Posts Tagged ‘ লিটল মাস্টার ’

‘সময় থমকে থাকে শচীনের সামনে’

Sachin_Tendulkar_Wallpaper_1_ovdee‘সময় যখন এই পৃথিবীর প্রতিটি মানুষের সামনে গিয়ে নিজের শুল্ক আদায় করবে, তখন মনে হয় সে শুধু একটা মানুষকেই ছাড় দেবে। সময় শচীনের সামনে থমকে থাকে। আমরা অনেক চ্যাম্পিয়ন পেয়েছি, আমরা অনেক কিংবদন্তী পেয়েছি। কিন্তু মনে হয় আরেকজন শচীন টেন্ডুলকারকে আমরা কখনোই পাব না।’ সদ্যই একদিনের ক্রিকেটকে বিদায় জানানো ভারতের ব্যাটিং বিস্ময় শচীন টেন্ডুলকারকে এভাবেই শ্রদ্ধাঞ্জলি জানিয়েছে টাইম ম্যাগাজিন।

এবছরের মার্চে এশিয়া কাপে শেষবারের মতো ওয়ানডে ম্যাচের রঙ্গিন জার্সি গায়ে টেন্ডুলকারকে দেখতে পেয়েছিলেন ক্রিকেটপ্রেমীরা। সেখানেই বাংলাদেশের বিপক্ষে ইতিহাসগড়া শতকটি করেছিলেন লিটল মাস্টার। আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের শততম শতকটি পূর্ণ করে শুধু নিজেকে বা দেশকে নয়, পুরো ক্রিকেট বিশ্বকেই তিনি নিয়ে গিয়েছিলেন নতুন উচ্চতায়। তারপর এই অবিস্মরণীয় ও প্রায় অলঙ্ঘনীয় কীর্তিটিকে সম্মান জানিয়ে গত মে মাসে টেন্ডুলকারকে নিজেদের প্রচ্ছদে তুলে এনেছিল টাইম ম্যাগাজিন। এবার বর্ণাঢ্য ক্রিকেট ক্যারিয়ারের একটি অধ্যায়ের সমাপ্তির পর শচীনকে আকুণ্ঠ শ্রদ্ধা জানিয়েছে আমেরিকার শীর্ষ এই পত্রিকাটি।

শচীনের একটি অন্যতম প্রধান বিশেষত্ব এই জায়গায় যে, ২৩ বছরের বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারে তিনি শুধু নিজেকেই না, পুরো ক্রিকেট খেলাটাকেই নতুন উচ্চতায় পৌঁছিয়েছেন। সবাইকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন একেরপর এক বিস্ময়কর মাইলফলকের সঙ্গে। আর আগামী প্রজন্মের কাছে রেখে গিয়েছেন সেই প্রায় অলঙ্ঘনীয় রেকর্ডগুলো ভাঙ্গতে পারার আহ্বান। ক্রীড়াজগতের অন্যান্য অঙ্গনে অনেক খেলোয়াড়েরই অনেক উত্থান পতন দেখা গেছে, অনেক নতুন নতুন তারকার আবির্ভাব হয়েছে। কিন্তু ক্রিকেটে শচীন টেন্ডুলকার যেন এক দীর্ঘস্থায়ী নাম। সময়ের যেন আসলেই থমকে আছে শচীনের সামনে। কিংবদন্তী এই ব্যাটসম্যানের এই খেলোয়াড়ী জীবনের বিস্ময়কর স্থায়ীত্ব স্মরণ করেই হয়তো টাইম ম্যাগাজিনের নিজেদের ওয়েবসাইটে বলেছে, ‘যখন শচীন টেন্ডুলকার পাকিস্তানে গিয়েছিলেন তত্কালিন ক্রিকেটের অন্যতম সেরা বোলিং আক্রমণের মোকাবিলা করতে তখন মাইকেল শুমাখার কোন ফরমুলা ওয়ান রেসে অংশ নেননি, ল্যান্স আর্মস্টং ফ্রান্স ট্যুরে পা রাখেননি, ডিয়েগো ম্যারাডোনা তখন শুধুই বিশ্বকাপজয়ী আর্জেন্টিনা দলের অধিনায়ক আর পিট সাম্প্রাস তখনও একটি গ্রান্ড স্ল্যামও জেতেননি। টেন্ডুলকার যখন ইমরান খানদের দুর্দান্ত ডেলিভারিগুলো সামলাচ্ছেন, তখন কেউ রজার ফেদেরারের নামও শোনেনি। লিওনেল মেসি ছোট্ট শিশু, উসাইন বোল্ট জ্যামাইকার একটা অজানা ছেলে, বার্লিন দেয়াল তখনও অটুট, সোভিয়েত ইউনিয়ন একটা বিশাল বিশাল বড় দেশ, ড. মনমোহন সিং তখনও কোনো নেহেরুপন্থী অর্থনীতির সূচনা করেননি।’

১৯৮৯ সালে পাকিস্তানের বিপক্ষে ওয়ানডে ক্রিকেটে অভিষেক হয়েছিল শচীন টেন্ডুলকারের। এরপর দীর্ঘ ২৩ বছরের ক্যারিয়ারে ৪৬৩টি একদিনের ম্যাচ খেলেছেন এই ডানহাতি ব্যাটসম্যান। ৪৯টি শতক ও ৯৬টি অর্ধশতক দিয়ে সাজানো বিস্ময়কর ক্যারিয়ারে ১৮,৪২৬ রান এসেছে টেন্ডুলকারের ব্যাট থেকে। একদিনের ক্রিকেটে প্রথম ব্যাটসম্যান হিসেবে দ্বিশতক করার অবিস্মরণীয় কৃতিত্বটিও নিজের দখলে নিয়েছিলেন ভারতের ক্রিকেট দেবতা।

স্বপ্নের পিছু ছাড়া যাবে না: শচীন

বহু প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে অবশেষে শততম শতকটির দেখা পেয়েছেন শচীন টেন্ডুলকার। আজ এশিয়া কাপের চতুর্থ ম্যাচে বাংলাদেশের বিপক্ষেই ক্রিকেট বিশ্বকে নতুন এই মাইলফলকটির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন সর্বকালের অন্যতম সেরা এই ব্যাটসম্যান।

এই একটি সেঞ্চুরির জন্য দীর্ঘ এক বছরের প্রতীক্ষা যে পাহাড় সমান চাপ তৈরি করেছিল, সেটা অস্বীকার করেননি শচীন। ক্যারিয়ারের শততম শতকটি পূর্ণ করার পর যেন ৫০ কেজি ওজনের ভার কমে গেছে বলে সাংবাদিকদের জানান ভারতের এই ব্যাটিং কিংবদন্তী। অনন্য এই কীর্তিটি করে শচীন দেখিয়ে দিয়েছেন অসম্ভব বলে আসলে কিছুই নেই। দীর্ঘ ২২ বছরের ক্যারিয়ারে ব্যাটিং রেকর্ডের প্রায় সবকিছুই নিজের দখলে নিয়ে আসার পর তরুণ ক্রিকেটারদের প্রতি শচীনের আহ্বান, ‘স্বপ্নের পিছু কখনো ছাড়া যাবে না।’

গত বিশ্বকাপে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে করা ৯৯তম আন্তর্জাতিক সেঞ্চুরির পর থেকেই শচীনের ব্যাটের দিকে উত্সুক চোখে তাকিয়ে ছিল গোটা ক্রিকেট বিশ্ব। শচীনের সেঞ্চুরির আশায় ‘এবারই হবে!’, ‘এই ম্যাচেই তাহলে হচ্ছে!’ ইত্যাদি লিখতে লিখতে ক্রীড়া সাংবাদিকরা ক্লান্তই হয়ে পড়েছিলেন বলা যায়। কিন্তু শচীনের এই শততম সেঞ্চুরিটির দেখা পেতে পার হয়ে গেছে পুরো একটা বছর। চারপাশের এই ধরণের আলোচনা-সমালোচনা যে প্রচণ্ড চাপ তৈরি করেছিল সেটা নির্দ্বিধায় স্বীকার করেছেন শচীন। তবে তিনি যে শুধু সেঞ্চুরির জন্যই মাঠে নামেন না, বরং দলের সামষ্টিক পারফরমেন্সই যে তাঁর প্রধান বিবেচ্য বিষয়, সেটাও সাংবাদিকদের মনে করিয়ে দিয়েছেন লিটল মাস্টার। ভারতীয় ইনিংস শেষ হওয়ার পর এক সাক্ষাত্কারে তিনি বলেছেন, ‘সত্যি বলতে, একদম এক বছর আগে আমি যখন ৯৯তম সেঞ্চুরিটি করেছিলাম, তখন এ নিয়ে কেউই খুব বেশি কথা বলেনি। কিন্তু এরপর গণমাধ্যমগুলোই প্রথমে এটা শুরু করেছিল। তারপর সব জায়গাতেই যেখানে আমি গিয়েছি, আমাকে এই শততম সেঞ্চুরির কথাই শুনতে হয়েছে। এটা খুবই কঠিন পরিস্থিতি। আমি তো শুধু শততম সেঞ্চুরির জন্যই খেলি না। আমি সবসময়ই দলের সামগ্রিক পারফরমেন্সই প্রধান হিসেবে বিবেচনা করেছি।’

ছোটরা, যারা ব্যাট হাতে হয়ে উঠতে চায় আগামীর শচীন, তাদের উদ্দেশ্যে কী বলবেন এমন প্রশ্নের জবাবে ভারতের ব্যাটিং আইকন বলেছেন, ‘খেলাটা উপভোগ করো, আর নিজের স্বপ্নের পিছু করো। স্বপ্ন সত্যি হয়। আমাকে অপেক্ষা করতে হয়েছে দীর্ঘ ২২ বছর। স্বপ্নের পিছু করা কখনোই বাদ দিও না।’

নিজের উপর আত্মবিশ্বাস আর নিজের স্বপ্নের পিছনে ছুটতে ছুটতেই ক্রিকেটের রেকর্ড বুকে শচীন এমন এক জায়গা করে নিয়েছেন, যেখানে অন্য কারও পৌঁছানো আর সম্ভব হবে কিনা, তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় আছে। কাজেই এমন উপদেশ এখন শচীনের মুখেই মানায়। আগামীতে এই উপদেশ অনুসরণ করেই কেউ হয়ত তাঁর তৈরি করা মাইলফলকগুলো ছুঁয়ে ফেলতে পারবে।

বাংলাদেশকেই বেছে নিলেন শচীন

বাংলাদেশকেই বেছে নিলেন শচীন

এ মাসের ১২ তারিখে সেঞ্চুরি-খরার এক বছর পূর্ণ করেছিলেন শচীন টেন্ডুলকার। গত বছরের ১২ মার্চ ক্যারিয়ারের ৯৯তম সেঞ্চুরি পাওয়ার পর থেকেই শচীনের ব্যাটের দিকে তাকিয়ে ছিল গোটা ক্রিকেট বিশ্ব। কিন্তু এক বছরের দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর অবশেষে বহু আকাঙ্ক্ষিত সেঞ্চুরির দেখা পেয়েছেন ভারতের এই ব্যাটিং আইকন। আর শততম সেঞ্চুরির অনন্য এই রেকর্ডটি করার জন্য বাংলাদেশকেই বেছে নিলেন সর্বকালের অন্যতম সেরা এই ব্যাটসম্যান। এশিয়া কাপের চতুর্থ ম্যাচে ক্রিকেট বিশ্বকে নতুন এই মাইলফলক উপহার দিলেন লিটল মাস্টার।

বাংলাদেশের বিপক্ষে যেন শচীনের সেঞ্চুরিটি না হয়, এটা অবশ্য খুব করেই চেয়েছিলেন মুশফিকুর রহিম। এশিয়া কাপে পাকিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচ শেষে সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশের অধিনায়ক বলেছিলেন, ‘আমি খুব করে চাই, শচীনের শততম সেঞ্চুরিটি হোক, কিন্তু আমাদের বিপক্ষে নয়।’ কিন্তু মুশফিকুরের এই আশা শেষ পর্যন্ত পূরণ হলো না। দীর্ঘদিন পর শচীনের ব্যাট আবার ঝলসে উঠল ঢাকাতেই। বাংলাদেশের বিপক্ষে। টসে হেরে ব্যাট করতে নেমে প্রথম থেকেই খুব সাবধানে ব্যাটিং করেছেন টেন্ডুলকার। শততম সেঞ্চুরিটি পূর্ণ করতে তিনি খেলেছেন ১৩৮টি বল। এর মধ্যে ছিল একটি ছয় ও ১০ টি চার।

গত বছর অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে শচীনকে শেষবারের মতো দেখা গিয়েছিল হেলমেট খুলে দুই হাত উপরে তুলে আকাশের দিকে তাকানোর ভঙ্গিমায়। এরপর টেস্ট, ওয়ানডে মিলিয়ে ২৩টি ম্যাচে মাঠে নেমেছিলেন ৩৯ বছর বয়সী এই ডানহাতি ব্যাটসম্যান। খেলেছেন ইংল্যান্ড, ওয়েস্ট ইন্ডিজ, অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে। কিন্তু অনেক সম্ভাবনা জাগিয়েও ক্রিকেট প্রেমীদের অপেক্ষাতেই রেখেছিলেন শচীন। অবশেষে সব প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে বাংলাদেশের বিপক্ষেই চিরচেনা ভঙ্গিমায় শতক উদযাপন করতে দেখা গেল কিংবদন্তি এই ব্যাটসম্যানকে। মুশফিকুর রহিমের অনিচ্ছা সত্ত্বেও শচীনের এই সেঞ্চুরিটির সঙ্গেই ইতিহাসের অংশ হিসেবে রেকর্ড বুকে জায়গা করে নিল বাংলাদেশ। মিরপুর শেরেবাংলা জাতীয় স্টেডিয়ামের উপস্থিত দর্শকেরাও হয়তো পরবর্তীকালে স্মৃতি রোমন্থন করে আনন্দ পাবেন যে, ‘শচীনের ইতিহাস গড়া এই দিনটিতে সেখানে আমিও ছিলাম।’