Posts Tagged ‘ ব্রায়ান লারা ’

ব্রায়ান লারার অটোগ্রাফ ও মরিস ওদুম্বে

১৯৯৬ বিশ্বকাপে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারানোর পর ব্রায়ান লারার অটোগ্রাফ পেয়েছিলেন কেনিয়ার অধিনায়ক মরিস ওদুম্বে

মরিস ওদুম্বে অনেকদিন ধরেই চেষ্টা করছিলেন ওয়েস্ট ইন্ডিজ কিংবদন্তী ব্রায়ান লারার একটা অটোগ্রাফ নেওয়ার। কিন্তু খুব বেশি কাছাকাছি আসার সুযোগই পাননি কখনো। ১৯৯৬ বিশ্বকাপের তিন বছর আগে একবার ইংল্যান্ডে অটোগ্রাফ চেয়ে প্রত্যাখ্যাত হয়েছিলেন কেনিয়ান অধিনায়ক। ৯৬-এর বিশ্বকাপে প্রথমবারের মতো কেনিয়া সুযোগ পাওয়ার পর ওদুম্বের প্রথম মনে হয়েছিল যে, একই টুর্নামেন্টে তিনি খেলতে পারবেন তাঁর স্বপ্নের নায়ক ব্রায়ান লারার সঙ্গে। আর এবার অটোগ্রাফ চাইতে গেলে লারা নিশ্চিত ফিরিয়ে দেবেন না। এতেই মহাখুশি ছিলেন তিনি।

ফিক্সচার ঘোষণার পর দেখা গেল একই গ্রুপে আছে কেনিয়া-ওয়েস্ট ইন্ডিজ। এর বেশি আর কী চাওয়ার থাকতে পারে ওদুম্বের? তিন বছর আগে যেখানে লারার অটোগ্রাফটাও নিতে ব্যর্থ হয়েছিলেন, সেখানে তিনি বিশ্বকাপের আসরে খেলতে পারবেন নিজের আদর্শ ক্রিকেটারটার বিপক্ষেই— এটা তো স্বপ্নেরও অতীত। ২৯ ফেব্রুয়ারী পুনেতে উইন্ডিজের বিপক্ষে মাঠে নামার আগের দিন পর্যন্ত এই আনন্দেই ডগমগ করছিলেন ওদুম্বে। তখনও ঘুনাক্ষরেও টের পাননি ভাগ্যদেবী তার কপালে আরো কত সৌভাগ্য লিখে রেখেছেন।

পরদিন বিশ্বকাপ ইতিহাসের অন্যতম বড় অঘটনের জন্ম দিয়ে লারার ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ৭৩ রানের জয় পেয়ে গেল ওদুম্বের কেনিয়া। আর এই জয়ের পেছনেও সবচেয়ে বড় ভূমিকাটা পালন করলেন তিনিই। ১০ ওভার বল করে মাত্র ১৫ রানের বিনিময়ে নিয়েছিলেন তিনটি উইকেট। ম্যান অব দ্য ম্যাচের পুরস্কারটাও উঠেছিল তাঁর হাতেই। ‘আদর্শ দল’, ‘আদর্শ ক্রিকেটারের’ বিপক্ষে এই জয়টার পর ওদুম্বে বলেছিলেন, ‘এটা যেন বিশ্বকাপ জয়ের মতোই অনুভূতি।’

এখানেই শেষ না। ওদুম্বের বিস্ময়ের পারদ আরো কয়েক ধাপ ওপরে তুলে দেওয়ার জন্য এই ম্যাচের পর কেনিয়ার ড্রেসিংরুমে গিয়ে হাজির হলেন প্রিন্স অব ত্রিনিদাদ ব্রায়ান লারা স্বয়ং। বিস্ময়ের ঘোর কাটতেই অনেকক্ষণ লেগেছিল ওদুম্বের। কিন্তু তারপর ধাতস্থ হওয়ার পর কিছুটা রসিকতা করতেও ছাড়েন নি কেনিয়ার এই ঐতিহাসিক জয়ের নায়ক। মুখে একগাল হাসি ছড়িয়ে লারাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘এখন নিশ্চয়ই আপনি আমাদের সঙ্গে ছবি তুলতে চাইবেন?’ লারাও শুধু শুকনো মুখে অভিনন্দন জানিয়েই ফিরে যান নি। বেশ কিছুক্ষণ কাটিয়েছিলেন ওদুম্বের সঙ্গে। এক ফাঁকে অটোগ্রাফটা নিতে নিশ্চয়ই ভুল করেন নি ওদুম্বে!

‘অপরাজিত’ ক্লুজনার

নিরানব্বইয়ের বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ রান এসেছিল রাহুল দ্রাবিড়ের ব্যাট থেকে। সেই বিশ্বকাপে শচীন টেন্ডুলকার, মার্ক ওয়াহ, হার্শেল গিবস, ব্রায়ান লারা ও সাঈদ আনোয়ারের মতো ব্যাটসম্যানরা ছিলেন স্ব-মহিমায় উজ্জ্বল। কিন্তু ব্যাটিংয়ের এসব মহারথীকে ছাপিয়ে ’৯৯-এর বিশ্বকাপে বোলারদের দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকার ল্যান্স ক্লুজনার। কিছুতেই আউট করা যাচ্ছিল না তাঁকে। বিশ্বকাপের প্রথম ছয়টি ম্যাচের পাঁচটিতে ব্যাট হাতে মাঠে নেমে করেছিলেন ১৬৪ রান। তাঁর কোনো গড় হিসাব করা যাচ্ছিল না। কারণ, ক্লুজনার যে এই পাঁচটি ম্যাচে আউটই হননি!

কেবল তাই নয়, তিনি শেষবারের মতো আউট হয়েছিলেন বিশ্বকাপ শুরু হওয়ারও দুই-আড়াই মাস আগে। সব মিলিয়ে ওয়ানডে ক্রিকেটে আউট না হওয়ার এক অনন্য রেকর্ডই করে বসেছিলেন তিনি। বিশ্বকাপের ছয়টি ম্যাচসহ টানা ১১টি ম্যাচে অপরাজিত থেকে ৩৯৩ রান করে তিনি ভেঙেছিলেন পাকিস্তানের ব্যাটিং কিংবদন্তি জাভেদ মিয়াঁদাদের রেকর্ড।

নিরানব্বইয়ের বিশ্বকাপটা পুরোটাই ছিল ক্লুজনারের বীরত্ব গাঁথা। পুরো বিশ্বকাপেই দারুণ আলোচিত ছিল তাঁর মারকুটে ব্যাটিং। সুপার সিক্সে পাকিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচটিতে দলের পরাজয় মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে যাওয়ার পরও অবিচল ছিলেন ল্যান্স ক্লুজনার। শোয়েব আকতারের এক ওভারে ১৭ রান নিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকাকে নিয়ে যান বিজয়ের বন্দরে। সেমিফাইনালে দক্ষিণ আফ্রিকার ট্র্যাজিক বিদায়েও তিনি ছিলেন ট্র্যাজিক হিরো। দলকে ফাইনালে প্রায় নিয়েই গিয়েছিলেন। অ্যালান ডোনাল্ডের সঙ্গে সেই ভুল-বোঝাবুঝিটা না হলে হয়তো বিশ্বকাপের ইতিহাসই অন্যভাবে লিখতে হতো। অনেক ম্যাচেই দক্ষিণ আফ্রিকার টপ অর্ডার ব্যর্থ হলেও অসাধারণ দৃঢ়তায় তিনি দলকে বিজয়ী করেছেন। ’৯৯-এর বিশ্বকাপে তাঁর নাম তাই হয়ে গিয়েছিল ‘ক্রাইসিস ম্যান’।

ক্রিকেটের ইতিহাসে সম্ভবত ল্যান্স ক্লুজনারের আউট হওয়া না-হওয়া নিয়েই ধরা হয়েছে একমাত্র বাজি। ’৯৯-এর বিশ্বকাপে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ১১ ম্যাচ পরে তিনি আউট হয়েছিলেন। সেই ম্যাচে তিনি আউট হবেন কি হবেন না, তা নিয়ে বাজির দর বেড়ে গিয়েছিল হু হু করে। শেষ পর্যন্ত ওয়ান ডাউনে ব্যাট করতে নেমে গ্যাভিন লারসেনের বলে তিনি আউট হন। অনেকে এই বলেও বিতর্ক ছড়িয়েছিলেন যে প্রোটিয়া অধিনায়ক হ্যানসি ক্রোনিয়ে যদি তাঁকে সেই ম্যাচে ওয়ান ডাউনে না নামাতেন, তাহলে এই ম্যাচেও নাকি তিনি অপরাজিত থাকতেন।

ল্যান্স ক্লুজনার ’৯৯-এর বিশ্বকাপে সবই পেয়েছেন, কেবল পারেননি দক্ষিণ আফ্রিকাকে ফাইনালে তুলতে। চরম নাটকীয় ও শ্বাসরুদ্ধকর সেমিফাইনালে ১৬ বলে ৩১ রান করে অপরাজিত থাকলেও মুহূর্তের ভুলে তিনিই ছিলেন সেই ম্যাচের ট্র্যাজেডির নায়ক। শুধু ব্যাট হাতেই নয়, বল হাতেও ১৭ উইকেট শিকার করে বিশ্বের অন্যতম সেরা অলরাউন্ডার হিসেবে ক্লুজনারের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল ’৯৯-এর ইংল্যান্ড বিশ্বকাপেই। প্রতিযোগিতার সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কারটিও অবধারিতভাবে উঠেছিল এই ‘স্প্রিংবকে’র হাতেই।