Posts Tagged ‘ শাহবাগ ’

যে যুদ্ধ বাংলাদেশ কোনদিন ভুলবে না

৪০ বছর আগে মুক্তিযুদ্ধে গর্জে ওঠা বন্দুকের আওয়াজ থেমে গিয়েছে কিন্তু স্বাধীনতাকামী সেই রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের ক্ষতচিহ্ন এখনো রয়ে গেছে বাংলাদেশের বুকে

C2

বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা একটা কোলাহলপূর্ণ, উত্তেজনাময় শহর। এখানে আছে প্রচুর প্রাণপ্রাচুর্য আর তর্ক-বিতর্ক। নিশ্চল হয়ে থাকা ট্রাফিক জ্যামের বিশাল বিশৃঙ্খলার মধ্যে প্রায়শই দেখতে পাওয়া যায় হরতাল-মিছিল-প্রতিবাদ। এগুলো বিশাল সংখ্যক মানুষের জন্যই হয়তো দুঃখ-দুর্দশার কারণ। কিন্তু এই দেশটা জন্মানোর সময় এমন এক জাতীয় চেতনা গড়ে দিয়েছে যেটা কখনোই পুরোপুরি সনাক্ত করা হয়নি। সেই চেতনা দিয়েই সবাই তাড়িত হচ্ছে। শাহবাগে জাতীয় জাদুঘরের সামনে এখন যে প্রতিবাদটা জারি আছে, সেটা একটা অভূতপূর্ব প্রকৃতির। একটা নজীরবিহীন আকারের।

গত ৫ ফেব্রম্নয়ারি থেকে, বাংলাদেশ অবশ হয়ে আছে এই চলমান, বিশালাকারের প্রতিবাদের কারণে। হাজার হাজার মানুষ শাহবাগ চত্বর দখল করে প্রতিবাদ জানাচ্ছেন ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় সংঘটিত যুদ্ধাপরাধেদের বিচারের জন্য গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুন্যালের ঘোষিত একটি রায়ের বিরুদ্ধে। এই যুদ্ধাপরাধীদের একজন আবুল কালাম আজাদকে এর আগে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। এরপরে, আরেকজন যুদ্ধাপরাধী, ৭১-এর গণহত্যার সঙ্গে জড়িত সংগঠন জামায়াতে ইসলামীর সহযোগী সাধারণ সেক্রেটারী আব্দুল কাদের মোল্লাকে দেওয়া হয়েছে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের সাজা। এর প্রতিবাদে শুরু হওয়া ও এখনো চলমান প্রতিবাদটার নেতৃত্ব দিচ্ছেন সমাজের চিন্তাশীল আর উদার মন মানসিকতার মানুষেরা। তারপরও তাঁরা কাদের মোল্লাসহ অন্যান্য অভিযুক্ত যুদ্ধাপরাধীদের অবিলম্বে ফাঁঁসির রায় কার্যকর করার দাবি জানাচ্ছেন।

৭১ এ সংঘটিত গণহত্যাটি সম্পর্কে পশ্চিমের মানুষ খুব কমই জানে। তাছাড়াও পার্টিজান তার্কিক ও স্বার্থান্বেষী ইতিহাসবিদদের মধ্যে বিষয়টি অস্বীকার করার প্রবণতা দেখা যায় বিস্ময়কর মাত্রায়। ১৯৭১ সালের আগে, বাংলাদেশ বা তত্কালিন পূর্ব পাকিস্তান মূল পাকিস্তানের সঙ্গে ভৌগলিকভাবে যুক্ত ছিল না। এই রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতারা বিশ্বাস করতেন যে, ধর্মের ঐক্যই এই পৃথকীকৃত দুই অঞ্চলের মানুষকে একসঙ্গে ধরে রাখবে। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে সংস্কৃতির বৈপরীত্য তীব্রভাবে বেড়ে উঠতে থাকে। পাকিস্তানি শাসকদের একটি বড় অংশ বাঙ্গালিদের বিবেচনা করত ঘৃণ্য সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে।

১৯৬৭ সালে একটি আত্মকথায়, জেনারেল আইয়ুব খান লিখেছিলেন, ‘পূর্ব বাঙ্গালিদের মধ্যে উত্পীড়িত জাতির সবগুলো প্রবৃত্তিই আছে… তাদের জটিলতা, নতুন কিছুর প্রতি অনীহা আর নিরাপত্তামূলক আগ্রাসন… উদ্ভুত হয়েছে এই ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট থেকে।’ অত্যন্ত সমৃদ্ধ একটি সেকুলার সংস্কৃতির প্রতি (পাকিস্তানি শাসকদের) সাধারণ এই শত্রুভাবাপন্ন মনোভাবটা একটা মীমাংসাকারক/চরম পর্যায়ে পৌঁছায় যখন আওয়ামী লীগের নেতা শেখ মুজিব জাতীয় নির্বাচনে জয়লাভ করেন। তাঁকে সেসময় কারাবন্দী করা হয় আর মার্চ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশের অধিবাসীদের উপর বর্বর গণহত্যা চালায় পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী।

C1

পাকিস্তান কখনোই তারা যা ঘটিয়েছিল সেটার দায়দায়িত্ব স্বীকার করেনি। আর এর বাইরেও, ইতিহাসবিদ ও সাংবাদিকেরা বিপদজনকভাবে এই গণহত্যাটাকে অস্বীকারই করে গেছেন। বা নিহত হওয়া মানুষদের সংখ্যা কমিয়ে বলার প্রবণতা তাদের মধ্যে দেখা গেছে। পাকিস্তানের আনুষ্ঠানিক হিসাব থেকে দেখা যায় নিহতের সংখ্যা মাত্র ২৬ হাজার। উদ্বাস্তু হয়েছিলেন মাত্র ২০ লাখ মানুষ। সম্প্রতি অক্সফোর্ডের এক ইতিহাসবিদ ঘোষণা দিয়েছেন যে, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় নিহতের সংখ্যা দুই পক্ষ মিলিয়ে ৫০ হাজার থেকে এক লাখের বেশি কোনভাবেই না। অবশ্য এই ইতিহাসবিদের গবেষণাপদ্ধতি তীব্র নিন্দার মুখে পড়েছিল।

এটা যদি সত্যি হয় তাহলে বলতে হবে, পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী তাদের উচ্চাকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী মানুষ হত্যা করতে পারেনি। ১৯৭১ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি এক বৈঠকে পাকিস্তানের তত্কালিন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ক্ষুব্ধস্বরে বলেছিলেন, ‘ ৩০ লাখ বাঙ্গালিকে মেরে ফেল, তারপর বাকিরা এমনিতেই আমাদের হাতে খাবে।’ এক কোটি মানুষ উদ্বাস্তু হয়ে ভারতে পাড়ি জমিয়েছিল, ৩ কোটি মানুষ শহর ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন গ্রামের বাড়িতে।

যুদ্ধের প্রথম ধাপে, হত্যার জন্য টার্গেট করা হয় তরুণ, হিন্দু, আওয়ামী লিগের সদস্য, শিক্ষার্থী- বুদ্ধিজীবী-চিন্তকদের। যুদ্ধের দ্বিতীয় ধাপে, টার্গেট বানানো হয় নারীদের। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের দোসররা সেসময় অন্তত দুই লাখ নারীকে ধর্ষণ করে। পরবর্তীতে ধর্ষণের শিকার প্রায় ২৫ হাজার নারী নিজেদের আবিস্কার করে গর্ভবতী অবস্থায়। কাজেই এই ক্রোধ কোনভাবেই শান্ত করা যায় না। এমন অনেক প্রত্যক্ষদর্শী আছেন যাঁরা বলেছেন যে, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী সেসময় অনেক ‘ধর্ষণ-ক্যাম্প’ স্থাপন করেছিল। ধর্ষিতা নারীদের সংখ্যা ও তাদের নাম-পরিচয় নিয়ে প্রায়শই বিতর্ক হয়। বাংলাদেশের প্রথম নেতা শেখ মুজিব এই তালিকা নষ্ট করে ফেলার আদেশ দিয়েছিলেন, যেন এই লজ্জা সেই নারীদের আজীবন বয়ে বেড়াতে না হয়।

মুক্তিযুদ্ধের শেষ সপ্তাহে, যখন পাকিস্তানের পরাজয় সুনিশ্চিত আর একটা নতুন দেশের জন্ম অনিবার্য, তখন ১২-১৪ ডিসেম্বরের মধ্যে দেশের বুদ্ধিবৃত্তিক নেতাদের (যতো জনকে সম্ভব) হত্যা করার একটা নৃশংশ পরিকল্পনা করে পাকিস্তান। অন্তত একজন পাকিস্তানি অফিসারের ডায়েরিতে ভবিষ্যত্ রাষ্ট্রটির সম্ভাবনাময় নেতাদের নাম পাওয়া গিয়েছিল।

সশস্ত্র বাহিনী গঠন করে পাকিস্তানিদের সহায়তা করেছিল বাঙ্গালী বিশ্বাসঘাতকেরা। আল শামস ও আল বদর নামের সংগঠন দুইটি এই নৃশংশ হত্যাকাণ্ডের নেতৃত্ব দিয়েছিল। বাংলাদেশের বিজয় অবশ্যম্ভাবী এটা জেনে যাওয়ার পরও চূড়ান্ত বিজয়ের মাত্র দুই দিন আগে তারা এই ঘৃণ্য কাজটা করেছিল।

সত্যিকারের নিহত সংখ্যাটা জানা সত্যিই অসম্ভব ব্যাপার। ইতিহাসবিদ আর জে রুমেল ঐ সময়ের ঘটনাটিকে অন্যান্য যে কারো চাইতে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন। তিনি এভাবে ইতি টেনেছেন, ‘পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যার শিকার হতে পারে ৩ থেকে ৩০ লাখ পর্যন্ত। বা খুব সাবধানী হয়ে বললে, বলা যায় সংখ্যাটা দেড় লাখ।’ স্কলার বিনা ডি’কস্তার মতে,  মুক্তিযুদ্ধের সময় নিহতের এই সংখ্যাটা পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিকভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। বাংলাদেশের সরকারের জন্য, নিহতের সংখ্যা বেশি থাকলে সেটা নবগঠিত নতুন দেশটিকে অধিকতর নায্যতা দেবে। আর অপরদিকে পাকিস্তানের জন্য সংখ্যাটা কমাতে পারলে বা সেটাকে উপেক্ষা করতে পারলে তারা একটা অবিশ্বাস দেখাতে পারবে। যেটা তারা এখনো করে যাচ্ছে। সত্যিকারের সংখ্যাটা যাই হোক, হাজার হাজার মানুষকে পাকিস্তানি বাহিনী যেরকম  নির্মমভাবে হত্যা করেছে, সেটা হয়তো কারও কল্পনাতেও আসা সম্ভব না। হাজার হাজার ঘটনার মধ্যে, সবার একটা জিনিস পড়া উচিত্। ট্রাইবুন্যালে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সময় এক সাহসী নারী নিজের অভিজ্ঞতার কথা বলেছেন। তিনি তাঁর পরিবারের একমাত্র জীবিত ব্যক্তি। তিনি বলেছিলেন, কিভাবে চোখের সামনে তিনি বাবা-মা, দুই বোন ও মাত্র দুই বছর বয়সী ভাইকে হত্যা করতে দেখেছেন। তারপর নিজে ১২ জনের সম্মিলিত ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। সেসময় তাঁর বয়স ছিল মাত্র ১৩ বছর।

এগুলো ৪০ বছর আগের ঘটনা। যুদ্ধাপরাধী পাকিস্তানি সেনাদের কখনোই বিচারের আওতায় আনা হয়নি। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর, পাকিস্তানের দিক থেকে বলা হয়েছিল যদি তাদের একজন সৈন্যকেও ধরে রাখা হয় তাহলে পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্থিত কোন বাঙ্গালিকে যেতে দেওয়া হবে না। খুব সম্প্রতি পাকিস্তানি বাহিনীর সহায়তা করা বাংলাদেশীদের বিচার শুরু হয়েছে। ট্রাইবুন্যালের এই বিচারকাজ চলছে এখন পর্যন্ত সক্রিয় থাকা জামায়েতী ইসলামের অব্যাহত সহিংস হুমকির মুখে। কিছু যুদ্ধাপরাধী বিদেশে পালিয়ে গেছে। ১৯৯৫ সালে, এরকমই কিছু অভিযুক্ত যুদ্ধাপরাধীদের দিকে বৃটিশ কর্তৃপক্ষের নজর ফিরিয়েছিলেন ঢাকার সাংবাদিক ডেভিড বার্গম্যান, একটি প্রামাণ্যচিত্রের মাধ্যমে। এদের মধ্যে একজন চৌধুরি মুইনউদ্দিন এখন কাজ করছেন এনএইচএস প্রশাসক হিসেবে। এই মানুষদেরকে কেবল বিচারের অধিনে আনার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।

গত শতকের অন্যতম নিষ্ঠুর কিছু গণহত্যাকারী শান্তিপূর্ণ অবসর পালন করতে পেরেছেন সাধারণ ক্ষমা আর কূটনৈতিক ঔদ্ধত্যের কারণে। ব্যাপারটা প্রায়শই প্রতিবাদের মুখে পড়লেও সেই প্রতিবাদকারীরা কোন সফলতা পাননি। ১৯৯২ সালে শহীদ জননী জাহানারা ইমাম যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের উদ্যোগ নিয়েছিলেন গণমানুষকে সঙ্গে নিয়ে। কিন্তু সফলতার মুখ দেখতে পারেননি। অবশেষে ২০০৮ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুন্যাল গঠিত হয়। এটার কর্মপ্রক্রিয়া ধীরগতির। আর সবাই অনুভব করেছে যে, আগামী নির্বাচনের আগেই এই বিচারকাজ শেষ করতে হবে। কারণ বিরোধীদলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার উপর মানুষের কোন আস্থা নাই। তিনি প্রকাশ্যেই জামায়াতে ইসলামীর রাজনৈতিক সহযোগী হিসেবে ভূমিকা পালন করেন। তিনি যে ট্রাইবুন্যালের কাজ চালিয়ে যেতে দেবেন বা এখন পর্যন্ত যাদের সাজা দেওয়া হয়েছে সেগুলো টিকে থাকতে দেবেন, সেটা মানুষ বিশ্বাস করে না।

cov

কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায় শুনে জনগণ ফুঁসে উঠেছিল কারণ তারা জানত, যেমনটা আগেও দেখা গেছে, যে পরিমাণ সাফল্য অর্জন করা সম্ভব সেটা শেখ হাসিনার সরকার অর্জন করতে পারেনি। আর সরকারের পরিবর্তন হলে সেটা প্রায় নিশ্চিতভাবেই কারাবন্দী যুদ্ধাপরাধীদের ক্ষমা করার দিকে মোড় নেবে। এরকমটা অতীতেও কয়েকবার দেখা গেছে। তাই বাংলাদেশের আপামর জনগণ যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবি উঠিয়েছেন, যেন কোন রাজনীতিবিদই এটা উল্টিয়ে দিতে না পারেন।

ফাঁসির দাবিতে জনগণের এই প্রতিবাদ এই দীর্ঘদিনের নৈরাশ্য থেকেই উত্থিত হয়েছে। এই মানুষগুলো এতদিন আবেগপূর্ণভাবেই আইনের শাসনের উপর বিশ্বাস রেখেছে। বিগত সময়ে তারা বেশ কয়েকবার দেখেছে যে, বিচারকার্য অনেকক্ষেত্রে সম্পাদিত হয়ে থাকে রাজনীতিবিদদের আদেশে। অনেক ক্ষেত্রে সম্পন্নও হতে পারে না। কিন্তু কাদের মোল্লার বিচারকার্য নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে পর্যবেক্ষকেরা ও চিন্তক বাঙ্গালীরা। শাহবাগ আন্দোলনের চাপের ফলে শেখ হাসিনা সরকার ট্রাইবুন্যালের বিচারকার্যে হস্তক্ষেপ করেছে। সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে রাষ্ট্রপক্ষের দিক থেকে রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের সুযোগ তৈরি করেছে। সবকিছুর উপরে, এটা গুরুত্বপূর্ণ যে, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলো বর্বর হত্যাকারীদের তুলনায় নিজেদেরকে আরও উন্নত অবস্থায় নিয়ে যাবে। তারপরও এই সম্ভাবনা থেকে যায় যে, ইতিহাসের কিছু ঘৃণ্য যুদ্ধাপরাধী কখনোই বিচারের অধীনে আসবে না। তাদেরকে সহায়তাকারী দালালদের হয়তো মাত্র এক বা দুই বছরের কারাদণ্ড ভোগ করতে হবে। এই বিষয়টিই প্রতিবাদকারীদের হতাশার দিকে ঠেলে চিয়েছে।

তাহলে এর সমাধান কী? যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কর্মকাণ্ড নিয়ে গুরুতর সংশয় তৈরি হয়েছে। আর এই ফাঁসির রায়ও কোন সঠিক সমাধান হতে পারে না। কিন্তু গণহত্যাকারীদের যাবজ্জীবন সাজার রায়টাও বাংলাদেশী নাগরিকদের জন্য কোন সম্মান বয়ে আনে না।

এখন আরেকটি সম্ভাবনা থেকে যায়। লাইবেরিয়ার যুদ্ধাপরাধী চার্লস টেলরকে লাইবেরিয়াতে কারাদণ্ড দেওয়া হয়নি। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের কয়েকটি ধারার অধীনে তাকে কারাবন্দী করা হয়েছিল হেগ-এ। আন্তর্জাতিক আইনপ্রণেতাদের হস্তক্ষেপ বাংলাদেশের ক্ষেত্রে কাম্য হতে পারে। এতে করে গণহত্যাকারীদের জাতীয় রাজনীতিবিদদের নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত করা যাবে। এরকমটা করা গেলে, শুধু বাংলাদেশের রাজাকারদেরই না, মূল যুদ্ধাপরাধীদের বিচারও করা সম্ভব হবে।

৭১ সালে যে বাংলাদেশ যে নৃশংশ হামলার শিকার হয়েছিল সেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আর সরকার পরিবর্তনের সাথে সাথে যেন সেটা কেউ নিজ স্বার্থে ব্যবহার করতে না পারে সেটাও জরুরি বিষয়। এখন এমনটাই মনে হচ্ছে যে, এই বিক্ষুব্ধ জাতীয় চেতনা যদি সফলতার মুখ দেখতে চায়, যদি ন্যায়বিচার পেতে চায় তাহলে সেটা বর্হিবিশ্বের চোখের সামনে করতে হবে। বর্হিবিশ্বের মতামতও নিতে হবে। আর গোটা বিশ্বের মানুষদের প্রতি বলছি, আমরা অনেকদিন মুখ ঘুরিয়ে থেকেছি। এই প্রায় ভুলে যাওয়া গণহত্যাটি সম্পর্কে জানা আমাদের কর্তব্য। আর এখানে আমাদের অনেক দায়দায়িত্বও গ্রহণ করতে হবে। গণহত্যাকারীদের আশ্রয় দেওয়া যাবে না। অগ্রাহ্য করা যাবে না। ভুলে যাওয়া যাবে না।

মিরপুরের কসাই

বাংলাদেশ জামায়েতী ইসলামের সহকারী জেনারেল সেক্রেটারী আব্দুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে ঘোষিত যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায় জনগকে বিক্ষুব্ধ করে তোলে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি যে ঘৃণ্য কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেছিলেন তার বিচারকার্য শেষে গত ৫ ফেব্রুয়ারী তাকে এই সাজা দেওয়া হয়। আদালতের এই রায়ে তিনি স্পষ্টতই খুশি হয়েছিলেন। কোর্ট থেকে বাইরে যাওয়ার সময় তিনি সমর্থকদের উদ্দেশ্যে দেখিয়েছেন বিজয় চিহ্ন। কিন্তু মিরপুরের কসাইখ্যাত কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে এই রায়ে মুহূর্তের মধ্যেই ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বাংলাদেশের সাধারণ জনগণ। ৭১ সালে কাদের মোল্লা এক কবির মাথা কেটে নেন, ১১ বছর বয়সী এক মেয়েকে ধর্ষণ করেন। আর হত্যা করেন ৩৪৪ জনকে। এখন এই কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসির রায় ঘোষণা করার দাবি জানাচ্ছেন বাংলাদেশের মানুষ। আরেক অভিযুক্ত যুদ্ধাপরাধী আবুল কালাম আজাদকে যেমনটা দেওয়া হয়েছে।

ফিলিপ হেনশার

লেখাটি গত ১৯ ফেব্রুয়ারী ছাপা হয়েছিল যুক্তরাজ্যের দৈনিক ইনডিপেনডেন্ট পত্রিকায়।

আমরা কেন এরকম হয়ে যাচ্ছি?

কয়েকদিন আগে বাসে একটা অদ্ভুত ঘটনা দেখে এই প্রশ্নটা মাথায় এল: আমরা কেন এরকম হয়ে যাচ্ছি? শাহবাগ মোাড় থেকে বাস ছেড়েছে, গেটের কাছে প্রচণ্ড ভীড়, বাইরেই ঝুলছে ৩-৪ জন। আর ঐ সময়টাতে রাস্তায় এত ভীড় যে, যে কোন সময়েই ঐ বাইরে ঝোলা মানুষগুলো একটা ভয়াবহ দুর্ঘটনার শিকার হতে পারে। অথচ ভেতরের দিকে বেশ খানিকটা জায়গা ফাঁকা। ভিতরের মানুষগুলো আরও কিছুটা ভিতরে চলে গেলেই একটা অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা এড়ানো সম্ভব। কন্ট্রাকটরও ক্রমাগত সেই কথা বলে যাচ্ছে। এরকম একটা পরিস্থিতিতে এক মাঝবয়েসি ভদ্রলোক তাঁর পাশে দাঁড়ানো দুই ছেলের কাছে জানতে চাইলেন যে, তারা কোথায় যাবে। উত্তরটা গাবতলী শুনে তিনি ছেলেগুলোকে ভিতরে চলে যেতে বললেন। মোটামোটি ভদ্র পরিচ্ছিত পোশাক পরা এক ছেলে তার বন্ধুকে ইশারা করল না যেতে। আরেকজন কিছুক্ষণ পরে নিচুস্বরে বলল, “গ্যালেই বইস্যা পরব”। আমি তাদের ইঙ্গিতটা বুঝতে পেরে কিছুক্ষণ হতাবিহ্বল হয়ে বসে থাকলাম। তারা আসলে মনে করেছে যে, ঐ মাঝবয়েসি ভদ্রলোকটা একটা সিট দখল করার জন্য তাদেরকে ভেতরে ঠেলে দিতে চেয়েছে। বাসের ওপারে রাস্তাঘাটের চেহারাটা এমন, তারা ওখানে দাঁড়িয়ে থাকলে বাইরে যে দু-একজন মরেও যেতে পারে সেটাও তারা গ্রাহ্য করছে না। সামান্য একটা সিট দখলের জন্য তারা সেখানেই দাড়িয়ে থাকছে। অল্প কিছুক্ষণ আরাম করার জন্য তারা দুই হাত দূরের একটা লোকের জীবন-মরণ নিয়েও মাথা ঘামাচ্ছে না। আমরা কেন এরকম হয়ে যাচ্ছি? নিজের ছোট ছোট সুযোগ সুবিধা, আরাম আয়েশের জন্য আমরা বাকি দুনিয়ার কথা কিছুই ভাবছি না। বা অনেক সময় অগ্রাহ্য করছি। সামান্য সামান্য ব্যাপারে আমরা কেন এরকম স্বার্থপর আচরণ করছি?

মনুষ্য প্রজাতির কী এমনটা করার কথা? মানুষ না আশরাফুল মাখলুকাত? সৃষ্টির সেরা জীব? বহু সাধ-সাধনার পর নাকি এই মানব জন্ম পাওয়া যায়? এমনকি এই মানবজন্ম নেওয়ার জন্য নাকি দেব-দেবতারাও আরাধনা করেন??? এ যদি সত্যি হয় তাহলে এই মহামূল্যবান সময়টুকু কী আমরা এভাবে পার করে দেব? আচ্ছা মানব-জন্মের উদ্দেশ্য-বিধেয় যাচাই-বিচার তো আরও অনেক দূরের কথা। আমরা যদি শুধু নিজের কথাও ভাবি, তাহলেও কী এখন আমাদের একটু সমবেদনশীল, সহযোগিতামূলক মানসিকতা গড়ে তোলা দরকার না? আমরা যে খুব সংকটপূর্ণ একটা সময় পার করছি!!! আমরা এমন একটা সময় পার করছি, যখন আমাদের খোদ নিজের অস্তিত্বটাই বিপন্ন!

আশরাফুল নাকি আশার-ফুল?

‘তোমার উপর আমার বিরক্তির মাত্রাটা চরমে উঠল, যখন দেখলাম আশরাফুল রাজু ভাস্কর্যে আউট হয়েও টিএসসির সামনে ব্যাট করছে।’- বাংলাদেশের ব্যাটিং শেষে আমার এক বন্ধু মাথার চুল ছিড়তে ছিড়তে কাকে যেন এ কথাটা বলেছিল।

শাহবাগ এলাকায় খেলা দেখার অভিজ্ঞতা নাই, এমন অনেকেরই হয়তো কথাটা বুঝতে অসুবিধা হতে পারে। আসল ব্যাপারটা হলো, গোটা শাহবাগ এলাকায় যে তিন-চারটা বড় স্ক্রিনে খেলা চলে, সেগুলোর সম্প্রচারে ১৫ বা ২০ সেকেন্ডের কমবেশি হয়। ফলে একজায়গায় আশরাফুলের আউটটা একটু আগে দেখা গেছে, কোথাও একটু পরে দেখা গেছে। যাই হোক, একটু আগে-পরে হলেও আশরাফুল কিন্তু সত্যিই গতকাল গোটা বাংলাদেশকে হতাশার মহাসমুদ্রে ডুবিয়ে সাজঘরে ফিরেছিলেন মাত্র এক রান করে। এ হতাশা অবর্ণনীয়। সেই সময়টা ছিল দুঃখ-রাগ-ক্ষোভ-হতাশা মিলে তৈরি হওয়া একটা ভয়ানক বিভীষিকাময় পরিস্থিতি। স্কোরবোর্ডে মাত্র ১৫১ রান। আশরাফুল ফিরে গেলেন ছয় নম্বর ব্যাটসম্যান হিসেবে। হতাশায় বেচাবিক্রি বাদ দিয়েছিলেন চায়ের দোকানদাররা। রাগে-ক্ষোভে আশরাফুলের কুশপুত্তুলিকা পোড়ানোর পরিকল্পনা শুরু করেছিলেন সমর্থকরা। আর অবর্ণনীয় গালাগালির কথা তো বাদই দিলাম।

কেন? কেন আলাদা করে শুধু আশরাফুলের উপরই রাগ বাংলাদেশের মানুষের? এক ম্যাচে না হয় খেলতে পারেন নি। কী হয়েছে তাতে? কিন্তু কাহিনীর শুরুটা তো শুধু এই একদিনেই হয় নি। এই রাগ-ক্ষোভ-হতাশার এক লম্বা ইতিহাস আছে।

বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ অনুষ্ঠানের যে উত্তাপ-উত্তেজনা, তার সঙ্গে প্রায় হাতে হাত ধরে হেটেছে আশরাফুল বিতর্ক। বাংলাদেশের সবচেয়ে অভিজ্ঞ এই ব্যাটসমানটিকে দলে নেওয়া হবে, কি হবে না, সেই বিতর্ক। ব্যাট হাতে মাঠে নামলে যে রান করতে হয়, দীর্ঘদিন ধরে সেটাই যেন ভুলে গিয়েছিলেন আশরাফুল। তাই বিশ্বকাপ কাউন্টডাউন শুরু হওয়ার পর থেকেই উঠে গেল সেই মোক্ষম প্রশ্ন। কী হবে আশরাফুলের বিশ্বকাপ ভাগ্য? শেষমুহূর্তে এই প্রশ্নেই নড়েচড়ে উঠেছিল বাংলাদেশের ক্রিকেট অঙ্গন।

শুরুর দিকে নির্বাচকদের দলে জায়গা হয়েছিল আশরাফুলের। কিন্তু বিসিবির টেকনিক্যাল কমিটির নাকি সেই দল পছন্দ হচ্ছিল না। তারা নাকি দলে আশরাফুলের জায়গায় অলোক কাপালিকে নেওয়ার জন্য চাপ দিচ্ছিলেন। নিবাচক কমিটির সদস্যরাও নাকি বদলে যাবে, এমন রিপোর্টও হয়েছে প্রথম আলোতে আর সেদিনই নিবাচকদের উপর টেকনিক্যাল কমিটির এই হস্তক্ষেপের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে একটা অগ্নিঝরা মন্তব্য প্রতিবেদন লিখলেন প্রথম আলোর ক্রীড়া-সম্পাদক উত্পল শুভ্র। ‘যাঁদের কাজ তাঁদেরই করতে দিন’- শিরোনামে। সেদিনই বিকেলবেলা ঘোষিত হলো বিশ্বকাপের চূড়ান্ত দল। প্রায় ছেড়ে দেওয়া একটা ট্রেনে শেষমুহূতে জায়গা পেলেন আশরাফুল।

সেসময়ই বিসিবির এই সিদ্ধান্ত খুশিমনে মেনে নিতে পারেন নি বাংলাদেশের অনেক ক্রিকেটপাগল মানুষ। আবার ‘ঠিক আছে মাঠে দেখা যাবে’ বলে মেনে নিয়েছিলেন অনেকে। এখানেই শেষ নয়। এরপর খবর পাওয়া গেল অনুশীলনে নাকি তার প্রতি বিমাতাসুলভ আচরণ করছেন কোচ জিমি সিডন্স। আবার আরেকপ্রস্থ পত্রিকার শিরোনাম হলেন আশরাফুল। অবশেষে সব ঝক্কি-ঝামেলা শেষে মাঠে গড়ালো খেলা। ভারতের বিপক্ষে উদ্বোধনী ম্যাচটা তিনি মাঠের বাইরে থেকেই দেখলেন। আর আজকের অবস্থা তো আগেই বলা হয়েছে। ফলে প্রায় সবাই বললেন, ‘আগেই বলেছিলাম ওকে দলে নেওয়াটা ঠিক হয়নি’। আর যারা আশরাফুলের অভিজ্ঞতা-সম্ভবনার উপর একটু ভরসা করেছিলেন, তারা হলেন চরম বিরক্ত, যারপরনাই হতাশ।

আশরাফুল কি ব্যাট হাতে নামার সময় একটুও ভেবেছিলেন যে, তাকে দলে জায়গা দেওয়া হয়েছে মাহমুদুল্লাহকে সরিয়ে? আগের ম্যাচে মাহমুদুল্লাহ যে ৬টি রান করেছিলেন, সেই অঙ্কটা অন্তত তার ছোয়া উচিত্? সেই ছয়টা রানই যে গতকালের ম্যাচের জন্য ছিল অনেক কিছু…।

ফিল্ডিং করতে মাঠে নামার সময় হয়তো এসব চিন্তাই কুড়ে কুড়ে খাচ্ছিল আশরাফুলকে। তাই হয়তো বল হাতে দুইটা উইকেট নিয়ে কিছুটা পুষিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলেন। কিন্তু বাংলাদেশের ২৭ রানের ঘামঝড়ানো জয়ের জন্য কিন্তু এটা যথেষ্ট ছিল না। আশরাফুল ধন্যবাদ দিতে পারেন শাফিউল ইসলামকে। স্বপ্নের মতো এক স্পেল (৬-১-১০-৪) দিয়ে বাংলাদেশকে রোমাঞ্চকর এক জয় এনে দিয়েছেন এই পেসার। এছাড়া হয়তো নিজেকে প্রতীকীভাবে পুড়ে যাওয়ার হাত থেকে বাঁচাতে পারতেন না জনাব মো. আশরাফুল। আমাদের ক্ষুব্ধ সমর্থকরা আরো কতো কী করতে পারতেন আমরা অনুমান করে নিতে পারি।

সেদিকে শেষপযন্ত যেতে হয়নি, বাংলাদেশের বণিল বিশ্বকাপটা ফ্যাকাশে হয়ে যায় নি এটাই অবশ্য এখন সবচেয়ে বড় ব্যাপার। তবে আশরাফুল বিতর্কটা কিন্তু আবার নতুন করে জাগিয়ে তুললেন আশরাফুল নিজেই। আমরা কিন্তু বোলার আশরাফুলকে চিনি না। আমরা চিনি ব্যাটসম্যান আশরাফুলকে। যার অসাধারণ ব্যাটিং নৈপুন্যে আমরা একদা হারিয়েছিলাম বিশ্বচ্যাম্পিয়ন অস্ট্রেলিয়াকে। গতকালের ম্যাচে সেই ব্যাটসম্যান আশরাফুলের পারফরমেন্স সম্পর্কে আমার ঐ বন্ধুর মন্তব্য দিয়েই শেষ করি। ‘আরে, আশরাফুল কী ‘ডাক’ মারার মতো ব্যাটসম্যান নাকি? ১ রান করছে মিয়া!’ আশরাফুল আর আশরাফুল-ভক্তরা কী এটাকেই সান্তনা ধরে নেবেন?