সুর কেন মানুষকে টানে
ফাহমিদা উর্ণি
তানসেনের কথা কে না জানি আমরা। গান গেয়ে তিনি নাকি বৃষ্টি নামাতেন। আর সুরের টানে পথে নামা কিংবা বৈরাগ্যসাধন; সেও আমাদের প্রাচ্যভূমির এক চেনাজানা ঐতিহ্য। সুরের মধ্য দিয়ে পরওয়ারদিগারের সঙ্গে নিজের সম্পর্কসূত্র আবিস্কারের চেষ্টা করেছেন ছেউড়িয়ার লালন ফকির। আমরা যারা সাধারণ তাদের ক্ষেত্রেও একই বাস্তবতা। আজন্ম-আমৃত্যু সুরের মূর্চ্ছনায় তাড়িত হয় মানুষ। সিক্ত হয়, আন্দোলিত হয়, বেদনার্ত হয়, আপ্লুত হয়। সঙ্গীত মানুষকে যেভাবে আকর্ষণ করে অন্য কোন স্বর-শব্দই তা পারে না। কিন্তু কেন? দীর্ঘদিন ধরে এর উত্তর খুঁজে যাচ্ছেন বিজ্ঞানীরা। নানা গবেষণার পর অবশেষে কিছু কারণ শনাক্ত করতে পেরেছেন তারা।
মানুষের মস্তিষ্কে সঙ্গীতের প্রভাব কী; তা নিয়ে গবেষণা করছেন এমন একজন স্নায়ুবিজ্ঞানী ভ্যালোরি সালিমপুর। তাঁর মতে, সঙ্গীত মানুষের মস্তিষ্কের আবেগের এলাকার গভীরে উন্মাদনা তৈরি করে। তবে ভ্যালোরির দাবি; বিচ্ছিন্ন স্বর-শব্দের চেয়ে একত্রিত এবং গোছালো ধরনের স্বর-শব্দ অনেক বেশি কার্যকরী আর শক্তিশালী। ফাংশনাল এমআরআই প্রযুক্তি ব্যবহারের মধ্য দিয়ে ভ্যালোরি আর তার সহযোগীরা যেতে চাইলেন আরও গভীরে। খুঁজে পেলেন কিছু চমৎকৃত হবার মতো উত্তর।
সঙ্গীতের প্রতি মানুষের টান যৌনতার মতোই জৈবিক
ফাংশনাল এমআরআই মেশিনের মাধ্যমে একদল লোকের মস্তিষ্কের কর্মকাণ্ড রেকর্ড করেন ভ্যালোরি এবং তার সহকর্মীরা। যাদের মস্তিষ্কের কর্মকাণ্ড রেকর্ড করা হয় তারা সেসময় তাদের পছন্দের গান শুনছিলেন। দেখা যায়, গানের চূড়ান্ত আবেগঘন মুহূর্তগুলোতে শ্রোতার মস্তিষ্কের নিউক্লিয়াস একামেবনস্-এর মধ্যে আনন্দ উদ্রেককারী হরমোন ডোপামিন সচল হয়ে ওঠে। ভ্যালোরির মতে, ডোপামিনের এ ধরনের সচলতা খুবই বড় ব্যাপার। কারণ খাবার গ্রহণ কিংবা যৌনতার মত জৈবিকভাবে আনন্দ লাভের সময়গুলোতেই ডোপামিনের সচলতা বেড়ে যায়। এমনকি কোকেনের মত খুব আসক্তি তৈরিকারী মাদক গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গেও ডোপামিন সচল হয়।
মানুষের মস্তিষ্কে আরেকটি অংশ আছে যা চূড়ান্ত আবেগঘন মুহূর্তেও আগের সময়টুকুতে ডোপামিনকে বয়ে নিয়ে যায়। মূলত আনন্দ লাভের জন্য প্রতীক্ষাজনিত অনুভূতি তৈরির কাজ করে এ নিউক্লিয়াস। অর্থাৎ যে পরিচিত গানটি আমরা শুনছি তার কোন অংশ আমাদের মধ্যে আবেগ তৈরি করবে তা আমরা আগে থেকেই জানি এবং সে অংশের জন্য অপেক্ষা করি। আর এ প্রতীক্ষা এবং আনন্দলাভ এ দুটির দারুণ সম্মিলনই বলে দেয়, মানুষ জৈবিকভাবেই নিজের পছন্দের গান শুনতে চায়।
সুরের আবেদন সার্বজনীন, ব্যাকরণ বিশ্বজনীন
পরবর্তী ধাপে শ্রোতাদের অপরিচিত গান শুনতে দেন ভ্যালোরি আর তার সহযোগীরা। আর এর মধ্যে যে গানটি ভালো লাগবে সে গানটি কেনার জন্য শ্রোতাদের টাকাও দেয়া হয়। তবে এক্ষেত্রে গান শোনার সময় শ্রোতাদের নিউক্লিয়াস একামবেনস আর কর্টিক্যাল স্ট্রাকচারের মধ্যে মিথষ্ক্রিয়া বেড়ে যায়। মূলত কোন কিছু শনাক্তকরণ, নির্দিষ্ট সুরটি মনে রাখা এবং আবেগগত প্রক্রিয়ার কাজে নিয়োজিত থাকে কর্টিক্যাল স্ট্রাকচার। আর এর মধ্য দিয়ে বোঝা যায়, মানুষ যখন অপরিচিত গান শোনে তখন মেমোরি সার্কিটের মাধ্যমে মস্তিষ্ক ওই সুরকে শনাক্ত করার চেষ্টা করে। গানটি কোন দিকে এগিয়ে যাচ্ছে তাও অনুমান করতে চায় মস্তিষ্ক। গানটি একেবারেই ভীনদেশের কিংবা অবোধগম্য হলেও, ওই সুরের মধ্যে পরিচিত কোন উপকরণ অর্থাৎ পরিচিত কোন বিট বা মেলোডি থাকলে মানুষ সেই গান বা সুরের আবেশি মুহূর্ত সহজেই শনাক্ত করতে পারে এবং তা উপভোগও করে থাকে।
মানুষ কেন একই গান বার বার শোনে?
বিজ্ঞানীদের মতে সুরের পছন্দের অংশটির ব্যাপারে মানুষের মধ্যে যে আবেগজনিত তাড়না তৈরি হয় তা অনেক বছর পর্যন্ত থেকে যায়। আর তাই একই গান বার বার উন্মাদনা তৈরি করতে পারে মানুষের মস্তিষ্কে। অনেক বছর পরও সঙ্গীতস্মৃতি শুধুই আবেগ অনুভূত হওয়ার ব্যাপার।
সঙ্গীত কিভাবে স্নায়ুকে সুসংগত করে?
কানেকটিকাট ইউনিভার্সিটির সঙ্গীতবিষয়ক মনস্তাত্ত্বিক এড লার্জ এর মতে, ছন্দের ঊর্ধ্বগামীতা কিংবা নিম্নগামীতা কিংবা শান্ত অথবা জোরালো শব্দভেদে মানুষের মস্তিষ্কে আলাদা আলাদা অনুভূতি তৈরি হয়। লার্জ বলেন, মেলোডি একই থাকার পরও গান যখন তার বৈচিত্র্য হারিয়ে ফেলে তখন ওই গানের প্রতি আবেগ হারিয়ে ফেলেন শ্রোতা। তাঁর মতে, এক্ষেত্রে কাজ করে মিরর নিউরন। মানুষ বাইরে যা দেখে তা নিজের ভেতরে উপলব্ধি করতে সহায়তা করে ওই নিউরন।
একই গানে সবার আনন্দ একই রকমের হয় না কেন?
একই গান সবার মধ্যে একই প্রতিক্রিয়া তৈরী করে না কেন; সে প্রশ্নেরও উত্তর দিয়েছেন লার্জ। তিনি জানান, যে গানটি শোনা হচ্ছে তাতে শ্রোতার মস্তিষ্কে নিউরনগুলো কতটা যুক্ত, সেই শ্রোতার গান শোনা ও পরিবেশনের ব্যক্তিগত ইতিহাস কী; তার উপরই ওই গান নিয়ে শ্রোতার প্রতিক্রিয়া তৈরী হয়। তাই ব্যক্তিভেদে প্রতিক্রিয়ার পার্থক্য হয়। লার্জের মতে, ছন্দ হলো অনুমানের ব্যাপার। একেবারে শৈশব থেকেই মানুষ নিজস্ব সাংস্কৃতিক পরিবেশে ছন্দের দ্বারা তাড়িত হয়। আর গান শোনার সঙ্গে সঙ্গে মানুষ অতীতের যে স্মৃতি ও আবেগ দ্বারা তাড়িত হয় তা একেক মানুষের ক্ষেত্রে একেক রকমের হতে পারে বলেও দাবি করেন তিনি। পছন্দের বিষয়টি একেবারেই মানসিক উল্লেখ করে লার্জ বলেন, অনেকসময় সামাজিক প্রেক্ষাপটও এক্ষেত্রে প্রভাব ফেলতে পারে। সূত্র: ডেইলি গুডস
প্রাসঙ্গিক: কেন কিছু গান মনে গেঁথে যায়