চিকিৎসা যেখানে হায়েনার সঙ্গে বসবাস
যুদ্ধবিধ্বস্ত সোমালিয়ায় মানসিক অসুস্থতার হার খুবই বেশি। পূর্ব আফ্রিকার এই দেশটির প্রতি তিনজনের মধ্যে একজন ভোগে মানসিক অসুস্থতায়। বিশ্বজুড়ে যে হারটা দশজনে একজন। বছরের পর বছর ধরে চলা যুদ্ধের ফলে সেখানকার স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাও আছে খুবই বিপর্যস্ত অবস্থায়। বেশিরভাগ রোগীই কোনো চিকিৎসা সাহায্য পায় না। প্রথাগত নিয়ম অনুসারে এই ধরনের ব্যক্তিদের উপর চালানো হয় নিষ্ঠুর চিকিৎসা পদ্ধতি।
সোমালিয়াতে সামাজিকভাবে বিশ্বাস করা হয় যে, মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ব্যক্তিদের উপর কোনো আত্মা ভর করেছে। এবং তাদের সামনে একমাত্র পথটাই থাকে যে, ঐ ব্যক্তিকে জোরপূর্বক বেঁধে ফেলা ও শেখকে (স্থানীয় ওঝা) খবর দেওয়া। এই শেখরা এরপর ঐ ব্যক্তির উপর প্রয়োগ করতে থাকেন বিচিত্র সব চিকিৎসা পদ্ধতি। শেকল দিয়ে বেঁধে রাখাটা খুবই সাধারণ ব্যাপার। কাউকে কাউকে এমনকি সারাজীবনই বেঁধে রাখা হয় বলে জানতে পেরেছে ইতালিয়ান একটি এনজিও। কখনো কখনো আত্মাকে তাড়ানোর জন্য রোগীকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় হায়েনার সঙ্গে একই খাঁচায় রাত কাটানোর জন্য।
সোমালিয়ানরা বিশ্বাস করে যে, হায়েনা মানুষের সবকিছুই দেখতে পায়, অশুভ আত্মার উপস্থিতিও। আর হায়েনারাই এই মানসিক সমস্যায় ভোগা মানুষদের মধ্যে থেকে অশুভ শক্তিকে বিতাড়িত করতে পারবে, তাদেরকে খামচে, কামড়ে দিয়ে। নির্মম এই পদ্ধতির শিকার অনেক মানুষ প্রাণও হারিয়েছেন।
আশ্চর্য্যজনক ব্যাপার যে, বর্বর এই চিকিৎসা পদ্ধতিটা বেশ দামীও বটে। পরিবারের প্রিয়জনকে হায়েনার সঙ্গে একই খাঁচায় ঢুকিয়ে দেওয়ার জন্য খরচ করতে হয় ৫৬০ ডলার। যেটা সোমালিয়ানদের গড় বাৎসরিক আয়ের চেয়েও বেশি।
সহিংসতায় পূর্ণ দেশটির যে অংশগুলো বেশি যুদ্ধবিধ্বস্ত, সেখানকার বেশিরভাগ মানুষই মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। খুবই খারাপ কোনো অভিজ্ঞতার পর চাপজনিত মানসিক ব্যাধি হয়ে পড়ে খুবই সাধারণ ব্যাপার। আর সোমালিয়ার সমাজে মানসিক বিপর্যস্ততা সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞান না থাকায় প্রথাগত পদ্ধতির পথেই হাঁটতে হয় সেখানকার মানুষদের। কারো মধ্যে অস্বাভাবিকতার কোনো ছাপ অনুমান করলেই সবাই উত্তেজিত হয়ে পড়ে তাকে বেঁধে ফেলতে। মোগাডিশুর রেডিও স্টেশনে দিনে তিনবার করে চলা বিজ্ঞাপনটাতে যেমন দেখানো হয়েছে: সবাই চিৎকার করে বলছে, “ও পাগল হয়ে গেছে! ও দৌড়ে পালাচ্ছে! বেঁধে ফেল, বেঁধে ফেল!” সোমালিয়াতে এই দৃশ্যটা খুবই সুপরিচিত।
তবে বিজ্ঞাপনের পরের দৃশ্যটি কিছুটা অন্যরকম, যেটা আশার সঞ্চার করেছে আফ্রিকার যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটিতে। যেখানে একটি কণ্ঠকে বলতে শোনা যায়, “শেকল দিয়ে বেঁধ না। তাকে ডা. হাবের হাসপাতালে নিয়ে চল! কেউ যদি মানসিক সমস্যায় ভোগে, তাহলে তাকে বেঁধ না, নিয়ে যাও ডা. হাবের কাছে। তিনি সাহায্য করবেন।”
ডা. হাবের এই কর্মকা-টা শুরু হয়েছিল ২০০৫ সালে এরকম একটা ঘটনা স্বচক্ষে দেখার পর। তিনি দেখেছিলেন কিছু নারীকে সড়কে তাড়া করছে একদল তরুণ। এই ঘটনাটাই নাড়া দিয়েছিল হাবকে। তখনই তিনি সিদ্ধান্ত নেন, ‘আমি সোমালিয়ার প্রথম মানসিক হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করব।’ মোগাডিশুতে হাবের পাবলিক হেলথ হাসপাতালে এখন পর্যন্ত ১৫ হাজার রোগীকে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। সোমালিয়ার ছয়টি আলাদা জায়গায় এটার শাখা আছে।
ডা. হাবের পুরো নাম আবদি রহমান আলি আওয়ালে। সত্যিকারের কোনো মানসিক রোগের চিকিৎসকও তিনি নন। বিশ্ব সাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) থেকে তিন মাসের একটা বিশেষজ্ঞ প্রশিক্ষণ নিয়েই তিনি মিশনটা শুরু করেছিলেন। এবং তাঁর দাবি অনুযায়ী, তিনি বহুবিধ বিষন্নতা থেকে শুরু করে স্কিজোফ্রেনিয়া পর্যন্ত চিকিৎসা করতে পারেন। একই সঙ্গে এসম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির কাজটাও করে যাচ্ছেন ডা. হাব। তিনি বলেছেন, ‘আমরা সবাইকে দেখানোর চেষ্টা করছি যে, (প্রথাগত পদ্ধতিগুলো) একেবারেই অর্থহীন। মানুষ আমাদের রেডিও বিজ্ঞাপন শুনছে আর তারা জানছে যে, মানসিক অসুস্থতাও অন্য একটা অসুখের মতো যেটার চিকিৎসা প্রয়োজন, বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অনুসারে।’- বিবিসি অনলাইন