ঘদিন ফ্রান্স ফুটবল ফেডারেশনের অগ্রণী ব্যক্তি হিসেবে কাজ করা ডুলানিই ১৯২৭ সালে প্রথমবারের মতো প্রস্তাব করেছিলেন ইউরোপভিত্তিক জাতীয় এই ফুটবল প্রতিযোগিতা আয়োজনের। এরপর দীর্ঘদিন বর্তমানের এই ইউরো কাপটার বাস্তব রুপ দেওয়ার জন্য কাজ করে গেলেও সফল হননি তিনি। ১৯৫৫ সালে চিরনিদ্রায় শায়িত হন এসময়ের অন্যতম শীর্ষ এই ক্রীড়া প্রতিযোগিতার স্বপ্নদ্রষ্টা। তাঁর মৃত্যুর তিন বছর পরে, ১৯৫৮ সালে সিদ্ধান্ত হয় সেসময়ের উয়েফা ইউরোপিয়ান ন্যাশনস কাপ। ডুলানির স্মরণে ১৯৬০ সালে প্রথমবারের আসরটি আয়োজন করা হয়েছিল ফ্রান্সে। শিরোপাজয়ী দলকে যে শিরোপাটা তুলে দেওয়া হয় তাতেও ছিল ডুমিনির নাম। প্রথম আসরে এক উত্তেজনাপূর্ণ ফাইনালে যুগোস্লোভিয়াকে ২-১ গোলে হারিয়ে প্রথমবারের শিরোপাটা জিতেছিল তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন।
তৃতীয় আসর (১৯৬৮) থেকে প্রতিযোগিতাটির নাম দেওয়া হয় উয়েফা ইউরোপিয়ান ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপ। আর গত আসর থেকে সংক্ষেপে সালভিত্তিক নামকরণের প্রচলন হয়। ইউরো ২০০৮ এর মতো এবারের আসরকেও ডাকা হচ্ছে ইউরো ২০১২। আর মাত্র ১৬ দিন পর থেকে পোল্যান্ড ও ইউক্রেনের মাটিতে শুরু হতে যাচ্ছে ইউরোপের সবচেয়ে বড় এই জাতীয় ফুটবলের প্রতিযোগিতা। স্বাগতিক দুই দেশ ছাড়াও এবারের আসরে অংশ নিতে যাচ্ছে ক্রোয়েশিয়া, চেক রিপাবলিক, ডেনমার্ক, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, গ্রীস, ইতালি, জার্মানি, নেদারল্যান্ড, পর্তুগাল, আয়ারল্যান্ড, রাশিয়া সুইডেন ও গতবারের শিরোপাজয়ী স্পেন। চারটি করে গ্রুপে ভাগ হয়ে প্রথমে গ্রুপ পর্বে অংশ নেবে মোট ১৬টি দেশ। গ্রুপের প্রতিটি দলের মুখোমুখি লড়াইয়ের পর গ্রুপ তালিকার শীর্ষ দুইটি করে দল অংশ নেবে কোয়ার্টার ফাইনালে। এরপর সেমিফাইনাল এবং চূড়ান্ত ও অন্তিম লড়াই, ফাইনাল। এখানেই নির্ধারিত হবে যে, কোন দেশ পাবে আগামী চার বছরের জন্য ইউরোপসেরার খেতাব।
বিগত ১৩টি আসরের ইউরো কাপ শিরোপা জয়ের স্বাদ পেয়েছে মোট নয়টি দেশ। সবচেয়ে বেশি, তিনবার শিরোপা জিতেছে জার্মানি। ফ্রান্স ও স্পেন শিরোপার দেখা পেয়েছে দুইবার করে। আর একবার করে জিতেছে ইতালি, চেকোস্লোভিয়া, নেদারল্যান্ড, ডেনমার্ক, গ্রীস ও তৎকালিন সোভিয়েত ইউনিয়ন। কিন্তু সবচেয়ে মজার ব্যাপার হচ্ছে, এখন পর্যন্ত টানা দুইটি শিরোপা জিততে পারেনি কোন দেশই। এ থেকে এই প্রতিযোগিতার চরম প্রতিদ্বন্দ্বীতাপূর্ণ পরিস্থিতি সম্পর্কেও বেশ ভালোই অনুমান করা যায়। তবে এইবার সেই নতুন ইতিহাস গড়ার সুযোগ আছে স্পেনের সামনে। ২০০৮ সালে গত আসরের শিরোপা জিতেছিল বর্তমানে ফুটবলের এই এক নম্বর দলটি। দুই বছর পর বিশ্বকাপ জিতে বিশ্ব ফুটবলেও নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করেছেন ক্যাসিয়াস-জাভি-ইনিয়েস্তারা। আর এবারের ইউরো কাপেও তারা নিশ্চিতভাবেই বিবেচিত হবে শিরোপার অন্যতম প্রধান দাবিদার হিসেবে। এখন যদি তারা এক মাসের হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের পর শেষ হাসি হাসতে পারে, তাহলে স্পেনই হবে টানা দুইটি ইউরো চ্যাম্পিয়নশীপ জয়ী প্রথম দল।

গাদ্দাফীর ‘অষ্টম আশ্চর্য’

দীর্ঘ ৪২ বছরের শাসনামলে অনেক নিন্দা-সমালোচনা কুড়িয়ে কুখ্যাতি অর্জন করেছিলেন কর্নেল মুয়াম্মার গাদ্দাফী। আরব বসন্তের নবজাগড়নে ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের পর লিবিয়ায় পতন হয়েছে গাদ্দাফী সরকারের। কয়েকদিন আগে বিদ্রোহীদের হাতে নির্মমভাবে হত্যার পর গতকাল সাহারা মরুভূমির কোন এক অজ্ঞাত স্থানে চিরনিদ্রায় শায়িত হয়েছেন এই স্বৈরশাসক। তবে বরাবরই কঠোর শাসরে জন্য পশ্চিমা বিশ্ব ও মানবাধিকার সংস্থাগুলোর বদনাম কুড়ালেও লিবিয়ার এইড মরুপ্রান্তরেই অনন্য এক কীর্তি গড়ে গেছেন লৌহমানব গাদ্দাফী। দেশবাসীদের বিশুদ্ধ খাবার পানি সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্য সমগ্র লিবিয়াজুড়ে তিনি যে ভূগর্ভস্থ পাইপ নেটওয়ার্ক নির্মান করেছিলেন তা পরিচিতি পেয়েছে ‘বিশাল মনুষ্যনির্মিত নদী’ নামে। বিশ্বের বৃহত্তম এই সেচ প্রকল্পটিকে খোদ গাদ্দাফী বলতেন ‘পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্য।’

সির্তে, ত্রিপোলি, বেনগাজিসহ লিবিয়ার অন্যান্য মেরু অঞ্চলে খাবার পানি সরবরাহ ও সেচকার্যের জন্য পুরো দেশটি জুড়ে ২৮৪০ কিলোমিটার দীর্ঘ ভূগর্ভস্থ পাইপ নেটওয়ার্ক নির্মিত হয়েছে এই প্রকল্পটিতে। ইতিহাসে এযাবত্কালের সবচেয়ে বড় এই পাইপ নেটওয়ার্কটিতে আছে ১৩০০-রও বেশি কুয়া। যেগুলোর বেশিরভাগই ৫০০ মিটারেরও বেশি গভীর। এখনও লিবিয়াতে প্রতিদিন ৬৫ হাজার ঘনমিটার বিশুদ্ধ পানি পৌঁছে দিচ্ছে গাদ্দাফীর এই ‘অষ্টমাশ্চার্য।’

১৯৫৩ সালে লিবিয়ার দক্ষিণাঞ্চলে তেল অনুসন্ধান করতে গিয়ে বিশালায়তনের এক ভূগর্ভস্থ জলাধারের খোঁজ পাওয়া যায়। ১৯৬০ সালের শেষে ৪০ হাজার বছর পুরোনো এই জলাধার থেকে ‘বিশাল মনুষ্যনির্মিত নদী প্রকল্প’ বাস্তবায়নের পরিকল্পনা করা হয়। তবে বাস্তবে কাজ শুরু হতে হতে অতিক্রান্ত হয় আরও ২৪ বছর। ১৯৮৩ সালে লিবিয়ার কনগ্রেসে এই প্রকল্প প্রস্তাবটি পাস হয়। এক বছর পরে সারির এলাকায় নির্মানকাজের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন গাদ্দাফি। কোন প্রকার বৈদেশিক ঋণ বা অনুদান ছাড়াই, পুরোপুরি গাদ্দাফি সরকারের অর্থায়নে বিশাল এই কর্মযজ্ঞের নকশা প্রণয়ন করে আমেরিকান প্রকৌশলী কোম্পানি ব্রাউন এন্ড রুট ও প্রাইস ব্রাদার্স। বিশালাকৃতির কনক্রিট পাইপগুলো নির্মানের জন্য প্রয়োজনীয় উপাদান রপ্তানি করা হয় ইতালি, স্পেন, জার্মানি, জাপানসহ বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশ থেকে। পুরো প্রকল্পটি সফলভাবে শেষ করার জন্য খরচ হয়েছিল ২৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারেরও বেশি অর্থ। ১৯৯০ সাল থেকে এই প্রকল্পে নিযুক্ত প্রকৌশলীদের কারিগরী প্রশিক্ষণ দিয়েছে ইউনেসকো।

এ বছর গাদ্দাফী সরকারের পতনকামী বিদ্রোহী জনতার সমর্থনে এগিয়ে আসা ন্যাটোর বোমা হামলায় এই মনুষ্যনির্মিত নদীর কিছু অংশ ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। ফলস্বরুপ বিশুদ্ধ খাবার পানির সরবরাহ থেকে বঞ্চিত হয়েছে অনেক লিবিয়বাসী।— উইকিপিডিয়া অবলম্বনে

বিন লাদেনের মৃত্যুতে নোম চমস্কির প্রতিক্রিয়া

 মে ৬, ২০১১

এটা খুবই স্পষ্ট যে, লাদেন হত্যার মার্কিনি অভিযানটা একটা পরিস্কার গুপ্তহত্যা। একই সঙ্গে এটা আন্তর্জাতিক অনেক আইন-আচরণবিধির লঙ্ঘনও বটে। তারা নিরস্ত্র লাদেনকে গ্রেফতার করার কোন চেষ্টাই করেনি। ৮০ জনের কমান্ডো দলের জন্য যেটা ছিল খুবই সহজ একটা কাজ। আর তাদেরকে তো সেখানে কোনরকম প্রতিরোধের মুখেও পড়তে হয়নি। তাদের দাবি অনুসারে, একমাত্র প্রতিরোধটা এসেছিল লাদেনের স্ত্রীর কাছ থেকে। আইনের প্রতি বিন্দুমাত্র শ্রদ্ধা আছে, এমন দাবিওয়ালা সমাজে তো সন্দেহভাজন অপরাধীকে গ্রেফতার করে বিচারের আওতায় আনার কথা। আমি কিন্তু ‘সন্দেহভাজন’ শব্দটার উপরে বিশেষভাবে জোর দিচ্ছি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে সবচেয়ে গভীর অনুসন্ধানের পর ৯/১১ হামলার পরিকল্পনাটা যে আফগানিস্থানেই করা হয়েছিল, এটা এফবিআই শুধু ‘বিশ্বাস’ থেকে করা, কোন তথ্য ছিল না। পরিকল্পনার বাস্তবায়নটা আবার হয়েছিল সৌদি আরব ও জার্মানিতে! ২০০২ সালের এপ্রিলে, এফবিআই প্রধান রবার্ট মুলার সংবাদমাধ্যমগুলোকে এই তথ্য জানিয়েছিলেন। এপ্রিল ২০০২ সালে তারা শুধু যেই জিনিসটা বিশ্বাস করলো, স্পষ্টতই তার ৮মাস আগে সেটা করতো না, যখন কিনা তালেবানরা ওয়াশিংটনকে প্রস্তাব করেছিল যে বিন লাদেনের বির’দ্ধে প্রমাণ হাজির করতে পারলে তারা তাকে বিচারের জন্য হস্তগত করবে। ওয়াশিংটন এই প্রস্তাব শোনেনি। তাই যখন ওবামা তাঁর হোয়াইট হাউজ বিবৃতিতে বলেন যে, ‘আমরা খুব তাড়াতাড়িই জানতে পেরেছিলাম, ৯/১১ হামলাটা আল কায়েদাই করেছিল’, তখন তিনি যে পুরোপুরি মিথ্যা কথা বলছেন, এটা বোঝাই যায়।

তখন থেকে এখন পর্যন্ত কোন আমাদের কাছে কোন গুরুতর প্রমাণই হাজির করা হয়নি। বিন লাদেনের ‘স্বীকারোক্তি’ নিয়ে অনেক কথাবার্তা হয়েছে। কিন্তু সেরকম স্বীকারোক্তি তো আমারও আছে। বোস্টন ম্যারাথন জিতলেও আমি সেরকম স্বীকারোক্তি দিব! তিনি যেটাকে একটা বিশাল অর্জন বলে মনে করেছেন, সেটাই তিনি শুধু প্রকাশ্যে স্বীকার করেছেন।

এখন পাকিস্তানের উপর ওয়াশিংটনের ক্ষোভ নিয়ে মিডিয়াতে অনেক কথাবার্তা হচ্ছে যে, কেন তারা লাদেনকে যুক্তরাষ্ট্রের হাতে তুলে দিল না। যেখানে আব্বোটাবাদে লাদেনের উপস্থিতির কথা পাকিস্তানি মিলিটারি ও নিরাপত্তাকর্মীরা জানত বলে ধারণা করা হচ্ছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের উপরও পাকিস্তানের যে অনেক ক্ষোভ, সেটা নিয়ে কোনই কথাবার্তা নেই। যুক্তরাষ্ট্র যে তাদের সার্বভৌমত্বকে বুড়ো আঙ্গুল দেখাল, রাজনৈতিক গুপ্তহত্যা করার জন্য তাদের এলাকায় প্রকাশ্যে হামলা করল— এগুলো নিয়ে কোন আলাপই নেই। আমেরিকা বিরোধী অনুভূতি আগে থেকেই পাকিস্তানে প্রবল মাত্রায় ছিল। এই ঘটনাটা যে সেটাকে আরও উস্কে দেবে, সেটা বলাই বাহুল্য। লাদেনের মৃতদেহ সমুদ্রে ভাসিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্তটাও নিশ্চিতভাবে মুসলিম বিশ্বের সংশয় এবং ক্রোধ দুটোই অনেক বাড়িয়ে দেবে।

আমাদের এখন নিজেদেরই প্রশ্ন করা দরকার যে, ইরাকি কমান্ডোরা যদি জর্জ ডব্লিউ বুশের বাড়িতে নেমে, তাকে হত্যা করে, লাশটা অ্যাটলান্টিকে ফেলে দেয়, তাহলে আমাদের কেমন লাগবে। বুশের অপরাধের পরিমাণ নিশ্চিতভাবেই লাদেনের গুলোকে পেছনে ফেলবে। কোন বিতর্ক ছাড়াই এ কথা বলা যায়। এবং বুশ ‘সন্দেহভাজন’ও না। কিন্তু অবশ্যই ‘‘সিদ্ধান্তদানকারী’’ যে কিনা অন্য যেকোন যুদ্ধাপরাধ থেকে আলাদা করে একটি মহান আন্তর্জাতিক অপরাধ করতে নির্দেশ দিয়েছিল সব শয়তানদের এরমধ্যে সম্পৃক্ত করে (নুমেনবার্গ ট্রায়াল থেকে উদ্ধৃত)। যেকারণে নাজি অপরাধীদের ফাঁসিতে ঝোলানো হয়েছিল- হাজার হাজার মৃত্যু, লক্ষ লক্ষ শরনার্থী, দেশে দেশে ধ্বংসযজ্ঞ, তীক্ত দ্বন্দ্ব, যা এখনো বেশিরভাগ জায়গায় ছড়িয়ে আছে।

কিউবার এয়ারলাইন বোমারু অরল্যান্ডো বস্ককে নিয়ে তো নতুন করে কিছুই বলার নাই। ইনি ১৯৭৬ সালে কিউবার একটা বেসামরিক বিমানে বোমা হামলা চালিয়ে ৭৩জন নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করেছিলেন। মাত্র কিছুদিন আগেই তিনি ফ্লোরিডায় শান্তিপূর্ণভাবে মৃত্যুবরণ করেছেন। ‘বুশ মতবাদ’ অনুসারেই, যারা সন্ত্রাসীদের লালন-পালন করে বা আশ্রয় দেয়, তারাও সন্ত্রাসীদেরই সমতুল্য এবং তাদের সঙ্গে সেরকম আচরণই করা উচিত্। কেউ এটা খেয়ালই করল না যে, একথা বলে বুশ নিজেই নিজের ধ্বংস এবং যুক্তরাষ্ট্রে বহিরাক্রমনের দাওয়াত দিচ্ছেন।

অপারেশন জেরোনিমো। এই নামটার ক্ষেত্রেও একই কথা। তারা এটার মধ্য দিয়ে লাদেনকে আরও বেশি মহান হিসেবে উপস্থাপন করছে। লাদেনকে তারা দেখাচ্ছে হানাদার-বাহিনীর গণহত্যার বিরুদ্ধে সাহসী প্রতিরোধের প্রতীক হিসেবে। পশ্চিমা সমাজে সাম্রাজ্যবাদী মনোভাবটা এত গভীরভাবে প্রোথিত যে কেউ এটা উপলব্ধিই করে না। এটা হলো আমাদের অপরাধগুলোর শিকার হওয়া মানুষদের নামে প্রাণঘাতি অস্ত্রের নামকরণ করার মতো ব্যাপার: অ্যাপাচি, টোমাহক…। চিন্তা করেন, জার্মান বিমানবাহিনী লুফটওয়াফে তাদের জঙ্গি বিমানগুলোকে ডাকছে “ইহুদি” বা “জিপসি” নামে!

আরও অনেক ব্যাপার নিয়ে কথা বলার আছে। কিন্তু এই মৌলিক ব্যাপারগুলোও আমাদেরকে চিন্তার অনেক ভালো খোরাক যোগাতে পারে।