Posts Tagged ‘ জাতিসঙ্ঘ ’

রেইন ফরেস্টের মুক্তিপন দাবি ইকুয়েডরের

প্রকৃতির বিস্ময় অ্যামাজন রেইন ফরেস্টের একাংশে বিশাল অঙ্ক মূল্যের এক তেল খনির সন্ধান পেয়েছে ইকুয়েডর সরকার। কিন্তু অনাবিল প্রাকৃতিক নৈসর্গ ও বৈচিত্রে পরিপূর্ণ এই অংশটি থেকে তেল উত্তোলন শুরু করলে প্রায় ধ্বংসের মুখে পড়ে যাবে পূর্ব ইকুয়েডরের ইয়াসুনি ন্যাশনাল পার্কের প্রাণবৈচিত্র্য। বিধ্বস্ত হবে এলাকাটির স্বর্গীয় প্রাকৃতিকতা। আবার বর্তমান বিশ্ববাজারে এই তেল বিক্রির যে টাকাটা পাওয়া যাবে, সেটাও খুব করেই প্রয়োজন লাতিন আমেরিকার উন্নয়নশীল এই দেশটির। তাই এখন, ইকুয়েডরের হুমকিযুক্ত দাবি: অ্যামাজনের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য ও প্রাণবৈচিত্র্য রক্ষার বিনিময়ে আমাদের অর্থসাহায্য দাও, নয়তো আমরা তেল উত্তোলনের উদ্যোগ নেব। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কী রাজি হবে এই প্রস্তাবে? বিস্তারিত পড়ুন

বিশ্বশান্তি অর্জনের একটি বাস্তববাদী রুপকল্প

শান্তিতে নোবেল পুরস্কারজয়ী জোডি উইলিয়ামস এসেছেন বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার প্রতি অদম্য ভালোবাসা নিয়ে। বক্তৃতাটায় তিনি “শান্তি” প্রত্যয়টির যথার্থ অর্থ নির্ধারণ করতে চেয়েছেন তাঁর ক্ষুরধার দৃষ্টি দিয়ে আর কিছু সুনির্দিষ্ট গল্প বলে তিনি দেখিয়েছেন যে, কিরুপে সৃজনশীলভাবে সম্মিলিত সংগ্রামের মাধ্যমে দুনিয়ায় শান্তি ফেরানোর প্রক্রিয়া শুরু করা যায়।

আমি আসলে এখানে এসেছি সবার প্রতি একটা চ্যালেঞ্জ জানাতে। আমি জানি মানুষের কাছে অনেক রকম চ্যালেঞ্জই রাখা হয়েছে। আমি যে চ্যালেঞ্জটা জানাতে যাচ্ছি, তা হলো: আমাদের সময় হয়েছে শান্তি বলতে আসলেই কী বোঝায়, তা পূর্ণবিবেচনা করার। শান্তি মানে শুধু “Kumbaya, my Lord.” না। শান্তি মানে শুধু কবুতর আর রঙধনু নয়- তারা যতই আকর্ষণীয় হোক না কেন। যখন আমি রঙধনু বা কবুতরের প্রতীক দেখি, তখন আমি ব্যক্তিগত প্রশান্তির কথা চিন্তা করি। আমি ধ্যানের কথা চিন্তা করি। এগুলোর মাধ্যমে, আমি যেটাকে শান্তি বলে বিবেচনা করি, তা আমার মাথায় আসে না । যেটা হলো ন্যায়বিচার ও সমতাযুক্ত একটা অর্জনযোগ্য শান্তি। এটা একটা অর্জনযোগ্য শান্তি, যেখানে এই দুনিয়ার বেশিরভাগ মানুষের, মর্যাদাপূর্ণ জীবন যাপনের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় সবধরণের উপকরণের সহজপ্রাপ্যতা থাকবে। যেখানে এই মানুষগুলোর কাছে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার প্রয়োজনীয় উপকরণগুলো সহজপ্রাপ্য হবে। যেন তারা এমনভাবে জীবনযাপন করতে পারে, যেখানে তারা চাহিদা থেকে মুক্তি ও ভয় থেকে মুক্তি পেতে পারবে। এটাকেই বলে মনুষ্য নিরাপত্তা। আর আমি পুরোপুরি শান্তিবাদী মানুষ না, আমার খুবই অটল অহিংস বন্ধু ম্যাইরিড ম্যাকগুইরের মতো। আমি বুঝি যে, মানুষ এত তালগোল পাকানো পরিস্থিতিতে আছে — ভালো শব্দ ব্যবহার করলাম, কারণ আমি আমার মাকে কথা দিয়েছি যে, অনেক মানুষের মধ্যে কোন অশ্লীল শব্দ ব্যবহার করব না। আর আমি সত্যিই চেষ্টা করছি, মা। সত্যিই করছি।

আমাদের অল্প কিছু পুলিশ দরকার; আমাদের অল্প কিছু সামরিক বাহিনী দরকার। কিন্তু সেটা অবশ্যই প্রতিরক্ষার জন্য। আমাদের পূর্ণবিবেচনা করা উচিত্ যে, কিভাবে আমরা নিরাপত্তা পেতে পারি। নিরাপত্তা মানে এই না যে, আমাদেরকে পুরো দেশটাকেই আগাগোড়া অস্ত্রসজ্জিত করে রাখতে হবে। এর মানে এও না যে, অন্য দেশগুলোকেও সেইসব অস্ত্র দিয়ে মুড়ে দিতে হবে, যেগুলো আমরা তৈরি করি আর তাদের কাছে বিক্রি করি। নিরাপত্তা মানে এইসব টাকাগুলো খুবই যৌক্তিকভাবে ব্যবহার করা যেন, সত্যিকার অর্থেই পৃথিবীর দেশগুলোকে, পৃথিবীর মানুষগুলোকে নিরাপদ করে তোলা যায়। আমি কংগ্রেসের চলমান সাম্প্রতিক অধিবেশনের কথা ভাবছিলাম, যেখানে আমাদের প্রেসিডেন্ট START ভোট পাস করার জন্য ৮.৪ বিলিয়ন ডলারের প্রস্তাব দিচ্ছেন। আমি অবশ্যই START ভোট সমর্থন করি। কিন্তু তিনি ৮৪ বিলিয়ন ডলারের প্রস্তাব দিচ্ছেন পরমানু আগ্নেয়াস্ত্র আধুনিকীকরণের জন্য! আপনি কী জানেন সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের করার জন্য জাতিসঙ্ঘ যে অর্থের পরিমাণটা বলে সেটা ৮০ বিলিয়ন? এত অল্প পরিমান টাকা! আমি ভাবি যে, যদি আমার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে থাকত! তা নেই। কিন্তু বৈশ্বিক প্রেক্ষিতে এটা খুবই অল্প পরিমাণ টাকা। আর এটা ব্যবহূত হতে যাচ্ছে সেইসব অস্ত্রের পেছনে যেগুলো আমাদের সত্যিই কোন দরকার নেই। আর আমরা এগুলোর হাত থেকে মুক্তিও পাব না যদি না আমরা উঠে দাঁড়াই ও এগুলোর রুখে দেওয়ার জন্য সক্রিয় হই। আমাদেরকে বিশ্বাস করতে হবে যে, বিভিন্ন ধরণের যেসব কর্মকাণ্ডের কথা আমরা গত দুইদিন ধরে এখানে শুনছি, সেগুলোই হলো সেসব উপাদান যেগুলোর সমন্বয়ে গড়ে ওঠে সত্যিকারের মনুষ্য নিরাপত্তা। সেটা হতে পারে বন্য বাঘ রক্ষা, সেটা হতে পারে টার-সান্ড রুখা, এটা হতে পারে সেইসব চিকিত্সা যন্ত্রপাতির সহজপ্রাপ্যতা যা দিয়ে সঠিকভাবে ক্যান্সার নির্নয় করা যায়। এটা এরকম যে কোন কিছুই হতে পারে। এটা টাকাগুলোকে এইসব কাজে ব্যায় করার প্রশ্ন। এটা সত্যিকার অর্থেই সক্রিয় হবার প্রশ্ন।

কয়েক সপ্তাহ আগে আমি গিয়েছিলাম হিরোশিমায়। আর সেখানে মহামান্য দালাই লামা উপস্থিত ছিলেন। আমরা শহরের হাজার হাজার মানুষের সামনে বসেছিলাম, আমরা আটজন নোবেল জয়ী সেখানে ছিলাম। আর তিনি একটু বদ লোক। তিনি যেন চার্চে একটা দুষ্টু বালকের মতো। আমরা সবাই একে অপরের দিকে তাকাতাকি করছিলাম আর অপেক্ষা করছিলাম আমাদের বক্তৃতার পালা আসার জন্য। এরকম পরিস্থিতিতে তিনি আমার দিকে ঝুঁকে বললেন, ‘জোডি, আমি একজন বৌদ্ধ সন্ন্যাসী।’ আমি বললাম, ‘হ্যাঁ, মহামান্য, আপনার পোশাক দিয়েই সেটা প্রকাশ পাচ্ছে।’ (হাসি) তিনি বললেন, ‘তুমি জান, আমি কিছুটা ধ্যান পছন্দ করি আর আমি প্রার্থনা করি।’ আমি বললাম, ‘এটা খুবই ভালো। খুবই ভালো। আমাদের দুনিয়ায় এটা খুবই দরকার। আমি এটা করি না, কিন্তু এটা খুবই ভালো।’ আর তিনি বললেন, ‘কিন্তু আমি সন্দেহগ্রস্থ হয়ে পড়েছি। আমি আর বিশ্বাস করি না যে, ধ্যান-প্রার্থনা দিয়ে দুনিয়ায় বদল আনা সম্ভব। আমার মনে হয় আমাদের যা দরকার তা হলো সক্রিয় হওয়া।’ মহামান্য দালাই লামা- তাঁর পোশাকসমেত, তিনিই এখন আমার নতুন সক্রিয়তার নায়ক।

আমি কয়েকদিন আগে কথা বলেছি আং সাং সু চির সঙ্গে। আপনাদের প্রায় সবাই-ই জানেন যে, তিনি তাঁর দেশ বার্মায় গণতন্ত্রের নায়ক। আপনারা সম্ভবত আরও জানেন যে, তিনি তাঁর জীবনের শেষ ২০ বছরের মধ্যে ১৫ বছরই কারাগারে কাটিয়েছেন এই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টায়। তাঁকে মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগে মুক্তি দেওয়া হয়েছে, আর আমরা এটা দেখার জন্য খুবই আগ্রহী যে, কতদিন তিনি মুক্ত থাকতে পারবেন। কারণ তিনি ইতিমধ্যেই রেঙ্গুনের রাস্তায় নেমে পড়েছেন। বিক্ষোভ করছেন পরিবর্তনের জন্য। তিনি রাস্তায় নেমে পড়েছেন, নিজের পার্টি নিয়ে কাজ করা শুরু করেছেন সেটা পূর্ণগঠনের জন্য। আমি তাঁর সঙ্গে অনেক প্রসঙ্গ নিয়ে কথা বলেছি। তার মধ্যে একটা যেটা আমি বলতে চাই, অনেকটাই মিলে যায় মহামান্য দালাই লামার সঙ্গে। সু চি বলেছিলেন, ‘আমার দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে আরও লম্বা একটা পথ পাড়ি দিতে হবে। কিন্তু আমি প্রচেষ্টা ব্যতিরেকে কোন আশায় বিশ্বাস করি না। আমি কোন পরিবর্তনের আশায় বিশ্বাস করি না, যতক্ষণ পর্যন্ত আমরা সেটা করার জন্য সক্রিয় না হচ্ছি।’

এবার বলব আমার আরেকজন নারী নায়কের কথা। তিনি আমার বন্ধু, ড. শিরীন এবাদি। প্রথম মুসলিম নারী যিনি নোবেল পুরস্কার জিতেছিলেন। গত দেড় বছর ধরে তিনি নির্বাসিত জীবন কাটাচ্ছেন। আপনি তাঁকে জিজ্ঞাসা করবেন, তিনি কোথায় থাকেন, নির্বাসিত অবস্থায় তাঁর বাস কোথায়? তিনি বলবেন, পুরো দুনিয়ার বিমানবন্দরগুলোতে। তিনি ক্রমাগত ভ্রমণ করে বেড়াচ্ছেন কারণ তাঁর দেশে নির্বাচনের সময় তাঁকে দেশ ছেড়ে চলে যেতে হয়। আর বাড়ি চরে যাওয়ার বদলে তিনি অন্যান্য নারীদের সঙ্গে আলাপচারিতা চালিয়ে যাচ্ছেন, যাঁদের নিয়ে তিনি একসঙ্গে কাজ করেন, যাঁরা তাঁকে বলে, ‘তুমি বাইরেই তাক। আমাদের তোমাকে বাইরেই দরকার। আমরা যেন তোমার সঙ্গে কথা বলতে পারি, এখানে কী কী ঘটে চলেছে, তা যেন আমরা তোমাকে জানাতে পারি।’ দেড় বছর ধরে তিনি তাঁর দেশের নারীদের প্রতিনিধিত্ব করে কথা বলে যাচ্ছেন।

ওয়াংগারি মাথাই — ২০০৪ সালের নোবেল পুরস্কার জয়ী। সবাই তাঁকে ডাকে “গাছ-মহিলা” বলে। কিন্তু তিনি গাছ মহিলার চেয়েও আরও অনেক কিছু। শান্তির জন্য কাজ করাটা খুব সৃজনশীল। এতে প্রতিদিনই কঠোর শ্রম দিতে হয়। যখন তিনি ঐসব গাছগুলো লাগাচ্ছিলেন, আমার মনে হয় না বেশিরভাগ মানুষ সেসময় বুঝেছিল যে, তিনি মানুষজনকে এই গাছ লাগানোর সঙ্গে সংযুক্ত করার মাধ্যমে, তাদের সঙ্গে নিজ দেশের কর্তৃত্বপরায়ন সরকারের হাত থেকে কিভাবে রক্ষা পাওয়া যায়, সেই আলাপও করছিলেন। গ্রেফতার হওয়া বা জেলে যাওয়া পরিহার করে মানুষের একজায়গায় হওয়ার কোন সুযোগ ছিল না। কিন্তু তারা একজায়গায় হয়ে যদি পরিবেশের জন্য গাছ লাগায়, তাহলে সেটা ঠিক আছে। এটা খুবই সৃজনশীল। শুধু শিরিন, অং সাং সু চি, ওয়াঙ্গারি মাথাইয়ের মতো প্রসিদ্ধ ব্যক্তিরাই নন, দুনিয়ার আরও অনেক নারী এই দুনিয়ার বদলের জন্য প্রতিনিয়ত একসঙ্গে সংগ্রাম করে যাচ্ছেন।

বার্মা নারী লিগ, বার্মিজ নারীদের ১১টি স্বতন্ত্র সংগঠন একসঙ্গে কাজ করছে। কারণ সংখ্যায় শক্তি বাড়ে। একসঙ্গে কাজ করেই আমরা এই দুনিয়ার বদল ঘটাতে পারি। বার্মার ভেতরে নারীরা সম্মিলিতভাবে গড়ে তুলেছে মিলিয়ন সিগনেচার ক্যাম্পেইন, সেখানকার মানবাধিকার পরিস্থিতি পরিবর্তনের জন্য। যখন একজনকে গ্রেফতার করা হয়, জেলে পোড়া হয়, তখন আরেকজন বেরিয়ে আসে, আন্দোলনে যুক্ত হয়। তারা এটা বুঝতে পেরেছে যে, যদি তারা একসাথে কাজ করে, তাহলেই শেষপর্যন্ত তারা নিজ দেশে পরিবর্তন আনতে পারবে।

মধ্যে মাইরেড ম্যাকগুইর, ডানপাশে বেটি উইলিয়ামস — একসঙ্গে মিলে তাঁরা শান্তি আনছেন নর্দান আয়ারল্যান্ডে। খুব সংক্ষেপে একটা গল্প বলি। একজন আইআরএ গাড়ি চালককে গুলি করা হয়েছিল আর তার গাড়িটা ফেলে দেওয়া হয়েছিল পাশের সড়কের মানুষদের উপরে। ওখানে ছিল একটা মা ও তার তিন বাচ্চা। বাচ্চাগুলো ঘটনাস্থলেই মারা গিয়েছিল। তিনি ছিলেন মাইরেডের বোন। এ ধরণের সহিংসতার মধ্যে পড়ে তীব্র শোক, হতাশা, পরাজয়ের বেদনায় মুষড়ে পড়ার বদলে মাইরেড ঝুলে গেলেন বেটির সঙ্গে। একজন গোঁড়া প্রোটেস্ট্যান্ড ও একজন গোঁড়া ক্যাথলিক। আর তারা রাস্তায় বেড়িয়ে পড়েছেন, “আর কোন সহিংসতা নয়” বলতে বলতে। আর তাঁরা হাজার হাজার মানুষকে সঙ্গে পেয়েছেন। প্রথমদিকে বেশিরভাগই নারী, কিছু পুরুষ। তারা রাস্তায় নেমেছেন পরিবর্তনের জন্য। আর নর্দান আয়ারল্যান্ডে যে শান্তি এসেছে, সেটার পেছনে তাঁরাও রেখেছেন বড় ভূমিকা। আর তাঁরা এ নিয়ে এখনও কাজ করে চলেছেন। কারণ এখনও অনেক কিছু করার বাকি।

এবার রিগোবেরটা মেঞ্চু টিম। তিনিও নোবেল পুরস্কার জয়ী। তিনি এখন প্রেসিডেন্ট পদের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বীতা করছেন। তিনি তাঁর দেশের আদিবাসী মানুষদের ধারণা দিচ্ছেন যে, গণতন্ত্র বলতে আসলে কী বোঝায়, কিভাবে দেশে গণতন্ত্র আনা যায়। তিনি তাদেরকে বলছেন ভোট দেওয়ার পদ্ধতি সম্পর্কে। কিন্তু এই গণতন্ত্র মানে শুধু ভোট দেওয়াই না। এর মানে একজন সক্রিয় নাগরিক হওয়া।

আমিও এইভাবে জড়িয়ে পড়েছিলাম, ল্যান্ডমাইন নিষিদ্ধ করার ক্যাম্পেইনে। কয়েকটি ব্যাপারের মধ্যে একটা, যে কারণে এই ক্যাম্পেইনটা কাজ করে যাচ্ছে, সেটা হলো আমরা মাত্র দুইটা এনজিও থেকে বিশ্বের ৯০টি দেশের হাজারটা এনজিওতে বেড়ে উঠেছি। ল্যান্ডমাইন নিষিদ্ধ করার সাধারণ দাবিতে আমরা একসঙ্গে কাজ করছি। এমনও মানুষ আছেন যারা আমাদের এই ক্যাম্পেইনে কাজ করেছে প্রতিদিন একঘন্টা, একমাস ধরে। তারা হয়ত এটুকু স্বেচ্ছাশ্রমই দিতে পারত। আবার আমার মতো সার্বক্ষনিক কর্মীও আছে। কিন্তু যা এখানে মুখ্য বিষয়, তা হলো সক্রিয়তা, একসঙ্গে, আমাদের সবার। যে পরিবর্তনটা আমরা আনতে চাই, সেটা নিয়ে।

আমার দৃষ্টিতে, আজকের দিনে আমাদের এমন মানুষ দরকার, যে উঠে দাঁড়াবে আর শান্তি প্রত্যয়টার যথার্থ অর্থ তুলে ধরে সক্রিয় হবে। এটা খুবই বাজে একটা দুনিয়া না। এটা প্রতিটা দিনই খুব কঠোর পরিশ্রম করার প্রশ্ন। আর যদি আমাদের সবাই, যারা ভিন্ন ধরণের জিনিসপত্র নিয়ে ভাবে, আর সেগুলো কার্যকর করার জন্য যে যেটুকু সময় পারে, সেটুকু স্বেচ্ছাশ্রম দেয়, তাহলে আমরা এই দুনিয়াটা বদলাতে পারব। আমরা এই দুনিয়াটাকে রক্ষা রতে পারব। আর আমরা অন্য কারও জন্য অপেক্ষা করতে পারি না। আমাদের নিজেদেরই এটা করতে হবে। ধন্যবাদ।

নোম চমস্কি: ইসরায়েলের জন্য সুনামি সতর্কবার্তা

মে মাসে ইসরায়েলের ব্যবসায়িক নেতাদের এক রুদ্ধদ্বার বৈঠকে ইদান ওফার সবাইকে সতর্ক করেছিলেন যে, ‘আমরা খুব দ্রুতই দক্ষিণ আফ্রিকা হয়ে যাচ্ছি। আন্তর্জাতিক আইনভঙ্গকারী হিসেবে আমাদের যে অর্থনৈতিক দণ্ডের সম্মুখীন হতে হবে, তার প্রভাব ইসরায়েলের প্রতিটা পরিবারের উপর পড়বে।’ এই ব্যবসায়িক নেতাদের প্রধান ভাবনার বিষয় ছিল, এই সেপ্টেম্বরে শুরু হওয়া জাতিসঙ্ঘের সাধারণ অধিবেশন। যেখানে ফিলিস্তিনের মানুষ নিজেদের রাষ্ট্রসত্তার বৈধতার দাবি তোলার পরিকল্পনা করছে। ঐ বৈঠকে আরও একজনের মুখে সতর্কবার্তা উচ্চারিত হয়েছিল। জাতিসঙ্ঘে নিযুক্ত ইসরায়েলের সাবেক রাষ্ট্রদূত বলেছিলেন, ‘ফিলিস্তিনকে একটা স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা দেওয়ার পরের দিন থেকেই ইসরায়েলের খুব কষ্টকর ও নাটকীয় একটা দক্ষিণ আফ্রিকাকরণ শুরু হবে।’ মানে, ইসরায়েল পরিণত হবে একটা অপরাধী রাষ্ট্রে। যার উপর আন্তর্জাতিক আইনানুযায়ী দণ্ড প্রযোজ্য হতে পারে।

এটা এবং এরকম আরও কিছু বৈঠকে ব্যবসায়িক গোষ্ঠী সরকারকে তাগাদা দিলেন বিগত দিনের মত দ্রুত এই ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের পরিকল্পনা ভেস্তে দেওয়ার উদ্যোগ নিতে। যেমনটা তারা আগে করেছিল সৌদি (আরব লীগ) প্রস্তাবসমূহ বা ২০০৩ সালে অনানুষ্ঠানিক জেনেভা চুক্তিসমূহের সময়। যেখানে উচ্চপর্যায়ের ইসরায়েলি ও ফিলিস্তিন নেতাদের মধ্যে একটা দুই রাষ্ট্র ব্যবস্থা বিষয়ে বিস্তারিত চুক্তি হয়েছিল। বিশ্বের বেশিরভাগ দেশ এটাকে স্বাগতও জানিয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীতে যুক্তরাষ্ট্রের অবহেলা ও ইসরায়েলের বিরুপ মনোভাবের কারণে তা বাস্তবায়িত হয়নি।
গত মার্চ মাসে ইসরায়েরের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইহুদ বারাক সাবধানবানী শুনিয়েছিলেন যে, যদি জাতিসঙ্ঘ ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি ঘোষণা করে, তাহলে ইসরায়েলর জন্য “সুনামি” অপেক্ষা করছে। তাঁর ভয় ছিল, পুরো বিশ্ব ইসরায়েলকে অপরাধী বানাবে শুধু এই কারণে নয় যে, তাঁরা আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করেছে। বরং এইজন্যও যে, তারা জাতিসঙ্ঘ স্বীকৃত একটা রাষ্ট্রে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড সংগঠিত করেছে। ফলে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল এটা রুখবার জন্য উচ্চপর্যায়ের কূটনৈতিক তত্পরতা চালাচ্ছে। যদি তারা ব্যর্থ হয়, তাহলে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের বৈধতা অবশ্যম্ভাবী।
১০০টিরও বেশি দেশ ফিলিস্তিনকে বৈধতা দিয়েছে। যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও অন্যান্য ইউরোপীয় দেশগুলো ফিলিস্তিনের সাধারণ ঘোষণাপত্রকে ‘কূটনৈতিক মিশন ও দূতাবাসের’ মর্যাদা দিয়েছে। যা সাধারণত শুধু কোন রাষ্ট্রের জন্যই সংরক্ষিত থাকে। আমেরিকান জার্নাল অব ইন্টারন্যালনাল ল-এ এই তথ্যটা সরবরাহ করেছেন ভিক্টর কাতান। ইউনেসকো ও ডব্লিউএইচও ছাড়া জাতিসঙ্ঘের সংগঠনগুলোতেও প্রবেশাধিকার পেয়েছে ফিলিস্তিন। তারা যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক অসহযোগিতার ভয়টাও পাত্তা দেয় নি।
যদি রাষ্ট্রসত্তার স্বীকৃতির দাবি থেকে সরে না আসে, তাহলে ফিলিস্তিনকে সাহায্য-সহযোগিতা বন্ধের হুমকি দিয়ে গত জুনে যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটে একটি বিল পাস করা হয়। ডেইলি টেলিগ্রাফের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, জাতিসঙ্ঘে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত সুশান রাইস সবাইকে সতর্ক করেছিলেন এই বলে যে, ‘জাতিসঙ্ঘকে টাকা জোগানোটা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য খুব বেশি হুমকি ছিল না, যতটা এখন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের বৈধরুপ প্রাপ্তির দিকসমূহ চিন্তা করে হচ্ছে। আর এটা হচ্ছে সহযোগী রাষ্ট্রসমূহের সহায়তাতেই।’ জাতিসঙ্ঘে ইসরায়েলের নতুন রাষ্ট্রদূত তার দেশের সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে জাতিসঙ্ঘের স্বীকৃতি সহিংসতা ও যুদ্ধে রুপ নিতে পারে।
জাতিসঙ্ঘ হয়তো ফিলিস্তিনকে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সীমানা ধরেই রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করতে পারে। সেক্ষেত্রে এই রাষ্ট্রের মধ্যে গোলান হাইটস, পশ্চিম তীর ও গাজাও অন্তর্ভূক্ত হবে।
১৯৮১ সালের ডিসেম্বরে, জাতিসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদের আদেশ ভঙ্গ করে ইসরায়েল এই হাইটস অধিগ্রহণ করেছিল। পশ্চিম তীরে ইসরায়েলকে সমর্থন যোগানোর জন্য যে বন্দোবস্ত ও আইন-কানুন জারি আছে, তা পরিস্কারভাবেই আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন। আন্তর্জাতিক আদালত ও নিরাপত্তা পরিষদও এটা স্বীকার করেছে।
২০০৬ সালের ফেব্রুয়ারীতে, যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল যৌথভাবে গাজার উপর অবরোধ জারি করে। এর কারণ ফিলিস্তিনের নির্বাচনে ‘ভুলপক্ষ’ হামাস জয়লাভ করেছিল। যাদের পরিচিতি স্বাধীনচেতা হিসেবে। ২০০৭ সালের জুনে যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত একটা সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে এই নির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার মিশন ব্যর্থ হওয়ার পর এই অবরোধ আরও জোরদার করা হয়েছিল।
২০১০ সালে রেড ক্রস আন্তর্জাতিক কমিটি এই গাজা অবরোধের তীব্র নিন্দা জানিয়েছিল। যারা এ ধরণের ইস্যু নিয়ে খুব কমই কথা বলে। বিবিসির প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, রেডক্রস অবরুদ্ধ গাজা পরিস্থিতির একটা বিষণ্ন চিত্র এঁকেছিল এভাবে, ‘হাসপাতালে প্রয়োজনীয় উপকরণ নেই, প্রতিদিন ঘন্টার পর ঘন্টা বিদ্যুত্ থাকে না, পানযোগ্য পানির অপর্যাপ্ততা এবং অবশ্যই এই সমগ্র জনগোষ্ঠী কারারুদ্ধ।’
১৯৯১ সালে গাজাকে পশ্চিম তীর থেকে পৃথক করার পরিকল্পনা শুরু করার পর থেকেই এই ধরণের অপরাধমূলক অবরোধ যুক্তরাষ্ট্র-ইসরায়েলের নীতি-নির্ধারণে বিস্তর প্রভাব রেখেছে। এর মাধ্যমে তারা এটা নিশ্চিত করে যে, যদি কখনো কোন ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র মাথা তুলে দাঁড়ায়, তাহলে তার অংশগুলো যেন ইসরায়েল ও জর্ডানের মতো শত্রুতাপূর্ণ ক্ষমতার আওতায় থাকে। ১৯৯৩ সালে, ইসরায়েল ও ফিলিস্তিন লিবারেশন অর্গানাইজেশনের (পিএলও) মধ্যে স্বাক্ষরিত অসলো চুক্তিতে গাজাকে পশ্চিম তীর থেকে পৃথক করার সুপারিশ করা হয়।
যুক্তরাষ্ট্র-ইসরায়েলের এই প্রত্যাখ্যানবাদের ফলে আরও একটা আসন্ন হুমকির মুখে আছে ফ্লোটিলা, যারা চিঠিপত্র ও জনহিতকর সাহায্য নিয়ে এনে গাজার এই অবরোধকে চ্যালেঞ্জ জানাতে চেয়েছিল। ২০১০ এর মে মাসে এ ধরণের একটা উদ্যোগ ইসরায়েলি কমান্ডোদের আক্রমণের মুখে পড়েছিল। গাজার আন্তর্জাতিক সমুদ্রসীমার মধ্যে পরিচালিত এই হামলায় মারা গিয়েছিল নয়জন যাত্রী। যা একটা বড় অপরাধ। যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া প্রায় সবাই এই হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়েছিল।
ইসরায়েলের বেশিরভাগ মানুষ নিজেদের বুঝিয়েছে যে, কমান্ডোরা নির্দোষ ছিল। হামলাকৃত ঐ জাহাজের যাত্রীরাই আগে আক্রমন চালিয়েছিল। কী ধরণের আত্মবিধ্বংসী অযৌক্তিকতা ইসরায়েলকে কুরে কুরে খাচ্ছে, এটা তার একটা চিহ্ন।
এখন যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল ফ্লোটিলা তত্পরতা বন্ধ করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে। হিলারি ক্লিনটন অপ্রত্যক্ষভাবে সহিংসতাকে আরও বৈধতা দিয়েছেন। বলেছেন, যদি ফ্লোটিলা ‘ইসরায়েলের জলসীমায় ঢুকে উসকানি দেওয়ার চেষ্টা করে’ তাহলে ‘ইসরায়েলিদের আত্মরক্ষা করার পূর্ণ অধিকার আছে।’
গ্রীস তাদের নৌবন্দর থেকে এই নৌযানগুলো ছেড়ে যাওয়া প্রতিরোধ করার ব্যাপারে সম্মতি জানিয়েছিল। যদিও ক্লিনটনের মতো, গ্রীসও খুব সঠিকভাবেই গাজার সমুদ্রসীমা নির্ধারণ করেছিল। অবশ্য ২০০৯ সালের জানুয়ারীতে গ্রীস একটা স্বতন্ত্র অবস্থান নিয়েছিল। সেসময় গাজার ওপর যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের নৃশংস সহিংসতা চলাকালে তারা যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র ইসরায়েলে নিয়ে যাওয়ার জন্য তাদের বন্দর ব্যবহার করতে দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল।
ফ্লোটিলা কোন উসকানিমূলক কর্মকাণ্ড কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে জাতিসঙ্ঘের ত্রাণ ও কর্মসংস্থান এজেন্সির মুখপাত্র ক্রিস গানেস বলেন, ‘যদি ফিলিস্তিনে কোন মানবাধিকার সংকট না-ই থাকে, যদি সেখানে কোন ধরণেরই সংকট না থাকে, তাহলে ফ্লোটিলারও কোন প্রয়োজন পড়বে না। গাজার ৯৫ ভাগ পানি পাণ করার উপযোগী না। সেখানে ৪০ ভাগ রোগই পানিবাহিত। শ্রমিকদের ৪৫.২ ভাগ বেকার। তাদের টিকে থাকার জন্য ৮০ ভাগেরও বেশি নির্ভর করতে হয় বাইরের সাহায্য-সহযোগিতার জন্য। আর এই পরিস্থিতির করুণ অবনতি হয়েছে গাজায় অবরোধ জারির পর থেকে। এই অবরোধ তুলে নেওয়া হোক। তাহলে আর কোন ফ্লোটিলারও প্রয়োজন পড়বে না।’
ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি বা সাধারণভাবে যে কোন অসহিংস কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য কূটনৈতিক উদ্যোগ তাদেরকে হুমকির মুখে ফেলে দেয়, যারা সহিংসতাকে একচেটিয়াভাবে দখলে রেখেছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল, নিজেদের একেবারে ক্ষমার অযোগ্য একটা অবস্থানে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে: দখলদারিত্ব ও নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড এবং একটা কূটনৈতিক বন্দোবস্ত বা ঐক্যমত্যে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রিতা।