Posts Tagged ‘ দক্ষিণ আফ্রিকা ’

স্বপ্নের পিছু ছাড়া যাবে না: শচীন

বহু প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে অবশেষে শততম শতকটির দেখা পেয়েছেন শচীন টেন্ডুলকার। আজ এশিয়া কাপের চতুর্থ ম্যাচে বাংলাদেশের বিপক্ষেই ক্রিকেট বিশ্বকে নতুন এই মাইলফলকটির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন সর্বকালের অন্যতম সেরা এই ব্যাটসম্যান।

এই একটি সেঞ্চুরির জন্য দীর্ঘ এক বছরের প্রতীক্ষা যে পাহাড় সমান চাপ তৈরি করেছিল, সেটা অস্বীকার করেননি শচীন। ক্যারিয়ারের শততম শতকটি পূর্ণ করার পর যেন ৫০ কেজি ওজনের ভার কমে গেছে বলে সাংবাদিকদের জানান ভারতের এই ব্যাটিং কিংবদন্তী। অনন্য এই কীর্তিটি করে শচীন দেখিয়ে দিয়েছেন অসম্ভব বলে আসলে কিছুই নেই। দীর্ঘ ২২ বছরের ক্যারিয়ারে ব্যাটিং রেকর্ডের প্রায় সবকিছুই নিজের দখলে নিয়ে আসার পর তরুণ ক্রিকেটারদের প্রতি শচীনের আহ্বান, ‘স্বপ্নের পিছু কখনো ছাড়া যাবে না।’

গত বিশ্বকাপে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে করা ৯৯তম আন্তর্জাতিক সেঞ্চুরির পর থেকেই শচীনের ব্যাটের দিকে উত্সুক চোখে তাকিয়ে ছিল গোটা ক্রিকেট বিশ্ব। শচীনের সেঞ্চুরির আশায় ‘এবারই হবে!’, ‘এই ম্যাচেই তাহলে হচ্ছে!’ ইত্যাদি লিখতে লিখতে ক্রীড়া সাংবাদিকরা ক্লান্তই হয়ে পড়েছিলেন বলা যায়। কিন্তু শচীনের এই শততম সেঞ্চুরিটির দেখা পেতে পার হয়ে গেছে পুরো একটা বছর। চারপাশের এই ধরণের আলোচনা-সমালোচনা যে প্রচণ্ড চাপ তৈরি করেছিল সেটা নির্দ্বিধায় স্বীকার করেছেন শচীন। তবে তিনি যে শুধু সেঞ্চুরির জন্যই মাঠে নামেন না, বরং দলের সামষ্টিক পারফরমেন্সই যে তাঁর প্রধান বিবেচ্য বিষয়, সেটাও সাংবাদিকদের মনে করিয়ে দিয়েছেন লিটল মাস্টার। ভারতীয় ইনিংস শেষ হওয়ার পর এক সাক্ষাত্কারে তিনি বলেছেন, ‘সত্যি বলতে, একদম এক বছর আগে আমি যখন ৯৯তম সেঞ্চুরিটি করেছিলাম, তখন এ নিয়ে কেউই খুব বেশি কথা বলেনি। কিন্তু এরপর গণমাধ্যমগুলোই প্রথমে এটা শুরু করেছিল। তারপর সব জায়গাতেই যেখানে আমি গিয়েছি, আমাকে এই শততম সেঞ্চুরির কথাই শুনতে হয়েছে। এটা খুবই কঠিন পরিস্থিতি। আমি তো শুধু শততম সেঞ্চুরির জন্যই খেলি না। আমি সবসময়ই দলের সামগ্রিক পারফরমেন্সই প্রধান হিসেবে বিবেচনা করেছি।’

ছোটরা, যারা ব্যাট হাতে হয়ে উঠতে চায় আগামীর শচীন, তাদের উদ্দেশ্যে কী বলবেন এমন প্রশ্নের জবাবে ভারতের ব্যাটিং আইকন বলেছেন, ‘খেলাটা উপভোগ করো, আর নিজের স্বপ্নের পিছু করো। স্বপ্ন সত্যি হয়। আমাকে অপেক্ষা করতে হয়েছে দীর্ঘ ২২ বছর। স্বপ্নের পিছু করা কখনোই বাদ দিও না।’

নিজের উপর আত্মবিশ্বাস আর নিজের স্বপ্নের পিছনে ছুটতে ছুটতেই ক্রিকেটের রেকর্ড বুকে শচীন এমন এক জায়গা করে নিয়েছেন, যেখানে অন্য কারও পৌঁছানো আর সম্ভব হবে কিনা, তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় আছে। কাজেই এমন উপদেশ এখন শচীনের মুখেই মানায়। আগামীতে এই উপদেশ অনুসরণ করেই কেউ হয়ত তাঁর তৈরি করা মাইলফলকগুলো ছুঁয়ে ফেলতে পারবে।

বাংলাদেশকেই বেছে নিলেন শচীন

বাংলাদেশকেই বেছে নিলেন শচীন

এ মাসের ১২ তারিখে সেঞ্চুরি-খরার এক বছর পূর্ণ করেছিলেন শচীন টেন্ডুলকার। গত বছরের ১২ মার্চ ক্যারিয়ারের ৯৯তম সেঞ্চুরি পাওয়ার পর থেকেই শচীনের ব্যাটের দিকে তাকিয়ে ছিল গোটা ক্রিকেট বিশ্ব। কিন্তু এক বছরের দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর অবশেষে বহু আকাঙ্ক্ষিত সেঞ্চুরির দেখা পেয়েছেন ভারতের এই ব্যাটিং আইকন। আর শততম সেঞ্চুরির অনন্য এই রেকর্ডটি করার জন্য বাংলাদেশকেই বেছে নিলেন সর্বকালের অন্যতম সেরা এই ব্যাটসম্যান। এশিয়া কাপের চতুর্থ ম্যাচে ক্রিকেট বিশ্বকে নতুন এই মাইলফলক উপহার দিলেন লিটল মাস্টার।

বাংলাদেশের বিপক্ষে যেন শচীনের সেঞ্চুরিটি না হয়, এটা অবশ্য খুব করেই চেয়েছিলেন মুশফিকুর রহিম। এশিয়া কাপে পাকিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচ শেষে সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশের অধিনায়ক বলেছিলেন, ‘আমি খুব করে চাই, শচীনের শততম সেঞ্চুরিটি হোক, কিন্তু আমাদের বিপক্ষে নয়।’ কিন্তু মুশফিকুরের এই আশা শেষ পর্যন্ত পূরণ হলো না। দীর্ঘদিন পর শচীনের ব্যাট আবার ঝলসে উঠল ঢাকাতেই। বাংলাদেশের বিপক্ষে। টসে হেরে ব্যাট করতে নেমে প্রথম থেকেই খুব সাবধানে ব্যাটিং করেছেন টেন্ডুলকার। শততম সেঞ্চুরিটি পূর্ণ করতে তিনি খেলেছেন ১৩৮টি বল। এর মধ্যে ছিল একটি ছয় ও ১০ টি চার।

গত বছর অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে শচীনকে শেষবারের মতো দেখা গিয়েছিল হেলমেট খুলে দুই হাত উপরে তুলে আকাশের দিকে তাকানোর ভঙ্গিমায়। এরপর টেস্ট, ওয়ানডে মিলিয়ে ২৩টি ম্যাচে মাঠে নেমেছিলেন ৩৯ বছর বয়সী এই ডানহাতি ব্যাটসম্যান। খেলেছেন ইংল্যান্ড, ওয়েস্ট ইন্ডিজ, অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে। কিন্তু অনেক সম্ভাবনা জাগিয়েও ক্রিকেট প্রেমীদের অপেক্ষাতেই রেখেছিলেন শচীন। অবশেষে সব প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে বাংলাদেশের বিপক্ষেই চিরচেনা ভঙ্গিমায় শতক উদযাপন করতে দেখা গেল কিংবদন্তি এই ব্যাটসম্যানকে। মুশফিকুর রহিমের অনিচ্ছা সত্ত্বেও শচীনের এই সেঞ্চুরিটির সঙ্গেই ইতিহাসের অংশ হিসেবে রেকর্ড বুকে জায়গা করে নিল বাংলাদেশ। মিরপুর শেরেবাংলা জাতীয় স্টেডিয়ামের উপস্থিত দর্শকেরাও হয়তো পরবর্তীকালে স্মৃতি রোমন্থন করে আনন্দ পাবেন যে, ‘শচীনের ইতিহাস গড়া এই দিনটিতে সেখানে আমিও ছিলাম।’

নোম চমস্কি: ইসরায়েলের জন্য সুনামি সতর্কবার্তা

মে মাসে ইসরায়েলের ব্যবসায়িক নেতাদের এক রুদ্ধদ্বার বৈঠকে ইদান ওফার সবাইকে সতর্ক করেছিলেন যে, ‘আমরা খুব দ্রুতই দক্ষিণ আফ্রিকা হয়ে যাচ্ছি। আন্তর্জাতিক আইনভঙ্গকারী হিসেবে আমাদের যে অর্থনৈতিক দণ্ডের সম্মুখীন হতে হবে, তার প্রভাব ইসরায়েলের প্রতিটা পরিবারের উপর পড়বে।’ এই ব্যবসায়িক নেতাদের প্রধান ভাবনার বিষয় ছিল, এই সেপ্টেম্বরে শুরু হওয়া জাতিসঙ্ঘের সাধারণ অধিবেশন। যেখানে ফিলিস্তিনের মানুষ নিজেদের রাষ্ট্রসত্তার বৈধতার দাবি তোলার পরিকল্পনা করছে। ঐ বৈঠকে আরও একজনের মুখে সতর্কবার্তা উচ্চারিত হয়েছিল। জাতিসঙ্ঘে নিযুক্ত ইসরায়েলের সাবেক রাষ্ট্রদূত বলেছিলেন, ‘ফিলিস্তিনকে একটা স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা দেওয়ার পরের দিন থেকেই ইসরায়েলের খুব কষ্টকর ও নাটকীয় একটা দক্ষিণ আফ্রিকাকরণ শুরু হবে।’ মানে, ইসরায়েল পরিণত হবে একটা অপরাধী রাষ্ট্রে। যার উপর আন্তর্জাতিক আইনানুযায়ী দণ্ড প্রযোজ্য হতে পারে।

এটা এবং এরকম আরও কিছু বৈঠকে ব্যবসায়িক গোষ্ঠী সরকারকে তাগাদা দিলেন বিগত দিনের মত দ্রুত এই ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের পরিকল্পনা ভেস্তে দেওয়ার উদ্যোগ নিতে। যেমনটা তারা আগে করেছিল সৌদি (আরব লীগ) প্রস্তাবসমূহ বা ২০০৩ সালে অনানুষ্ঠানিক জেনেভা চুক্তিসমূহের সময়। যেখানে উচ্চপর্যায়ের ইসরায়েলি ও ফিলিস্তিন নেতাদের মধ্যে একটা দুই রাষ্ট্র ব্যবস্থা বিষয়ে বিস্তারিত চুক্তি হয়েছিল। বিশ্বের বেশিরভাগ দেশ এটাকে স্বাগতও জানিয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীতে যুক্তরাষ্ট্রের অবহেলা ও ইসরায়েলের বিরুপ মনোভাবের কারণে তা বাস্তবায়িত হয়নি।
গত মার্চ মাসে ইসরায়েরের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইহুদ বারাক সাবধানবানী শুনিয়েছিলেন যে, যদি জাতিসঙ্ঘ ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি ঘোষণা করে, তাহলে ইসরায়েলর জন্য “সুনামি” অপেক্ষা করছে। তাঁর ভয় ছিল, পুরো বিশ্ব ইসরায়েলকে অপরাধী বানাবে শুধু এই কারণে নয় যে, তাঁরা আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করেছে। বরং এইজন্যও যে, তারা জাতিসঙ্ঘ স্বীকৃত একটা রাষ্ট্রে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড সংগঠিত করেছে। ফলে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল এটা রুখবার জন্য উচ্চপর্যায়ের কূটনৈতিক তত্পরতা চালাচ্ছে। যদি তারা ব্যর্থ হয়, তাহলে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের বৈধতা অবশ্যম্ভাবী।
১০০টিরও বেশি দেশ ফিলিস্তিনকে বৈধতা দিয়েছে। যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও অন্যান্য ইউরোপীয় দেশগুলো ফিলিস্তিনের সাধারণ ঘোষণাপত্রকে ‘কূটনৈতিক মিশন ও দূতাবাসের’ মর্যাদা দিয়েছে। যা সাধারণত শুধু কোন রাষ্ট্রের জন্যই সংরক্ষিত থাকে। আমেরিকান জার্নাল অব ইন্টারন্যালনাল ল-এ এই তথ্যটা সরবরাহ করেছেন ভিক্টর কাতান। ইউনেসকো ও ডব্লিউএইচও ছাড়া জাতিসঙ্ঘের সংগঠনগুলোতেও প্রবেশাধিকার পেয়েছে ফিলিস্তিন। তারা যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক অসহযোগিতার ভয়টাও পাত্তা দেয় নি।
যদি রাষ্ট্রসত্তার স্বীকৃতির দাবি থেকে সরে না আসে, তাহলে ফিলিস্তিনকে সাহায্য-সহযোগিতা বন্ধের হুমকি দিয়ে গত জুনে যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটে একটি বিল পাস করা হয়। ডেইলি টেলিগ্রাফের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, জাতিসঙ্ঘে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত সুশান রাইস সবাইকে সতর্ক করেছিলেন এই বলে যে, ‘জাতিসঙ্ঘকে টাকা জোগানোটা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য খুব বেশি হুমকি ছিল না, যতটা এখন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের বৈধরুপ প্রাপ্তির দিকসমূহ চিন্তা করে হচ্ছে। আর এটা হচ্ছে সহযোগী রাষ্ট্রসমূহের সহায়তাতেই।’ জাতিসঙ্ঘে ইসরায়েলের নতুন রাষ্ট্রদূত তার দেশের সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে জাতিসঙ্ঘের স্বীকৃতি সহিংসতা ও যুদ্ধে রুপ নিতে পারে।
জাতিসঙ্ঘ হয়তো ফিলিস্তিনকে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সীমানা ধরেই রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করতে পারে। সেক্ষেত্রে এই রাষ্ট্রের মধ্যে গোলান হাইটস, পশ্চিম তীর ও গাজাও অন্তর্ভূক্ত হবে।
১৯৮১ সালের ডিসেম্বরে, জাতিসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদের আদেশ ভঙ্গ করে ইসরায়েল এই হাইটস অধিগ্রহণ করেছিল। পশ্চিম তীরে ইসরায়েলকে সমর্থন যোগানোর জন্য যে বন্দোবস্ত ও আইন-কানুন জারি আছে, তা পরিস্কারভাবেই আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন। আন্তর্জাতিক আদালত ও নিরাপত্তা পরিষদও এটা স্বীকার করেছে।
২০০৬ সালের ফেব্রুয়ারীতে, যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল যৌথভাবে গাজার উপর অবরোধ জারি করে। এর কারণ ফিলিস্তিনের নির্বাচনে ‘ভুলপক্ষ’ হামাস জয়লাভ করেছিল। যাদের পরিচিতি স্বাধীনচেতা হিসেবে। ২০০৭ সালের জুনে যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত একটা সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে এই নির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার মিশন ব্যর্থ হওয়ার পর এই অবরোধ আরও জোরদার করা হয়েছিল।
২০১০ সালে রেড ক্রস আন্তর্জাতিক কমিটি এই গাজা অবরোধের তীব্র নিন্দা জানিয়েছিল। যারা এ ধরণের ইস্যু নিয়ে খুব কমই কথা বলে। বিবিসির প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, রেডক্রস অবরুদ্ধ গাজা পরিস্থিতির একটা বিষণ্ন চিত্র এঁকেছিল এভাবে, ‘হাসপাতালে প্রয়োজনীয় উপকরণ নেই, প্রতিদিন ঘন্টার পর ঘন্টা বিদ্যুত্ থাকে না, পানযোগ্য পানির অপর্যাপ্ততা এবং অবশ্যই এই সমগ্র জনগোষ্ঠী কারারুদ্ধ।’
১৯৯১ সালে গাজাকে পশ্চিম তীর থেকে পৃথক করার পরিকল্পনা শুরু করার পর থেকেই এই ধরণের অপরাধমূলক অবরোধ যুক্তরাষ্ট্র-ইসরায়েলের নীতি-নির্ধারণে বিস্তর প্রভাব রেখেছে। এর মাধ্যমে তারা এটা নিশ্চিত করে যে, যদি কখনো কোন ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র মাথা তুলে দাঁড়ায়, তাহলে তার অংশগুলো যেন ইসরায়েল ও জর্ডানের মতো শত্রুতাপূর্ণ ক্ষমতার আওতায় থাকে। ১৯৯৩ সালে, ইসরায়েল ও ফিলিস্তিন লিবারেশন অর্গানাইজেশনের (পিএলও) মধ্যে স্বাক্ষরিত অসলো চুক্তিতে গাজাকে পশ্চিম তীর থেকে পৃথক করার সুপারিশ করা হয়।
যুক্তরাষ্ট্র-ইসরায়েলের এই প্রত্যাখ্যানবাদের ফলে আরও একটা আসন্ন হুমকির মুখে আছে ফ্লোটিলা, যারা চিঠিপত্র ও জনহিতকর সাহায্য নিয়ে এনে গাজার এই অবরোধকে চ্যালেঞ্জ জানাতে চেয়েছিল। ২০১০ এর মে মাসে এ ধরণের একটা উদ্যোগ ইসরায়েলি কমান্ডোদের আক্রমণের মুখে পড়েছিল। গাজার আন্তর্জাতিক সমুদ্রসীমার মধ্যে পরিচালিত এই হামলায় মারা গিয়েছিল নয়জন যাত্রী। যা একটা বড় অপরাধ। যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া প্রায় সবাই এই হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়েছিল।
ইসরায়েলের বেশিরভাগ মানুষ নিজেদের বুঝিয়েছে যে, কমান্ডোরা নির্দোষ ছিল। হামলাকৃত ঐ জাহাজের যাত্রীরাই আগে আক্রমন চালিয়েছিল। কী ধরণের আত্মবিধ্বংসী অযৌক্তিকতা ইসরায়েলকে কুরে কুরে খাচ্ছে, এটা তার একটা চিহ্ন।
এখন যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল ফ্লোটিলা তত্পরতা বন্ধ করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে। হিলারি ক্লিনটন অপ্রত্যক্ষভাবে সহিংসতাকে আরও বৈধতা দিয়েছেন। বলেছেন, যদি ফ্লোটিলা ‘ইসরায়েলের জলসীমায় ঢুকে উসকানি দেওয়ার চেষ্টা করে’ তাহলে ‘ইসরায়েলিদের আত্মরক্ষা করার পূর্ণ অধিকার আছে।’
গ্রীস তাদের নৌবন্দর থেকে এই নৌযানগুলো ছেড়ে যাওয়া প্রতিরোধ করার ব্যাপারে সম্মতি জানিয়েছিল। যদিও ক্লিনটনের মতো, গ্রীসও খুব সঠিকভাবেই গাজার সমুদ্রসীমা নির্ধারণ করেছিল। অবশ্য ২০০৯ সালের জানুয়ারীতে গ্রীস একটা স্বতন্ত্র অবস্থান নিয়েছিল। সেসময় গাজার ওপর যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের নৃশংস সহিংসতা চলাকালে তারা যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র ইসরায়েলে নিয়ে যাওয়ার জন্য তাদের বন্দর ব্যবহার করতে দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল।
ফ্লোটিলা কোন উসকানিমূলক কর্মকাণ্ড কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে জাতিসঙ্ঘের ত্রাণ ও কর্মসংস্থান এজেন্সির মুখপাত্র ক্রিস গানেস বলেন, ‘যদি ফিলিস্তিনে কোন মানবাধিকার সংকট না-ই থাকে, যদি সেখানে কোন ধরণেরই সংকট না থাকে, তাহলে ফ্লোটিলারও কোন প্রয়োজন পড়বে না। গাজার ৯৫ ভাগ পানি পাণ করার উপযোগী না। সেখানে ৪০ ভাগ রোগই পানিবাহিত। শ্রমিকদের ৪৫.২ ভাগ বেকার। তাদের টিকে থাকার জন্য ৮০ ভাগেরও বেশি নির্ভর করতে হয় বাইরের সাহায্য-সহযোগিতার জন্য। আর এই পরিস্থিতির করুণ অবনতি হয়েছে গাজায় অবরোধ জারির পর থেকে। এই অবরোধ তুলে নেওয়া হোক। তাহলে আর কোন ফ্লোটিলারও প্রয়োজন পড়বে না।’
ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি বা সাধারণভাবে যে কোন অসহিংস কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য কূটনৈতিক উদ্যোগ তাদেরকে হুমকির মুখে ফেলে দেয়, যারা সহিংসতাকে একচেটিয়াভাবে দখলে রেখেছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল, নিজেদের একেবারে ক্ষমার অযোগ্য একটা অবস্থানে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে: দখলদারিত্ব ও নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড এবং একটা কূটনৈতিক বন্দোবস্ত বা ঐক্যমত্যে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রিতা।

‘ইংল্যান্ডকে হারাতেই হবে’

মাত্র কয়েকদিন আগেই বাংলাদেশের বিশ্বকাপ স্বপ্নে একটা বড়সড় আঘাত দিয়েছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। শুধু আঘাত বললেও কম বলা হয়। দেশের যে কোন চরম ক্রান্তিকালিন পরিস্থিতির সঙ্গেই তুলনা দেওয়া যেতে পারে সেই বিভীষিকাময় পরিস্থিতির। মাত্র ৫৮ রানেই অলআউটের লজ্জায় লাল হয়ে গিয়েছিলেন বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা। সমর্থকরা হতাশা চেপেও রাখতে পারেন নি। ওয়েস্ট ইন্ডিজ টিম বাসে ইট-পাটকেল ছুঁড়ে কলঙ্কিত করে দিয়েছিলেন বাংলাদেশ ক্রীড়া অঙ্গনের ভাবমুর্তি। কিন্তু মাত্র কয়েকদিনের ব্যবধানে সেই ওয়েস্ট ইন্ডিজই কিনা হয়ে গেল বাংলাদেশের পরম মিত্র! যে কোমার রোচ, সুলেমান বেনদের নির্মম আঘাতে বাংলাদেশ ধুলোয় লুটিয়েছিল, তারা আবারও তেমনভাবেই জ্বলে উঠুক, ক্রিস গেইল, কাইরন পোলার্ডরা ব্যাটে ঝড় তুলুক, এটাই এখন বাংলাদেশ সমর্থকদের একান্ত প্রার্থনা। ইংল্যান্ডকে যে হারাতেই হবে!

‘বি’ গ্রুপ থেকে কোয়ার্টার ফাইনালে যাওয়ার হিসাব-নিকাশটা অনেকটাই স্পষ্ট হয়ে গেছে। দক্ষিণ আফ্রিকা ইতিমধ্যেই পা রেখেছে শেষ আটের আঙ্গিনায়। ভারতেরও কোয়ার্টার ফাইনাল প্রায় নিশ্চিতই বলা যায়। হাড্ডাহাড্ডি লড়াই চলছে বাংলাদেশ, উইন্ডিজ আর ইংল্যান্ডের মধ্যে। কাগজে-কলমে তিন দলেরই জোর সম্ভাবনা আছে কোয়ার্টার ফাইনালে যাওয়ার। কিন্তু এত হিসাব-নিকাশের খাতা খুলে বসে থাকতে হবে না যদি আগামীকাল ইংল্যান্ডকে হারের স্বাদ দিতে পারে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। উপমহাদেশে আয়োজিত এবারের বিশ্বকাপ থেকে একেবারেই শূণ্য-রিক্ত হাতে ফিরে যেতে হবে এ অঞ্চলের এককালীন শাসক ইংল্যান্ডকে। তারচেয়েও বড় কথা, নিশ্চিত হয়ে যাবে বাংলাদেশের পরবর্তী রাউন্ড। এরকম অবস্থায় বাংলাদেশের মানুষ তো স্যামি, গেইল, ব্রাভোদের পেছনে দাঁড়াবেই।

ঢাকার এক হোটেল কর্মকর্তা এনামুর রহমান বলেছেন, ‘আমরা অবশ্যই ওয়েস্ট ইন্ডিজকে সমর্থন দেব। ইংল্যান্ডকে হারাতেই হবে।’ শুধু এনামুর রহমানই না, বাংলাদেশের ক্রিকেট পাগল কোটি কোটি মানুষের মুখে এখন একই কথা। ‘ইংল্যান্ডকে হারাতে হবে।’ অতি উত্সাহী দু-একজন তো বলছেন, ‘ইস, খেলাটা যদি বাংলাদেশে হতো, গলা ফাটিয়ে চিত্কার করেই ওয়েস্ট ইন্ডিজকে জিতিয়ে দিতাম।’ একেবারে কিন্তু ফেলেও দেওয়া যায় না কথাটা। বাঙ্গালীর গলার জোরের পরিচয় কিন্তু ইংল্যান্ড কয়েকদিন আগে ভালোমতোই পেয়েছিল!

তবে সমর্থকদের ভাবনা যাই হোক, বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা নিশ্চয়ই শুধু অপরের দিকে তাকিয়েই দিন পার করছেন না। ইতিমধ্যেই তাঁরা নিশ্চয়ই দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ম্যাচের জন্য জোর প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছেন। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ২ উইকেটের অসাধারণ জয় দিয়ে নিজেদের সামর্থ্য তো ভালোমতোই প্রমাণ করেছেন সাকিব-তামিমরা। হল্যান্ডের বিপক্ষেও খেলেছেন অনেক পরিণত ক্রিকেট। কাজেই গত বিশ্বকাপের মতো এবারও প্রোটিয়া-বধের স্বপ্ন তো বাংলাদেশ দেখতেই পারে। অধিনায়ক সাকিব আল হাসান বলেছেন, ‘আমরা ইংল্যান্ড-ওয়েস্ট ইন্ডিজ ম্যাচটার দিকে খুব আগ্রহভরে তাকিয়ে থাকব। এটা ঠিক। কিন্তু আমাদের নিজেদের ভাগ্য নিজেদেরই গড়ে নিতে হবে। আসল কথা হলো, দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারাতে হবে।’ বাংলাদেশের বোলিং আক্রমণের অন্যতম প্রধান ভরসা আব্দুর রাজ্জাকও গলা মিলিয়েছেন অধিনায়কের সঙ্গে। বলেছেন, ‘দলের সবাই দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ম্যাচটার দিকেই তাকিয়ে আছে। কেউই পয়েন্ট তালিকার জটিল হিসাব-নিকাশ নিয়ে ভাবছে না। আমরা পরের ম্যাচটা জিতেই কোয়ার্টার ফাইনালে যেতে চাই।’

আগামীকালের ইংল্যান্ড-ওয়েস্ট ইন্ডিজের খেলাটা বাংলাদেশের না হয়েও এক অর্থে বাংলাদেশেরই। গোটা খেলাটার উপরই নির্ভর করবে বাংলাদেশের বিশ্বকাপ সম্ভাবনা। ১২ দিন আগে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট দল এদেশ ছেড়ে যাওয়ার আগে ক্ষুব্ধ ক্রিকেট পাগল সমর্থকদের হতাশার চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ দেখেছে। আতঙ্কিত হয়েছে। কিন্তু তারপর “We are Sorry” লেখা প্ল্যাকার্ডগুলোও তো দেখেছে। আর এবার বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে বাংলাদেশের মানুষের প্রাণঢালা শুভকামনা আর ভালোবাসাও নিশ্চয়ই উইন্ডিজ ক্রিকেটাররা দেখছেন। ক্রিস গেইলরা কী এই ভালোবাসার প্রতিদান দেবেন না?

ধোনির আফসোস

বিশ্বকাপের শুরু থেকেই অনেকের চোখ ছিল হরভজন সিংয়ের দিকে। উপমহাদেশের স্পিনারবান্ধব উইকেটে ভারতের শিরোপা জয়ের লক্ষ্য পূরণে এই অফস্পিনার একটা ভালো ভূমিকা পালন করতে পারবেন এমনটাই আশা করেছিলেন সবাই। কিন্তু প্রথম চার ম্যাচে সবাইকে হতাশই করেছিলেন ‘ভাজ্জি’। পেয়েছিলেন মাত্র ২ উইকেট। কিন্তু গতকাল দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে গ্রুপের গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে ফিরেছিলেন পুরোনো রুপে। একটু খরুচে প্রমাণিত হলেও দক্ষিণ আফ্রিকার তিন বিধ্বংসী ব্যাটসম্যান হাশিম আমলা, ডি ভিলিয়ার্স ও জে পি ডুমিনির উইকেট তুলে নিয়ে জয়ের আশা জাগিয়েছিলেন ভারতীয় শিবিরে। কিন্তু শেষটা আশানরুপ হলো না হরভজনের। টেন্ডুলকারের অনবদ্য শতকের মতো বৃথা গেল তাঁর এই প্রত্যাবর্তনও।

শ্বাসরুদ্ধকর ম্যাচে দুই উইকেটের জয় দিয়ে ভারতীয় শিবিরকে হতাশায় ডোবালেন প্লেসিস, পিটারসেনরা। হতাশাটা হয়তো হরভজনের আরেকটু বেশিই হতে পারে। শেষ ওভারে ধোনি যদি বলটা আশিস নেহরার হাতে না দিয়ে তাঁর হাতে দিতেন, তাহলে হয়তো শেষ হাসিটা তাঁরাই হাসতে পারতেন। কী হতে পারত, এ নিয়ে আলাপ করে অবশ্য এখন খুব বেশি লাভ নেই। কিন্তু শেষ ৬ বলে যখন ১৩ রান দরকার, সেসময় হরভজনকে বোলিংয়ে না এনে, নেহরাকে দিয়ে বল করানোর সিদ্ধান্তটা অনেককেই অবাক করেছে। সমালোচনার মুখেও পড়তে হয়েছে ভারতীয় অধিনায়ককে। ম্যাচ শেষে তাই আফসোস করা ছাড়া আর কিছুই করার ছিল না ধোনির। ম্যাচ পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে ধোনির সাফাই, ‘শেষ ওভারের জন্য আশিসই উপযুক্ত ছিল। সে ভালো বোলিং করেছিল। আমি ভেবেছিলাম তাকে দিয়েই কাজ হবে। আমাকে এই সিদ্ধান্তের জন্য দোষারোপ করতে পারেন। কিন্তু আমার মনে হয়েছিল, পেসার দিয়েই আমাদের জয়ের কাজটা ভালোভাবে হবে।’

ধোনির আফসোস শুধু এই একটা জায়গাতেই না। ব্যাটিংয়েও তাঁর আস্থার প্রতিদান দিতে পারেন নি সতীর্থরা। শচীনের ৪৮তম ওয়ানডে সেঞ্চুরি, শেবাগের ৭৩ ও গৌতম গম্ভীরের ৬৯ রানের লড়াকু ইনিংসের সুবাদে মাত্র ৪০ ওভারেই ভারতীয় স্কোরবোর্ডে যুক্ত হয়েছিল ২৬৮ রান। সবাই ভাবছিলেন ভারতের রান বুঝি ৩৫০ ছাড়িয়ে যাবে। কিন্তু শেষ ১০ ওভারে শুধু আসা-যাওয়াই করেছেন বাকি ব্যাটসম্যানরা। উইকেটের অপর প্রান্তে দাঁড়িয়ে শুধু আফসোসই করতে হয়েছে ধোনিকে। ১০ বল বাকি থাকতে ২৯৬ রানেই গুটিয়ে যাওয়ার পর শুধু হতাশ হওয়া ছাড়া আক্ষরিক অর্থেই আর কিছুই করার ছিল না তাঁর। মাঠ ছেড়েছেন ১২ রানে অপরাজিত থেকে। শেষ তিন ওভারে মাত্র চার রানের বিনিময়ে পাঁচটি উইকেট নিয়ে ম্যাচসেরার পুরস্কারটা ঝুলিতে ভরেছেন ডেল স্টেইন। ভারতকে দিয়েছেন এবারের বিশ্বকাপের প্রথম পরাজয়ের স্বাদ।

ইংল্যান্ড ও দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে গ্রুপ পর্বের দুইটা বড় ম্যাচেই একেবারে শেষমুহূর্তে জয়বঞ্চিত হতে হয়েছে ভারতকে। গতকাল ম্যাচটা জিততে পারলে কোয়ার্টার ফাইনাল নিশ্চিতই করে ফেলতে পারত ধোনি-বাহিনী। এই হারের ফলেও হয়তো শেষ আটে যাওয়া আটকাবে না স্বাগতিকদের। কিন্তু বড় দলগুলোর বিপক্ষে এই শেষ মুহূর্তের আফসোসগুলো নিয়ে সত্যিই ভাবতে হবে ধোনিকে। রয়টার্স

ট্র্যাজেডির সেমিফাইনাল

১৯৯৯ সালের বিশ্বকাপ সেমিফাইনালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে দক্ষিণ আফ্রিকার ট্রাজিক বিদায়টার কথা এখনো ভুলতে পারেন নি ক্রিকেটপ্রেমীরা। ম্যাচটা ড্র হয়ে গেলেও পয়েন্ট মারপ্যাঁচের ফাঁদে পড়ে বিদায় নিতে হয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকাকে। প্রোটিয়াসদের সেমিফাইনাল ট্রাজেডি কিন্তু সেটাই প্রথম না। এর আগে ১৯৯২ সালের বিশ্বকাপ সেমিফাইনালেও জঘন্য কিছু আইন-কানুনের জালে আটকে গিয়েছিল তাদের বিশ্বকাপ জয়ের স্বপ্ন।

১৯৯২ সালেই বিশ্বকাপে প্রথমবারের মতো অংশ নিয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকা। তার আগে বর্ণবাদ বিতর্কের ঘেরাটোপে আটকে বেশ কিছুদিন আন্তর্জাতিক ক্রিকেট অঙ্গনেরই বাইরে ছিল তারা। বিশ্বকাপে তাদের প্রথম ম্যাচে স্বাগতিক অস্ট্রেলিয়াকে ৯ উইকেটে হারিয়ে শুরুটাও করেছিল দুর্দান্তভাবে। তারপর একে একে ওয়েস্ট ইন্ডিজ, পাকিস্তান, জিম্বাবুয়ে, ভারতকে হারিয়ে উঠে এসেছিল সেমিফাইনালে। অধিনায়ক কেপলার ওয়েলস, অ্যালান ডোনাল্ড, হ্যানসি ক্রনিয়ে, জন্টি রোডসরা অসাধারণ পারফরমেন্স দেখিয়ে মুগ্ধ করে দিয়েছিলেন ক্রিকেট বিশ্বকে। পাকিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচটিতে জন্টি রোডস যেভাবে ইনজামামকে রান আউট করেছিলেন তা এখনো জ্বলজ্বল করছে বিশ্বকাপ ইতিহাসের পাতায়।

দক্ষিণ আফ্রিকার এই প্রথম বিশ্বকাপে অনেককিছুই দেখা গিয়েছিল প্রথমবারের মতো। যেমন, সেবারই প্রথম প্রচলন হয় রঙ্গিন পোশাকের। সেই সঙ্গে চালু করা হয় সাদা বল। সেবারই প্রথম খেলা শুরু হয়েছিল ফ্লাডলাইটের আলোয়। কিন্তু এসবকিছুকে ছাপিয়ে ১৯৯২ বিশ্বকাপের অন্যতম প্রধান আলোচিত বিষয়ে পরিণত হয়েছিল বৃষ্টি সংক্রান্ত নতুন আইন। ৯২ বিশ্বকাপের বৃষ্টি আইনের নিয়মটা ছিল যে, প্রথমে ফিল্ডিং করা দলের সবচেয়ে কম রান দেওয়া ওভারগুলির রানসংখ্যা কমিয়ে নেওয়া হবে। ধরা যাক বৃষ্টির কারণে ২ ওভার কেটে নেওয়া হলো। তখন হিসাব করা হবে যে, প্রথমে বোলিং করা দল কোন দুই ওভারে সবচেয়ে কম রান দিয়েছে। যত রান কম দিয়েছে তত রান বাদ দিয়ে নতুন টার্গেট নির্ধারণ করা হবে। সেবার বৃষ্টিই গড়ে দিয়েছিল বিশ্বকাপের অনেকগুলো ম্যাচের ভাগ্য। আর সেই বৃষ্টির জলেই যে ধুয়ে যাবে দুর্দান্ত ফর্মে থাকা দক্ষিণ আফ্রিকার বিশ্বকাপ স্বপ্ন- তা হয়তো কেউই ভাবতে পারে নি।

ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সেমিফাইনালটিতে বৃষ্টি বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল খেলা শুরুর আগেই। খেলার দৈর্ঘ্য কমিয়ে নিয়ে আসা হয়েছিল ৪৫ ওভারে। শুরু থেকেই ভাগ্যদেবী যেন একেবারে মুখ ফিরিয়ে রেখেছিলেন প্রোটিয়াসদের উপর থেকে। যে গ্রায়েম হিকের ৯০ বলে ৮৩ রানের ইনিংসটির সুবাদে ইংল্যান্ড স্কোরবোর্ডে ২৫২ রান যোগ হয়েছিল, সেই হিক দুই দুইবার ফিরে এসেছেন নিশ্চিত আউটের দ্বারপ্রান্ত থেকে। ম্যাচের প্রথম বলেই নিশ্চিত একটা এলবিডব্লিউর আবেদনে সাড়া দেন নি আম্পায়ার। দ্বিতীয়বার হিক ক্যাচ আউট হয়েছিলেন একটা নো বলে। তখনও রানের খাতাই খুলতে পারেন নি তিনি।

২৫৩ রানের টার্গেট নিয়ে ব্যাট করতে নেমে বেশ ভালোভাবেই এগিয়ে যাচ্ছিল প্রোটিয়াসরা। উদ্বোধনী ব্যাটসম্যান অ্যান্ড্রু হাডসনের ৪৬, আদ্রিয়ান কুইপারের ৩৬, হ্যানসি ক্রনিয়ের ২৪ রানের ছোট ছোট ইনিংসগুলির উপর ভর করে ধীরে ধীরে জয়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল তারা। শেষদিকে জন্টি রোডসের ৩৮ বলে ৪৩ রানের ইনিংসটি রান-বলের ব্যবধান কমিয়ে এনেছিল অনেকখানিই। শেষ পাঁচ ওভারে তাদের দরকার ছিল ৪৭ রান। সপ্তম উইকেটে ব্রায়ান ম্যাকমিলান ও ডেভ রিচার্ডসন মাত্র তিন ওভারে অবিচ্ছিন্ন ২৬ রানের জুটি গড়ে জয়টাকে অনেকটাই নাগালের মধ্যে নিয়ে এসেছিলেন। আর তারা যেভাবে খেলে যাচ্ছিলেন তাতে সেটা খুব বেশি কঠিনও মনে হচ্ছিল না। কিন্তু ৪৩তম ওভারের শেষ বলের আগে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম সেমিফাইনাল ট্রাজেডিটার জন্ম দিতেই আবার শুরু হলো বৃষ্টি। জয়ের জন্য তখন প্রয়োজন ছিল ১৩ বলে ২২ রান। সেদিনের সেই ১২ মিনিটের বৃষ্টি একটা ক্লাসিক ম্যাচকে পরিণত করেছিল বিশ্বকাপের অন্যতম বিতর্কিত একটা ম্যাচে। ম্যাকমিলান ও রিচার্ডসন চাচ্ছিলেন খেলা চালিয়ে যেতে। কিন্তু ইংলিশ অধিনায়ক গ্রাহাম গুচ কোনক্রমেই রাজি হলেন না। আম্পায়াররা শেষপর্যন্ত খেলা বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিলেন। এরপর তারা সেই অদ্ভুত নিয়মের খাতা খুলে হিসাব করতে বসলেন নতুন টার্গেট। প্রথমে আম্পায়াররা লক্ষ্য নির্ধারণ করলেন ৭ বলে ২২ রান। মেলবোর্নের উপস্থিত দর্শক ক্ষুব্ধ হয়ে উঠল এই নির্বুদ্ধিতায়। কিন্তু পরিস্থিতি আরো নির্মম হয়ে উঠল যখন কর্মকর্তারা খেলা দুই ওভার কমিয়ে নতুন লক্ষ্য নির্ধারণ করলেন। ইলেকট্রনিক স্কোরবোর্ডে ভেসে উঠল হাস্যকর, নির্মম একটা টার্গেট। ১ বলে ২১ রান। দক্ষিণ আফ্রিকার সবচেয়ে কম রান দেওয়া দুই ওভারে ইংল্যান্ড নিয়েছিল ১ রান। সৌজন্যে রক্ষার খাতিরে অসম্ভব এই টার্গেট নিয়ে একমাত্র বলটির মুখোমুখি হতে আবার ব্যাট হাতে মাঠে নামলেন ম্যাকমিলান ও রিচার্ডসন। ক্রিস লুইসের শেষ বলে একটা রান নিয়ে ক্ষুব্ধভাবে প্যাভিলিয়নের দিকে তাকালেন দুই প্রোটিয়াস ব্যাটসম্যান। গ্যালারি থেকে হাততালি দিয়ে অভিনন্দন জানানো হলো না বিজয়ী দলকে। দুয়োধ্বনিতে প্রকম্পিত হলো সিডনি স্টেডিয়াম। বিশ্বকাপ ফাইনালে ওঠার আনন্দে মাতলেন না ইংলিশ খেলোয়াড়রাও বরং এরকম বিতর্কিত একটা জয় পেয়ে বেশ বিব্রতই হয়ে পড়েছিলেন তারা।

এর পরের কাহিনী তো সবারই জানা। ফাইনালে ইংল্যান্ডকে ২২ রানে হারিয়ে বিশ্বকাপ শিরোপাটা উঠেছিল ইমরান খানের পাকিস্তানের হাতে। আর এই জঘন্য বৃষ্টি-আইনটি কোন রকম উচ্চবাচ্য ছাড়াই সরিয়ে ফেলা হয়েছিল ক্রিকেট দুনিয়া থেকে। ১৯৯৯ সালে প্রণয়ন করা হয়েছিল অধিক গ্রহণযোগ্য ডাকওয়ার্থ-লুইস পদ্ধতি।

 

‘অপরাজিত’ ক্লুজনার

নিরানব্বইয়ের বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ রান এসেছিল রাহুল দ্রাবিড়ের ব্যাট থেকে। সেই বিশ্বকাপে শচীন টেন্ডুলকার, মার্ক ওয়াহ, হার্শেল গিবস, ব্রায়ান লারা ও সাঈদ আনোয়ারের মতো ব্যাটসম্যানরা ছিলেন স্ব-মহিমায় উজ্জ্বল। কিন্তু ব্যাটিংয়ের এসব মহারথীকে ছাপিয়ে ’৯৯-এর বিশ্বকাপে বোলারদের দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকার ল্যান্স ক্লুজনার। কিছুতেই আউট করা যাচ্ছিল না তাঁকে। বিশ্বকাপের প্রথম ছয়টি ম্যাচের পাঁচটিতে ব্যাট হাতে মাঠে নেমে করেছিলেন ১৬৪ রান। তাঁর কোনো গড় হিসাব করা যাচ্ছিল না। কারণ, ক্লুজনার যে এই পাঁচটি ম্যাচে আউটই হননি!

কেবল তাই নয়, তিনি শেষবারের মতো আউট হয়েছিলেন বিশ্বকাপ শুরু হওয়ারও দুই-আড়াই মাস আগে। সব মিলিয়ে ওয়ানডে ক্রিকেটে আউট না হওয়ার এক অনন্য রেকর্ডই করে বসেছিলেন তিনি। বিশ্বকাপের ছয়টি ম্যাচসহ টানা ১১টি ম্যাচে অপরাজিত থেকে ৩৯৩ রান করে তিনি ভেঙেছিলেন পাকিস্তানের ব্যাটিং কিংবদন্তি জাভেদ মিয়াঁদাদের রেকর্ড।

নিরানব্বইয়ের বিশ্বকাপটা পুরোটাই ছিল ক্লুজনারের বীরত্ব গাঁথা। পুরো বিশ্বকাপেই দারুণ আলোচিত ছিল তাঁর মারকুটে ব্যাটিং। সুপার সিক্সে পাকিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচটিতে দলের পরাজয় মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে যাওয়ার পরও অবিচল ছিলেন ল্যান্স ক্লুজনার। শোয়েব আকতারের এক ওভারে ১৭ রান নিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকাকে নিয়ে যান বিজয়ের বন্দরে। সেমিফাইনালে দক্ষিণ আফ্রিকার ট্র্যাজিক বিদায়েও তিনি ছিলেন ট্র্যাজিক হিরো। দলকে ফাইনালে প্রায় নিয়েই গিয়েছিলেন। অ্যালান ডোনাল্ডের সঙ্গে সেই ভুল-বোঝাবুঝিটা না হলে হয়তো বিশ্বকাপের ইতিহাসই অন্যভাবে লিখতে হতো। অনেক ম্যাচেই দক্ষিণ আফ্রিকার টপ অর্ডার ব্যর্থ হলেও অসাধারণ দৃঢ়তায় তিনি দলকে বিজয়ী করেছেন। ’৯৯-এর বিশ্বকাপে তাঁর নাম তাই হয়ে গিয়েছিল ‘ক্রাইসিস ম্যান’।

ক্রিকেটের ইতিহাসে সম্ভবত ল্যান্স ক্লুজনারের আউট হওয়া না-হওয়া নিয়েই ধরা হয়েছে একমাত্র বাজি। ’৯৯-এর বিশ্বকাপে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ১১ ম্যাচ পরে তিনি আউট হয়েছিলেন। সেই ম্যাচে তিনি আউট হবেন কি হবেন না, তা নিয়ে বাজির দর বেড়ে গিয়েছিল হু হু করে। শেষ পর্যন্ত ওয়ান ডাউনে ব্যাট করতে নেমে গ্যাভিন লারসেনের বলে তিনি আউট হন। অনেকে এই বলেও বিতর্ক ছড়িয়েছিলেন যে প্রোটিয়া অধিনায়ক হ্যানসি ক্রোনিয়ে যদি তাঁকে সেই ম্যাচে ওয়ান ডাউনে না নামাতেন, তাহলে এই ম্যাচেও নাকি তিনি অপরাজিত থাকতেন।

ল্যান্স ক্লুজনার ’৯৯-এর বিশ্বকাপে সবই পেয়েছেন, কেবল পারেননি দক্ষিণ আফ্রিকাকে ফাইনালে তুলতে। চরম নাটকীয় ও শ্বাসরুদ্ধকর সেমিফাইনালে ১৬ বলে ৩১ রান করে অপরাজিত থাকলেও মুহূর্তের ভুলে তিনিই ছিলেন সেই ম্যাচের ট্র্যাজেডির নায়ক। শুধু ব্যাট হাতেই নয়, বল হাতেও ১৭ উইকেট শিকার করে বিশ্বের অন্যতম সেরা অলরাউন্ডার হিসেবে ক্লুজনারের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল ’৯৯-এর ইংল্যান্ড বিশ্বকাপেই। প্রতিযোগিতার সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কারটিও অবধারিতভাবে উঠেছিল এই ‘স্প্রিংবকে’র হাতেই।