Posts Tagged ‘ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ’

ব্লগার গ্রেপ্তার প্রসঙ্গে কিছু বললেন না ইউনুস

Yunus+In+US-18.04.13

২০০৬ সালে শান্তিতে নোবেল জয়ের পর ড. মুহাম্মদ ইউনুস এবার পেয়েছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা, কংগ্রেশনাল স্বর্ণপদক। ক্ষুদ্রঋণভিত্তিক গ্রামীন ব্যাংকের মাধ্যমে তিনি যা করে আসছেন সেটা যুক্তরাষ্ট্রের বিবেচনায়, ‘মানুষকে শ্রেয়তর জীবনের পথে এগিয়ে নেবে’। একারণেই ড. ইউনুসকে এই পুরস্কার দেওয়ার জন্য মনোনিত করেছে যুক্তরাষ্ট্র। সাম্প্রতিক সময়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করার দাবিতে বাংলাদেশে যে আন্দোলন গড়ে উঠেছে, সে প্রসঙ্গে কোন মন্তব্য শোনা যায় নি ড. ইউনুসের কাছ থেকে। এবার হেফাজতে ইসলামের দাবিমাফিক সরকার যে তথাকথিত চার ‘নাস্তিক’ ব্লগারকে গ্রেপ্তার করেছে, সে বিষয়েও কোন মন্তব্য করেননি শান্তিতে নোবেলজয়ী প্রথম বাংলাদেশী।
পুরস্কার গ্রহণ অনুষ্ঠানে ব্লগারদের গ্রেপ্তার প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে ড. ইউনুস বলেন, ‘আমি এখন এই রকম ইস্যু নিয়ে কোন মন্তব্য করতে চাই না। আজকের সমস্ত আলোচনার কেন্দ্রে এই অনুষ্ঠানটাই থাকা উচিৎ।’ একথা বলেই তিনি দ্রুত সেখান থেকে চলে যান।
ইউনুসের আনুষ্ঠানিক বক্তব্য সীমাবদ্ধ ছিল গ্রামীন ব্যাংককে ঘিরেই। দারিদ্র দূরীকরণে এই প্রতিষ্ঠানটি কত ‘চমৎকার’ ও ‘উদ্ভাবনী চিন্তাভাবনা’ নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে, সেটা বর্ণনা করেছেন তিনি। এছাড়া ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় মার্কিন  সিনেটরদের সঙ্গে লবিং করার কথা উল্লেখ করেছেন ইউনুস। সেসময় তিনি আমেরিকায় থাকতেন। এবং এ কথা স্মরণীয় যে, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতা করেছিল এবং পাকিস্তানের আত্মসমর্পণের বিষয়টা প্রায় একদিন ঝুলিয়ে রেখেছিল
নারীর ক্ষমতায়ন প্রশ্নে ডেমোক্রাট, রিপাবলিকান, উভয় পার্টিরই ভূয়সী প্রশংসা পেয়েছেন ইউনুস। পুরস্কারটাও তিনি বাংলাদেশের লাখো নারীর পক্ষ থেকেই গ্রহণ করছেন বলে জানিয়েছেন। নারীরাই মূলত দারিদ্র দূরীকরণের এই স্বপ্নপূরণের পথে অগ্রণী ভূমিকা রাখবে বলে উল্লেখ করেন ইউনুস। অথচ সাম্প্রতিক সময়ে হেফাজতে ইসলাম নামধারী একটি সংগঠন নারীদের স্বাধীনতা হরণের লক্ষ্যে আন্দোলন শুরু করলেও সে বিষয়ে কোন মন্তব্য আসেনি ইউনুসের কাছ থেকে। শাহবাগ আন্দোলন সম্পর্কেও তিনি নিরব।
এইরকম পরিস্থিতির মধ্যে ইউনুসের নতুন এই পুরস্কারপ্রাপ্তির খবরটি সমালোচিত হয়েছে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে। অনলাইন অ্যাকটিভিস্টদের অনেকেই ভেবে পাচ্ছেন না যে, সমাজের খুবই গুরুত্বপূর্ণ সব ইস্যুতে কোন মতামত না দেওয়া সত্ত্বেও তিনি কিভাবে একের পর এক পুরস্কার জিতে যাচ্ছেন?
গত ২৫ বছরে অন্তত ১০৩টি পুরস্কার পেয়েছেন মুহাম্মদ ইউনুস। ২০০৬ সালে শান্তিতে নোবেল ও যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা ছাড়াও ২০০৯ সালে ইউ.এস প্রেসিডেনশিয়াল মেডেল অব ফ্রিডম পুরস্কার পেয়েছেন ইউনুস।  ইউনুসের দর্শন প্রচারের জন্য ২০০৬ সালে প্রতিষ্ঠা হয়েছে ইউনুস সেন্টার।- হাফিংটন পোস্ট

ইতিহাস নির্ধারণী মুহূর্তের সামনে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ

bangladesh_illus_20130318

বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও শাহবাগ চত্বরের আন্দোলন নিয়ে বেশ কয়েকটি ভুল ধারণা চালু হয়েছে। শাহবাগ চত্বর থেকে সরকারকে চাপ দেওয়া হচ্ছে দ্রুত জামায়াত-ই-ইসলামী নিষিদ্ধ করার কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুন্যালের সমালোচকেরা এই বিচারপ্রক্রিয়া নিয়ে আপত্তি তুলেছেন। কেউ কেউ এটাকে আখ্যায়িত করছেন ‘পক্ষপাতদুষ্ট’ বলে। আরেকটি অভিযোগ হলো, এই বিচার করা হচ্ছে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ও বিরোধীদলীয় নেতাদের ঘায়েল করার জন্য। এই উদ্বেগ-আশঙ্কাগুলো পশ্চিমা গণমাধ্যমের ফিল্টার গলে প্রকাশিত হয়েছে। আর এর পেছনে আছে কিছু সুসংগঠিত জনসংযোগ তত্পরতা, যেগুলো চালানো হচ্ছে কিছু নেতৃস্থানীয় জামায়াত নেতাদের তরফ থেকে।

এই নিন্দুকেরা যা বুঝতে ব্যর্থ হয়েছেন সেটা হলো, ১৯৮৯ সালে গণঅভ্যুত্থানের মধ্যে দিয়ে সামরিক শাসনের অবসান ঘটানোর পর এবার বাংলাদেশ ফিরে পাওয়ার চেষ্টা করছে তার জন্মকালীন আদর্শগুলোকে। বাঙ্গালী সংস্কৃতির অপহূত বহুমতভিত্তিক অসাম্প্রদায়িক মূল্যবোধকে। ৭১’র মুক্তিযুদ্ধের সময়কে ঘিরে গড়ে ওঠা বিতর্কিত ঘটনাগুলোর অবসান ঘটানোর কাজটাও তাদের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। এটা বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষের কাছেই একটা আবেগীয় ইস্যু। দেশের ভেতরে ও প্রবাসী, উভয়ের জন্যই। আর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুন্যাল গঠন এই লক্ষ্যপূরণের পথে একটা বিশাল ধাপ।

এই দেশ বা রাষ্ট্র ফাঁসির দাবিতে উন্মত্ত জনতা বা কোন ডেথ স্কোয়াড তৈরি করে নি। বা শুধু বিরোধীদলীয় নেতৃবৃন্দকে মেরে ফেলার জন্য এই বিচারপ্রক্রিয়া শুরু করেনি। যুদ্ধাপরাধের দায়ে বিচারাধীনদের মধ্যে অনেকেই স্বীকার করেছে যে, তারা ১৯৭১ সালে নৃশংশতার সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত ছিল। পুরোপুরি নিখুঁত না হলেও আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুন্যাল প্রতিষ্ঠিত মানদণ্ডের ভিত্তিতে, আইনের রীতিনীতি মেনেই ক্রিয়াশীল আছে। এছাড়াও, এটা আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে, পুরো বিশ্বজুড়েই এই ধরণের বিশেষ ট্রাইবুন্যাল গঠনের ঘটনাগুলো অনেক বিতর্কের মুখে পড়ে। বিচারিক কর্মকাণ্ডগুলো প্রশংশিত বা নিন্দিত হয় কোন পক্ষের দিকে দিকে রায় যাচ্ছে, তা বিবেচনা করে।

এই বিষয়টা নিয়ে ভারতীয় বা আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে দেখা যাচ্ছে খুবই সাধারণীকৃত বিবরণী। কিন্তু শাহবাগের বিশাল লোকসমাগমটা শুধুই কিছু জামায়াত নেতার ফাঁসির দাবিতে হয়নি। এটা এর চেয়েও অনেক বেশি কিছু। এটা নির্ধারণ করবে বাংলাদেশ ভবিষ্যতে কোন পথে হাঁটবে। বহুমতভিত্তিক অসাম্প্রদায়িক চেতনার পথে নাকি জামায়াত প্রবর্তিত ভীনগ্রহের মতবাদস্বরুপ ধর্মীয় মৌলবাদের পথে।

চলমান এই আন্দোলনের নেতৃস্থানীয়দের অনেকে নিজেদেরকে ডাকছেন ‘প্রজন্ম ৭১’ নামে। এরা কেউই ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ ও পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসর জামায়াতের নেতৃত্বে রাজাকার-আলবদরদের নৃশংস-নির্মম সহিংসতা দেখেননি। কিন্তু বর্বর আক্রমণের সেই স্মৃতি, এই জাতির সামগ্রিক চেতনার সঙ্গে গেঁথে গেছে আজীবনের জন্য। এই তরুণ প্রজন্ম স্মৃতি-ইতিহাস থেকে শুধু অনুপ্রেরণাই সংগ্রহ করছে না; এটা সবার মাথায় রাখা দরকার যে, এই প্রজন্মের অনেকেই মুক্তিযুদ্ধের সময় তাদের খুবই কাছের মানুষদের খুন হওয়ার কথা জেনেছে, রাজাকারদের হাতে। ফলে ১৯৭১ সালের নৃসংশ সহিংসতার জন্য দায়ী যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি যে বাংলাদেশীদের চেতনাগত জায়গায় নাড়া দেবে, এটাতে বিস্ময়ের কিছু নেই। আর তারা শাহবাগ চত্বরে আসতেই আছেন।

একদিক থেকে, এই তরুণ প্রজন্ম ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের চেতনারও পুনরুজ্জীবন ঘটাতে সক্ষম হয়েছে। যেটা গড়ে উঠেছিল বাংলা ভাষাভাষী তত্কালিন পূর্ব পাকিস্তানের মানুষদের উপর জোর করে রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসেবে উর্দু চাপিয়ে দেওয়ার প্রবল প্রতিবাদে। সেইসময়ই এই ভূখণ্ডে রোপণ হয়েছিল একটি অসাম্প্রদায়িক দেশ গঠনের স্বপ্ন। সেই স্বপ্ন পূর্ণতা পায় ১৯৭১ সালে নয়মাসব্যাপী রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে। একইভাবে, ১৯৮৯ সালের ডিসেম্বরে জনসাধারণের ঢল নামে রাজপথে। সেবার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে সামরিক স্বৈরতন্ত্রকে ক্ষমতাচ্যুত করেছিল তারা।

বাংলাদেশের ইতিহাসের এই গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলো এটাই প্রমাণ করে যে, যখনই দেশের রাজনীতি তার মূল ভিত্তি উদারনৈতিক বহুমতবাদের মূল জায়গা থেকে সরে যাচ্ছে, তখন রাজনীতিকে সঠিক পথ দেখানোর একটা অসাধারণ ক্ষমতা  এই দেশের মানুষের আছে।

সালাফি মতবাদের একটি সংযোজিত রুপ হচ্ছে জামায়াত। এবং এই সংগঠনটি বাংলাদেশী চিন্তাচেতনার সঙ্গে মিলতে পারে না। পুরো ৮০ ও ৯০এর দশক জুড়ে জামায়াত ও তাদের সহযোগী সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর (যেমন জেএমবি, জেএমজেবি, হরকাতুল জিহাদ) হামলার শিকার ছিল সমাজের প্রগতিশীল, অসাম্প্রদায়িক উপাদানগুলো। এবং এনজিও-র দ্বারা ক্ষমতায়িত গ্রামের নারীরা।

জামায়াতও এখন করছে একটা বাঁচামরার সংগ্রাম। তারা এটা অনুধাবন করতে পারে যে, জনগণের মনোভঙ্গি তাদের বিরুদ্ধে চলে যাচ্ছে। সেকারণে তারা রাষ্ট্রের সঙ্গে সংঘর্ষমূলক অবস্থানে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বাংলাদেশে বসবাসরত হিন্দু ও ভারতকে দোষারোপ করে, সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর উপর সহিংস হামলা চালিয়ে তারা মূল ইস্যুটা থেকে সবার দৃষ্টি ফেরাতে চাইছে।

সমাজের অভিজাত, মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত তথা আপামর জনসাধারণের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা শাহবাগ চত্বরের গণজাগরণ, বাংলাদেশকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে ইতিহাস নির্ধারণী মুহূর্তের সামনে। বিশ্ব এই মুহূর্তে ইতিহাসের একটা গতিপথ সংশোধন প্রক্রিয়ার স্বাক্ষী হয়ে থাকছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় তারা এটার গুরুত্বটা সঠিকভাবে অনুধাবন করতে পারছে না। ১৯৫২, ১৯৭১-এর মতো এই গণজাগরণই একটা সংকেতরুপে দেখা দেবে, যা নির্ধারণ করে দেবে বাংলাদেশের ভবিষ্যত্।

নাফিস আফরোজের এই লেখাটি ভারতের আউটলুক পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে লেখক বিবিসি ওয়ার্ল্ডের দড়্গিণ ও পশ্চিম এশিয়ার সাবেক নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন

বাংলাদেশ বসন্ত: ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল

২৬ তারিখে ওয়াল স্ট্রিট জার্নালে ছাপা হওয়া এই লেখাটিতে জনাব আহমেদ একটা বিষয় খুব চমৎকারভাবে সনাক্ত করেছেন যে, বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখন আর ধর্মের কার্ডটা অনায়াসে খেলা যায় না। খুব একটা ভালো কার্যকরীতা আশা করা যায় না। সেটা সত্যিই প্রমাণ হলো আজকের মতিঝিল মহাসমাবেশে। ধর্মীয় নেতারা, ওলামা-মাশায়েখেরাও যুদ্ধাপরাধী জামায়েতের নেতাদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছেন। এর চেয়ে আনন্দের খবর আর কী হতে পারে? জামায়াত যেভাবে নানা ধরণের ছল-চাতুরি, প্রতারণার মাধ্যমে পুরো আন্দোলনটিকে নাস্তিক বনাম ইসলাম হিসেবে উপস্থাপন করতে চেয়েছিল। দেশের মধ্যে এবং বর্হিবিশ্বে। সেই অপপ্রচেষ্টাটিতে তারা পুরোপুরিই ব্যর্থ হয়েছে। এখন পুরো দেশেই এই ধরণের সাংস্কৃতিক প্রচারণা চালাতে পারলে আমরা হয়তো সত্যিই একটা অসাম্প্রদায়িক চেতনার সমাজ গড়তে পারব।

জনৈক মৌলভী, ওলামা-মাশায়েখ ঐক্য পরিষদের নেতা স্পষ্টতই জানিয়ে দিলেন খুন, ধর্ষন, লুট ইসলাম সমর্থন করেনা। কাদের মোল্লার ৩৪৪ জন হত্যার সাথে সম্পৃক্ততা শরীয়া আইনেও মৃত্যুদন্ড প্রাপ্তির যোগ্য, তারাও সমস্বরে দাবি তোললেন যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির।
তারা শ্লোগান ধরলেনঃ
ওলামা-মাশায়েখ-জনতা
গড়ে তোল একতা…
এক দফা এক দাবি
ফাঁসি ফাঁসি…

ঢাকার আন্দোলনকারীরা উচ্চকণ্ঠে দাবি জানাচ্ছে অসাম্প্রদায়িক চেতনা ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার জন্য।

চলতি মাসে টানা ২২ দিন ধরে প্রতিবাদকারীরা কাঁপিয়ে দিয়েছেন পুরো বাংলাদেশকে। তরুণ ব্লগার-অ্যাক্টিভিস্টরা রাজধানী ঢাকার মূল জংশন শাহবাগ দখল করে এই প্রতিবাদের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তাঁরা যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করার  দাবি জানাচ্ছেন। এখানে প্রায়শই দেখা যাচ্ছে হাজার হাজার মানুষের ঢল। যেটা বিবেচিত হচ্ছে গত দুই দশকে দেশটিতে সাধারণ মানুষের সবচেয়ে বড় জমায়েত হিসেবে। কাছাকাছি সময়ে যেখানে অন্যান্য মুসলিম অধুষ্যিত গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে (তুরস্ক, মালয়েশিয়া, মিশর, তিউনিসিয়া) ইসলামি ভাবধারা প্রভাবের উত্থান দেখা যাচ্ছে, সেখানে বাংলাদেশের নাগরিকেরা উচ্চকিত হচ্ছেন অসাম্প্রদায়িক সমাজ গঠনের লক্ষ্যে।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় যারা যুদ্ধাপরাধ করেছিল বলে অভিযুক্ত, তাদেরকে কখনোই বিচারের আওতায় আনা যায়নি। এই ঘটনাটায় দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের মানুষ তীব্র মনোকষ্টে ভুগেছে। সেসময় পাকিস্তানি বাহিনী ৩০ লাখ মানুষ হত্যা করেছিল। ধর্ষণ করেছিল প্রায় ২ লাখ নারীকে। পাক হানাদার বাহিনীকে সহায়তা করেছিল বাংলাদেশেরই কিছু নাগরিক। যারা পরিচিত রাজাকার নামে। এদের অনেকেই দেশের সবচেয়ে বড় ইসলামি দল জামায়েত-ই-ইসলামির সদস্য।
এই রাজাকারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের পরেই ব্যবস্থা নেওয়া উচিৎ ছিল। কিন্তু ৭০ ও ৮০-এর দশকের স্বৈরতান্ত্রিক শাসন এদেরকে রাজনৈতিকভাবে পূর্নবাসিত করেছে। যার ফলে পরবর্তী সময়ে এই যুদ্ধাপরাধীদের অনেকে মন্ত্রী হয়ে গাড়িতে রাষ্ট্রীয় পতাকা লাগিয়ে ঘুরতে পেরেছে। এই ব্যাপারটাকে যুদ্ধের সময় এই রাজাকারদের বর্বরতার শিকার হওয়া মানুষেরা গণ্য করেছিলেন অপমান হিসেবে। এই ঘটনা ঘটেছিল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)-র শাসনামলে। যাদের সঙ্গে জামাতের খুব ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে।
বিএনপির প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লিগ, যারা ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশকে নেতৃত্ব দিয়েছিল, তারাও ৯০-এর দশকের শেষদিকে ক্ষমতায় এসে এই যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ইস্যুটি সামনে আনেনি। সেসময় সংসদে তাদের আসনসংখ্যা বেশি ছিল না। কিন্তু ২০০৯ সালে আবার ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লিগ গঠন করে আন্তর্জাতিক যুদ্ধ অপরাধ ট্রাইবুন্যাল। এর পেছনে একটি কারণ ছিল জনমতের চাপ, আরেকটি কারণ ছিল এইবার তারা সংসদে দুই তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার গঠন করতে পেরেছে।
গত ৫ ফেব্রুয়ারী এই ট্রাইবুন্যাল থেকে ঘোষিত একটি রায়ের পরেই শুরু হয় প্রতিবাদ আন্দোলন। এই আদালত প্রথম রায় দিয়েছিল গত জানুয়ারীতে। সেটা ছিল আব্দুল কালাম আজাদের (বাচ্চু রাজাকার) ফাঁসি। কিন্তু এইবার জামায়াতের নেতা আব্দুল কাদের মোল্লাকে দেওয়া হয় শুধু যাবজ্জীবন কারাগারের দ-। রায় ঘোষণার পর মোল্লা আদালত থেকে বের হয়ে বিজয়সূচক চিহ্ন প্রদর্শন করেন। এর পরপরই জনগণ ফুঁসে ওঠে। তাদের মতে, কাদের মোল্লাকে দেওয়া হয়েছে গুরু পাপে লঘু দণ্ড।
চলমান এই আন্দোলনের প্রতি ব্যপক জনসমর্থন আওয়ামী লিগ সরকারকে বাধ্য করে আইন সংশোধন করতে। এই মাসে পাস হওয়া এই সংশোধনীতে যুদ্ধাপরাধী সংগঠন হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর বিচার করার ধারাও অন্তর্ভূক্ত হয়। এইটাকে সফলতা ধরে নিয়ে, গত বৃহস্পতিবার সংগঠকেরা শাহবাগে জমায়েত হওয়াটা সাময়িকভাবে স্থগিত করার আহ্বান জানান। যদিও আন্দোলন অব্যাহত রাখার কথাও বলা হয়।
কিন্তু শুক্রবার, জামায়াত উন্মত্তভাবে সহিংসতা দেখানোর ফলে পাঁচজন নিহত ও বেশ কয়েকজন আহত হন। এর আগে গত ১৬ ফেব্রুয়ারী, একজন পরিচিত ব্লগার, রাজীব হায়দারকে তাঁর বাড়ির পাশে হত্যা করা হয়। খুন করার পদ্ধতিটা জামায়াতের ছাত্র সংগঠন শিবিরের সঙ্গে মিলে যায় বলে প্রতিবাদকারীরা এই খুনের দায় জামায়াতের উপরেই চাপান। এরপর গত শুক্রবার থেকে জামায়াতের উস্কানিতে সংঘটিত সংঘর্ষে সাতজন নিহত হয়েছে।
সহিংসতার হুমকি দিয়ে বহুদিন ধরেই ন্যায়বিচারের ক্ষেত্রে বাধা দিয়ে আসছে এই গোষ্ঠি। বাংলাদেশের নাগরিকেরা অবশ্য তারপরও এই সহিংসতার হুমকির কাছে নত হবেন না বলে দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। গত শুক্রবার জামায়াতের উন্মত্ততার কয়েক ঘন্টার মধ্যেই শাহবাগ আবার উত্তাল হয়ে ওঠে হাজারো মানুষের জমায়াতে।
সাধারণ মানুষদের দিক থেকে যুদ্ধাপরাধীদের শুধু সাজা নয়, ফাঁসি দেওয়ার দাবিটা ওঠার পেছনে বেশকিছু সমন্বিত কারণ আছে। অনেকেই আশঙ্কা করেন যে, কাদের মোল্লার মতো মানুষেরা মুক্ত হয়ে বেরিয়ে আসবে যদি আগামী নির্বাচনে বিএনপি ক্ষমতায় আসে। বাংলাদেশের মানুষ রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির জন্য ন্যায়বিচারকে বলি দেওয়ার ঘটনা আর দেখতে রাজি না। কাদের মোল্লা কারাগার থেকে বেরিয়ে যেরকম বিজয় চিহ্ন দেখানোর দুঃসাহস দেখিয়েছিলেন, সেরকম দৃশ্য মানুষ আর সহ্য করতে রাজি না।
শাহবাগ আন্দোলন বাংলাদেশকে চিহ্নিত করিয়েছে উদারনৈতিক জাতীয়তাবাদের চমৎকার দৃষ্টান্ত হিসেবে। এই চত্বরে, অনেক নারীকে নেতৃত্বের ভূমিকায় দেখা যাচ্ছে। তারা গভীর রাত পর্যন্ত পুরুষদের সঙ্গে স্বাধীনভাবে মেলামেশা করছেন, কোনরকম হয়রাণির ভয় ছাড়াই।
একইসময়ে জামায়াত, শাহবাগের এই আন্দোলনটিকে ইসলামবিরোধী আন্দোলন হিসেবে রুপ দেওয়ার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছে। তারা এতটাই নিচে নেমেছে যে, রাজীব হায়দারের নামে ভুয়া ব্লগ অ্যাকাউন্ট খুলে সেখানে ধর্মের নামে কুমন্তব্য প্রকাশ করতেও দ্বিধা করেনি। যদিও তারপরেও তারা মানুষের সমর্থন আদায়ে ব্যর্থ হয়েছে।
একসময় বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভালো একটা প্রভাবের আশা করে এই ধর্ম কার্ডটা খেলা যেত। কিন্তু এখন জাতীয় পরিচয়ের সঙ্গে ধর্মীয় বিশ্বাসের যে কোন প্রতিযোগিতা নেই, এটা বলার মানুষ বাংলাদেশে ক্রমশই বাড়ছে। জাতীয় ও ধর্মীয়, দুই ক্ষেত্রেই যে জামায়াতের ধ্বংসাত্মক প্রবণতাটাই যে বেশি দেখা যায়, সেটা উচ্চকণ্ঠে বলেছেন দেশের অন্যান্য ইসলামিক ইমামরাও। এটা একটা পরিস্কার সংকেত যে, বাংলাদেশ ইসলামিক চরমপন্থাকে প্রত্যাখান করেছে।
কিন্তু শুধু জামায়াতই না, মূলধারার বেশিরভাগ রাজনীতিবিদই এই গণমানুষের আন্দোলনের মুখে খানিকটা বেসামাল অবস্থায় প্রকাশিত হয়েছেন। বাংলাদেশের মানুষ এখন শুধু ঐতিহাসিক ন্যায়বিচারই না, নিজেদের জাতীয় মর্যাদা পুনরুদ্ধারের দাবিও জানাচ্ছে।
অসাম্প্রদায়িকতাকে সমাজের চিরন্তন চেতনা হিসেবে স্বাগত জানাচ্ছে তরুণ প্রজন্ম। আর তারা চাইছে তাদের নেতারাও যেন এটা করেন। সাধারণ একজন মানুষ শুধু অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেই না, মতাদর্শিক ইস্যুতেও যেভাবে আগ্রহ দেখাচ্ছে, এবং এত বড় আকারের একটা আন্দোলন সংগঠিত করার ক্ষমতা যে তাদের আছে, এই ব্যাপারগুলো হয়তো জনসম্পৃক্ততার একটা নতুন যুগের সূচনারই ইঙ্গিত দিচ্ছে। রাজনীতিবিদেরা নিজেদের বিপন্নতার মুহূর্তেও  ক্রমবর্ধমাণ এই মধ্যবিত্ত শ্রেণীর আওয়াজটা বরাবরই অগ্রাহ্য করে গেছে।