যখন বার্সার ওপর ছিল মাদ্রিদের রাজত্ব
স্প্যানিশ লিগে বরাবরই দেখা যায় বার্সেলোনা আর রিয়াল মাদ্রিদের আধিপত্য। ১৯৯৭-৯৮ সাল থেকে বর্তমান ফরম্যাটের প্রতিযোগিতা শুরু হওয়ার পর ১৭টি মৌসুমের মধ্যে ১৩বারই শিরোপা নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নিয়েছে স্পেনের শীর্ষ এই দুই ক্লাব। এর মধ্যে আটবারই জিতেছে বার্সা। রিয়াল জিতেছে পাঁচবার।
সাম্প্রতিক সময়ে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী রিয়ালের চেয়ে বার্সেলোনা কিছুটা এগিয়ে থাকলেও একটা সময় বার্সেলোনার ওপর আক্ষরিক অর্থেই রাজত্ব করত মাদ্রিদ। ফুটবল মাঠে শিরোপা জয়ের লড়াইয়ে তো বটেই, এমনকি রাজনৈতিকভাবেও।
১৯৩৬ থেকে ১৯৩৯ সাল পর্যন্ত রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধের পর ক্ষমতা দখল করেন স্বৈরশাসক ফ্রান্সিসকো ফ্রাঙ্কো। এবং সাধারণ মানুষের কাছে নিজেকে গ্রহণযোগ্য করে তোলার জন্য খুব দ্রুতই তিনি ফুটবল মাঠে রিয়াল মাদ্রিদের সাফল্যকে কাজে লাগাতে শুরু করেন। কিন্তু সেসময় তাদের শক্তিশালী প্রতিপক্ষ ছিল কাতালোনিয়া ও বাস্ক জাতিগোষ্ঠীর স্বকীয়তার প্রতীক দুই ফুটবল ক্লাব বার্সেলোনা ও অ্যাথলেটিক বিলবাও।
১৯৩৬ সালে স্প্যানিশ রিপাবলিকের বিরুদ্ধে সামরিক অভুত্থান শুরু করেন ফ্রাঙ্কো। সেসময় এই ক্যু’র বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিরোধটা এসেছিল বার্সেলোনা থেকে। ফলে কাতালান জাতিগোষ্ঠীর মানুষদের প্রতি বিশেষভাবেই ক্ষুব্ধ ছিলেন ফ্রাঙ্কো। ফুটবল মাঠে বার্সেলোনা, রিয়াল মাদ্রিদের ওপর আধিপত্য করবে এটা মানতে পারেননি এই স্বৈরশাসক। রিয়ালের সাফল্য নিশ্চিত করার জন্য নিজের ক্ষমতার চরম অপব্যবহার করতেও বিন্দুমাত্র কুণ্ঠাবোধ করেননি ফ্রাঙ্কো।
আদিতে বার্সেলোনা ফুটবল ক্লাবের নাম ছিল কাতালান এফসি বার্সেলোনা। কিন্তু কাতালোনিয়ার স্বকীয়তা-স্বাধীনতার দাবি যেন মাথাচাড়া না দেয়, সেজন্য তিনি ক্লাবের নাম পরিবর্তন করতে বাধ্য করেন। তাদের নতুন নাম হয় বার্সেলোনা সিএফ।
রিয়াল মাদ্রিদের সাফল্য নিশ্চিত করার জন্য ফ্রাঙ্কো নিজের ক্ষমতার অপব্যবহার কিভাবে করেছেন, তার সবচেয়ে ভালো উদাহরণ ১৯৪৩ সালে কিংস কাপের (এখনকার কোপা ডেল রে) সেমিফাইনাল। প্রথম লেগে ৩-০ গোলের জয় দিয়ে ফাইনালের পথে অনেকখানি এগিয়ে গিয়েছিল বার্সা। কিন্তু দ্বিতীয় লেগের খেলায় অংশ নিতে বার্সার ফুটবলাররা যখন মাদ্রিদে গেলেন, তখন আকস্মিকভাবে তাদের সাজঘরে হাজির হয়েছিলেন স্পেনের স্টেট সিকিউরিটির ডিরেক্টর। বার্সার খেলোয়াড়দের যে ভয়ভীতি দেখানো হয়েছিল, তা স্পষ্টই বোঝা যায় সেই ম্যাচের ফলাফল দেখলে। রিয়ালের মাঠে ১১-১ গোলের বিশাল ব্যবধানে হেরেছিল বার্সেলোনা।
রিয়াল মাদ্রিদের কিংবদন্তি ফুটবলার আলফ্রেড ডি স্টেফানোকে দলে ভেড়ানো নিয়েও বেধেছিল বিপত্তি। ১৯৫৩ সালে আর্জেন্টাইন এই ফুটবলারকে প্রথমে দলে ভিড়িয়েছিল বার্সেলোনা। কিন্তু সেসময় ফ্রাঙ্কো একটা ডিক্রি জারি করেন যে বিদেশী কোনো খেলোয়াড় কেনা যাবে না। শেষপর্যন্ত দুই পক্ষের মধ্যে আলাপ-আলোচনা সমঝোতার ভিত্তিতে এমন ঐক্যমত্যে পৌঁছানো হয় যে, ডি স্টেফানো এক মৌসুম-এক মৌসুম করে খেলবেন দুই দলের হয়েই। এই ঘটনার কিছুদিন পরই বার্সেলোনার সভাপতির পদ থেকে সরে দাঁড়ান এনরিক মার্টি কোয়েত্তো। কিছুদিন পরে ডি স্টেফানোকে এককভাবেই দখল করে নেয় রিয়াল মাদ্রিদ।
আর্জেন্টাইন এই জাদুকরের দুর্দান্ত নৈপুন্যে ১৯৫৩ থেকে ১৯৬৫ পর্যন্ত, ১৪ মৌসুমের মধ্যে নয়বারই শিরোপা ওঠে রিয়ালের ঘরে। ১৯৩৩ সালের পর ১৯৫৩-৫৪ মৌসুমেই প্রথমবারের মতো লা লিগা শিরোপা ওঠে রিয়ালের ট্রফি কেসে। ১৯৫৬-৫৭ মৌসুমে প্রথমবারের মতো ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়ন হয় রিয়াল। সেসময় মাদ্রিদ সত্যিই রাজত্ব করত বার্সেলোনার ওপর।