রাজনীতিতেও চলছে বার্সা-রিয়াল লড়াই
‘রিয়াল মাদ্রিদ যখন বার্সেলোনার বিপক্ষে খেলে তখন বিশ্ব থেমে যায়।’- এল ক্লাসিকোর জনপ্রিয়তা বর্ণনা করতে গিয়ে ঠিক এই বাক্যটিই ব্যবহার করেছিলেন রিয়ালের সাবেক কোচ হোসে মরিনহো। খুব বেশি বাড়িয়ে হয়তো বলেননি এই পর্তুগিজ কোচ। গত বছরের অক্টোবরে রিয়াল-বার্সা দ্বৈরথে অংশ নিতে স্পেনে ছুটেছিলেন ২৮টি দেশের ৬৮০জন সাংবাদিক। খেলাটি সরাসরি সম্প্রচার হয়েছিল এশিয়া, আফ্রিকা, উত্তর, দক্ষিণ ও মধ্য আমেরিকার ৩০টিরও বেশি দেশে। খেলাটি একযোগে দেখেছিল ৪০ কোটি মানুষ। ফুটবলপ্রেমী, অথচ এল ক্লাসিকোর নাম শোনেননি এমনটা হয়তো খুঁজেই পাওয়া যাবে না। রিয়াল মাদ্রিদ আর বার্সেলোনার দ্বৈরথটা শুধু স্পেনেই না, সমগ্র ফুটবল বিশ্বেরই আকর্ষণ।
স্প্যানিশ এই দুইটি শহরের মধ্যে চলমান আরও একটি লড়াই হয়তো অচিরেই কেড়ে নিতে পারে সমগ্র বিশ্বের মনোযোগ। কারণ শুধু ফুটবলেই না, স্পেনের রাজনীতিতেও চলছে বার্সা-মাদ্রিদ লড়াই। সম্প্রতি স্পেনের কাছ থেকে স্বাধীনতা দাবি করে একটি মানববন্ধন করেছিলেন কাতালোনিয়ার বাসিন্দারা। স্বাধীনতার দাবি হাতে হাতে ছড়িয়ে পড়েছিল প্রায় ৪০০ কিলোমিটার। স্প্যানিশ সরকারের প্রতি কাতালানদের দাবি, খুব তাড়াতাড়ি একটা গণভোট আয়োজন করতে হবে, যা থেকে নির্ধারিত হবে যে, তাদের একটা স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র গড়ে তোলার অধিকার আছে কিনা।
‘কাতালোনিয়া স্পেন নয়’, ‘আমরা স্বাধীন হতে চাই’ ইত্যাদি ব্যানার লিখে লাখ লাখ মানুষ অংশ নিয়েছিলেন এই মানববন্ধনে। লাল-হলুদের এই ঢেউটা অতিক্রম করেছে বার্সেলোনার বিখ্যাত ন্যু ক্যাম্প স্টেডিয়ামের ভেতর দিয়েও। কাতালোনিয়ার রাজধানী বার্সেলোনায় উপস্থিত ছিলেন সরকারি চাকুরিজীবী ইস্টার সারামোন। এখানকার অন্য অনেক বাসিন্দাদের মতো সারামোনও মনে করেন যে, কেন্দ্রিয় সরকার কাতালানদের উপর অনায্য আচরণ করছে। ট্যাক্স বৃদ্ধির ক্ষেত্রে, ভাষার অধিকারসহ অন্যান্য সাংস্কৃতিক ইস্যুর ক্ষেত্রে। তিনি বলেছেন, ‘স্বাধীনতার পক্ষে সংখ্যাগরীষ্ঠ মানুষ আছে কিনা, সেটা দেখার জন্য আমরা একটা গণভোট চাই। কিন্তু সমস্যা হলো স্পেন এটা শুনবে না। আমাদের একটাই আশা যে, ইউরোপ আর বাকি বিশ্ব এটার জন্য স্প্যানিশ সরকারকে চাপ প্রয়োগ করতে পারে।’
স্বাধীন কাতালোনিয়ার দাবিটা অনেকদিন ধরেই ছিল। সেটা আরও জোরদার করেছে ইউরোপের সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি। ইউরো অঞ্চলের আর্থিক সংকটের সর্বশেষ শিকারে পরিণত হয়েছে স্পেন। যার ফলে এখন আন্তর্জাতিক সাহায্য চাওয়ার চিন্তাভাবনাও আছে ইউরোপের অন্যতম বড় অর্থনীতির এই দেশটির। নানা ধরনের কৃচ্ছনীতি আরোপের ফলে স্পেনের কেন্দ্রিয় সরকারও হয়ে পড়েছে ব্যপকভাবে অজনপ্রিয়। ট্যাক্স বৃদ্ধি, জনসেবামূলক খাতে বরাদ্দ ঘাটতির বিষয়গুলো মেনে নিতে পারছে না কাতালানরা। সেই সঙ্গে কাতালান ভাষার উপর আধিপত্যশীল আচরণও ক্ষুব্ধ করেছে এই অঞ্চলের মানুষদের। গত বছরের শেষের দিকে স্পেনের প্রতিটা স্কুলে স্প্যানিশ ভাষায় পাঠদানের বিষয়টি বাধ্যতামূলক করার একটি প্রস্তাবও উস্কে দিয়েছে কাতালানদের স্বাধীকার আন্দোলন। সব মিলিয়ে বেশ খারাপ পরিস্থিতিতেই আছে স্পেনের কেন্দ্রিয় সরকার।
কিন্তু স্পেনের সবচেয়ে ধনী ও অন্যতম শিল্পায়িত অঞ্চলটিকে খুব সহজে স্বাধীনতাও দিতে চাইবে না মাদ্রিদের নীতিনির্ধারকরা। অর্থনৈতিক দিকগুলো বাদ দিয়ে শুধু ফুটবল দলটার দিকে তাকালেও স্পষ্ট বোঝা যায় কাতালানরা স্পেনের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ। কাতালোনিয়াকে স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দিয়ে দিলে স্পেনকে দল গঠন করতে হবে কার্লোস পুয়োল, জরডি আলবা, সেস ফেব্রিগাস, জেরার্ড পিকে, জাভি, সার্জিও বুসকেটস, ক্রিশ্চিয়ান টেলোদের ছাড়া। তেমনটা হলে ফুটবল বিশ্বে সর্বজয়ী স্পেনের আধিপত্য কতটা বজায় থাকবে সন্দেহ আছে।
যদিও স্বাধীন কাতালোনিয়ার দাবি দিনদিন বেড়েই চলেছে। সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা গেছে কাতালোনিয়ার ৭.৫ মিলিয়ন মানুষের মধ্যে ৮১ শতাংশই চায় স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রের স্বীকৃতি। বার্সেলোনা ফুটবল দলও গত ডিসেম্বরে আনুষ্ঠানিক বিবৃতির মাধ্যমে জানিয়েছিল স্বাধীন কাতালোনিয়া ও তার ভাষা-সংস্কৃতি সংরক্ষণের দাবি, ‘আমাদের স্বাধীন দেশের পরিচয় তৈরির একটা গুরুত্বপূর্ণ উপাদান আমাদের ভাষা। ঠিক যেমনটা আমাদের ক্লাব। আমরা খুব দৃঢ়ভাবে কাতালান ভাষা চর্চা ও শিক্ষার অধিকার রক্ষা করতে চাই।’
কাতালোনিয়া আর স্পেনের এই লড়াইয়ের কেন্দ্রে রয়েছে বার্সেলোনা আর রিয়াল মাদ্রিদ। দুইটি শহরই দুই অঞ্চলের রাজধানী। তাই এখন হয়তো সমান্তরালেই চলতে পারে ফুটবলের ধ্রুপদী লড়াই আর রাজনীতির মারপ্যাঁচটা। মাঠের লড়াইয়ে আগামী মাসেই মুখোমুখি হবে চিরপ্রতিদ্বন্দ¦ী এই দুই ফুটবল ক্লাব। ন্যু ক্যাম্পে অনুষ্ঠিত হবে এবারের মৌসুমের প্রথম এল ক্লাসিকো। সেদিন হয়তো ঘুঁচেও যেতে পারে খেলা আর রাজনীতির সীমানা। স্বাধীনতার দাবি সম্বলিত ব্যানার নিয়েই হয়তো হাজির হয়ে যেতে পারেন বার্সেলোনার সমর্থকেরা।