নোম চমস্কি: ইসরায়েলের জন্য সুনামি সতর্কবার্তা
মে মাসে ইসরায়েলের ব্যবসায়িক নেতাদের এক রুদ্ধদ্বার বৈঠকে ইদান ওফার সবাইকে সতর্ক করেছিলেন যে, ‘আমরা খুব দ্রুতই দক্ষিণ আফ্রিকা হয়ে যাচ্ছি। আন্তর্জাতিক আইনভঙ্গকারী হিসেবে আমাদের যে অর্থনৈতিক দণ্ডের সম্মুখীন হতে হবে, তার প্রভাব ইসরায়েলের প্রতিটা পরিবারের উপর পড়বে।’ এই ব্যবসায়িক নেতাদের প্রধান ভাবনার বিষয় ছিল, এই সেপ্টেম্বরে শুরু হওয়া জাতিসঙ্ঘের সাধারণ অধিবেশন। যেখানে ফিলিস্তিনের মানুষ নিজেদের রাষ্ট্রসত্তার বৈধতার দাবি তোলার পরিকল্পনা করছে। ঐ বৈঠকে আরও একজনের মুখে সতর্কবার্তা উচ্চারিত হয়েছিল। জাতিসঙ্ঘে নিযুক্ত ইসরায়েলের সাবেক রাষ্ট্রদূত বলেছিলেন, ‘ফিলিস্তিনকে একটা স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা দেওয়ার পরের দিন থেকেই ইসরায়েলের খুব কষ্টকর ও নাটকীয় একটা দক্ষিণ আফ্রিকাকরণ শুরু হবে।’ মানে, ইসরায়েল পরিণত হবে একটা অপরাধী রাষ্ট্রে। যার উপর আন্তর্জাতিক আইনানুযায়ী দণ্ড প্রযোজ্য হতে পারে।
এটা এবং এরকম আরও কিছু বৈঠকে ব্যবসায়িক গোষ্ঠী সরকারকে তাগাদা দিলেন বিগত দিনের মত দ্রুত এই ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের পরিকল্পনা ভেস্তে দেওয়ার উদ্যোগ নিতে। যেমনটা তারা আগে করেছিল সৌদি (আরব লীগ) প্রস্তাবসমূহ বা ২০০৩ সালে অনানুষ্ঠানিক জেনেভা চুক্তিসমূহের সময়। যেখানে উচ্চপর্যায়ের ইসরায়েলি ও ফিলিস্তিন নেতাদের মধ্যে একটা দুই রাষ্ট্র ব্যবস্থা বিষয়ে বিস্তারিত চুক্তি হয়েছিল। বিশ্বের বেশিরভাগ দেশ এটাকে স্বাগতও জানিয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীতে যুক্তরাষ্ট্রের অবহেলা ও ইসরায়েলের বিরুপ মনোভাবের কারণে তা বাস্তবায়িত হয়নি।
গত মার্চ মাসে ইসরায়েরের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইহুদ বারাক সাবধানবানী শুনিয়েছিলেন যে, যদি জাতিসঙ্ঘ ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি ঘোষণা করে, তাহলে ইসরায়েলর জন্য “সুনামি” অপেক্ষা করছে। তাঁর ভয় ছিল, পুরো বিশ্ব ইসরায়েলকে অপরাধী বানাবে শুধু এই কারণে নয় যে, তাঁরা আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করেছে। বরং এইজন্যও যে, তারা জাতিসঙ্ঘ স্বীকৃত একটা রাষ্ট্রে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড সংগঠিত করেছে। ফলে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল এটা রুখবার জন্য উচ্চপর্যায়ের কূটনৈতিক তত্পরতা চালাচ্ছে। যদি তারা ব্যর্থ হয়, তাহলে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের বৈধতা অবশ্যম্ভাবী।
১০০টিরও বেশি দেশ ফিলিস্তিনকে বৈধতা দিয়েছে। যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও অন্যান্য ইউরোপীয় দেশগুলো ফিলিস্তিনের সাধারণ ঘোষণাপত্রকে ‘কূটনৈতিক মিশন ও দূতাবাসের’ মর্যাদা দিয়েছে। যা সাধারণত শুধু কোন রাষ্ট্রের জন্যই সংরক্ষিত থাকে। আমেরিকান জার্নাল অব ইন্টারন্যালনাল ল-এ এই তথ্যটা সরবরাহ করেছেন ভিক্টর কাতান। ইউনেসকো ও ডব্লিউএইচও ছাড়া জাতিসঙ্ঘের সংগঠনগুলোতেও প্রবেশাধিকার পেয়েছে ফিলিস্তিন। তারা যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক অসহযোগিতার ভয়টাও পাত্তা দেয় নি।
যদি রাষ্ট্রসত্তার স্বীকৃতির দাবি থেকে সরে না আসে, তাহলে ফিলিস্তিনকে সাহায্য-সহযোগিতা বন্ধের হুমকি দিয়ে গত জুনে যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটে একটি বিল পাস করা হয়। ডেইলি টেলিগ্রাফের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, জাতিসঙ্ঘে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত সুশান রাইস সবাইকে সতর্ক করেছিলেন এই বলে যে, ‘জাতিসঙ্ঘকে টাকা জোগানোটা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য খুব বেশি হুমকি ছিল না, যতটা এখন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের বৈধরুপ প্রাপ্তির দিকসমূহ চিন্তা করে হচ্ছে। আর এটা হচ্ছে সহযোগী রাষ্ট্রসমূহের সহায়তাতেই।’ জাতিসঙ্ঘে ইসরায়েলের নতুন রাষ্ট্রদূত তার দেশের সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে জাতিসঙ্ঘের স্বীকৃতি সহিংসতা ও যুদ্ধে রুপ নিতে পারে।
জাতিসঙ্ঘ হয়তো ফিলিস্তিনকে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সীমানা ধরেই রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করতে পারে। সেক্ষেত্রে এই রাষ্ট্রের মধ্যে গোলান হাইটস, পশ্চিম তীর ও গাজাও অন্তর্ভূক্ত হবে।
১৯৮১ সালের ডিসেম্বরে, জাতিসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদের আদেশ ভঙ্গ করে ইসরায়েল এই হাইটস অধিগ্রহণ করেছিল। পশ্চিম তীরে ইসরায়েলকে সমর্থন যোগানোর জন্য যে বন্দোবস্ত ও আইন-কানুন জারি আছে, তা পরিস্কারভাবেই আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন। আন্তর্জাতিক আদালত ও নিরাপত্তা পরিষদও এটা স্বীকার করেছে।
২০০৬ সালের ফেব্রুয়ারীতে, যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল যৌথভাবে গাজার উপর অবরোধ জারি করে। এর কারণ ফিলিস্তিনের নির্বাচনে ‘ভুলপক্ষ’ হামাস জয়লাভ করেছিল। যাদের পরিচিতি স্বাধীনচেতা হিসেবে। ২০০৭ সালের জুনে যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত একটা সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে এই নির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার মিশন ব্যর্থ হওয়ার পর এই অবরোধ আরও জোরদার করা হয়েছিল।
২০১০ সালে রেড ক্রস আন্তর্জাতিক কমিটি এই গাজা অবরোধের তীব্র নিন্দা জানিয়েছিল। যারা এ ধরণের ইস্যু নিয়ে খুব কমই কথা বলে। বিবিসির প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, রেডক্রস অবরুদ্ধ গাজা পরিস্থিতির একটা বিষণ্ন চিত্র এঁকেছিল এভাবে, ‘হাসপাতালে প্রয়োজনীয় উপকরণ নেই, প্রতিদিন ঘন্টার পর ঘন্টা বিদ্যুত্ থাকে না, পানযোগ্য পানির অপর্যাপ্ততা এবং অবশ্যই এই সমগ্র জনগোষ্ঠী কারারুদ্ধ।’
১৯৯১ সালে গাজাকে পশ্চিম তীর থেকে পৃথক করার পরিকল্পনা শুরু করার পর থেকেই এই ধরণের অপরাধমূলক অবরোধ যুক্তরাষ্ট্র-ইসরায়েলের নীতি-নির্ধারণে বিস্তর প্রভাব রেখেছে। এর মাধ্যমে তারা এটা নিশ্চিত করে যে, যদি কখনো কোন ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র মাথা তুলে দাঁড়ায়, তাহলে তার অংশগুলো যেন ইসরায়েল ও জর্ডানের মতো শত্রুতাপূর্ণ ক্ষমতার আওতায় থাকে। ১৯৯৩ সালে, ইসরায়েল ও ফিলিস্তিন লিবারেশন অর্গানাইজেশনের (পিএলও) মধ্যে স্বাক্ষরিত অসলো চুক্তিতে গাজাকে পশ্চিম তীর থেকে পৃথক করার সুপারিশ করা হয়।
যুক্তরাষ্ট্র-ইসরায়েলের এই প্রত্যাখ্যানবাদের ফলে আরও একটা আসন্ন হুমকির মুখে আছে ফ্লোটিলা, যারা চিঠিপত্র ও জনহিতকর সাহায্য নিয়ে এনে গাজার এই অবরোধকে চ্যালেঞ্জ জানাতে চেয়েছিল। ২০১০ এর মে মাসে এ ধরণের একটা উদ্যোগ ইসরায়েলি কমান্ডোদের আক্রমণের মুখে পড়েছিল। গাজার আন্তর্জাতিক সমুদ্রসীমার মধ্যে পরিচালিত এই হামলায় মারা গিয়েছিল নয়জন যাত্রী। যা একটা বড় অপরাধ। যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া প্রায় সবাই এই হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়েছিল।
ইসরায়েলের বেশিরভাগ মানুষ নিজেদের বুঝিয়েছে যে, কমান্ডোরা নির্দোষ ছিল। হামলাকৃত ঐ জাহাজের যাত্রীরাই আগে আক্রমন চালিয়েছিল। কী ধরণের আত্মবিধ্বংসী অযৌক্তিকতা ইসরায়েলকে কুরে কুরে খাচ্ছে, এটা তার একটা চিহ্ন।
এখন যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল ফ্লোটিলা তত্পরতা বন্ধ করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে। হিলারি ক্লিনটন অপ্রত্যক্ষভাবে সহিংসতাকে আরও বৈধতা দিয়েছেন। বলেছেন, যদি ফ্লোটিলা ‘ইসরায়েলের জলসীমায় ঢুকে উসকানি দেওয়ার চেষ্টা করে’ তাহলে ‘ইসরায়েলিদের আত্মরক্ষা করার পূর্ণ অধিকার আছে।’
গ্রীস তাদের নৌবন্দর থেকে এই নৌযানগুলো ছেড়ে যাওয়া প্রতিরোধ করার ব্যাপারে সম্মতি জানিয়েছিল। যদিও ক্লিনটনের মতো, গ্রীসও খুব সঠিকভাবেই গাজার সমুদ্রসীমা নির্ধারণ করেছিল। অবশ্য ২০০৯ সালের জানুয়ারীতে গ্রীস একটা স্বতন্ত্র অবস্থান নিয়েছিল। সেসময় গাজার ওপর যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের নৃশংস সহিংসতা চলাকালে তারা যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র ইসরায়েলে নিয়ে যাওয়ার জন্য তাদের বন্দর ব্যবহার করতে দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল।
ফ্লোটিলা কোন উসকানিমূলক কর্মকাণ্ড কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে জাতিসঙ্ঘের ত্রাণ ও কর্মসংস্থান এজেন্সির মুখপাত্র ক্রিস গানেস বলেন, ‘যদি ফিলিস্তিনে কোন মানবাধিকার সংকট না-ই থাকে, যদি সেখানে কোন ধরণেরই সংকট না থাকে, তাহলে ফ্লোটিলারও কোন প্রয়োজন পড়বে না। গাজার ৯৫ ভাগ পানি পাণ করার উপযোগী না। সেখানে ৪০ ভাগ রোগই পানিবাহিত। শ্রমিকদের ৪৫.২ ভাগ বেকার। তাদের টিকে থাকার জন্য ৮০ ভাগেরও বেশি নির্ভর করতে হয় বাইরের সাহায্য-সহযোগিতার জন্য। আর এই পরিস্থিতির করুণ অবনতি হয়েছে গাজায় অবরোধ জারির পর থেকে। এই অবরোধ তুলে নেওয়া হোক। তাহলে আর কোন ফ্লোটিলারও প্রয়োজন পড়বে না।’
ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি বা সাধারণভাবে যে কোন অসহিংস কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য কূটনৈতিক উদ্যোগ তাদেরকে হুমকির মুখে ফেলে দেয়, যারা সহিংসতাকে একচেটিয়াভাবে দখলে রেখেছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল, নিজেদের একেবারে ক্ষমার অযোগ্য একটা অবস্থানে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে: দখলদারিত্ব ও নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড এবং একটা কূটনৈতিক বন্দোবস্ত বা ঐক্যমত্যে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রিতা।