Posts Tagged ‘ নিউরন ’

অপটোজেনেটিকস: মস্তিস্ক নিয়ন্ত্রণের হাতিয়ার নাকি মনোবিজ্ঞানের নতুন দিগন্ত?

optogenetics-neuron-640x353গত দশকে বিজ্ঞান জগতের অন্যতম প্রধান ক্ষেত্র ছিলস্নায়ুবিজ্ঞান। মানুষের মস্তিস্ক সম্পর্কে জানা-বোঝা তৈরি হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় গবেষণাকর্ম ব্যাপকভাবে শুরু হয় ৯০-এর দশকে নতুন এক প্রযুক্তি আবিস্কারের পর। এমআরআই নামক এই প্রযুক্তির কল্যানে আমরা এখন মস্তিস্কের সকল কার্যকলাপের পূর্ণাঙ্গ চিত্র পাই। এই প্রযুক্তি ব্যবহার করেই গত বছরের শেষে প্রথমবারের মতো মানব মস্তিস্কের পূর্ণাঙ্গ মানচিত্র হাজির করতে পেরেছেন বিজ্ঞানীরা। কিন্তু এবার স্নায়ুবিজ্ঞানের জগতে হয়তো আরেকটি নতুন বিপ্লব সাধিত হতে যাচ্ছে। যুগান্তকারী এই নতুন প্রযুক্তির ব্যপকতা হতে পারে অনেক অনেক বেশি। ‘অপটোজেনেটিকস’ নামের এই প্রযুক্তিটির মাধ্যমে যে কোন প্রাণীর মস্তিস্কের নির্দিষ্ট কোন কোষ বা নিউরনের কার্যকলাপ ইচ্ছামাফিক বন্ধ বা চালু করা সম্ভব হবে। আক্ষরিক অর্থেই মস্তিস্ক নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে এই প্রযুক্তি দিয়ে। আবার রহস্যময় মস্তিস্ক সম্পর্কে আমাদের বোঝাপড়ার পরিধি অনেকখানি বাড়িয়ে দিতে পারে এই প্রযুক্তির ব্যবহার। নতুন দিগন্তের সূচনা হতে পারে মনোবিজ্ঞানে।

অপটোজেনেটিকস এর ভাবনাটা প্রথম আসে ১৯৭৯ সালে। যখন ডিএনএর গঠন আবিস্কারকারী তিন বিজ্ঞানীর একজন ফ্রান্সিস ক্রিক বলেছিলেন যে, মস্তিকের একটা নির্দিষ্ট কোষকে কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায় এটা শেখার চেষ্টা করা উচিৎ স্নায়ুয়ুবিজ্ঞানীদের। কল্পনা করুন যে, একটা প্রাণীর মস্তিস্কের কোন কোন নিউরন আপনি চালু অথবা বন্ধ করে দিতে পারছেন, বাইরে থেকে। শুনে মনে হচ্ছে যেন, একটা জলজ্যান্ত প্রাণীকে রোবট বানিয়ে ফেলার মতো বা বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর মতো। তাই না? কিন্তু ৩০ বছর পরের কথা কল্পনা করুন, হয়তো এই অপটোজেনেটিকসের অস্তিত্বটাই হবে বাস্তবতা।
বর্তমান সময়েই আমরা কোন প্রাণীর মস্তিস্কে কিছু ছোট ইলেকট্রোড বসিয়ে তার স্নায়ুগুলোকে উদ্দীপ্ত করতে পারি। এটা করা হয় তড়িৎপ্রবাহের মাধ্যমে। খুবই ছোট, সুক্ষ ইলেকট্রোডও আমাদের কাছে আছে। কিন্তু এগুলো দিয়ে কাজ করাটা খুবই নির্দয়ের মতো ব্যাপার হয়ে যায়। ক্রিক অনুমান করেছিলেন যে, আলোকরশ্মি ব্যবহার করে এই কাজটা করা যায়। সেটাই সত্যি হয়ে দাঁড়িয়েছে। অপটোজেনেটিকস প্রযুক্তিতে প্রথমে কোন প্রাণীর মস্তিস্কে একটা ফাইপার অপটিক যন্ত্র স্থাপন করা হয়। তারপর সেখান থেকে আলোকরশ্মি পাঠিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা হয় মস্তিস্কের নির্দিষ্ট কোন নিউরনকে।
কিন্তু শুধু মস্তিস্কে আলোকরশ্মি নিক্ষেপ করতে পারাটাই যথেষ্ট নয়। এই পদ্ধতিতে কাজ করতে গেলে প্রথমেই নিউরনগুলোকে নতুনভাবে বিন্যস্ত করতে হবে যেন তারা আলোক সংবেদী হয়ে ওঠে। কারণ সাধারণ অবস্থায় মানুষের নিউরণে এই আলোক সংবেদী প্রোটিনের উপস্থিতি থাকে না। এই অধ্যায়ের কাজটা সম্ভব হয়েছে নতুন ধরণের এই প্রোটিনের বিস্ময়কর আবিস্কারের পর। এই প্রোটিন ব্যবহার করে নিউরনগুলোকে আলোক সংবেদনশীল করে তোলা সম্ভব, যেন তাদেরকে চালু বা বন্ধ করা যায়।
ফলে এবার বিজ্ঞানীদের ভাবতে হলো যে, কিভাবে এই প্রোটিন নিউরনে প্রবেশ করানো যায়। এই অধ্যায়ের কাজটা করা হয় একধরণের জিন প্রকৌশলীর মাধ্যমে। যার বৈজ্ঞানিক নাম ‘ট্রান্সফেকশন’। এই প্রক্রিয়ায় নিউরনের মধ্যে ‘ভেকটর’ নামক একধরণের ভাইরাসের মতো উপাদান ঢোকানো হয় এবং এর মাধ্যমে নিউরণে কিছু জীনগত উপাদান প্রবেশ করানো হয়। যার ফলে নিউরনগুলো এই আলোক সংবেদী প্রোটিন তৈরি করা শুরু করে।
এই পুরো প্রক্রিয়ার ফসল হচ্ছে একটা বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর মতো প্রযুক্তি। জীবিত ও হেঁটেচলে বেড়ানো প্রাণীদের মস্তিস্কে থাকবে জীনগতভাবে পরিবর্তিত নিউরন, যেগুলো আমরা নিজেদের ইচ্ছামতো বন্ধ বা চালু করতে পারব। অপটিক ও জেনেটিক্স এর এই সম্মিলিত ব্যবহার থেকেই প্রযুক্তিটি তার নাম পেয়েছে, ‘অপটোজেনেটিকস’।

opto1
কিন্তু যুগান্তকারী এই প্রযুক্তিটা কিভাবে কাজ করে সেটার থেকেও উত্তেজনাকর বিষয় হলো, এই প্রযুক্তিটা দিয়ে কী করা হবে। বিজ্ঞানীরা এটা একারণে উদ্ভাবন করেননি যেন, কোন প্রাণীর মস্তিস্কের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেওয়া যায়। এমআরআইয়ের মতো তাঁরা এটা বানিয়েছেন মস্তিস্ক সম্পর্কে আরও ভালো বোঝাপড়া তৈরি করার উদ্দেশ্যে। মস্তিকের নির্দিষ্ট কোন নিউরন উদ্দীপিত করে তাঁরা বুঝতে চান যে, কিভাবে এই মস্তিস্ক কাজ করে। ইতিমধ্যেই অপটোজেনেটিকস-এর প্রায়োগিক কিছু ব্যবহার করে সন্তোষজনক সাফল্যও অর্জন করেছেন স্নায়ু ও মনোবিজ্ঞানীরা।
মস্তিস্কে নিউরন কিভাবে ডোপামিন তৈরি করে এবং সেটা কিভাবে পুরস্কার বা আনন্দ পাওয়ার অনুভূতি জোগায় এটা বোঝার জন্য বিজ্ঞানীরা অপটোজেনেজিকসের ব্যবহার করেছেন। এটা ভালোমতো বুঝতে পারলে বিষন্নতা জনিত চিকিৎসায় ঔষুধের কার্যকারীতা সম্পর্কে আরও স্পষ্ট ধারণা পাবেন চিকিৎসকরা।
আরেকটি ক্ষেত্রে, পার্কিনসন রোগে আক্রান্ত একটি প্রাণী মস্তিস্কের নির্দিষ্ট কিছু কোষ উদ্দীপ্ত করেছিলেন বিজ্ঞানীরা। যে রোগে মস্তিস্কের তথ্য প্রক্রিয়াকরণের সময় ব্যাঘাত ঘটে। এই গবেষণা থেকে বিজ্ঞানীরা নতুন ধারণা পেয়েছেন রোগটি সম্পর্কে এবং এর চিকিৎসা পদ্ধতি সম্পর্কে।
স্কিজোফ্রেনিয়া এধরণেরই আরেকটি মানসিক ভারসাম্যহীনতা যেখানে মস্তিস্কের তথ্য প্রক্রিয়াকরণ পর্বটি জড়িত। মস্তিকের অভ্যন্তরীণ একটা কার্য্যসাধন পদ্ধতি কাজ না করার কারণেই একজন মানুষ বুঝতে পারে না যে, কাল্পনিক কোন চরিত্রের উপস্থিতি, কারও কণ্ঠস্বর শুনতে পাওয়া এই জাতীয় ভ্রমগুলো বাস্তব না, একান্তই তাঁর কল্পনাপ্রসূত। স্বাভাবিক একটা মানুষের মস্তিস্কে ‘গামা অসকিলেশন’ নামক একটি ক্রিয়ার উপস্থিতি থাকে। স্কিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত মানুষের মস্তিস্কে এটি থাকে ভারসাম্যহীন অবস্থায়। অপটোজেনেটিকস প্রযুক্তি ব্যবহার করে এই গামা অসকিলেশনের কার্যকলাপ সম্পর্কে আরও পরিস্কার বোঝাপড়া তৈরি করা সম্ভব বলে আশাবাদী বিজ্ঞানীরা। যার ফলে বিভিন্ন ধরণের মানসিক ভারসাম্যহীনতা সম্পর্কে ভালো ধারণা তৈরি করতে সক্ষম হওয়া যাবে।
অপটোজেনেটিকস প্রযুক্তি দিয়ে আমরা বদলে ফেলতে পারি আমাদের মানসিক অসুস্থতার চিকিৎসা পদ্ধতি। এমনকি আমরা জানা শুরু করতে পারি যে, কেন আমরা মানুষ হিসেবে এইরকম স্বতন্ত্র হয়ে উঠতে পেরেছি। বুঝে ওঠা শুরু করতে পারি আমাদের মস্তিস্কের অকল্পনীয় ও রহস্যময় কর্মক্ষমতাকে।

সভ্যতার আদল গড়া নিউরনগুলো

স্নায়ুবিজ্ঞানী বিলয়ানুর রামাচন্দ্রন কথা বলেছেন মিরর নিউরনের আকর্ষণীয় কার্যাবলী নিয়ে। খুব সাম্প্রতি আবিস্কৃত হয়েছে যে, এই নিউরণগুলোর মাধ্যমে আমরা কিভাবে জটিল সামাজিক আচরণবিধিগুলো দ্রুত শিখে ফেলি। যেগুলোর কিছু কিছু আমাদের চেনাজানা মনুষ্য সভ্যতারই ভিত্তি গড়ে দিয়েছে।

আমি আজ আপনাদের সামনে কথা বলতে চাই মনুষ্য মস্তিস্ক নিয়ে। ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা এই বিষয়টা নিয়েই গবেষণা করি। এক মুহূর্তের জন্য এই সমস্যাটা নিয়ে একটু ভাবুন। এই হল একটা মাংস পিণ্ড। মোটামুটি তিন পাউন্ড ওজনের, যেটা আপনি আপনার হাতের তালুর মধ্যেই ধরতে পারেন। কিন্তু এটা এই আর্ন্তনক্ষত্রিক জগতের বিশালত্বকেও ধারণ করতে পারে। এটা অসীমের অর্থকে ধারণ করতে পারে। আপনি আপনার নিজের অস্তিত্বের অর্থ নিয়েও প্রশ্ন করতে পারেন। প্রশ্ন করতে পারেন ঈশ্বরের প্রকৃতি নিয়েও।

আর এটা সত্যিই এই দুনিয়ার সবচেয়ে বিস্ময়কর জিনিস। এটা্ই মনুষ্য প্রজাতির কাছে একটা বিশাল রহস্য। কিভাবে এ-সব কিছু এল? তো, এই মস্তিস্কটা, যেমনটা আপনি জানেন, তৈরি হয়েছে নিউরন দিয়ে। আমরা এখানে নিউরনগুলোকে দেখছি। পূর্ণবয়স্ক একজন মানুষের মস্তিস্কে প্রায় ১০০ বিলিয়ন নিউরন থাকে। আর মস্তিস্কের মধ্যে এই প্রতিটি নিউরন প্রায় ১০০০ বা ১০,০০০ অন্যান্য নিউরনের সঙ্গে যোগাযোগ করে। এটা মাথায় রেখে, মানুষ হিসেব করেছে যে, এই পরিমাণ মস্তিস্ক কার্যকলাপের permutation ও combination -এর অঙ্কটা মহাবিশ্বের সব মৌলিক কনিকার সংখ্যাকেও ছাড়িয়ে যায়।

তো, আপনি কিভাবে এই মস্তিস্ক নিয়ে জানাবোঝাটা শুরু করবেন? একটা পদ্ধতি হলো, সেইসব রোগীদের নিয়ে পরীক্ষা করা যাদের মস্তিস্কের বিভিন্ন অংশে ক্ষত আছে, এবং এটার উপর নির্ভর করে তাদের আচরণের পরিবর্তন পর্যালোচনা করা। এটা নিয়েই আমি TED এ গতবার কথা বলেছি। আজ আমি একটা ভিন্ন ধরণ নিয়ে কথা বলব। যেটা হলো: মস্তিস্কের বিভিন্ন অংশে ইলেকট্রোড লাগানো। যেন সত্যি সত্যিই মস্তিস্কের একেকটা স্বতন্ত্র স্নায়ুকোষের কার্যকলাপ রেকর্ড করা যায়।

এখন, খুব সমপ্রতি একটা আবিস্কার সাধিত হয়েছে ইতালির পারমায়। জিয়াকোমো রিজোলাত্তি ও তাঁর সহকর্মী গবেষক দলের দ্বারা। সেটি হলো, এক ধরণের গুচ্ছ নিউরণের উপস্থিতি। যাদেরকে বলা হয় মিরর নিউরন। যেগুলো থাকে মস্তিস্কের সামনে, ফ্রন্টাল লোবসে। এখন, এই আবিস্কারটা এতদিন ধরে জানা একটা ধারণাকে উল্টে দেয় যে, মস্তিস্কের সামনে থাকা নিউরনগুলো সাধারণ মোটর কমান্ড নিউরন। এটাই আমরা জানি বিগত ৫০ বছর ধরে। এই নিউরনগুলো সক্রিয় হবে, যখন কোন ব্যক্তি কোন নির্দিষ্ট একটা কাজ করতে যাবেন। উদাহরণ হিসেবে, যদি আমি এটা করতে যাই, একটা আপেলের কাছে পৌঁছাতে চাই ও সেটা ধরতে চাই, তাহলে আমার মস্তিস্কের সামনে থাকা একটা মোটর কমান্ড নিউরন সক্রিয় হবে ও আমাকে নির্দেশ দিবে সেই বস্তুটা ধরে ফেলতে। এইগুলো হলো মোটর কমান্ড নিউরন। এটাই আমরা জানি একটা লম্বা সময় ধরে।

কিন্তু রিজোলাত্তি যা পেয়েছেন, তা হলো এই নিউরনগুলোরই একটা সাবসেট। সম্ভবত এগুলোর ২০ শতাংশ মতো। এই নিউরনগুলো সক্রিয় হবে, যখন আমি অন্য কাউকেও ঐ একই কাজ করতে দেখব। তো, এগুলো সেই নিউরন, যেটা সক্রিয় হবে যখন আমি নিজে কোন কাজ করতে যাব এবং তখনও, যখন আমি জো-কে কোন একটা বস্তুর কাছে পৌঁছাতে ও ধরতে দেখব। আর এটা সত্যিই তাক লাগানোর মতো। কারণ ব্যাপারটা এরকম যে, এই নিউরনগুলো অন্য মানুষদের দৃষ্টিভঙ্গিটাও গ্রহণ করছে। এই নিউরনগুলো মস্তিস্কের মধ্যে অন্য মানুষদের কার্যকলাপের একটা ভার্চুয়াল রিয়েলিটি স্টিমুলেশন তৈরি করে।

এখন, এই মিরর নিউরনগুলোর গুরুত্বটা কোথায়? একটা হলো, এগুলো নিশ্চিতভাবেই কোন ব্যক্তিকে অনুকরণ ও তার সমকক্ষ হওয়ার চেষ্টা করা জাতীয় জিনিসের সঙ্গে সম্পর্কিত। কারণ একটা জটিল কাজ অনুকরণ করতে হলে আমার মস্তিস্ককে অন্য মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করতে পারতে হবে। তো, এটা অনুকরণ করা ও কারও সমকক্ষ হতে পারার জন্য জরুরি। আচ্ছা, এটা গুরুত্বপূর্ণ কেন? এবার আমরা নজর দেই পরবর্তী স্লাইডে। তো, আপনি কিভাবে এই অনুকরণ করেন? কেনই বা এটা গুরুত্বপূর্ণ? মিরর নিউরন আর অনুকরণ, কারও সমকক্ষ হওয়ার চেষ্টা?

এখন আমরা একটু নজর দেই সংস্কৃতির দিকে। মনুষ্য সংস্কৃতি প্রত্যয়টার দিকে। আপনি যদি প্রায় ৭৫ হাজার থেকে একশ হাজার বছর পিছিয়ে গিয়ে মানুষের বিবর্তনটা দেখেন, তো দেখবেন, প্রায় ৭৫ হাজার বছরের কাছাকাছি সময়ে খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু ঘটেছিল। আর সেটা হলো একটা তড়িত্ উত্থান ও দ্রুতই খুব দক্ষতাপূর্ণ কর্মকাণ্ড, যেগুলো মানুষেরই বিশেষত্ব, যেমন হাতিয়ার, আগুন, বাসস্থানের ব্যবহার এবং অবশ্যই ভাষার ব্যবহার। এবং অন্য কোন মানুষের চিন্তা অনুমান করতে পারার ও সেই মানুষের আচরণ অনুধাবন করতে পারার ক্ষমতা। এই সবকিছুই হয়েছিল তুলনামূলক দ্রুততার সঙ্গে।

যদিও মনুষ্য মস্তিস্ক তার বর্তমান আকারটা পেয়েছিল প্রায় তিন বা চারশ হাজার বছর আগে। কিন্তু একশ হাজার বছর আগে এই সবকিছু ঘটেছিল খুবই খুবই দ্রুত। আর আমার দাবি হলো, এ সবকিছুর মূলে ছিল একটা সুক্ষ মিরর নিউরন ব্যবস্থার উদ্ভব। যেটা আপনাকে অন্য মানুষদের কাজের অনুকরণ ও তার সমকক্ষ হতে সামর্থ্য যোগায়। তো, তার ফলে যখন কোন গোষ্ঠীর একজন সদস্য একটা আকস্মিক আবিস্কার করে ফেলে, ধরেন, আগুনের ব্যবহার বা নির্দিষ্ট কোন হাতিয়ারের ব্যবহার আবিস্কার করে ফেলে, তখন পরবর্তীতে তা বিস্মৃত হয়ে যাওয়ার বদলে এটা দ্রুতই সমগ্র জনমানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে প্রবাহিত হয়।

তো, এর ফলে বিবর্তনটা হঠাত্-ই ডারউইনিয়ান বিবর্তন না হয়ে, হয়ে পড়ে লামারকিয়ান বিবর্তন। ডারউইনিয়ান বিবর্তন খুব ধীরগতির, এটা নেয় কয়েকশ হাজার বছর। একটা পোলার বিয়ার থেকে কোট বানাতে এটা নেয় কয়েক হাজার প্রজন্ম। হয়ত একশ হাজার বছর। কিন্তু একটা মানুষ, একটা বাচ্চা, শুধু তার মা-বাবাকে একটা পোলার বিয়ার মেরে ফেলে সেটার চামড়াটা গায়ে জড়াতে দেখে। আর একধাপেই সেটা শিখে ফেলে। একটা পোলার বিয়ার যা শিখতে একশ হাজার বছর সময় নেয়, সেটা একটা মানুষের বাচ্চা ৫ মিনিটেই শিখতে পারে। বা ১০ মিনিটে। আর যখন এটা শেখা হয়ে গেল, তখন তা বাকি জনসমষ্টির মধ্যে ছড়িয়ে যায় গানিতিক হারে।

এটাই হলো ভিত্তি। জটিল কাজগুলোর অনুকরণ করতে পারাই হলো, যেটাকে আমরা বলি সংস্কৃতি আর এটাই সভ্যতার ভিত্তি। এখন, মস্তিস্কে আরেক ধরণের মিরর নিউরণ আছে, যেগুলো কিছুটা ভিন্ন ধরণের কাজে সম্পৃক্ত থাকে। কোন কাজের জন্য যেমন মিরর নিউরন থাকে। তেমনি কিছু মিরর নিউরন আছে স্পর্শ অনুভবের ক্ষেত্রে। অন্যভাবে বলা যায়, যদি কেউ আমাকে স্পর্শ করে, আমার হাত স্পর্শ করে, তাহলে মস্তিস্কের, সেনসোরি অঞ্চলের স্টোমাটোসেন্সরি কোরটেক্স-এর নিউরন সক্রিয় হবে। কিন্তু, এই একই নিউরন, কিছু ক্ষেত্রে সক্রিয় হয়ে উঠবে, যখন আমি অন্য কোন মানুষকেও স্পর্শ পেতে দেখবে। তো, এটা অন্য মানুষের স্পর্শ পাওয়ার অনুভূতির সঙ্গেও একাত্ম বোধ করছে।

তো, এই নিউরনগুলো বেশিরভাগই সক্রিয় হবে, যখন আমি শরীরের বিভিন্ন অংশে স্পর্শানুভূতি লাভ করব। ভিন্ন ভিন্ন অংশের জন্য ভিন্ন ভিন্ন নিউরন সক্রিয় হবে। কিন্তু এগুলোর একটা সাবসেটও সক্রিয় হবে, যদি আমি শুধু অন্য কাউকে শরীরের সেই একই অংশে স্পর্শ পেতে দেখি। তো, এখানে আবার আমরা কিছু নিউরন পাচ্ছি, যেগুলো অন্য কারো স্পর্শানুভূতির সঙ্গে একাত্মতা জানাচ্ছে। এখন, তাহলে প্রশ্নটা ওঠে যে: যদি আমি শুধু অন্য একজন ব্যক্তিকে স্পর্শ পেতে দেখি, তাহলে আমি কেন কনফিউসজড হয়ে যাই না, আর কেন শুধু অন্য ব্যক্তির স্পর্শানুভূতি দেখে আমি আক্ষরিকভাবেই সেই স্পর্শ অনুভব করি না? আমি বলতে চাচ্ছি যে, আমি ঐ ব্যক্তির আবেগ-অনুভূতির সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করলাম, কিন্তু আমি তো সত্যি সত্যিই সেই স্পর্শটা অনুভব করলাম না। এর কারণ হচ্ছে, আপনার ত্বকে কিছু রিসেপটর আছে। স্পর্শ ও ব্যাথা অনুভবের রিসেপটর। এগুলো আপনার মস্তিস্কে ফিরে যায়, আর গিয়ে বলে, “চিন্তা করো না, তোমাকে স্পর্শ করা হয় নি।” তো, অন্য ব্যক্তির আবেগ-অনুভূতির সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশের মাধ্যমে আপনি সত্যি সত্যিই স্পর্শ অনুভব করেন না। এছাড়া হয়তো আপনি বিভ্রান্ত হয়ে পড়তেন ও তালগোল পাকিয়ে ফেলতেন।

আচ্ছা। তো, এই রিসেপটরগুলোর ফিরতি সাড়া, মিরর নিউরনের সিগন্যালগুলোকে বাতিল করে দেয়। ফলে আপনি সচেতনভাবে সেই স্পর্শ অনুভব করেন না। কিন্তু যদি আপনি আপনার একটা হাত সড়িয়ে ফেলেন, আপনি হাতটাকে অবশ করে ফেলেন, আপনি আমার হাতে একটা ইঞ্জেকশন দিয়ে ব্রাচিয়াল প্লেক্সাস অবশ করে ফেললেন, এখন আমার হাত একেবারে সাড়হীন। এর মধ্য দিয়ে আর কোন অনুভূতি প্রবাহিত হচ্ছে না। এখন যদি আমি আপনাকে স্পর্শ পেতে দেখি, তাহলে আমি সত্যি সত্যিই আমার হাতে সেই স্পর্শ অনুভব করতে পারব। অন্যভাবে বললে, আপনি আপনার ও অন্য মানুষদের মধ্যে বিদ্যমান ব্যারিয়ার সড়িয়ে দিয়েছেন। তো, আমি এদেরকে ডাকি গান্ধি নিউরন বলে। বা একাত্মতার নিউরন (হাসি)

আর এটা কোন বিমূর্ত রূপক অর্থে না। আপনাকে, তার কাছ থেকে অন্য মানুষদের কাছ থেকে দূরে সড়িয়ে রেখেছে আপনার ত্বক। ত্বকটা সড়িয়ে ফেলুন, আপনি আপনার মাথায় অন্য মানুষদের স্পর্শানুভূতিও অনুভব করতে পারবেন। আপনি আপনার ও অন্য মানুষদের মধ্যে বিদ্যমান ব্যারিয়ার সড়িয়ে ফেলতে পারবেন। আর এটাই, বেশিরভাগ প্রাচ্য দর্শনের ভিত্তি, যে, অন্য মানুষদের থেকে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় সত্যিকারের কোন স্বাধীন-স্বতন্ত্র মনুষ্য সত্তা নেই। আপনারা, বস্তুত শুধু ফেসবুক বা ইন্টারনেট দিয়েই যে সংযুক্ত আছেন, তা-ই নয়। বরং আপনারা সত্যিকার অর্থে পরস্পরের সাথে সংযুক্ত আছেন আপনাদের নিউরন দিয়ে। আর এই মুহূর্তে এই ঘরে এই নিউরনগুলোর একটা বন্ধন আছে। তারা কথা বলছে পরস্পরের সঙ্গে। আর সত্যিই আপনার সচেতনতা ও অন্য কারও সচেতনতার মধ্যে কোন ভিন্নতা নেই।

আর এটা কোন আউল-ফাউল দর্শন না। এটা গড়ে উঠেছে আমাদের স্নায়ুবিজ্ঞানের গোড়ার দিককার বোঝাপড়া থেকে। তো, আপনার কাছে অলীক হাতওয়ালা কোন ব্যক্তি আছে। যদি হাতটা সড়িয়ে দেওয়া হয় আর আপনার কাছে ঐ অলীক হাতটা আসে, তখন যদি আপনি অন্য কাউকে স্পর্শ পেতে দেখেন, তাহলে আপনি আপনার ঐ অদৃশ্য হাতে সেই স্পর্শ অনুভব করবেন। আরও মজার জিনিস হলো, যদি আপনি আপনার ঐ অলীক হাতটাতে ব্যাথা অনুভব করেন, তাহলে আপনি অন্য কোন ব্যক্তির হাত মালিশ করে দিতে দেখলেও আপনার ব্যাথার নিরাময় অনুভব করতে পারবেন। একদম যেন, এই নিউরনগুলো আপনাকে ব্যাথার উপশম করে দিচ্ছে শুধুই অন্য কারও হাত মালিশ করতে দেখে।

তো, এবার আমার শেষ স্লাইড। দীর্ঘদিন যাবত মানুষ বিজ্ঞান ও মানবিক— এই দুইটাকে জ্ঞানচর্চার দুইটা পৃথক শাখা হিসেবে বিবেচনা করে এসেছে। সি.পি.স্নো বলেছেন দুইটা ভিন্ন সংস্কৃতির কথা। একদিকে বিজ্ঞান, অন্যদিকে মানবিক। কখনোই এই দুইয়ের মিলন হয়নি। মিরর নিউরন ব্যবস্থার কার্যকলাপের উপর দৃষ্টিপাত করে আমি বলতে চেয়েছি, এটা আপনাকে সুযোগ করে দেয় সচেতনতা, আত্মসত্তার উপস্থাপন, কী আপনাকে অন্য মানুষদের থেকে পৃথক করে রাখে, কিভাবে আপনি অন্য মানুষদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেন ইত্যাদি বিষয় নিয়ে আরেকবার চিন্তা করার। এমনকি সংস্কৃতি ও সভ্যতার উদ্ভব কেমন করে হলো তা নিয়েও। যে বিষয়গুলো খোদ মনুষ্য প্রজাতিরই বিশেষত্ব। ধন্যবাদ। (হাততালি)

আসছে মস্তিস্কসদৃশ কম্পিউটার চিপ!

মানুষের মতো কোন কিছু শিখে নেওয়ার ক্ষমতা আছে কম্পিউটারেরও। কিন্তু মানুষের মস্তিস্কের মতো করে চিন্তাভাবনা করে কাজ করতে পারবে এমন কম্পিউটার তৈরি করা সম্ভব হয় নি এখনও। কারন মস্তিস্কের আদলে কম্পিউটার বানানোর কাজটা একই সাথে প্রাযুক্তিক ও মনস্তাত্বিক। তাই এটা করতে গিয়ে বার বার সীমাবদ্ধতার মধ্যেই পড়েছে কম্পিউটার ও মস্তিস্ক বিজ্ঞান। তবে সম্প্রতি এই দুই জগতের মেলবন্ধন ঘটাতে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের কমিপউটার নির্মাতা প্রতিষ্ঠান আইবিএম কর্পোরেশন। মস্তিকের আদলে কম্পিউটার তৈরির কাজে অনেক অগ্রগতি হয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির গবেষকরা। ঘোষণা করেছেন যে, তাঁরা নতুন ধরণের কম্পিউটার চিপ বানাতে সক্ষম হয়েছেন, যা মানুষের মস্তিস্কের মতোই কাজ করবে।

প্রায় ১০০ জন গবেষকের টানা ছয় বছরের নিরলস প্রচেষ্টার পর এই নতুন চিপটি বানানোর কাজে অনেকখানি এগিয়ে গেছে আইবিএম। এখন পর্যন্ত এই গবেষণায় খরচ হয়েছে প্রায় ৪১ মিলিয়ন ডলার। নতুন এই যুগান্তকারী প্রযুক্তিটিকে ‘সৃজনশীল কম্পিউটিং’ বলে আখ্যায়িত করেছেন আইবিএমের গবেষকরা। নব আবিস্কৃত এই চিপটি মস্তিস্কের নিউরন ও সিনাপসের মতো কাজ করবে। যার ফলে পূর্ব পরিচিত নয়, এমন তথ্যের সঙ্গেও খাপ খাইয়ে নিতে পারবে এই চিপ ব্যবহারকারী কম্পিউটার। আইবিএমের গবেষক গুইলিও টোটোনি বলেছেন, ‘আগে থেকে নির্দেশনা দেওয়া হয় নি এমন কোন প্রোগ্রাম বা তথ্যের সঙ্গে মানিয়ে নিয়েও কাজ করতে পারবে এই চিপটি। কিন্তু চিপটা কী কাজ করছে, এটা গুরুত্বপূর্ণ না। আমাদের লক্ষ্য করতে হবে এটা কাজটা কী পদ্ধতিতে করছে, সেইদিকে।’

তবে নতুন এই চিপটি গবেষণাগার থেকে বেরিয়ে জনসমক্ষে আসতে আরও অনেক সময় লাগবে বলে মনে করছেন বিজ্ঞানীরা। অবশ্য এই গবেষণার ক্ষেত্রে একটা গুরুত্বপূর্ণ ধাপ যে অতিক্রম করা গেছে, এ ব্যাপারে সন্দেহ নেই কারোরই। আইবিএমের এই প্রকল্পের প্রধান গবেষক ধর্মেন্দ্র মোধা বলেছেন, ‘পুরো ব্যাপারটা আমরা ‘যদি হয়’ থেকে ‘এবার কী’-তে নামিয়ে এনেছি। শুরুতে অনেক সন্দেহ-সংশয় থাকলেও আজ আমরা প্রমাণ করেছি যে, এটা সত্যিই সম্ভব। সামনে আমাদের হয়ত আরও অনেক বাধার সম্মুখীন হতে হবে। কিন্তু প্রথম ধাপের কাজটা আমরা সফলভাবেই শেষ করেছি।’— ইকোনমিক টাইমস