Posts Tagged ‘ জামায়াত-শিবির ’

নতজানু আর নয়

পূর্বপরিকল্পিত পথেই হাঁটছে জামায়াত-শিবির

২০০৯ সালে জামায়াতে ইসলামীর করা কিছু পরিকল্পনা-কর্মপদ্ধতি সম্পর্কে জানা যায় উইকিলিকসের কল্যানে। এগুলো তারা বলেছিল ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে। নিজেদের লক্ষ্য সম্পর্কে জামায়াত নেতারা বলেছিল, জামায়াত পরবর্তী নির্বাচনে জয়ী হওয়া বা জাতীয় সংসদে আসনসংখ্যা বাড়ানোর মতো স্বল্পমেয়াদি অর্জন নিয়ে চিন্তিত নয়, তাদের দৃষ্টি চূড়ান্ত লক্ষ্যের দিকে। চূড়ান্ত লক্ষ্যটা কি? ইসলামি রাষ্ট্র কায়েম করা। পাকিস্তানে যেমনটা ছিল-আছে।
২০০৮ সালে আওয়ামী লিগ সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করার অঙ্গীকার নিয়ে ক্ষমতায় এলে খানিকটা কোনঠাসা বোধ করে জামায়াত-শিবির। যদি সরকার তাদের নিষিদ্ধই করে, তাহলে কী করা হবে সেটাও তখনই ভেবে রেখেছিল তারা। উইকিলিকসে জামায়াতে ইসলাম ২০১০ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রদূত মরিয়ার্টি একটি গোপনীয় তারবার্তায় লেখেন: জামায়াতের নেতা ব্যারিস্টার রাজ্জাক ১০ ফেব্রুয়ারি বৈঠকে তাঁকে বলেন, জামায়াতে ইসলামী ‘সাংবিধানিক পথে’ বিশ্বাস করে, দলটি আদালতের সিদ্ধান্ত মেনে চলবে। বাংলাদেশে যদি ধর্মভিত্তিক দলগুলো নিষিদ্ধ হয়ে যায়, তাহলে জামায়াত তুরস্কের ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর দৃষ্টান্ত অনুসরণ করবে। জামায়াত দলের নাম পরিবর্তন করবে, দলীয় গঠনতন্ত্র থেকে ধর্মীয় মতবাদগুলো বাদ দেবে; কিন্তু একই সঙ্গে তিনি বলেন যে জামায়াত রুলিংটিকে আদালতে চ্যালেঞ্জ করবে। রাজ্জাকের ভাষ্য অনুসারে, ধর্মভিত্তিক দলগুলোর ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হলে জামায়াতে ইসলামী দলের নামে ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ও ট্রাস্টে যে অর্থ আছে, দলটি তা হারাবে, কিন্তু দল টিকে থাকবে। রাজ্জাক বলেন, একটি ক্ষত সৃষ্টি হবে, তবে সেই ক্ষত সারানো যাবে। (সূত্র: উইকিলিকসে বাংলাদেশ: ‘জামায়াতে ইসলামী- খরগোশ নয়, কচ্ছপ’)
দুই বছর পরে এখন তাহলে জামায়াত কি সেই কর্মপরিকল্পনা অনুসারেই হাঁটছে না? হেফাজতে ইসলাম যে জামায়াতেরই মদদপুষ্ট এবং মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ সেকথা কি এখনো কারও বোঝার বাকি আছে? পরিস্কারভাবে দেখা যাচ্ছে যে, তারা হেফাজতে ইসলামের নামে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচাল, জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধের দাবির কণ্ঠরোধ করতে চায়।
জামায়াত তুরস্কের ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর দৃষ্টান্ত অনুসরণ করবে সেকথাও বলেছে। সকলের বোধহয় মনে আছে যে, ট্রাইবুন্যালের বিচার কার্যক্রমকে প্রশ্নবিদ্ধ করে এই বিচার বন্ধ করার প্রস্তাব দিয়েছিল তুরস্কের সরকার। ফলে তুরস্ক তো জামায়াতের আদর্শ উদাহরণ হবেই। সেই পথেই তারা এগিয়ে যাচ্ছে এবং হেফাজতে ইসলাম ব্যানারের আড়ালে নতুনভাবে সংগঠিত হতে চাচ্ছে।

হেফাজতে ইসলাম + জামায়াতে ইসলামী = হেফাজতে জামায়াতে ইসলামী

জামায়াতে ইসলামী ও হেফাজতে ইসলাম যে একই মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ এটা তাদের কর্মকা-ের মাধ্যমেও বোঝা যায়।
শাহবাগ আন্দোলন শুরুর সঙ্গে সঙ্গে এটাকে নাস্তিকদের আন্দোলন বলে মিথ্যা প্রচারণা চালিয়েছিল জামায়াত-শিবির। তারা ব্লগার রাজীব হায়দারকে হত্যা পর্যন্ত করেছে। ধর্মভীরু মানুষদের মাঝে তারা প্রচারণা চালিয়েছে যে, শাহবাগে সবাই নাস্তিক, ওখানে বেলেল্লাপনা হয়, ওরা ‘বিজাতীয় সংস্কৃতি’র ধারকবাহক। এই প্রচারণা দিয়ে এখনো সারাদেশে তা-ব চালিয়ে যাচ্ছে জামায়াত-শিবির। এদিকে ধুম করে দৃশ্যপটে হাজির হওয়া এবং সবাইকে ভীতসন্ত্রস্ত করে তোলা হেফাজতে ইসলামের দাবিগুলোও কিন্তু একই রকম। জামায়াত-শিবিরও মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্য, শহীদ মিনার, মন্দিরে মূর্তি ভাঙ্গছে, আগুন দিচ্ছে। হেফাজতে ইসলামীও তাদের মতো করে মূর্তি-ভাস্কর্য স্থাপনের বিরোধীতা করছে।
হেফাজতে ইসলামের ১৩ দফা দাবি দেখলেই বোঝা যায় যে তারা কেমন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করতে চায়। এগুলো মধ্যে কয়েকটি হলো: ব্যক্তি ও বাক-স্বাধীনতার নামে সকল বেহায়াপনা, অনাচার, ব্যভিচার, প্রকাশ্যে নারী-পুরুষের অবাধ বিচরণ, মোমবাতি প্রজ্বলনসহ সকল বিজাতীয় সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ বন্ধ করতে হবে, মসজিদের নগরী ঢাকাকে মূর্তির নগরীতে রূপান্তর এবং দেশব্যাপী রাস্তার মোড়ে ও কলেজ-ভার্সিটিতে ভাস্কর্যের নামে মূর্তি স্থাপন বন্ধ করতে হবে, পার্বত্য চট্টগ্রামসহ দেশব্যাপী ইসলাম বিরোধী কর্মকা-ে জড়িত এনজিও এবং খ্রিস্টান মিশনারীদের ধর্মান্তকরণসহ সকল অপ-তৎপরতা বন্ধ করতে হবে, কথিত শাহবাগী আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী স্বঘোষিত নাস্তিক-মুরতাদ এবং প্রিয় নবী (সা.)-র শানে জঘন্য কুৎসা রটনাকারী কুলাঙ্গার ব্লগার ও ইসলাম বিদ্বেষীদের সকল অপপ্রচার বন্ধসহ কঠোর শাস্তিদানের ব্যবস্থা করতে হবে ইত্যাদি ইত্যাদি।
এ কেমন বাংলাদেশ বানানোর দাবি জানাচ্ছে হেফাজতে ইসলাম? এটা কি বাংলাদেশকে পাকিস্তান বা আফগানিস্তান বানানোরই রুপকল্প না? এই দাবি বাস্তবায়ন হলে নারী-পুরুষ অবাধে মেলামেশা করতে পারবে না। মূর্তি-ভাস্কর্য স্থাপন করা যাবে না। মোমবাতি প্রজ্জলন এদের কাছে বিজাতীয় সংস্কৃতি। হেফাজতে ইসলামের কল্পিত বাংলাদেশে সবাইকেই এক অর্থে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে হবে। আর যদি অন্য ধর্মাবলম্বী কেউ থাকেও তাহলে তারা নিজেদের আচার পালন করতে পারবেন না। এবং এই মুসলিমটাও হতে হবে তাদের তরিকা অনুযায়ী। কারণ তারা কাদিয়ানীদেরও অমুসলিম ঘোষণা করেছে। হেফাজতে ইসলাম যে বাংলাদেশ কায়েম করতে চায় সেটা হবে চরম আকারের সাম্প্রদায়িক, রক্ষণশীল,  গুমোট একটা পরিবেশ। সেখানে কারও স্বাধীন মত প্রকাশের স্বাধীনতা থাকবে না, গণতান্ত্রিক চর্চার সুযোগ থাকবে না। ৪২ বছর আগে মুক্তিযোদ্ধারা জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করেছিলেন কি এই বাংলাদেশের জন্য?

হেফাজতে ইসলাম কেন ইসলামী নিদর্শন ধ্বংস নিয়ে কোন কথা বলে না?

হেফাজতে ইসলাম কতিপয় কিছু কথিত নাস্তিক ব্লগারদের পেছনে লেগেছে। কিন্তু যখন সৌদি আরবে মহানবী হজরত মোহাম্মদ (সাঃ) এর সময়কার, তাঁর স্মৃতিবিজরিত মসজিদসহ অন্যান্য স্থাপনা ভেঙ্গে ফেলা হয় তখন কোথায় থাকেন হেফাজতে ইসলামের লোকজনেরা? সেটাকে তাহলে তারা ইসলামের কোন ক্ষতি বলে মনে করছে না? মহানবীকে নিয়ে কটুক্তি করলে ব্লগার গ্রেপ্তার আর মহানবীর নিদর্শন, যেখানে মহানবী নামাজ পড়েছেন, সেই মসজিদ ভেঙ্গে দিলে কোন সমস্যা নেই?

Macca

বাংলাদেশেও খুবই প্রাচীন একটা মসজিদের সন্ধান পাওয়া গেছে রংপুরের রামজাপুর গ্রামে। ধারণা করা হচ্ছে এটা দক্ষিণ এশিয়ারই প্রথম মসজিদ হতে পারে। কিন্তু সেখানকার গুরুত্বপূর্ণ প্রতœতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলো সরকারী অবহেলায় নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। সে ব্যাপারে হেফাজতে ইসলামের কোন কথাবার্তা নেই কেন? তাহলে এটা কি খুবই পরিস্কার না যে, হেফাজতে ইসলাম আসলে কী হেফাজত করতে চাচ্ছে? তারা প্রকৃতঅর্থেই জামায়াতের হেফাজতকারী। যুদ্ধাপরাধীদের হেফাজতকারী। এদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর সময় এখনই।

আওয়ামী লিগ সরকারের ডিগবাজি

১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত ধর্মের নামে পাকিস্তানী ঔপনিবেশিক শাসকরা এই বাংলাদেশ ভূখ-ের মানুষদের শোষণ করেছিল, নির্যাতন-নিপীড়ণ চালিয়েছিল, খুন-ধর্ষণ করেছিল। সেই অভিজ্ঞতা থেকেই সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে যখন সংবিধান রচিত হয় তখন রাষ্ট্র পরিচালনার চারটি মূলনীতির মধ্যে স্থান দেওয়া হয় ধর্মনিরপেক্ষতাকে। কিন্তু অবাক করে দেওয়ার মতো বিষয় হলো, যে আওয়ামী লিগের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়েছিল, যে আওয়ামী লিগ ১৯৭২ সালে প্রথম সংবিধানটি রচনা করেছিল সেই আওয়ামী লিগই ৪২ বছর পর নতজানু হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধী হেফাজতে ইসলামের কাছে। সরকার নাকি জামায়াতের লেবেলধারী হেফাজতে ইসলামের বেশ কিছু দাবি আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে মেনে নিতে যাচ্ছে। কিছুতেই বোঝা যায় না যে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা হয়ে বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কিভাবে হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে আপোষ করতে পারেন। জয় বাংলার পরে জয় বঙ্গবন্ধু না বললে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ঠিকমতো প্রতিষ্ঠিত হয় না বলে মনে করেন অনেক আওয়ামী লিগার। কিন্তু এখন তো আপনারা বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলার স্বপ্নের বিপরীতেই হাঁটছেন। এ কেমন স্ববিরোধীতা?
হেফাজতে ইসলামের কাছে সরকার যেন নিজের মাথাটাই পেতে দিয়েছে। অত্যন্ত অন্যায়ভাবে গ্রেফতার করা হয়েছে তিনজন ব্লগারকে। তাঁরা কি অবমাননা করেছেন, কিভাবে অবমাননা করেছেন সেগুলো এখনো কারো কাছে স্পষ্ট না। ব্লগ-ব্লগার বলতে হেফাজতে ইসলামই বা কি বোঝেন আর সরকারই বা কি বোঝেন সেটা নিয়েও যথেষ্ট সন্দেহ আছে। সরকার আমারব্লগ বন্ধ করে দিয়েছে। হেফাজতে ইসলামের কথা বাদ দিলাম, ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়তে চাওয়া সরকার কি জানে যে ব্লগগুলোতে শুধু ঐ দুই-তিনজনই লেখেন না। আরও অনেকেই লেখেন। শুধু ধর্ম নিয়েই না, সেখানে রাজনীতি-অর্থনীতি-সমাজ নিয়েও আরও অনেক লেখা ছিল? সেগুলো তাহলে আমরা কিভাবে পড়ব? স্বাধীন মতপ্রকাশের পথ এভাবে কেন বন্ধ করা হবে?
দেশ পরিচালনায় নিযুক্ত ব্যক্তিবর্গ, আপনারা কিভাবে ভুলে যান যে, জামায়াতে ইসলাম ১৯৭১ সালে কিভাবে এদেশের সূর্য্যসন্তানদের হত্যা করেছে। এই একই ধর্মের দোহাই তুলে। ৪২ বছর পরে এবারও স্বাধীনতাবিরোধী গোষ্ঠী সেই একই কায়দায় রুদ্ধ করতে চাইছে এদেশের মুক্ত চিন্তা-স্বাধীন মতপ্রকাশের পথ। আর সরকার মহোদয়রা সেই কাজেই আরও সহায়তা করছেন। এর চেয়ে দুঃখজনক আর কি হতে পারে? বিএনপি যদি এই কাজটা করত তাহলে এটাকে দুঃখজনক বলে আখ্যায়িত করার প্রয়োজন পড়ত না। কারণ তারা তো সেটা করবেই, ঐতিহাসিকভাবে তারা এটা করে এসেছে। এখনো তারা হেফাজতে ইসলামের প্রতি, প্রকারান্তরে জামায়াত শিবিরের প্রতি নৈতিক সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আওয়ামী লিগ? তারা না মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি? এই আওয়ামী লিগই না ১৯৭২ সালে ‘গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতাকে মূল নীতি করে সংবিধান রচনা করেছিল?’ মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকার-চেতনা সব কি ভেসে গেল ভোটের চিন্তায়? পক্ষ নিন সরকার- মানবতা না মুনাফা?

নতজানু আর নয়

শাহবাগ আন্দোলনের শুরুর দিকে অনেকেই ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করে, ১৯৭২ সালের সংবিধান অনুযায়ী ধর্মনিরপেক্ষতার পথে হাঁটার আওয়াজ তুলেছিলেন। সেসময় কৌশলগত কারণে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি বাদ দিয়ে শুধু জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধের দাবিতে সরে আসা হয়েছিল। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে এতে জামায়াত-শিবিরের কর্ম-পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করার পথ প্রসারিত হয়েছে। নিষিদ্ধ হয়ে যাবে বুঝতে পেরেই তারা হেফাজতে ইসলামের ব্যানারে সংগঠিত হচ্ছে। ফলে জামায়াত-শিবিরকে শুধু নিষিদ্ধ করলেই হবে না। নিষিদ্ধ করতে হবে তাদের রক্ষণশীল-সাম্প্রদায়িক মতাদর্শকেও। যেমনটা করা হয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর হিটলারের নাৎসি পার্টিকে। এমনভাবে তাদেরকে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল যে এখনও, ৬২ বছর পরে নাৎসি ভঙ্গিতে স্যালুট দেওয়ার দায়ে আজীবনের জন্য নিষিদ্ধ করা হয় প্রতিভাবান তরুণ ফুটবলারকে। এইরকম কঠোরভাবেই বন্ধ করে দিতে হবে জামায়াত-শিবিরের এখানে সেখানে গজিয়ে ওঠার পথ। তাহলেই কেবল একটি অসাম্প্রদায়িক, মানবিকতার সমাজের পথে অগ্রসর হওয়া সম্ভব বাংলাদেশের পক্ষে। যেমন বাংলাদেশের স্বপ্ন বুকে নিয়ে মুক্তির সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন পুরো দেশের স্বাধীনতাকামী মানুষ। ফলে শাহবাগ চত্বরে দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছে, একথা যদি স্বীকার করে নিই, তাহলে বিজয় অর্জন করতে গেলে সেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নের পথেই হাঁটতে হবে শাহবাগ আন্দোলনকে। ষ্পষ্টভাবে বলতে হবে, ৭১ এ স্বাধীনতাবিরোধী গোষ্ঠী যে আদর্শ-মতবাদের প্রেক্ষিতে রাজনীতি করছে, স্বাধীন বাংলাদেশে সেই মতাদর্শ বাস্তবায়নের কোন অধিকার থাকতে পারবে না। সাংবিধানিকভাবে তাদের রাজনৈতিক অধিকার বিলোপ করতে হবে।

নাস্তিকতার বিভ্রান্তি দূর হবে কিভাবে?

556684_10151485313048104_1449525823_n

প্রচণ্ড কোনঠাসা অবস্থার মধ্যে পড়েও জামায়াত-শিবিরই মনে হয় এখন পর্যন্ত কৌশলগত দিক থেকে সফল। শুরুতেই তারা রাজীব হায়দারকে খুন করে শাহবাগ আন্দোলনটাকে ‘আস্তিক-নাস্তিক’ পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছে। ভেবেছিলাম এই কৌশলটা ধোপে টিকবে না। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে যে, এই পরিকল্পনা দারুণভাবে সফলতা অর্জন করেছে। এখন জামায়াত-শিবিরের বদলে হেফাজতে ইসলামকে আদর্শিকভাবে মোকাবিলা করাটাই একটা বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিভাবে দূর করা যাবে এই নাস্তিকতার বিভ্রান্তি? কি পরিকল্পনা গণজাগরণ মঞ্চের? সরকারের?

ধোঁয়াশাপূর্ণ সব বক্তব্য দিয়ে আন্দোলন-কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে হেফাজতে ইসলাম। জিজ্ঞাসা করলে কোন প্রশ্নের উত্তর তাঁরা স্পষ্ট করে দিতে পারবেন কিনা সন্দেহ আছে। ‘নাস্তিক ব্লগার-নাস্তিক ব্লগার’ রব তুলে তারা সবার মনোযোগ কেড়ে নিয়েছে ঠিকই, কিন্তু ব্লগিং বা নাস্তিকতা সম্পর্কে তাদের কোন স্বচ্ছ ধারণাই নেই বলে প্রতিয়মান হয়।

গতকাল রাতে বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাতকারে হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা জুনায়েদ বাবু বলেন, ‘আমাদের দাবি হলো, বর্তমানে যে ব্লগাররা আছে, যারা রাসুল (সা.)-এর অবমাননাকারী, ইসলামের বিদ্বেষী, নাস্তিক্যবাদী, তাদের শাস্তি হওয়া উচিত। সরকার যেন তাদের উচিত শাস্তি দেয়।’ আপনি যেসব ব্লগারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করছেন, তারা অসলে কী লিখেছে, আপনি কি একটা বলতে পারবেন? আপনি নিজে তা পড়েছেন? বিবিসির এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘না, পড়ি নাই। না পড়লেও সমস্যা নাই, আমার যারা কর্মী আছে, কর্মীদের আমরা দায়িত্ব দিছি। তারা পড়েছে। তারা আমাদের শুনাইছে। তারা তো সেইগুলা আমাদের সামনে নিয়া আসছে।’ সেই সব ব্লগারের উচিত শাস্তিটি কী—বিবিসির এই প্রশ্নের উত্তরে মাওলানা জুনায়েদ বাবু বলেন, ‘আমাদের দাবি হলো উচিত শাস্তি দিতে হবে, তারা যেন এই সমস্ত কাজ আর না করে।’

আগে জানতাম নেতারাই পড়াশোনা করে কর্মীদের হেদায়েত দান করেন, সবার নানারকম প্রশ্নের জবাব দেন। এখন তো দেখা যাচ্ছে হেফাজতে ইসলামের কর্মীরাই নেতাদেরকে সবকিছু জানানোর দায়িত্বটা পালন করছে। ভালো কথা, তা করুক। কিন্তু কোন সুনির্দিষ্ট যৌক্তিক বক্তব্য কিন্তু পাওয়া যাচ্ছে না এই নেতা-কর্মীদের কাছ থেকে। তারা দাবি করছে যারা এই সমস্ত কাজ করে তাদের উচিত্ শাস্তি দিতে হবে। ব্যাপারটা এমন দাঁড়িয়েছে যে, কি কাজ, কে করেছে, কবে করেছে, প্রমাণ কিছু আছে কিনা— কোন কিছুই বুঝি না, তারপরও বিচার চাই। এর চেয়ে হাস্যকর-অযৌক্তিক কোন বিষয় এই একবিংশ শতাব্দীর পৃথিবীতে হতে পারে?

এখন পুরো ব্যাপারটা দেখা হচ্ছে জামায়াত-শিবিরের সঙ্গে হেফাজতে ইসলামের সংযুক্তি-সম্পৃক্ততার বিষয় হিসেবে। কিন্তু এই দিক দিয়ে জিনিসটা মোকাবিলা করতে গেলে আরও প্যাঁচ লেগে যাওয়ার আশঙ্কা আছে। বাংলাদেশে ধর্মভীরু মুসলমানের সংখ্যা কম নয়। কয়েকদিন আগেই সাঈদীকে চাঁদে দেখিয়ে অনেক মানুষকে উন্মত্ত করে তুলেছিল জামায়াত-শিবির। ভবিষ্যতে যদি হেফাজতে ইসলামের বিরুদ্ধেও শাহবাগ আন্দোলনের প্রকাশ্য বিরোধ শুরু হয়ে যায়, তাহলে তার পরিণাম বোধহয় ভালো হবে না। গণজাগরণ মঞ্চের পক্ষ থেকে ধর্ম বিষয়ক বিভ্রান্তি দূর করার সর্বোচ্চ চেষ্টাই আমার ধারণা করা হয়েছে। শাহবাগ চত্বরে বারবার উচ্চারিত হয়ে যে, ‘এই আন্দোলনের সঙ্গে ধর্মের কোন বিরোধ নেই, ধর্ম যার যার, দেশ সবার’ ইত্যাদি। যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে ইসলামপন্থী ওলামা-মাশায়েখ ঐক্য পরিষদের নেতৃবৃন্দও সোচ্চার হয়েছেন। তাঁরাও দৃঢ়কণ্ঠে জানিয়েছেন যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবি। তারপরও এই ধর্ম-নাস্তিকতার কার্ড খেলে যাচ্ছে হেফাজতে ইসলাম। গণজাগরণ মঞ্চের সঙ্গে কোন আলোচনাতে যেতেও রাজি নয় তারা। তাহলে এখন এই বিভ্রান্তিমূলক পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের উপায় কি?

285661_586128814749514_2133248007_n

এখন বোধহয় এ বিষয়ে সরকারের অনেক কিছু করার আছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা থেকে শুরু করে দেশ চালানোর কাজে নিযুক্ত সব্বাই তো শাহবাগের গণজাগরণকে সমর্থন জানিয়েছিলেন একবাক্যে। তারা কি করছেন আসলে? কেন দূর করছেন না এই বিভ্রান্তি? বাংলাদেশের ধর্ম মন্ত্রণালয় কি করছে? তাদের দিক থেকে কোন বিবৃতি নেই কেন? সরকারের পক্ষ থেকে সুনির্দিষ্টভাবে শুনতে চাওয়া হোক হেফাজতে ইসলামের অভিযোগসমূহ। কোন ব্লগারের বিরুদ্ধে তারা ব্যবস্থা নিতে বলছেন? কোন ব্লগগুলোকে তারা “প্রিয় নবীজির (সা.) শানে বেয়াদবির” সামিল বলে মনে করছে? কোন বিষয়গুলোকে তারা “জনগণের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার” সামিল বলে মনে করছে? সুনির্দিষ্টভাবে শুনতে চাওয়া হোক। তাহলেই তো সকলের কাছে স্পষ্ট হয়ে যাবে তাদের অবস্থান। অযথাই কান নিয়ে গেছে চিলে বলে দিশাবিহীন দৌড়াদৌড়ি করার কি দরকার?

এই মুহূর্তে হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে জামায়াত-শিবিরের সংশ্লিষ্টতা খোঁজার চেয়ে এই প্রশ্নগুলোর উত্তর জানতে চাওয়াটাই তো মনে হয় বেশি জরুরি। কারণ জামায়াত-শিবির আজ হেফাজতে ইসলামের আড়ালে কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে, কাল অন্য কিছুর আড়ালে আশ্রয় নেবে। এর মূলে হাত দেওয়াটাই কি জরুরি না?

সাবাশ বাংলাদেশ, এ পৃথিবী অবাক তাকিয়ে রয়

এই মুহূর্তে মনে হয় সত্যিই পৃথিবী তাকিয়ে আছে বাংলাদেশের দিকে। বা বলা যায় তাকানো শুরু করেছে, কিছুটা সংশয়, কিছুটা আশাবাদ, কিছুটা কৌতুহল-বিস্ময় নিয়ে। গত ৫ ফেব্রুয়ারি শাহবাগ আন্দোলন শুরু হওয়ার পর আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনগুলো থেকে আমরা সেরকমই একটা ইঙ্গিত পেয়েছি। আন্তর্জাতিক মিডিয়ার কাভারেজের পরিমাণ বা ধরণ নিয়ে অনেকেরই অনেক সমালোচনা আছে। আমার নিজেরও আছে। কিন্তু এর মধ্যেও, বাংলাদেশের এই গণজাগরণ যে পুরো বিশ্বের সামনেই একটা বিকল্প রুপকল্প দাঁড় করিয়েছে, সে কথা উঠেছে বর্হিবিশ্ব থেকেই। এবং বাংলাদেশ যে বিশ্বকে আরও অনেক শিক্ষা-বার্তা দিতে পারে; শাহবাগ চত্বর যে পুরো বিশ্বের সামনেই নতুন এক দিগন্ত উন্মোচন করতে পারে, তেমন সম্ভাবনার কথাও উচ্চারিত হয়েছে বর্হিবিশ্বের মানুষদের মুখে। এবং তারা এই সম্ভাবনার কথা বলেছেন সম্ভ্রমের সঙ্গে, আশার সঙ্গে। কিন্তু কেন এই সম্ভ্রম, আশাবাদ?  পুরো বিশ্ব কেন তাকিয়ে আছে শাহবাগ চত্বরের ঐক্যবদ্ধ তারুণ্যের দিকে?

1

১৯৭১ সালে যে হানাদার পাকসেনাদের বিরুদ্ধে রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছিলাম, ৪২ বছর পর শাহবাগ আন্দোলন তার প্রথম শিক্ষাটা দিয়েছে এই পাকিস্তানকেই। দীর্ঘ ৪২ বছর ধরে পাকিস্তানের শাসকেরা তাদের নাগরিকদের-শিক্ষার্থীদের শিখিয়েছে ভুল ইতিহাস। বাংলাদেশ নামক ভূখণ্ডের এই মানুষগুলো যে সবক্ষেত্রে প্রচ্ল অনাচার-বৈষম্য-নির্যাতন-নিপীড়ণের শিকার হওয়ার পর স্বাধীনতার ডাক দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, সেই ইতিহাসটা পাকিস্তানের বেশিরভাগ মানুষ জানে না। বা যারা জানে, তাদের বৃহদাংশ মনে করে শুধুমাত্র সেনাবাহিনীর প্রশাসনিক ব্যর্থতার কারণে বাংলাদেশ একটা স্বাধীন দেশ হিসেবে দাঁড়াতে পেরেছে। এবং অনেকেই মনে করেন যে, স্বাধীন বাংলার জন্ম না হলেই ভালো হতো।

কিন্তু এই রকমের ইতিহাস বিকৃতির ফলাফল যে ভালো হয় না সেটা খুব স্পষ্টভাবে বলেছেন পাকিস্তানের এক ইতিহাসের শিক্ষক। ১৮ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের ট্রিবিউন পত্রিকায় প্রকাশিত এক লেখায় ইয়াকুব খান বাঙগাস লিখেছেন,

‘১৯৭০-৭১ সালের ঘটনাগুলোর দিকে আমাদের দৃষ্টি দিতে না চাওয়ায় আমরা এখনো আমাদের অন্যান্য সাংবিধানিক প্রদেশগুলো নিয়ে অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে আছি। এবং আমরা নিজেদের পৃথক পৃথক পরিচিতি নিয়ে গর্ব বোধ করতে পারি না। আমরা ভয় পাই যে, সিন্ধু আমাদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে কারণ সেখানকার মানুষেরা উর্দুর পাশাপাশি তাদের ভাষাটারও স্বীকৃতি চায়। আমরা বেলুচিস্থানে একটা সামরিক অপারেশন চালিয়েছি তার প্রধান কারণ হলো, সেখানকার মানুষেরা তাদের প্রদেশটি নিজেরাই পরিচালনা করতে চেয়েছে। আমরা অস্বস্তিতে আছি এটা ভেবে যে, দক্ষিণ পাঞ্জাব ও বাহাওয়ালপুর আলাদা প্রদেশ হয়ে যায় কিনা। সেখানে একটা আকস্মিক অভ্যুত্থান ঘটে যায় কিনা, এই ভয়ে আমরা ব্যাপারগুলো নিয়ে আলাপ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছি এবং আমরা গিলগিট-বালিস্তানের মানুষদের পূর্ণ নাগরিক অধিকার দেই নি। এগুলোর বেশিরভাগই হচ্ছে ঐ বিগত দিনের ঘটনাগুলোর ভূত। আমরা সেগুলো নিয়ে ভাবতে চাই না, অগ্রাহ্য করি আর আশা করি যে, আলৌকিকভাবে সেগুলো নিজে থেকেই গায়েব হয়ে যাবে।’

কিন্তু তেমনটা যে বাস্তবে হয় না, সেকথাও পরিস্কারভাবেই বলেছেন ইয়াকুব খান। এবং পাকিস্তান যদি এই সমস্যাগুলোর কার্যকর সমাধান করতে চায়, তাহলে দেশটির শাসকদের বাংলাদেশের কাছ থেকেই শিক্ষা নিতে হবে বলে মত দিয়েছেন ইতিহাস বিভাগের এই শিক্ষক। তিনি বলেছেন, ‘ ইতিহাস খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শুধু এই কারণে না যে, সেটা নিজে থেকেই পুনরাবৃত্তি ঘটায় বা ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা আছে। বরং ইতিহাস এইজন্যও গুরুত্বপূর্ণ যে, বারংবার ঐতিহাসিক ঘটনাগুলো অগ্রাহ্য করা একটা দেশের জাতিগত চেতনায় প্রভাব ফেলে। এবং পুরো দেশটাই পুরোনো ঐ ঘটনাগুলোর কবলে জিম্মি হয়ে থাকে।’ সমাধান হিসেবে তিনি পাকিস্তান সরকারকে দেখিয়েছেন ভুল স্বীকার করার পথ। লিখেছেন, ‘পাকিস্তানি সরকারের জন্য এটাই সুবর্ণ সময়, তত্কালিন পূর্ব পাকিস্তানের মানুষদের উপরে তারা যে বর্বরতা চালিয়েছিল সেটা আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার করার। সত্য ঘটনাকে সামনে নিয়ে আসবে এমন ঐতিহাসিক দলিলগুলো এতদিন ধরে তারা লুকিয়ে রেখেছে। সেগুলো সবার জন্য উন্মুক্ত করতে রাজি হতে হবে। সেমময়কার যেসব অপরাধী এখনো বেঁচে আছে তাদেরকে আইনের আওতায় এনে ন্যায়বিচার করতে হবে। জনসমক্ষে ঘোষণা দিতে হবে যে, ১৯৭০-৭১ সালে আমরা একটা জাতি হিসেবে, হ্যাঁ, আমরা, সামগ্রিকভাবে যা করেছি সেটার জন্য আমরা দুঃখিত।’ সেটা পাকিস্তান সরকার করবে কিনা, সেটা তাদের ব্যাপার।

আমাদেরকে তো এই মুহূর্তে দেশের পরিস্থিতি নিয়েই ভীষণভাবে উদ্বিগ্ন থাকতে হচ্ছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার ৪২ বছর পরেও আমাদেরকে জিম্মি হয়ে থাকতে হচ্ছে খোদ স্বাধীনতাবিরোধী গোষ্ঠীটির সহিংস হুমকির কাছে। যেখানে খোদ পাকিস্তানেই মুক্তিযুদ্ধের সময়কার যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আওতায় হাজির করার দাবি উঠছে, সেখানে স্বাধীন বাংলাদেশে এখনো তাণ্ডব চালিয়ে যেতে পারছে পাক বাহিনীর সহোদর জামায়াত-শিবির। এই কি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অর্জন?

যেখানে খোদ পাকিস্তানেই আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে এবারের একুশে ফেব্রুয়ারি পালিত হয়েছে বেশ সমাদরের সঙ্গে, সেখানে বাংলাদেশের একুশে ফেব্রুয়ারিতে জামায়াত-শিবির বিভিন্ন জায়গায় শহীদ মিনার ভেঙ্গেছে। ইতিহাসের কি নির্মম পরিহাস! মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্য ভেঙ্গে, বাস-ট্রেনে আগুন দিয়ে, বোমাবাজি-ককটেলবাজি করে জনমনে ত্রাস ছড়িয়েছে এই পাকিস্তানের প্রেতাত্মারা। আর গণজাগরণকে অস্বীকার করে, পুরো দেশের মানুষের নায্য দাবীর আন্দোলনকে অস্বীকার করে নব্য রাজাকারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে প্রধান বিরোধীদল বিএনপি। তারা যে শুধু নিজেরা ক্ষমতায় যাওয়ার জন্যই আন্দোলন করে, সেকথা এখন পুরোপুরি স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে দেশের মানুষের কাছে। তাহলে কি দেশে শুধু আওয়ামী লিগেরই রাজনীতি থাকবে? তখন বিরোধী দল কে হবে? বামদলগুলো নাকি ইসলামপন্থী দলগুলো? তৃতীয় শক্তির আবির্ভাব হবে? নাকি শক্তিশালী বিরোধী দলের অনুপস্থিতিতে দেশ চলে যাবে ফ্যাসিবাদী শাসনের কবলে? উত্তর এখন জানা নেই, ভাবতে হবে সবাইকেই।

তবে এই প্রশ্নগুলোর উপস্থিতি এটাই ইঙ্গিত দেয় যে, বর্তমানে বাংলাদেশ একটা সংকটপূর্ণ পরিস্থিতি পার করছে। কিন্তু অনেক খারাপ সংবাদ, মেনে নিতে না পারার মতো পরিস্থিতির মধ্যেও এবারের সংকটটা তৈরি হয়েছে অনেক অনেক আশা নিয়ে, অনেক অনেক স্বপ্ন নিয়ে। ৫২, ৬৯, ৭১, ৯০-এর মতো ২০১৩ সালের ইতিহাসটাতেও লিপিবদ্ধ হচ্ছে জনমানুষের উপস্থিতি। জনগণের সংঘবদ্ধতা, তারুণ্যের তীব্র দীপ্তি, মুক্তিকামী মানুষের সংহতি-সৃজনশীলতা দিয়ে ২০১৩-র ইতিহাস রচিত হচ্ছে। এটাই অনেক আশার কথা। অনেক বড় স্বপ্ন দেখার জায়গা। সত্যিকারের গণজাগরণে, মানুষের মুষ্ঠিবদ্ধ হাতের ঐক্যবদ্ধতায় ভুল হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে। এখন আমাদের সামনে, সাধারণ জনগণের সামনে সুবর্ণ সুযোগ এসেছে রাজাকার-যুদ্ধাপরাধীদের নিমূল করে ‘সোনার বাংলা’ গড়ার স্বপ্ন দেখার। দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে দেশকে সত্যিকারের স্বাধীন করার সময় বোধহয় এখনই। এবারের এই জেগে ওঠা তারুণ্য যদি আবার প্রতারিত হয়, তাহলে তার চেয়ে হতাশার বোধহয় আর কিছুই থাকবে না। আর আমাদের সামনে অনুপ্রেরণা হিসেবে তো অনেককিছু আছে। ৫২ আছে, ৬৯ আছে, ৭১ আছে, ৯০ আছে। আমরা তো অনেকখানি এগিয়েই গেছি। এখন আমাদের শুধু ইতিহাস থেকে শিক্ষাটা নিয়ে শুরু করে দিলেই হয়। তবে তার আগে আত্মসমালোচনা দরকার। আত্মশুদ্ধির প্রক্রিয়া দরকার। ভুল স্বীকার করে নিতে পারার মানসিকতা দরকার। সবারই। ব্যক্তিমানুষেরও, সংগঠনেরও। সরকারেরও। এটাই বোধহয় আমাদের প্রকৃত মানবিকতার দিকে নিয়ে যেতে পারে। ভুল কারো হতেই পারে। কিন্তু ভুল প্রমাণিত হওয়ার পরে সেটা স্বীকার করে নিতে পারার মতো বিনীত আমাদের হওয়া উচিত্।

জামায়াত-শিবির এখন পর্যন্ত যেসব নাষকতা চালিয়েছে, তার সবকিছুই তারা করছে বিভ্রান্তিমূলক, প্রতারণামূলক প্রচারণার মাধ্যমে। যেগুলো কিছু কিছু ক্ষেত্রে হাস্যরসেরও উপাদান হয়। কিন্তু এটা তো তারা করতে পারছে। কেন করতে পারছে? এটা কি আমাদেরই ব্যর্থতা না? কেন স্বাধীনতার ৪২ বছর পরেও যুদ্ধাপরাধীদের সংগঠন জামায়াত-ই-ইসলামি এইভাবে ধর্মের নামে মানুষকে ক্ষেপিয়ে তুলতে পারছে? শাহবাগের এই নায্য দাবী, এখানকার তরুণেরা একুশ-মুক্তিযুদ্ধের চেতনা দ্বারা যেভাবে অনুপ্রাণিত হয়েছে, ২য় মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে যেভাবে ‘সোনার বাংলা’ গড়ার স্বপ্ন দেখছে, সেটা কি পুরো দেশের মানুষ অনুধাবন করছেন? সবার কাছে কী গণজাগরণের দৃপ্ত তারুণ্যের দিপ্তী পৌঁছাচ্ছে? আমরা কি ১৬ কোটি মানুষের বাংলাদেশে বিরাজমান শিক্ষাগত-সাংস্কৃতিক ব্যবধান-বৈষম্য ঘোঁচানোর কথা ভাবছি?

জামায়াত-শিবির স্বাধীনতার পর গত ৪২ বছরে যেভাবে পুরো দেশজুড়ে তাদের বহুবিধ বিস্তার ঘটিয়েছে সেটা হুট করে গায়েব করে দেওয়া সম্ভব না। নিষিদ্ধ করার মাধ্যমে তাদেরকে অনেকটাই দুর্বল করে দেওয়া যায় কিন্তু পুরোপুরি নির্মুল হয়তো করা যাবে না। কারণ আজ চাঁদের গায়ে সাঈদী দেখাচ্ছে, কাল মেঘের গায়ে মওদুদীকে দেখাবে। এবং কে জানে, সেটা দেখেও হয়তো অনেক ধর্মভীরু মানুষ প্রাণের তোয়াক্কা না করে রাস্তায় বেরিয়ে আসবে বাস-ট্রেন পোড়াতে, বোমাবাজি করতে। সেধরণের পরিস্থিতি মোটেই কাম্য নয়। অহিংস গণজাগরণের মানসিকতায় সেই পরিস্থিতির ঠাঁয় নাই। ফলে আমার মতে, জামায়াত-শিবির নির্মূল করার জন্য শিক্ষা ও সংস্কৃতির বৈষম্য ঘোঁচানোর কাজ শুরু করাটা খুবই জরুরি। সত্যিকার অর্থেই দেশের প্রতিটি কোনায় কোনায়, গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে দেওয়া উচিত্ ৭১-এর এই পুনরুদ্ধারিত চেতনার আগুন। মানুষ শুধু একবার এই শাহবাগের তরুণদের কথা শোনার অপেক্ষায় আছে। দেশ গড়ার যে তেজী প্রত্যয় নিয়ে অনেক তরুণ শাহবাগে পড়ে আছে দিনের পর দিন, তাদের দৃপ্ত মুখটা দেখলেই হয়তো এই শাহবাগ আন্দোলন নিয়ে সংশয়ে ভোগা অনেক মানুষ প্রাণপণে দাঁড়িয়ে যাবেন জামায়াত-শিবিরের নাষকতার বিরুদ্ধে। দেশে একমাত্র সাংস্কৃতিক প্রচার দিয়েই শান্তির পায়ড়া ওড়ানো সম্ভব, অহিংস উপায়ে। এখন আমরা সম্মিলিতভাবে এই দায়িত্ব পালন করতে পারব কিনা, সেটাই হচ্ছে প্রশ্ন।

এই মুহূর্তে আসলে শুধু বাংলাদেশই না, পুরো বিশ্বই একটা সংকটপূর্ণ পরিস্থিতি পার করছে। আর সত্যিই হয়তো এই যুদ্ধপিড়ীত, বিপন্ন বিশ্ব তাকিয়ে আছে বাংলাদেশের দিকে। এখন হয়তো বর্হিবিশ্বে এই শাহবাগ আন্দোলন নিয়ে অনেকের মধ্যে বিভ্রান্তি-সংশয়-নেতিবাচকতা  আছে। ভবিষ্যত্ নিয়ে উত্কণ্ঠা আছে। কিন্তু অনেকেই শাহবাগ আন্দোলনের ভবিষ্যত্ দেখার জন্য তাকিয়ে আছেন প্রচ্ল কৌতুহল নিয়ে। তারা এখান থেকে পাচ্ছেন নতুন দিনের ইঙ্গিত, তারা খুঁজে বের করছেন এই আন্দোলনের অনন্যতা, এই আন্দোলনের সম্ভবনা। কে জানে!

02-21-2013motherlanguage

এই আশাবাদের কারণ হচ্ছে, পুরো বিশ্বকেই পথ দেখানোর নজির বাংলাদেশের ইতিহাসে আগেও আছে। ভাষা যে মনুষ্য সমাজের খুবই গুরুত্বপূর্ণ উপাদান, এবং এই ভাষার অধিকার ছাড়া যে একটা জাতির বিকাশ সম্ভব না, এই সত্যটা পুরো পৃথিবীকে রক্তের বিনিময়ে জানিয়েছিলেন ভাষা শহীদেরা। মনুষ্যবিকাশের পথে ভাষা-সংস্কৃতির যে অপরিহার্যতা, তার প্রতি এখন সহমত পোষণ করেছে পুরো বিশ্ব। ১৯৯৯ সালে ২১শে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেওয়া হয়। আর তারপর থেকে পুরো বিশ্বে নানাভাবে বেড়েছে ভাষা বিষয়ক গবেষণা, প্রতিবেদন, চিন্তাভাবনা। ২০০০ সালের পর থেকে এখন পর্যন্ত মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষ্যে ভাষিক বৈচিত্র্য, বিপন্ন বা বিলুপ্তির হুমকির মুখে থাকা ভাষাগুলো সংরক্ষণ, মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের প্রয়োজনীয়তা, ব্রেইল ও সংকেত ভাষার উন্নয়ন, তথ্যপ্রযুক্তি ও ভাষার সম্পর্ক, বহুভাষিক শিক্ষা ইত্যাদি বিষয় নিয়ে কাজ করেছে জাতিসংঘ। ফলে, বাংলাদেশ আরও একবার নতুন কিছু দিতেই পারে পুরো বিশ্বকে। শাহবাগ আন্দোলন থেকে আরও অনেক শিক্ষাবার্তা, সংকেত-ইশারা হয়তো আগামীতেও পেতে পারেন বর্হিবিশ্বের মুক্তমনা উত্সুক ব্যক্তি/সংগঠন। কে জানে, তারা বোধহয় তেমন কিছু একটা আশাও করছেন?