অবিশ্বাস্য এক জয়!

অবিশ্বাস্য এক জয় উদযাপন করছেন জিম্বাবুয়ের ইতিহাস গড়া ক্রিকেটাররা।
‘তোমাদের মতো আনাড়িদের সঙ্গে খেলার এটাই সমস্যা। তোমরা জানো না, কীভাবে সিঙ্গেল নিয়ে ধীরে ধীরে খেলতে হয়, বিরতির পরে আমাদের পেশাদার ব্যাটসম্যানদের খেলাটা দেখো। তারা শুধু ফাঁকায় বল ফেলবে, এক-দুই করে রান নেবে। আর খেলাটা জিতে নেবে খুবই সহজে।’ ১৯৯২ বিশ্বকাপে জিম্বাবুয়ের অধিনায়ক ডেভ হজসনের উদ্দেশে খুবই অবজ্ঞাভরে এ কথাগুলো বলেছিলেন সাবেক ইংলিশ ক্রিকেটার জিওফ্রে বয়কট। সময়টা ছিল সেমিফাইনালের আগে গ্রুপ পর্বে নিজেদের শেষ ম্যাচের মধ্যাহ্ন বিরতিতে। বলাটাও যৌক্তিক! কারণ সেই ম্যাচে সেবারের ফাইনালিস্ট ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ‘চুনোপুঁটি’ জিম্বাবুয়ে গুটিয়ে গিয়েছিল মাত্র ১৩৪ রানে। কিন্তু কারোরই তো এটা কল্পনাতেই আসেনি যে, শেষ পর্যন্ত কী নিদারুণভাবে লুটিয়ে পড়তে যাচ্ছে এই দম্ভ।
১৯৯২ সালের অন্যতম ফেভারিট ছিল ইংল্যান্ড। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ম্যাচটার আগে শেষ ছয়টি ম্যাচের পাঁচটিতেই তারা জিতেছিল দুর্দান্ত দাপট দেখিয়ে। অন্যদিকে তখনো টেস্ট পরিবারের বাইরের দেশ জিম্বাবুয়ে সবকটিতেই হেরেছিল খুব শোচনীয়ভাবে। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে তাই অন্য কিছু ঘটবে এটা ভাবার মতো কোনো পরিস্থিতিই ছিল না। কিন্তু এই চুনোপুঁটি জিম্বাবুয়েই সেদিন প্রমাণ করেছিল, ক্রিকেট একটা অনিশ্চয়তার খেলা। এখানে অনেক কিছু অনুমান করা গেলেও শেষ পর্যন্ত ফলাফল কী দাঁড়াবে, সেটা কিছুতেই বলা যায় না।
১৮ মার্চ। ল্যাভিংটন স্পোর্টস ওভাল স্টেডিয়ামে টসে জিতে প্রথমে ফিল্ডিং করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন ইংলিশ অধিনায়ক গ্রাহাম গুচ। ব্যাট করতে নেমে ইয়ান বোথাম, রিচার্ড ইলিংওর্থদের দুর্দান্ত বোলিংয়ের সামনে শুরুতেই চাপের মুখে পড়ে যান জিম্বাবুয়ের ব্যাটসম্যানরা। নিয়মিত বিরতিতে উইকেট পতনের মধ্য দিয়ে জিম্বাবুয়ের সংগ্রহ দাঁড়ায় ৬ উইকেটে ৭৭ রান। অনেকক্ষণ লড়াই চালিয়ে শেষ পর্যন্ত ২৯ রান করে সাজঘরে ফিরে যান অধিনায়ক ডেভ হজসন। ২৯ রানের এই ‘ক্ষুদ্র’ ইনিংসটা তিনি খেলেছিলেন ৭২ বলে। আর এটাই ছিল জিম্বাবুয়ের পক্ষে সর্বোচ্চ রান। শেষ পর্যন্ত অষ্টম উইকেটে বুচার্ট আর ব্রান্ডেসের ৩১ রানের জুটিটা জিম্বাবুয়েকে এনে দেয় ১৩৪ রানের ‘লড়িয়ে’ সংগ্রহ!
ভয়াবহ এই ব্যাটিং বিপর্যয়ের পর জিম্বাবুয়ের ক্রিকেটাররা বোধহয় আরও একটা শোচনীয় হার বরণ করে নেওয়ারই প্রহর গুনতে শুরু করেছিলেন। কিন্তু মধ্যাহ্ন বিরতিতে বয়কটের কাছ থেকে অবজ্ঞাসূচক ‘উপদেশবাণী’ শুনে কিছুটা যেন রোখ চেপে গিয়েছিল হজসনের। জেতার জন্য মাঠে নামবেন, এতটা হয়তো কল্পনা করতে পারেননি। কিন্তু কিছু একটা যে করে দেখাতে হবে, সে ব্যাপারে ছিলেন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। মধ্যাহ্ন বিরতি শেষে মাঠে নামার আগে সতীর্থদের উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘মাঠে প্রায় আট হাজার দর্শক খেলা দেখতে এসেছে। আর তারা এখনো কিছু আনন্দময়-উত্তেজনাপূর্ণ পরিস্থিতি দেখতে চায়। আর আমরা শুধু একটা উপায়েই তাদের এই বিনোদনটা দিতে পারি। আমাদের চেষ্টা করতে হবে খেলাটা যতদূর সম্ভব চালিয়ে যাওয়ার।’
হজসনের এই কথা বোধহয় সত্যিই অনুপ্রাণিত করেছিল জিম্বাবুয়ের ক্রিকেটারদের। বিশেষত ব্রান্ডেসকে। জিম্বাবুয়ের এই ফাস্ট বোলারের দুর্দান্ত বোলিংয়ের মুখে খুব দ্রুতই খেই হারিয়ে ফেলেছিলেন ইংলিশ ব্যাটসম্যানরা। অধিনায়ক গ্রাহাম গুচ ইনিংসের প্রথম বলেই ফিরেছিলেন সাজঘরে। এরপর একে একে ব্রান্ডেসের শিকারে পরিণত হন অ্যালান ল্যাম্ব, রবিন স্মিথ ও গ্রায়েম হিক। ১০ ওভার বল করে মাত্র ২১ রান দিয়েই তিনি নিয়েছিলেন এই চারটি উইকেট। মাত্র ৪৩ রানেই পাঁচটি উইকেট তুলে নিয়ে অবিশ্বাস্য কিছু করার আশা জেগে উঠতে শুরু করেছিল জিম্বাবুইয়ান শিবিরে। কিন্তু ষষ্ঠ উইকেটে ৫২ রানের পার্টনারশিপ গড়ে সেই স্বপ্ন-পূরণের পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন অ্যালেক স্টুয়ার্ট ও নেইল ফেয়ারব্রাদার।
৯৫ রানের মাথায় স্টুয়ার্টকে সাজঘরে ফিরিয়ে আবারও আশার সঞ্চার করেন ওমর শাহ। এরপর অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই ফিল ডিফ্রেইটাস আর ফেয়ারব্রাদারের উইকেট তুলে নিয়ে অসম্ভবকে সম্ভব করার পথে জিম্বাবুয়েকে আরও একধাপ এগিয়ে নেন ইয়ান বুচার্ট। ভাগ্যদেবীও সেদিন পুরোপুরিই ছিল জিম্বাবুয়ের দিকে। কারণ নবম উইকেটে আবার ১৬ রানের জুটি গড়ে ম্যাচটা জেতার কিছুটা এগিয়ে যেতেই রানআউটের ফাঁদে পড়েন ইলিংওর্থ। ইংলিশদের স্কোর দাঁড়ায় ৯ উইকেটে ১২৪ রান। শেষ ওভারে দরকার নয় রান। আর অবিশ্বাস্য এক জয় উদ্যাপনের জন্য জিম্বাবুয়ের দরকার এক উইকেট। বল হাতে দৌড় শুরু করার আগে জিম্বাবুয়ান পেসার ম্যালকম জারভিসকে শুধু একটা কথাই বলেছিলেন অধিনায়ক হজসন। ‘কোনো কিছু না ভেবে শুধু ঠিক লাইন-লেন্থে বল করে যাও।’ অধিনায়কের কথা রেখেছিলেন জারভিস। প্রথম বলেই বাজিমাত। ইংল্যান্ডের শেষ ব্যাটসম্যান গ্লাডস্টোন স্মল ধরা পড়লেন অ্যান্ডি পাইক্রফটের হাতে। জিম্বাবুয়ে পেল ৯ রানের ইতিহাস গড়া, অবিশ্বাস্য, কল্পনাতীত এক জয়। আর শেষ পর্যন্ত এই জয়টাই খুলে দিয়েছিল তাদের টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার দ্বার।
একটা কথা জানতে ইচ্ছা হতেই পারে। ম্যাচ শেষে জিম্বাবুয়ের অধিনায়ক ডেভ হজসন কি কৃতজ্ঞতাবশত ‘মহান পথপ্রদর্শক’ জিওফ্রে বয়কটের সঙ্গে আর দেখা করেননি? আসলে হজসন সেই সুযোগটাই পাননি। কারণ খেলা শেষ হতেই বিড়ালের মতো নিঃশব্দে স্টেডিয়াম ছেড়েছিলেন সাবেক এই ইংলিশ ক্রিকেটার!