Posts Tagged ‘ গ্রীস ’

ইউরো কাপের আদিকথা ও চিনপরিচয়

১৯৬০ সালে প্রথম উয়েফা ইউরোপিয়ান ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপটা যখন বাস্তবে মাঠে গড়িয়েছিল, তখন আসলে পূরণ হয়েছিল হেনরি ডুলানির আজন্ম লালিত একটা স্বপ্ন। দীর্ঘদিন ফ্রান্স ফুটবল ফেডারেশনের অগ্রণী ব্যক্তি হিসেবে কাজ করা ডুলানিই ১৯২৭ সালে প্রথমবারের মতো প্রস্তাব করেছিলেন ইউরোপভিত্তিক জাতীয় এই ফুটবল প্রতিযোগিতা আয়োজনের। এরপর দীর্ঘদিন বর্তমানের এই ইউরো কাপটার বাস্তব রুপ দেওয়ার জন্য কাজ করে গেলেও সফল হননি তিনি। ১৯৫৫ সালে চিরনিদ্রায় শায়িত হন এসময়ের অন্যতম শীর্ষ এই ক্রীড়া প্রতিযোগিতার স্বপ্নদ্রষ্টা। তাঁর মৃত্যুর তিন বছর পরে, ১৯৫৮ সালে সিদ্ধান্ত হয় সেসময়ের উয়েফা ইউরোপিয়ান ন্যাশনস কাপ। ডুলানির স্মরণে ১৯৬০ সালে প্রথমবারের আসরটি আয়োজন করা হয়েছিল ফ্রান্সে। শিরোপাজয়ী দলকে যে শিরোপাটা তুলে দেওয়া হয় তাতেও ছিল ডুমিনির নাম। প্রথম আসরে এক উত্তেজনাপূর্ণ ফাইনালে যুগোস্লোভিয়াকে ২-১ গোলে হারিয়ে প্রথমবারের শিরোপাটা জিতেছিল তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন।
তৃতীয় আসর (১৯৬৮) থেকে প্রতিযোগিতাটির নাম দেওয়া হয় উয়েফা ইউরোপিয়ান ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপ। আর গত আসর থেকে সংক্ষেপে সালভিত্তিক নামকরণের প্রচলন হয়। ইউরো ২০০৮ এর মতো এবারের আসরকেও ডাকা হচ্ছে ইউরো ২০১২। আর মাত্র ১৬ দিন পর থেকে পোল্যান্ড ও ইউক্রেনের মাটিতে শুরু হতে যাচ্ছে ইউরোপের সবচেয়ে বড় এই জাতীয় ফুটবলের প্রতিযোগিতা। স্বাগতিক দুই দেশ ছাড়াও এবারের আসরে অংশ নিতে যাচ্ছে ক্রোয়েশিয়া, চেক রিপাবলিক, ডেনমার্ক, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, গ্রীস, ইতালি, জার্মানি, নেদারল্যান্ড, পর্তুগাল, আয়ারল্যান্ড, রাশিয়া সুইডেন ও গতবারের শিরোপাজয়ী স্পেন। চারটি করে গ্রুপে ভাগ হয়ে প্রথমে গ্রুপ পর্বে অংশ নেবে মোট ১৬টি দেশ। গ্রুপের প্রতিটি দলের মুখোমুখি লড়াইয়ের পর গ্রুপ তালিকার শীর্ষ দুইটি করে দল অংশ নেবে কোয়ার্টার ফাইনালে। এরপর সেমিফাইনাল এবং চূড়ান্ত ও অন্তিম লড়াই, ফাইনাল। এখানেই নির্ধারিত হবে যে, কোন দেশ পাবে আগামী চার বছরের জন্য ইউরোপসেরার খেতাব।
বিগত ১৩টি আসরের ইউরো কাপ শিরোপা জয়ের স্বাদ পেয়েছে মোট নয়টি দেশ। সবচেয়ে বেশি, তিনবার শিরোপা জিতেছে জার্মানি। ফ্রান্স ও স্পেন শিরোপার দেখা পেয়েছে দুইবার করে। আর একবার করে জিতেছে ইতালি, চেকোস্লোভিয়া, নেদারল্যান্ড, ডেনমার্ক, গ্রীস ও তৎকালিন সোভিয়েত ইউনিয়ন। কিন্তু সবচেয়ে মজার ব্যাপার হচ্ছে, এখন পর্যন্ত টানা দুইটি শিরোপা জিততে পারেনি কোন দেশই। এ থেকে এই প্রতিযোগিতার চরম প্রতিদ্বন্দ্বীতাপূর্ণ পরিস্থিতি সম্পর্কেও বেশ ভালোই অনুমান করা যায়। তবে এইবার সেই নতুন ইতিহাস গড়ার সুযোগ আছে স্পেনের সামনে। ২০০৮ সালে গত আসরের শিরোপা জিতেছিল বর্তমানে ফুটবলের এই এক নম্বর দলটি। দুই বছর পর বিশ্বকাপ জিতে বিশ্ব ফুটবলেও নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করেছেন ক্যাসিয়াস-জাভি-ইনিয়েস্তারা। আর এবারের ইউরো কাপেও তারা নিশ্চিতভাবেই বিবেচিত হবে শিরোপার অন্যতম প্রধান দাবিদার হিসেবে। এখন যদি তারা এক মাসের হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের পর শেষ হাসি হাসতে পারে, তাহলে স্পেনই হবে টানা দুইটি ইউরো চ্যাম্পিয়নশীপ জয়ী প্রথম দল।

ঋণের বোঝা আমরা কেন নিতে যাব?

শেয়ারবাজারের বিশাল বিশাল ধ্বস, অস্থিরতা ইত্যাদি দেখে আঁঁচ করা যাচ্ছিল যে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি খুব একটা ভালো না। কিন্তু অবস্থা যে খুবই খারাপ, সেটা এতদিন আমাদের অগোচরেই ছিল। ৩০ অক্টোবর প্রথম আলোর একটি খবর থেকে জানা গেল যে, সরকার মহাশয় ‘চরম আর্থিক সংকটে’ রয়েছেন এবং ঘাটতি মেটাতে এবার সার্বভৌম ঋণ বা বন্ড ছেড়ে বিদেশ থেকে টাকা সংগ্রহ করতে চলেছেন। বাংলাদেশের ৪০ বছরের ইতিহাসে এমন বাণিজ্যিক ঋণের নজির আগে কখনো দেখা যায় নি।

সরকার যদি সত্যিই এই পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করে, তাহলে বিপুল পরিমাণ উচ্চ সুদযুক্ত ঋণের বোঝা এক অর্থে আমাদের অর্থাত্ বাংলাদেশের সমস্ত মানুষের উপরই চাপতে যাচ্ছে। আমাদের কী এই ভার বহন করার মতো বাস্তব পরিস্থিতি আছে? এটা কী আদৌ কোন দীর্ঘমেয়াদী সুফল বয়ে আনবে? অর্থনীতিবীদ, বিশেষজ্ঞরা কিন্তু উত্তরটা না-ই দিচ্ছেন। সরকারের এই নতুন উদ্যোগে উদ্বেগ প্রকাশ করে তাঁরা বলছেন, ‘এই জাতীয় ঋণের মধ্যে ঢুকলে মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদে তা দেশের অর্থনৈতিক কাঠামোকেই ক্ষতিগ্রস্থ করবে।’ তাহলে আমরা কেন এই ঋণের বোঝা মাথায় নিতে যাব? সরকারের এই পদক্ষেপের সঙ্গে বাংলাদেশের প্রতিটা নাগরিকেরই প্রত্যক্ষ সম্পর্ক আছে। সেক্ষেত্রে নজিরবিহীন এই বিশাল উদ্যোগটির কথা আমাদেরকে জানানো হলো না কেন? সরকার কারও সঙ্গে কোন ধরণের আলোচনা-মতবিনিময় না করেই এই বিধ্বংসী পরিকল্পনা বাস্তবায়নের দিকে এগিয়ে চলেছেন। এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে আসলে কী ধরণের পদ্ধতিতে পরিচালিত হচ্ছে, সেই প্রশ্নটা এসেই যাচ্ছে। এটা কী ধরণের গণতন্ত্র? কোথায় এখানে সরকারের জবাবদিহিতা-স্বচ্ছতা? এভাবে একদিন দেনার দায়ে লাঞ্ছিত-অপমানিত হলেও আমাদের কিছুই বলার থাকবে না? বসে থাকব আমরা, পাঁচ বছর পর পর মহান ভোটাধিকার প্রয়োগ করার জন্য?

পত্রিকা সূত্রে জানা যাচ্ছে, ইতিমধ্যেই একটি বিদেশী ব্যাংকের পক্ষ থেকে অর্থমন্ত্রী ও অর্থসচিবের কাছে এ ঋণ নেওয়ার বিভিন্ন দিক উপস্থাপনও করা হয়েছে। তারা বাংলাদেশ ব্যাংককে এ বিষয়ে একটি প্রতিবেদন তৈরি করে দিতেও বলেছে। শ্রীলঙ্কার পথ অনুসরণ করে ৬.২৫% সুদ হারে ১০ বছর মেয়াদের ঋণ আন্তর্জাতিক বাজার থেকে নিতে পারে বাংলাদেশ। ৫০ থেকে ১০০ কোটি ডলার ঋণের জন্য বণ্ড ছাড়া হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এর জন্য দেশের আর্থিক অবস্থার সূচকগুলো প্রদর্শন করে বর্হিবিশ্বে রোড শো করে বেড়াতে হবে সরকারকে। সরকারের নেওয়া ব্যাংক ঋণের কারণে মূল্যস্ফীতিসহ সামষ্টিক অর্থনীতিতে নানা সমস্যা দেখা দিয়েছে, স্থানীয় ও বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সরকারকে আর অর্থের যোগান দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না, বৈদেশিক লেনদেনের উপর চাপ পড়ছে, শেয়ারবাজারে বিগত ১ বছর ধরে চরম অস্থিরতা বিরাজ করছে— এই জাতীয় সূচকগুলোই নিশ্চয় দেখানো হবে এই রোড শো গুলোতে? এগুলো বিশ্লেষণ করেই নিশ্চয়ই বাংলাদেশকে ঋণ দেওয়ার লাভ-ক্ষতির হিসাব-নিকাশ কষবে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো। অর্থনৈতিক হিসাব-নিকাশ, আন্তর্জাতিক ঋণ দেওয়া-নেওয়ার আইনকানুনের মারপ্যাঁচের মধ্যে না গিয়েও, শুধু নিজের আত্মসম্মানের জায়গা থেকেও বলার আছে যে, এই ধরণের পরিস্থিতি আমাদের জন্য অবমাননাকর। আমি অন্তত চাই না যে, বিশ্বদরবারে এভাবে নিজেদের দুর্বলতা প্রদর্শন করে ধার চেয়ে বেড়াতে। সরকার তাহলে এ ধরণের অপমানজনক পরিস্থিতির মধ্যে আমাদের কেন ফেলে দিচ্ছে? কোন ধরণের কথাবার্তা-অবহিতকরণ ছাড়াই?

এই প্রশ্ন তোলাটা সম্ভবত এখন খুবই জরুরি হয়ে পড়েছে। সম্প্রতি খোদ গণতন্ত্রের জন্মভূমি গ্রীস নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণা করেছে। দেনার দায় শোধ করতে না পেরে। পরিস্থিতি উত্তরণে ভর্তুকি কমানো, ট্যাক্স বৃদ্ধি ইত্যাদি কারণে অবিরাম রাষ্ট্র-জনতার সংঘর্ষ চলছে সেখানে। আমাদের পরিস্থিতিও কী সেদিকেই যেতে বসেছে? ২০২১ সালে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা ঝলমল করবে নাকি দেনার দায়ে পেট শুকিয়ে থাকতে হবে? এই ঋণ যদি নেওয়াও হয়, তাহলে তা শোধ করার মতো বাস্তব-কার্যকরী পরিকল্পনা আছে কী আমাদের দিন বদলের সরকারের? কোন ধরণের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে সরকারের অবশ্যই এই প্রশ্নগুলির উত্তর দেওয়া উচিত্। আমাদেরও মনে হয় বারংবার প্রশ্নগুলো করে সরকারকে জবাবদিহি করতে বাধ্য করা প্রয়োজন।

 

 

নোম চমস্কি: ইসরায়েলের জন্য সুনামি সতর্কবার্তা

মে মাসে ইসরায়েলের ব্যবসায়িক নেতাদের এক রুদ্ধদ্বার বৈঠকে ইদান ওফার সবাইকে সতর্ক করেছিলেন যে, ‘আমরা খুব দ্রুতই দক্ষিণ আফ্রিকা হয়ে যাচ্ছি। আন্তর্জাতিক আইনভঙ্গকারী হিসেবে আমাদের যে অর্থনৈতিক দণ্ডের সম্মুখীন হতে হবে, তার প্রভাব ইসরায়েলের প্রতিটা পরিবারের উপর পড়বে।’ এই ব্যবসায়িক নেতাদের প্রধান ভাবনার বিষয় ছিল, এই সেপ্টেম্বরে শুরু হওয়া জাতিসঙ্ঘের সাধারণ অধিবেশন। যেখানে ফিলিস্তিনের মানুষ নিজেদের রাষ্ট্রসত্তার বৈধতার দাবি তোলার পরিকল্পনা করছে। ঐ বৈঠকে আরও একজনের মুখে সতর্কবার্তা উচ্চারিত হয়েছিল। জাতিসঙ্ঘে নিযুক্ত ইসরায়েলের সাবেক রাষ্ট্রদূত বলেছিলেন, ‘ফিলিস্তিনকে একটা স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা দেওয়ার পরের দিন থেকেই ইসরায়েলের খুব কষ্টকর ও নাটকীয় একটা দক্ষিণ আফ্রিকাকরণ শুরু হবে।’ মানে, ইসরায়েল পরিণত হবে একটা অপরাধী রাষ্ট্রে। যার উপর আন্তর্জাতিক আইনানুযায়ী দণ্ড প্রযোজ্য হতে পারে।

এটা এবং এরকম আরও কিছু বৈঠকে ব্যবসায়িক গোষ্ঠী সরকারকে তাগাদা দিলেন বিগত দিনের মত দ্রুত এই ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের পরিকল্পনা ভেস্তে দেওয়ার উদ্যোগ নিতে। যেমনটা তারা আগে করেছিল সৌদি (আরব লীগ) প্রস্তাবসমূহ বা ২০০৩ সালে অনানুষ্ঠানিক জেনেভা চুক্তিসমূহের সময়। যেখানে উচ্চপর্যায়ের ইসরায়েলি ও ফিলিস্তিন নেতাদের মধ্যে একটা দুই রাষ্ট্র ব্যবস্থা বিষয়ে বিস্তারিত চুক্তি হয়েছিল। বিশ্বের বেশিরভাগ দেশ এটাকে স্বাগতও জানিয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীতে যুক্তরাষ্ট্রের অবহেলা ও ইসরায়েলের বিরুপ মনোভাবের কারণে তা বাস্তবায়িত হয়নি।
গত মার্চ মাসে ইসরায়েরের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইহুদ বারাক সাবধানবানী শুনিয়েছিলেন যে, যদি জাতিসঙ্ঘ ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি ঘোষণা করে, তাহলে ইসরায়েলর জন্য “সুনামি” অপেক্ষা করছে। তাঁর ভয় ছিল, পুরো বিশ্ব ইসরায়েলকে অপরাধী বানাবে শুধু এই কারণে নয় যে, তাঁরা আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করেছে। বরং এইজন্যও যে, তারা জাতিসঙ্ঘ স্বীকৃত একটা রাষ্ট্রে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড সংগঠিত করেছে। ফলে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল এটা রুখবার জন্য উচ্চপর্যায়ের কূটনৈতিক তত্পরতা চালাচ্ছে। যদি তারা ব্যর্থ হয়, তাহলে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের বৈধতা অবশ্যম্ভাবী।
১০০টিরও বেশি দেশ ফিলিস্তিনকে বৈধতা দিয়েছে। যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও অন্যান্য ইউরোপীয় দেশগুলো ফিলিস্তিনের সাধারণ ঘোষণাপত্রকে ‘কূটনৈতিক মিশন ও দূতাবাসের’ মর্যাদা দিয়েছে। যা সাধারণত শুধু কোন রাষ্ট্রের জন্যই সংরক্ষিত থাকে। আমেরিকান জার্নাল অব ইন্টারন্যালনাল ল-এ এই তথ্যটা সরবরাহ করেছেন ভিক্টর কাতান। ইউনেসকো ও ডব্লিউএইচও ছাড়া জাতিসঙ্ঘের সংগঠনগুলোতেও প্রবেশাধিকার পেয়েছে ফিলিস্তিন। তারা যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক অসহযোগিতার ভয়টাও পাত্তা দেয় নি।
যদি রাষ্ট্রসত্তার স্বীকৃতির দাবি থেকে সরে না আসে, তাহলে ফিলিস্তিনকে সাহায্য-সহযোগিতা বন্ধের হুমকি দিয়ে গত জুনে যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটে একটি বিল পাস করা হয়। ডেইলি টেলিগ্রাফের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, জাতিসঙ্ঘে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত সুশান রাইস সবাইকে সতর্ক করেছিলেন এই বলে যে, ‘জাতিসঙ্ঘকে টাকা জোগানোটা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য খুব বেশি হুমকি ছিল না, যতটা এখন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের বৈধরুপ প্রাপ্তির দিকসমূহ চিন্তা করে হচ্ছে। আর এটা হচ্ছে সহযোগী রাষ্ট্রসমূহের সহায়তাতেই।’ জাতিসঙ্ঘে ইসরায়েলের নতুন রাষ্ট্রদূত তার দেশের সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে জাতিসঙ্ঘের স্বীকৃতি সহিংসতা ও যুদ্ধে রুপ নিতে পারে।
জাতিসঙ্ঘ হয়তো ফিলিস্তিনকে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সীমানা ধরেই রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করতে পারে। সেক্ষেত্রে এই রাষ্ট্রের মধ্যে গোলান হাইটস, পশ্চিম তীর ও গাজাও অন্তর্ভূক্ত হবে।
১৯৮১ সালের ডিসেম্বরে, জাতিসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদের আদেশ ভঙ্গ করে ইসরায়েল এই হাইটস অধিগ্রহণ করেছিল। পশ্চিম তীরে ইসরায়েলকে সমর্থন যোগানোর জন্য যে বন্দোবস্ত ও আইন-কানুন জারি আছে, তা পরিস্কারভাবেই আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন। আন্তর্জাতিক আদালত ও নিরাপত্তা পরিষদও এটা স্বীকার করেছে।
২০০৬ সালের ফেব্রুয়ারীতে, যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল যৌথভাবে গাজার উপর অবরোধ জারি করে। এর কারণ ফিলিস্তিনের নির্বাচনে ‘ভুলপক্ষ’ হামাস জয়লাভ করেছিল। যাদের পরিচিতি স্বাধীনচেতা হিসেবে। ২০০৭ সালের জুনে যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত একটা সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে এই নির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার মিশন ব্যর্থ হওয়ার পর এই অবরোধ আরও জোরদার করা হয়েছিল।
২০১০ সালে রেড ক্রস আন্তর্জাতিক কমিটি এই গাজা অবরোধের তীব্র নিন্দা জানিয়েছিল। যারা এ ধরণের ইস্যু নিয়ে খুব কমই কথা বলে। বিবিসির প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, রেডক্রস অবরুদ্ধ গাজা পরিস্থিতির একটা বিষণ্ন চিত্র এঁকেছিল এভাবে, ‘হাসপাতালে প্রয়োজনীয় উপকরণ নেই, প্রতিদিন ঘন্টার পর ঘন্টা বিদ্যুত্ থাকে না, পানযোগ্য পানির অপর্যাপ্ততা এবং অবশ্যই এই সমগ্র জনগোষ্ঠী কারারুদ্ধ।’
১৯৯১ সালে গাজাকে পশ্চিম তীর থেকে পৃথক করার পরিকল্পনা শুরু করার পর থেকেই এই ধরণের অপরাধমূলক অবরোধ যুক্তরাষ্ট্র-ইসরায়েলের নীতি-নির্ধারণে বিস্তর প্রভাব রেখেছে। এর মাধ্যমে তারা এটা নিশ্চিত করে যে, যদি কখনো কোন ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র মাথা তুলে দাঁড়ায়, তাহলে তার অংশগুলো যেন ইসরায়েল ও জর্ডানের মতো শত্রুতাপূর্ণ ক্ষমতার আওতায় থাকে। ১৯৯৩ সালে, ইসরায়েল ও ফিলিস্তিন লিবারেশন অর্গানাইজেশনের (পিএলও) মধ্যে স্বাক্ষরিত অসলো চুক্তিতে গাজাকে পশ্চিম তীর থেকে পৃথক করার সুপারিশ করা হয়।
যুক্তরাষ্ট্র-ইসরায়েলের এই প্রত্যাখ্যানবাদের ফলে আরও একটা আসন্ন হুমকির মুখে আছে ফ্লোটিলা, যারা চিঠিপত্র ও জনহিতকর সাহায্য নিয়ে এনে গাজার এই অবরোধকে চ্যালেঞ্জ জানাতে চেয়েছিল। ২০১০ এর মে মাসে এ ধরণের একটা উদ্যোগ ইসরায়েলি কমান্ডোদের আক্রমণের মুখে পড়েছিল। গাজার আন্তর্জাতিক সমুদ্রসীমার মধ্যে পরিচালিত এই হামলায় মারা গিয়েছিল নয়জন যাত্রী। যা একটা বড় অপরাধ। যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া প্রায় সবাই এই হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়েছিল।
ইসরায়েলের বেশিরভাগ মানুষ নিজেদের বুঝিয়েছে যে, কমান্ডোরা নির্দোষ ছিল। হামলাকৃত ঐ জাহাজের যাত্রীরাই আগে আক্রমন চালিয়েছিল। কী ধরণের আত্মবিধ্বংসী অযৌক্তিকতা ইসরায়েলকে কুরে কুরে খাচ্ছে, এটা তার একটা চিহ্ন।
এখন যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল ফ্লোটিলা তত্পরতা বন্ধ করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে। হিলারি ক্লিনটন অপ্রত্যক্ষভাবে সহিংসতাকে আরও বৈধতা দিয়েছেন। বলেছেন, যদি ফ্লোটিলা ‘ইসরায়েলের জলসীমায় ঢুকে উসকানি দেওয়ার চেষ্টা করে’ তাহলে ‘ইসরায়েলিদের আত্মরক্ষা করার পূর্ণ অধিকার আছে।’
গ্রীস তাদের নৌবন্দর থেকে এই নৌযানগুলো ছেড়ে যাওয়া প্রতিরোধ করার ব্যাপারে সম্মতি জানিয়েছিল। যদিও ক্লিনটনের মতো, গ্রীসও খুব সঠিকভাবেই গাজার সমুদ্রসীমা নির্ধারণ করেছিল। অবশ্য ২০০৯ সালের জানুয়ারীতে গ্রীস একটা স্বতন্ত্র অবস্থান নিয়েছিল। সেসময় গাজার ওপর যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের নৃশংস সহিংসতা চলাকালে তারা যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র ইসরায়েলে নিয়ে যাওয়ার জন্য তাদের বন্দর ব্যবহার করতে দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল।
ফ্লোটিলা কোন উসকানিমূলক কর্মকাণ্ড কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে জাতিসঙ্ঘের ত্রাণ ও কর্মসংস্থান এজেন্সির মুখপাত্র ক্রিস গানেস বলেন, ‘যদি ফিলিস্তিনে কোন মানবাধিকার সংকট না-ই থাকে, যদি সেখানে কোন ধরণেরই সংকট না থাকে, তাহলে ফ্লোটিলারও কোন প্রয়োজন পড়বে না। গাজার ৯৫ ভাগ পানি পাণ করার উপযোগী না। সেখানে ৪০ ভাগ রোগই পানিবাহিত। শ্রমিকদের ৪৫.২ ভাগ বেকার। তাদের টিকে থাকার জন্য ৮০ ভাগেরও বেশি নির্ভর করতে হয় বাইরের সাহায্য-সহযোগিতার জন্য। আর এই পরিস্থিতির করুণ অবনতি হয়েছে গাজায় অবরোধ জারির পর থেকে। এই অবরোধ তুলে নেওয়া হোক। তাহলে আর কোন ফ্লোটিলারও প্রয়োজন পড়বে না।’
ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি বা সাধারণভাবে যে কোন অসহিংস কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য কূটনৈতিক উদ্যোগ তাদেরকে হুমকির মুখে ফেলে দেয়, যারা সহিংসতাকে একচেটিয়াভাবে দখলে রেখেছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল, নিজেদের একেবারে ক্ষমার অযোগ্য একটা অবস্থানে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে: দখলদারিত্ব ও নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড এবং একটা কূটনৈতিক বন্দোবস্ত বা ঐক্যমত্যে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রিতা।