Posts Tagged ‘ হেফাজতে ইসলাম ’

ব্লগার গ্রেপ্তার প্রসঙ্গে কিছু বললেন না ইউনুস

Yunus+In+US-18.04.13

২০০৬ সালে শান্তিতে নোবেল জয়ের পর ড. মুহাম্মদ ইউনুস এবার পেয়েছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা, কংগ্রেশনাল স্বর্ণপদক। ক্ষুদ্রঋণভিত্তিক গ্রামীন ব্যাংকের মাধ্যমে তিনি যা করে আসছেন সেটা যুক্তরাষ্ট্রের বিবেচনায়, ‘মানুষকে শ্রেয়তর জীবনের পথে এগিয়ে নেবে’। একারণেই ড. ইউনুসকে এই পুরস্কার দেওয়ার জন্য মনোনিত করেছে যুক্তরাষ্ট্র। সাম্প্রতিক সময়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করার দাবিতে বাংলাদেশে যে আন্দোলন গড়ে উঠেছে, সে প্রসঙ্গে কোন মন্তব্য শোনা যায় নি ড. ইউনুসের কাছ থেকে। এবার হেফাজতে ইসলামের দাবিমাফিক সরকার যে তথাকথিত চার ‘নাস্তিক’ ব্লগারকে গ্রেপ্তার করেছে, সে বিষয়েও কোন মন্তব্য করেননি শান্তিতে নোবেলজয়ী প্রথম বাংলাদেশী।
পুরস্কার গ্রহণ অনুষ্ঠানে ব্লগারদের গ্রেপ্তার প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে ড. ইউনুস বলেন, ‘আমি এখন এই রকম ইস্যু নিয়ে কোন মন্তব্য করতে চাই না। আজকের সমস্ত আলোচনার কেন্দ্রে এই অনুষ্ঠানটাই থাকা উচিৎ।’ একথা বলেই তিনি দ্রুত সেখান থেকে চলে যান।
ইউনুসের আনুষ্ঠানিক বক্তব্য সীমাবদ্ধ ছিল গ্রামীন ব্যাংককে ঘিরেই। দারিদ্র দূরীকরণে এই প্রতিষ্ঠানটি কত ‘চমৎকার’ ও ‘উদ্ভাবনী চিন্তাভাবনা’ নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে, সেটা বর্ণনা করেছেন তিনি। এছাড়া ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় মার্কিন  সিনেটরদের সঙ্গে লবিং করার কথা উল্লেখ করেছেন ইউনুস। সেসময় তিনি আমেরিকায় থাকতেন। এবং এ কথা স্মরণীয় যে, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতা করেছিল এবং পাকিস্তানের আত্মসমর্পণের বিষয়টা প্রায় একদিন ঝুলিয়ে রেখেছিল
নারীর ক্ষমতায়ন প্রশ্নে ডেমোক্রাট, রিপাবলিকান, উভয় পার্টিরই ভূয়সী প্রশংসা পেয়েছেন ইউনুস। পুরস্কারটাও তিনি বাংলাদেশের লাখো নারীর পক্ষ থেকেই গ্রহণ করছেন বলে জানিয়েছেন। নারীরাই মূলত দারিদ্র দূরীকরণের এই স্বপ্নপূরণের পথে অগ্রণী ভূমিকা রাখবে বলে উল্লেখ করেন ইউনুস। অথচ সাম্প্রতিক সময়ে হেফাজতে ইসলাম নামধারী একটি সংগঠন নারীদের স্বাধীনতা হরণের লক্ষ্যে আন্দোলন শুরু করলেও সে বিষয়ে কোন মন্তব্য আসেনি ইউনুসের কাছ থেকে। শাহবাগ আন্দোলন সম্পর্কেও তিনি নিরব।
এইরকম পরিস্থিতির মধ্যে ইউনুসের নতুন এই পুরস্কারপ্রাপ্তির খবরটি সমালোচিত হয়েছে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে। অনলাইন অ্যাকটিভিস্টদের অনেকেই ভেবে পাচ্ছেন না যে, সমাজের খুবই গুরুত্বপূর্ণ সব ইস্যুতে কোন মতামত না দেওয়া সত্ত্বেও তিনি কিভাবে একের পর এক পুরস্কার জিতে যাচ্ছেন?
গত ২৫ বছরে অন্তত ১০৩টি পুরস্কার পেয়েছেন মুহাম্মদ ইউনুস। ২০০৬ সালে শান্তিতে নোবেল ও যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা ছাড়াও ২০০৯ সালে ইউ.এস প্রেসিডেনশিয়াল মেডেল অব ফ্রিডম পুরস্কার পেয়েছেন ইউনুস।  ইউনুসের দর্শন প্রচারের জন্য ২০০৬ সালে প্রতিষ্ঠা হয়েছে ইউনুস সেন্টার।- হাফিংটন পোস্ট

রক্ত নিয়ে হোলি-খেলা, ফুরিয়ে গেছে তোদের বেলা

ছোট আকারে হলেও গতকাল ৬ এপ্রিল মুখোমুখি সংঘর্ষে জড়িয়েছে হেফাজতে ইসলাম ও শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চ। পুরো দেশজুড়ে এমন ঘটনা আরও কিছু ঘটেছে। গতকাল ৬ এপ্রিল যখন শাহবাগ আন্দোলনের কর্মীরা হেফাজতে ইসলামের হামলা প্রতিহত করার জন্য উত্তেজিতভাবে লাঠি-বাঁশ সংগ্রহ করছিলেন, ঠিক সেই সময় মঞ্চ থেকে নতুন এই শ্লোগানটি শুনতে পেলাম: ‘রক্ত নিয়ে হোলি-খেলা, ফুরিয়ে গেছে তোদের বেলা’। শুনে খুবই ভালো লাগল। আসলেই, রক্তের হোলি-খেলা বন্ধ করার সময় এখন। অপশক্তির দিক থেকে আক্রমণ আসলে সেটা প্রতিহত করার শক্তি আমাদের যেমন অর্জন করতে হবে, তেমনি যখন সংঘর্ষ চলছে না, সেসময় এই পেশিশক্তির লড়াই কিভাবে এড়ানো যায়, সেকথাও আমাদের চিন্তা করতে হবে। সমান গুরুত্ব দিয়ে। বর্তমান তরুণ প্রজন্মের যে মেধাবী সন্তানরা জীবন তুচ্ছ করে লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে, তাদের রক্তাক্ত লাশ কোন পরিস্থিতিতেই কাম্য না। তাদের মগজটাই আজকের লড়াইয়ে বেশি জরুরি।

17206_551344121575076_1574400579_n

কেন তৈরি হলো সাংঘর্ষিক পরিস্থিতি?

পেশিশক্তির সাংঘর্ষিক পরিস্থিতি এড়ানো যায় নি। তবে একটা বিষয় স্পষ্ট যে, এই মুখোমুখি সংঘর্ষের জন্য কোনভাবেই গণজাগরণ মঞ্চ বা শাহবাগ আন্দোলনের কর্মীদের দায়ি করার সুযোগ নেই। শাহবাগ আন্দোলনের কর্মীরা আগ বাড়িয়ে হেফাজতে ইসলামের উপর আক্রমণ করতে যায়নি। শাহবাগ যখন আক্রান্ত হয়েছে, তখন অনেকেই নিজ উদ্যোগে নিজেদের আত্মরক্ষার স্বার্থে লাঠি হাতে নিয়েছে।

অনেকেই হয়তো গণজাগরণ মঞ্চ ও ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি, সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর ঢাকা হরতাল-অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণাকে সমর্থন করতে পারেননি। কিন্তু যখন একথা বেশ ভালোভাবেই প্রতিষ্ঠা করা গেছে যে, হেফাজতে ইসলাম আসলে জামায়েতী ইসলামকেই হেফাজত করতে চাচ্ছে, দেশের সব ভাস্কর্য-শহীদ মীনার ভেঙ্গে ফেলার কথা বলছে, নারী-পুরুষের প্রকাশ্য মেলামেশা বন্ধ করার দাবি তুলছে তখন তাদেরকে প্রতিহত করার দায়িত্ব কি মুক্তমনা-স্বাধীনচেতা মানুষরা অনুভব করবেন না? যেখানে আওয়ামী লিগ সরকারও তাদের কথা অনুযায়ী ৪ জন বগারকে গ্রেফতার করেছে এবং ১৩ দফার অধিকাংশ দাবি মেনে নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে, তখন এই হরতাল-অবরোধের পক্ষে যুক্তি দেখানোর অনেক জায়গা আছে।

২৬ মার্চ জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধ সংক্রান্ত আল্টিমেটাম শেষ হওয়ার পর যখন গণজাগরণ মঞ্চ থেকে কোন কঠোর কর্মসূুিচ আসেনি, শাহবাগে কিছুটা দ্বিধা-বিভক্তি, মতানৈক্য ইত্যাদি তৈরি হয়েছে। শহীদ রুমী স্কোয়াড আমরণ অনশনের ঘোষণা দেওয়ার পর আবার আশার আলো জ্বলছিল শাহবাগ চত্বরে। এরই মধ্যে বেশ কাঁপাকাঁপি দিয়ে ময়দানে আবির্ভাব ঘটে হেফাজতে ইসলামের। মধ্যযুগীয় কায়দার ১৩ দফা দাবি দিয়ে। ‘নাস্তিক ব্লগারদের’ ফাঁসির দাবি নিয়ে। সরকারও তাদের দাবির প্রতি নতজানু হয়ে ৪ জন ব্লগারকে গ্রেফতার করে। নজীরবিহীন কায়দায়। আমারব্লগ বন্ধ করে দেয়। অন্যদিকে শহীদ রুমী স্কোয়াডের সঙ্গে একরকম প্রতারণা করেই তাদের অনশন কর্মসূচি স্থগিত করানো হয়। প্রতারণা বললাম এই কারণে যে, মাননীয় পরিকল্পনামন্ত্রী এ কে খন্দকার বলেছিলেন জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধের দাবি মেনে না নিলে তিনি নিজেই অনশনে বসবেন। কবে সেটা? জানা যায় নি। ফলে অনেকেই মনে হয় কিছুটা হলেও আশাহত হয়েছিলেন, উদ্যোম হারিয়েছিলেন। ফলে সরকারও হয়তো ভাবতে শুরু করেছিল যে, ওদেরকে তো শান্ত করাই গেছে, এখন তাদের দাবির দিকে না তাকালেও হবে। বরং অন্যদিকটাই ট্যাকল দিই। এই পর্যায়ে শাহবাগ আন্দোলনের পক্ষ থেকেও সরকারকে জানিয়ে দিতে পারাটা দরকার ছিল যে, আমরাও আমাদের দাবি থেকে একচুল নড়িনি। আবার সবাইকে স্মরণ করিয়ে দেওয়ার দরকার ছিল যে, ‘আমরা বাড়ি ফিরছি না/রাজাকারদের ছাড়ছি না’। নিজেদের শক্তিমত্তা সম্পর্কে জানান দেওয়ার দরকার ছিল। নাহলে সবাই মনে করত যে, শাহবাগ আন্দোলন সতিই শেষের পথে।

আর রুমী স্কোয়াডের ৮দিনের আমরণ অনশন কর্মসূচিতেও যে সরকারের কোন ভ্রুক্ষেপ হয়নি সেটা তো বোঝাই যায়। এই পরিস্থিতিতে শাহবাগের অস্তিত্বের কথা সরকারকে মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য কঠোর কর্মসূচিরই প্রয়োজনীয়তা ছিল। দেশ পরিচালনায় নিযুক্ত রাজনীতিবিদরা এখনো হয়তো বুঝতে পারছেন না যে, শাহবাগ আন্দোলন ও হেফাজতে ইসলাম পুরোপুরি বিপরীতধর্মী দুইটা পক্ষ। দুই পক্ষ পরস্পরের পুরোপুরি উল্টাপথে হাঁটতে চায়। একপক্ষ চায় সামনে এগোতে, আরেক পক্ষ চায় পেছনে ফিরে যেতে। দুইটি আদর্শের মতভিন্নতা এতটাই বেশি যে, এটার মধ্যে কোন সমন্বয়ও সম্ভব কিনা, সন্দেহ আছে। ফলে সরকার যদি সবসময় ভোটবুদ্ধি না খাটিয়ে একটু যুক্তিবুদ্ধি খাটাতো তাহলে হেফাজতে ইসলামকে আস্কারা দেওয়ার আত্মঘাতি সিদ্ধান্ত কখনোই নিত না। আফসোস যে, তারা সেটা করছেন না। ফলে শাহবাগ আন্দোলনের পক্ষ থেকে নব উদ্যোমে সংগঠিত হওয়ার এই সুযোগটা ইতিবাচকই হয়েছে বলে আশা করছি।

 শুধু হাতইয়ার নামনইয়ারও চাই

এই একবিংশ শতাব্দির পৃথিবীতে হেফাজতে ইসলাম যে ধরণের দাবিদাওয়া উঠিয়েছে, সেটা মেনে দেওয়া প্রায় অসম্ভব রকমের ব্যাপার। কিন্তু তাদেরকে সহিংস উপায়ে হাতিয়ারের সাহায্যে মোকাবিলা করার পথ বেছে নেওয়া মোটেই মনে হয় উচিত্ হবে না দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধের সৈনিকদের। একথা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই যে, হেফাজতে ইসলামের ডাকে রাস্তায় বেরিয়ে আসা লোকের সংখ্যাও বাংলাদেশে কম না। এবং ধর্ম বিষয়টা আসলেও খুব স্পর্ষকাতর ইস্যু। তাই খুবই সাবধানতার সাথে এই পরিস্থিতি মোকাবিলা করা প্রয়োজন।

হেফাজতে ইসলামের লংমার্চে যারা অংশ নিয়েছিলেন তাদের অধিকাংশই জীবনে কখনো ইন্টারনেট, ফেসবুক-ব্লগ ব্যবহারের সুযোগ পেয়েছেন কিনা সন্দেহ আছে। তারা ধর্মভিত্তিক বইগুলো ছাড়া অন্য কোন বই পড়ারও সুযোগ পেয়েছেন কিনা সন্দেহ আছে। ফলে শিক্ষিত-শহুরে মানুষদের থেকে তাদের মানসিক ব্যবধানটা যে অনেক বেশি থাকবে, এতে আশ্চর্যের কি আছে। কিন্তু ‘আমরা জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা করি, আমরা মুক্তমনা’ এই বলে আত্মপ্রসাদের ভোগাটাও বিপদজনক হবে অপর পক্ষের জন্য। বরং দুই পক্ষের সাংস্কৃতিক-মানসিক মেলবন্ধনটা কিভাবে হতে পারে সেটাই বিবেচনা করা দরকার।

গতকাল খুব অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম, আমার এক স্কুলবন্ধুর মনে জন্মেছে প্রচণ্ড ইসলাম বিদ্বেষ। ইসলাম ধর্ম মানবকল্যানের জন্য, শান্তির জন্য কোন অবদান রাখতে পারে না বলেই সে মনে করে। এই ধরণের আলট্রা মডার্ন দৃষ্টিভঙ্গিও কিন্তু আখেরে সমাজের কোন কল্যান বয়ে আনবে না। এই রকমের দৃষ্টিভঙ্গি বরং ঘৃণার বিপরীতে আরও ঘৃণাই ছড়াবে। সমাজকে শান্তির পথে নিয়ে নিয়ে যাবে না। স্বাধীনতা-সমবেদনার পথে নিয়ে যাবে না।

ধর্মচিন্তা-ধর্ম সংক্রান্ত আলাপ-আলোচনাকে পরিহার-পরিত্যাগ করে অনেকদিন থাকা হয়েছে। প্রগতিশীলদের পক্ষ থেকে ধর্মীয় আলাপ দূরে সরিয়ে রাখার যে প্রবণতা, এতদিন সেটারই ফায়দা নিয়েছে কট্টরপন্থী, রক্ষণশীলরা। তারা নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য ইসলাম ধর্ম বা অতীতে আরও অনেক ধর্মের অপব্যাখ্যা দিয়েছে, এখনো দিচ্ছে। একদল মানুষ কিছু না বুঝেই মোল্লা-পুরোহিতদের সাথে সাথ মিলিয়ে গেছেন, পরকালের ভয়ে। অপরদিকে কিছু মানুষ এসব দেখে পুরো ধর্মটাকেই অবজ্ঞা করতে শুরু করেছেন। এটা এক ভয়াবহ দুষ্টচক্র। পুরো সমাজের কল্যানেই এর অবসান ঘটানো প্রয়োজন।

দুই পক্ষের সামজিক-সাংস্কৃতিক ব্যবধানটা ঘোঁচাতে হবে। সেটা জ্ঞান-বিজ্ঞানের দিক থেকেও, ধর্মীয় বা আধ্যাত্মিকতার দিক থেকেও। মানুষের জন্য, সমাজের জন্য বিজ্ঞানভিত্তিক অগ্রগতিটা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি মনুষ্যজন্মের মহিমা বোঝার জন্য আধ্যাত্মিক চর্চাটাও সমান গুরুত্বপূর্ণ। সেই আধ্যাত্মিকতার চর্চা ইসলাম ধর্ম দিয়েও হতে পারে, অন্যান্য ধর্ম-মতবাদ দিয়েও হতে পারে। আধ্যাত্মিক শূণ্যতা (Spiritual Vacuum) যে সামগ্রিকভাবে সমাজের জন্য ক্ষতিকর সেটা নিয়ে পশ্চিমে বেশ কথাবার্তা শুরু হয়েছে। কারণ তারা এটা টের পাওয়া শুরু করেছে। বাজার সংস্কৃতিতে সব কিছু কিনতে পাওয়া গেলেও মনের শান্তিটা এখনও পর্যন্ত কোন কোম্পানি বাজারজাত করে নাই। আর এই মনের শান্তি লাভের উপায়-উপাদানগুলো অনেকাংশে সংরক্ষিত আছে বিভিন্ন ধর্মীয় মতবাদগুলোর মধ্যে। পুরো ধর্মকেই খারিজ করে দেওয়ার প্রবনতা থেকে সরে এসে আমাদের বরং ধর্মীয় মতবাদগুলোর মুক্তিকামী উপাদানগুলো খুঁজে বের করা দরকার। সেগুলো প্রচার-প্রসার করা দরকার।

আর এটা করতে গেলে আমাদের ওঠাতে হবে মন-ইয়ার। অস্ত্রে নয়, শান দিতে হবে যুক্তিতে। মানবতার পক্ষে, সাম্য-স্বাধীনতার পক্ষে নিরন্তর প্রচারণা চালাতে হবে। সমাজের সুবিধাবঞ্চিত মানুষদের কাছে যেমন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে যেতে হবে, জ্ঞান-বিজ্ঞান অগ্রগতির খবর নিয়ে যেতে হবে, তেমনি ইসলামসহ প্রতিটা ধর্মে বিরাজমান সাম্য-শান্তি-সমবেদনার বার্তাও পৌঁছে দিতে হবে। বর্তমানে দেশের যা পরিস্থিতি তাতে, ব্যাপক আকারের সাংস্কৃতিক প্রচারণার মাধ্যমেই কেবল রক্ত নিয়ে হোলি খেলা বন্ধ করা সম্ভব।

নতজানু আর নয়

পূর্বপরিকল্পিত পথেই হাঁটছে জামায়াত-শিবির

২০০৯ সালে জামায়াতে ইসলামীর করা কিছু পরিকল্পনা-কর্মপদ্ধতি সম্পর্কে জানা যায় উইকিলিকসের কল্যানে। এগুলো তারা বলেছিল ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে। নিজেদের লক্ষ্য সম্পর্কে জামায়াত নেতারা বলেছিল, জামায়াত পরবর্তী নির্বাচনে জয়ী হওয়া বা জাতীয় সংসদে আসনসংখ্যা বাড়ানোর মতো স্বল্পমেয়াদি অর্জন নিয়ে চিন্তিত নয়, তাদের দৃষ্টি চূড়ান্ত লক্ষ্যের দিকে। চূড়ান্ত লক্ষ্যটা কি? ইসলামি রাষ্ট্র কায়েম করা। পাকিস্তানে যেমনটা ছিল-আছে।
২০০৮ সালে আওয়ামী লিগ সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করার অঙ্গীকার নিয়ে ক্ষমতায় এলে খানিকটা কোনঠাসা বোধ করে জামায়াত-শিবির। যদি সরকার তাদের নিষিদ্ধই করে, তাহলে কী করা হবে সেটাও তখনই ভেবে রেখেছিল তারা। উইকিলিকসে জামায়াতে ইসলাম ২০১০ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রদূত মরিয়ার্টি একটি গোপনীয় তারবার্তায় লেখেন: জামায়াতের নেতা ব্যারিস্টার রাজ্জাক ১০ ফেব্রুয়ারি বৈঠকে তাঁকে বলেন, জামায়াতে ইসলামী ‘সাংবিধানিক পথে’ বিশ্বাস করে, দলটি আদালতের সিদ্ধান্ত মেনে চলবে। বাংলাদেশে যদি ধর্মভিত্তিক দলগুলো নিষিদ্ধ হয়ে যায়, তাহলে জামায়াত তুরস্কের ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর দৃষ্টান্ত অনুসরণ করবে। জামায়াত দলের নাম পরিবর্তন করবে, দলীয় গঠনতন্ত্র থেকে ধর্মীয় মতবাদগুলো বাদ দেবে; কিন্তু একই সঙ্গে তিনি বলেন যে জামায়াত রুলিংটিকে আদালতে চ্যালেঞ্জ করবে। রাজ্জাকের ভাষ্য অনুসারে, ধর্মভিত্তিক দলগুলোর ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হলে জামায়াতে ইসলামী দলের নামে ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ও ট্রাস্টে যে অর্থ আছে, দলটি তা হারাবে, কিন্তু দল টিকে থাকবে। রাজ্জাক বলেন, একটি ক্ষত সৃষ্টি হবে, তবে সেই ক্ষত সারানো যাবে। (সূত্র: উইকিলিকসে বাংলাদেশ: ‘জামায়াতে ইসলামী- খরগোশ নয়, কচ্ছপ’)
দুই বছর পরে এখন তাহলে জামায়াত কি সেই কর্মপরিকল্পনা অনুসারেই হাঁটছে না? হেফাজতে ইসলাম যে জামায়াতেরই মদদপুষ্ট এবং মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ সেকথা কি এখনো কারও বোঝার বাকি আছে? পরিস্কারভাবে দেখা যাচ্ছে যে, তারা হেফাজতে ইসলামের নামে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচাল, জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধের দাবির কণ্ঠরোধ করতে চায়।
জামায়াত তুরস্কের ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর দৃষ্টান্ত অনুসরণ করবে সেকথাও বলেছে। সকলের বোধহয় মনে আছে যে, ট্রাইবুন্যালের বিচার কার্যক্রমকে প্রশ্নবিদ্ধ করে এই বিচার বন্ধ করার প্রস্তাব দিয়েছিল তুরস্কের সরকার। ফলে তুরস্ক তো জামায়াতের আদর্শ উদাহরণ হবেই। সেই পথেই তারা এগিয়ে যাচ্ছে এবং হেফাজতে ইসলাম ব্যানারের আড়ালে নতুনভাবে সংগঠিত হতে চাচ্ছে।

হেফাজতে ইসলাম + জামায়াতে ইসলামী = হেফাজতে জামায়াতে ইসলামী

জামায়াতে ইসলামী ও হেফাজতে ইসলাম যে একই মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ এটা তাদের কর্মকা-ের মাধ্যমেও বোঝা যায়।
শাহবাগ আন্দোলন শুরুর সঙ্গে সঙ্গে এটাকে নাস্তিকদের আন্দোলন বলে মিথ্যা প্রচারণা চালিয়েছিল জামায়াত-শিবির। তারা ব্লগার রাজীব হায়দারকে হত্যা পর্যন্ত করেছে। ধর্মভীরু মানুষদের মাঝে তারা প্রচারণা চালিয়েছে যে, শাহবাগে সবাই নাস্তিক, ওখানে বেলেল্লাপনা হয়, ওরা ‘বিজাতীয় সংস্কৃতি’র ধারকবাহক। এই প্রচারণা দিয়ে এখনো সারাদেশে তা-ব চালিয়ে যাচ্ছে জামায়াত-শিবির। এদিকে ধুম করে দৃশ্যপটে হাজির হওয়া এবং সবাইকে ভীতসন্ত্রস্ত করে তোলা হেফাজতে ইসলামের দাবিগুলোও কিন্তু একই রকম। জামায়াত-শিবিরও মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্য, শহীদ মিনার, মন্দিরে মূর্তি ভাঙ্গছে, আগুন দিচ্ছে। হেফাজতে ইসলামীও তাদের মতো করে মূর্তি-ভাস্কর্য স্থাপনের বিরোধীতা করছে।
হেফাজতে ইসলামের ১৩ দফা দাবি দেখলেই বোঝা যায় যে তারা কেমন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করতে চায়। এগুলো মধ্যে কয়েকটি হলো: ব্যক্তি ও বাক-স্বাধীনতার নামে সকল বেহায়াপনা, অনাচার, ব্যভিচার, প্রকাশ্যে নারী-পুরুষের অবাধ বিচরণ, মোমবাতি প্রজ্বলনসহ সকল বিজাতীয় সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ বন্ধ করতে হবে, মসজিদের নগরী ঢাকাকে মূর্তির নগরীতে রূপান্তর এবং দেশব্যাপী রাস্তার মোড়ে ও কলেজ-ভার্সিটিতে ভাস্কর্যের নামে মূর্তি স্থাপন বন্ধ করতে হবে, পার্বত্য চট্টগ্রামসহ দেশব্যাপী ইসলাম বিরোধী কর্মকা-ে জড়িত এনজিও এবং খ্রিস্টান মিশনারীদের ধর্মান্তকরণসহ সকল অপ-তৎপরতা বন্ধ করতে হবে, কথিত শাহবাগী আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী স্বঘোষিত নাস্তিক-মুরতাদ এবং প্রিয় নবী (সা.)-র শানে জঘন্য কুৎসা রটনাকারী কুলাঙ্গার ব্লগার ও ইসলাম বিদ্বেষীদের সকল অপপ্রচার বন্ধসহ কঠোর শাস্তিদানের ব্যবস্থা করতে হবে ইত্যাদি ইত্যাদি।
এ কেমন বাংলাদেশ বানানোর দাবি জানাচ্ছে হেফাজতে ইসলাম? এটা কি বাংলাদেশকে পাকিস্তান বা আফগানিস্তান বানানোরই রুপকল্প না? এই দাবি বাস্তবায়ন হলে নারী-পুরুষ অবাধে মেলামেশা করতে পারবে না। মূর্তি-ভাস্কর্য স্থাপন করা যাবে না। মোমবাতি প্রজ্জলন এদের কাছে বিজাতীয় সংস্কৃতি। হেফাজতে ইসলামের কল্পিত বাংলাদেশে সবাইকেই এক অর্থে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে হবে। আর যদি অন্য ধর্মাবলম্বী কেউ থাকেও তাহলে তারা নিজেদের আচার পালন করতে পারবেন না। এবং এই মুসলিমটাও হতে হবে তাদের তরিকা অনুযায়ী। কারণ তারা কাদিয়ানীদেরও অমুসলিম ঘোষণা করেছে। হেফাজতে ইসলাম যে বাংলাদেশ কায়েম করতে চায় সেটা হবে চরম আকারের সাম্প্রদায়িক, রক্ষণশীল,  গুমোট একটা পরিবেশ। সেখানে কারও স্বাধীন মত প্রকাশের স্বাধীনতা থাকবে না, গণতান্ত্রিক চর্চার সুযোগ থাকবে না। ৪২ বছর আগে মুক্তিযোদ্ধারা জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করেছিলেন কি এই বাংলাদেশের জন্য?

হেফাজতে ইসলাম কেন ইসলামী নিদর্শন ধ্বংস নিয়ে কোন কথা বলে না?

হেফাজতে ইসলাম কতিপয় কিছু কথিত নাস্তিক ব্লগারদের পেছনে লেগেছে। কিন্তু যখন সৌদি আরবে মহানবী হজরত মোহাম্মদ (সাঃ) এর সময়কার, তাঁর স্মৃতিবিজরিত মসজিদসহ অন্যান্য স্থাপনা ভেঙ্গে ফেলা হয় তখন কোথায় থাকেন হেফাজতে ইসলামের লোকজনেরা? সেটাকে তাহলে তারা ইসলামের কোন ক্ষতি বলে মনে করছে না? মহানবীকে নিয়ে কটুক্তি করলে ব্লগার গ্রেপ্তার আর মহানবীর নিদর্শন, যেখানে মহানবী নামাজ পড়েছেন, সেই মসজিদ ভেঙ্গে দিলে কোন সমস্যা নেই?

Macca

বাংলাদেশেও খুবই প্রাচীন একটা মসজিদের সন্ধান পাওয়া গেছে রংপুরের রামজাপুর গ্রামে। ধারণা করা হচ্ছে এটা দক্ষিণ এশিয়ারই প্রথম মসজিদ হতে পারে। কিন্তু সেখানকার গুরুত্বপূর্ণ প্রতœতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলো সরকারী অবহেলায় নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। সে ব্যাপারে হেফাজতে ইসলামের কোন কথাবার্তা নেই কেন? তাহলে এটা কি খুবই পরিস্কার না যে, হেফাজতে ইসলাম আসলে কী হেফাজত করতে চাচ্ছে? তারা প্রকৃতঅর্থেই জামায়াতের হেফাজতকারী। যুদ্ধাপরাধীদের হেফাজতকারী। এদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর সময় এখনই।

আওয়ামী লিগ সরকারের ডিগবাজি

১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত ধর্মের নামে পাকিস্তানী ঔপনিবেশিক শাসকরা এই বাংলাদেশ ভূখ-ের মানুষদের শোষণ করেছিল, নির্যাতন-নিপীড়ণ চালিয়েছিল, খুন-ধর্ষণ করেছিল। সেই অভিজ্ঞতা থেকেই সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে যখন সংবিধান রচিত হয় তখন রাষ্ট্র পরিচালনার চারটি মূলনীতির মধ্যে স্থান দেওয়া হয় ধর্মনিরপেক্ষতাকে। কিন্তু অবাক করে দেওয়ার মতো বিষয় হলো, যে আওয়ামী লিগের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়েছিল, যে আওয়ামী লিগ ১৯৭২ সালে প্রথম সংবিধানটি রচনা করেছিল সেই আওয়ামী লিগই ৪২ বছর পর নতজানু হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধী হেফাজতে ইসলামের কাছে। সরকার নাকি জামায়াতের লেবেলধারী হেফাজতে ইসলামের বেশ কিছু দাবি আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে মেনে নিতে যাচ্ছে। কিছুতেই বোঝা যায় না যে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা হয়ে বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কিভাবে হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে আপোষ করতে পারেন। জয় বাংলার পরে জয় বঙ্গবন্ধু না বললে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ঠিকমতো প্রতিষ্ঠিত হয় না বলে মনে করেন অনেক আওয়ামী লিগার। কিন্তু এখন তো আপনারা বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলার স্বপ্নের বিপরীতেই হাঁটছেন। এ কেমন স্ববিরোধীতা?
হেফাজতে ইসলামের কাছে সরকার যেন নিজের মাথাটাই পেতে দিয়েছে। অত্যন্ত অন্যায়ভাবে গ্রেফতার করা হয়েছে তিনজন ব্লগারকে। তাঁরা কি অবমাননা করেছেন, কিভাবে অবমাননা করেছেন সেগুলো এখনো কারো কাছে স্পষ্ট না। ব্লগ-ব্লগার বলতে হেফাজতে ইসলামই বা কি বোঝেন আর সরকারই বা কি বোঝেন সেটা নিয়েও যথেষ্ট সন্দেহ আছে। সরকার আমারব্লগ বন্ধ করে দিয়েছে। হেফাজতে ইসলামের কথা বাদ দিলাম, ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়তে চাওয়া সরকার কি জানে যে ব্লগগুলোতে শুধু ঐ দুই-তিনজনই লেখেন না। আরও অনেকেই লেখেন। শুধু ধর্ম নিয়েই না, সেখানে রাজনীতি-অর্থনীতি-সমাজ নিয়েও আরও অনেক লেখা ছিল? সেগুলো তাহলে আমরা কিভাবে পড়ব? স্বাধীন মতপ্রকাশের পথ এভাবে কেন বন্ধ করা হবে?
দেশ পরিচালনায় নিযুক্ত ব্যক্তিবর্গ, আপনারা কিভাবে ভুলে যান যে, জামায়াতে ইসলাম ১৯৭১ সালে কিভাবে এদেশের সূর্য্যসন্তানদের হত্যা করেছে। এই একই ধর্মের দোহাই তুলে। ৪২ বছর পরে এবারও স্বাধীনতাবিরোধী গোষ্ঠী সেই একই কায়দায় রুদ্ধ করতে চাইছে এদেশের মুক্ত চিন্তা-স্বাধীন মতপ্রকাশের পথ। আর সরকার মহোদয়রা সেই কাজেই আরও সহায়তা করছেন। এর চেয়ে দুঃখজনক আর কি হতে পারে? বিএনপি যদি এই কাজটা করত তাহলে এটাকে দুঃখজনক বলে আখ্যায়িত করার প্রয়োজন পড়ত না। কারণ তারা তো সেটা করবেই, ঐতিহাসিকভাবে তারা এটা করে এসেছে। এখনো তারা হেফাজতে ইসলামের প্রতি, প্রকারান্তরে জামায়াত শিবিরের প্রতি নৈতিক সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আওয়ামী লিগ? তারা না মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি? এই আওয়ামী লিগই না ১৯৭২ সালে ‘গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতাকে মূল নীতি করে সংবিধান রচনা করেছিল?’ মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকার-চেতনা সব কি ভেসে গেল ভোটের চিন্তায়? পক্ষ নিন সরকার- মানবতা না মুনাফা?

নতজানু আর নয়

শাহবাগ আন্দোলনের শুরুর দিকে অনেকেই ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করে, ১৯৭২ সালের সংবিধান অনুযায়ী ধর্মনিরপেক্ষতার পথে হাঁটার আওয়াজ তুলেছিলেন। সেসময় কৌশলগত কারণে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি বাদ দিয়ে শুধু জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধের দাবিতে সরে আসা হয়েছিল। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে এতে জামায়াত-শিবিরের কর্ম-পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করার পথ প্রসারিত হয়েছে। নিষিদ্ধ হয়ে যাবে বুঝতে পেরেই তারা হেফাজতে ইসলামের ব্যানারে সংগঠিত হচ্ছে। ফলে জামায়াত-শিবিরকে শুধু নিষিদ্ধ করলেই হবে না। নিষিদ্ধ করতে হবে তাদের রক্ষণশীল-সাম্প্রদায়িক মতাদর্শকেও। যেমনটা করা হয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর হিটলারের নাৎসি পার্টিকে। এমনভাবে তাদেরকে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল যে এখনও, ৬২ বছর পরে নাৎসি ভঙ্গিতে স্যালুট দেওয়ার দায়ে আজীবনের জন্য নিষিদ্ধ করা হয় প্রতিভাবান তরুণ ফুটবলারকে। এইরকম কঠোরভাবেই বন্ধ করে দিতে হবে জামায়াত-শিবিরের এখানে সেখানে গজিয়ে ওঠার পথ। তাহলেই কেবল একটি অসাম্প্রদায়িক, মানবিকতার সমাজের পথে অগ্রসর হওয়া সম্ভব বাংলাদেশের পক্ষে। যেমন বাংলাদেশের স্বপ্ন বুকে নিয়ে মুক্তির সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন পুরো দেশের স্বাধীনতাকামী মানুষ। ফলে শাহবাগ চত্বরে দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছে, একথা যদি স্বীকার করে নিই, তাহলে বিজয় অর্জন করতে গেলে সেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নের পথেই হাঁটতে হবে শাহবাগ আন্দোলনকে। ষ্পষ্টভাবে বলতে হবে, ৭১ এ স্বাধীনতাবিরোধী গোষ্ঠী যে আদর্শ-মতবাদের প্রেক্ষিতে রাজনীতি করছে, স্বাধীন বাংলাদেশে সেই মতাদর্শ বাস্তবায়নের কোন অধিকার থাকতে পারবে না। সাংবিধানিকভাবে তাদের রাজনৈতিক অধিকার বিলোপ করতে হবে।

সরকারের স্ববিরোধীতা উন্মোচিত হচ্ছে

যুদ্ধাপরাধীদের সংগঠন জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধের দাবিতে আমরণ অনশনে বসেছিলেন রুমী স্কোয়াডের স্কোয়াডের কিছু স্বপ্নবাজ তরুণ-তরুণী। সরকারের তরফ থেকে তাদের দাবিটা উপেক্ষা করা হয়েছিল টানা ৬টা দিন। এর আগে সরকারকে জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধের প্রক্রিয়া শুরু করার জন্য এক মাসেরও বেশি সময় দিয়েছিল গণজাগরণ মঞ্চ। অনশনের সময় বেশ কয়েকজন অনশনকারী কয়েক দফায় হাসপাতালে গিয়েছে, প্রচণ্ড ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে একটি পুরো রাত পার করেছে। অনুমান করতে পারি যে, এই কয় দিনে অনেক অনেক বাধা-বিপত্তির মুখে তাদের পড়তে হয়েছে। মৃত্যুকে তুচ্ছ করে কেন করছিলেন তাঁরা এইসব? কারণ তাঁরা মনে করছেন, নতুন বাংলাদেশ গঠনের কাজে হাত দেওয়ার আগে দেশের ক্যান্সারস্বরুপ জামায়াত-শিবিরকে আগে নির্মূল করা প্রয়োজন। আর দাবি আদায়ের জন্য তাঁরা কোন জ্বালাও-পোড়াও করছেন না, কাউকে হুমকি-ধামকি দিচ্ছেন না, নিজেদের কথা সরকারের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য তারা নিজেদেরকেই কষ্ট দিচ্ছেন। গতকাল ১ এপ্রিল পরিকল্পনা মন্ত্রী ও  মুক্তিযুদ্ধের সেকেন্ড-ইন-কমান্ড এ.কে.খন্দকারের  আশ্বাসের প্রেক্ষিতে অনশন কর্মসূচি স্থগিত করেছে শহীদ রুমী স্কোয়াড।

rumi

অন্যদিকে সহিংসতা-হরতাল-অবরোধের হুমকি আসছে হেফাজতে ইসলামের তরফ থেকে। যাদেরকে অনেকেই, এমনকি ইসলামী লোকজনই বলেছেন, জামায়াতেরই অন্য রুপ। তারা আসলে ইসলাম না, জামায়াতেরই হেফাজত করতে নেমেছে। ‘নাস্তিক’ ব্লগার ও ধর্মানূভূতিতে আঘাত দেওয়ার শাস্তির দাবিতে চলছে এই আন্দোলন। তাদের ১৩টি দাবি হলো:

১। সংবিধানে ‘আল্লাহ্‌্‌র উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস’ পুনঃস্থাপন এবং কোরান-সুন্নাহ্‌্‌ বিরোধী সকল আইন বাতিল করতে হবে।
২। আল্লাহ্‌, রাসুল (সা.) ও ইসলাম ধর্মের অবমাননা এবং মুসলমানদের বিরুদ্ধে কুৎসা রোধে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে জাতীয় সংসদে আইন পাস করতে হবে।

৩। কথিত শাহবাগী আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী স্বঘোষিত নাস্তিক-মুরতাদ এবং প্রিয় নবী (সা.)-র শানে জঘন্য কুৎসা রটনাকারী কুলাঙ্গার ব্লগার ও ইসলাম বিদ্বেষীদের সকল অপপ্রচার বন্ধসহ কঠোর শাস্তিদানের ব্যবস্থা করতে হবে।

৪। ব্যক্তি ও বাক-স্বাধীনতার নামে সকল বেহায়াপনা, অনাচার, ব্যভিচার, প্রকাশ্যে নারী-পুরুষের অবাধ বিচরণ, মোমবাতি প্রজ্বলনসহ সকল বিজাতীয় সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ বন্ধ করতে হবে।

৫। ইসলামবিরোধী নারীনীতি, ধর্মহীন শিক্ষানীতি বাতিল করে শিক্ষার প্রাথমিক স্তর থেকে উচ্চ মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত ইসলাম ধর্মীয় শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করতে হবে।

৬। সরকারিভাবে কাদিয়ানিদের অমুসলিম ঘোষণা এবং তাদের প্রচারণা ও ষড়যন্ত্রমূলক সকল অপ-তৎপরতা বন্ধ করতে হবে।
৭। মসজিদের নগরী ঢাকাকে মূর্তির নগরীতে রূপান্তর এবং দেশব্যাপী রাস্তার মোড়ে ও কলেজ-ভার্সিটিতে ভাস্কর্যের নামে মূর্তি স্থাপন বন্ধ করতে হবে।

৮। জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমসহ দেশের সকল মসজিদে মুসল্লিদের নির্বিঘ্নে নামাজ আদায়ে বাধা-বিপত্তি ও প্রতিবন্ধকতা অপসারণ এবং ওয়াজ-নসিহত ও ধর্মীয় কার্যকলাপে বাধাদান বন্ধ করতে হবে।

৯। রেডিও, টেলিভিশনসহ বিভিন্ন মিডিয়ায় দাড়ি-টুপি ও ইসলামী কৃষ্টি-কালচার নিয়ে হাসি-ঠাট্টা এবং নাটক-সিনেমায় খল ও নেতিবাচক চরিত্রে ধর্মীয় লেবাস-পোশাক পরিয়ে অভিনয়ের মাধ্যমে তরুণ প্রজন্মের মনে ইসলামের প্রতি বিদ্বেষমূলক মনোভাব সৃষ্টির অপপ্রয়াস বন্ধ করতে হবে।

১০। পার্বত্য চট্টগ্রামসহ দেশব্যাপী ইসলাম বিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িত এনজিও এবং খ্রিস্টান মিশনারীদের ধর্মান্তকরণসহ সকল অপ-তৎপরতা বন্ধ করতে হবে।

১১। রাসুলপ্রেমিক প্রতিবাদী আলেম-ওলামা, মাদরাসা ছাত্র এবং তৌহিদী জনতার ওপর হামলা, দমন-পীড়ন, নির্বিচার গুলিবর্ষণ এবং গণহত্যা বন্ধ করতে হবে।

১২। সারা দেশের কওমী মাদরাসার ছাত্র-শিক্ষক, ওলামা-মাশায়েখ এবং মসজিদের ইমাম-খতিবকে হুমকি-ধামকি ও ভয়ভীতি দানসহ তাদের বিরুদ্ধে সকল ষড়যন্ত্র বন্ধ করতে হবে।

১৩। অবিলম্বে গ্রেপ্তারকৃত সকল আলেম-ওলামা, মাদরাসা ছাত্র ও তৌহিদী জনতাকে মুক্তিদান, দায়েরকৃত সকল মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার এবং আহত ও নিহতদের ক্ষতিপূরণসহ দুষ্কৃতকারীদেরকে বিচারের আওতায় এনে কঠোর শাস্তি দিতে হবে।

এই দাবি নিয়ে আগামী ৬ মার্চ ঢাকামুখী লংমার্চ করার ব্যাপক প্রস্তুতি নিচ্ছেন হেফাজতে ইসলামের নেতা-কর্মীরা। এর ভেতরে বেশ কিছু দাবিই নাকি মেনে নেওয়ার বিষয় বিবেচনা করা হচ্ছে

পরষ্পরবিরোধী দুই পক্ষই আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের চিন্তাচেতনাই শুধু না, দাবি আদায়ের লক্ষ্যে কর্মসূচি বেছে নেওয়ার ধরণেও স্পষ্ট পার্থক্য বিদ্যমান। চট্টগ্রামে একবার হেফাজতে ইসলামের নেতৃবৃন্দকে আলোচনায় বসার আহ্বানও জানানো হয়েছিল গণজাগরণ মঞ্চের পক্ষ থেকে। তারা কিন্তু সেবার আলোচনা করতে রাজি ছিলেন না। অহিংস ও সহিংস, দুই পক্ষেরই দাবি সরকারের কাছে। প্রশ্ন হচ্ছে, সরকার কাদের দাবির কথাটা আগে বিবেচনা করবে? জামায়াতের লেবেলধারী সহিংসতাপন্থী হেফাজতে ইসলামের নাকি মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারী অহিংস শাহবাগ আন্দোলনের?

জামায়াত-শিবিরকে নিষিদ্ধের বিষয়ে সরকার এখনো আনুষ্ঠানিক কোন বক্তব্য দেয়নি। সরকারদলীয় ব্যক্তিবর্গের কথাতে স্ববিরোধীতাও স্পষ্ট। দুই দিন আগেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছিলেন, পুরো দেশে দাবি উঠলে জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধ করব। আজ ২ এপ্রিল আওয়ামী লিগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল হক হানিফ বলেছেন, সমগ্র দেশে এখন জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার দাবি উঠেছে। এই দলকে নিষিদ্ধ করা এখন সময়ের ব্যাপার। তাদের নিষিদ্ধ করার প্রক্রিয়া খুব দ্রুত শুরু হবে।’
খুব দ্রুতটা যে কবে, সেটা কিন্তু এখনো জানা গেল না। শুধু তাই না, শাহবাগ আন্দোলন নিয়ে উষ্মাও প্রকাশ করেছেন দেশ পরিচালনার সঙ্গে জড়িত রাজনীতিবিদেরা।

অন্যদিকে হেফাজতে ইসলামের দাবি দ্রুত মেনে নেওয়ার উদ্যোগ দেখিয়েছে সরকার। ৬ এপ্রিলের লংমার্চের আগেই সরকার ‘আমারব্লগ’ বন্ধ করে দিয়েছে, তিনজন ব্লগারকে গ্রেফতার করে রিমান্ডে নিয়েছে। এবং এই ক্ষেত্রে জনমত যাচাইয়েরও কোন প্রয়োজনীয়তা মনে করেনি সরকার। এটা কি সরকারের স্ববিরোধীতা নয়? ত্বরিতগতিতে তিন ব্লগারকে গ্রেপ্তার-রিমান্ড, ব্লগ বন্ধ ইত্যাদি আলামত থেকে আশঙ্কা হয় যে. সরকার হেফাজতে ইসলামের দিকেই বেশি ঝুঁকে গেছে। কেন এমন হলো? আওয়ামী লিগ না মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি? আওয়ামী লিগ কি তাহলে শুধু ভোটের জন্যই তাহলে মুক্তিযুদ্ধের কথা বলে? সরকারের কর্মকাণ্ড মানুষের মনে এমন অনেক প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে। গণজাগরণ মঞ্চের পক্ষ থেকে ইমরানও ছয়টি প্রশ্ন রেখেছেন সরকারের উদ্দেশ্যে,

 ১. জামায়াত-শিবির চক্র ব্লগে এবং ফেইসবুকে মওদুদীবাদ প্রচারের মাধ্যমে ইসলাম ধর্মকে নানাভাবে যখন প্রশ্নবিদ্ধ করে, তখন কোথায় থাকে রাষ্ট্রীয় বিজ্ঞপ্তির ধর্মানুভূতি?

২. যখন জামায়াত জাতীয় মসজিদে ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ করে তখন কী রাষ্ট্রের ধর্মানুভূতি শীতনিদ্রায় থাকে?

৩. যখন চট্রগ্রামে আলেম সমাজকে হত্যার হুমকি দেয় জামায়াত-শিবিরের শ্বাপদরা, তখন কি রাষ্ট্রের অভিধানে ধর্মানুভূতি শব্দটি অনুপস্থিত থাকে?

৪. যখন জামায়াত-শিবির পুলিশের উপরে নির্বিচারে হামলা চালায়, তাদের হত্যা করে, চিকিৎসককে আগুনে পুড়িয়ে মারে, রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে গৃহযুদ্ধের হুমকি দেয়, রাষ্ট্র তখন কেন তদন্ত কমিশন বানায় না? তখন কি রাষ্ট্র আঘাতপ্রাপ্ত হয় না?

৫. হরতালের নৈরাজ্য সৃষ্টি করে জামায়াত-শিবির যখন দেশকে অস্থিতিশীলতার দিকে ঠেলে দেয়, ব্লগের ক্ষুদ্র গণ্ডি থেকে যে সব গণমাধ্যম ধর্মীয় অবমাননাকর বিষয়গুলো সামনে নিয়ে আসে, তখন রাষ্ট্র কেন কমিশন করে ‍উদ্যোগ নেয় না?

৬. যখন অনলাইন এবং ব্লগে জামায়াত-শিবির বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অপপ্রচার চালায়, তখন কেন মহাজোট সরকার তার বিরুদ্ধে উদ্যোগ নেয় না? আজ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু এবং জাতীয় চার নেতা, মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করার বিরুদ্ধে সরকার কি কোনো উদ্যোগ নিয়েছে?

সরকার এখন এইসব প্রশ্নের জবাব দেবে নাকি এই প্রশ্নগুলোর ড্রাফট কে লিখে দিয়েছে, সেটা তদন্ত করতে বসবে, সেটাই দেখার বিষয়।

সরকার শাহবাগ আন্দোলনের গণদাবির প্রতি কোন ভ্রুক্ষেপ তো করছেই না, উল্টো হেফাজতে ইসলামের রক্ষণশীল দাবিগুলোকে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করছে। সেই দাবি বাস্তবায়নের জন্য পদক্ষেপ নিচ্ছে। সরকার একটি ব্লগ পর্যবেক্ষণ কমিটি বানিয়েছে, সেখানে ইসলাম বিশেষজ্ঞ হিসেবে দুইজন আলেমকে স্থান দেওয়া হলেও কোন ব্লগার সেখানে অন্তর্ভূক্ত হননি। কেন? সরকার শুধু তাদের দিকটাই শুনবে? আর সেটা শুনে যখন যেভাবে যাকে খুশি তুলে নিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারবে? এটা তো ভয়াবহ পরিস্থিতি। ককটেলবাজি-বোমা বিস্ফোরণ, খুন, গাড়ি পোড়ানো, ট্রেনের বগি লাইনচ্যুত করা, ভিন্নধর্মাবলম্বীদের বাড়িঘরে আগুন দেওয়া এইসব সহিংস ঘটনার সঙ্গে যারা জড়িত তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে ধীরেসুস্থে। যারা এগুলো করছে, তাদের নিষিদ্ধ করা হবে ধীরেসুস্থে আর কারো সাথে পাঁচে না থেকে শুধু নিজের মতটা প্রকাশের জন্য দণ্ড পেতে হবে ব্লগারদের? বন্ধ করে দেওয়া হবে মুক্তচিন্তার প্ল্যাটফর্মগুলো? এটা কিধরণের ন্যায়বিচার হলো? এটা তো পুরোপুরি স্বেচ্ছাচারী আচরণ। ডিজিটাল ফ্যাসিবাদের আগমনবার্তা।

এইটাই কি আওয়ামী লিগ সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার নমুনা? ব্লগ বন্ধ করে দিয়ে, ইন্টারনেটের উপর নিয়ন্ত্রণ এনে কিভাবে ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠন করতে চান আপনারা? ব্লগ-ওয়েবসাইট-ফেসবুক পেজের মাধ্যমে তো জামায়াত-শিবিরও ব্যাপক মিথ্যা প্রচারণা চালাচ্ছে। সেগুলোর ব্যাপারে তো সরকারের কোন বক্তব্য নেই। সেই মিথ্যা প্রচারণাগুলো কি কারও অনুভূতিতে আঘাত দেয় না? ধর্ম ছাড়া কি মানুষের আর কোন অনুভূতি নেই?

exposed

বিষয়গুলো প্রশ্ন আকারে উত্থাপিত হলেও সরকারের অবস্থান হয়তো ইতিমধ্যেই অনেকের কাছে স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে। কারণ জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে আঁঁতাত করার ইতিহাস আওয়ামী লিগের আছে। ২০০৬ সালে খেলাফতে মজলিশের সঙ্গে তাদের চুক্তির কথাও আমরা জানি।

425125_10200974897117592_328957520_n

অতীতের এই ঘটনাগুলো আমাদের ইঙ্গিত দেয় যে, আওয়ামী লিগ সরকার আরও একবার আপোষরফা করেছে বা করতে চলেছে রক্ষণশীল গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে। দুর্ভাগ্যবশত, এই আশঙ্কা যদি সত্যি হয় তাহলে শাহবাগ আন্দোলনকে আরও কঠোর-বন্ধুর পথ পাড়ি দেওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। যেহেতু প্রত্যেক ক্রিয়ারই একটি সমান এবং বিপরীত প্রতিক্রিয়া আছে, তাই সরকারকেও বিবেচনা করতে হবে শাহবাগ আন্দোলনের বিপরীতে দাঁড়ানোর পরিনামের কথা। মুক্তচিন্তা-মত প্রকাশের স্বাধীনতার উপর হস্তক্ষেপের পরিণামটা কি হবে, সেটার কথা।

নাস্তিকতার বিভ্রান্তি দূর হবে কিভাবে?

556684_10151485313048104_1449525823_n

প্রচণ্ড কোনঠাসা অবস্থার মধ্যে পড়েও জামায়াত-শিবিরই মনে হয় এখন পর্যন্ত কৌশলগত দিক থেকে সফল। শুরুতেই তারা রাজীব হায়দারকে খুন করে শাহবাগ আন্দোলনটাকে ‘আস্তিক-নাস্তিক’ পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছে। ভেবেছিলাম এই কৌশলটা ধোপে টিকবে না। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে যে, এই পরিকল্পনা দারুণভাবে সফলতা অর্জন করেছে। এখন জামায়াত-শিবিরের বদলে হেফাজতে ইসলামকে আদর্শিকভাবে মোকাবিলা করাটাই একটা বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিভাবে দূর করা যাবে এই নাস্তিকতার বিভ্রান্তি? কি পরিকল্পনা গণজাগরণ মঞ্চের? সরকারের?

ধোঁয়াশাপূর্ণ সব বক্তব্য দিয়ে আন্দোলন-কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে হেফাজতে ইসলাম। জিজ্ঞাসা করলে কোন প্রশ্নের উত্তর তাঁরা স্পষ্ট করে দিতে পারবেন কিনা সন্দেহ আছে। ‘নাস্তিক ব্লগার-নাস্তিক ব্লগার’ রব তুলে তারা সবার মনোযোগ কেড়ে নিয়েছে ঠিকই, কিন্তু ব্লগিং বা নাস্তিকতা সম্পর্কে তাদের কোন স্বচ্ছ ধারণাই নেই বলে প্রতিয়মান হয়।

গতকাল রাতে বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাতকারে হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা জুনায়েদ বাবু বলেন, ‘আমাদের দাবি হলো, বর্তমানে যে ব্লগাররা আছে, যারা রাসুল (সা.)-এর অবমাননাকারী, ইসলামের বিদ্বেষী, নাস্তিক্যবাদী, তাদের শাস্তি হওয়া উচিত। সরকার যেন তাদের উচিত শাস্তি দেয়।’ আপনি যেসব ব্লগারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করছেন, তারা অসলে কী লিখেছে, আপনি কি একটা বলতে পারবেন? আপনি নিজে তা পড়েছেন? বিবিসির এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘না, পড়ি নাই। না পড়লেও সমস্যা নাই, আমার যারা কর্মী আছে, কর্মীদের আমরা দায়িত্ব দিছি। তারা পড়েছে। তারা আমাদের শুনাইছে। তারা তো সেইগুলা আমাদের সামনে নিয়া আসছে।’ সেই সব ব্লগারের উচিত শাস্তিটি কী—বিবিসির এই প্রশ্নের উত্তরে মাওলানা জুনায়েদ বাবু বলেন, ‘আমাদের দাবি হলো উচিত শাস্তি দিতে হবে, তারা যেন এই সমস্ত কাজ আর না করে।’

আগে জানতাম নেতারাই পড়াশোনা করে কর্মীদের হেদায়েত দান করেন, সবার নানারকম প্রশ্নের জবাব দেন। এখন তো দেখা যাচ্ছে হেফাজতে ইসলামের কর্মীরাই নেতাদেরকে সবকিছু জানানোর দায়িত্বটা পালন করছে। ভালো কথা, তা করুক। কিন্তু কোন সুনির্দিষ্ট যৌক্তিক বক্তব্য কিন্তু পাওয়া যাচ্ছে না এই নেতা-কর্মীদের কাছ থেকে। তারা দাবি করছে যারা এই সমস্ত কাজ করে তাদের উচিত্ শাস্তি দিতে হবে। ব্যাপারটা এমন দাঁড়িয়েছে যে, কি কাজ, কে করেছে, কবে করেছে, প্রমাণ কিছু আছে কিনা— কোন কিছুই বুঝি না, তারপরও বিচার চাই। এর চেয়ে হাস্যকর-অযৌক্তিক কোন বিষয় এই একবিংশ শতাব্দীর পৃথিবীতে হতে পারে?

এখন পুরো ব্যাপারটা দেখা হচ্ছে জামায়াত-শিবিরের সঙ্গে হেফাজতে ইসলামের সংযুক্তি-সম্পৃক্ততার বিষয় হিসেবে। কিন্তু এই দিক দিয়ে জিনিসটা মোকাবিলা করতে গেলে আরও প্যাঁচ লেগে যাওয়ার আশঙ্কা আছে। বাংলাদেশে ধর্মভীরু মুসলমানের সংখ্যা কম নয়। কয়েকদিন আগেই সাঈদীকে চাঁদে দেখিয়ে অনেক মানুষকে উন্মত্ত করে তুলেছিল জামায়াত-শিবির। ভবিষ্যতে যদি হেফাজতে ইসলামের বিরুদ্ধেও শাহবাগ আন্দোলনের প্রকাশ্য বিরোধ শুরু হয়ে যায়, তাহলে তার পরিণাম বোধহয় ভালো হবে না। গণজাগরণ মঞ্চের পক্ষ থেকে ধর্ম বিষয়ক বিভ্রান্তি দূর করার সর্বোচ্চ চেষ্টাই আমার ধারণা করা হয়েছে। শাহবাগ চত্বরে বারবার উচ্চারিত হয়ে যে, ‘এই আন্দোলনের সঙ্গে ধর্মের কোন বিরোধ নেই, ধর্ম যার যার, দেশ সবার’ ইত্যাদি। যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে ইসলামপন্থী ওলামা-মাশায়েখ ঐক্য পরিষদের নেতৃবৃন্দও সোচ্চার হয়েছেন। তাঁরাও দৃঢ়কণ্ঠে জানিয়েছেন যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবি। তারপরও এই ধর্ম-নাস্তিকতার কার্ড খেলে যাচ্ছে হেফাজতে ইসলাম। গণজাগরণ মঞ্চের সঙ্গে কোন আলোচনাতে যেতেও রাজি নয় তারা। তাহলে এখন এই বিভ্রান্তিমূলক পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের উপায় কি?

285661_586128814749514_2133248007_n

এখন বোধহয় এ বিষয়ে সরকারের অনেক কিছু করার আছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা থেকে শুরু করে দেশ চালানোর কাজে নিযুক্ত সব্বাই তো শাহবাগের গণজাগরণকে সমর্থন জানিয়েছিলেন একবাক্যে। তারা কি করছেন আসলে? কেন দূর করছেন না এই বিভ্রান্তি? বাংলাদেশের ধর্ম মন্ত্রণালয় কি করছে? তাদের দিক থেকে কোন বিবৃতি নেই কেন? সরকারের পক্ষ থেকে সুনির্দিষ্টভাবে শুনতে চাওয়া হোক হেফাজতে ইসলামের অভিযোগসমূহ। কোন ব্লগারের বিরুদ্ধে তারা ব্যবস্থা নিতে বলছেন? কোন ব্লগগুলোকে তারা “প্রিয় নবীজির (সা.) শানে বেয়াদবির” সামিল বলে মনে করছে? কোন বিষয়গুলোকে তারা “জনগণের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার” সামিল বলে মনে করছে? সুনির্দিষ্টভাবে শুনতে চাওয়া হোক। তাহলেই তো সকলের কাছে স্পষ্ট হয়ে যাবে তাদের অবস্থান। অযথাই কান নিয়ে গেছে চিলে বলে দিশাবিহীন দৌড়াদৌড়ি করার কি দরকার?

এই মুহূর্তে হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে জামায়াত-শিবিরের সংশ্লিষ্টতা খোঁজার চেয়ে এই প্রশ্নগুলোর উত্তর জানতে চাওয়াটাই তো মনে হয় বেশি জরুরি। কারণ জামায়াত-শিবির আজ হেফাজতে ইসলামের আড়ালে কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে, কাল অন্য কিছুর আড়ালে আশ্রয় নেবে। এর মূলে হাত দেওয়াটাই কি জরুরি না?