সুবোধের বোধ ও বাংলাদেশের প্রাক-রূপায়নের রাজনীতি
ধানমন্ডির আবাহনী মাঠ সংলগ্ন এলাকায় চোখে পড়েছিল এই ছবিটি। পলায়নরত সুবোধকে এভাবে ঢেকে দেওয়া হয়েছিল পোস্টার দিয়ে। সুবোধের এই গ্রাফিতিতে লেখা ছিল, ‘এখানে সাপ ভরা চাপ চাপ রুচি! কাপ ভরা পাপ পাপ চা! সুবোধ… তুই পালিয়ে যাহ!’
তো এই ‘চাপ চাপ রুচি’র দারুণ প্রয়োগই ঘটিয়েছিলেন পোস্টার লাগানেওয়ালারা। এই একটা গ্রাফিতি ঢেকে দেওয়ার প্রয়াসে তারা সফল হয়েছিলেন খুব সফলভাবে! কিন্তু ঢাকা শহরে তো সুবোধ ছড়িয়ে গিয়েছিল ততদিনে। মানুষের মনে ততদিন প্রশ্ন উঠে গেছে যে, কে এই সুবোধ? কেন পালাতে বলা হচ্ছে তাকে? ‘এখন সময় পক্ষে না’ যে বলা হচ্ছে, তো এটা কোন সময়? কেমন সময়? যে সময়ে সূর্যকে খাঁচাবন্দী করে পালিয়ে যেতে হচ্ছে সুবোধকে? এসব প্রশ্ন আর খোদ এই সুবোধের খোঁজ করতে গিয়ে কিছু বন্ধু মিলে বানানো হয়েছিল এই ভিডিওটি।
কলকাতার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সেখানকার শিক্ষার্থীরা সুবোধকে দেখেছেন লড়াইয়ের প্রতীক হিসেবে। তারা সুবোধকে দিয়েছেন ইতিবাচকতা। সুবোধকে বলেছেন তৈরি হতে, ঘুরে দাঁড়াতে, ছড়িয়ে যেতে। হয়েছেও তো খানিকটা সেরকমই। ২০১৮ জুলাই-আগস্টে কিশোর বিদ্রোহের তোলপাড় করা সেই দিনগুলোতে একটি ছবি অনেকেরই নজর কেড়েছিল। বাংলাদেশের কিশোররা যে অসাধারণ কল্পনাশক্তির পরিচয় দিয়েছিল তাদের প্ল্যাকার্ডগুলোতে- সেখানে ঠাঁই হয়েছিল এই সুবোধেরও। একজনের হাতে ধরা প্ল্যাকার্ডে লেখা হয়েছিল, ‘সুবোধ এখন রাস্তায়’।
রাবির কর্তৃত্ববিরোধী মঞ্চের মূখ্য কিছু সংগঠক আগে থেকেই অরাজপন্থার ধারণার সঙ্গে পরিচিত ছিলেন। ফলে ২০০৮ সালের এই আন্দোলনটি ছিল বিকল্প কোনো পথে নামার সচেতন প্রয়াস। আর অচেতন প্রয়াসটা আমরা খুব সম্প্রতি দেখলাম কিশোর বিদ্রোহে। কিভাবে একটি কেন্দ্র না থেকেও, একক নেতৃত্ব তো দূরের কথা; দৃশ্যমান কোনো নেতৃত্ব না থেকেও কিভাবে রাজধানীর রাজপথ দাপিয়ে বেড়ানো যায়— সে শিক্ষাটা খুব দারুণভাবে দিয়েছে বাংলাদেশের কিশোররা। এবং এভাবে জনগণ সক্রিয় হয়ে উঠলে, জনগণ নিজের কাজের ব্যাপারে নিজে সচেতন হলে যে সব কিছু অনেক ভালোভাবে চলতে পারে—সেই শিক্ষাটাও দিয়েছে স্কুল-কলেজের ছেলেমেয়েগুলো।
এ প্রসঙ্গে পড়তে পারেন…
>> সবুজের অভিযান: সকল ক্ষমতা চাই শিশুদের কল্পনার হাতে (https://goo.gl/VvQteH)
>> রাস্তার পাঠশালায় চলে ‘এসো নিজে করি’ ক্লাস; বড়রা অংশ নেবে কি? (https://goo.gl/WnrsHu)
>> লাইসেন্স আছে?: কিশোর বিদ্রোহ যে বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখায় (https://goo.gl/JsVtjA)
এগুলো গেল খুব নিকট উদাহরণ। প্রত্যক্ষ উদাহরণ। পার্টি-পলিটিক্সের বাইরে স্বাধীন সংগঠন গড়ে ওঠার অজস্র নজির পৃথিবীতে দেখা গেছে। বহু প্রাচীনকালের সেসব ঐতিহাসিক উপাদানের উল্লেখ নাহয় তোলা থাকল। শিল্প-বিপ্লবের সময় থেকেও সমাজতান্ত্রিক রাজনীতির একেবারে শুরুর দিকেই অনেক আলাপ উঠেছিল কাঙ্ক্ষিত সমাজ ও তা রূপায়নের পদ্ধতি-কৌশল নিয়ে। সেসব ইতিহাসের গায়ে পড়া বহু বছরের ধুলো ঝাড়ার সময় বোধহয় চলে এসেছে। এ জায়গায় এসে আবারও সেলিম রেজা নিউটনের অচেনা দাগ বইয়ের “প্রিফিগারেটিভ পলিটিক্স বা প্রাক-রূপায়নের রাজনীতি: রাজনীতির অরাজপন্থা” (পৃষ্ঠা ১৭৭-১৮৬) এই অধ্যায়টির কথা উল্লেখ করছি। আগ্রহীরা অনলাইনে বসেই পড়তে পারেন এখান থেকে: https://goo.gl/zPRg1m
সুবোধ যেন আর পালিয়ে না বেড়ায়, সময়টা যেন সুবোধের পক্ষে আসে — সেই লক্ষ্যে কাজ করতে হবে সবাইকেই। এটা কোনো ভ্যানগার্ড, একক ব্যক্তি-সংগঠনের করে দিয়ে যাওয়ার বিষয় না। সুবোধের বোধ উদ্বোধনের সময় এখন। #হবেকি?
———————————————————————–
*** টি-শার্ট সম্পর্কিত ডিসক্লেইমার: সুবোধের এই গ্রাফিতিগুলোর আইডিয়া খুব বেশিমাত্রায় পছন্দ হওয়ায় দুইটা গ্রাফিতি দিয়ে মোট ৩০০ টি-শার্ট করার উদ্যোগটা আমি নিয়েছিলাম। কিছু বন্ধুর সঙ্গে মিলে সেগুলো বানানো হয়েছিল। এর পেছনে কোনো বাণিজ্যিক উদ্দেশ্য ছিল না। অধিকাংশ টি-শার্টই বিলানো হয়েছে বন্ধু-স্বজনদের মধ্যে। হ্যাঁ, শুরুতে এমন ভাবনা ছিল যে, যা খরচ হয়েছে- সেই টাকাটা যদি তুলে আনা যায়; তাহলে ভালো হয়। কিন্তু সেটাও শেষপর্যন্ত হয়নি। ১৫-২০ হাজার টাকা নিজের গাঁট থেকেই গিয়েছিল। এ নিয়ে অনেককে বলতে শুনেছি যে, টি-শার্ট বানিয়ে ব্যবসা হচ্ছে। সুবোধকে নিয়ে ব্যবসা হচ্ছে। আহত হয়েছিলাম। তাই এই লেখার সুবাদে এই কথাটুকু ডিসক্লেইমার আকারে দেওয়ার লোভ সংবরণ করতে পারলাম না। সুবোধকে নিয়ে ব্যবসা করার রুচি কখনো ছিল না, ভবিষ্যতেও আশা করি হবে না।