Posts Tagged ‘ ভাগ্যদেবী ’

অবিশ্বাস্য এক জয়!

অবিশ্বাস্য এক জয় উদযাপন করছেন জিম্বাবুয়ের ইতিহাস গড়া ক্রিকেটাররা।

‘তোমাদের মতো আনাড়িদের সঙ্গে খেলার এটাই সমস্যা। তোমরা জানো না, কীভাবে সিঙ্গেল নিয়ে ধীরে ধীরে খেলতে হয়, বিরতির পরে আমাদের পেশাদার ব্যাটসম্যানদের খেলাটা দেখো। তারা শুধু ফাঁকায় বল ফেলবে, এক-দুই করে রান নেবে। আর খেলাটা জিতে নেবে খুবই সহজে।’ ১৯৯২ বিশ্বকাপে জিম্বাবুয়ের অধিনায়ক ডেভ হজসনের উদ্দেশে খুবই অবজ্ঞাভরে এ কথাগুলো বলেছিলেন সাবেক ইংলিশ ক্রিকেটার জিওফ্রে বয়কট। সময়টা ছিল সেমিফাইনালের আগে গ্রুপ পর্বে নিজেদের শেষ ম্যাচের মধ্যাহ্ন বিরতিতে। বলাটাও যৌক্তিক! কারণ সেই ম্যাচে সেবারের ফাইনালিস্ট ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ‘চুনোপুঁটি’ জিম্বাবুয়ে গুটিয়ে গিয়েছিল মাত্র ১৩৪ রানে। কিন্তু কারোরই তো এটা কল্পনাতেই আসেনি যে, শেষ পর্যন্ত কী নিদারুণভাবে লুটিয়ে পড়তে যাচ্ছে এই দম্ভ।

১৯৯২ সালের অন্যতম ফেভারিট ছিল ইংল্যান্ড। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ম্যাচটার আগে শেষ ছয়টি ম্যাচের পাঁচটিতেই তারা জিতেছিল দুর্দান্ত দাপট দেখিয়ে। অন্যদিকে তখনো টেস্ট পরিবারের বাইরের দেশ জিম্বাবুয়ে সবকটিতেই হেরেছিল খুব শোচনীয়ভাবে। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে তাই অন্য কিছু ঘটবে এটা ভাবার মতো কোনো পরিস্থিতিই ছিল না। কিন্তু এই চুনোপুঁটি জিম্বাবুয়েই সেদিন প্রমাণ করেছিল, ক্রিকেট একটা অনিশ্চয়তার খেলা। এখানে অনেক কিছু অনুমান করা গেলেও শেষ পর্যন্ত ফলাফল কী দাঁড়াবে, সেটা কিছুতেই বলা যায় না।

১৮ মার্চ। ল্যাভিংটন স্পোর্টস ওভাল স্টেডিয়ামে টসে জিতে প্রথমে ফিল্ডিং করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন ইংলিশ অধিনায়ক গ্রাহাম গুচ। ব্যাট করতে নেমে ইয়ান বোথাম, রিচার্ড ইলিংওর্থদের দুর্দান্ত বোলিংয়ের সামনে শুরুতেই চাপের মুখে পড়ে যান জিম্বাবুয়ের ব্যাটসম্যানরা। নিয়মিত বিরতিতে উইকেট পতনের মধ্য দিয়ে জিম্বাবুয়ের সংগ্রহ দাঁড়ায় ৬ উইকেটে ৭৭ রান। অনেকক্ষণ লড়াই চালিয়ে শেষ পর্যন্ত ২৯ রান করে সাজঘরে ফিরে যান অধিনায়ক ডেভ হজসন। ২৯ রানের এই ‘ক্ষুদ্র’ ইনিংসটা তিনি খেলেছিলেন ৭২ বলে। আর এটাই ছিল জিম্বাবুয়ের পক্ষে সর্বোচ্চ রান। শেষ পর্যন্ত অষ্টম উইকেটে বুচার্ট আর ব্রান্ডেসের ৩১ রানের জুটিটা জিম্বাবুয়েকে এনে দেয় ১৩৪ রানের ‘লড়িয়ে’ সংগ্রহ!

ভয়াবহ এই ব্যাটিং বিপর্যয়ের পর জিম্বাবুয়ের ক্রিকেটাররা বোধহয় আরও একটা শোচনীয় হার বরণ করে নেওয়ারই প্রহর গুনতে শুরু করেছিলেন। কিন্তু মধ্যাহ্ন বিরতিতে বয়কটের কাছ থেকে অবজ্ঞাসূচক ‘উপদেশবাণী’ শুনে কিছুটা যেন রোখ চেপে গিয়েছিল হজসনের। জেতার জন্য মাঠে নামবেন, এতটা হয়তো কল্পনা করতে পারেননি। কিন্তু কিছু একটা যে করে দেখাতে হবে, সে ব্যাপারে ছিলেন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। মধ্যাহ্ন বিরতি শেষে মাঠে নামার আগে সতীর্থদের উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘মাঠে প্রায় আট হাজার দর্শক খেলা দেখতে এসেছে। আর তারা এখনো কিছু আনন্দময়-উত্তেজনাপূর্ণ পরিস্থিতি দেখতে চায়। আর আমরা শুধু একটা উপায়েই তাদের এই বিনোদনটা দিতে পারি। আমাদের চেষ্টা করতে হবে খেলাটা যতদূর সম্ভব চালিয়ে যাওয়ার।’

হজসনের এই কথা বোধহয় সত্যিই অনুপ্রাণিত করেছিল জিম্বাবুয়ের ক্রিকেটারদের। বিশেষত ব্রান্ডেসকে। জিম্বাবুয়ের এই ফাস্ট বোলারের দুর্দান্ত বোলিংয়ের মুখে খুব দ্রুতই খেই হারিয়ে ফেলেছিলেন ইংলিশ ব্যাটসম্যানরা। অধিনায়ক গ্রাহাম গুচ ইনিংসের প্রথম বলেই ফিরেছিলেন সাজঘরে। এরপর একে একে ব্রান্ডেসের শিকারে পরিণত হন অ্যালান ল্যাম্ব, রবিন স্মিথ ও গ্রায়েম হিক। ১০ ওভার বল করে মাত্র ২১ রান দিয়েই তিনি নিয়েছিলেন এই চারটি উইকেট। মাত্র ৪৩ রানেই পাঁচটি উইকেট তুলে নিয়ে অবিশ্বাস্য কিছু করার আশা জেগে উঠতে শুরু করেছিল জিম্বাবুইয়ান শিবিরে। কিন্তু ষষ্ঠ উইকেটে ৫২ রানের পার্টনারশিপ গড়ে সেই স্বপ্ন-পূরণের পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন অ্যালেক স্টুয়ার্ট ও নেইল ফেয়ারব্রাদার।

৯৫ রানের মাথায় স্টুয়ার্টকে সাজঘরে ফিরিয়ে আবারও আশার সঞ্চার করেন ওমর শাহ। এরপর অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই ফিল ডিফ্রেইটাস আর ফেয়ারব্রাদারের উইকেট তুলে নিয়ে অসম্ভবকে সম্ভব করার পথে জিম্বাবুয়েকে আরও একধাপ এগিয়ে নেন ইয়ান বুচার্ট। ভাগ্যদেবীও সেদিন পুরোপুরিই ছিল জিম্বাবুয়ের দিকে। কারণ নবম উইকেটে আবার ১৬ রানের জুটি গড়ে ম্যাচটা জেতার কিছুটা এগিয়ে যেতেই রানআউটের ফাঁদে পড়েন ইলিংওর্থ। ইংলিশদের স্কোর দাঁড়ায় ৯ উইকেটে ১২৪ রান। শেষ ওভারে দরকার নয় রান। আর অবিশ্বাস্য এক জয় উদ্যাপনের জন্য জিম্বাবুয়ের দরকার এক উইকেট। বল হাতে দৌড় শুরু করার আগে জিম্বাবুয়ান পেসার ম্যালকম জারভিসকে শুধু একটা কথাই বলেছিলেন অধিনায়ক হজসন। ‘কোনো কিছু না ভেবে শুধু ঠিক লাইন-লেন্থে বল করে যাও।’ অধিনায়কের কথা রেখেছিলেন জারভিস। প্রথম বলেই বাজিমাত। ইংল্যান্ডের শেষ ব্যাটসম্যান গ্লাডস্টোন স্মল ধরা পড়লেন অ্যান্ডি পাইক্রফটের হাতে। জিম্বাবুয়ে পেল ৯ রানের ইতিহাস গড়া, অবিশ্বাস্য, কল্পনাতীত এক জয়। আর শেষ পর্যন্ত এই জয়টাই খুলে দিয়েছিল তাদের টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার দ্বার।

একটা কথা জানতে ইচ্ছা হতেই পারে। ম্যাচ শেষে জিম্বাবুয়ের অধিনায়ক ডেভ হজসন কি কৃতজ্ঞতাবশত ‘মহান পথপ্রদর্শক’ জিওফ্রে বয়কটের সঙ্গে আর দেখা করেননি? আসলে হজসন সেই সুযোগটাই পাননি। কারণ খেলা শেষ হতেই বিড়ালের মতো নিঃশব্দে স্টেডিয়াম ছেড়েছিলেন সাবেক এই ইংলিশ ক্রিকেটার!

ভারত-অস্ট্রেলিয়া মহারণ

একদিনের ক্রিকেটের অনেক শ্বাসরুদ্ধকর, প্রতিদ্বন্দীতাপূর্ণ ম্যাচের জন্ম হয়েছে বিশ্বকাপের আসরে। ৯৯ বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে অস্ট্রেলিয়া-দক্ষিণ আফ্রিকার সেই টাই ম্যাচটার কথা তো অনেকেই এখনো ভুলতে পারেন নি। তবে সবচেয়ে কম রানের ব্যবধানে ফলাফল নির্ধারিত হয়েছে এমন ম্যাচগুলোর মধ্যে বিশ্বকাপের রেকর্ডবুকের পাতায় সবার উপরে স্থান করে নিয়েছে দুইটি ম্যাচ। ৮৭ বিশ্বকাপের তৃতীয় ম্যাচ ও ৯২ বিশ্বকাপের ১২তম ম্যাচ। পরপর দুইটি বিশ্বকাপের এই ম্যাচ দুটিতে পাওয়া যাবে প্রচুর মিল। দুবারই প্রতিপক্ষ ভারত-অস্ট্রেলিয়া। প্রচণ্ড উত্তেজনাপূর্ণ ম্যাচদুটিতে শেষ হাসি হেসেছে অস্ট্রেলিয়া। দুটি ম্যাচেই জয়-পরাজয়ের ব্যবধান মাত্র এক রান।

৮৭ বিশ্বকাপের অন্যতম ফেভারিট দুই দল বিবেচনা করা হয়েছিল ভারত ও অস্ট্রেলিয়াকে। আগেরবারের শিরোপাজয়ী হিসেবে স্বাগতিক ভারতকে শিরোপার দৌড়ে কিছুটা এগিয়ে রেখেছিলেন অনেকেই। অন্যদিকে বিশ্ব ক্রিকেটে নিজেদের স্থায়ী আসন দখলের কথা জানান দিতে শুরু করেছিল অস্ট্রেলিয়া। সব মিলিয়ে ৮৭ বিশ্বকাপের শুরুতেই তৃতীয় ম্যাচটার দিকে নজর ছিল সবারই। আর এই দর্শকদের একেবারেই হতাশ করেন নি দুই দলের ক্রিকেটাররা।

মাদ্রাজের চিদাম্বরম স্টেডিয়ামে টসে জিতে প্রথমে ফিল্ডিং করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন ভারতীয় অধিনায়ক কপিল দেব। কিন্তু দুই অসি ওপেনার ডেভিড বুন আর জিওফ মার্শের দুর্দান্ত ব্যাটিংয়ে সেই সিদ্ধান্তের কার্যকারিতা প্রমাণ করতে পারেন নি কপিল দেবরা। উদ্বোধনী জুটিতেই তাঁরা সংগ্রহ করেন ১১০ রান। ডেভিড বুন ৪৯ রান করে শাস্ত্রীর বলে এলবিডব্লিউ’র ফাঁদে পড়লেও জিওফ মার্শ পৌঁছে যান শতকের দোরগোড়ায়। সাজঘরে ফেরার আগপর্যন্ত তিনি খেলেন ১১০ রানের অসাধারণ এক ইনিংস। সঙ্গে ডিন জোনসের ৩৫ বলে ৩৯ ও তরুণ স্টিভ ওয়াহ’র ১৭ বলে ১৯ রানের ইনিংস দুটির সুবাদে নির্ধারিত ৫০ ওভারে অস্ট্রেলিয়ার সংগ্রহ দাঁড়ায় ২৭০ রান।

২৭১ রানের টার্গেটটা সেসময়ের প্রেক্ষিতে বেশ শক্ত টার্গেটই বলা চলে। তারপরও ভারতীয় ব্যাটসম্যানরা বেশ ভালোভাবেই এগিয়ে যাচ্ছিলেন লক্ষ্যের দিকে। যে সুনীল গাভাস্কার প্রথম বিশ্বকাপে ১৭৬ বলে ৩৬ রানের ইনিংস খেলে বিরক্তি উত্পাদন করেছিলেন, সেই গাভাস্কার এই ম্যাচে করলেন ৩৭। তাও মাত্র ৩২ বলে! আরেক ওপেনার ক্রিস শ্রীশান্ত খেললেন ৭০ রানের একটি ঝলমলে ইনিংস। তিন নম্বরে ব্যাট করতে নেমে চারটি চার ও পাঁচটি ছয় দিয়ে সাজানো সর্বোচ্চ ৭৩ রানের ঝড়ো একটি ইনিংস খেলেন নবজাত্ সিং সিধু । শুরুর দিকের এই তিন ব্যাটসম্যান ভারতের জয়ের রাস্তাটা অনেকখানি পরিস্কার করে দিয়েছিল। কিন্তু এরপরই জ্বলে উঠলেন অস্ট্রেলিয়ার অন্যতম সফল ফাস্ট বোলার ক্রেইগ ম্যাকডারমট। খুব অল্প সময়ের মধ্যে একে একে ফিরিয়ে দিলেন সিধু, আজহারউদ্দিন, দিলিপ ভেনসাঙ্কার ও রবি শাস্ত্রীকে। দুই উইকেটে ২০৬ রান থেকে মুহূর্তে মধ্যে ভারতের স্কোর দাঁড়ালো ৬ উইকেটে ২৪৬ রান। এরপর যেন ভাগ্যদেবীও মুখ ফিরিয়ে নিলেন ভারতের উপর থেকে। খুবই দুঃখজনকভাবে রানআউট হয়ে ফিরে গেলেন রজার বিনি আর মনোজ প্রভাকর। শেষ ওভারের শেষ দুই বলে জয়ের জন্য দরকার ছিল মাত্র দুই রান। ব্যাট হাতে দাঁড়িয়েছিলেন ভারতের শেষ ব্যাটসম্যান মহিন্দর সিং। বল হাতে স্টিভ ওয়াহ। পঞ্চম বলটাতেই মহিন্দর সিংকে বোল্ড করে জয় ছিনিয়ে নিলেন তরুন ওয়াহ।

৯২ বিশ্বকাপের ম্যাচটাতেও ভাগ্য সহায় হয় নি ভারতের। সেই ম্যাচে রান আউটের শিকার হয়েছিলেন চারজন ভারতীয় ব্যাটসম্যান। বৃষ্টির কারণে তত্কালিন বৃষ্টি-আইনও গিয়েছিল ভারতের বিপক্ষে। সব মিলিয়ে আগের বিশ্বকাপের সেই স্মৃতিই যেন নতুন করে ফিরে এসেছিল এই বিশ্বকাপেও। এবারও প্রথমে ব্যাট করতে নামে অস্ট্রেলিয়া। তবে সেই ম্যাচের মতো এবার আর খুব বেশি দাপটের সঙ্গে ব্যাট চালাতে পারেন নি অসি ব্যাটসম্যানরা। ডেভিড জোনসের ৯০, ডেভিড বুনের ৪৩ ও শেষদিকে স্টিভ ওয়াহ, টম মুডির ২৯ ও ২৫ রানের ইনিংসগুলির সুবাদে নির্ধারিত ৫০ ওভারে ২৩৬ রান তোলে অস্ট্রেলিয়া।

জবাবে ব্যাট করতে নেমে ছোট ছোট পার্টনারশিপে বেশ ভালোই রান সংগ্রহ করছিলেন আজহারউদ্দিন, রবি শাস্ত্রি, কপিল দেবরা। কিন্তু বাধ সাধে বৃষ্টি ১৭ তম ওভারে বৃষ্টি শুরু হওয়ার পর তিন ওভার কমিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ভারতের নতুন টার্গেট দাঁড়ায় ৪৭ ওভারে ২৩৬। আজহারউদ্দিনের ১০২ বলে ৯৩ রান আর সঞ্জয় মাঞ্জেরেকারের ৪২ বলে ৪৭ রানের ইনিংস দুটো অনেক আশা জাগিয়েছিল ভারতীয় শিবিরে। কিন্তু দুজনকেই বিদায় নিতে হয় রানআউটের ফাঁদে পড়ে। শেষ ওভারে ভারতের প্রয়োজন ছিল ১৩ রান। কিরন মোরে প্রথম দুই বলে চার হাঁকিয়ে বোল্ড হয়ে যান টম মুডির বলে। টার্গেট দাঁড়ায় তিন বলে পাঁচ রান। তাড়াহুড়ো করে রান নিতে গিয়ে শেষ দুই ব্যাটসম্যান মনোজ প্রভাকর ও ভেঙ্কটপতি রাজু, দুজনই পড়েন রানআউটের ফাঁদে। স্কোরবোর্ডে যোগ হয় তিন রান। আবারও ভারতের পরাজয়ের ব্যবধান মাত্র ১ রান।

ট্র্যাজেডির সেমিফাইনাল

১৯৯৯ সালের বিশ্বকাপ সেমিফাইনালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে দক্ষিণ আফ্রিকার ট্রাজিক বিদায়টার কথা এখনো ভুলতে পারেন নি ক্রিকেটপ্রেমীরা। ম্যাচটা ড্র হয়ে গেলেও পয়েন্ট মারপ্যাঁচের ফাঁদে পড়ে বিদায় নিতে হয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকাকে। প্রোটিয়াসদের সেমিফাইনাল ট্রাজেডি কিন্তু সেটাই প্রথম না। এর আগে ১৯৯২ সালের বিশ্বকাপ সেমিফাইনালেও জঘন্য কিছু আইন-কানুনের জালে আটকে গিয়েছিল তাদের বিশ্বকাপ জয়ের স্বপ্ন।

১৯৯২ সালেই বিশ্বকাপে প্রথমবারের মতো অংশ নিয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকা। তার আগে বর্ণবাদ বিতর্কের ঘেরাটোপে আটকে বেশ কিছুদিন আন্তর্জাতিক ক্রিকেট অঙ্গনেরই বাইরে ছিল তারা। বিশ্বকাপে তাদের প্রথম ম্যাচে স্বাগতিক অস্ট্রেলিয়াকে ৯ উইকেটে হারিয়ে শুরুটাও করেছিল দুর্দান্তভাবে। তারপর একে একে ওয়েস্ট ইন্ডিজ, পাকিস্তান, জিম্বাবুয়ে, ভারতকে হারিয়ে উঠে এসেছিল সেমিফাইনালে। অধিনায়ক কেপলার ওয়েলস, অ্যালান ডোনাল্ড, হ্যানসি ক্রনিয়ে, জন্টি রোডসরা অসাধারণ পারফরমেন্স দেখিয়ে মুগ্ধ করে দিয়েছিলেন ক্রিকেট বিশ্বকে। পাকিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচটিতে জন্টি রোডস যেভাবে ইনজামামকে রান আউট করেছিলেন তা এখনো জ্বলজ্বল করছে বিশ্বকাপ ইতিহাসের পাতায়।

দক্ষিণ আফ্রিকার এই প্রথম বিশ্বকাপে অনেককিছুই দেখা গিয়েছিল প্রথমবারের মতো। যেমন, সেবারই প্রথম প্রচলন হয় রঙ্গিন পোশাকের। সেই সঙ্গে চালু করা হয় সাদা বল। সেবারই প্রথম খেলা শুরু হয়েছিল ফ্লাডলাইটের আলোয়। কিন্তু এসবকিছুকে ছাপিয়ে ১৯৯২ বিশ্বকাপের অন্যতম প্রধান আলোচিত বিষয়ে পরিণত হয়েছিল বৃষ্টি সংক্রান্ত নতুন আইন। ৯২ বিশ্বকাপের বৃষ্টি আইনের নিয়মটা ছিল যে, প্রথমে ফিল্ডিং করা দলের সবচেয়ে কম রান দেওয়া ওভারগুলির রানসংখ্যা কমিয়ে নেওয়া হবে। ধরা যাক বৃষ্টির কারণে ২ ওভার কেটে নেওয়া হলো। তখন হিসাব করা হবে যে, প্রথমে বোলিং করা দল কোন দুই ওভারে সবচেয়ে কম রান দিয়েছে। যত রান কম দিয়েছে তত রান বাদ দিয়ে নতুন টার্গেট নির্ধারণ করা হবে। সেবার বৃষ্টিই গড়ে দিয়েছিল বিশ্বকাপের অনেকগুলো ম্যাচের ভাগ্য। আর সেই বৃষ্টির জলেই যে ধুয়ে যাবে দুর্দান্ত ফর্মে থাকা দক্ষিণ আফ্রিকার বিশ্বকাপ স্বপ্ন- তা হয়তো কেউই ভাবতে পারে নি।

ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সেমিফাইনালটিতে বৃষ্টি বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল খেলা শুরুর আগেই। খেলার দৈর্ঘ্য কমিয়ে নিয়ে আসা হয়েছিল ৪৫ ওভারে। শুরু থেকেই ভাগ্যদেবী যেন একেবারে মুখ ফিরিয়ে রেখেছিলেন প্রোটিয়াসদের উপর থেকে। যে গ্রায়েম হিকের ৯০ বলে ৮৩ রানের ইনিংসটির সুবাদে ইংল্যান্ড স্কোরবোর্ডে ২৫২ রান যোগ হয়েছিল, সেই হিক দুই দুইবার ফিরে এসেছেন নিশ্চিত আউটের দ্বারপ্রান্ত থেকে। ম্যাচের প্রথম বলেই নিশ্চিত একটা এলবিডব্লিউর আবেদনে সাড়া দেন নি আম্পায়ার। দ্বিতীয়বার হিক ক্যাচ আউট হয়েছিলেন একটা নো বলে। তখনও রানের খাতাই খুলতে পারেন নি তিনি।

২৫৩ রানের টার্গেট নিয়ে ব্যাট করতে নেমে বেশ ভালোভাবেই এগিয়ে যাচ্ছিল প্রোটিয়াসরা। উদ্বোধনী ব্যাটসম্যান অ্যান্ড্রু হাডসনের ৪৬, আদ্রিয়ান কুইপারের ৩৬, হ্যানসি ক্রনিয়ের ২৪ রানের ছোট ছোট ইনিংসগুলির উপর ভর করে ধীরে ধীরে জয়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল তারা। শেষদিকে জন্টি রোডসের ৩৮ বলে ৪৩ রানের ইনিংসটি রান-বলের ব্যবধান কমিয়ে এনেছিল অনেকখানিই। শেষ পাঁচ ওভারে তাদের দরকার ছিল ৪৭ রান। সপ্তম উইকেটে ব্রায়ান ম্যাকমিলান ও ডেভ রিচার্ডসন মাত্র তিন ওভারে অবিচ্ছিন্ন ২৬ রানের জুটি গড়ে জয়টাকে অনেকটাই নাগালের মধ্যে নিয়ে এসেছিলেন। আর তারা যেভাবে খেলে যাচ্ছিলেন তাতে সেটা খুব বেশি কঠিনও মনে হচ্ছিল না। কিন্তু ৪৩তম ওভারের শেষ বলের আগে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম সেমিফাইনাল ট্রাজেডিটার জন্ম দিতেই আবার শুরু হলো বৃষ্টি। জয়ের জন্য তখন প্রয়োজন ছিল ১৩ বলে ২২ রান। সেদিনের সেই ১২ মিনিটের বৃষ্টি একটা ক্লাসিক ম্যাচকে পরিণত করেছিল বিশ্বকাপের অন্যতম বিতর্কিত একটা ম্যাচে। ম্যাকমিলান ও রিচার্ডসন চাচ্ছিলেন খেলা চালিয়ে যেতে। কিন্তু ইংলিশ অধিনায়ক গ্রাহাম গুচ কোনক্রমেই রাজি হলেন না। আম্পায়াররা শেষপর্যন্ত খেলা বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিলেন। এরপর তারা সেই অদ্ভুত নিয়মের খাতা খুলে হিসাব করতে বসলেন নতুন টার্গেট। প্রথমে আম্পায়াররা লক্ষ্য নির্ধারণ করলেন ৭ বলে ২২ রান। মেলবোর্নের উপস্থিত দর্শক ক্ষুব্ধ হয়ে উঠল এই নির্বুদ্ধিতায়। কিন্তু পরিস্থিতি আরো নির্মম হয়ে উঠল যখন কর্মকর্তারা খেলা দুই ওভার কমিয়ে নতুন লক্ষ্য নির্ধারণ করলেন। ইলেকট্রনিক স্কোরবোর্ডে ভেসে উঠল হাস্যকর, নির্মম একটা টার্গেট। ১ বলে ২১ রান। দক্ষিণ আফ্রিকার সবচেয়ে কম রান দেওয়া দুই ওভারে ইংল্যান্ড নিয়েছিল ১ রান। সৌজন্যে রক্ষার খাতিরে অসম্ভব এই টার্গেট নিয়ে একমাত্র বলটির মুখোমুখি হতে আবার ব্যাট হাতে মাঠে নামলেন ম্যাকমিলান ও রিচার্ডসন। ক্রিস লুইসের শেষ বলে একটা রান নিয়ে ক্ষুব্ধভাবে প্যাভিলিয়নের দিকে তাকালেন দুই প্রোটিয়াস ব্যাটসম্যান। গ্যালারি থেকে হাততালি দিয়ে অভিনন্দন জানানো হলো না বিজয়ী দলকে। দুয়োধ্বনিতে প্রকম্পিত হলো সিডনি স্টেডিয়াম। বিশ্বকাপ ফাইনালে ওঠার আনন্দে মাতলেন না ইংলিশ খেলোয়াড়রাও বরং এরকম বিতর্কিত একটা জয় পেয়ে বেশ বিব্রতই হয়ে পড়েছিলেন তারা।

এর পরের কাহিনী তো সবারই জানা। ফাইনালে ইংল্যান্ডকে ২২ রানে হারিয়ে বিশ্বকাপ শিরোপাটা উঠেছিল ইমরান খানের পাকিস্তানের হাতে। আর এই জঘন্য বৃষ্টি-আইনটি কোন রকম উচ্চবাচ্য ছাড়াই সরিয়ে ফেলা হয়েছিল ক্রিকেট দুনিয়া থেকে। ১৯৯৯ সালে প্রণয়ন করা হয়েছিল অধিক গ্রহণযোগ্য ডাকওয়ার্থ-লুইস পদ্ধতি।

 

ব্রায়ান লারার অটোগ্রাফ ও মরিস ওদুম্বে

১৯৯৬ বিশ্বকাপে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারানোর পর ব্রায়ান লারার অটোগ্রাফ পেয়েছিলেন কেনিয়ার অধিনায়ক মরিস ওদুম্বে

মরিস ওদুম্বে অনেকদিন ধরেই চেষ্টা করছিলেন ওয়েস্ট ইন্ডিজ কিংবদন্তী ব্রায়ান লারার একটা অটোগ্রাফ নেওয়ার। কিন্তু খুব বেশি কাছাকাছি আসার সুযোগই পাননি কখনো। ১৯৯৬ বিশ্বকাপের তিন বছর আগে একবার ইংল্যান্ডে অটোগ্রাফ চেয়ে প্রত্যাখ্যাত হয়েছিলেন কেনিয়ান অধিনায়ক। ৯৬-এর বিশ্বকাপে প্রথমবারের মতো কেনিয়া সুযোগ পাওয়ার পর ওদুম্বের প্রথম মনে হয়েছিল যে, একই টুর্নামেন্টে তিনি খেলতে পারবেন তাঁর স্বপ্নের নায়ক ব্রায়ান লারার সঙ্গে। আর এবার অটোগ্রাফ চাইতে গেলে লারা নিশ্চিত ফিরিয়ে দেবেন না। এতেই মহাখুশি ছিলেন তিনি।

ফিক্সচার ঘোষণার পর দেখা গেল একই গ্রুপে আছে কেনিয়া-ওয়েস্ট ইন্ডিজ। এর বেশি আর কী চাওয়ার থাকতে পারে ওদুম্বের? তিন বছর আগে যেখানে লারার অটোগ্রাফটাও নিতে ব্যর্থ হয়েছিলেন, সেখানে তিনি বিশ্বকাপের আসরে খেলতে পারবেন নিজের আদর্শ ক্রিকেটারটার বিপক্ষেই— এটা তো স্বপ্নেরও অতীত। ২৯ ফেব্রুয়ারী পুনেতে উইন্ডিজের বিপক্ষে মাঠে নামার আগের দিন পর্যন্ত এই আনন্দেই ডগমগ করছিলেন ওদুম্বে। তখনও ঘুনাক্ষরেও টের পাননি ভাগ্যদেবী তার কপালে আরো কত সৌভাগ্য লিখে রেখেছেন।

পরদিন বিশ্বকাপ ইতিহাসের অন্যতম বড় অঘটনের জন্ম দিয়ে লারার ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ৭৩ রানের জয় পেয়ে গেল ওদুম্বের কেনিয়া। আর এই জয়ের পেছনেও সবচেয়ে বড় ভূমিকাটা পালন করলেন তিনিই। ১০ ওভার বল করে মাত্র ১৫ রানের বিনিময়ে নিয়েছিলেন তিনটি উইকেট। ম্যান অব দ্য ম্যাচের পুরস্কারটাও উঠেছিল তাঁর হাতেই। ‘আদর্শ দল’, ‘আদর্শ ক্রিকেটারের’ বিপক্ষে এই জয়টার পর ওদুম্বে বলেছিলেন, ‘এটা যেন বিশ্বকাপ জয়ের মতোই অনুভূতি।’

এখানেই শেষ না। ওদুম্বের বিস্ময়ের পারদ আরো কয়েক ধাপ ওপরে তুলে দেওয়ার জন্য এই ম্যাচের পর কেনিয়ার ড্রেসিংরুমে গিয়ে হাজির হলেন প্রিন্স অব ত্রিনিদাদ ব্রায়ান লারা স্বয়ং। বিস্ময়ের ঘোর কাটতেই অনেকক্ষণ লেগেছিল ওদুম্বের। কিন্তু তারপর ধাতস্থ হওয়ার পর কিছুটা রসিকতা করতেও ছাড়েন নি কেনিয়ার এই ঐতিহাসিক জয়ের নায়ক। মুখে একগাল হাসি ছড়িয়ে লারাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘এখন নিশ্চয়ই আপনি আমাদের সঙ্গে ছবি তুলতে চাইবেন?’ লারাও শুধু শুকনো মুখে অভিনন্দন জানিয়েই ফিরে যান নি। বেশ কিছুক্ষণ কাটিয়েছিলেন ওদুম্বের সঙ্গে। এক ফাঁকে অটোগ্রাফটা নিতে নিশ্চয়ই ভুল করেন নি ওদুম্বে!