মালিঙ্গা ম্যাজিক

২০০৭ বিশ্বকাপটা অল্পের জন্য হাতছাড়া হয়ে গিয়েছিল শ্রীলঙ্কার। বৃষ্টিবিঘ্নিত ফাইনালে টুর্নামেন্ট আয়োজকদের নানারকম সিদ্ধান্তহীনতা, আইন-কানুনের জটিল মারপ্যাঁচের ফলে শেষপর্যন্ত শিরোপাটা উঠেছিল রিকি পন্টিংয়ের অস্ট্রেলিয়ার হাতে। তবে এই বিশ্বকাপটা বিশেষভাবে স্মরণীয় করে রেখেছিলেন শ্রীলঙ্কার ফাস্ট বোলার লাথিস মালিঙ্গা। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে সুপার এইটের একটি ম্যাচে সোনালী চুলের এই পেসার বিশ্বকাপ ইতিহাসের পঞ্চম বোলার হিসেবে হ্যাট্রিক করেছিলেন। শুধু হ্যাট্রিক বললেই এর মাহাত্মটা ঠিকমতো বোঝানো যাবে না। আসলে ক্রিকেট ইতিহাসের প্রথম বোলার হিসেবে তিনি নিয়েছিলেন টানা চার বলে চার উইকেট।

২০০৭ বিশ্বকাপের ২৬ তম ম্যাচ ছিল সেটি। গায়ানার বোলিং সহায়ক উইকেটে টসে জিতে প্রথমে ব্যাট করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন শ্রীলঙ্কান অধিনায়ক মাহেলা জয়াবর্ধনে। শুরু থেকেই শন পোলক, মাখায়া এনটিনি, চার্ল ল্যানজেভেল্টের দুর্ধর্ষ বোলিংয়ের সামনে চাপের মুখে পড়ে যান শ্রীলঙ্কান ব্যাটসম্যানরা। ল্যানজেভেল্ট মাত্র ৩৯ রানের বিনিময়ে নিয়েছিলেন পাঁচ উইকেট। তিন বল বাকি থাকতেই শ্রীলঙ্কার ইনিংস গুটিয়ে গিয়েছিল ২০৯ রানে।

২১০ রানের টার্গেটটা খুব বেশি কঠিন ছিল না গিবস, ডি ভিলিয়ার্স, ক্যালিস, স্মিথদের নিয়ে সাজানো ব্যাটিং লাইন আপের জন্য। মুরালিধরন, মালিঙ্গা, ভাসদের বোলিংয়ের সামনে খুব বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ না করলেও ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছিলেন জয়ের দিকে। ৪৪ ওভার শেষে দক্ষিণ আফ্রিকার সংগ্রহ ছিল ৫ উইকেটে ২০০ রান। জয়ের জন্য তখন দরকার মাত্র ১০ রান। হাতে আছে আরো পাঁচ উইকেট। এমন ম্যাচ হারার কথা বা হারার সম্ভবনা তৈরি হওয়ার কথা কেউ স্বপ্নেও ভাবে না। কিন্তু সেদিন মালিঙ্গা ম্যাজিকে নড়েচড়ে বসেছিল গায়ানার প্রোভিডেন্স স্টেডিয়ামের দর্শকরা।

৪৫ তম ওভারে দ্বিতীয় স্পেলে বল করতে আসলেন মালিঙ্গা। প্রথম চার বলেই একটা চারসহ মোট ছয় রান নিয়ে জয়টাকে একেবারেই হাতের মুঠোয় নিয়ে আসলেন শন পোলক। তখনও কেউ কল্পনাও করতে পারেন নি যে, এরপর কী জাদু দেখাতে যাচ্ছেন শ্রীলঙ্কান এই ফাস্ট বোলার। পঞ্চম বলটাতে উপড়ে গেল শন পোলকের লেগ স্ট্যাম্প। এবার উইকেটে আসলেন নতুন ব্যাটসম্যান অ্যান্ড্রু হল। মালিঙ্গার ইয়র্কারটা ঠিকমতো খেলতে পারলেন না তিনি। ধরা পরলেন কাভারে দাঁড়ানো উপল থারাঙ্গার হাতে। দক্ষিণ আফ্রিকার স্কোর তখন ৭ উইকেটে ২০৬ রান। জয়ের জন্য দরকার ৩০ বলে মাত্র ৪ রান। চামিন্ডা ভাসের পরের ওভারে মাত্র এক রানই নিতে পেরেছিলেন জ্যাক ক্যালিস।

৪৭ তম ওভারের প্রথম বলেই জ্যাক ক্যালিসকে উইকেটের পেছনে ক্যাচ দিতে বাধ্য করলেন মালিঙ্গা। বিশ্বকাপ ইতিহাসের পঞ্চম বোলার হিসেবে গড়লেন হ্যাট্রিক করার বিরল কীর্তি। কিন্তু এখানেই থেমে থাকল না মালিঙ্গার গ্রেনেডসদৃশ বলগুলো। পরের বলে তিনি চমত্কার এক ইয়র্কারে উড়িয়ে দিলেন মাখায়া এনটিনির স্ট্যাম্প। পর পর চার বলে চার উইকেট। জয়ের জন্য তখনও দুই রান দরকার প্রোটিয়াদের। মালিঙ্গার দুর্ধর্ষ বোলিংয়ে জয়সূচক সেই দুইটা রানই যেন তখন মনে হচ্ছিল অনেক দূরের ব্যাপার। মালিঙ্গার পরের চার বলে আর কোন রান নিতে পারলেন না দক্ষিণ আফ্রিকার শেষ দুই ব্যাটসম্যান, পিটারসন ও ল্যানজেভেল্ট। ভাসের ৪৮তম ওভারটাও মেইডেন। জয়ের জন্য তখনও দরকার সেই দুই রান। আবার বল হাতে দৌড় শুরু করলেন মালিঙ্গা। প্রথম বলটাতে ব্যাটই ছোঁয়াতে পারলেন না পিটারসন। দ্বিতীয় বলে ব্যাটের কানা ছুঁয়ে বল চলে গেল থার্ড ম্যান দিয়ে সীমানার বাইরে। চার।

এক উইকেটের ঘাম ঝড়ানো জয় পেল দক্ষিণ আফ্রিকা। শ্রীলঙ্কা শেষপর্যন্ত ম্যাচটা জিততে না পারলেও মালিঙ্গা একটা নির্জীব ম্যাচে যেভাবে প্রাণের সঞ্চার করেছিলেন তা এখনো স্মরণীয় হয়ে আছে ক্রিকেটপ্রেমীদের মনে।

ফ্লাওয়ার-ওলোঙ্গার অভিনব প্রতিবাদ

ক্রীড়াঙ্গনকে রাজনীতির আওতার বাইরে রাখার আকাঙ্ক্ষাটা বোধহয় সবাই কমবেশি লালন করেন। আর বিশ্বকাপের মতো আসরে তো এই চাওয়ার পরিমাণটা অনেক বেশিই থাকে। কিন্তু এই বিশ্বকাপের আসরেই ইতিবাচক রাজনৈতিক তত্পরতা চালিয়ে একটা অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত তৈরি করেছিলেন অ্যান্ডি ফ্লাওয়ার ও হেনরি ওলোঙ্গা।

সময়টা ২০০৩ সাল। জিম্বাবুয়েতে তখন চলছে মুগাবের একদলীয় শাসন। মানবাধিকার হরণ, সামাজিক নিরাপত্তা ইত্যাদি ইস্যুতে চলছিল নিরন্তর বিতর্ক। একঘরে হয়ে যেতে বসেছিল জিম্বাবুয়ের ক্রিকেট অঙ্গনও। বিশ্বকাপ শুরুর ঠিক একমাস আগে ইংল্যান্ড বাতিল করেছিল তাদের জিম্বাবুয়ে সফর। ইংল্যান্ড এই সফর বাতিলের পেছনে নিরাপত্তার অজুহাত দেখালেও নীতিগত বিষয়ে জিম্বাবুয়ের স্বৈরশাসনের সঙ্গে একমত হতে না পারাই ছিল এর অন্যতম প্রধান কারণ। বিশ্বকাপ শুরুর আগ দিয়েও জিম্বাবুয়ের শাসকগোষ্ঠী কিছুটা ভয়ে ছিল যে, বিশ্বকাপে জিম্বাবুয়ের ম্যাচগুলোতে হয়তো গ্যালারি থেকে এই স্বৈরশাসনের প্রতিবাদ জানানো হতে পারে। এমন ভয়ের কিছুটা যৌক্তিক কারণও ছিল। কারণ এক বছর আগে বুলাওয়েতে একটা ম্যাচে এরকম প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে নিহত হয়েছিলেন এক বিক্ষোভকারী। যাই হোক, শেষপর্যন্ত সবাই ক্রিকেটের দিকেই বেশি মনোযোগ দেওয়ায় কিছুটা হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিলেন জিম্বাবুয়ের শাসকরা।

কিন্তু জিম্বাবুয়ের শাসকগোষ্ঠীকে খুব বেশি সময় স্বস্তিতে থাকতে দেন নি অ্যান্ডি ফ্লাওয়ার ও হেনরি ওলোঙ্গা। নামিবিয়ার বিপক্ষে জিম্বাবুয়ের প্রথম ম্যাচের আগে তাঁরা সাংবাদিকদের কাছে একটা লিখিত বিবৃতিতে জানালেন যে, ‘জিম্বাবুয়েতে গণতন্ত্র-হরণের শোকে’ তাঁরা হাতে কালো বাহুবন্ধনী বেঁধে মাঠে নামবেন। ফ্লাওয়ার ও ওলোঙ্গা বেশ ভালোমতোই জানতেন যে, এই প্রতিবাদ করার সাহস দেখানোর জন্য তাঁদের ক্রিকেট ক্যারিয়ারের অবসান ঘটতে পারে। এমনকি তাদেরকে দেশ থেকেও বের করে দেওয়া হতে পারে। কিন্তু তারপরও তাঁরা তাদের এই অভিনব প্রতিবাদের মাধ্যমে জিম্বাবুয়ের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে একটা বিশ্ব জনমত গড়ে তোলার সুযোগ হাতছাড়া করতে চান নি। সেই সঙ্গে অন্য কেউ যেন বিপদে না পড়ে, সেজন্য তারা খুব ভালোমতোই জানিয়ে দিয়েছিলেন যে, এই কালো বাহুবন্ধনী ধারণের সিদ্ধান্তটা তাঁদের একান্তই ব্যক্তিগত ব্যাপার। এমনকি তাঁরা যে এই কাজটা করতে যাচ্ছেন সেটা সতীর্থদেরও অনেকে জানতেন না।

খেলার শুরুতে সাংবাদিকদেরকে এই প্রতিবাদ সম্পর্কে জানানো হলেও খেলার ২২ তম ওভার পর্যন্ত আর কারোরই এ ব্যাপারে কোন ধারণাই ছিল না। ২৩তম ওভারে ব্যাট হাতে মাঠে নামলেন অ্যান্ডি ফ্লাওয়ার। দেখা গেল সত্যিই তিনি মাঠে নেমেছেন কালো একটা বাহুবন্ধনী বেঁধে। এরপর ক্যামেরার চোখ খুঁজে নিল ওলোঙ্গাকেও। হারারে স্টেডিয়ামের ব্যালকনিতে দাঁড়ানো ওলোঙ্গার হাতেও দেখা গেল একই ধরণের জিনিস। তাদের হাতের ঐ কালো ব্যান্ডগুলো সেদিন জ্বল জ্বল করে জানিয়ে দিয়েছিল জিম্বাবুয়েতে গণতন্ত্র হরণের করুণ কাহিনী।

পরবর্তী ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া বোধহয় কিছুটা আঁঁচ করতে পারছেন সবাই। যথারীতি জিম্বাবুয়ের শাসকগোষ্ঠী মরীয়া হয়ে ওঠে ভিন্নমত প্রকাশের এই অভিনব উপায়টা বন্ধ করার জন্য। তাঁরা আইসিসির কাছে দাবি জানায় ফ্লাওয়ার ও ওলোঙ্গার এই কর্মকাণ্ড অবৈধ ঘোষণা করার জন্য। আইসিসি তাদের এই ডাকে পুরোপুরি সাড়া দেয় নি। তারা শুধু প্রতিবাদী দুই ক্রিকেটারের কাছে অনুরোধ করেছিল যেন পরবর্তীতে তারা আর এ ধরণের কিছু না করে। বাকিটা তারা ছেড়ে দিয়েছিল জিম্বাবুয়ের ক্রিকেট বোর্ডের কাছে। কিন্তু আইসিসির অনুরোধে কান দেন নি ফ্লাওয়ার-ওলোঙ্গা। তারা পরবর্তীতেও কালো বাহুবন্ধনী বেঁধেই মাঠে নামার সিদ্ধান্তে অটল ছিলেন। হেনরি ওলোঙ্গা খুব পরিস্কারভাবেই জানিয়েছিলেন, ‘তারা যদি আমাকে দল থেকে বের করে দিতে চায় তো দিতে পারে। আমার কিছু যায় আসে না।’ স্বৈরতন্ত্রের চরিত্র সম্পর্কে তাঁর অনুমানটা সঠিকই ছিল। পরবর্তী ম্যাচ থেকেই বহিস্কার করা হয় ওলোঙ্গাকে। অ্যান্ডি ফ্লাওয়ারকেও বহিস্কার করার কথা উঠতেই বেঁকে বসেন দলের বাকি খেলোয়াড়রা। সবার খেলা বর্জনের হুমকির মুখে শেষপর্যন্ত দলে রাখতেই হয় ফ্লাওয়ারকে।

যে উদ্দেশ্যে এতখানি ঝুঁকি নিয়ে ফ্লাওয়ার আর ওলোঙ্গা এই প্রতিবাদ করার স্পর্ধা দেখিয়েছিলেন, তা কিন্তু অনেকখানিই সফল হয়েছিল। তাঁরা তাদের এই একান্ত ব্যক্তিগত এই উদ্যোগটা ছড়িয়ে পড়েছিল দর্শকদের মাঝেও। জিম্বাবুয়ের পরবর্তী ম্যাচগুলোতে এই কালো বাহুবন্ধনী পড়ে আসতে দেখা গিয়েছিল অনেক দর্শককেই।

টমসনের আগুনের গোলা

ওয়ানডে ক্রিকেটের শুরুর দিকে ক্রিকেট জগতের সবচেয়ে বিধ্বংসী বোলিং জুটি হিসেবে গণ্য করা হতো দুই অস্ট্রেলিয়ান ফাস্ট বোলার ডেনিস লিলি ও জেফ টমসনকে। ওয়েস্ট ইন্ডিজ কিংবদন্তী ক্লাইভ লয়েড তাঁর দেখা সবচেয়ে দ্রুতগতির বোলারের নাম বলতে গিয়ে বলেছেন টমসনের কথা। ১৫০ কিমি বেগে থমসন যে বলগুলো ছুঁড়তেন সেগুলোকে বুলেট গতিতে ছুটে যাওয়া এক একটা আগুনের গোলার সঙ্গেও তুলনা করা যায় অনায়াসে। আর সে আমলে তো এখনকার মতো সুরক্ষা ব্যাটসম্যানদের ছিল না। হেলমেট, হ্যান্ডপ্যাড ছাড়া এই বিধ্বংসী বোলারের মুখোমুখি হয়ে অনেকেই শুধু যে উইকেটটি খুইয়েছেন তাই নয়। বরং শারিরীকভাবেও আহত হয়েছেন-এমন উদাহরণ প্রচুর পাওয়া যাবে। এ ধরণেরই একটা ঘটনা ঘটেছিল প্রথম বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে শ্রীলঙ্কার তৃতীয় ম্যাচটাতে। টমসনের গোলার আঘাতে আহত হয়ে রীতিমতো হাসপাতালে যেতে হয়েছিল দুই শ্রীলঙ্কান ব্যাটসম্যান সুনীল ওয়েট্টিমুনি ও দিলীপ মেন্ডিসকে।

টেস্ট খেলুড়ে দেশগুলোর বাইরে শুধু শ্রীলঙ্কা আর পূর্ব আফ্রিকাই অংশ নিয়েছিল প্রথম বিশ্বকাপে। অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে আগে কখনো টেস্ট না খেলার কারণে ডেনিস লিলি বা জেফ টমসনের বিধ্বংসী বোলিং সম্পর্কে কোন ধারণাই ছিল না লঙ্কানদের। বিশ্বকাপে তাদের প্রথম ম্যাচে নিউজিল্যান্ডের কাছে তারা হারে ৯ উইকেটে। দ্বিতীয় ম্যাচে অ্যান্ডি রবার্টস, বার্নার্ড জুলিয়েন, কেইথ বোয়েসদের সামনে তারা গুটিয়ে যায় মাত্র ৮৬ রানে। এই ম্যাচটাও তাদের হারের ব্যবধান ৯ উইকেট। তৃতীয় ম্যাচে এবার আর আগে ব্যাট করতে নামতে হয় নি শ্রীলঙ্কাকে। টসে জিতে প্রথমে বল করাটাকেই সুবিধাজনক মনে করেছিলেন শ্রীলঙ্কান অধিনায়ক আনুরা টেন্নেকুন। অ্যালান টার্নারের সেঞ্চুরির সুবাদে শ্রীলঙ্কাকে ৩২৯ রানের (৬০ ওভারে) লক্ষ্য বেঁধে দেয় অস্ট্রেলিয়া।

প্রথম দুই ম্যাচের মতো এবার আর অতটা হুড়মুড়িয়ে ভেঙ্গে পড়লেন না লঙ্কান ব্যাটসম্যানরা। বেশ ভালোই লড়তে লাগলেন লিলি-টমসনদের বিধ্বংসী বোলিংয়ের সামনে। ৩২ ওভারে মাত্র ২ উইকেট হারিয়ে তারা সংগ্রহ করেছিলেন ১৫০ রান। কিন্তু তারপর যেন একেবারে রুদ্রমুর্তি ধারণ করলেন জেফ টমসন। দ্বিতীয় স্পেলে বল করতে এসে যেন আগুন ঝড়াতে লাগলেন ওভালের বাউন্সি উইকেটে। ৩২ রান করে ঐ গোলার আঘাতে একেবারে হাসপাতালে চলে যেতে হয় মেন্ডিসকে। অপরপ্রান্তে দাঁড়ানো ওয়েট্টিমুনির মানসিক অবস্থাটা তখন কেমন ছিল, তা অনুমান করাই যায়। কিন্তু ৫২ রান করে তখনও বেশ ভালোই লড়ে যাচ্ছিলেন তিনি। বেশ কয়েকবার তাঁর গায়ে বল লাগলেও হার মানেন নি। কিছুক্ষণ সেবাশুশ্রুসার পর আবার ব্যাট হাতে দাঁড়িয়েছেন। এতেই যেন বলের গতি আরো বাড়িয়ে দিলেন টমসন। কিছুক্ষণ পরে এবার আর শেষরক্ষা করতে পারলেন না ওয়েট্টিমুনি। মাথায় গুরুতর আঘাত পেয়ে মেন্ডিসের পিছু পিছু তাকেও যেতে হলো হাসপাতালে। তবে তার আগে তিনি পূর্ণ করতে পেরেছিলেন ক্যারিয়ারের প্রথম অর্ধশতক।

ওয়েট্টিমুনি পরে টমসনের সেই স্পেলটার কথা স্মরণ করতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘ঐ বলগুলো ছিল একেকটা আলোর ঝলকানির মতো। আমি সেগুলো একটাও দেখতে পাই নি।’ আর মেন্ডিস বলেছিলেন, ‘সে বল করছিল ১০০ মাইল গতিতে। আমি এরচেয়ে দ্রুতগতির বল কখনো মোকাবিলা করিনি।’ টমসন অবশ্য তার বাউন্সারগুলোকে সত্যিকারের বাউন্সার বলতে রাজি নন। তাঁর মতে তিনি স্বাভাবিকভাবেই বল করছিলেন! শ্রীলঙ্কান ব্যাটসম্যানদের গড় উচ্চতা অনেক কম বলে ওগুলো নাকি বাউন্সার বলে মনে হয়েছিল! সেই ম্যাচে ১২ ওভার বল করে মাত্র ২২ রান দিয়ে একটি উইকেট নিয়েছিলেন টমসন। তাঁর উইকেট একটা গণ্য হলেও কার্যত তিনি আরো দুইজনকে সাজঘরে (হাসপাতালেই বলা ভালো) পাঠিয়েছিলেন। শেষপর্যন্ত সেই ম্যাচটা শ্রীলঙ্কা হেরেছিল ৫২ রানে।

ট্র্যাজেডির সেমিফাইনাল

১৯৯৯ সালের বিশ্বকাপ সেমিফাইনালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে দক্ষিণ আফ্রিকার ট্রাজিক বিদায়টার কথা এখনো ভুলতে পারেন নি ক্রিকেটপ্রেমীরা। ম্যাচটা ড্র হয়ে গেলেও পয়েন্ট মারপ্যাঁচের ফাঁদে পড়ে বিদায় নিতে হয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকাকে। প্রোটিয়াসদের সেমিফাইনাল ট্রাজেডি কিন্তু সেটাই প্রথম না। এর আগে ১৯৯২ সালের বিশ্বকাপ সেমিফাইনালেও জঘন্য কিছু আইন-কানুনের জালে আটকে গিয়েছিল তাদের বিশ্বকাপ জয়ের স্বপ্ন।

১৯৯২ সালেই বিশ্বকাপে প্রথমবারের মতো অংশ নিয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকা। তার আগে বর্ণবাদ বিতর্কের ঘেরাটোপে আটকে বেশ কিছুদিন আন্তর্জাতিক ক্রিকেট অঙ্গনেরই বাইরে ছিল তারা। বিশ্বকাপে তাদের প্রথম ম্যাচে স্বাগতিক অস্ট্রেলিয়াকে ৯ উইকেটে হারিয়ে শুরুটাও করেছিল দুর্দান্তভাবে। তারপর একে একে ওয়েস্ট ইন্ডিজ, পাকিস্তান, জিম্বাবুয়ে, ভারতকে হারিয়ে উঠে এসেছিল সেমিফাইনালে। অধিনায়ক কেপলার ওয়েলস, অ্যালান ডোনাল্ড, হ্যানসি ক্রনিয়ে, জন্টি রোডসরা অসাধারণ পারফরমেন্স দেখিয়ে মুগ্ধ করে দিয়েছিলেন ক্রিকেট বিশ্বকে। পাকিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচটিতে জন্টি রোডস যেভাবে ইনজামামকে রান আউট করেছিলেন তা এখনো জ্বলজ্বল করছে বিশ্বকাপ ইতিহাসের পাতায়।

দক্ষিণ আফ্রিকার এই প্রথম বিশ্বকাপে অনেককিছুই দেখা গিয়েছিল প্রথমবারের মতো। যেমন, সেবারই প্রথম প্রচলন হয় রঙ্গিন পোশাকের। সেই সঙ্গে চালু করা হয় সাদা বল। সেবারই প্রথম খেলা শুরু হয়েছিল ফ্লাডলাইটের আলোয়। কিন্তু এসবকিছুকে ছাপিয়ে ১৯৯২ বিশ্বকাপের অন্যতম প্রধান আলোচিত বিষয়ে পরিণত হয়েছিল বৃষ্টি সংক্রান্ত নতুন আইন। ৯২ বিশ্বকাপের বৃষ্টি আইনের নিয়মটা ছিল যে, প্রথমে ফিল্ডিং করা দলের সবচেয়ে কম রান দেওয়া ওভারগুলির রানসংখ্যা কমিয়ে নেওয়া হবে। ধরা যাক বৃষ্টির কারণে ২ ওভার কেটে নেওয়া হলো। তখন হিসাব করা হবে যে, প্রথমে বোলিং করা দল কোন দুই ওভারে সবচেয়ে কম রান দিয়েছে। যত রান কম দিয়েছে তত রান বাদ দিয়ে নতুন টার্গেট নির্ধারণ করা হবে। সেবার বৃষ্টিই গড়ে দিয়েছিল বিশ্বকাপের অনেকগুলো ম্যাচের ভাগ্য। আর সেই বৃষ্টির জলেই যে ধুয়ে যাবে দুর্দান্ত ফর্মে থাকা দক্ষিণ আফ্রিকার বিশ্বকাপ স্বপ্ন- তা হয়তো কেউই ভাবতে পারে নি।

ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সেমিফাইনালটিতে বৃষ্টি বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল খেলা শুরুর আগেই। খেলার দৈর্ঘ্য কমিয়ে নিয়ে আসা হয়েছিল ৪৫ ওভারে। শুরু থেকেই ভাগ্যদেবী যেন একেবারে মুখ ফিরিয়ে রেখেছিলেন প্রোটিয়াসদের উপর থেকে। যে গ্রায়েম হিকের ৯০ বলে ৮৩ রানের ইনিংসটির সুবাদে ইংল্যান্ড স্কোরবোর্ডে ২৫২ রান যোগ হয়েছিল, সেই হিক দুই দুইবার ফিরে এসেছেন নিশ্চিত আউটের দ্বারপ্রান্ত থেকে। ম্যাচের প্রথম বলেই নিশ্চিত একটা এলবিডব্লিউর আবেদনে সাড়া দেন নি আম্পায়ার। দ্বিতীয়বার হিক ক্যাচ আউট হয়েছিলেন একটা নো বলে। তখনও রানের খাতাই খুলতে পারেন নি তিনি।

২৫৩ রানের টার্গেট নিয়ে ব্যাট করতে নেমে বেশ ভালোভাবেই এগিয়ে যাচ্ছিল প্রোটিয়াসরা। উদ্বোধনী ব্যাটসম্যান অ্যান্ড্রু হাডসনের ৪৬, আদ্রিয়ান কুইপারের ৩৬, হ্যানসি ক্রনিয়ের ২৪ রানের ছোট ছোট ইনিংসগুলির উপর ভর করে ধীরে ধীরে জয়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল তারা। শেষদিকে জন্টি রোডসের ৩৮ বলে ৪৩ রানের ইনিংসটি রান-বলের ব্যবধান কমিয়ে এনেছিল অনেকখানিই। শেষ পাঁচ ওভারে তাদের দরকার ছিল ৪৭ রান। সপ্তম উইকেটে ব্রায়ান ম্যাকমিলান ও ডেভ রিচার্ডসন মাত্র তিন ওভারে অবিচ্ছিন্ন ২৬ রানের জুটি গড়ে জয়টাকে অনেকটাই নাগালের মধ্যে নিয়ে এসেছিলেন। আর তারা যেভাবে খেলে যাচ্ছিলেন তাতে সেটা খুব বেশি কঠিনও মনে হচ্ছিল না। কিন্তু ৪৩তম ওভারের শেষ বলের আগে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম সেমিফাইনাল ট্রাজেডিটার জন্ম দিতেই আবার শুরু হলো বৃষ্টি। জয়ের জন্য তখন প্রয়োজন ছিল ১৩ বলে ২২ রান। সেদিনের সেই ১২ মিনিটের বৃষ্টি একটা ক্লাসিক ম্যাচকে পরিণত করেছিল বিশ্বকাপের অন্যতম বিতর্কিত একটা ম্যাচে। ম্যাকমিলান ও রিচার্ডসন চাচ্ছিলেন খেলা চালিয়ে যেতে। কিন্তু ইংলিশ অধিনায়ক গ্রাহাম গুচ কোনক্রমেই রাজি হলেন না। আম্পায়াররা শেষপর্যন্ত খেলা বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিলেন। এরপর তারা সেই অদ্ভুত নিয়মের খাতা খুলে হিসাব করতে বসলেন নতুন টার্গেট। প্রথমে আম্পায়াররা লক্ষ্য নির্ধারণ করলেন ৭ বলে ২২ রান। মেলবোর্নের উপস্থিত দর্শক ক্ষুব্ধ হয়ে উঠল এই নির্বুদ্ধিতায়। কিন্তু পরিস্থিতি আরো নির্মম হয়ে উঠল যখন কর্মকর্তারা খেলা দুই ওভার কমিয়ে নতুন লক্ষ্য নির্ধারণ করলেন। ইলেকট্রনিক স্কোরবোর্ডে ভেসে উঠল হাস্যকর, নির্মম একটা টার্গেট। ১ বলে ২১ রান। দক্ষিণ আফ্রিকার সবচেয়ে কম রান দেওয়া দুই ওভারে ইংল্যান্ড নিয়েছিল ১ রান। সৌজন্যে রক্ষার খাতিরে অসম্ভব এই টার্গেট নিয়ে একমাত্র বলটির মুখোমুখি হতে আবার ব্যাট হাতে মাঠে নামলেন ম্যাকমিলান ও রিচার্ডসন। ক্রিস লুইসের শেষ বলে একটা রান নিয়ে ক্ষুব্ধভাবে প্যাভিলিয়নের দিকে তাকালেন দুই প্রোটিয়াস ব্যাটসম্যান। গ্যালারি থেকে হাততালি দিয়ে অভিনন্দন জানানো হলো না বিজয়ী দলকে। দুয়োধ্বনিতে প্রকম্পিত হলো সিডনি স্টেডিয়াম। বিশ্বকাপ ফাইনালে ওঠার আনন্দে মাতলেন না ইংলিশ খেলোয়াড়রাও বরং এরকম বিতর্কিত একটা জয় পেয়ে বেশ বিব্রতই হয়ে পড়েছিলেন তারা।

এর পরের কাহিনী তো সবারই জানা। ফাইনালে ইংল্যান্ডকে ২২ রানে হারিয়ে বিশ্বকাপ শিরোপাটা উঠেছিল ইমরান খানের পাকিস্তানের হাতে। আর এই জঘন্য বৃষ্টি-আইনটি কোন রকম উচ্চবাচ্য ছাড়াই সরিয়ে ফেলা হয়েছিল ক্রিকেট দুনিয়া থেকে। ১৯৯৯ সালে প্রণয়ন করা হয়েছিল অধিক গ্রহণযোগ্য ডাকওয়ার্থ-লুইস পদ্ধতি।

 

বার্মিংহামের সেই ম্যাচটি

৭৬ বলে ৬১ রানের হার না মানা ম্যাচজয়ী ইনিংসটি খেলার পথে ডারেক মারে

সবাই জানেন, ১৯৭৫ সালে প্রথম ক্রিকেট বিশ্বকাপটা জিতেছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। কিন্তু এটা হয়তো অনেকেরই অজানা যে, বিশ্বকাপে তাদের দ্বিতীয় ম্যাচটাই হেরে গ্রুপ পর্ব থেকেই ছিটকে যেতে বসেছিলেন ক্লাইভ লয়েড, ভিভ রিচার্ডসরা।  পাকিস্তানের বিপক্ষে সেই ম্যাচটাতে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ভালোমতোই প্রমাণ করেছিল যে, ক্রিকেট ‘অনিশ্চয়তার খেলা’। এখানে অনেক কিছু অনুমান করা সম্ভব হলেও শেষ বলটার আগ পর্যন্ত জোর দিয়ে কিছুই বলা যায় না।

এখনো পর্যন্ত বিশ্বকাপের অনেক উত্তেজনাপূর্ণ ম্যাচই তাঁবু গেড়েছে ক্রিকেটপ্রেমীদের স্মৃতিতে। স্থান করে নিয়েছে ক্রিকেট ইতিহাসে। প্রথম বিশ্বকাপে বার্মিংহামে ওয়েস্ট ইন্ডিজ-পাকিস্তানের এই ম্যাচটিকেও নিঃসন্দেহে জায়গা দেওয়া যায় সেই তালিকার প্রথম সারিতে।

বার্মিংহামের রৌদ্রজ্জ্বল সকালে নিজেদের অজান্তেই এক স্মরণীয় ম্যাচের টস করতে নেমেছিলেন উইন্ডিজ অধিনায়ক ক্লাইভ লয়েড ও পাকিস্তান অধিনায়ক মজিদ খান। টসে জিতে ব্যাট করার সিদ্ধান্ত নেয় পাকিস্তান। অ্যান্ডি রবার্টস, কেইথ বয়েস, বের্নাড জুলিয়েনদের দুর্ধর্ষ পেস আক্রমণ বেশ ভালোমতোই মোকাবিলা করছিলেন পাকিস্তানি ব্যাটসম্যানরা। অধিনায়ক মজিদ খান খেলেছিলেন ৬০ রানের এক অনবদ্য ইনিংস। পরে মুশতাক মোহাম্মদের ৫৫, ওয়াসিম রাজার ৫৭ বলে ৫৮ রানের ইনিংস দুটির সুবাদে নির্ধারিত ৬০ ওভারে পাকিস্তানের সংগ্রহ দাঁড়ায় ২৬৬ রান।

গর্ডন গ্রিনিজ, আলভিন কালিচরন, রোহান কানহাই, ভিভ রিচার্ডসের মতো বাঘা বাঘা ব্যাটসম্যান আছেন যে দলে, তাদের জন্য ২৬৭ রানের টার্গেটটা নিতান্ত মামুলিই বলা যায়। কিন্তু সে দিন সারফরাজ নেওয়াজ, নাসের মালিকদের অসাধারণ বোলিং পাল্টে দিল সব হিসেব নিকেশ। খুব বেশিক্ষণ উইকেটে টিকতে পারলেন না গ্রিনিজ, ফ্রেডরিক, কালিচরণ, কানহাই, ভিভ রিচার্ডস। তিন অঙ্কের ঘরে না পৌঁছাতেই সাজঘরে ফিরে গেলেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের প্রথম সারির এই পাঁচ ব্যাটসম্যান। আশার আলো কিছুটা জাগিয়ে রেখেছিলেন ক্লাইভ লয়েড। কিন্তু ৫৮ বলে ৫৩ রানের লড়াকু ইনিংসটি খেলে তিনি জাভেদ মিঁয়াদাদের শিকারে পরিণত হলে হতাশায় ডুবে যায় উইন্ডিজ শিবির। স্কোরবোর্ডের চেহারা শোচনীয়। ৭ উইকেটে ১৫১ রান। টেনে হিঁচড়ে স্কোরটাকে ২০৩ পর্যন্ত নিয়ে যেতেই পতন হলো আরো দুইটি উইকেটের। জয়ের জন্য তখনো দরকার ৬৪ রান।

শেষ উইকেট জুটিতে এত রান সংগ্রহের কথা কেউ স্বপ্নেও ভাবে না। একদিকে অভিজ্ঞ ব্যাটসম্যান ডারেক মারে থাকলেও আরেক দিকে আছেন নবাগত ফাস্ট বোলার অ্যান্ডি রবার্টস, একদিনের ক্রিকেটে এটি ছিল যার দ্বিতীয় ম্যাচ। পাকিস্তানের জয় উদযাপনও শুরু করে দিয়েছিলেন অনেকে। তাদের জয়টা মনে হচ্ছিল শুধু সময়ের ব্যাপার মাত্র। কিন্তু তারপর ইতিহাস গড়ার জন্যই যেন উইকেটে খুঁটি গেড়ে বসলেন উইন্ডিজ উইকেটরক্ষক ডারেক মারে আর অ্যান্ডি রবার্টস। সবাইকে হতবাক করে দিয়ে একে একে ঠিকই ৬৩ রান যোগ করে ফেললেন শেষ উইকেট জুটিতে। এরপরই এসে গেল সেই মহেন্দ্রক্ষণ। ওয়াসিম রাজার বল মিড উইকেটে ঠেলে দিয়েই অবিশ্বাস্য এক জয় ছিনিয়ে নিলেন রবার্টস। শেষ পর্যন্ত তিনি অপরাজিত ছিলেন ২৪ রানে। আর ডারেক মারের ৭৬ বলে ৬১ রানের হার না মানা ম্যাচজয়ী ইনিংসটি এখনো উজ্জ্বল হয়ে আছে বিশ্বকাপের ইতিহাসে।

৭০-এর দশকে ক্রিকেট জগতে উইন্ডিজের একক আধিপত্যের কালে প্রতিপক্ষকে দুমড়ে-মুচড়ে দিয়ে অনেক জয়ই পেয়েছিল ক্লাইভ লয়েডের নেতৃত্বাধীন ওয়েস্ট ইন্ডিজ। কিন্তু ওয়ানডে ক্রিকেটের ৪০ বছরের ইতিহাসের সবচেয়ে স্মরণীয় ম্যাচের কথা বলতে গিয়ে উইন্ডিজ কিংবদন্তী ক্লাইভ লয়েডের মনে সবার আগে ভেসে উঠেছিল এই ম্যাচটির কথাই।

ব্রায়ান লারার অটোগ্রাফ ও মরিস ওদুম্বে

১৯৯৬ বিশ্বকাপে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারানোর পর ব্রায়ান লারার অটোগ্রাফ পেয়েছিলেন কেনিয়ার অধিনায়ক মরিস ওদুম্বে

মরিস ওদুম্বে অনেকদিন ধরেই চেষ্টা করছিলেন ওয়েস্ট ইন্ডিজ কিংবদন্তী ব্রায়ান লারার একটা অটোগ্রাফ নেওয়ার। কিন্তু খুব বেশি কাছাকাছি আসার সুযোগই পাননি কখনো। ১৯৯৬ বিশ্বকাপের তিন বছর আগে একবার ইংল্যান্ডে অটোগ্রাফ চেয়ে প্রত্যাখ্যাত হয়েছিলেন কেনিয়ান অধিনায়ক। ৯৬-এর বিশ্বকাপে প্রথমবারের মতো কেনিয়া সুযোগ পাওয়ার পর ওদুম্বের প্রথম মনে হয়েছিল যে, একই টুর্নামেন্টে তিনি খেলতে পারবেন তাঁর স্বপ্নের নায়ক ব্রায়ান লারার সঙ্গে। আর এবার অটোগ্রাফ চাইতে গেলে লারা নিশ্চিত ফিরিয়ে দেবেন না। এতেই মহাখুশি ছিলেন তিনি।

ফিক্সচার ঘোষণার পর দেখা গেল একই গ্রুপে আছে কেনিয়া-ওয়েস্ট ইন্ডিজ। এর বেশি আর কী চাওয়ার থাকতে পারে ওদুম্বের? তিন বছর আগে যেখানে লারার অটোগ্রাফটাও নিতে ব্যর্থ হয়েছিলেন, সেখানে তিনি বিশ্বকাপের আসরে খেলতে পারবেন নিজের আদর্শ ক্রিকেটারটার বিপক্ষেই— এটা তো স্বপ্নেরও অতীত। ২৯ ফেব্রুয়ারী পুনেতে উইন্ডিজের বিপক্ষে মাঠে নামার আগের দিন পর্যন্ত এই আনন্দেই ডগমগ করছিলেন ওদুম্বে। তখনও ঘুনাক্ষরেও টের পাননি ভাগ্যদেবী তার কপালে আরো কত সৌভাগ্য লিখে রেখেছেন।

পরদিন বিশ্বকাপ ইতিহাসের অন্যতম বড় অঘটনের জন্ম দিয়ে লারার ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ৭৩ রানের জয় পেয়ে গেল ওদুম্বের কেনিয়া। আর এই জয়ের পেছনেও সবচেয়ে বড় ভূমিকাটা পালন করলেন তিনিই। ১০ ওভার বল করে মাত্র ১৫ রানের বিনিময়ে নিয়েছিলেন তিনটি উইকেট। ম্যান অব দ্য ম্যাচের পুরস্কারটাও উঠেছিল তাঁর হাতেই। ‘আদর্শ দল’, ‘আদর্শ ক্রিকেটারের’ বিপক্ষে এই জয়টার পর ওদুম্বে বলেছিলেন, ‘এটা যেন বিশ্বকাপ জয়ের মতোই অনুভূতি।’

এখানেই শেষ না। ওদুম্বের বিস্ময়ের পারদ আরো কয়েক ধাপ ওপরে তুলে দেওয়ার জন্য এই ম্যাচের পর কেনিয়ার ড্রেসিংরুমে গিয়ে হাজির হলেন প্রিন্স অব ত্রিনিদাদ ব্রায়ান লারা স্বয়ং। বিস্ময়ের ঘোর কাটতেই অনেকক্ষণ লেগেছিল ওদুম্বের। কিন্তু তারপর ধাতস্থ হওয়ার পর কিছুটা রসিকতা করতেও ছাড়েন নি কেনিয়ার এই ঐতিহাসিক জয়ের নায়ক। মুখে একগাল হাসি ছড়িয়ে লারাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘এখন নিশ্চয়ই আপনি আমাদের সঙ্গে ছবি তুলতে চাইবেন?’ লারাও শুধু শুকনো মুখে অভিনন্দন জানিয়েই ফিরে যান নি। বেশ কিছুক্ষণ কাটিয়েছিলেন ওদুম্বের সঙ্গে। এক ফাঁকে অটোগ্রাফটা নিতে নিশ্চয়ই ভুল করেন নি ওদুম্বে!

‘অপরাজিত’ ক্লুজনার

নিরানব্বইয়ের বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ রান এসেছিল রাহুল দ্রাবিড়ের ব্যাট থেকে। সেই বিশ্বকাপে শচীন টেন্ডুলকার, মার্ক ওয়াহ, হার্শেল গিবস, ব্রায়ান লারা ও সাঈদ আনোয়ারের মতো ব্যাটসম্যানরা ছিলেন স্ব-মহিমায় উজ্জ্বল। কিন্তু ব্যাটিংয়ের এসব মহারথীকে ছাপিয়ে ’৯৯-এর বিশ্বকাপে বোলারদের দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকার ল্যান্স ক্লুজনার। কিছুতেই আউট করা যাচ্ছিল না তাঁকে। বিশ্বকাপের প্রথম ছয়টি ম্যাচের পাঁচটিতে ব্যাট হাতে মাঠে নেমে করেছিলেন ১৬৪ রান। তাঁর কোনো গড় হিসাব করা যাচ্ছিল না। কারণ, ক্লুজনার যে এই পাঁচটি ম্যাচে আউটই হননি!

কেবল তাই নয়, তিনি শেষবারের মতো আউট হয়েছিলেন বিশ্বকাপ শুরু হওয়ারও দুই-আড়াই মাস আগে। সব মিলিয়ে ওয়ানডে ক্রিকেটে আউট না হওয়ার এক অনন্য রেকর্ডই করে বসেছিলেন তিনি। বিশ্বকাপের ছয়টি ম্যাচসহ টানা ১১টি ম্যাচে অপরাজিত থেকে ৩৯৩ রান করে তিনি ভেঙেছিলেন পাকিস্তানের ব্যাটিং কিংবদন্তি জাভেদ মিয়াঁদাদের রেকর্ড।

নিরানব্বইয়ের বিশ্বকাপটা পুরোটাই ছিল ক্লুজনারের বীরত্ব গাঁথা। পুরো বিশ্বকাপেই দারুণ আলোচিত ছিল তাঁর মারকুটে ব্যাটিং। সুপার সিক্সে পাকিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচটিতে দলের পরাজয় মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে যাওয়ার পরও অবিচল ছিলেন ল্যান্স ক্লুজনার। শোয়েব আকতারের এক ওভারে ১৭ রান নিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকাকে নিয়ে যান বিজয়ের বন্দরে। সেমিফাইনালে দক্ষিণ আফ্রিকার ট্র্যাজিক বিদায়েও তিনি ছিলেন ট্র্যাজিক হিরো। দলকে ফাইনালে প্রায় নিয়েই গিয়েছিলেন। অ্যালান ডোনাল্ডের সঙ্গে সেই ভুল-বোঝাবুঝিটা না হলে হয়তো বিশ্বকাপের ইতিহাসই অন্যভাবে লিখতে হতো। অনেক ম্যাচেই দক্ষিণ আফ্রিকার টপ অর্ডার ব্যর্থ হলেও অসাধারণ দৃঢ়তায় তিনি দলকে বিজয়ী করেছেন। ’৯৯-এর বিশ্বকাপে তাঁর নাম তাই হয়ে গিয়েছিল ‘ক্রাইসিস ম্যান’।

ক্রিকেটের ইতিহাসে সম্ভবত ল্যান্স ক্লুজনারের আউট হওয়া না-হওয়া নিয়েই ধরা হয়েছে একমাত্র বাজি। ’৯৯-এর বিশ্বকাপে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ১১ ম্যাচ পরে তিনি আউট হয়েছিলেন। সেই ম্যাচে তিনি আউট হবেন কি হবেন না, তা নিয়ে বাজির দর বেড়ে গিয়েছিল হু হু করে। শেষ পর্যন্ত ওয়ান ডাউনে ব্যাট করতে নেমে গ্যাভিন লারসেনের বলে তিনি আউট হন। অনেকে এই বলেও বিতর্ক ছড়িয়েছিলেন যে প্রোটিয়া অধিনায়ক হ্যানসি ক্রোনিয়ে যদি তাঁকে সেই ম্যাচে ওয়ান ডাউনে না নামাতেন, তাহলে এই ম্যাচেও নাকি তিনি অপরাজিত থাকতেন।

ল্যান্স ক্লুজনার ’৯৯-এর বিশ্বকাপে সবই পেয়েছেন, কেবল পারেননি দক্ষিণ আফ্রিকাকে ফাইনালে তুলতে। চরম নাটকীয় ও শ্বাসরুদ্ধকর সেমিফাইনালে ১৬ বলে ৩১ রান করে অপরাজিত থাকলেও মুহূর্তের ভুলে তিনিই ছিলেন সেই ম্যাচের ট্র্যাজেডির নায়ক। শুধু ব্যাট হাতেই নয়, বল হাতেও ১৭ উইকেট শিকার করে বিশ্বের অন্যতম সেরা অলরাউন্ডার হিসেবে ক্লুজনারের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল ’৯৯-এর ইংল্যান্ড বিশ্বকাপেই। প্রতিযোগিতার সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কারটিও অবধারিতভাবে উঠেছিল এই ‘স্প্রিংবকে’র হাতেই।

‘দৌড় সংস্কৃতি’র বিপত্তি

 

১৯৭৫ সালের বিশ্বকাপ ক্রিকেটের ফাইনাল। খেলা তখনো শেষ হয়নি, কিন্তু মাঠে হাজারো দর্শকের ভিড়

১৯৭৬ সালের দিকে একদিন বাসে করে দক্ষিণ লন্ডনের দিকে যাচ্ছিলেন কিংবদন্তী আম্পায়ার ডিকি বার্ড। হঠাৎ কন্ডাক্টরের মাথার হ্যাটটা তাঁর খুব পরিচিত মনে হলো। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন হ্যাটটা সে কোনখান থেকে পেয়েছে। কন্ডাক্টরের জবাব, ‘ওহ! তুমি কী কখনো ডিকি বার্ডের নাম শোনোনি? এটা তার হ্যাট। আমি এটা তার কাছ থেকে নিয়েছিলাম বিশ্বকাপের ফাইনাল ম্যাচের সময়। ম্যাচ শেষ হওয়ার পর আমরা সবাই মাঠে দৌড় দিয়েছিলাম। আর বুঝতেই পারছ, রেসটা আমিই জিতেছিলাম!’
খেলা শেষ হলে উল্লাসিত জনতার এভাবে মাঠে দৌড় দেওয়ার রেওয়াজটা এখন আর নাই। কিন্তু ওয়ানডে ক্রিকেটের শুরুর দিকে এটা ছিল খুবই নিয়মমাফিক একটা ব্যাপার। এখনকার মতো এত নিরাপত্তার কড়াকড়িও ছিল না সেসময়। খেলা শেষ হলেই বিজয়ী দলের সদস্যদের অভিনন্দন জানাতে বা সবাই মিলে একসঙ্গে জয় উদযাপন করার জন্য মাঠে দৌড় দিতেন দর্শকরা। তবে তখনকার এই ‘দৌড়-সংস্কৃতি’র ফলে খেলাটা সুষ্ঠভাবে শেষ করতে অনেক জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে, এমন উদাহরণও আছে প্রচুর। দেখা গেল, দর্শকরা ধরেই নিয়েছে যে, খেলাটা শেষ হয়ে গেছে। মুহূর্তেই তারা দৌড়ে এসে ভরিয়ে দিল গোটা মাঠ। কিন্তু আসলে হয়তো তখনও খেলা কিছুটা বাকিই থেকে গেছে। ১৯৭৫ সালের বিশ্বকাপ ফাইনালটাই এটার সবচেয়ে যুৎসই উদাহরণ। যেখানে আম্পায়ার ডিকি বার্ডকে তাঁর হ্যাট খোয়াতে হয়েছিল। অস্ট্রেলিয়ান ফাস্ট বোলার জেফ টমসন হারিয়েছিলেন তার প্যাড। আর অতিকষ্টে মাঠ ছাড়ার পর উইন্ডিজ অলরাউন্ডার কেইথ বয়েস খুঁজে পান নি তার জুতোজোড়া।
প্রথম বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়া-ওয়েস্ট ইন্ডিজের ফাইনাল ম্যাচটা শুরু হয়েছিল এক রৌদ্রোজ্জ্বল সকালে। ১১টার সময়। আর শেষ হয়েছিল প্রায় ১০ ঘন্টা পর। রাত পৌনে নয়টায়। কারণ দুই তিনবার খেলোয়াড়-আম্পায়ারদের সামলাতে হয়েছিল উৎসুক দর্শকদের জোয়ার। টসে হেরে ব্যাট করতে নেমে অস্ট্রেলিয়াকে ২৯২ রানের দুরুহ টার্গেট ছুঁড়ে দিয়েছিল ক্লাইভ লয়েড বাহিনী। ক্লাইভ লয়েড নিজে খেলেছিলেন ৮৫ বলে ১০২ রানের এক অসাধারণ অধিনায়কোচিত ইনিংস।
জবাবে ব্যাট করতে নেমে ভালোই লড়াই চালাচ্ছিল অস্ট্রেলিয়া। কিন্তু পাঁচ পাঁচটা রানআউট আর কেইথ বয়েসের আগুন ঝড়ানো বোলিং অসহায় করে দিল অস্ট্রেলিয়াকে। স্কোরবোর্ডে ২৩৩ রান জমা করেই ফিরে গেলেন নয়জন ব্যাটসম্যান। কিন্তু শেষ উইকেট জুটিতেই টানটান উত্তেজনা সৃষ্টি করে ফেললেন জেফ টমসন আর ডেনিস লিলি। এক রান, দুই রান করে আসে- আসে- স্কোরবোর্ডে ৩৩ রান জমা করে ফেললেন এই দুই উদ্বোধনী বোলার। শেষ দুই ওভারে দরকার ২৬ রান। ৫৯তম ওভারের প্রথম বলে দুই রান নেওয়ার পর দ্বিতীয় বলেই কাভারে দাঁড়ানো রয় ফ্রেডরিকের হাতে ধরা পড়লেন  থমসন। ওয়েস্ট ইন্ডিজের প্রথম বিশ্বকাপ জয়ের আনন্দ উদযাপন করতে মুহূর্তের মধ্যে জনসমুদ্রে পরিণত হলো লর্ডস স্টেডিয়াম। ২২ ইয়ার্ডের পিচটুকু বাদ দিয়ে পুরো মাঠটাই চলে গেল ওয়েস্ট ইন্ডিজ সমর্থকদের দখলে। কিন্তু ওদিকে আম্পায়ার যে একটা হাত তুলে নো বলের ইশারা করেছেন সেটার দিকে কেউ নজরই দেয় নি। মজার ঘটনাটা শুরু হলো এখানেই।
উইকেটের এক প্রান্তে ডেনিস লিলিকে সীমানার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে স্ট্যাম্প লক্ষ্য করে বল ছুঁড়লেন ফ্রেডরিক। লক্ষ্যভ্রষ্ট। বল চলে গেল দর্শকদের মাঝে। এই অপ্রত্যাশিত-লাভজনক পরিস্থিতির সুযোগটা হাতছাড়া করতে চাইলেন না লিলি। ইচ্ছেমতো দৌড়াতে লাগলেন উইকেটের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত। তিন রান নেওয়ার পর থেমে যেতে চেয়েছিলেন টমসন। কিন্তু লিলি শান্ত হলেন আরো অনেকক্ষণ দৌড়ানোর পর। শেষপর্যন্ত একসময় দর্শকরা পরিসি’তি সম্পর্কে অবগত হয়ে আবার চলে গেল দড়ির বাইরে। লিলি, আম্পায়ার টম স্পেনসারের কাছে জানতে চাইলেন তিনি কত রান পাচ্ছেন? এতবার দৌড়ানোর পরও তাকে মাত্র দুই রান দেওয়া হবে শুনে তিনি ভয়ানক চটে গেলেন। ক্ষুব্ধ হয়ে বললেন, ‘অসম্ভব, আমরা সারা দুপুর ধরে এই উইকেটের এপার-ওপার করছি।’ ডিকি বার্ডও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এগিয়ে আসলেন। লিলিকে জিজ্ঞাসা করলেন তারা আসলে কয় রান নিয়েছে। লিলি তখনো তাঁর এতখানি পরিশ্রম বৃথা যাবে, এটা ভাবতেই পারছিলেন না। বললেন, ‘এটা তো তোমাদেরই গোনার কথা। কিন্তু আমি ১৭ রানের মতো নিয়েছি।’ যদিও কিংবদন্তী এই দুই পেসারের ঐ দৌড়গুলো শেষপর্যন্ত গোনায় আসেনি। তাদেরকে দেওয়া হয়েছিল মাত্র চার রান। খেলাটাও এরপর চলেছিল আর মাত্র তিন বল। প্রথম দুই বলে দুইটা সিঙ্গেল নেওয়ার পর তৃতীয় বলে স্ট্যাম্পিংয়ের ফাঁদে পড়ে গেলেন টমসন। ওয়েস্ট ইন্ডিজ পেল ১৭ রানের জয়। এবার দ্বিগুন গতিতে মাঠের দিকে ধেয়ে আসল উল্লাসিত উইন্ডিজ সমর্থকদের স্রোত। মাঠে উপস্থিত ক্রিকেটার-আম্পায়ারদের হাল কী হয়েছিল সেটা তো শুরুতেই বলা হয়েছে। তবে পরিস্থিতি এরকম হতে পারে আন্দাজ করে বুদ্ধিমানের মতো কাজ করেছিলেন কেইথ বয়েস। চা বিরতির সময়ই তিনি তাঁর নতুন জুতাটা পাল্টে পড়ে নিয়েছিলেন একজোড়া পুরোনো জুতা। যেন জুতার মায়া ছেড়েই ভোঁ-দৌড় দেওয়া যায় সাজঘরের দিকে!

ঘুমন্ত দৈত্য

আপনাকে যদি বলা হয় আপনি বসে আছেন এমন এক জায়গায় যেখান থেকেই একবার এই পৃথিবীর বুকে ঘটে গেছে প্রলয়ঙ্করী এক বিস্ফোরণ? কেমন লাগবে আপনার? আসলে এ ধরণের প্রশ্নের সম্মুখিন হওয়ার কথা আমরা হয়তো মনেও আনি না। কি রাশিয়ার কিছু অঞ্চলের অধিবাসীদের দিকে সত্যিই এমন একটি প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। সমপ্রতি তাঁরা এক গবেষণায় দাবি করেছেন যে, ২৫০ মিলিয়ন বছর আগে পৃথিবীর প্রায় সকল প্রাণী বিলুপ্ত হয়েছিল বিস্তৃত অঞ্চল জুড়ে ছড়িয়ে থাকা এক অতিকায় আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাতে। আর সেই ঘুমন্ত দৈত্যটার অবস্থান রাশিয়ার আশপাশ জুড়ে। যার আয়তন গোটা ইউরোপ মহাদেশের চেয়েও কিছুটা বড়! সম্প্রতি স্তব্ধ করে দেওয়ার মতো এই খবরটা দিয়েছে ডেইলি মেইল অনলাইন।

পার্মিয়ান যুগে ( ২৯৯-২৫১ মিলিয়ন বছর আগে) পৃথিবীর সর্বশেষ প্রলয়ঙ্করী দুর্যোগে প্রায় সকল প্রাণির বিলুপ্তি ঘটেছিল বলে আগে থেকেই বিশ্বাস করতেন ইতিহাসবিদ ও বিজ্ঞানিরা। এটা গ্রেট ডাইয়িং নামেও পরিচিত। ধারণা করা হয় পৃথিবীর জলজ প্রাণীর প্রায় ৯৫% ও ভূমির ৭০% প্রাণী এসময় বিলুপ্ত হয়েছিল। এই ধারণাটা বিজ্ঞানীমহলে একপ্রকার বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করলেও তারা শক্ত কোন প্রমাণ পাচ্ছিলেন না যে, আসলে এর সঠিক কারণটা কী? সমপ্রতি কানাডার ক্যালগারি বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক দাবি করেছেন যে, পার্মিয়ান যুগের ঐ মহাপ্রলয়ের কারণটা ছিল ভয়াবহ আকারের অস্নুৎপাত। কানাডায় প্রাপ্ত এক পাথরের গায়ের কয়লার স্তর বা আবরণ থেকে বিজ্ঞানীরা এর প্রমাণ পেয়েছেন। ক্যালগারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. স্টিভ গ্রাসবে বলেছেন, ‘এটা খুব ভালোভাবেই পার্মিয়ান যুগের প্রাণী বিলুপ্তির কারণটা ব্যাখ্যা করে। আমাদের এই গবেষণাটাই প্রথম প্রমাণ করতে পারবে যে, পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে বড় এই অস্নুৎপাতের ফলে যে ব্যাপক পরিমাণ কয়লা দহন হয়েছিল সেটাই আজকের গ্রিনহাউজ গ্যাস সৃষ্টির একটি অন্যতম কারণ।’
ড. গ্রাসবি পাথরের গায়ে অদ্ভুত ধরণের এই কয়লার আবরণটা আরো ভালোমতো পরীক্ষা করার জন্য ভূবিজ্ঞানের অধ্যাপক ড. বেনোইট বিউচ্যাম্প ও পরিবেশ ভূ-রসায়নের অধ্যাপক ড. হামিদ সানেইয়ের সঙ্গে আলোচনা করেছেন। এবং সম্মিলিতভাবেই তাঁরা উপরোক্ত ঐ সিদ্ধানে- পৌঁছেছেন। তাঁরা এটাও চিহ্নি‎ত করেছেন যে, আদি বিলুপ্তির কারণ ভয়াবহ এই আগ্নেয়গিরির অবস্থান বর্তমান রাশিয়ার উত্তরে। জায়গাটা সাইবেরিয়ান ফাঁদ নামেও পরিচিত। উত্তর রাশিয়া, তুরা, উকুটস, নোরিলস্ক ও ইরাকুটস্ক অঞ্চল ঘিরে এই আগ্নেয়গিরির বিস্তৃতি। পুরো এলাকাটার আয়তন দুই মিলিয়ন স্কয়ার কিলোমিটার। যা ইউরোপ মহাদেশের চেয়েও খানিকটা বড়। এই অস্নুৎপাতের ছাই গিয়েই জমা হয়েছিল কানাডায় বিজ্ঞানীদের প্রাপ্ত কয়লার আস্তরণজমা ঐ পাথরে। ড. বেনোইট বিউচ্যাম্প বলেছেন, ‘আমরা ঐ পাথরটাতে প্রচুর পরিমাণ জৈব উপাদান পেয়েছি। আর এগুলো থেকে আমরা নিশ্চিত হতে পেরেছি যে, এগুলো কয়লা-ছাইয়ের স্তর। আধুনিক কয়লা পোড়ানোর পাওয়ার প্লান্টগুলোতে যেমনটা দেখা যা। ড. সানেই আরো যোগ করেছেন, ‘আমাদের এই আবিস্কারটাই প্রথম এই নিশ্চয়তা দিতে পারবে যে, আদি বিলুপ্তির ঐ সময়ে কয়লা ছাইয়ের উদগিরন হয়েছিল যা আগে চি‎হ্নত করা যায় নি।’
বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন যে, সেসময়ের সেই ছাই উদগিরনটাই বর্তমান সময়ের এই বৈশ্বিক উষ্ণায়ন, পরিবেশ বিপর্যয়ের আদি কারণ। ঐ আগ্নেয়গিরি থেকে যে ছাই উদগিরন হয়েছিল সেটা ছিল খুবই বিষাক্ত।
তবে এখন আবার এই আগ্নেয়গিরি থেকে নতুন করে অস্নুৎপাতের সম্ভাবনা আছে কিনা সে সম্পর্কে এখনো কিছু জানান নি বিজ্ঞানীরা। তবে পরিবেশের যা হালচাল তাতে কিছুটা সাবধান হওয়ার সময় বোধহয় এসেছে। সময় এসেছে পরিবেশ নিয়ে বাণিজ্য-রাজনীতি না করে সত্যিই যেন ভয়ঙ্কর সুপ্ত এই দৈত্যটা জেগে না ওঠে সেদিকে নজর দেবার।

দ্বিতীয় সূর্য?!

স্টার ওয়ার্স সিনেমাতে লুক স্কাইওয়াকারকে দেখা গিয়েছিল দুই সূর্যওয়ালা কল্পিত এক গ্রহে। বাস্তবে পৃথিবীর মানুষও পেতে পারেন এ ধরণের বিরল অভিজ্ঞতা।

এ বছরই একটা অভূতপূর্ব বিরল ঘটনার সাক্ষী হতে পারেন পৃথিবীর বাসিন্দারা। প্রত্যক্ষ করতে পারেন দ্বিতীয় সূর্যের উপস্থিতি। ফলে রাতেও টের পাওয়া যাবে সূর্যের উজ্জ্বলতা। কিন্তু সেটা কীভাবে সম্ভব? তাহলে কী প্রকৃতির নিয়ম ভেঙে প্রলয়ংকরী কোনো ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে পৃথিবীর বুকে? না, ব্যাপারটা সে রকম কিছু নয়। বিজ্ঞানীদের নতুন একটি প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে ডেইলি মেইল অনলাইন জানিয়েছে, বহু দূরে একটা উজ্জ্বল নক্ষত্র ধ্বংসপ্রাপ্ত হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেওয়ায় পৃথিবীবাসীর এই বিরল অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে।
বিজ্ঞানীদের রিপোর্ট অনুযায়ী, প্রায় ৬৪০ আলোকবর্ষ দূরে ‘বেটেলগুস’ নামের একটি নক্ষত্র খুব তাড়াতাড়িই প্রচুর শক্তি বিকিরণ করে ধীরে ধীরে ঢলে পড়বে মৃত্যুর কোলে। আর নক্ষত্রটি শক্তি বিকিরণের শেষ মুহূর্তে এমন এক বিস্ফোরণ ঘটাবে যার ফলে প্রায় এক বা দুই সপ্তাহ ধরে পৃথিবীর মানুষ প্রত্যক্ষ করতে পারবে দ্বিতীয় সূর্যের উপস্থিতি। তবে এই ঘটনাটি ঠিক কবে ঘটতে যাচ্ছে, সেটা নিয়ে এখনো নিশ্চিত হতে পারেননি বিজ্ঞানীরা। জ্যোর্তিবিজ্ঞানের নিয়মানুয়ায়ী অনুমান করা হচ্ছে, ‘বেটেলগুস’ অদূর ভবিষ্যতেই ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে। তবে তার মানে এই না যে, আপনাকে এখনই সানগ্লাস কেনার জন্য দৌড়াতে হবে।
অস্ট্রেলিয়ার সাউদার্ন কুইন্সল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক ব্রাড কারটেল বলেছেন, ‘২০১২ সালের আগেই এই বিস্ফোরণের ঘটনাটি ঘটতে পারে। নক্ষত্রটি খুব দ্রুতই তার কেন্দ্রের জ্বালানি শক্তি হারাচ্ছে। এই জ্বালানির জন্যই নক্ষত্রটি আলো বিকিরণ করতে পারে। জ্বালানি ভান্ডার শেষ হয়ে গেলে আক্ষরিক অর্থেই এটি বিলুপ্ত হয়ে যাবে। কিন্তু পুরোপুরি শেষ হয়ে যাওয়ার আগে এটি একটা প্রচণ্ড বিস্ফোরণ ঘটাবে। এই বিস্ফোরণের ফলে আমরা পৃথিবীতে কয়েক সপ্তাহব্যাপী অবিশ্বাস্য আলোকিত একটা পরিবেশ পাব। তারপর এটা আস্তে আস্তে মিইয়ে যেতে শুরু করবে। এবং একসময় এটিকে আর দেখাই যাবে না।’
নতুন এই বিস্ময়কর খবরে অবশ্য ‘মহাপ্রলয়’, ‘পৃথিবীর শেষ’ ইত্যাদি নানাবিধ জল্পনা-কল্পনায় তোলপাড় হচ্ছে ইন্টারনেট দুনিয়া। মায়ান দিনপঞ্জী অনুয়ায়ী ২০১২ সালেই পৃথিবীতে একটা মহাপ্রলয় হবে, এমন ধারণা আগে থেকেই বেশ চালু আছে। তার ওপর ‘বেটেলগুস’ নামের অর্থ শয়তান, এই তথ্যটি এসব কল্পনায় যোগ করেছে নতুন মাত্রা। কিন্তু বিজ্ঞানীরা এ ধরনের সম্ভাবনা একেবারেই আমল দেননি। তাঁরা বেশ স্পষ্টভাবেই জানিয়েছেন, নক্ষত্রের বিস্ফোরণটা পৃথিবী থেকে এত দূরে হবে যে, তাতে পৃথিবীর কোনো ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা একেবারেই নেই। ডেইলি মেইল অনলাইন।

সবচেয়ে বড় কাহিনী, যা এখনো বলা হয় নি…

আসলে আধ্যাত্মিকতা হলো নির্দিষ্ট ধরণের এমন একটা বিষয়, যার মূল কাজকারবার হচ্ছে ‘ধারণা করতে পারা, অনুমান করতে পারা’র সঙ্গে। ঈশ্বরবিশ্বাসী ঐতিহ্যে একটা ধারণা আছে যে, .. .. .. । এখানে কিছু কিছু কাজকে বিবেচনা করা হয়, ঈশ্বরিক নিয়মনীতি না মানা হিসেবে। আবার কিছু কিছু কাজকে সন্তোষজনক বলে গণ্য করা হয়, ঈশ্বরিক কোনো কিছুর কাছে। কিন’ ঈশ্বরে বিশ্বাসী না, এমন ঐতিহ্যর ধারণায়, এটা খুবই সোজাসাপ্টা/সরলসোজা ব্যাপার যে, ঐতিহাসিক পরিসি’তি আসলে খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ না। আসল গুরুত্বপূর্ণ জিনিসটা হলো ‘এখানে-এখন’। এখন মানে কিন্তু এখনই। কোন একটা কাজ করতে গিয়ে আমরা আগে দেখার চেষ্টা করি আমাদের কাছে এই মুহূর্তে কী কী পথ খোলা আছে। আমাদের এরকম ভাবার কোনই সুযোগ নাই যে, অতীতের কোন একটা সময় যদি এখন আবার পেতাম! এটা এখন। এই মুহূর্তটাই। কোন রহস্য না, খুব সোজা-সরাসরি শুধু এই ‘এখন’। বিস্তারিত পড়ুন

Hello world!

Welcome to WordPress.com. This is your first post. Edit or delete it and start blogging!