যুদ্ধাপরাধীদের সংগঠন জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধের দাবিতে আমরণ অনশনে বসেছিলেন রুমী স্কোয়াডের স্কোয়াডের কিছু স্বপ্নবাজ তরুণ-তরুণী। সরকারের তরফ থেকে তাদের দাবিটা উপেক্ষা করা হয়েছিল টানা ৬টা দিন। এর আগে সরকারকে জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধের প্রক্রিয়া শুরু করার জন্য এক মাসেরও বেশি সময় দিয়েছিল গণজাগরণ মঞ্চ। অনশনের সময় বেশ কয়েকজন অনশনকারী কয়েক দফায় হাসপাতালে গিয়েছে, প্রচণ্ড ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে একটি পুরো রাত পার করেছে। অনুমান করতে পারি যে, এই কয় দিনে অনেক অনেক বাধা-বিপত্তির মুখে তাদের পড়তে হয়েছে। মৃত্যুকে তুচ্ছ করে কেন করছিলেন তাঁরা এইসব? কারণ তাঁরা মনে করছেন, নতুন বাংলাদেশ গঠনের কাজে হাত দেওয়ার আগে দেশের ক্যান্সারস্বরুপ জামায়াত-শিবিরকে আগে নির্মূল করা প্রয়োজন। আর দাবি আদায়ের জন্য তাঁরা কোন জ্বালাও-পোড়াও করছেন না, কাউকে হুমকি-ধামকি দিচ্ছেন না, নিজেদের কথা সরকারের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য তারা নিজেদেরকেই কষ্ট দিচ্ছেন। গতকাল ১ এপ্রিল পরিকল্পনা মন্ত্রী ও মুক্তিযুদ্ধের সেকেন্ড-ইন-কমান্ড এ.কে.খন্দকারের আশ্বাসের প্রেক্ষিতে অনশন কর্মসূচি স্থগিত করেছে শহীদ রুমী স্কোয়াড।

অন্যদিকে সহিংসতা-হরতাল-অবরোধের হুমকি আসছে হেফাজতে ইসলামের তরফ থেকে। যাদেরকে অনেকেই, এমনকি ইসলামী লোকজনই বলেছেন, জামায়াতেরই অন্য রুপ। তারা আসলে ইসলাম না, জামায়াতেরই হেফাজত করতে নেমেছে। ‘নাস্তিক’ ব্লগার ও ধর্মানূভূতিতে আঘাত দেওয়ার শাস্তির দাবিতে চলছে এই আন্দোলন। তাদের ১৩টি দাবি হলো:
১। সংবিধানে ‘আল্লাহ্্র উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস’ পুনঃস্থাপন এবং কোরান-সুন্নাহ্্ বিরোধী সকল আইন বাতিল করতে হবে।
২। আল্লাহ্, রাসুল (সা.) ও ইসলাম ধর্মের অবমাননা এবং মুসলমানদের বিরুদ্ধে কুৎসা রোধে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে জাতীয় সংসদে আইন পাস করতে হবে।
৩। কথিত শাহবাগী আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী স্বঘোষিত নাস্তিক-মুরতাদ এবং প্রিয় নবী (সা.)-র শানে জঘন্য কুৎসা রটনাকারী কুলাঙ্গার ব্লগার ও ইসলাম বিদ্বেষীদের সকল অপপ্রচার বন্ধসহ কঠোর শাস্তিদানের ব্যবস্থা করতে হবে।
৪। ব্যক্তি ও বাক-স্বাধীনতার নামে সকল বেহায়াপনা, অনাচার, ব্যভিচার, প্রকাশ্যে নারী-পুরুষের অবাধ বিচরণ, মোমবাতি প্রজ্বলনসহ সকল বিজাতীয় সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ বন্ধ করতে হবে।
৫। ইসলামবিরোধী নারীনীতি, ধর্মহীন শিক্ষানীতি বাতিল করে শিক্ষার প্রাথমিক স্তর থেকে উচ্চ মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত ইসলাম ধর্মীয় শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করতে হবে।
৬। সরকারিভাবে কাদিয়ানিদের অমুসলিম ঘোষণা এবং তাদের প্রচারণা ও ষড়যন্ত্রমূলক সকল অপ-তৎপরতা বন্ধ করতে হবে।
৭। মসজিদের নগরী ঢাকাকে মূর্তির নগরীতে রূপান্তর এবং দেশব্যাপী রাস্তার মোড়ে ও কলেজ-ভার্সিটিতে ভাস্কর্যের নামে মূর্তি স্থাপন বন্ধ করতে হবে।
৮। জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমসহ দেশের সকল মসজিদে মুসল্লিদের নির্বিঘ্নে নামাজ আদায়ে বাধা-বিপত্তি ও প্রতিবন্ধকতা অপসারণ এবং ওয়াজ-নসিহত ও ধর্মীয় কার্যকলাপে বাধাদান বন্ধ করতে হবে।
৯। রেডিও, টেলিভিশনসহ বিভিন্ন মিডিয়ায় দাড়ি-টুপি ও ইসলামী কৃষ্টি-কালচার নিয়ে হাসি-ঠাট্টা এবং নাটক-সিনেমায় খল ও নেতিবাচক চরিত্রে ধর্মীয় লেবাস-পোশাক পরিয়ে অভিনয়ের মাধ্যমে তরুণ প্রজন্মের মনে ইসলামের প্রতি বিদ্বেষমূলক মনোভাব সৃষ্টির অপপ্রয়াস বন্ধ করতে হবে।
১০। পার্বত্য চট্টগ্রামসহ দেশব্যাপী ইসলাম বিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িত এনজিও এবং খ্রিস্টান মিশনারীদের ধর্মান্তকরণসহ সকল অপ-তৎপরতা বন্ধ করতে হবে।
১১। রাসুলপ্রেমিক প্রতিবাদী আলেম-ওলামা, মাদরাসা ছাত্র এবং তৌহিদী জনতার ওপর হামলা, দমন-পীড়ন, নির্বিচার গুলিবর্ষণ এবং গণহত্যা বন্ধ করতে হবে।
১২। সারা দেশের কওমী মাদরাসার ছাত্র-শিক্ষক, ওলামা-মাশায়েখ এবং মসজিদের ইমাম-খতিবকে হুমকি-ধামকি ও ভয়ভীতি দানসহ তাদের বিরুদ্ধে সকল ষড়যন্ত্র বন্ধ করতে হবে।
১৩। অবিলম্বে গ্রেপ্তারকৃত সকল আলেম-ওলামা, মাদরাসা ছাত্র ও তৌহিদী জনতাকে মুক্তিদান, দায়েরকৃত সকল মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার এবং আহত ও নিহতদের ক্ষতিপূরণসহ দুষ্কৃতকারীদেরকে বিচারের আওতায় এনে কঠোর শাস্তি দিতে হবে।
এই দাবি নিয়ে আগামী ৬ মার্চ ঢাকামুখী লংমার্চ করার ব্যাপক প্রস্তুতি নিচ্ছেন হেফাজতে ইসলামের নেতা-কর্মীরা। এর ভেতরে বেশ কিছু দাবিই নাকি মেনে নেওয়ার বিষয় বিবেচনা করা হচ্ছে।
পরষ্পরবিরোধী দুই পক্ষই আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের চিন্তাচেতনাই শুধু না, দাবি আদায়ের লক্ষ্যে কর্মসূচি বেছে নেওয়ার ধরণেও স্পষ্ট পার্থক্য বিদ্যমান। চট্টগ্রামে একবার হেফাজতে ইসলামের নেতৃবৃন্দকে আলোচনায় বসার আহ্বানও জানানো হয়েছিল গণজাগরণ মঞ্চের পক্ষ থেকে। তারা কিন্তু সেবার আলোচনা করতে রাজি ছিলেন না। অহিংস ও সহিংস, দুই পক্ষেরই দাবি সরকারের কাছে। প্রশ্ন হচ্ছে, সরকার কাদের দাবির কথাটা আগে বিবেচনা করবে? জামায়াতের লেবেলধারী সহিংসতাপন্থী হেফাজতে ইসলামের নাকি মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারী অহিংস শাহবাগ আন্দোলনের?
জামায়াত-শিবিরকে নিষিদ্ধের বিষয়ে সরকার এখনো আনুষ্ঠানিক কোন বক্তব্য দেয়নি। সরকারদলীয় ব্যক্তিবর্গের কথাতে স্ববিরোধীতাও স্পষ্ট। দুই দিন আগেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছিলেন, পুরো দেশে দাবি উঠলে জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধ করব। আজ ২ এপ্রিল আওয়ামী লিগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল হক হানিফ বলেছেন, সমগ্র দেশে এখন জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার দাবি উঠেছে। এই দলকে নিষিদ্ধ করা এখন সময়ের ব্যাপার। তাদের নিষিদ্ধ করার প্রক্রিয়া খুব দ্রুত শুরু হবে।’
খুব দ্রুতটা যে কবে, সেটা কিন্তু এখনো জানা গেল না। শুধু তাই না, শাহবাগ আন্দোলন নিয়ে উষ্মাও প্রকাশ করেছেন দেশ পরিচালনার সঙ্গে জড়িত রাজনীতিবিদেরা।
অন্যদিকে হেফাজতে ইসলামের দাবি দ্রুত মেনে নেওয়ার উদ্যোগ দেখিয়েছে সরকার। ৬ এপ্রিলের লংমার্চের আগেই সরকার ‘আমারব্লগ’ বন্ধ করে দিয়েছে, তিনজন ব্লগারকে গ্রেফতার করে রিমান্ডে নিয়েছে। এবং এই ক্ষেত্রে জনমত যাচাইয়েরও কোন প্রয়োজনীয়তা মনে করেনি সরকার। এটা কি সরকারের স্ববিরোধীতা নয়? ত্বরিতগতিতে তিন ব্লগারকে গ্রেপ্তার-রিমান্ড, ব্লগ বন্ধ ইত্যাদি আলামত থেকে আশঙ্কা হয় যে. সরকার হেফাজতে ইসলামের দিকেই বেশি ঝুঁকে গেছে। কেন এমন হলো? আওয়ামী লিগ না মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি? আওয়ামী লিগ কি তাহলে শুধু ভোটের জন্যই তাহলে মুক্তিযুদ্ধের কথা বলে? সরকারের কর্মকাণ্ড মানুষের মনে এমন অনেক প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে। গণজাগরণ মঞ্চের পক্ষ থেকে ইমরানও ছয়টি প্রশ্ন রেখেছেন সরকারের উদ্দেশ্যে,
১. জামায়াত-শিবির চক্র ব্লগে এবং ফেইসবুকে মওদুদীবাদ প্রচারের মাধ্যমে ইসলাম ধর্মকে নানাভাবে যখন প্রশ্নবিদ্ধ করে, তখন কোথায় থাকে রাষ্ট্রীয় বিজ্ঞপ্তির ধর্মানুভূতি?
২. যখন জামায়াত জাতীয় মসজিদে ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ করে তখন কী রাষ্ট্রের ধর্মানুভূতি শীতনিদ্রায় থাকে?
৩. যখন চট্রগ্রামে আলেম সমাজকে হত্যার হুমকি দেয় জামায়াত-শিবিরের শ্বাপদরা, তখন কি রাষ্ট্রের অভিধানে ধর্মানুভূতি শব্দটি অনুপস্থিত থাকে?
৪. যখন জামায়াত-শিবির পুলিশের উপরে নির্বিচারে হামলা চালায়, তাদের হত্যা করে, চিকিৎসককে আগুনে পুড়িয়ে মারে, রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে গৃহযুদ্ধের হুমকি দেয়, রাষ্ট্র তখন কেন তদন্ত কমিশন বানায় না? তখন কি রাষ্ট্র আঘাতপ্রাপ্ত হয় না?
৫. হরতালের নৈরাজ্য সৃষ্টি করে জামায়াত-শিবির যখন দেশকে অস্থিতিশীলতার দিকে ঠেলে দেয়, ব্লগের ক্ষুদ্র গণ্ডি থেকে যে সব গণমাধ্যম ধর্মীয় অবমাননাকর বিষয়গুলো সামনে নিয়ে আসে, তখন রাষ্ট্র কেন কমিশন করে উদ্যোগ নেয় না?
৬. যখন অনলাইন এবং ব্লগে জামায়াত-শিবির বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অপপ্রচার চালায়, তখন কেন মহাজোট সরকার তার বিরুদ্ধে উদ্যোগ নেয় না? আজ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু এবং জাতীয় চার নেতা, মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করার বিরুদ্ধে সরকার কি কোনো উদ্যোগ নিয়েছে?
সরকার এখন এইসব প্রশ্নের জবাব দেবে নাকি এই প্রশ্নগুলোর ড্রাফট কে লিখে দিয়েছে, সেটা তদন্ত করতে বসবে, সেটাই দেখার বিষয়।
সরকার শাহবাগ আন্দোলনের গণদাবির প্রতি কোন ভ্রুক্ষেপ তো করছেই না, উল্টো হেফাজতে ইসলামের রক্ষণশীল দাবিগুলোকে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করছে। সেই দাবি বাস্তবায়নের জন্য পদক্ষেপ নিচ্ছে। সরকার একটি ব্লগ পর্যবেক্ষণ কমিটি বানিয়েছে, সেখানে ইসলাম বিশেষজ্ঞ হিসেবে দুইজন আলেমকে স্থান দেওয়া হলেও কোন ব্লগার সেখানে অন্তর্ভূক্ত হননি। কেন? সরকার শুধু তাদের দিকটাই শুনবে? আর সেটা শুনে যখন যেভাবে যাকে খুশি তুলে নিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারবে? এটা তো ভয়াবহ পরিস্থিতি। ককটেলবাজি-বোমা বিস্ফোরণ, খুন, গাড়ি পোড়ানো, ট্রেনের বগি লাইনচ্যুত করা, ভিন্নধর্মাবলম্বীদের বাড়িঘরে আগুন দেওয়া এইসব সহিংস ঘটনার সঙ্গে যারা জড়িত তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে ধীরেসুস্থে। যারা এগুলো করছে, তাদের নিষিদ্ধ করা হবে ধীরেসুস্থে আর কারো সাথে পাঁচে না থেকে শুধু নিজের মতটা প্রকাশের জন্য দণ্ড পেতে হবে ব্লগারদের? বন্ধ করে দেওয়া হবে মুক্তচিন্তার প্ল্যাটফর্মগুলো? এটা কিধরণের ন্যায়বিচার হলো? এটা তো পুরোপুরি স্বেচ্ছাচারী আচরণ। ডিজিটাল ফ্যাসিবাদের আগমনবার্তা।
এইটাই কি আওয়ামী লিগ সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার নমুনা? ব্লগ বন্ধ করে দিয়ে, ইন্টারনেটের উপর নিয়ন্ত্রণ এনে কিভাবে ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠন করতে চান আপনারা? ব্লগ-ওয়েবসাইট-ফেসবুক পেজের মাধ্যমে তো জামায়াত-শিবিরও ব্যাপক মিথ্যা প্রচারণা চালাচ্ছে। সেগুলোর ব্যাপারে তো সরকারের কোন বক্তব্য নেই। সেই মিথ্যা প্রচারণাগুলো কি কারও অনুভূতিতে আঘাত দেয় না? ধর্ম ছাড়া কি মানুষের আর কোন অনুভূতি নেই?

বিষয়গুলো প্রশ্ন আকারে উত্থাপিত হলেও সরকারের অবস্থান হয়তো ইতিমধ্যেই অনেকের কাছে স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে। কারণ জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে আঁঁতাত করার ইতিহাস আওয়ামী লিগের আছে। ২০০৬ সালে খেলাফতে মজলিশের সঙ্গে তাদের চুক্তির কথাও আমরা জানি।

অতীতের এই ঘটনাগুলো আমাদের ইঙ্গিত দেয় যে, আওয়ামী লিগ সরকার আরও একবার আপোষরফা করেছে বা করতে চলেছে রক্ষণশীল গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে। দুর্ভাগ্যবশত, এই আশঙ্কা যদি সত্যি হয় তাহলে শাহবাগ আন্দোলনকে আরও কঠোর-বন্ধুর পথ পাড়ি দেওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। যেহেতু প্রত্যেক ক্রিয়ারই একটি সমান এবং বিপরীত প্রতিক্রিয়া আছে, তাই সরকারকেও বিবেচনা করতে হবে শাহবাগ আন্দোলনের বিপরীতে দাঁড়ানোর পরিনামের কথা। মুক্তচিন্তা-মত প্রকাশের স্বাধীনতার উপর হস্তক্ষেপের পরিণামটা কি হবে, সেটার কথা।