Posts Tagged ‘ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ’

রক্ত নিয়ে হোলি-খেলা, ফুরিয়ে গেছে তোদের বেলা

ছোট আকারে হলেও গতকাল ৬ এপ্রিল মুখোমুখি সংঘর্ষে জড়িয়েছে হেফাজতে ইসলাম ও শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চ। পুরো দেশজুড়ে এমন ঘটনা আরও কিছু ঘটেছে। গতকাল ৬ এপ্রিল যখন শাহবাগ আন্দোলনের কর্মীরা হেফাজতে ইসলামের হামলা প্রতিহত করার জন্য উত্তেজিতভাবে লাঠি-বাঁশ সংগ্রহ করছিলেন, ঠিক সেই সময় মঞ্চ থেকে নতুন এই শ্লোগানটি শুনতে পেলাম: ‘রক্ত নিয়ে হোলি-খেলা, ফুরিয়ে গেছে তোদের বেলা’। শুনে খুবই ভালো লাগল। আসলেই, রক্তের হোলি-খেলা বন্ধ করার সময় এখন। অপশক্তির দিক থেকে আক্রমণ আসলে সেটা প্রতিহত করার শক্তি আমাদের যেমন অর্জন করতে হবে, তেমনি যখন সংঘর্ষ চলছে না, সেসময় এই পেশিশক্তির লড়াই কিভাবে এড়ানো যায়, সেকথাও আমাদের চিন্তা করতে হবে। সমান গুরুত্ব দিয়ে। বর্তমান তরুণ প্রজন্মের যে মেধাবী সন্তানরা জীবন তুচ্ছ করে লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে, তাদের রক্তাক্ত লাশ কোন পরিস্থিতিতেই কাম্য না। তাদের মগজটাই আজকের লড়াইয়ে বেশি জরুরি।

17206_551344121575076_1574400579_n

কেন তৈরি হলো সাংঘর্ষিক পরিস্থিতি?

পেশিশক্তির সাংঘর্ষিক পরিস্থিতি এড়ানো যায় নি। তবে একটা বিষয় স্পষ্ট যে, এই মুখোমুখি সংঘর্ষের জন্য কোনভাবেই গণজাগরণ মঞ্চ বা শাহবাগ আন্দোলনের কর্মীদের দায়ি করার সুযোগ নেই। শাহবাগ আন্দোলনের কর্মীরা আগ বাড়িয়ে হেফাজতে ইসলামের উপর আক্রমণ করতে যায়নি। শাহবাগ যখন আক্রান্ত হয়েছে, তখন অনেকেই নিজ উদ্যোগে নিজেদের আত্মরক্ষার স্বার্থে লাঠি হাতে নিয়েছে।

অনেকেই হয়তো গণজাগরণ মঞ্চ ও ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি, সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর ঢাকা হরতাল-অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণাকে সমর্থন করতে পারেননি। কিন্তু যখন একথা বেশ ভালোভাবেই প্রতিষ্ঠা করা গেছে যে, হেফাজতে ইসলাম আসলে জামায়েতী ইসলামকেই হেফাজত করতে চাচ্ছে, দেশের সব ভাস্কর্য-শহীদ মীনার ভেঙ্গে ফেলার কথা বলছে, নারী-পুরুষের প্রকাশ্য মেলামেশা বন্ধ করার দাবি তুলছে তখন তাদেরকে প্রতিহত করার দায়িত্ব কি মুক্তমনা-স্বাধীনচেতা মানুষরা অনুভব করবেন না? যেখানে আওয়ামী লিগ সরকারও তাদের কথা অনুযায়ী ৪ জন বগারকে গ্রেফতার করেছে এবং ১৩ দফার অধিকাংশ দাবি মেনে নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে, তখন এই হরতাল-অবরোধের পক্ষে যুক্তি দেখানোর অনেক জায়গা আছে।

২৬ মার্চ জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধ সংক্রান্ত আল্টিমেটাম শেষ হওয়ার পর যখন গণজাগরণ মঞ্চ থেকে কোন কঠোর কর্মসূুিচ আসেনি, শাহবাগে কিছুটা দ্বিধা-বিভক্তি, মতানৈক্য ইত্যাদি তৈরি হয়েছে। শহীদ রুমী স্কোয়াড আমরণ অনশনের ঘোষণা দেওয়ার পর আবার আশার আলো জ্বলছিল শাহবাগ চত্বরে। এরই মধ্যে বেশ কাঁপাকাঁপি দিয়ে ময়দানে আবির্ভাব ঘটে হেফাজতে ইসলামের। মধ্যযুগীয় কায়দার ১৩ দফা দাবি দিয়ে। ‘নাস্তিক ব্লগারদের’ ফাঁসির দাবি নিয়ে। সরকারও তাদের দাবির প্রতি নতজানু হয়ে ৪ জন ব্লগারকে গ্রেফতার করে। নজীরবিহীন কায়দায়। আমারব্লগ বন্ধ করে দেয়। অন্যদিকে শহীদ রুমী স্কোয়াডের সঙ্গে একরকম প্রতারণা করেই তাদের অনশন কর্মসূচি স্থগিত করানো হয়। প্রতারণা বললাম এই কারণে যে, মাননীয় পরিকল্পনামন্ত্রী এ কে খন্দকার বলেছিলেন জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধের দাবি মেনে না নিলে তিনি নিজেই অনশনে বসবেন। কবে সেটা? জানা যায় নি। ফলে অনেকেই মনে হয় কিছুটা হলেও আশাহত হয়েছিলেন, উদ্যোম হারিয়েছিলেন। ফলে সরকারও হয়তো ভাবতে শুরু করেছিল যে, ওদেরকে তো শান্ত করাই গেছে, এখন তাদের দাবির দিকে না তাকালেও হবে। বরং অন্যদিকটাই ট্যাকল দিই। এই পর্যায়ে শাহবাগ আন্দোলনের পক্ষ থেকেও সরকারকে জানিয়ে দিতে পারাটা দরকার ছিল যে, আমরাও আমাদের দাবি থেকে একচুল নড়িনি। আবার সবাইকে স্মরণ করিয়ে দেওয়ার দরকার ছিল যে, ‘আমরা বাড়ি ফিরছি না/রাজাকারদের ছাড়ছি না’। নিজেদের শক্তিমত্তা সম্পর্কে জানান দেওয়ার দরকার ছিল। নাহলে সবাই মনে করত যে, শাহবাগ আন্দোলন সতিই শেষের পথে।

আর রুমী স্কোয়াডের ৮দিনের আমরণ অনশন কর্মসূচিতেও যে সরকারের কোন ভ্রুক্ষেপ হয়নি সেটা তো বোঝাই যায়। এই পরিস্থিতিতে শাহবাগের অস্তিত্বের কথা সরকারকে মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য কঠোর কর্মসূচিরই প্রয়োজনীয়তা ছিল। দেশ পরিচালনায় নিযুক্ত রাজনীতিবিদরা এখনো হয়তো বুঝতে পারছেন না যে, শাহবাগ আন্দোলন ও হেফাজতে ইসলাম পুরোপুরি বিপরীতধর্মী দুইটা পক্ষ। দুই পক্ষ পরস্পরের পুরোপুরি উল্টাপথে হাঁটতে চায়। একপক্ষ চায় সামনে এগোতে, আরেক পক্ষ চায় পেছনে ফিরে যেতে। দুইটি আদর্শের মতভিন্নতা এতটাই বেশি যে, এটার মধ্যে কোন সমন্বয়ও সম্ভব কিনা, সন্দেহ আছে। ফলে সরকার যদি সবসময় ভোটবুদ্ধি না খাটিয়ে একটু যুক্তিবুদ্ধি খাটাতো তাহলে হেফাজতে ইসলামকে আস্কারা দেওয়ার আত্মঘাতি সিদ্ধান্ত কখনোই নিত না। আফসোস যে, তারা সেটা করছেন না। ফলে শাহবাগ আন্দোলনের পক্ষ থেকে নব উদ্যোমে সংগঠিত হওয়ার এই সুযোগটা ইতিবাচকই হয়েছে বলে আশা করছি।

 শুধু হাতইয়ার নামনইয়ারও চাই

এই একবিংশ শতাব্দির পৃথিবীতে হেফাজতে ইসলাম যে ধরণের দাবিদাওয়া উঠিয়েছে, সেটা মেনে দেওয়া প্রায় অসম্ভব রকমের ব্যাপার। কিন্তু তাদেরকে সহিংস উপায়ে হাতিয়ারের সাহায্যে মোকাবিলা করার পথ বেছে নেওয়া মোটেই মনে হয় উচিত্ হবে না দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধের সৈনিকদের। একথা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই যে, হেফাজতে ইসলামের ডাকে রাস্তায় বেরিয়ে আসা লোকের সংখ্যাও বাংলাদেশে কম না। এবং ধর্ম বিষয়টা আসলেও খুব স্পর্ষকাতর ইস্যু। তাই খুবই সাবধানতার সাথে এই পরিস্থিতি মোকাবিলা করা প্রয়োজন।

হেফাজতে ইসলামের লংমার্চে যারা অংশ নিয়েছিলেন তাদের অধিকাংশই জীবনে কখনো ইন্টারনেট, ফেসবুক-ব্লগ ব্যবহারের সুযোগ পেয়েছেন কিনা সন্দেহ আছে। তারা ধর্মভিত্তিক বইগুলো ছাড়া অন্য কোন বই পড়ারও সুযোগ পেয়েছেন কিনা সন্দেহ আছে। ফলে শিক্ষিত-শহুরে মানুষদের থেকে তাদের মানসিক ব্যবধানটা যে অনেক বেশি থাকবে, এতে আশ্চর্যের কি আছে। কিন্তু ‘আমরা জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা করি, আমরা মুক্তমনা’ এই বলে আত্মপ্রসাদের ভোগাটাও বিপদজনক হবে অপর পক্ষের জন্য। বরং দুই পক্ষের সাংস্কৃতিক-মানসিক মেলবন্ধনটা কিভাবে হতে পারে সেটাই বিবেচনা করা দরকার।

গতকাল খুব অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম, আমার এক স্কুলবন্ধুর মনে জন্মেছে প্রচণ্ড ইসলাম বিদ্বেষ। ইসলাম ধর্ম মানবকল্যানের জন্য, শান্তির জন্য কোন অবদান রাখতে পারে না বলেই সে মনে করে। এই ধরণের আলট্রা মডার্ন দৃষ্টিভঙ্গিও কিন্তু আখেরে সমাজের কোন কল্যান বয়ে আনবে না। এই রকমের দৃষ্টিভঙ্গি বরং ঘৃণার বিপরীতে আরও ঘৃণাই ছড়াবে। সমাজকে শান্তির পথে নিয়ে নিয়ে যাবে না। স্বাধীনতা-সমবেদনার পথে নিয়ে যাবে না।

ধর্মচিন্তা-ধর্ম সংক্রান্ত আলাপ-আলোচনাকে পরিহার-পরিত্যাগ করে অনেকদিন থাকা হয়েছে। প্রগতিশীলদের পক্ষ থেকে ধর্মীয় আলাপ দূরে সরিয়ে রাখার যে প্রবণতা, এতদিন সেটারই ফায়দা নিয়েছে কট্টরপন্থী, রক্ষণশীলরা। তারা নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য ইসলাম ধর্ম বা অতীতে আরও অনেক ধর্মের অপব্যাখ্যা দিয়েছে, এখনো দিচ্ছে। একদল মানুষ কিছু না বুঝেই মোল্লা-পুরোহিতদের সাথে সাথ মিলিয়ে গেছেন, পরকালের ভয়ে। অপরদিকে কিছু মানুষ এসব দেখে পুরো ধর্মটাকেই অবজ্ঞা করতে শুরু করেছেন। এটা এক ভয়াবহ দুষ্টচক্র। পুরো সমাজের কল্যানেই এর অবসান ঘটানো প্রয়োজন।

দুই পক্ষের সামজিক-সাংস্কৃতিক ব্যবধানটা ঘোঁচাতে হবে। সেটা জ্ঞান-বিজ্ঞানের দিক থেকেও, ধর্মীয় বা আধ্যাত্মিকতার দিক থেকেও। মানুষের জন্য, সমাজের জন্য বিজ্ঞানভিত্তিক অগ্রগতিটা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি মনুষ্যজন্মের মহিমা বোঝার জন্য আধ্যাত্মিক চর্চাটাও সমান গুরুত্বপূর্ণ। সেই আধ্যাত্মিকতার চর্চা ইসলাম ধর্ম দিয়েও হতে পারে, অন্যান্য ধর্ম-মতবাদ দিয়েও হতে পারে। আধ্যাত্মিক শূণ্যতা (Spiritual Vacuum) যে সামগ্রিকভাবে সমাজের জন্য ক্ষতিকর সেটা নিয়ে পশ্চিমে বেশ কথাবার্তা শুরু হয়েছে। কারণ তারা এটা টের পাওয়া শুরু করেছে। বাজার সংস্কৃতিতে সব কিছু কিনতে পাওয়া গেলেও মনের শান্তিটা এখনও পর্যন্ত কোন কোম্পানি বাজারজাত করে নাই। আর এই মনের শান্তি লাভের উপায়-উপাদানগুলো অনেকাংশে সংরক্ষিত আছে বিভিন্ন ধর্মীয় মতবাদগুলোর মধ্যে। পুরো ধর্মকেই খারিজ করে দেওয়ার প্রবনতা থেকে সরে এসে আমাদের বরং ধর্মীয় মতবাদগুলোর মুক্তিকামী উপাদানগুলো খুঁজে বের করা দরকার। সেগুলো প্রচার-প্রসার করা দরকার।

আর এটা করতে গেলে আমাদের ওঠাতে হবে মন-ইয়ার। অস্ত্রে নয়, শান দিতে হবে যুক্তিতে। মানবতার পক্ষে, সাম্য-স্বাধীনতার পক্ষে নিরন্তর প্রচারণা চালাতে হবে। সমাজের সুবিধাবঞ্চিত মানুষদের কাছে যেমন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে যেতে হবে, জ্ঞান-বিজ্ঞান অগ্রগতির খবর নিয়ে যেতে হবে, তেমনি ইসলামসহ প্রতিটা ধর্মে বিরাজমান সাম্য-শান্তি-সমবেদনার বার্তাও পৌঁছে দিতে হবে। বর্তমানে দেশের যা পরিস্থিতি তাতে, ব্যাপক আকারের সাংস্কৃতিক প্রচারণার মাধ্যমেই কেবল রক্ত নিয়ে হোলি খেলা বন্ধ করা সম্ভব।

নতজানু আর নয়

পূর্বপরিকল্পিত পথেই হাঁটছে জামায়াত-শিবির

২০০৯ সালে জামায়াতে ইসলামীর করা কিছু পরিকল্পনা-কর্মপদ্ধতি সম্পর্কে জানা যায় উইকিলিকসের কল্যানে। এগুলো তারা বলেছিল ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে। নিজেদের লক্ষ্য সম্পর্কে জামায়াত নেতারা বলেছিল, জামায়াত পরবর্তী নির্বাচনে জয়ী হওয়া বা জাতীয় সংসদে আসনসংখ্যা বাড়ানোর মতো স্বল্পমেয়াদি অর্জন নিয়ে চিন্তিত নয়, তাদের দৃষ্টি চূড়ান্ত লক্ষ্যের দিকে। চূড়ান্ত লক্ষ্যটা কি? ইসলামি রাষ্ট্র কায়েম করা। পাকিস্তানে যেমনটা ছিল-আছে।
২০০৮ সালে আওয়ামী লিগ সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করার অঙ্গীকার নিয়ে ক্ষমতায় এলে খানিকটা কোনঠাসা বোধ করে জামায়াত-শিবির। যদি সরকার তাদের নিষিদ্ধই করে, তাহলে কী করা হবে সেটাও তখনই ভেবে রেখেছিল তারা। উইকিলিকসে জামায়াতে ইসলাম ২০১০ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রদূত মরিয়ার্টি একটি গোপনীয় তারবার্তায় লেখেন: জামায়াতের নেতা ব্যারিস্টার রাজ্জাক ১০ ফেব্রুয়ারি বৈঠকে তাঁকে বলেন, জামায়াতে ইসলামী ‘সাংবিধানিক পথে’ বিশ্বাস করে, দলটি আদালতের সিদ্ধান্ত মেনে চলবে। বাংলাদেশে যদি ধর্মভিত্তিক দলগুলো নিষিদ্ধ হয়ে যায়, তাহলে জামায়াত তুরস্কের ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর দৃষ্টান্ত অনুসরণ করবে। জামায়াত দলের নাম পরিবর্তন করবে, দলীয় গঠনতন্ত্র থেকে ধর্মীয় মতবাদগুলো বাদ দেবে; কিন্তু একই সঙ্গে তিনি বলেন যে জামায়াত রুলিংটিকে আদালতে চ্যালেঞ্জ করবে। রাজ্জাকের ভাষ্য অনুসারে, ধর্মভিত্তিক দলগুলোর ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হলে জামায়াতে ইসলামী দলের নামে ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ও ট্রাস্টে যে অর্থ আছে, দলটি তা হারাবে, কিন্তু দল টিকে থাকবে। রাজ্জাক বলেন, একটি ক্ষত সৃষ্টি হবে, তবে সেই ক্ষত সারানো যাবে। (সূত্র: উইকিলিকসে বাংলাদেশ: ‘জামায়াতে ইসলামী- খরগোশ নয়, কচ্ছপ’)
দুই বছর পরে এখন তাহলে জামায়াত কি সেই কর্মপরিকল্পনা অনুসারেই হাঁটছে না? হেফাজতে ইসলাম যে জামায়াতেরই মদদপুষ্ট এবং মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ সেকথা কি এখনো কারও বোঝার বাকি আছে? পরিস্কারভাবে দেখা যাচ্ছে যে, তারা হেফাজতে ইসলামের নামে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচাল, জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধের দাবির কণ্ঠরোধ করতে চায়।
জামায়াত তুরস্কের ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর দৃষ্টান্ত অনুসরণ করবে সেকথাও বলেছে। সকলের বোধহয় মনে আছে যে, ট্রাইবুন্যালের বিচার কার্যক্রমকে প্রশ্নবিদ্ধ করে এই বিচার বন্ধ করার প্রস্তাব দিয়েছিল তুরস্কের সরকার। ফলে তুরস্ক তো জামায়াতের আদর্শ উদাহরণ হবেই। সেই পথেই তারা এগিয়ে যাচ্ছে এবং হেফাজতে ইসলাম ব্যানারের আড়ালে নতুনভাবে সংগঠিত হতে চাচ্ছে।

হেফাজতে ইসলাম + জামায়াতে ইসলামী = হেফাজতে জামায়াতে ইসলামী

জামায়াতে ইসলামী ও হেফাজতে ইসলাম যে একই মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ এটা তাদের কর্মকা-ের মাধ্যমেও বোঝা যায়।
শাহবাগ আন্দোলন শুরুর সঙ্গে সঙ্গে এটাকে নাস্তিকদের আন্দোলন বলে মিথ্যা প্রচারণা চালিয়েছিল জামায়াত-শিবির। তারা ব্লগার রাজীব হায়দারকে হত্যা পর্যন্ত করেছে। ধর্মভীরু মানুষদের মাঝে তারা প্রচারণা চালিয়েছে যে, শাহবাগে সবাই নাস্তিক, ওখানে বেলেল্লাপনা হয়, ওরা ‘বিজাতীয় সংস্কৃতি’র ধারকবাহক। এই প্রচারণা দিয়ে এখনো সারাদেশে তা-ব চালিয়ে যাচ্ছে জামায়াত-শিবির। এদিকে ধুম করে দৃশ্যপটে হাজির হওয়া এবং সবাইকে ভীতসন্ত্রস্ত করে তোলা হেফাজতে ইসলামের দাবিগুলোও কিন্তু একই রকম। জামায়াত-শিবিরও মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্য, শহীদ মিনার, মন্দিরে মূর্তি ভাঙ্গছে, আগুন দিচ্ছে। হেফাজতে ইসলামীও তাদের মতো করে মূর্তি-ভাস্কর্য স্থাপনের বিরোধীতা করছে।
হেফাজতে ইসলামের ১৩ দফা দাবি দেখলেই বোঝা যায় যে তারা কেমন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করতে চায়। এগুলো মধ্যে কয়েকটি হলো: ব্যক্তি ও বাক-স্বাধীনতার নামে সকল বেহায়াপনা, অনাচার, ব্যভিচার, প্রকাশ্যে নারী-পুরুষের অবাধ বিচরণ, মোমবাতি প্রজ্বলনসহ সকল বিজাতীয় সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ বন্ধ করতে হবে, মসজিদের নগরী ঢাকাকে মূর্তির নগরীতে রূপান্তর এবং দেশব্যাপী রাস্তার মোড়ে ও কলেজ-ভার্সিটিতে ভাস্কর্যের নামে মূর্তি স্থাপন বন্ধ করতে হবে, পার্বত্য চট্টগ্রামসহ দেশব্যাপী ইসলাম বিরোধী কর্মকা-ে জড়িত এনজিও এবং খ্রিস্টান মিশনারীদের ধর্মান্তকরণসহ সকল অপ-তৎপরতা বন্ধ করতে হবে, কথিত শাহবাগী আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী স্বঘোষিত নাস্তিক-মুরতাদ এবং প্রিয় নবী (সা.)-র শানে জঘন্য কুৎসা রটনাকারী কুলাঙ্গার ব্লগার ও ইসলাম বিদ্বেষীদের সকল অপপ্রচার বন্ধসহ কঠোর শাস্তিদানের ব্যবস্থা করতে হবে ইত্যাদি ইত্যাদি।
এ কেমন বাংলাদেশ বানানোর দাবি জানাচ্ছে হেফাজতে ইসলাম? এটা কি বাংলাদেশকে পাকিস্তান বা আফগানিস্তান বানানোরই রুপকল্প না? এই দাবি বাস্তবায়ন হলে নারী-পুরুষ অবাধে মেলামেশা করতে পারবে না। মূর্তি-ভাস্কর্য স্থাপন করা যাবে না। মোমবাতি প্রজ্জলন এদের কাছে বিজাতীয় সংস্কৃতি। হেফাজতে ইসলামের কল্পিত বাংলাদেশে সবাইকেই এক অর্থে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে হবে। আর যদি অন্য ধর্মাবলম্বী কেউ থাকেও তাহলে তারা নিজেদের আচার পালন করতে পারবেন না। এবং এই মুসলিমটাও হতে হবে তাদের তরিকা অনুযায়ী। কারণ তারা কাদিয়ানীদেরও অমুসলিম ঘোষণা করেছে। হেফাজতে ইসলাম যে বাংলাদেশ কায়েম করতে চায় সেটা হবে চরম আকারের সাম্প্রদায়িক, রক্ষণশীল,  গুমোট একটা পরিবেশ। সেখানে কারও স্বাধীন মত প্রকাশের স্বাধীনতা থাকবে না, গণতান্ত্রিক চর্চার সুযোগ থাকবে না। ৪২ বছর আগে মুক্তিযোদ্ধারা জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করেছিলেন কি এই বাংলাদেশের জন্য?

হেফাজতে ইসলাম কেন ইসলামী নিদর্শন ধ্বংস নিয়ে কোন কথা বলে না?

হেফাজতে ইসলাম কতিপয় কিছু কথিত নাস্তিক ব্লগারদের পেছনে লেগেছে। কিন্তু যখন সৌদি আরবে মহানবী হজরত মোহাম্মদ (সাঃ) এর সময়কার, তাঁর স্মৃতিবিজরিত মসজিদসহ অন্যান্য স্থাপনা ভেঙ্গে ফেলা হয় তখন কোথায় থাকেন হেফাজতে ইসলামের লোকজনেরা? সেটাকে তাহলে তারা ইসলামের কোন ক্ষতি বলে মনে করছে না? মহানবীকে নিয়ে কটুক্তি করলে ব্লগার গ্রেপ্তার আর মহানবীর নিদর্শন, যেখানে মহানবী নামাজ পড়েছেন, সেই মসজিদ ভেঙ্গে দিলে কোন সমস্যা নেই?

Macca

বাংলাদেশেও খুবই প্রাচীন একটা মসজিদের সন্ধান পাওয়া গেছে রংপুরের রামজাপুর গ্রামে। ধারণা করা হচ্ছে এটা দক্ষিণ এশিয়ারই প্রথম মসজিদ হতে পারে। কিন্তু সেখানকার গুরুত্বপূর্ণ প্রতœতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলো সরকারী অবহেলায় নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। সে ব্যাপারে হেফাজতে ইসলামের কোন কথাবার্তা নেই কেন? তাহলে এটা কি খুবই পরিস্কার না যে, হেফাজতে ইসলাম আসলে কী হেফাজত করতে চাচ্ছে? তারা প্রকৃতঅর্থেই জামায়াতের হেফাজতকারী। যুদ্ধাপরাধীদের হেফাজতকারী। এদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর সময় এখনই।

আওয়ামী লিগ সরকারের ডিগবাজি

১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত ধর্মের নামে পাকিস্তানী ঔপনিবেশিক শাসকরা এই বাংলাদেশ ভূখ-ের মানুষদের শোষণ করেছিল, নির্যাতন-নিপীড়ণ চালিয়েছিল, খুন-ধর্ষণ করেছিল। সেই অভিজ্ঞতা থেকেই সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে যখন সংবিধান রচিত হয় তখন রাষ্ট্র পরিচালনার চারটি মূলনীতির মধ্যে স্থান দেওয়া হয় ধর্মনিরপেক্ষতাকে। কিন্তু অবাক করে দেওয়ার মতো বিষয় হলো, যে আওয়ামী লিগের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়েছিল, যে আওয়ামী লিগ ১৯৭২ সালে প্রথম সংবিধানটি রচনা করেছিল সেই আওয়ামী লিগই ৪২ বছর পর নতজানু হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধী হেফাজতে ইসলামের কাছে। সরকার নাকি জামায়াতের লেবেলধারী হেফাজতে ইসলামের বেশ কিছু দাবি আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে মেনে নিতে যাচ্ছে। কিছুতেই বোঝা যায় না যে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা হয়ে বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কিভাবে হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে আপোষ করতে পারেন। জয় বাংলার পরে জয় বঙ্গবন্ধু না বললে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ঠিকমতো প্রতিষ্ঠিত হয় না বলে মনে করেন অনেক আওয়ামী লিগার। কিন্তু এখন তো আপনারা বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলার স্বপ্নের বিপরীতেই হাঁটছেন। এ কেমন স্ববিরোধীতা?
হেফাজতে ইসলামের কাছে সরকার যেন নিজের মাথাটাই পেতে দিয়েছে। অত্যন্ত অন্যায়ভাবে গ্রেফতার করা হয়েছে তিনজন ব্লগারকে। তাঁরা কি অবমাননা করেছেন, কিভাবে অবমাননা করেছেন সেগুলো এখনো কারো কাছে স্পষ্ট না। ব্লগ-ব্লগার বলতে হেফাজতে ইসলামই বা কি বোঝেন আর সরকারই বা কি বোঝেন সেটা নিয়েও যথেষ্ট সন্দেহ আছে। সরকার আমারব্লগ বন্ধ করে দিয়েছে। হেফাজতে ইসলামের কথা বাদ দিলাম, ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়তে চাওয়া সরকার কি জানে যে ব্লগগুলোতে শুধু ঐ দুই-তিনজনই লেখেন না। আরও অনেকেই লেখেন। শুধু ধর্ম নিয়েই না, সেখানে রাজনীতি-অর্থনীতি-সমাজ নিয়েও আরও অনেক লেখা ছিল? সেগুলো তাহলে আমরা কিভাবে পড়ব? স্বাধীন মতপ্রকাশের পথ এভাবে কেন বন্ধ করা হবে?
দেশ পরিচালনায় নিযুক্ত ব্যক্তিবর্গ, আপনারা কিভাবে ভুলে যান যে, জামায়াতে ইসলাম ১৯৭১ সালে কিভাবে এদেশের সূর্য্যসন্তানদের হত্যা করেছে। এই একই ধর্মের দোহাই তুলে। ৪২ বছর পরে এবারও স্বাধীনতাবিরোধী গোষ্ঠী সেই একই কায়দায় রুদ্ধ করতে চাইছে এদেশের মুক্ত চিন্তা-স্বাধীন মতপ্রকাশের পথ। আর সরকার মহোদয়রা সেই কাজেই আরও সহায়তা করছেন। এর চেয়ে দুঃখজনক আর কি হতে পারে? বিএনপি যদি এই কাজটা করত তাহলে এটাকে দুঃখজনক বলে আখ্যায়িত করার প্রয়োজন পড়ত না। কারণ তারা তো সেটা করবেই, ঐতিহাসিকভাবে তারা এটা করে এসেছে। এখনো তারা হেফাজতে ইসলামের প্রতি, প্রকারান্তরে জামায়াত শিবিরের প্রতি নৈতিক সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আওয়ামী লিগ? তারা না মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি? এই আওয়ামী লিগই না ১৯৭২ সালে ‘গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতাকে মূল নীতি করে সংবিধান রচনা করেছিল?’ মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকার-চেতনা সব কি ভেসে গেল ভোটের চিন্তায়? পক্ষ নিন সরকার- মানবতা না মুনাফা?

নতজানু আর নয়

শাহবাগ আন্দোলনের শুরুর দিকে অনেকেই ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করে, ১৯৭২ সালের সংবিধান অনুযায়ী ধর্মনিরপেক্ষতার পথে হাঁটার আওয়াজ তুলেছিলেন। সেসময় কৌশলগত কারণে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি বাদ দিয়ে শুধু জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধের দাবিতে সরে আসা হয়েছিল। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে এতে জামায়াত-শিবিরের কর্ম-পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করার পথ প্রসারিত হয়েছে। নিষিদ্ধ হয়ে যাবে বুঝতে পেরেই তারা হেফাজতে ইসলামের ব্যানারে সংগঠিত হচ্ছে। ফলে জামায়াত-শিবিরকে শুধু নিষিদ্ধ করলেই হবে না। নিষিদ্ধ করতে হবে তাদের রক্ষণশীল-সাম্প্রদায়িক মতাদর্শকেও। যেমনটা করা হয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর হিটলারের নাৎসি পার্টিকে। এমনভাবে তাদেরকে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল যে এখনও, ৬২ বছর পরে নাৎসি ভঙ্গিতে স্যালুট দেওয়ার দায়ে আজীবনের জন্য নিষিদ্ধ করা হয় প্রতিভাবান তরুণ ফুটবলারকে। এইরকম কঠোরভাবেই বন্ধ করে দিতে হবে জামায়াত-শিবিরের এখানে সেখানে গজিয়ে ওঠার পথ। তাহলেই কেবল একটি অসাম্প্রদায়িক, মানবিকতার সমাজের পথে অগ্রসর হওয়া সম্ভব বাংলাদেশের পক্ষে। যেমন বাংলাদেশের স্বপ্ন বুকে নিয়ে মুক্তির সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন পুরো দেশের স্বাধীনতাকামী মানুষ। ফলে শাহবাগ চত্বরে দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছে, একথা যদি স্বীকার করে নিই, তাহলে বিজয় অর্জন করতে গেলে সেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নের পথেই হাঁটতে হবে শাহবাগ আন্দোলনকে। ষ্পষ্টভাবে বলতে হবে, ৭১ এ স্বাধীনতাবিরোধী গোষ্ঠী যে আদর্শ-মতবাদের প্রেক্ষিতে রাজনীতি করছে, স্বাধীন বাংলাদেশে সেই মতাদর্শ বাস্তবায়নের কোন অধিকার থাকতে পারবে না। সাংবিধানিকভাবে তাদের রাজনৈতিক অধিকার বিলোপ করতে হবে।

কিভাবে হবে সাংস্কৃতিক আন্দোলন?

Shahbag Square protest reaches Day 9

গণজাগরণের ঢেউ দেশের প্রতিটি প্রান্তে ছড়িয়ে দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ইমরান এইচ সরকার। ছয় দফা দাবি আদায়ের পর দেশজুড়ে একটা সাংস্কৃতিক আন্দোলন পরিচালনার পরিকল্পনাও গণজাগরণ মঞ্চের সংগঠকদের আছে বলে জানিয়েছেন তিনি। বিডিনিউজকে দেওয়া এক সাক্ষাত্কারে তিনি বলেছেন, ‘সবাই আমাদের ছয় দফা দাবি সম্পর্কে জানেন। এগুলো পূরণ হয়ে গেলে আমরা দেশজুড়ে একটি সাংস্কৃতিক আন্দোলন পরিচালনার কথা ভাবছি, যার মূল লক্ষ্য হবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সারা দেশে ছড়িয়ে দেয়া। এতে করে আমাদের দেশের রাজনীতি থেকে ময়লাগুলো সব ধুয়ে যাবে।’ নিঃসন্দেহে খুবই ভালো ও প্রশংসনীয় উদ্যোগ। সাংস্কৃতিক প্রচার চালানো অবশ্যই জরুরি। পুরো দেশের মানুষের কাছে শাহবাগের গণজাগরণ বার্তা সঠিকভাবে পৌঁছে দেওয়াটার উপরই আসলে নির্ভর করছে নতুন প্রজন্মের এই মুক্তিযুদ্ধের সাফল্য। কিন্তু এই কাজটা করা হবে কিভাবে?

যদি বিষয়টা এমন হয় যে, একেক দিন একেকটা শহরে শুধু একটা করে মহাসমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে, তাহলে কার্যকরী কোন প্রভাব ফেলা যাবে কি না, সে বিষয়ে সন্দেহ আছে। হয়তো ঐ দিনটাতে একটা শহরে একটু উত্তাপ-উত্তেজনা ছড়াবে, মানুষ কৌতুহল নিয়ে দেখতে আসবে, খুব বেশি হলে আরও কিছুদিন এলাকা সরগরম থাকবে। কিন্তু এই প্রক্রিয়ায় পুরো দেশে বিরাজমান সাংস্কৃতিক-শিক্ষাগত বৈষম্য/ব্যবধান দূর করা যাবে না। মানুষের মনোজগতে কার্যকরী প্রভাব ফেলতে গেলে হয়তো আরও জনসম্পৃক্ততামূলক পদ্ধতির কথা ভাবতে হবে শাহবাগ চত্বরকে। মানুষের মনে দীর্ঘদিন ধরে জমে থাকা অনেক সন্দেহ-সংশয়, বিভ্রান্তি দূর করার কাজটা সহজ না।

আজকে আমরা শিবিরের পেজগুলোকে এখন এত প্রকটভাবে উন্মোচিত হতে দেখছি। ছাগুদের কীর্তি-কারবার নিয়ে হাসাহাসি করছি, এগুলোর বিরুদ্ধে সাইবার যুদ্ধ করছি। কিন্তু এগুলো ক্রিয়াশীল ছিল তো অনেকদিন ধরে। এবং সরকারের নিরন্তর সমালোচনা করে তারা সত্যিই জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। সেইসব সমালোচনার পেছনে যে এই জামায়াত-শিবির আছে, সেটা আমরা খেয়ালই করে দেখিনি। কারণ সমালোচনা করার যৌক্তিক কারণ ছিল। পদ্মা সেতু কেলেঙ্কারির পর যদি কোন পেজ থেকে আবুল হোসেনের একটি কেরিকেচার-যুক্ত ছবি পোস্ট করা হতো, তাহলে কি কেউ বুঝতে পারতেন যে, সেটা জামায়াত-শিবিরের পেজ? সেইরকম সমালোচনা তো অনেকেরই ছিল সরকারকে নিয়ে। ফলে সরকার-আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগের কুকীর্তিকে পুঁজি করেই কিন্তু এতদিন ধরে অনেকের “লাইক” পেয়ে এসেছে এই ‘বাঁশের কেল্লা’গুলো। এটা তো শুধু ফেসবুকের কথা হলো। এর বাইরেও গ্রামে-বন্দরে, হাটে-বাজারে-শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে-সর্বত্রই নানাবিধ প্রচারণা চালিয়ে এসেছে, সরকার বা আওয়ামী লিগের বিরুদ্ধে। এবং সেগুলো এখনকার মতো মিথ্যা প্রচারণা দিয়েও করতে হয়নি। সরকার, তাদের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ যেভাবে গত চার বছর ধরে নানাবিধ দুর্নীতি-স্বেচ্ছাচারীতা চালিয়ে গেছে, তাতে তাদের উপরে মানুষের আস্থা প্রায় তলানিতে নেমে এসেছিল। সেগুলোর প্রভাব তো হুট করে চলে যাবে না। জামায়াত-শিবির মানুষের ভেতরে এতদিন ধরে যে প্রচারণা চালিয়েছে এবং তারা যে দীর্ঘদিন ধরে মানুষের সমর্থন আদায় করার কাজটা করে গেছে, জনসমাজে সেটার প্রভাব এক-দুইটা মহাসমাবেশ করে উড়িয়ে দেওয়া কি সম্ভব?

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করার সুবাদে খুব কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্য হয়েছে যে, শিবির কিভাবে পরিচালিত হয়, কিভাবে তারা সাধারণ শিক্ষার্থীদের আস্থা অর্জন করে। কিভাবে তারা একজন ছাত্রকে সংগঠনটির উপর নির্ভরশীল করে ফেলে। শিবিরের স্বর্ণযুগে, ভর্তিপরীক্ষার আগ দিয়ে প্রতিটা হলে ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীদের থাকার ব্যবস্থা করত ছাত্রশিবির। সেখানে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে অতি ভালো ব্যবহার করা হতো। এরপর যারা যারা ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়, তাদেরকে সেই সুখবরটা জানানোর কাজটিও করতেন ছাত্রশিবিরের নেতা-কর্মীরা। একজন গরীব বা অস্বচ্ছল শিক্ষার্থীর হলে থাকার ব্যবস্থা, প্রয়োজনে খাবার খরচটিও বহন করে সংগঠনটি। অনেক মেধাবী শিক্ষার্থীর সঙ্গে গড়ে তোলে পারিবারিক সম্পর্ক। তাদের পড়াশোনার ক্ষেত্রে সার্বক্ষণিক সহযোগিতাও করে শিবিরের নেতারা। এবং কখনোই তাদেরকে মিছিল-মিটিং-মারামারির ভেতরে ঢোকানো হয় না। ফলে এই রকম অনেক শিক্ষার্থী কৃতজ্ঞতাবশই শিবিরের প্রতি সমর্থন জানান। ক্যাডারদের জন্যও থাকে আলাদা ব্যবস্থা। সেটার ব্যবস্থাপনার পদ্ধতি অন্য ধরণের। এভাবে খুবই সুশৃঙ্খলভাবে পরিচালিত হয় ছাত্রশিবির। ভালো ফলাফল করে পাস করা শিক্ষার্থীদের চাকরির ব্যবস্থাও অনেকাংশে করে দেওয়া হয় ছাত্রশিবিরের পক্ষ থেকে। এভাবেই তারা ছড়িয়ে পড়ে পেশাগত জায়গায়। প্রভাব বিস্তার করে সমাজের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলোতে। দীর্ঘদিনের সুসংগঠিত কর্মতত্পরতা আর প্রচারণার মাধ্যমে জনমানসে শক্ত খুঁটি গেড়েছে জামায়াত-শিবির।

এবং তাদেরকে সাংস্কৃতিকভাবে মোকাবিলা করার মতো কার্যকর তত্পরতা কিন্তু এতদিন ধরে প্রগতিশীলদের দিক থেকে তেমনভাবে ছিল না। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সহিংস-বল প্রয়োগের মাধ্যমে ছাত্রশিবিরকে ক্যাম্পাস থেকে উত্খাত করা গিয়েছে বলে দাবি করা হয়। কিন্তু সফলতা কতখানি আর এই সহিংস বলপ্রয়োগের পথ বেছে নেওয়ার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কি হয় সেটা এখনকার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে তাকালেই সবাই দেখতে পারবেন। বিগত চার বছরে ছাত্রশিবিরকে রুখার নামে ছাত্রলীগকে দেওয়া হয়েছিল অবাধ স্বাধীনতা। আব্দুস সোবহান প্রশাসনের শেষসময়ে সেই ছাত্রলীগই ফ্রাঙ্কেনস্টাইন হয়ে চড়াও হয়েছে প্রশাসনের উপর। নিয়োগ বাণিজ্যে অসন্তুষ্ট হয়ে প্রশাসন ভবনে ভাঙচুর করেছে সরকারদলীয় ছাত্রসংগঠনের কিছু নেতা-কর্মী। আর উপাচার্য,-উপ-উপাচার্যবিহীন অবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে পড়েছে অভিভাবকহীন। পরিহাসের কথাটি হচ্ছে, এই অভিভাবকত্বহীনতার সুযোগ নিয়ে নাকি এখন ছাত্রশিবির ক্যাম্পাসে গোলযোগ তৈরি করতে পারে। শেষ শিক্ষক সমিতির নির্বাচনে সভাপতির পদটিও হারিয়েছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসীরা। তাহলে কী প্রতিরোধ করলেন উনারা এতদিন? আমার ধারণা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বিগত ৪টি বছর থেকে শিক্ষা নিতে পারে এখনকার শাহবাগ আন্দোলন। দুই ক্ষেত্রেই ইস্যুটা একই। জামায়াত-শিবির প্রতিরোধ। গত চার বছর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার পূর্ণ স্বাধীনতা পেয়েও শিবির উত্খাত করতে পারেনি ছাত্রলীগ ও প্রশাসন। তাদের তো পূর্ণ ইচ্ছা ছিল বিশ্ববিদ্যালয়কে শিবির মুক্ত করা। কেন পারলো না? তাহলে কী পদ্ধতিতে কোন ভুল ছিল? আমার ধারণা এই দিকটি ভাবার দাবি রাখে।

শত্রুপক্ষের প্রচারণা নিয়ে শুধু হাসাহাসি করলেই তো সমস্যার সমাধান হবে না, সেগুলো মোকাবিলার জন্য কার্যকর কি পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে, সেই কথাটা ভাবতে হবে। আর এখন যেভাবে র্যাব-পুলিশ দিয়ে সহিংসভাবে জামায়াত-শিবির রুখার বা জনসাধারণকে নিরাপত্তা দেওয়ার ব্যবস্থা করা হচ্ছে, সেটা কোন সমাধান না। ব্লগার রাজীব খুন হওয়ার পর যেমন আমরা শ্লোগান দেই যে, ‘এক রাজীব লোকান্তরে, লক্ষ্য রাজীব ঘরে ঘরে’। তেমনি তারাও ‘শহীদ’দের লাশ দেখিয়ে জেহাদে ঝাঁপিয়ে পড়তে অনুপ্রাণিত করে অন্য দশজন তরুণকে। পিঠ একদম দেওয়ালে ঠেকে যাওয়ার পর, আর কোন উপায়ান্তর না দেখলে হয়তো এই তরুণদের মধ্যেই কেউ কেউ হয়ে উঠতে পারে আত্মঘাতি বোমাবাহক। তেমন পরিস্থিতি কি তাহলে আরও খারাপ হবে না?

Somabesh

গতকাল ছিল ঐতিহাসিক ৭ই মার্চ। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ক্ষুদে যোদ্ধা অপূর্ব’র বেশে সত্যিই যেন ফিরে এসেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁর ৭ই মার্চের ভাষণটি হুবহু অনুকরণ করে অজস্র মানুষকে আবারও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অনুপ্রাণিত করেছেন অপূর্ব। আবারও মুষ্ঠিবদ্ধ হাতের ঐক্যবদ্ধতায় উচ্চারিত হয়েছে মুক্তির সংগ্রাম করার অঙ্গীকার। সত্যিই আজ আমরা আবার রাজাকার-যুদ্ধাপরাধীমুক্ত স্বাধীন ‘সোনার বাংলা’ গড়ার দৃঢ় শপথ নিয়েছি। কিন্তু প্রতিপক্ষকে মোকাবিলা করব কিভাবে, কোন পদ্ধতিতে, সেটাও আমাদের ভাবতে হবে। জামায়াত-শিবিরের গোড়া কোন পর্যন্ত বিস্তৃত, এবং এটা কেন বিস্তৃত হতে পেরেছে সেটাই আমাদের সবার আগে ভাবা উচিত্। গ্রাম-গঞ্জের, জেলা-উপজেলার সাধারণ মানুষের কাছে গণজাগরণের বার্তা সত্যিই পৌঁছে দিতে চাইলে আপামর জনসাধারণের মনে জমে থাকা অনেক অনেক প্রশ্ন, সন্দেহ-সংশয়ের সঠিক জবাব দিতে পারতে হবে শাহবাগ আন্দোলনের সংগঠকদের। শুধু জবাব না, অনেক অনেক প্রশ্নের কথাই আগে ভাবতে হবে।