৪০ বছর আগে মুক্তিযুদ্ধে গর্জে ওঠা বন্দুকের আওয়াজ থেমে গিয়েছে। কিন্তু স্বাধীনতাকামী সেই রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের ক্ষতচিহ্ন এখনো রয়ে গেছে বাংলাদেশের বুকে।

বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা একটা কোলাহলপূর্ণ, উত্তেজনাময় শহর। এখানে আছে প্রচুর প্রাণপ্রাচুর্য আর তর্ক-বিতর্ক। নিশ্চল হয়ে থাকা ট্রাফিক জ্যামের বিশাল বিশৃঙ্খলার মধ্যে প্রায়শই দেখতে পাওয়া যায় হরতাল-মিছিল-প্রতিবাদ। এগুলো বিশাল সংখ্যক মানুষের জন্যই হয়তো দুঃখ-দুর্দশার কারণ। কিন্তু এই দেশটা জন্মানোর সময় এমন এক জাতীয় চেতনা গড়ে দিয়েছে যেটা কখনোই পুরোপুরি সনাক্ত করা হয়নি। সেই চেতনা দিয়েই সবাই তাড়িত হচ্ছে। শাহবাগে জাতীয় জাদুঘরের সামনে এখন যে প্রতিবাদটা জারি আছে, সেটা একটা অভূতপূর্ব প্রকৃতির। একটা নজীরবিহীন আকারের।
গত ৫ ফেব্রম্নয়ারি থেকে, বাংলাদেশ অবশ হয়ে আছে এই চলমান, বিশালাকারের প্রতিবাদের কারণে। হাজার হাজার মানুষ শাহবাগ চত্বর দখল করে প্রতিবাদ জানাচ্ছেন ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় সংঘটিত যুদ্ধাপরাধেদের বিচারের জন্য গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুন্যালের ঘোষিত একটি রায়ের বিরুদ্ধে। এই যুদ্ধাপরাধীদের একজন আবুল কালাম আজাদকে এর আগে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। এরপরে, আরেকজন যুদ্ধাপরাধী, ৭১-এর গণহত্যার সঙ্গে জড়িত সংগঠন জামায়াতে ইসলামীর সহযোগী সাধারণ সেক্রেটারী আব্দুল কাদের মোল্লাকে দেওয়া হয়েছে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের সাজা। এর প্রতিবাদে শুরু হওয়া ও এখনো চলমান প্রতিবাদটার নেতৃত্ব দিচ্ছেন সমাজের চিন্তাশীল আর উদার মন মানসিকতার মানুষেরা। তারপরও তাঁরা কাদের মোল্লাসহ অন্যান্য অভিযুক্ত যুদ্ধাপরাধীদের অবিলম্বে ফাঁঁসির রায় কার্যকর করার দাবি জানাচ্ছেন।
৭১ এ সংঘটিত গণহত্যাটি সম্পর্কে পশ্চিমের মানুষ খুব কমই জানে। তাছাড়াও পার্টিজান তার্কিক ও স্বার্থান্বেষী ইতিহাসবিদদের মধ্যে বিষয়টি অস্বীকার করার প্রবণতা দেখা যায় বিস্ময়কর মাত্রায়। ১৯৭১ সালের আগে, বাংলাদেশ বা তত্কালিন পূর্ব পাকিস্তান মূল পাকিস্তানের সঙ্গে ভৌগলিকভাবে যুক্ত ছিল না। এই রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতারা বিশ্বাস করতেন যে, ধর্মের ঐক্যই এই পৃথকীকৃত দুই অঞ্চলের মানুষকে একসঙ্গে ধরে রাখবে। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে সংস্কৃতির বৈপরীত্য তীব্রভাবে বেড়ে উঠতে থাকে। পাকিস্তানি শাসকদের একটি বড় অংশ বাঙ্গালিদের বিবেচনা করত ঘৃণ্য সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে।
১৯৬৭ সালে একটি আত্মকথায়, জেনারেল আইয়ুব খান লিখেছিলেন, ‘পূর্ব বাঙ্গালিদের মধ্যে উত্পীড়িত জাতির সবগুলো প্রবৃত্তিই আছে… তাদের জটিলতা, নতুন কিছুর প্রতি অনীহা আর নিরাপত্তামূলক আগ্রাসন… উদ্ভুত হয়েছে এই ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট থেকে।’ অত্যন্ত সমৃদ্ধ একটি সেকুলার সংস্কৃতির প্রতি (পাকিস্তানি শাসকদের) সাধারণ এই শত্রুভাবাপন্ন মনোভাবটা একটা মীমাংসাকারক/চরম পর্যায়ে পৌঁছায় যখন আওয়ামী লীগের নেতা শেখ মুজিব জাতীয় নির্বাচনে জয়লাভ করেন। তাঁকে সেসময় কারাবন্দী করা হয় আর মার্চ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশের অধিবাসীদের উপর বর্বর গণহত্যা চালায় পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী।

পাকিস্তান কখনোই তারা যা ঘটিয়েছিল সেটার দায়দায়িত্ব স্বীকার করেনি। আর এর বাইরেও, ইতিহাসবিদ ও সাংবাদিকেরা বিপদজনকভাবে এই গণহত্যাটাকে অস্বীকারই করে গেছেন। বা নিহত হওয়া মানুষদের সংখ্যা কমিয়ে বলার প্রবণতা তাদের মধ্যে দেখা গেছে। পাকিস্তানের আনুষ্ঠানিক হিসাব থেকে দেখা যায় নিহতের সংখ্যা মাত্র ২৬ হাজার। উদ্বাস্তু হয়েছিলেন মাত্র ২০ লাখ মানুষ। সম্প্রতি অক্সফোর্ডের এক ইতিহাসবিদ ঘোষণা দিয়েছেন যে, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় নিহতের সংখ্যা দুই পক্ষ মিলিয়ে ৫০ হাজার থেকে এক লাখের বেশি কোনভাবেই না। অবশ্য এই ইতিহাসবিদের গবেষণাপদ্ধতি তীব্র নিন্দার মুখে পড়েছিল।
এটা যদি সত্যি হয় তাহলে বলতে হবে, পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী তাদের উচ্চাকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী মানুষ হত্যা করতে পারেনি। ১৯৭১ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি এক বৈঠকে পাকিস্তানের তত্কালিন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ক্ষুব্ধস্বরে বলেছিলেন, ‘ ৩০ লাখ বাঙ্গালিকে মেরে ফেল, তারপর বাকিরা এমনিতেই আমাদের হাতে খাবে।’ এক কোটি মানুষ উদ্বাস্তু হয়ে ভারতে পাড়ি জমিয়েছিল, ৩ কোটি মানুষ শহর ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন গ্রামের বাড়িতে।
যুদ্ধের প্রথম ধাপে, হত্যার জন্য টার্গেট করা হয় তরুণ, হিন্দু, আওয়ামী লিগের সদস্য, শিক্ষার্থী- বুদ্ধিজীবী-চিন্তকদের। যুদ্ধের দ্বিতীয় ধাপে, টার্গেট বানানো হয় নারীদের। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের দোসররা সেসময় অন্তত দুই লাখ নারীকে ধর্ষণ করে। পরবর্তীতে ধর্ষণের শিকার প্রায় ২৫ হাজার নারী নিজেদের আবিস্কার করে গর্ভবতী অবস্থায়। কাজেই এই ক্রোধ কোনভাবেই শান্ত করা যায় না। এমন অনেক প্রত্যক্ষদর্শী আছেন যাঁরা বলেছেন যে, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী সেসময় অনেক ‘ধর্ষণ-ক্যাম্প’ স্থাপন করেছিল। ধর্ষিতা নারীদের সংখ্যা ও তাদের নাম-পরিচয় নিয়ে প্রায়শই বিতর্ক হয়। বাংলাদেশের প্রথম নেতা শেখ মুজিব এই তালিকা নষ্ট করে ফেলার আদেশ দিয়েছিলেন, যেন এই লজ্জা সেই নারীদের আজীবন বয়ে বেড়াতে না হয়।
মুক্তিযুদ্ধের শেষ সপ্তাহে, যখন পাকিস্তানের পরাজয় সুনিশ্চিত আর একটা নতুন দেশের জন্ম অনিবার্য, তখন ১২-১৪ ডিসেম্বরের মধ্যে দেশের বুদ্ধিবৃত্তিক নেতাদের (যতো জনকে সম্ভব) হত্যা করার একটা নৃশংশ পরিকল্পনা করে পাকিস্তান। অন্তত একজন পাকিস্তানি অফিসারের ডায়েরিতে ভবিষ্যত্ রাষ্ট্রটির সম্ভাবনাময় নেতাদের নাম পাওয়া গিয়েছিল।
সশস্ত্র বাহিনী গঠন করে পাকিস্তানিদের সহায়তা করেছিল বাঙ্গালী বিশ্বাসঘাতকেরা। আল শামস ও আল বদর নামের সংগঠন দুইটি এই নৃশংশ হত্যাকাণ্ডের নেতৃত্ব দিয়েছিল। বাংলাদেশের বিজয় অবশ্যম্ভাবী এটা জেনে যাওয়ার পরও চূড়ান্ত বিজয়ের মাত্র দুই দিন আগে তারা এই ঘৃণ্য কাজটা করেছিল।
সত্যিকারের নিহত সংখ্যাটা জানা সত্যিই অসম্ভব ব্যাপার। ইতিহাসবিদ আর জে রুমেল ঐ সময়ের ঘটনাটিকে অন্যান্য যে কারো চাইতে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন। তিনি এভাবে ইতি টেনেছেন, ‘পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যার শিকার হতে পারে ৩ থেকে ৩০ লাখ পর্যন্ত। বা খুব সাবধানী হয়ে বললে, বলা যায় সংখ্যাটা দেড় লাখ।’ স্কলার বিনা ডি’কস্তার মতে, মুক্তিযুদ্ধের সময় নিহতের এই সংখ্যাটা পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিকভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। বাংলাদেশের সরকারের জন্য, নিহতের সংখ্যা বেশি থাকলে সেটা নবগঠিত নতুন দেশটিকে অধিকতর নায্যতা দেবে। আর অপরদিকে পাকিস্তানের জন্য সংখ্যাটা কমাতে পারলে বা সেটাকে উপেক্ষা করতে পারলে তারা একটা অবিশ্বাস দেখাতে পারবে। যেটা তারা এখনো করে যাচ্ছে। সত্যিকারের সংখ্যাটা যাই হোক, হাজার হাজার মানুষকে পাকিস্তানি বাহিনী যেরকম নির্মমভাবে হত্যা করেছে, সেটা হয়তো কারও কল্পনাতেও আসা সম্ভব না। হাজার হাজার ঘটনার মধ্যে, সবার একটা জিনিস পড়া উচিত্। ট্রাইবুন্যালে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সময় এক সাহসী নারী নিজের অভিজ্ঞতার কথা বলেছেন। তিনি তাঁর পরিবারের একমাত্র জীবিত ব্যক্তি। তিনি বলেছিলেন, কিভাবে চোখের সামনে তিনি বাবা-মা, দুই বোন ও মাত্র দুই বছর বয়সী ভাইকে হত্যা করতে দেখেছেন। তারপর নিজে ১২ জনের সম্মিলিত ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। সেসময় তাঁর বয়স ছিল মাত্র ১৩ বছর।
এগুলো ৪০ বছর আগের ঘটনা। যুদ্ধাপরাধী পাকিস্তানি সেনাদের কখনোই বিচারের আওতায় আনা হয়নি। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর, পাকিস্তানের দিক থেকে বলা হয়েছিল যদি তাদের একজন সৈন্যকেও ধরে রাখা হয় তাহলে পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্থিত কোন বাঙ্গালিকে যেতে দেওয়া হবে না। খুব সম্প্রতি পাকিস্তানি বাহিনীর সহায়তা করা বাংলাদেশীদের বিচার শুরু হয়েছে। ট্রাইবুন্যালের এই বিচারকাজ চলছে এখন পর্যন্ত সক্রিয় থাকা জামায়েতী ইসলামের অব্যাহত সহিংস হুমকির মুখে। কিছু যুদ্ধাপরাধী বিদেশে পালিয়ে গেছে। ১৯৯৫ সালে, এরকমই কিছু অভিযুক্ত যুদ্ধাপরাধীদের দিকে বৃটিশ কর্তৃপক্ষের নজর ফিরিয়েছিলেন ঢাকার সাংবাদিক ডেভিড বার্গম্যান, একটি প্রামাণ্যচিত্রের মাধ্যমে। এদের মধ্যে একজন চৌধুরি মুইনউদ্দিন এখন কাজ করছেন এনএইচএস প্রশাসক হিসেবে। এই মানুষদেরকে কেবল বিচারের অধিনে আনার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
গত শতকের অন্যতম নিষ্ঠুর কিছু গণহত্যাকারী শান্তিপূর্ণ অবসর পালন করতে পেরেছেন সাধারণ ক্ষমা আর কূটনৈতিক ঔদ্ধত্যের কারণে। ব্যাপারটা প্রায়শই প্রতিবাদের মুখে পড়লেও সেই প্রতিবাদকারীরা কোন সফলতা পাননি। ১৯৯২ সালে শহীদ জননী জাহানারা ইমাম যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের উদ্যোগ নিয়েছিলেন গণমানুষকে সঙ্গে নিয়ে। কিন্তু সফলতার মুখ দেখতে পারেননি। অবশেষে ২০০৮ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুন্যাল গঠিত হয়। এটার কর্মপ্রক্রিয়া ধীরগতির। আর সবাই অনুভব করেছে যে, আগামী নির্বাচনের আগেই এই বিচারকাজ শেষ করতে হবে। কারণ বিরোধীদলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার উপর মানুষের কোন আস্থা নাই। তিনি প্রকাশ্যেই জামায়াতে ইসলামীর রাজনৈতিক সহযোগী হিসেবে ভূমিকা পালন করেন। তিনি যে ট্রাইবুন্যালের কাজ চালিয়ে যেতে দেবেন বা এখন পর্যন্ত যাদের সাজা দেওয়া হয়েছে সেগুলো টিকে থাকতে দেবেন, সেটা মানুষ বিশ্বাস করে না।

কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায় শুনে জনগণ ফুঁসে উঠেছিল কারণ তারা জানত, যেমনটা আগেও দেখা গেছে, যে পরিমাণ সাফল্য অর্জন করা সম্ভব সেটা শেখ হাসিনার সরকার অর্জন করতে পারেনি। আর সরকারের পরিবর্তন হলে সেটা প্রায় নিশ্চিতভাবেই কারাবন্দী যুদ্ধাপরাধীদের ক্ষমা করার দিকে মোড় নেবে। এরকমটা অতীতেও কয়েকবার দেখা গেছে। তাই বাংলাদেশের আপামর জনগণ যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবি উঠিয়েছেন, যেন কোন রাজনীতিবিদই এটা উল্টিয়ে দিতে না পারেন।
ফাঁসির দাবিতে জনগণের এই প্রতিবাদ এই দীর্ঘদিনের নৈরাশ্য থেকেই উত্থিত হয়েছে। এই মানুষগুলো এতদিন আবেগপূর্ণভাবেই আইনের শাসনের উপর বিশ্বাস রেখেছে। বিগত সময়ে তারা বেশ কয়েকবার দেখেছে যে, বিচারকার্য অনেকক্ষেত্রে সম্পাদিত হয়ে থাকে রাজনীতিবিদদের আদেশে। অনেক ক্ষেত্রে সম্পন্নও হতে পারে না। কিন্তু কাদের মোল্লার বিচারকার্য নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে পর্যবেক্ষকেরা ও চিন্তক বাঙ্গালীরা। শাহবাগ আন্দোলনের চাপের ফলে শেখ হাসিনা সরকার ট্রাইবুন্যালের বিচারকার্যে হস্তক্ষেপ করেছে। সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে রাষ্ট্রপক্ষের দিক থেকে রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের সুযোগ তৈরি করেছে। সবকিছুর উপরে, এটা গুরুত্বপূর্ণ যে, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলো বর্বর হত্যাকারীদের তুলনায় নিজেদেরকে আরও উন্নত অবস্থায় নিয়ে যাবে। তারপরও এই সম্ভাবনা থেকে যায় যে, ইতিহাসের কিছু ঘৃণ্য যুদ্ধাপরাধী কখনোই বিচারের অধীনে আসবে না। তাদেরকে সহায়তাকারী দালালদের হয়তো মাত্র এক বা দুই বছরের কারাদণ্ড ভোগ করতে হবে। এই বিষয়টিই প্রতিবাদকারীদের হতাশার দিকে ঠেলে চিয়েছে।
তাহলে এর সমাধান কী? যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কর্মকাণ্ড নিয়ে গুরুতর সংশয় তৈরি হয়েছে। আর এই ফাঁসির রায়ও কোন সঠিক সমাধান হতে পারে না। কিন্তু গণহত্যাকারীদের যাবজ্জীবন সাজার রায়টাও বাংলাদেশী নাগরিকদের জন্য কোন সম্মান বয়ে আনে না।
এখন আরেকটি সম্ভাবনা থেকে যায়। লাইবেরিয়ার যুদ্ধাপরাধী চার্লস টেলরকে লাইবেরিয়াতে কারাদণ্ড দেওয়া হয়নি। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের কয়েকটি ধারার অধীনে তাকে কারাবন্দী করা হয়েছিল হেগ-এ। আন্তর্জাতিক আইনপ্রণেতাদের হস্তক্ষেপ বাংলাদেশের ক্ষেত্রে কাম্য হতে পারে। এতে করে গণহত্যাকারীদের জাতীয় রাজনীতিবিদদের নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত করা যাবে। এরকমটা করা গেলে, শুধু বাংলাদেশের রাজাকারদেরই না, মূল যুদ্ধাপরাধীদের বিচারও করা সম্ভব হবে।
৭১ সালে যে বাংলাদেশ যে নৃশংশ হামলার শিকার হয়েছিল সেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আর সরকার পরিবর্তনের সাথে সাথে যেন সেটা কেউ নিজ স্বার্থে ব্যবহার করতে না পারে সেটাও জরুরি বিষয়। এখন এমনটাই মনে হচ্ছে যে, এই বিক্ষুব্ধ জাতীয় চেতনা যদি সফলতার মুখ দেখতে চায়, যদি ন্যায়বিচার পেতে চায় তাহলে সেটা বর্হিবিশ্বের চোখের সামনে করতে হবে। বর্হিবিশ্বের মতামতও নিতে হবে। আর গোটা বিশ্বের মানুষদের প্রতি বলছি, আমরা অনেকদিন মুখ ঘুরিয়ে থেকেছি। এই প্রায় ভুলে যাওয়া গণহত্যাটি সম্পর্কে জানা আমাদের কর্তব্য। আর এখানে আমাদের অনেক দায়দায়িত্বও গ্রহণ করতে হবে। গণহত্যাকারীদের আশ্রয় দেওয়া যাবে না। অগ্রাহ্য করা যাবে না। ভুলে যাওয়া যাবে না।
‘মিরপুরের কসাই’
বাংলাদেশ জামায়েতী ইসলামের সহকারী জেনারেল সেক্রেটারী আব্দুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে ঘোষিত যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায় জনগকে বিক্ষুব্ধ করে তোলে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি যে ঘৃণ্য কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেছিলেন তার বিচারকার্য শেষে গত ৫ ফেব্রুয়ারী তাকে এই সাজা দেওয়া হয়। আদালতের এই রায়ে তিনি স্পষ্টতই খুশি হয়েছিলেন। কোর্ট থেকে বাইরে যাওয়ার সময় তিনি সমর্থকদের উদ্দেশ্যে দেখিয়েছেন বিজয় চিহ্ন। কিন্তু মিরপুরের কসাইখ্যাত কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে এই রায়ে মুহূর্তের মধ্যেই ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বাংলাদেশের সাধারণ জনগণ। ৭১ সালে কাদের মোল্লা এক কবির মাথা কেটে নেন, ১১ বছর বয়সী এক মেয়েকে ধর্ষণ করেন। আর হত্যা করেন ৩৪৪ জনকে। এখন এই কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসির রায় ঘোষণা করার দাবি জানাচ্ছেন বাংলাদেশের মানুষ। আরেক অভিযুক্ত যুদ্ধাপরাধী আবুল কালাম আজাদকে যেমনটা দেওয়া হয়েছে।
ফিলিপ হেনশার
লেখাটি গত ১৯ ফেব্রুয়ারী ছাপা হয়েছিল যুক্তরাজ্যের দৈনিক ইনডিপেনডেন্ট পত্রিকায়।