সুর কেন মানুষকে টানে

ফাহমিদা উর্ণি

তানসেনের কথা কে না জানি আমরা। গান গেয়ে তিনি নাকি বৃষ্টি নামাতেন। আর সুরের টানে পথে নামা কিংবা বৈরাগ্যসাধন; সেও আমাদের প্রাচ্যভূমির এক চেনাজানা ঐতিহ্য। সুরের মধ্য দিয়ে পরওয়ারদিগারের সঙ্গে নিজের সম্পর্কসূত্র আবিস্কারের চেষ্টা করেছেন ছেউড়িয়ার লালন ফকির। আমরা যারা সাধারণ তাদের ক্ষেত্রেও একই বাস্তবতা। আজন্ম-আমৃত্যু সুরের মূর্চ্ছনায় তাড়িত হয় মানুষ। সিক্ত হয়, আন্দোলিত হয়, বেদনার্ত হয়, আপ্লুত হয়। সঙ্গীত মানুষকে যেভাবে আকর্ষণ করে অন্য কোন স্বর-শব্দই তা পারে না। কিন্তু কেন? দীর্ঘদিন ধরে এর উত্তর খুঁজে যাচ্ছেন বিজ্ঞানীরা। নানা গবেষণার পর অবশেষে কিছু কারণ শনাক্ত করতে পেরেছেন তারা।

img_6829

মানুষের মস্তিষ্কে সঙ্গীতের প্রভাব কী; তা নিয়ে গবেষণা করছেন এমন একজন স্নায়ুবিজ্ঞানী ভ্যালোরি সালিমপুর। তাঁর মতে, সঙ্গীত মানুষের মস্তিষ্কের আবেগের এলাকার গভীরে উন্মাদনা তৈরি করে। তবে ভ্যালোরির দাবি; বিচ্ছিন্ন স্বর-শব্দের চেয়ে একত্রিত এবং গোছালো ধরনের স্বর-শব্দ অনেক বেশি কার্যকরী আর শক্তিশালী। ফাংশনাল এমআরআই প্রযুক্তি ব্যবহারের মধ্য দিয়ে ভ্যালোরি আর তার সহযোগীরা যেতে চাইলেন আরও গভীরে। খুঁজে পেলেন কিছু চমৎকৃত হবার মতো উত্তর।

সঙ্গীতের প্রতি মানুষের টান যৌনতার মতোই জৈবিক
ফাংশনাল এমআরআই মেশিনের মাধ্যমে একদল লোকের মস্তিষ্কের কর্মকাণ্ড রেকর্ড করেন ভ্যালোরি এবং তার সহকর্মীরা। যাদের মস্তিষ্কের কর্মকাণ্ড রেকর্ড করা হয় তারা সেসময় তাদের পছন্দের গান শুনছিলেন। দেখা যায়, গানের চূড়ান্ত আবেগঘন মুহূর্তগুলোতে শ্রোতার মস্তিষ্কের নিউক্লিয়াস একামেবনস্-এর মধ্যে আনন্দ উদ্রেককারী হরমোন ডোপামিন সচল হয়ে ওঠে। ভ্যালোরির মতে, ডোপামিনের এ ধরনের সচলতা খুবই বড় ব্যাপার। কারণ খাবার গ্রহণ কিংবা যৌনতার মত জৈবিকভাবে আনন্দ লাভের সময়গুলোতেই ডোপামিনের সচলতা বেড়ে যায়। এমনকি কোকেনের মত খুব আসক্তি তৈরিকারী মাদক গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গেও ডোপামিন সচল হয়।

মানুষের মস্তিষ্কে আরেকটি অংশ আছে যা চূড়ান্ত আবেগঘন মুহূর্তেও আগের সময়টুকুতে ডোপামিনকে বয়ে নিয়ে যায়। মূলত আনন্দ লাভের জন্য প্রতীক্ষাজনিত অনুভূতি তৈরির কাজ করে এ নিউক্লিয়াস। অর্থাৎ যে পরিচিত গানটি আমরা শুনছি তার কোন অংশ আমাদের মধ্যে আবেগ তৈরি করবে তা আমরা আগে থেকেই জানি এবং সে অংশের জন্য অপেক্ষা করি। আর এ প্রতীক্ষা এবং আনন্দলাভ এ দুটির দারুণ সম্মিলনই বলে দেয়, মানুষ জৈবিকভাবেই নিজের পছন্দের গান শুনতে চায়।

সুরের আবেদন সার্বজনীন, ব্যাকরণ বিশ্বজনীন

পরবর্তী ধাপে শ্রোতাদের অপরিচিত গান শুনতে দেন ভ্যালোরি আর তার সহযোগীরা। আর এর মধ্যে যে গানটি ভালো লাগবে সে গানটি কেনার জন্য শ্রোতাদের টাকাও দেয়া হয়। তবে এক্ষেত্রে গান শোনার সময় শ্রোতাদের নিউক্লিয়াস একামবেনস আর কর্টিক্যাল স্ট্রাকচারের মধ্যে মিথষ্ক্রিয়া বেড়ে যায়। মূলত কোন কিছু শনাক্তকরণ, নির্দিষ্ট সুরটি মনে রাখা এবং আবেগগত প্রক্রিয়ার কাজে নিয়োজিত থাকে কর্টিক্যাল স্ট্রাকচার। আর এর মধ্য দিয়ে বোঝা যায়, মানুষ যখন অপরিচিত গান শোনে তখন মেমোরি সার্কিটের মাধ্যমে মস্তিষ্ক ওই সুরকে শনাক্ত করার চেষ্টা করে। গানটি কোন দিকে এগিয়ে যাচ্ছে তাও অনুমান করতে চায় মস্তিষ্ক। গানটি একেবারেই ভীনদেশের কিংবা অবোধগম্য হলেও, ওই সুরের মধ্যে পরিচিত কোন উপকরণ অর্থাৎ পরিচিত কোন বিট বা মেলোডি থাকলে মানুষ সেই গান বা সুরের আবেশি মুহূর্ত সহজেই শনাক্ত করতে পারে এবং তা উপভোগও করে থাকে।

মানুষ কেন একই গান বার বার শোনে?

বিজ্ঞানীদের মতে সুরের পছন্দের অংশটির ব্যাপারে মানুষের মধ্যে যে আবেগজনিত তাড়না তৈরি হয় তা অনেক বছর পর্যন্ত থেকে যায়। আর তাই একই গান বার বার উন্মাদনা তৈরি করতে পারে মানুষের মস্তিষ্কে। অনেক বছর পরও সঙ্গীতস্মৃতি শুধুই আবেগ অনুভূত হওয়ার ব্যাপার।

সঙ্গীত কিভাবে স্নায়ুকে সুসংগত করে?

কানেকটিকাট ইউনিভার্সিটির সঙ্গীতবিষয়ক মনস্তাত্ত্বিক এড লার্জ এর মতে, ছন্দের ঊর্ধ্বগামীতা কিংবা নিম্নগামীতা কিংবা শান্ত অথবা জোরালো শব্দভেদে মানুষের মস্তিষ্কে আলাদা আলাদা অনুভূতি তৈরি হয়। লার্জ বলেন, মেলোডি একই থাকার পরও গান যখন তার বৈচিত্র্য হারিয়ে ফেলে তখন ওই গানের প্রতি আবেগ হারিয়ে ফেলেন শ্রোতা। তাঁর মতে, এক্ষেত্রে কাজ করে মিরর নিউরন। মানুষ বাইরে যা দেখে তা নিজের ভেতরে উপলব্ধি করতে সহায়তা করে ওই নিউরন।

একই গানে সবার আনন্দ একই রকমের হয় না কেন?

একই গান সবার মধ্যে একই প্রতিক্রিয়া তৈরী করে না কেন; সে প্রশ্নেরও উত্তর দিয়েছেন লার্জ। তিনি জানান, যে গানটি শোনা হচ্ছে তাতে শ্রোতার মস্তিষ্কে নিউরনগুলো কতটা যুক্ত, সেই শ্রোতার গান শোনা ও পরিবেশনের ব্যক্তিগত ইতিহাস কী; তার উপরই ওই গান নিয়ে শ্রোতার প্রতিক্রিয়া তৈরী হয়। তাই ব্যক্তিভেদে প্রতিক্রিয়ার পার্থক্য হয়। লার্জের মতে, ছন্দ হলো অনুমানের ব্যাপার। একেবারে শৈশব থেকেই মানুষ নিজস্ব সাংস্কৃতিক পরিবেশে ছন্দের দ্বারা তাড়িত হয়। আর গান শোনার সঙ্গে সঙ্গে মানুষ অতীতের যে স্মৃতি ও আবেগ দ্বারা তাড়িত হয় তা একেক মানুষের ক্ষেত্রে একেক রকমের হতে পারে বলেও দাবি করেন তিনি। পছন্দের বিষয়টি একেবারেই মানসিক উল্লেখ করে লার্জ বলেন, অনেকসময় সামাজিক প্রেক্ষাপটও এক্ষেত্রে প্রভাব ফেলতে পারে। সূত্র: ডেইলি গুডস

প্রাসঙ্গিক: কেন কিছু গান মনে গেঁথে যায়

গাছ লাগিয়ে মেয়েশিশুর আবাহন

piplantriধর্ষণ আর নারী নির্যাতনের কারণেই সাম্প্রতিক সময়ে আলোচনার কেন্দ্রে এসেছে ভারত। বিবিসি নির্মিত একটি প্রামাণ্যচিত্র নিয়েও হৈচৈ কম হয়নি বিশ্বজুড়ে। কিন্তু সেই ভারতেরই একটি গ্রামে দেখা যায় সম্পূর্ণ ভিন্ন চিত্র। রাজস্থানের পিপলান্ত্রি নামের একটি গ্রামে প্রতিটি মেয়েশিশুর জন্ম উপলক্ষে রোপণ করা হয় ১১১টি গাছ। গ্রামের সবাই মেয়েশিশুর সুন্দর ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করার জন্য জমা রাখেন নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ।

১১১টি গাছ লাগিয়ে মেয়েশিশুর জন্ম উদযাপনের পাশাপাশি গ্রামের সবাই মিলে জমা করেন ২১ হাজার রুপি। শিশুর পরিবারের পক্ষ থেকে জমা করা হয় ১০ হাজার রুপি। এই অর্থ ব্যাংকে জমা রাখা হয়। ২০ বছরে পা দিলে সেই অর্থের দাবিদার হয় মেয়েটি। এ ছাড়া শিক্ষাজীবন নিশ্চিত করা ও প্রাপ্তবয়স্ক না হওয়া পর্যন্ত তার বিয়ে না দেওয়ার বিষয়েও একটি চুক্তি সই করেন মেয়ের বাবা-মা।

নিজের ছোট্ট মেয়েকে হারানোর কষ্ট ভুলতে ২০০৭ সালে এই অভিনব উদ্যোগটি নিয়েছিলেন সেই গ্রামেরই বাসিন্দা শ্যামসুন্দর পালিওয়াল। তারপর গত ছয় বছরে পিপলান্ত্রি গ্রামে লাগানো হয়েছে প্রায় আড়াই হাজার গাছ। প্রতিটা মেয়েকন্যার জন্য ১১১টি ও প্রতিজন মৃত ব্যক্তির জন্য ১১টি। গ্রামের সব সদস্য মিলেই দেখভাল করেন এই অভিনব সামাজিক বনায়ন প্রকল্পের। সাধারণত ঔষুধি গাছ লাগিয়ে থাকেন গ্রামের অধিবাসীরা। সেখান থেকে অর্থনৈতিকভাবেও লাভবান হচ্ছেন তাঁরা।

অভিনব এই উদ্যোগের ফলে গ্রামটি হয়ে উঠেছে সবুজ। পাল্টেছে নারীসংক্রান্ত দৃষ্টিভঙ্গি। আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে, সেই গ্রামে অপরাধপ্রবণতা কমে গেছে ব্যাপক হারে। গত সাত বা আট বছরে সেই গ্রামের কাউকে পুলিশের কাছে গিয়ে মামলা করতে হয়নি।

piplantri2

পিপলান্ত্রির অনুকরণে অনেক গ্রামই এখন মেয়েশিশুর জন্ম উদযাপন করছে গাছ লাগিয়ে। বুডানিয়া গ্রামে প্রতিটি মেয়েশিশুর জন্মের সময় লাগানো হয় ১০০টি গাছ। লুহাভাদ গ্রামও উদ্যোগটি নিয়েছে অনেক ছোট পরিসরে। সেখানে লাগানো হয় একটি গাছ।

কাজাকিস্তানের ঘুমন্ত মায়াপুরী!

Teaser sleeping

এ যেন ঠিক সেই রুপকথার মায়াপুরী। অদ্ভুত কোনো এক জাদুর মায়ায় দিনের পর দিন ঘুমিয়ে থাকছেন সেই মায়াপুরীর বাসিন্দারা। রুপকথার গল্প সত্যি হয়ে ফুটে উঠেছে কাজাকিস্তানের ছোট্ট শহর কালাচিতে। সোভিয়েত ইউনিয়ন আমালের একটি ইউরেনিয়াম খনির পাশে অবস্থিত এই শহরে কোনো এক রহস্যময় নিদ্রা অসুখে আক্রান্ত হয়ে দুই থেকে ছয় দিন পর্যন্ত ঘুমিয়ে থাকছেন সেখানকার অধিবাসীরা। জেগে ওঠার পর ভুগছেন স্মৃতিবিভ্রমে।

২০১০ সালে প্রথম দেখা যায় এই অদ্ভুত ব্যাপারটি। আর ২০১৩ সালের মার্চ মাস থেকে সেটা ক্রমেই বাড়ছে। ঘুমিয়ে যাওয়া ছাড়াও রহস্যময় এই রোগের অন্য উপসর্গগুলো হচ্ছে ঝিমঝিম ভাব, দাঁড়িয়ে থাকতে না পারা ও চরম শারিরীক অবসাদ। রাশিয়ান টাইমসের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, একদিন এক স্কুলে হঠাৎ করেই আটজন শিশু ঘুমিয়ে পড়ে। কয়েক মাস পরে দেখা যায় একই দিনে ৬০ জন হঠাৎ করে নিদ্রার কোলে ঢলে পড়ে।

ম্যাশেবলের একটি প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে যে, এই রহস্যের কিনারা করার জন্য কিছু বিজ্ঞানী ও ডাক্তার উড়ে যান কালাচিতে। কিন্তু পরিবেশ থেকে শুরু করে রোগীর তথ্য উপাত্ত পরীক্ষা করেও কোনো উপসংহারে পৌঁছাতে পারেননি তারা। ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাল পরীক্ষার ফল নেতিবাচক। আফ্রিকান ট্রাইপানোসোমিয়াসিস নামের একটি অসুখে এধরণের উপসর্গ দেখা যায়। কিন্তু সেটা যে কারণে হয়ে থাকে তার কোনো উপাদান পাওয়া যায়নি কালাচির মানুষদের মধ্যে।

ইউরেনিয়াম খনির তেজস্ক্রিয়তার প্রভাবে এমনটা হওয়ার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দিচ্ছেন না বিজ্ঞানিরা। কিন্তু সেটারও কোনো পাকাপোক্ত তথ্যপ্রমাণ হাজির করতে পারছেন না তাঁরা। কাজাকিস্তানের জাতীয় নিউক্লিয়ার সেন্টারের রেডিয়শন সেফটি এন্ড ইকোলজি ইন্সটিটিউটের পরিচালক সার্গেই লুকাশেঙ্কো বলেছেন যে তিনি মনে করেন ব্যাপারটি বর্ণহীন, তেজস্ক্রিয় গ্যাস রোডনের কারণে হচ্ছে না। সার্বিয়ান টাইমসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ‘এটা কার্বন মনোক্সাইডের কারণে হতে পারে। এই অঞ্চলের অদ্ভুত অবস্থান ও আবহাওয়া পরিস্থিতির কারণে আমাদের কেউ কেউ এমন সন্দেহ করছে। এখানে চিমনির ধোঁয়া ওপরে উঠে যাওযার বদলে নিচে ও চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে। কার্বন মনোক্সাইডের কারণে প্রায়ই মাথাব্যাথা, বমি ও অবসন্ন ভাব আসতে পারে। কিন্তু এই উদ্ভট ঘুমিয়ে পড়ার ব্যাপারটা সেটা দিয়েও ব্যাখ্যা করা যায় না।’

Uranium_mine

অদ্ভুত এই রোগের কারণে কালাচি শহরের অনেকেই পাড়ি জমিয়েছেন অন্য কোথাও। যারা আছেন তাঁরাও এখন অন্য কোথাও চলে যাওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছেন। তেমনই একজন ওলগা সামুসেঙ্কো জানালেন নিজের ভয়াল অভিজ্ঞতার কথা, ‘সেপ্টেম্বরের এক তারিখে আমরা ছেলেমেয়েদের স্কুল প্যারেডে গিয়েছিলাম। আমার বাচ্চাটা ছোট। ফলে আমরা শুধু দেখতেই গিয়েছিলাম। তারপর (দুই বছর বয়সী) স্টানিস্লাভ বাড়ির উঠোনে কিছুক্ষণ খেলে ৪টা নাগাদ বাড়িতে ফিরেছে। ফিরেই সে ঝুপ করে মাটিতে পড়ে যায়। সে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিল না। বসতেও পারছিল না। আমি তাকে দাঁড়া করানোর চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু সে বারবার পড়ে যায়। তার দৃষ্টি ছিল অন্য কোথাও। মনে হচ্ছিল যেন মাতাল হয়ে আছে। খুবই ভয় পেয়েছিলাম। আমাদের এখন এখান থেকে চলে যেতে হবে। এখানে কোনো ভবিষ্যৎ নেই। সবাই চলে যাচ্ছে। অনেকেই তাদের ছেলেমেয়েকে দূরে অন্য কোনো শহর বা গ্রামে রেখে এসেছে আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে। কেউ কিছু ব্যাখ্যাও করতে পারছে না। আমরা কেউই জানি না কী ঘটছে।’

Sleeping Disorder

এল ক্লাসিকো কি শুধুই ফুটবলীয় লড়াই?

ফুটবল বিশ্বে ‘ডার্বি’ বলতে বোঝানো হয় ‘একই শহর বা এলাকার দুইটা দলের দ্বৈরথ’। যেমন একই শহর ম্যানচেস্টারের দুই ক্লাব ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ও সিটির লড়াই। বা ইতালির মিলান শহরের এসি মিলান ও ইন্টার মিলানের লড়াই। সেই অর্থে রিয়াল মাদ্রিদ-বার্সেলোনার ধ্রুপদী লড়াইকে কেন ডার্বি বলা হবে; তা ভেবে অবাক হতে হয়। দুইটা দল এক শহরের না, এক এলাকার না; এমনকি তাদের ‘জাতীয়তা’ও আলাদা।

স্বাধীনতার দাবিতে যুগ যুগ ধরে তোলপাড় হয়ে আসছে কাতালোনিয়া। ফ্রান্স ও ভূমধ্যসাগরীয় সীমান্তবর্তী কাতালোনিয়ার রাজধানী বার্সেলোনা। অন্যদিকে কেন্দ্রীভূত স্প্যানিশ রাষ্ট্রের মধ্যমনি মাদ্রিদ। স্পেনের ম্যাপের একেবারে মাঝামাঝি মাদ্রিদের অবস্থান। কিন্তু ভৌগলিকভাবে অনেক দুরত্ব থাকার পরও রিয়াল মাদ্রিদ-বার্সেলোনার দ্বৈরথ কেন এমন ধ্রুপদী লড়াই হয়ে উঠল, তা জানার জন্য আমাদের নজর দিতে হবে দেশটির রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক ইতিহাসের দিকে।

স্প্যানিশ ফুটবলের সঙ্গে দেশটির রাজনীতি খুব ওতোপ্রতোভাবে জড়িত। ইউরোপের অন্য যে কোনো দেশের চেয়ে স্পেনেই সম্ভবত দুইয়ের মিশেলটা সবচেয়ে বেশি ঘটেছে। ‘এল ক্লাসিকো’ বা রিয়াল-বার্সার ধ্রুপদী লড়াইয়ের সঙ্গে রাজনীতি-সংস্কৃতি, নিপীড়ণ আর প্রতিরোধগাথা এত অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে আছে, যেটা আর অন্য কোনো ফুটবল ম্যাচে দেখা যায় না।

বার্সেলোনা ফুটবল ক্লাব সবসময় ছিল কাতালোনিয়া জাতীয়তাবাদের প্রতীক। ১৯৩৬ থেকে ১৯৩৯ সাল পর্যন্ত, তিন বছরের রক্তাক্ত গৃহযুদ্ধের পর স্বৈরশাসক ফ্রান্সিসকো ফ্রাঙ্কো যখন ক্ষমতা দখল করলেন তখন বার্সেলোনার ওপর নেমে আসে নির্মম অত্যাচার। এর একটা অন্যতম প্রধান কারণ: ১৯৩৬ সালে ফ্রাঙ্কোর সেনাবাহিনীর ক্যু’র বিরুদ্ধে প্রথম আওয়াজ এসেছিল বার্সেলোনা থেকে। সেবছর বার্সার সভাপতি জোসেফ সুনিয়োলকে গ্রেপ্তার করে হত্যা করে ফ্রাঙ্কোর সেনাবাহিনী। ১৯৩৬ সালের পর ফ্রাঙ্কোর শাসনামলে নিষিদ্ধ করা হয় কাতালান ভাষা। পুড়িয়ে দেওয়া হয় কাতালান ভাষায় লেখা বহু বই। সামরিক শাসনামলে এসবের প্রতিবাদ জানানোর মঞ্চ হিসেবে কাতালোনিয়ার মানুষ বেছে নিয়েছিল ফুটবল মাঠকে। বার্সেলোনার মাঠ ন্যু ক্যাম্প পরিণত হয়েছিল নিপীড়ত মানুষের মুখ খোলবার জায়গা। এখানেই কোনো দ্বিধা-ভয় ছাড়াই তারা স্বাধীনভাবে কথা বলতে পারত মাতৃভাষায়। এভাবেই সাধারণ মানুষের কণ্ঠস্বর হয়ে উঠেছিল একটা ফুটবল মাঠ ও ক্লাব। বার্সেলোনা এখনও সেই উত্তরাধিকার বহন করে। এখনও তাদের শ্লোগান: ‘ক্লাবের চেয়েও বেশি কিছু’।

Catalonia vs Argentina

অন্যদিকে ফ্রাঙ্কোর মদমপুষ্ট হয়ে রিয়াল মাদ্রিদ পরিণত হয় শাসকদের আভিজাত্যের প্রতীককে। উঁচু পদ পাওয়ার আশায় জেনারেল ফ্রাঙ্কোর দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য রিয়ালের স্যান্টিয়াগো বার্নাব্যু স্টেডিয়ামে হাজির হতেন স্পেনের অভিজাতরা। সেনা কর্মকর্তা-ব্যবসায়ীরা। ফ্রাঙ্কোও রিয়াল মাদ্রিদের সাফল্যকে ব্যবহার করতেন নিজের ক্ষমতার যৌক্তিকতা টিকিয়ে রাখার জন্য। এর জন্য নিজের নিরঙ্কুশ ক্ষমতাকে নগ্নভাবে ব্যবহার করতেও পিছপা হতেন না স্পেনের কুখ্যাত স্বৈরশাসক। বার্সেলোনার খেলোয়াড়-কর্মকর্তাদের ভয়ভীতি দেখানো, রেফারিদের কিনে নেওয়া ইত্যাদি নানা উপায়ে বার্সার ওপর আধিপত্য বজায় রেখেছে মাদ্রিদ। ১৯৭৫ সালের ২০ নভেম্বর ফ্রাঙ্কোর মৃত্যুসংবাদ শুনে কুখ্যাত এই স্বৈরশাসকের মূর্তি নিয়ে আনন্দে লোফালুফি করেছিলেন বার্সেলোনার সেক্রেটারি জাউম রোসেল ও পরিচালক হুয়ান গ্রানাডোস। একটা নিপীড়ণ-নির্যাতনমূলক যুগের অবসান হওয়ায় তাঁরা যে কী পরিমাণ খুশি হয়েছিলেন তা স্পষ্টই বোঝা যায়।

ফুটবলে রিয়াল-বার্সার লড়াই যে মহা গুরুত্বপূর্ণ তা নতুন করে বলার কিছু নেই। একই সঙ্গে রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিকভাবেও নিরন্তর লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে ইউরোপের অন্যতম সেরা দুই ক্লাব। খুব সাম্প্রতিক সময়েও, ২০১৩ সালে স্বাধীন কাতালোনিয়ার দাবিতে ৪০০ কিলোমিটার দীর্ঘ জায়গা জুড়ে মানববন্ধন করেছেন সেখানকার অধিবাসীরা। হাতে-হাত রেখে এই প্রতিবাদের ঢেউ বয়ে গেছে বার্সেলোনার ন্যু ক্যাম্প স্টেডিয়ামের ভেতর দিয়েও। তার আগের বছর স্বাধীন কাতালোনিয়া ও তার ভাষা-সংস্কৃতি সংরক্ষণের দাবি জানিয়ে আনুষ্ঠানিক বিবৃতিও দিয়েছে বার্সেলোনা ফুটবল ক্লাব।

CATALONIA Human chain

তাই ‘ডার্বি’র প্রথাগত সংজ্ঞার সঙ্গে ঠিকঠাক না মিললেও রিয়াল মাদ্রিদ-বার্সেলোনা লড়াই পরিণত হয়েছে ইউরোপের অন্যতম প্রধান দ্বৈরথে। এর সঙ্গে মেসি-রোনালদো, বেল-নেইমারের ফুটবলীয় লড়াইয়ের উন্মাদনা যেমন আছে। ঠিক তেমনি আছে রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক লড়াইয়ের উত্তাপ-উত্তেজনা।

যখন বার্সার ওপর ছিল মাদ্রিদের রাজত্ব

স্প্যানিশ লিগে বরাবরই দেখা যায় বার্সেলোনা আর রিয়াল মাদ্রিদের আধিপত্য। ১৯৯৭-৯৮ সাল থেকে বর্তমান ফরম্যাটের প্রতিযোগিতা শুরু হওয়ার পর ১৭টি মৌসুমের মধ্যে ১৩বারই শিরোপা নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নিয়েছে স্পেনের শীর্ষ এই দুই ক্লাব। এর মধ্যে আটবারই জিতেছে বার্সা। রিয়াল জিতেছে পাঁচবার।

সাম্প্রতিক সময়ে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী রিয়ালের চেয়ে বার্সেলোনা কিছুটা এগিয়ে থাকলেও একটা সময় বার্সেলোনার ওপর আক্ষরিক অর্থেই রাজত্ব করত মাদ্রিদ। ফুটবল মাঠে শিরোপা জয়ের লড়াইয়ে তো বটেই, এমনকি রাজনৈতিকভাবেও।

১৯৩৬ থেকে ১৯৩৯ সাল পর্যন্ত রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধের পর ক্ষমতা দখল করেন স্বৈরশাসক ফ্রান্সিসকো ফ্রাঙ্কো। এবং সাধারণ মানুষের কাছে নিজেকে গ্রহণযোগ্য করে তোলার জন্য খুব দ্রুতই তিনি ফুটবল মাঠে রিয়াল মাদ্রিদের সাফল্যকে কাজে লাগাতে শুরু করেন। কিন্তু সেসময় তাদের শক্তিশালী প্রতিপক্ষ ছিল কাতালোনিয়া ও বাস্ক জাতিগোষ্ঠীর স্বকীয়তার প্রতীক দুই ফুটবল ক্লাব বার্সেলোনা ও অ্যাথলেটিক বিলবাও।

franco real madrid

১৯৩৬ সালে স্প্যানিশ রিপাবলিকের বিরুদ্ধে সামরিক অভুত্থান শুরু করেন ফ্রাঙ্কো। সেসময় এই ক্যু’র বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিরোধটা এসেছিল বার্সেলোনা থেকে। ফলে কাতালান জাতিগোষ্ঠীর মানুষদের প্রতি বিশেষভাবেই ক্ষুব্ধ ছিলেন ফ্রাঙ্কো। ফুটবল মাঠে বার্সেলোনা, রিয়াল মাদ্রিদের ওপর আধিপত্য করবে এটা মানতে পারেননি এই স্বৈরশাসক। রিয়ালের সাফল্য নিশ্চিত করার জন্য নিজের ক্ষমতার চরম অপব্যবহার করতেও বিন্দুমাত্র কুণ্ঠাবোধ করেননি ফ্রাঙ্কো।

আদিতে বার্সেলোনা ফুটবল ক্লাবের নাম ছিল কাতালান এফসি বার্সেলোনা। কিন্তু কাতালোনিয়ার স্বকীয়তা-স্বাধীনতার দাবি যেন মাথাচাড়া না দেয়, সেজন্য তিনি ক্লাবের নাম পরিবর্তন করতে বাধ্য করেন। তাদের নতুন নাম হয় বার্সেলোনা সিএফ।

রিয়াল মাদ্রিদের সাফল্য নিশ্চিত করার জন্য ফ্রাঙ্কো নিজের ক্ষমতার অপব্যবহার কিভাবে করেছেন, তার সবচেয়ে ভালো উদাহরণ ১৯৪৩ সালে কিংস কাপের (এখনকার কোপা ডেল রে) সেমিফাইনাল। প্রথম লেগে ৩-০ গোলের জয় দিয়ে ফাইনালের পথে অনেকখানি এগিয়ে গিয়েছিল বার্সা। কিন্তু দ্বিতীয় লেগের খেলায় অংশ নিতে বার্সার ফুটবলাররা যখন মাদ্রিদে গেলেন, তখন আকস্মিকভাবে তাদের সাজঘরে হাজির হয়েছিলেন স্পেনের স্টেট সিকিউরিটির ডিরেক্টর। বার্সার খেলোয়াড়দের যে ভয়ভীতি দেখানো হয়েছিল, তা স্পষ্টই বোঝা যায় সেই ম্যাচের ফলাফল দেখলে। রিয়ালের মাঠে ১১-১ গোলের বিশাল ব্যবধানে হেরেছিল বার্সেলোনা।

1943 barcelona defeat1943 barcelona defeat2

রিয়াল মাদ্রিদের কিংবদন্তি ফুটবলার আলফ্রেড ডি স্টেফানোকে দলে ভেড়ানো নিয়েও বেধেছিল বিপত্তি। ১৯৫৩ সালে আর্জেন্টাইন এই ফুটবলারকে প্রথমে দলে ভিড়িয়েছিল বার্সেলোনা। কিন্তু সেসময় ফ্রাঙ্কো একটা ডিক্রি জারি করেন যে বিদেশী কোনো খেলোয়াড় কেনা যাবে না। শেষপর্যন্ত দুই পক্ষের মধ্যে আলাপ-আলোচনা সমঝোতার ভিত্তিতে এমন ঐক্যমত্যে পৌঁছানো হয় যে, ডি স্টেফানো এক মৌসুম-এক মৌসুম করে খেলবেন দুই দলের হয়েই। এই ঘটনার কিছুদিন পরই বার্সেলোনার সভাপতির পদ থেকে সরে দাঁড়ান এনরিক মার্টি কোয়েত্তো। কিছুদিন পরে ডি স্টেফানোকে এককভাবেই দখল করে নেয় রিয়াল মাদ্রিদ।

di stefano

আর্জেন্টাইন এই জাদুকরের দুর্দান্ত নৈপুন্যে ১৯৫৩ থেকে ১৯৬৫ পর্যন্ত, ১৪ মৌসুমের মধ্যে নয়বারই শিরোপা ওঠে রিয়ালের ঘরে। ১৯৩৩ সালের পর ১৯৫৩-৫৪ মৌসুমেই প্রথমবারের মতো লা লিগা শিরোপা ওঠে রিয়ালের ট্রফি কেসে। ১৯৫৬-৫৭ মৌসুমে প্রথমবারের মতো ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়ন হয় রিয়াল। সেসময় মাদ্রিদ সত্যিই রাজত্ব করত বার্সেলোনার ওপর।

‘সে-ও কি কোথাও বসে ছবি আঁকে?’

কয়েকদিন আগে সংসদ ভবনের সামনে বসে অনেক রাজা-উজির মারছিলাম আমি আর বন্ধু সুমন। বিশ্বাস-অবিশ্বাসের তর্কে ঢেউ তুলছিলাম মানিক মিয়া অ্যাভেনিউয়ের প্রশস্ত সড়কটাতে। গল্পে-কথায় উল্টিয়ে পাল্টিয়ে দিচ্ছিলাম দেশের সমাজ-রাজনীতি। হঠাৎ করে দেখলাম এক কেতাদুরস্ত মধ্যবয়সী দম্পতি তাদের দুই সন্তান নিয়ে সিএনজি বা ট্যাক্সি ধরার নিমিত্তে সামনে এসে দাঁড়ালেন।

সুমন তার পরিস্কার প্যান্টটা বাঁচানোর জন্য পশ্চাৎদেশের নিচে একপাটি স্যান্ডেল নিয়েছে। (কেতাদুরস্ত হওয়ার জন্য না, কাপড় কাচার ভয়ে) আরেক পা খোলা… রাস্তায়। আমার দুই পায়েরই স্যান্ডেল খোলা। দুই বন্ধু খালি পায়ে সড়ক দাপিয়ে বসে আছি।
কিছুক্ষণ পর দেখা গেল, আমাদের সামনে দাঁড়ানো সেই চার প্রানী ধীক্কার-তিরস্কার আর সন্ধিৎসু জিজ্ঞাসা নিয়ে আমাদের দিকে একটু পর পর তাকাচ্ছে। তারা কদাকিঞ্চিৎ এমন করেন কিনা, সন্দেহ আছে। বাচ্চাগুলো হয়তো ভাবতেও পারে না যে এভাবে খালি পায়ে রাস্তায় বসেও থাকা যায়।

একই সময় আমাদের ঠিক বামপাশেই চায়ের দোকানের কোনা থেকে বোতল-কাগজ টোকাচ্ছে ঐ দম্পত্তির বড় কন্যার বয়সী একটি ছেলে। এই ছেলের কথা হয়তো ঐ মেয়েটা জানে না। তারা ‘বসে আঁকে’। ‘আল্পনা-লতাপাতা’ আঁকে। কদাকিঞ্চিত ‘মহেন্দ্র দত্তর ছাতা’ও আঁকে। কিন্তু যে ছেলেটা ‘কাগজ কুড়িয়ে, বস্তায় ভরে’ একা চলে যায় তার খবর মেয়েটির কাছে পৌঁছায় না।

আমাদের সমাজ-রাষ্ট্র মেয়েটিকেও যেমন বঞ্চিত করেছে খালি সড়কে-সবুজ ঘাসে নগ্ন পায়ে হাঁটার আনন্দ থেকে; ঠিক তেমনি নায্য অধিকার দেয়নি একা চলে যাওয়া ছেলেটাকেও।

এই ছেলেটাকেই হয়তো একদিন কোনো বড় রাস্তার মোড়ে লাল রঙের একটা নির্দোষ ফাঁকা কৌটো কুড়াতে দেখে বেদম মার দেবে ‘আইনশৃঙ্খলা বাহিনী’। সেই দাগ শরীরে নিয়ে নিজের পেট বাঁচানো আর সস্তা কিছু নেশার তাড়নায় ‘কদাকার’ মুখওয়ালা ছেলেটি হয়তো হাতে তুলে নেবে হাত বা পেট্রোলবোমা। কোনো একদিন যদি সেটা ঐ মেয়েটির দিকেই ধেয়ে যায়? মৃত্যু পরোয়ানা নিয়ে?

কয়েক হাতের দুরত্বে থাকা দুইটি ফুটফুটে শিশু এভাবে একে-অপরের ঘাতক হয়ে অবস্থান করছে প্রতিনিয়ত।
মেয়েটিও হয়তো ভেবেছে কখনো কখনো: ‘সে-ও কি কোথাও বসে ছবি আঁকে???’ কিন্তু সেটা শোনানোর ফুরসত হয়নি… তার আগেই তারা একে-অপরের ঘাতক বনে গেছে…

ক্রিকবোমিও পরিস্থিতি: কোন দিকে যাবে ক্রিকেট?

ক্রিকেট নিয়ে বাংলাদেশের মানুষের উত্তেজনার অন্ত নেই… এ তো জানা কথা। কিন্তু ব্যাট-বলের এই খেলাটা যে অনেক ক্ষমতাও ধরে, সেটা অদ্যই জানা গেল।
এসএসসি পরীক্ষা, ইজতেমা… সাধারণ মানুষের নাজেহাল দশা; কোনো কিছুই টলাতে পারেনি আমাদের আপোষহীন নেত্রীকে। হরতাল-অবরোধ অব্যাহত ছিল। কিন্তু হাজার হাজার মাইল দূরে মাশরাফি-সাকিবরা একটা ম্যাচ জিতে সত্যিই স্বস্তি দিয়েছেন বাংলাদেশের মানুষকে। এক দিনের জন্য হলেও হরতাল শিথিল করার ডাক এসেছে আন্দোলনরত ২০ দলের পক্ষ থেকে। ১৪ দলের সরকারি পক্ষ থেকেও এসেছে অনেক অনেক শুভেচ্ছাবার্তা, আর্থিক পুরস্কারের ঘোষণা।

team celebration

তার মানে দেশের মানুষের শিক্ষাদীক্ষা, প্রথাগত ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালন, মানুষের রোজকার বাঁচা-মরার থেকেও গুরুত্বপূর্ণ বাংলাদেশের ক্রিকেট। এ কিন্তু অনেক বড় ব্যাপার একটা দেশের ক্রীড়াঙ্গনের জন্য। প্রশ্ন হচ্ছে: আমাদের ক্রিকেটারদের কাছে এটার গুরুত্ব কতটুকু? ক্রিকেটারদের সঙ্গে সমাজ-রাষ্ট্রের সম্পর্কই বা কী? আদৌ আছে কিনা…

ইতিহাস বলে সম্পর্ক আছে। ১৯৮০ সালের দিকে স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে কথা বলার মাধ্যম হিসেবে ফুটবল মাঠকেই বেছে নিয়েছিলেন ব্রাজিলের কিংবদন্তি ফুটবলার সক্রেটিস। করিন্থিয়ান ক্লাবের মাধ্যমে সংগঠিত করেছিলেন স্বৈরতন্ত্রবিরোধী পাঠাতন। মানুষকে ভাবাতে শুরু করিয়েছিলেন যে তাদেরও বলার অনেক কিছু আছে। স্পেনে জেনারেল ফ্রাঙ্কোর একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে জোর আওয়াজ উঠত বার্সেলোনার ন্যু ক্যাম্প বা অ্যাথলেটিক বিলবাওয়ের সান মেমে স্টেডিয়ামে। নিজেদের স্বকীয়তা-স্বাধীনতার কথা জানান দেওয়ার জন্য ফুটবল ম্যাচগুলোই ছিল কাতালান-বাস্ক জাতিগোষ্ঠীর প্রধান মাধ্যম। খুব সাম্প্রতিককালেও আইভরি কোস্টের স্ট্রাইকার দিদিয়ের দ্রগবা অনেক লড়েছেন যুদ্ধবিধ্বস্ত একটা দেশে শান্তি ফিরিয়ে আনার জন্য।

কোনো স্পোর্টিং ইভেন্ট যে সত্যিই একটা জাতীয় পরিস্থিতিতে প্রভাব ফেলতে পারে, তার বড় প্রমাণ ১৯৮৩ সালে ভারতের ক্রিকেট বিশ্বকাপ জয়। অনেকের মতেই, সেটা ছিল ভারতের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া একটা মুহূর্ত। ১৯৫৩ ও ৫৪ সালে দুইটি ফুটবল ম্যাচের কারণে চূর্ণ হয়েছিল সাম্রাজ্যের অহঙ্কার আর নিপীড়িত মানুষের মনে জাগিয়েছিল স্বাধীন হওয়ার স্বপ্ন। হাঙ্গেরি ৬-৩ ও ৭-১ গোলের ব্যবধানে হারিয়েছিল ইংল্যান্ডকে। ১৯৫৬ সালের হাঙ্গেরিয়ান বিপ্লবের সঙ্গে এই ম্যাচদুটির প্রত্যক্ষ যোগসূত্র ছিল বলেই দাবি করেছিলেন দেশটির প্রখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক পিটার টিমার। ১৯৯৯ সালে তাঁর পরিচালিত ‘৩-৬’ সিনেমাটিতে দেখানো হয়েছিল, রেফারির শেষ বাঁশি বাজার পর রাজনৈতিক বন্দীদের সঙ্গে কোলাকুলি করে বিজয় উদযাপন করেছিলেন কারাগারের রক্ষীরা। দুই বছর পরে অনেকেই একজোট হয়ে লড়েছিলেন সোভেয়েত ট্যাঙ্কের বিরুদ্ধে। খুঁজলে হয়তো এমন আরও অনেক কিছু পাওয়া যাবে।

আবার ঠিক উল্টোভাবে খেলাধুলা শাসকদের লাঠি হিসেবেও ব্যবহৃত হয়েছে যুগ যুগ ধরে। ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ জয়কে ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার সুযোগ হিসেবে দেখেছিলেন দুই দেশের সামরিক জান্তারা। হিটলার জার্মান জাতির শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করার জন্য খেলাধুলাকে বেছে নিয়েছিলেন। স্পেনের জেনারেল ফ্রাঙ্কোও ফুটবলকে অনেকভাবে ব্যবহার করেছেন নিজের ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য। হাঙ্গেরি ও সোভিয়েত সরকারের কাছে খেলাধুলা, বিশেষত ফুটবলটা ছিল কমিউনিজমের আদর্শ প্রতিষ্ঠার লড়াই। হাঙ্গেরির জাতীয় দল ছিল পুরোপুরি সরকারের কর্তৃত্বাধীন। সেসময়ের কোচ গুসতাভ সেবেস বলেছিলেন, ‘পুঁজিবাদ ও কমিউনিজমের লড়াইটা শুধু আমাদের সমাজেই না, চালাতে হবে ফুটবল মাঠেও।’

তথ্যপ্রযুক্তির যুগে এসে বিশাল মাপের বাণিজ্যক্ষেত্রেও পরিণত হয়েছে খেলাধুলা। বৈশ্বিক বাণিজ্যের কথা নতুন করে বলার কিছু নেই। বাংলাদেশেও ক্রিকেটকে খুব সুচতুরভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে নিজেদের পণ্য বিকানোর জন্য। ক্রিকেট দলকে অভিনন্দন জানানোর নাম করে অমুক বিজ্ঞাপন, তমুক বিজ্ঞাপন… এমনকি ৬৪ জেলায় কনসার্ট পর্যন্ত আয়োজন করা হয়। যেটা স্রেফ ব্যবসা ছাড়া আর কিছুই না| মূলধারার গণমাধ্যমের ভাষায়, ‘ক্রিকেটটা মানুষ খায়’- তাই ক্রিকেটের মোড়ক দিয়ে সাজিয়ে নানাবিধ পণ্য পাবলিককে খাওয়ানো যায় খুব সহজে। আবেগে গদগদ হয়ে আমরা খেতেও থাকি ভোগবাদ, শাসকতা-নাশকতার বড়ি।

সবকিছু শেষে প্রশ্ন হচ্ছে একটাই: আমরা কোনদিকে এগুবো??? বাংলাদেশের ক্রিকেট কী শাসক-নাশকদের স্বৈরতন্ত্র জারি রাখার লাঠি হিসেবে ব্যবহার হবে? বেনিয়াদের ব্যবসাপাতির সামগ্রী হবে নাকি সত্যিই মুক্তির স্বপ্ন দেখাবে মানুষকে?

এ দৃশ্যে মরুভূমি সাগরের ধায়

এ দৃশ্যে মরুভূমি সাগরের ধায়/এ দৃশ্যে পাতাগুলি ঝড়ে যেতে চায়… কবিকে প্রণতি জানাই…

06Aral Sea fishing boats

কোজাবে এমন একজন জেলের নাম যিনি বাস করেন মরুভূমিতে। শুধু তিনি না, তাঁর গ্রামের প্রায় সবাই মাছ ধরাকেই জীবিকা হিসেবে বেছে নিয়েছে। কিন্তু ১৯৭০-এর দশকে তাদের মাছ ধরার বিচরণক্ষেত্রগুলো শুকিয়ে যেতে থাকে। মাছগুলো মরে যেতে থাকে। ধীরে ধীরে গত ৪০ বছরে মরুভূমি গ্রাস করে নেয় আরাল সাগরের প্রায় ৬০ হাজার বর্গ কিলোমিটার এলাকা। কাজাকিস্তানের আরাল সাগরের কোথাও কোথাও ৪০মিটার পর্যন্ত গভীর। বিশাল-বিপুল এই জলরাশি বাষ্প হয়ে মিলিয়ে গেছে গরম বাতাসের মধ্যে।

মধ্য এশিয়ার এই আরাল সাগর, আয়তনের দিক থেকে পৃথিবীর মধ্যে চতুর্থ। কাস্পিয়ন সাগর, লেকস সুপেরিয়র ও ভিক্টোরিয়ার পরেই তার স্থান। কিন্তু এখন তার ১০ ভাগও অবশিষ্ট আছে কিনা, সন্দেহ। গত কয়েক দশকের মধ্যে এটি জলবায়ু পরিবর্তনের অন্যতম নাটকীয় ঘটনা।

কোজাবের গ্রাম, কাজাকিস্তানের জালানাস নামক এলাকাটি ছিল এই আরাল সাগরের উত্তরবর্তী কূলে। এখন সেখানে কোথাও জলের দেখা নেই। যেদিকে দুচোখে যায়; শুধু বালি আর বালি। নিজের চারপাশটা দেখিয়ে কোজাবে বলেন, ‘একটু সামনেই ছিল সাগরটা। আমরা গিয়ে সেখানে ঝাঁপিয়ে পড়তাম। একটা সৈকত ছিল। সেখানে বাচ্চারা রৌদ্রস্নান করত।’

01. aral197302 aral198703 aral199904 aral_then05 aral_now

সমুদ্রের উপস্থিতি জানান দেওয়ার জন্য এখনও আশেপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অনেক মাছ-ধরা ট্রলার, নৌকা। একটা বড় নৌকা দেখিয়ে ৮৬ বছর বয়সী কোজাবে জানান সেটাতে ২০ থেকে ৪০ জন মানুষ উঠতে পারে। আকস্মিক এই পরিবর্তনের কথা মনে করে তিনি বলেন ‘এখানে জেলেরা থাকত, পাচক থাকত, নাবিক, প্রকৌশলী থাকত। কিন্তু সাগর যখন শুকিয়ে যেতে থাকল তখন নৌকাগুলো আর কম জলের বন্দরে আর আসতে পারত না। এক এক করে সেগুলো আটকে যেতে থাকল নরম কাদার মধ্যে। আর সেই কাদাই এখন পরিণত হয়েছে এই বালিতে।’

এই আরাল সমুদ্র থেকে কোজাবেরা এত মাছ মারতেন, যা দিয়ে সোভিয়েত রাশিয়ার ছয়ভাগের একভাগ মৎস চাহিদা পূরণ হতো। একবারের খ্যাপে ৪০০ কেজির বেশি মাছও ধরেছেন কোজাবে। আহ! সেগুলো ছিল সুখের দিন! সাত কেজি ওজনের মাছও ধরা পড়েছে কোজাবের জালে। কিন্তু ১৯৭৬ সালে কোজাবের জালে উঠে আসে এক ঝাঁক মরা মাছ। দিনের পর দিন এভাবেই চলতে থাকায় কোজাবের মতো অনেকেই পাড়ি জমান অন্যত্র।

আরাল সাগরের এই বাঁচা-মরার প্রশ্নটি কোনো দীর্ঘমেয়াদী প্রাকৃতিক বিপর্যয় বা জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে হয়নি। এটা মনুষ্যসৃষ্ট কিছু মুনাফা সংশ্লিষ্ট কর্মকাণ্ডের প্রত্যক্ষ পরিণতি। সাগর শুকিয়ে মরুভূমি হয়ে যাওয়ার নেপথ্যে আছে ভূ-রাজনৈতিক মারপ্যাঁচ।

মধ্য এশিয়ার সবচেয়ে বড় দুই নদীর জলধারা এসে মিশত আরাল সাগরে। উত্তর থেকে সির ডারয়া ও দক্ষিণ থেকে আমু ডারয়া। এই দুই নদীই পড়েছে কাজাকিস্তানের প্রতিবেশী উজবেকিস্তানের বাধার মুখে।

১৯৭০, ৮০-র দশকে সোভিয়েত রাশিয়ার তুলা-শিল্পের বৃহত্তম ক্ষেত্র ছিল উজবেকিস্তান। মধ্য এশিয়াকে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় তুলা উৎপাদনকারী অঞ্চল হিসেবে গড়ে তোলার পরিকল্পনা ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের। ৮০-র দশকে অন্য যে কোনো দেশের চেয়ে বেশি তুলা উজবেকিস্তানেই উৎপাদিত হয়েছে। উজবেকিস্তান এখনও আছে তুলা উৎপাদনকারী শীর্ষ পাঁচটি দেশের মধ্যে।

বাণিজ্যিক বা রাজনৈতিক কারণে গড়ে ওঠা সেই তুলার জমিতে সেচের ব্যবস্থা করতে গিয়ে থমকে গেছে আরাল সাগরের দুই সখা-নদী সির ডারয়া এ আমু ডারয়ার জলপ্রবাহ।

পামির পর্বতমালা থেকে ২৪১৪ কিলোমিটার লম্বা পথ পাড়ি দিয়ে আসা আমু ডারয়া নদীর বৃহদাংশই শুষে নেয় উজবেক তুলা চাষের জমিগুলো। বিগত পাঁচ বছর ধরে এটা আরাল সমুদ্র পর্যন্ত এসে পৌঁছাতেও পারছে না। ঠিক কবে থেকে এটা শুরু হয়েছে সেটা জানাও যায়নি। কারণ উজবেক কর্তৃপক্ষ এটা প্রকাশ করতে চায় না।

এককালে মহাবীর আলেক্সান্ডার যে নদীকে বর্ণনা করেছিলেন তাঁর দুর্ধর্ষ সেনাদলের জন্য একটা দ্রুত-বহমান বাধা হিসেবে, সেই সির ডারয়া নদীর প্রবাহও অনেক কমে গেছে। এককালে যেখানে থইথই করত বিপুল জলরাশি, সেটা প্রথমে ভাগ হয়ে যায় দুইটা লবনাক্ত হ্রদে। দক্ষিণে বড় আরাল। সেটার অর্ধেক অংশ আছে উজবেকিস্তানে। আর কাজাকিস্তানে আছে ছোট আরাল। বড় আরালটাও আবার পরবর্তীতে ভাগ হয়ে যায় পূর্ণ ও পশ্চিম বেসিনে। ২০১৪ সালের অক্টোবরে এই পূর্ব বেসিনও পুরোপুরি উধাও হয়ে গেছে।

মধ্য এশিয়ার স্কুলপড়ুয়া বাচ্চারা আমু ডারয়া নদীকে চিনত এই অঞ্চলের আমাজন হিসেবে। এমন প্রমত্ত একটা নদীর ধারা রোধ করা হয়েছে তুলা ও ধানক্ষেতে সেচ দেওয়ার কাজে। লাখো মানুষের জীবনও জড়িয়ে আছে এই চাষবাষের সঙ্গে। সেটা বাধাগ্রস্থ করাও সম্ভব না বলে মন্তব্য করেছেন সেভ দ্য আরাল সি ফাউন্ডেশনের প্রধান মেদাদ অসপানোভ, ‘আপনি যদি পুরো আরাল সমুদ্রকে বাঁচাতে চান তাহলে এই অঞ্চলে (উজবেকিস্তানে) সেচকার্য বন্ধ করতে হবে। কিন্তু এটা হবে অসম্ভব।’

তবে নদীগুলো বাঁচানোর জন্য উজবেক সরকারের আন্তরিকতা ছিল না বলেও অভিযোগ করছেন কেউ কেউ। কারণ শুমিয়ে যাওয়া সাগরের বুকে পাওয়া গেছে তেল ও গ্যাসের সন্ধান। খনিজ সম্পদ উত্তোলনের কাজে জলের নিচের চেয়ে শুকনো জায়গাতেই বেশি সুবিধা পাওয়া যায়। রাশিয়ান ও কোরিয়ান কিছু এনার্জি কোম্পানি ইতিমধ্যে তাদের কাজ শুরুও করে দিয়েছে।

সাগর বাঁচানোর চেয়ে মরুভূমির আশেপাশ বসবাসরত মানুষদের জীবনযাত্রার মান কিভাবে উন্নয়ন করা যায়, সেদিকেই মনোযোগ দিচ্ছে উজবেক সরকার।

‘আলো হাতে আঁধারের যাত্রী’

Avijit Roy Murder Protest

মুক্তবুদ্ধি রুদ্ধ

একদিকে ৫৭ ধারা-রাষ্ট্র অন্যদিকে মৌলবাদ
নিষেধাজ্ঞা আর নিশ্চুপিকরণ
আমরা কোথায়?

এমন প্রশ্ন সামনে রেখে অভিজিৎ রায় হত্যার প্রতিবাদে রাজু ভাস্কর্যে মোমবাতি প্রজ্জলন করেছেন দমবন্ধকর ঢাকা শহরের কিছু নাগরিক। এখানে না ছিল কোনো মাইক, না কোনো ব্যানার। মুখপাত্রের ভূমিকাতেও দেখা যায়নি কাউকে। কিন্তু রাষ্ট্রীয় নিষেধাজ্ঞা-বিধিনিষেধ আর মৌলবাদের নিশ্চুপ করিয়ে দেওয়ার ভয়াল-সংস্কৃতি থেকে মুক্তি পেতে গেলে যে সাধারণ মানুষকে কোনো না কোনো উপায়ে সংগঠিত হতে হবে, সেই আর্জি স্পষ্টভাবেই ফুটে উঠেছে হাজারো মোমবাতির আলোয়।

দুর্বত্তদের নারকীয় হামলায় নৃশংসভাবে নিহত হওয়া অভিজিৎ রায়ের একটি বইয়ের নাম ‘আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী’। যেখানে তিনি বিজ্ঞানীদের জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার ধারা বর্ণনা করেছেন। যাদের হাত ধরে মানুষ আজকের এই ‘আধুনিক বিজ্ঞানে’র যুগে পৌঁছেছে, তাদের ক্রমবিবর্তন বর্ণনা করেছেন। বৃহস্পতিবার (৫ মার্চ) রাজু ভাস্কর্যের সামনে মোমবাতি প্রজ্জ্বলন কর্মসূচির নামটিও দেওয়া হয়েছিল ‘আলো হাতে আঁধারের যাত্রী’।

অনেক অনেক মানুষের মৃত্যুর মিছিলে আরেকটি নাম হিসেবে যুক্ত হয়েছেন মুক্তচিন্তক অভিজিৎ রায়। এ থেকে পরিত্রাণের উপায় কি? বিচার কি হবে আদৌ? বিচার হলেও কী সমস্যার সমাধান হবে? উত্তর সহজে মিলবে না। তবে একটা বিষয় স্পষ্ট যে সাধারণ মানুষ যতদিন বিচ্ছিন্ন থাকবে, রাষ্ট্রের শাসকতার হাতে নিজের নিরাপত্তার ভার দিয়ে বসে থাকবে ততদিন পর্যন্ত কেউই নিরাপদ থাকবে না। পেট্রোল বোমা, হাত বোমা বা চাপাতির কোপ; যে কোনোটাই ছুটে আসতে পারে ঘাড়-মাথা লক্ষ্য করে। সমাধান একটাই: জনসক্রিয়তা। নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার স্বার্থে, বেঁচে থাকার স্বার্থে সমাজের প্রতিরোধ-শক্তি বাড়ানো। যেটা ক্রমশই প্রায় শূণ্যের কোটায় নিয়ে যাচ্ছে রাষ্ট্র।

অশুভ শক্তি দমনের নাম করে রাষ্ট্র যত বেশি শুভ-স্বৈরতন্ত্র গড়ে তুলবে সাধারণ মানুষের সংকট ততই ঘনিভূত হবে। মানুষের সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টাই পারে সব অশুভ ষড়যন্ত্র রুখে দিতে। রাষ্ট্র শুধু নিজের ক্ষমতার দেয়ালটাই আরও মজবুত করতে চায়। জনগণের নিরাপত্তা বিধানের কোনো তাগিদ রাষ্ট্রের নেই।

খুবই ছোট পরিসরে, ছোট কলেবড়ে হলেও সংগঠিত কিভাবে হওয়া যায়, জনসক্রিয়তা কিভাবে বাড়ানো যায়; সেই ভাবনার খোরাক হতে পারে ‘আলো হাতে আঁধারের যাত্রী’ শীর্ষক এই মোমবাতি প্রজ্জ্বলন কর্মসূচি।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা…; শিখব কি?

কয়েকদিন আগেই আরিফ রেজা মাহমুদ লিখেছিলেন যে,

রাষ্ট্র, ক্রমাগত সমাজকে ক্ষত্রশক্তি শুন্য করে ফেলছে। সমাজের হাজার বছরের সংহতি, পারস্পারিক সহযোগিতা-প্রতিরোধ সব চুরমার করে ফেলছে রাষ্ট্র। ক্রমাগত এক নিষেধাজ্ঞারআঁধারে নিমজ্জিত করে রাখছে আমাদের। উদাহরণ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। ৭ বছর ধরে অব্যাহত আছে নিষেধাজ্ঞা। শিবির জুজু দেখিয়ে এই নিষেধাজ্ঞা চালু হলেও তা আসলে বলবৎ প্রগতিশীল শক্তিরই উপরে। শিবির এখন আউট অফ ক্যাম্পাস-চোরাগোপ্তা দল। তাহলে শিবির ঠেকাতে প্রগতিশীল সংগঠনগুলোকে কর্মকান্ড করতে না দেয়ার অর্থ খুব সোজা। শিবির বিরোধী শক্তির নিক্ষত্রীয়করণ। একই পদ্ধতি সবখানে বিস্তৃত হচ্ছে। হত্যার শিকার হচ্ছেন অভিজিৎরা। সমাজ-প্রতিরোধ না বাঁচলে যে কেউ ষড়যন্ত্র করতে পারবে।
সামাজিক প্রতিরোধ এমন দুর্বল হয়ে পড়ার পরণতি একটাই– দাসত্ব-দীর্ঘ মেয়াদী দাসত্ব।

RU1

সেই অভিজিৎ হত্যার বিচার চাইতে গিয়েই আবার পুলিশি বাধার মুখে পড়তে হয়েছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রগতিশীল শিক্ষার্থীদের। শিবির-মুক্ত ক্যাম্পাস গড়ার নামে রাবিকে নিষেধাজ্ঞার বেড়ি পড়ানো হয়েছিল ২০০৯ সালে। তারপর থেকে ঘটা এমন কয়েকটি ঘটনার বিবরণ দিয়েছেন Sohraab Hossaiin…

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এবং পুলিশ কাহিনীঃ

০২ অক্টোবর ২০১২।
ছাত্রলীগ এবং ছাত্রশিবিরের মধ্যে গোলাগুলি চলাকালে পুলিশকে দর্শকের ভূমিকায় দেখা যায়। সংঘর্ষ চলাকালীন ছাত্রলীগের ২ নেতাকে পুলিশের পাশে দাঁড়িয়ে পিস্তলে গুলি ভরতে এবং গুলি করতে দেখা যায়।

০৬ অক্টোবর ২০১২। ভর্তি পরীক্ষার্থীদের শুভেচ্ছা জানিয়ে সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট রাবি শাখা মিছিল করলে সেখানে বাধা দেয় অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে, ব্যানার ছিড়ে ফেলে এবং ছাত্র ফ্রন্ট এর চার নেতাকর্মিকে (সোহরাব, সুজন, রিহান, তৌফিক) গ্রেফতার করে।

১০ অক্টোবর ২০১২।
বাকৃবিতে বর্ধিত ফি বিরোধী আন্দোলনে ছাত্রলীগ ও পুলিশের যৌথ হামলা এবং আন্দোলনকারি সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট এর ১১ নেতাকর্মির নামে দায়ের করা মিথ্যা মামলা ও বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহারের দাবিতে রাবি ক্যাম্পাসে প্রগতিশীল ছাত্রজোট মিছিল করলে মতিহার থানার এসি হাসানাত এর নেতৃত্বে হামলা করা হয়, আহত হন ১০/১২ জন জোট নেতাকর্মি, গ্রেফতার করা হয় ৫জনকে (ছাত্র ফ্রন্ট এর সোহরাব, সুজন, সাদিক; বাসদ এর দেবাশীষ রায়, ছাত্র ফেডারেশন এর মোসাদ্দেক)

২ ফেব্রুয়ারি ২০১৪
বর্ধিত ফি ও বাণিজ্যিক সান্ধ্যকোর্স বিরোধী আন্দোলনে রাবি প্রশাসনিক ভবনের সামনে দশ সহস্রাধিক শিক্ষার্থীদের শান্তিপূর্ণ সমাবেশে প্রক্টরিয়াল বডির উপস্থিতিতে এবং নির্দেশে পুলিশ এবং ছাত্রলীগের গুলি। সাংবাদিকসহ শতাধিক আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী গুলিবিদ্ধ। ফলাফলঃ আন্দোলনকারিদের নামে মামলা।

[চলবে]

RU2

ক্যাম্পাসে রাষ্ট্রীয় কলকব্জা ঢুকিয়ে দেওয়ার, পুলিশি পাহাড়া বসানোর, নায্য কথা বলতে আসা শিক্ষার্থীদের মারধর করার পরিণামে ক্রমাগত প্রাণহীন হয়ে পড়েছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। রাজনৈতিক তৎপরতা চালাতে গিয়ে তো সরাসরি ডাণ্ডা-বেড়ির ঘা খেতে হচ্ছে। মতিহার চত্বর নিষ্প্রাণ হয়ে পড়ছে সাংস্কৃতিকভাবেও। ক্যাম্পাসে এখন কি ১০ বছর আগের মতো সেমিনার-আলোচনা সভা হয়? পথনাটক-মঞ্চনাটক হয়? গান-বাজনা হয়? হাঁফ ছাড়ার মতো মুক্ত পরিবেশ আছে? উত্তর নেতিবাচকই হওয়ার কথা।

অথচ ১০ বছর আগে শিবিরের দাপুটে উপস্থিতির মধ্যে, তাদের ভয়- ভীতি প্রদর্শনের মুখেই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় হাজার গুনে সরব ছিল রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিকভাবে…

শিবির দমনের নামে “মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী”রা নিজেদের ক্ষমতা একচেটিয়াকরণ করেছেন শুধু। স্রেফ ফায়দা লুটেছেন অন্য সবার মুখ বন্ধ করে দিয়ে। এদিকে শিবির কিন্তু মাঝেমধ্যেই জানান দিয়েছে নিজেদের উপস্থিতি। সেগুলো ঠেকাতে পারেননি রাষ্ট্রের পাণ্ডারা।

বাংলাদেশের বৃহত্তর পরিসরেও এমন ঘটনা ঘটার আশঙ্কা থাকে। জাতীয় পরিস্থিতিতে যদি সবার মুখ বন্ধ করে দিয়ে, কাউকে কোনোরকম কথা বলতে না দিয়ে, সভা-সমিতি-মিছিল-মিটিং সব বন্ধ করে দিয়ে মৌলবাদ নির্মুল বা জঙ্গি দমন শুরু করা হয়… তাহলে পরিণতি কী হতে পারে সে ধারণা পাওয়ার জন্য রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে তাকানোই যায়

ক্রিকবোমিও পরিস্থিতি: বড় অসময়ে এসেছে বিশ্বকাপ!

বাংলাদেশ ক্রিকেট পাগল একটা দেশ। অনেকটা থোরবড়িখাড়া ধরণের হলেও তাদের ‘টাইগার’দের নিয়ে গর্ব-ভালোবাসার অন্ত নেই বাংলাদেশের মানুষের। সেই বাংলাদেশ পঞ্চমবারের মতো অংশ নিয়েছে ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় আসর বিশ্বকাপে। সাধারণ একটা সিরিজের ম্যাচ হলেও যেখানে উত্তেজনার অন্ত থাকে না, সেখানে বিশ্বকাপের সময় তো নাওয়া-খাওয়া ভুলে শুধু ক্রিকেট গেলার দশা হয়। কিন্তু এবার তেমনটা হবে কিনা, বলা মুশকিল। কারণ এবারের বিশ্বকাপ যে এসেছে… বড় অসময়ে।

বিশ্বকাপ ক্রিকেট এসেছে দেশের এক ওলটানো-পালটানো সময়ে… যখন সকালে বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় মনে হয় সন্ধায় বেঁচে ফিরব তো!… হাতবোমার হাত থেকে হাত-পা বাঁচাতে পারব তো? পেট্রোলবোমার আগুনে পুড়ে যাবে না তো মুখটা? কোনো মতে খেয়েপড়ে বেঁচে থাকাও না… শুধু বেঁচে থাকাটাই যে এখন বড় সংগ্রামের বিষয়। এইরকম একটা প্রাণঘাতী-অস্থির সময়ে দুয়ারে হানা দিয়েছে বিশ্বকাপ ক্রিকেট। এই ক্রিকবোমিও পরিস্থিতির মধ্যে এবারও কী আমরা ফেটে পড়তে পারব ক্রিকেটীয় আনন্দ-উল্লাসে বা আক্ষেপ-আফসোসে; রাগে-ক্ষোভে?

Cricket Bomd Bangladesh Situation

খেলাধুলা যে জাতীয় রাজনীতি-অর্থনীতির সঙ্গে খুব ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে যেতে পারে তার প্রমাণ আমরা অতীতে অনেক পেয়েছি। কখনো বা এটা হয়েছে নিপীড়িততের প্রতিবাদের পন্থা, সংগঠিত হওয়ার উপায়। কখনো বা হয়েছে শাসকদের ছড়ি। কখনো বা মাত্র একটি খেলার প্রভাবে সাধিত হয়েছে বিশাল মনোজাগতিক পরিবর্তন।

ক্রিকেটও কিন্তু আমাদের জাতীয় জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে গেছে ওতোপ্রতোভাবে। কোন সরকারের আমলে ক্রিকেট বা ফুটবল দল কত বেশি সাফল্য পেয়েছে-এগুলো পরিসংখ্যান ব্যবহৃত হয় রাজনীতিতে। ক্রীড়াঙ্গনে কেমন টাকা বরাদ্দ করা হবে সেটাও আমাদের অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ অংশ। আর ক্রিকেট আমাদের মনোজগতে কতটা প্রভাব ফেলে সেটা নতুন করে বলার কি আছে?

ক্রিকেটের সঙ্গে আমাদের ‘দেশপ্রেম’ও জড়িয়ে গেছে খুব সুনিপুনভাবে। ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ ধারণ করা যেমন দেশপ্রেম… সবচেয়ে বড় পতাকা বানিয়ে রেকর্ড গড়াটাও যেমন দেশপ্রেম… ক্রিকেটে বাংলাদেশকে সমর্থন করাটাও তেমন দেশপ্রেমের কাতারে পড়ে গেছে। দেশপ্রেম যেমন নিঃস্বার্থ… বাংলাদেশ দশকে সমর্থন করার ব্যাপারটাও নিঃস্বার্থ। ‘টাইগাররা জিতুক আর হারুক… সঙ্গে আছি’। কোনো চাওয়া-পাওয়া নাই, শুধু ভালোবেসে যাব- টাইপ ব্যাপার। সমর্থকদের আবেগে থরথর হয়ে বলতে শোনা যায়, ‘বাংলাদেশ এগিয়ে চলো, জয় তোমাদের হবেই’ জাতীয় কথাবার্তা। ‘একাত্তরে যেভাবে হানাদার বাহিনীর হাত থেকে দেশ স্বাধীন করেছি সেভাবে আমরা এবার বিশ্বকাপ জয় করব’ এমন সংযোগ রেখাও টানতে দেখা যায় কাউকে কাউকে। ক্রিকেটারদের অনুপ্রেরণা দেওয়ার জন্য ৬৪ জেলায় কনসার্ট, নাচ-গানের আয়োজন করা হয়। ঠিক যেন ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশের’ যুগোপযোগী ভার্সন। অনেক সময় এমন অনুভূতি পাওয়া যায় যেন মনে হয় যে ঐ ক্রিকেট দলটাই পুরো বাংলাদেশ। এর বাইরে আর কিছু নেই।

কিন্তু দেশের মানুষের মরোমরো দশার মধ্যে এই গ্রামীনফোন-বাংলালিংক মার্কা আবেগীয়-ক্রিকেটীয় দেশপ্রেম দেখানো কতটা শালীন-শোভন; তা নিয়ে সংশয় জাগে। যেটা স্রেফ ব্যবসা ছাড়া আর কিছুই না| তার চেয়ে বরং ক্রিকেট আমাদের সমাজ-রাজনীতিতে কেমন প্রভাব রাখছে সেটাই দেখা যাক খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। দেখা যাক এরকম একটা অস্থির সময়ে ক্রিকেট বিশ্বকাপ আমাদের জাতীয় জীবনে…চিন্তায়… মূলধারার গণমাধ্যমে, সামাজিক গণমাধ্যমে… জাতীয় রাজনীতি, আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে কিভাবে প্রভাব ফেলছে…

ক্রিকেটীয় কূটনীতির দেখা ইতিমধ্যে পাওয়াই গেছে: মোদি-হাসিনার ক্রিকেটীয় শুভেচ্ছা বিনিময়। ক্রিকেটকে উপলক্ষ্য করে কূটনৈতিক যোগাযোগ হচ্ছে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর। ভবিষ্যতে আরও কী কী ঘটে সেটা দেখার অপেক্ষা থাকল।

হুদহুদের নাম “হুদহুদ” কেন?

হুদহুদ। অদ্ভুত! সত্যিই, নামটা একটু অদ্ভুতই বটে! সম্প্রতি যে ঘূর্ণিঝড়টি ভারত-বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকার লাখো মানুষের জীবন বিপন্ন করে তুলেছে -এটা তারই নাম। কিন্তু বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট এই ঘূর্ণিঝড়টি কিভাবে পেল এই নাম? এর মানেই বা কী? কিভাবে করা হয় এই ঘূর্নিঝড়গুলোর নামকরণ?

Hudhud1

বঙ্গোপসাগরের দক্ষিণ আন্দামান সাগরে সৃষ্টি হয়ে মহা শক্তিশালী এই ঘূর্ণিঝড় আঘাত হেনেছে ভারতের অন্ধ্রপ্রদেশে। প্রায় স্থবির হয়ে পড়েছে বাংলাদেশ ও ভারতের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের উপকূলীয় এলাকা। ১৭০ কিলোমিটার বেগে ধেয়ে আসা এই ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলায় নেওয়া হয়েছে নানা পদক্ষেপ। অথচ প্রবল এই ঘূর্ণিঝড়ের নামটি কিন্তু এসেছে ওমান থেকে।
হুদহুদ আসলে একটি পাখির নাম। আফ্রিকা, ইউরোপ ও এশিয়ার অনেক অঞ্চলেই দেখতে পাওয়া যায় আকর্ষণীয় পালক, ঝুঁটি ও লম্বা ঠোঁটের এই পাখিটিকে। ‘হুপি’ নামের এই পাখিকেই ওমান ভাষায় ডাকা হয় হুদহুদ বলে। এটি ইসরায়েলের জাতীয় পাখিও বটে। ২০০৪ সালে যখন আরব সাগর ও বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড়গুলোর নামকরণের আহ্বান জানানো হয় তখন অন্য আরও কিছু নামের সঙ্গে এই হুদহুদ নামটাও যোগ করেছিল ওমান।

Hudhud
আটলান্টিক মহাসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড়গুলোর নামকরণ করা হয় ১৯৫৩ সাল থেকে। শুরুটা মিয়ামির জাতীয় হারিকেন সেন্টারে হলেও পরবর্তীতে এই নামকরণ প্রক্রিয়া পরিচালিত হয় বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থার (ডব্লিউএমও) তত্ত্বাবধানে। কিন্তু দক্ষিণ এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলের ঘূর্ণিঝড়গুলোর নামকরণ প্রথা চালু হয়েছে ২০০৪ সাল থেকে। তার আগে এই অঞ্চলের ঘূর্ণিঝড়গুলো যা করার সেটা বেনামেই করত।
ঘূর্ণিঝড়গুলোর গতিপ্রকৃতি বোঝা, কার্যকরীভাবে সতর্কতা জারি, ক্ষয়ক্ষতির পরিমান নির্নয় ইত্যাদির জন্য ঘূণিঝড়গুলোর নামকরণ করা উচিৎ বলে শক্ত পদক্ষেপ নেন আবহাওয়াবীদরা। অবশেষে ২০০৪ সালে আরব সাগর ও বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড়গুলোর নামকরণের জন্য একজোট হয় আটটি দেশ। ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, মালদ্বীপ, মিয়ানমার, ওমান, শ্রীলঙ্কা ও থাইল্যান্ড। প্রতিটি দেশ প্রস্তাব করে আটটি করে নাম। দেশের নামের আদ্যাক্ষর অনুযায়ী একের পর এক আসে র্ন্বিাচিত নামগুলো।
এ বছরের জুনে আরব সাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড়, নানাউকের নামকরণ করেছিল মিয়ানমার। এবার এসেছে ওমানের পালা। ২০০৭ সালের প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় সিডরের নামটিও এসেছিল ওমান থেকে। এই অঞ্চলের পরবর্তী ঘূর্ণিঝড়টির নাম হবে নিলোফার। এটি এসেছে পাকিস্তান থেকে।
বাংলাদেশের প্রস্তাবকৃত পাঁচটি নাম ইতিমধ্যেই ব্যবহৃত হয়ে গেছে। অনিল (২০০৪), অগ্নি (২০০৬), নিশা (২০০৮), গিরি (২০১০) ও হেলেন (২০১৩)। বাংলাদেশের দেওয়া আরও তিনটি নাম ভবিষ্যতে ব্যবহার হবে। সেগুলো হলো: চপলা, অক্ষি ও ফনি।

Cyclone Names

Cyclone Names2
২০০৪ সাল পর্যন্ত যে এই ঘূর্ণিঝড়গুলোর নামকরণ করা যায়নি তার একটা অন্যতম প্রধান কারণ সনাক্ত করতে গিয়ে ভারতের ঘূর্ণিঝড় সতর্কতা সেন্টারের প্রধান ড. এম মহাপত্র বলেছেন, ‘এই ধরণের বৈচিত্র্যময় একটা সাংস্কৃতিক অঞ্চলে ঘূর্ণিঝড়ের নামকরণ করতে গিয়ে সবাইকে খুবই সতর্ক আর নিরপেক্ষ থাকতে হয়, যেন এটা কারও অনুভূতিতে আঘাত না করে।’
তবে অনেক সতর্কতা অবলম্বন করার পরেও বিপত্তি যে বাধেনি, তা কিন্তু নয়। ২০১৩ সালের ঘূর্নিঝড় মহাসেনের নামকরণ করেছিল শ্রীলঙ্কা। কিন্তু এই নামটা নিয়ে প্রবল আপত্তি জানিয়েছিলেন দেশটির অনেক মানুষ। তারা বলেছিলেন যে, মহাসেন ছিলেন একজন শ্রীলঙ্কান রাজা, যিনি সেখানে এনেছিলেন শান্তি ও সমৃদ্ধি। তাঁর নামে এমন একটা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের নামকরণ করাটা একেবারেই অনুচিত। পরবর্তীতে শ্রীলঙ্কান কর্তৃপক্ষ ঘূর্ণিঝড়টির নাম বদলে রেখেছিল ভিয়ারু।

নাইকি বনাম অ্যাডিডাস: বিশ্বকাপের অন্য লড়াই!


21আর মাত্র ৪০ দিন পরেই ফুরোবে অপেক্ষার প্রহর। পর্দা উঠবে ‘দ্য গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ’-এর। কার মাথায় উঠবে ফুটবল শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট—সেই আলোচনাতেই বিভোর ফুটবল বিশ্ব। মাঠের লড়াইয়ের আগে কথার লড়াইয়েও মশগুল হয়ে উঠবেন তারকা ফুটবলাররা। তবে এসব বাদ দিয়ে সবার অলক্ষ্যে আরেকটি লড়াইয়ের ময়দানও কিন্তু তৈরি হয়ে গেছে ফুটবল বিশ্বকাপকে ঘিরে। যেখানে লড়তে দেখা যাবে নাইকি, অ্যাডিডাসের মতো বহুজাতিক করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোকে। বিশ্বব্যাপী নিজেদের বিপণন বাণিজ্য ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টায় তারাও নিয়োগ করবে সর্বোচ্চ শক্তি। ব্রাজিল বনাম আর্জেন্টিনা কিংবা মেসি-রোনালদো লড়াইয়ের চেয়েও এই লড়াই কিন্তু কোনো অংশে কম আকর্ষণীয় নয়।

অ্যাডিডাস-নাইকি, দুটোই ক্রীড়াসামগ্রী প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান। একই ধরনের পণ্য উত্পাদনকারী হিসেবে পণ্যের বিপণন বাণিজ্যে এই দুটি প্রতিষ্ঠান সব সময়ই একে অন্যকে ছাড়িয়ে যেতে চায়। বিশ্বকাপের বছরে এই ‘ছাড়িয়ে যাওয়ার লড়াই’ পায় ভিন্ন মাত্রা। এবারের আসরটা ব্রাজিলে অনুষ্ঠিত হচ্ছে বলে উত্তাপটা আরও বেশি ছড়াচ্ছে। বর্তমান বিশ্বে ব্রাজিলিয়ানদের মতো ফুটবলপাগল জাতি যে খুব কমই আছে। আর এটার তাত্পর্য বেশ ভালোভাবেই উপলব্ধি করেছেন নাইকির ব্রান্ড প্রেসিডেন্ট ট্রেভর এডওয়ার্ড। সম্প্রতি এক সাক্ষাত্কারে তিনি বলেছেন, ‘এবারের বিশ্বকাপ ব্রাজিলে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এর চেয়ে বেশি উত্তেজনাকর ব্যাপার আর কী হতে পারে? পুরো বিশ্বেই এর অনুরণন দেখা যাবে।’ এডওয়ার্ড তো ভালোমতোই জানেন যে, যত বেশি উন্মাদনা, ততই বেশি বেচাকেনা! পাঁচ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি অর্থের এই বিশাল বাজারে সর্বোচ্চ মুনাফা তুলে আনার চেষ্টাই করে যাচ্ছে নাইকি-অ্যাডিডাস। ফুটবলপ্রেমী ক্রেতাদের সামনে ছড়িয়ে দিয়েছে আকর্ষণীয় সব পণ্যের পসরা।

অ্যাডিডাসের যাত্রা শুরু হয়েছিল ১৯৫০ সালে। দীর্ঘদিনের ঐতিহ্যের কারণে বরাবরই অন্যদের চেয়ে তারা কিছুটা এগিয়ে থাকে। ফুটবল-সংক্রান্ত বাণিজ্যে বরাবরই অন্যদের পেছনে ফেলেছে জার্মানিভিত্তিক এই প্রতিষ্ঠানটি। ফুটবল জগেক তারা বিবেচনা করে নিজেদের অঞ্চল হিসেবে। কিন্তু অনেক পরে যাত্রা শুরু করেও অ্যাডিডাসকে বেশ ভালোই চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে নাইকি। আমেরিকান এ প্রতিষ্ঠানটি ফুটবল অঙ্গনে পা রেখেছিল ১৯৯৪ সালের বিশ্বকাপে। এরপর থেকে অ্যাডিডাসের সঙ্গে পাল্লা দিয়েই লড়ছে তারা।

এবারের বিশ্বকাপে স্বাগতিক ব্রাজিলসহ মোট ১০টি দেশের ক্রীড়াসামগ্রীর জোগান দেবে নাইকি। ইংল্যান্ড, পর্তুগাল, ফ্রান্স, নেদারল্যান্ডসের খেলোয়াড়েরা মাঠে নামবেন নাইকির প্রস্তুতকৃত বুট-জার্সি পরে। অন্যদিকে অ্যাডিডাস স্পন্সর করছে নয়টি বিশ্বকাপ দলকে। যার মধ্যে আছে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন স্পেন, জার্মানি, আর্জেন্টিনার মতো শীর্ষ দলগুলো। এবারের বিশ্বকাপের অন্যতম অফিশিয়াল স্পন্সরও অ্যাডিডাস। প্রতিবারের মতো এবারও অ্যাডিডাসের তৈরি করা বল দিয়েই খেলা হবে বিশ্বকাপ।

ক্রীড়াবিশ্বের সবচেয়ে বড় এই আসর সামনে রেখে নতুন নতুন আকর্ষণীয় সব পণ্যও বাজারে এনেছে নাইকি-অ্যাডিডাস। গত শুক্রবারেই নাইকি উন্মুক্ত করেছে তাদের নতুন বুট— ‘মারকিউরিয়াল সুপারফ্লাই’। এর আকর্ষণীয় এক বিজ্ঞাপনে অংশ নিয়েছেন রোনালদো-নেইমার-ওয়েইন রুনির মতো তারকারা। হালকা এই বুট পায়ে দিয়ে ফুটবলাররা আরও জোরে দৌড়াতে পারবেন বলেই দাবি নাইকির।

অন্যদিকে এবারের বিশ্বকাপ আয়োজক ব্রাজিলের কথা মাথায় রেখে অ্যাডিডাস বাজারে এনেছে ‘সাম্বা’ নামের বিশেষ বুট। জার্সি তৈরির ক্ষেত্রেও অনেক নতুনত্ব এনেছে অ্যাডিডাস। নতুন এই জার্সিগুলো অনেক হালকা এবং খেলোয়াড়েরা এগুলো গায়ে দিয়ে অনেক স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবেন বলেই দাবি করেছে তারা। আর্জেন্টিনার মেসি, স্পেনের জাভি-ইনিয়েস্তা, জার্মানির ওজিল-মুলাররা বিশ্বকাপ খেলবেন অ্যাডিডাসের এই জার্সি গায়েই।

ফুটবল অঙ্গনের এই বিশাল বাজারের প্রায় ৮০ ভাগই আছে নাইকি আর অ্যাডিডাসের দখলে। তবে জার্মানির আরেক প্রতিষ্ঠান পুমাও থাকছে এই বিশ্বকাপের লড়াইয়ে। ইতালি, সুইজারল্যান্ড ও আফ্রিকার চারটি দেশসহ মোট আটটি দেশের ফুটবলাররা বিশ্বকাপে মাঠে নামবেন পুমার তৈরি জার্সি গায়ে। বিশ্বকাপ সামনে রেখে এ বছরের শুরুতেই ‘ইভোপাওয়ার’ নামে নতুন একটি বুট তৈরি করেছিল পুমা। তাদের জার্সিগুলোতেও থাকবে আধুনিক প্রযুক্তির ছোঁয়া। গায়ের সঙ্গে সেঁটে থাকা এই জার্সিগুলো নাকি খেলোয়াড়দের পেশিগুলোকে উদ্দীপিত করবে।

অ্যাডিডাস-নাইকি-পুমাদের এই লড়াইয়ে ফুটবলাররাও নিশ্চিতভাবেই রাখবেন বিশাল ভূমিকা। নেইমারের ব্রাজিল বা রোনালদোর পর্তুগাল যদি ফাইনালে যায় বা শিরোপা জেতে তাহলে ব্যাপকহারে বেড়ে যাবে নাইকির জার্সি বিক্রির হার। অন্যদিকে অ্যাডিডাস বিশ্বকাপ শিরোপাটা দেখতে চাইবে স্পেন, জার্মানি বা আর্জেন্টিনার হাতে। মেসি-রোনালদো-নেইমার-জাভিদের দিকে শুধু তাঁদের সমর্থকেরাই না, তীক্ষ দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে থাকবেন অ্যাডিডাস-নাইকির বিপণন কর্মকর্তারাও।

মুক্ত-বিশ্ববিদ্যালয় নাকি মুক্ত-বাজার?

গত ২০ জানুয়ারী থেকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলন শুরু করেছিলেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। তাদের দাবি ছিল বর্ধিত বেতন-ফি প্রত্যাহার ও সান্ধকালীন বাণিজ্যিক মাস্টার্স কোর্স চালুর সিদ্ধান্ত বাতিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাণিজ্যিকীকরনের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলেছিলেন হাজার হাজার শিক্ষার্থী। কোনো আন্দোলনে এত বিপুল পরিমাণ শিক্ষার্থীর অংশগ্রহণ বহুদিন পর দেখা গেছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। শিক্ষার্থীদের তীব্র আন্দোলনের মুখে ১ ফেব্রুয়ারী বর্ধিত ফি বাড়ানোর সিদ্ধান্তটি সাময়িকভাবে স্থগিত করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। কিন্তু শুধু স্থগিত না, সিদ্ধান্তটা পুরোপুরি প্রত্যাহার এবং সান্ধকালীন মাস্টার্স কোর্স বন্ধের দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেয় শিক্ষার্থীরা। এই কয়দিন ‘বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ধৈর্য্য ধরে মোকাবিলা করছিল নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি’। কিন্তু এবার ভেঙ্গে গেল তাদের ধৈর্য্যর বাঁধ। বেরিয়ে পড়ল সেই চিরাচরিত নিপীড়ণমূলক চেহারা। এক দিন পরেই শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর লেলিয়ে দেওয়া হলো পুলিশ আর ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীদের। প্রকাশ্যে বন্দুক-পিস্তল নিয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর চড়াও হলো আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনী আর প্রশাসনের পেটোয়া বাহিনী। নির্বিচারে গুলি চালিয়ে আহত করা হলো শতাধিক শিক্ষার্থীকে। আর চূড়ান্ত পরিণতি হিসেবে অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হলো বিশ্ববিদ্যালয়।

8_1
ইতিমধ্যে পত্রপত্রিকা-টেলিভিশন মারফত গোটা জিনিসটা যখন জাতীয় ইস্যুতে পরিণত হলো, তখন দেখা গেল মধ্যবিত্ত শিক্ষিত সমাজের বৃহদাংশই, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল কাজটা কী, সেটাই প্রায় ভুলতে বসেছে। আলু-পটলের মতো শিক্ষাকেও, মুক্ত জ্ঞানচর্চার কেন্দ্রকেও এখন ফেলে দেওয়া হয়েছে পণ্যের কাতারে। ফলে এই যুক্তি অহরহই শুনতে পাওয়া যায় যে, ‘বেতন তো বাড়বেই। পাঁচ বছর আগে যেই জিনিসের দাম ছিল দুই টাকা এখন সেটা দশ টাকা। সেই তুলনায় তো বাড়েই নি বলা চলে।’ বা ‘সান্ধকালীন কোর্সটা তো কতজনকে উচ্চশিক্ষার সুযোগ করে দিচ্ছে, ফলে ক্ষতি কী? বরং ভালোই তো।’ আর যেভাবে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় বাড়ছে, গোটা সমাজটাই যখন শুধু কেনাবেচার উপরেই চলছে, তখন এমনটা হওয়াই যে স্বাভাবিক, তাতে অবাক হওয়ারও আসলে কিছু নাই। ফলে একটা দেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় নামের সায়ত্ত্বশাসিত বস্তুটা আছে কেনÑ এই প্রশ্নটাই এখন তোলার দরকার।

‘শিক্ষা-ব্যবসা, একসাথে চলে না’
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা লেখাপড়া করে খেটে খাওয়া মানুষের করের টাকায়। একদম গোড়ায় দেখলে দেখা যায় যেটা আসলে কৃষক-শ্রমিকদের প্রত্যক্ষ শ্রমের ফসল। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশ্নে এই মানুষগুলোর শ্রম-ঘামের কথা শুরুতেই মাথায় রাখতে হবে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ সমাজকে এমন ধরণের জ্ঞানের যোগান দেওয়া যা দিয়ে উন্নতি-অগ্রগতির পথে হাঁটা যাবে। যে জ্ঞান সহায়ক হবে মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন করা কাজে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সেই সমাজ-প্রগতি অর্জনের জন্য জ্ঞানচর্চা করার কথা, নতুন নতুন জ্ঞান সৃজন করার কথা। শুধু চাকরি-বাকরি পাওয়ার জন্য একটা সার্টিফিকেট প্রদান বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ না। প্রদান বলছি কেন, এখন তো তারা সার্টিফিকেট বেচতেই শুরু করে দিয়েছেন। কিন্তু জ্ঞান-বিদ্যা তো বিক্রির জিনিস না। শিক্ষকদের যদি উচ্চশিক্ষা না পাওয়াদের জন্য এতই উদ্বেগ থাকে, তাহলে তারা নিয়মিতভাবেই আরেকটা সান্ধকালীন শিফট চালু করুক। সরকারের কাছ থেকে বেশি টাকা দাবি করুক। কিন্তু সেটা না করে, ‘অনেককে সুযোগ করে দিচ্ছি’, এই মহান দোহাই দিয়ে তারা নগদ নারায়নের পূজা করবেন। বিশ্ববিদ্যালয়কেও বাজার বানাবেন।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের চেতনাবিরোধী এই বাণিজ্যিক পদক্ষেপের বিরুদ্ধে অনেকবারই আওয়াজ তুলেছিলেন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। ‘শিক্ষা-ব্যবসা, একসাথে চলে না’, এই শ্লোগানে এর আগেও অনেকবার মুখরিত হয়েছে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। যারই সর্বশেষ সংযোজন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এই আন্দোলন। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে নৈশ/সান্ধকালিন বা বৈকালিক; কোনো ধরণের বাণিজ্যিক কোর্সই গ্রহণযোগ্য না। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এই দাবিটাই তুলেছিলেন। তারা কোনো ‘নৈরাজ্য’ করছিলেন না। শান্তিপূর্ণভাবে নিজেদের দাবিদাওয়ার কথা তুলে ধরছিলেন।

বিশ্ববিদ্যালয় চালানোর আর্থিক ভার রাষ্ট্রকেই নিতে হবে

রাষ্ট্র যদি বিশ্ববিদ্যালয় চালানোর ব্যয়ভার পরিপূর্ণভাবে বহন না করে আর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যদি শিক্ষার্থীদের ঘাড়ে পা দিয়ে সেই টাকাটা তুলবার চেষ্টা করা হয়, তাহলে সেটাই রীতিতে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। আর্থিকভাবে অসচ্ছল পরিবারের ছেলেমেয়েদের তখন সেই টাকাটা জোটানোর সামর্থ্য নাও থাকতে পারে। ইতিমধ্যেই বিশ্ববিদ্যালয়ের বড়লোকীকরণ অনেক ক্ষেত্রেই শুরু হয়ে গেছে। কয়েক বছর আগেও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে আসা এমন শিক্ষার্থীদের দেখা যেত, যাদের আর্থিক অবস্থা খুবই অসচ্ছল। ছেলে বা মেয়েকে শিক্ষিত করার বাসনা নিয়ে অতি কষ্টে অর্থের যোগান দিতেন তাদের বাবা-মা। এখন এমন ঘরের ছেলেমেয়েদের খুব বেশি দেখা যাবে কিনা, সন্দেহ আছে। নতুন করে বেতন-ফি বাড়ানো হলে সংখ্যাটা আরও অনেক কমে যাবে। বেতন-ফি না বাড়িয়ে রাষ্ট্রকেই বরং বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্ণ ব্যয়ভার বহন করতে বলা হোক না কেন? শিক্ষকদের তো উচ্চকণ্ঠে বলা উচিৎ যে, অনুৎপাদনশীল খাতগুলোতে বরাদ্দ কমিয়ে শিক্ষাখাতে বেশি বরাদ্দ দেওয়া হোক। কিন্তু সেই দাবি, এমনকি নিজেদের বেতন-ভাতা বাড়ানোর দাবিও তারা কখনো তোলেননি। তারা রাষ্ট্রক্ষমতার পদলেহন করে চলেছেন; শিক্ষার্থীদের বলির পাঁঠা বানিয়ে। শিক্ষার্থীরা যখন ক্রমাগত চিপা খেতে খেতে ফুঁসে উঠছেন, তখন তারা পুলিশ-পেটোয়া বাহিনী নামিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়টাই দিচ্ছেন বন্ধ করে। কিন্তু এভাবে আর কত?

আর কত শিবির জুজু?
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলনে ন্যাক্কারজনকভাবে হামলা চালিয়েছে সরকার সমর্থিত ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা। প্রকাশ্যে অস্ত্র হাতে শিক্ষার্থীদের উপর চড়াও হতে দেখা গেছে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের। পুলিশ সেসময় পাশে দাঁড়িয়ে থেকেও তাদের কিছু বলেনি। ছাত্রলীগের ভাষ্যমতে সাধারণ শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলনে নাকি শিবির ঢুকে গিয়েছিল। এই শিবির জুজু দেখানো হচ্ছে দীর্ঘদিন ধরে। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়কে পচিয়ে ফেলা হয়েছে এই শিবির জুজ দেখিয়ে। শিবির দমনের নাম করে বিশ্ববিদ্যালয়ে অবাধে দুর্নীতি, দলীয়করণ করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। অবাধে সন্ত্রাস চাঁদাবাজি করে এসেছে ছাত্রলীগ। দেশের অন্যতম প্রধান একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেসব ন্যাক্কারজনক ঘটনার কথা অনেকেই জেনেছেন পত্রপত্রিকা মারফত। নতুন করে বলার কিছু নেই। আর এসবের প্রতিরোধ করতে গেলে বরাবরই দেখানো হয়েছে শিবির জুজ। এটা যে নিজেদের দুর্নীতি-লুটপাট আড়াল করার জন্যই করা হয় সেটা বুঝতে কারো আর বাকি নেই। হাজার হাজার শিক্ষার্থী, যারা নিজেদের অস্তিত্ব বাঁচানোর জন্য প্রতিবাদে সামিল হয়েছে, তারা শিবির না। শিবির প্রতিরোধের জন্য ছাত্রলীগ প্রকাশ্যে অস্ত্র হাতে মহড়া দেয় নি। প্রশাসনের সঙ্গে যোগসাজস করে শিক্ষার্থীদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলন বানচাল করার জন্যই চড়াও হয়েছিল প্রশাসনের গুন্ডারা। শিবির প্রতিরোধ তো দূরে থাক, সাধারণ শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে গুঁড়িয়ে দেওয়ার জন্য ছাত্রলীগই যদি শিবিরের সঙ্গে হাত মেলায় তাহলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই।

‘শিবঠাকুরের আপন দেশে/আইনকানুন সর্বনেশে’!
গুলি খেয়ে, স্বল্প সময়ের নোটিশে বিশ্ববিদ্যালয় ত্যাগ করেও নিস্তার পাচ্ছে না আন্দোলনরত সাধারণ শিক্ষার্থীরা। এবার তাদের ওপর নেমে আসছে আইনি সন্ত্রাসের খাঁড়া। বেআইনি সমাবেশ, মারামারি, সরকারি কাজে বাধাদান ও ভাঙচুরের অভিযোগে চারটি মামলা করেছে পুলিশ ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এমনকি প্রকাশ্যে সন্ত্রাস করা ছাত্রলীগও একটা মামলা করেছে তাদের মিছিলে হামলা করার জন্য। সবগুলো মামলায় নামে-বেনামে অসামী করা হয়েছে ৭৯০ জন শিক্ষার্থীকে। মামলায় যাদের নাম উল্লেখ করা হয়েছে, তাদের পরিচয়টুকু পর্যন্ত জানাচ্ছে মতিহার থানা। তদন্তের স্বার্থে নাকি ক্ষতি হবে। বুঝতে কিছুই বাকি থাকে না যে, ‘শিবিরের চর’, ‘চক্রান্তকারী’, ‘বিশ্ববিদ্যালয়কে অস্থিতিশীল করে তোলার চেষ্টারত বিশেষ মহল’Ñ ইত্যাদি নাম দিয়ে এখন আইনি জুলুম নেমে আসবে আন্দোলনকারীদের ওপর। পুলিশ তাদেরকে খুঁজে খুঁজে বের করবে যারা উচ্চকণ্ঠে আওয়াজ তুলেছিলেন ন্যায়ের পক্ষে। আর বেশুমার ঘুরে বেড়াবে অস্ত্র হাতে মহড়া দেওয়া সন্ত্রাসীরা। এ তো সেই ‘শিবঠাকুরের আপন দেশে/আইনকানুন সর্বনেশে’!
বরাবরই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন নিজেদের মতো করে যে কোনো সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন। হাস্যকর হলেও সত্যি যে বাংলাদেশে স্বৈরশাসন থাকার সময় পর্যন্তই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র-সংসদ চালু ছিল। ১৯৯১ সালে ‘গণতান্ত্রিক’ সরকার আসার পর থেকেই সেটা উবে গেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রমে অংশগ্রহণের একমাত্র পথ, ছাত্র সংসদ আর চালু থাকেনি। ফলে নিজেদের দাবির কথাটা জানাতে হলে এভাবেই কাসরুম ছেড়ে রাস্তায় নামতে হয় শিক্ষার্থীদের। নিজেদের স্বার্থবিরোধী কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হলে এভাবে আন্দোলন করা ছাড়া তাদের আর কোনো উপায় থাকে না। আর এই আন্দোলন করতে গিয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীরা কোনোরকম সহিংস আচরণ করেনি। মারামারি-ভাঙচুর করেনি। বরং তারাই হুমকিধামকি-মারধোরের শিকার হয়েছে, গুলি খেয়েছে। কিন্তু উল্টো এখন তাদেরই পড়তে হবে নানাবিধ নিপীড়ণের মধ্যে।

বিশ্ববিদ্যালয়ই আশা
বাংলাদেশের ইতিহাসে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বরাবরই একটা বাতিঘর হিসেবে কাজ করেছে। হাজারো অবক্ষয় সত্ত্বেও এখনো ন্যায়-সাম্য-স্বাধীনতার প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে বিশ্ববিদ্যালয়। এখনো বিশ্ববিদ্যালয়ে মুক্তিপরায়ন শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের পদচারণা আছে বলেই সমাজে কিছু আশা আছে।
ইতিমধ্যেই রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ চরমভাবে বাড়িয়ে দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্ত পরিসর অনেকটাই সংকুচিত করে ফেলা হয়েছে। রাষ্ট্রকর্তৃত্বের শুঁড় আষ্টেপৃষ্টে পেঁচিয়ে ধরেছে স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়কে। যার পরিণতি হিসেবে আমরা প্রতিনিয়তই বিশ্ববিদ্যালয়ের লজ্জাজনক সব দুর্নীতি-লুটতরাজের খবর পত্রপত্রিকায় দেখি। এত কিছুর পরও সমাজকে প্রগতির পথে নিয়ে যেতে পারে এমন একটা প্রতিষ্ঠান পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘটে যাওয়া একটা ‘তুচ্ছ ঘটনা’ই কিন্তু কাঁপিয়ে দিয়েছিল মহা দাপুটে সেনা সমর্থিক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ভিত। খুব সাম্প্রতিক কালেরটা বললাম। আগে আরও কত বড় বড় ঘটনা ঘটেছে সেটা সবাই জানেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যে আরও একবার সমাজে ন্যায় প্রতিষ্ঠার পক্ষে আওয়াজ তুলেছেন, সেজন্য তাদেরকে অভিনন্দন ও ধন্যবাদ।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সান্ধকোর্স বিরোধী আন্দোলন আরও একবার সুযোগ করে দিয়েছে সমাজে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা কী হবে সেটা নিয়ে কথা তোলার। বিশ্ববিদ্যালয়ে কী শুধু সার্টিফিকেট বিক্রি হবে? জামাত-শিবির দমনের নামে অবাধে দুর্নীতি-দলীয়করণ, সন্ত্রাস-চাঁদাবাজী হবে? নাকি এটা স্বাধীন-সায়ত্ত্বশাসিত একটা প্রতিষ্ঠান হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে? সমাজকে প্রগতির পথে এগিয়ে যাওয়ার জন্য পথপ্রদর্শক হিসেবে কাজ করবে? তেমনটা করতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বাধীনভাবে জ্ঞানচর্চা-অনুশীলনের সুযোগ থাকতে হবে। কোনোভাবেই সেটাকে পুলিশি প্রহরায় পরিচালিত একটা বাজার বানানো যাবে না।

ক্রিকেট বিশ্বের বর্তমান সংকটঃ থার্ড আম্পায়ারের ভূমিকা নিবে কে?

আদনান শাহরিয়ার তপু

১৯৯৩ সাল । তখন দাবা বলতে মানুষ কাসপরভকেই বুঝতো । ফিদে’র (দাবার বিশ্বসংস্থা) আয় রোজগারও বেশিরভাগ আসতো কাসপরভের অংশ নেওয়া টুর্নামেন্ট থেকেই । আর তার ব্যক্তিগত স্পন্সরেরও অভাব ছিলো না । বোধহয় সে কারনেই হঠকারী এক সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন তিনি । সেবারের বিশ্বদাবা চ্যাম্পিয়নশিপে কাসপরভের মুখোমুখি হওয়ার কথা ববি ফিশারের । ফিদে তাদের নিয়মনীতির ব্যাতয় ঘটিয়ে তড়িঘড়ি চ্যাম্পিয়নশিপ আয়োজন করলো ম্যানচেস্টারে । অপ্রস্তুত ববি ফিশার যোগাযোগ করলেন কাসপরভের সাথে । অর্থকড়ি নিয়ে বনিবনা না হওয়ায় আগে থেকেই ফিদের উপরে ক্ষিপ্ত কাসপরভ ঘোষণা দিলেন ফিদে থেকে বেরিয়ে যাওয়ার । নিজের তৈরি পিসিএ’র অধীনে ববি ফিশারের সঙ্গে আয়োজন করলেন বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ । ফিদেও কেড়ে নিলো তাদের সদস্যপদ, রেটিং পয়েন্ট ।

cricket

ডালমিয়া আইসিসির প্রধান হন ১৯৯৭ সালে । মূলত তার প্রচেষ্টাতেই বাংলাদেশ টেস্ট স্ট্যাটাস পায় সত্যি কিন্তু এর পেছনে তার ক্রিকেট বিশ্বায়ন নামের সুন্দর চেতনার আড়ালে যে অর্থকড়ির সংস্থানের ধুরন্ধর মস্তিস্কটি ছিলো তা চিরতরে বদলে দিলো ক্রিকেটকে । স্পন্সরশিপ, বাজার অর্থনীতি দিয়ে ভারত হয়ে গেলো সবচেয়ে ধনী ক্রিকেট বোর্ড আর বদলে যেতে শুরু করলো ক্ষমতার সমীকরণ । ক্রিকেটে ব্যবসা যেমন এনে দিয়েছে পেশাদারিত্ব তেমনি কেড়ে নিয়েছে নীতিবোধ । খুব স্বাভাবিকভাবেই অর্থের ছড়াছড়ি প্যান্ডরার বাক্স ভেঙ্গে বের করে এনেছে লোভ । আর সেই লোভকে পুজি করে জুয়াড়িরা পকেটে ভরছে বিশ্বাসযোগ্যতা আর বিসিসিআই চাইছে এককেন্দ্রিক ক্ষমতা । আইপিএলে যত হাজার কোটি টাকার জুয়ায় লেনদেন হয় সেটা জানার পর এটাতে আর কোনও সন্দেহই থাকেনা যে, বিসিসিআই আইসসিসির পুরো ক্ষমতা পেলে ক্রিকেট খেলাটা আসলে নিয়ন্ত্রিত হবে জুয়াড়িদের লাভক্ষতির হিসেব নিকেশে ।

Cartoon-741738


ক্ষমতার নেশায় বিসিসিআই এখন আলাদা হয়ে যাওয়ার হুমকি দিতেও পিছু হটছে না । কিন্তু তারা ভুলে যাচ্ছে তারা ক্রিকেট খেলাটার উর্ধে না । ক্রিকেটের জন্য বিসিসিআই , বিসিআই এর জন্য ক্রিকেট না । আজ তারা স্পন্সরদের ঘাড়ে পা রেখে ভয় দেখাচ্ছে, কিন্তু আলাদা হয়ে যাওয়ার পর যখন শুধু তিন দেশের মধ্যে তাদের খেলা সীমাবদ্ধ হয়ে যাবে তখন স্পন্সরাও কি সেটা ভালো ভাবে নেবে?? কে দেখতে চাইবে ঘুরে ফিরে তিন দেশের খেলা ?? কাসপরভ ফিদে থেকে আলাদা হয়ে দুই বছর কোনোওক্রমে পিসিএ চালানোর পর আবার ফিদের সাথে যুক্ত হওয়ার চেষ্টা করেন এবং পরে তিনি স্বীকার করেন, ফিদেকে ছেড়ে যাওয়া তার ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বড় ভুল ছিলো ! কারণ, ওই নির্দিষ্ট কয়েকজন প্রতিযোগীর সাথে ঘুরে ফিরে কাসপরভের খেলা কারোরই বেশিদিন আগ্রহের কেন্দ্রে থাকেনি।

আমরা মানতে যতই ঘৃণা করিনা কেনও সত্যি কথাটা হলো, ক্রিকেট অর্থনীতি ভারতের বাজারের উপর অনেক অংশেই নির্ভর । সেই বাজার হারিয়ে ফেললে, ক্রিকেটারদের আর্থিক সচ্ছলতা কমবে তবে এই চরম স্বার্থপরতার যুগে ক্রিকেটের মূল চেতনা ফিরে আসবে বলে যারা আশা করছেন তা নিতান্তই দুরাশা । বরং দুই দিকে দুইরকম আর্থিক পরিস্থিতি এক চরম বিশৃঙ্খল অর্থনৈতিক অসাম্যের জন্ম দিবে । একসময় এটিই এই খেলা থেকে দর্শক, স্পন্সর সবাইকে মুখ ফিরিয়ে নিতে বাধ্য করবে । মৃত্যু হবে খেলাটির । যেমন, কাসপরভ চলে যাওয়ার পর ফিদের উপর অসন্তুষ্ট স্পন্সরদের কারনে, ফিদের আবার নতুন করে গুছিয়ে উঠতে দীর্ঘ সময় লেগেছিলো ।


সব মিলিয়ে ক্রিকেট এখন এক কঠিন সঙ্কটে । ভারতের অসম্ভব প্রস্তাব মেনে নেওয়া যায়না , একদিন না একদিন এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ উঠতই । আবার ভারত, অস্ট্রেলিয়া এবং ইংল্যান্ড আলাদা হয়ে গেলে অন্যান্য ক্রিকেটাররা আর সেসব জায়গায় খেলতে পারবে না এটা মেনে নেওয়াও কঠিন , কারণ কে জানে একজন ক্রিকেটারের ক্রিকেট সামর্থ্যের বড় পরীক্ষাটাই হয় অস্ট্রেলিয়া আর ইংল্যান্ডে ।

যদিও আমার আবেগে টইটুম্বুর মন, বারবার বলছে, যাক বিসিসিআই জাহান্নামে ! তারপর একটা শিক্ষা হোক তাদের । কিন্তু সমস্যা হলো, তাতে ক্রিকেটেরই ক্ষতি। তাই প্রার্থনা, বর্তমানে যেমন আছে তেমনই থাক ক্রিকেট । ক্রিকেটের বড় ভাইরা বুঝুক, গৃহবিবাদে কারও লাভ হয়না । কেউ তাদের বোঝাক, জমিদারী প্রথা কিংবা দুই মেরুর ক্রিকেট বিশ্ব দুটোই চরম ক্ষতিকর ক্রিকেট খেলাটির জন্য ।

কিন্তু প্রশ্ন একটাই, এই সঙ্কটে থার্ড আম্পায়ারের ভূমিকা নিবে কে ??