রক্ত নিয়ে হোলি-খেলা, ফুরিয়ে গেছে তোদের বেলা
ছোট আকারে হলেও গতকাল ৬ এপ্রিল মুখোমুখি সংঘর্ষে জড়িয়েছে হেফাজতে ইসলাম ও শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চ। পুরো দেশজুড়ে এমন ঘটনা আরও কিছু ঘটেছে। গতকাল ৬ এপ্রিল যখন শাহবাগ আন্দোলনের কর্মীরা হেফাজতে ইসলামের হামলা প্রতিহত করার জন্য উত্তেজিতভাবে লাঠি-বাঁশ সংগ্রহ করছিলেন, ঠিক সেই সময় মঞ্চ থেকে নতুন এই শ্লোগানটি শুনতে পেলাম: ‘রক্ত নিয়ে হোলি-খেলা, ফুরিয়ে গেছে তোদের বেলা’। শুনে খুবই ভালো লাগল। আসলেই, রক্তের হোলি-খেলা বন্ধ করার সময় এখন। অপশক্তির দিক থেকে আক্রমণ আসলে সেটা প্রতিহত করার শক্তি আমাদের যেমন অর্জন করতে হবে, তেমনি যখন সংঘর্ষ চলছে না, সেসময় এই পেশিশক্তির লড়াই কিভাবে এড়ানো যায়, সেকথাও আমাদের চিন্তা করতে হবে। সমান গুরুত্ব দিয়ে। বর্তমান তরুণ প্রজন্মের যে মেধাবী সন্তানরা জীবন তুচ্ছ করে লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে, তাদের রক্তাক্ত লাশ কোন পরিস্থিতিতেই কাম্য না। তাদের মগজটাই আজকের লড়াইয়ে বেশি জরুরি।
কেন তৈরি হলো সাংঘর্ষিক পরিস্থিতি?
পেশিশক্তির সাংঘর্ষিক পরিস্থিতি এড়ানো যায় নি। তবে একটা বিষয় স্পষ্ট যে, এই মুখোমুখি সংঘর্ষের জন্য কোনভাবেই গণজাগরণ মঞ্চ বা শাহবাগ আন্দোলনের কর্মীদের দায়ি করার সুযোগ নেই। শাহবাগ আন্দোলনের কর্মীরা আগ বাড়িয়ে হেফাজতে ইসলামের উপর আক্রমণ করতে যায়নি। শাহবাগ যখন আক্রান্ত হয়েছে, তখন অনেকেই নিজ উদ্যোগে নিজেদের আত্মরক্ষার স্বার্থে লাঠি হাতে নিয়েছে।
অনেকেই হয়তো গণজাগরণ মঞ্চ ও ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি, সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর ঢাকা হরতাল-অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণাকে সমর্থন করতে পারেননি। কিন্তু যখন একথা বেশ ভালোভাবেই প্রতিষ্ঠা করা গেছে যে, হেফাজতে ইসলাম আসলে জামায়েতী ইসলামকেই হেফাজত করতে চাচ্ছে, দেশের সব ভাস্কর্য-শহীদ মীনার ভেঙ্গে ফেলার কথা বলছে, নারী-পুরুষের প্রকাশ্য মেলামেশা বন্ধ করার দাবি তুলছে তখন তাদেরকে প্রতিহত করার দায়িত্ব কি মুক্তমনা-স্বাধীনচেতা মানুষরা অনুভব করবেন না? যেখানে আওয়ামী লিগ সরকারও তাদের কথা অনুযায়ী ৪ জন বগারকে গ্রেফতার করেছে এবং ১৩ দফার অধিকাংশ দাবি মেনে নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে, তখন এই হরতাল-অবরোধের পক্ষে যুক্তি দেখানোর অনেক জায়গা আছে।
২৬ মার্চ জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধ সংক্রান্ত আল্টিমেটাম শেষ হওয়ার পর যখন গণজাগরণ মঞ্চ থেকে কোন কঠোর কর্মসূুিচ আসেনি, শাহবাগে কিছুটা দ্বিধা-বিভক্তি, মতানৈক্য ইত্যাদি তৈরি হয়েছে। শহীদ রুমী স্কোয়াড আমরণ অনশনের ঘোষণা দেওয়ার পর আবার আশার আলো জ্বলছিল শাহবাগ চত্বরে। এরই মধ্যে বেশ কাঁপাকাঁপি দিয়ে ময়দানে আবির্ভাব ঘটে হেফাজতে ইসলামের। মধ্যযুগীয় কায়দার ১৩ দফা দাবি দিয়ে। ‘নাস্তিক ব্লগারদের’ ফাঁসির দাবি নিয়ে। সরকারও তাদের দাবির প্রতি নতজানু হয়ে ৪ জন ব্লগারকে গ্রেফতার করে। নজীরবিহীন কায়দায়। আমারব্লগ বন্ধ করে দেয়। অন্যদিকে শহীদ রুমী স্কোয়াডের সঙ্গে একরকম প্রতারণা করেই তাদের অনশন কর্মসূচি স্থগিত করানো হয়। প্রতারণা বললাম এই কারণে যে, মাননীয় পরিকল্পনামন্ত্রী এ কে খন্দকার বলেছিলেন জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধের দাবি মেনে না নিলে তিনি নিজেই অনশনে বসবেন। কবে সেটা? জানা যায় নি। ফলে অনেকেই মনে হয় কিছুটা হলেও আশাহত হয়েছিলেন, উদ্যোম হারিয়েছিলেন। ফলে সরকারও হয়তো ভাবতে শুরু করেছিল যে, ওদেরকে তো শান্ত করাই গেছে, এখন তাদের দাবির দিকে না তাকালেও হবে। বরং অন্যদিকটাই ট্যাকল দিই। এই পর্যায়ে শাহবাগ আন্দোলনের পক্ষ থেকেও সরকারকে জানিয়ে দিতে পারাটা দরকার ছিল যে, আমরাও আমাদের দাবি থেকে একচুল নড়িনি। আবার সবাইকে স্মরণ করিয়ে দেওয়ার দরকার ছিল যে, ‘আমরা বাড়ি ফিরছি না/রাজাকারদের ছাড়ছি না’। নিজেদের শক্তিমত্তা সম্পর্কে জানান দেওয়ার দরকার ছিল। নাহলে সবাই মনে করত যে, শাহবাগ আন্দোলন সতিই শেষের পথে।
আর রুমী স্কোয়াডের ৮দিনের আমরণ অনশন কর্মসূচিতেও যে সরকারের কোন ভ্রুক্ষেপ হয়নি সেটা তো বোঝাই যায়। এই পরিস্থিতিতে শাহবাগের অস্তিত্বের কথা সরকারকে মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য কঠোর কর্মসূচিরই প্রয়োজনীয়তা ছিল। দেশ পরিচালনায় নিযুক্ত রাজনীতিবিদরা এখনো হয়তো বুঝতে পারছেন না যে, শাহবাগ আন্দোলন ও হেফাজতে ইসলাম পুরোপুরি বিপরীতধর্মী দুইটা পক্ষ। দুই পক্ষ পরস্পরের পুরোপুরি উল্টাপথে হাঁটতে চায়। একপক্ষ চায় সামনে এগোতে, আরেক পক্ষ চায় পেছনে ফিরে যেতে। দুইটি আদর্শের মতভিন্নতা এতটাই বেশি যে, এটার মধ্যে কোন সমন্বয়ও সম্ভব কিনা, সন্দেহ আছে। ফলে সরকার যদি সবসময় ভোটবুদ্ধি না খাটিয়ে একটু যুক্তিবুদ্ধি খাটাতো তাহলে হেফাজতে ইসলামকে আস্কারা দেওয়ার আত্মঘাতি সিদ্ধান্ত কখনোই নিত না। আফসোস যে, তারা সেটা করছেন না। ফলে শাহবাগ আন্দোলনের পক্ষ থেকে নব উদ্যোমে সংগঠিত হওয়ার এই সুযোগটা ইতিবাচকই হয়েছে বলে আশা করছি।
শুধু হাত–ইয়ার না… মন–ইয়ারও চাই…
এই একবিংশ শতাব্দির পৃথিবীতে হেফাজতে ইসলাম যে ধরণের দাবিদাওয়া উঠিয়েছে, সেটা মেনে দেওয়া প্রায় অসম্ভব রকমের ব্যাপার। কিন্তু তাদেরকে সহিংস উপায়ে হাতিয়ারের সাহায্যে মোকাবিলা করার পথ বেছে নেওয়া মোটেই মনে হয় উচিত্ হবে না দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধের সৈনিকদের। একথা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই যে, হেফাজতে ইসলামের ডাকে রাস্তায় বেরিয়ে আসা লোকের সংখ্যাও বাংলাদেশে কম না। এবং ধর্ম বিষয়টা আসলেও খুব স্পর্ষকাতর ইস্যু। তাই খুবই সাবধানতার সাথে এই পরিস্থিতি মোকাবিলা করা প্রয়োজন।
হেফাজতে ইসলামের লংমার্চে যারা অংশ নিয়েছিলেন তাদের অধিকাংশই জীবনে কখনো ইন্টারনেট, ফেসবুক-ব্লগ ব্যবহারের সুযোগ পেয়েছেন কিনা সন্দেহ আছে। তারা ধর্মভিত্তিক বইগুলো ছাড়া অন্য কোন বই পড়ারও সুযোগ পেয়েছেন কিনা সন্দেহ আছে। ফলে শিক্ষিত-শহুরে মানুষদের থেকে তাদের মানসিক ব্যবধানটা যে অনেক বেশি থাকবে, এতে আশ্চর্যের কি আছে। কিন্তু ‘আমরা জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা করি, আমরা মুক্তমনা’ এই বলে আত্মপ্রসাদের ভোগাটাও বিপদজনক হবে অপর পক্ষের জন্য। বরং দুই পক্ষের সাংস্কৃতিক-মানসিক মেলবন্ধনটা কিভাবে হতে পারে সেটাই বিবেচনা করা দরকার।
গতকাল খুব অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম, আমার এক স্কুলবন্ধুর মনে জন্মেছে প্রচণ্ড ইসলাম বিদ্বেষ। ইসলাম ধর্ম মানবকল্যানের জন্য, শান্তির জন্য কোন অবদান রাখতে পারে না বলেই সে মনে করে। এই ধরণের আলট্রা মডার্ন দৃষ্টিভঙ্গিও কিন্তু আখেরে সমাজের কোন কল্যান বয়ে আনবে না। এই রকমের দৃষ্টিভঙ্গি বরং ঘৃণার বিপরীতে আরও ঘৃণাই ছড়াবে। সমাজকে শান্তির পথে নিয়ে নিয়ে যাবে না। স্বাধীনতা-সমবেদনার পথে নিয়ে যাবে না।
ধর্মচিন্তা-ধর্ম সংক্রান্ত আলাপ-আলোচনাকে পরিহার-পরিত্যাগ করে অনেকদিন থাকা হয়েছে। প্রগতিশীলদের পক্ষ থেকে ধর্মীয় আলাপ দূরে সরিয়ে রাখার যে প্রবণতা, এতদিন সেটারই ফায়দা নিয়েছে কট্টরপন্থী, রক্ষণশীলরা। তারা নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য ইসলাম ধর্ম বা অতীতে আরও অনেক ধর্মের অপব্যাখ্যা দিয়েছে, এখনো দিচ্ছে। একদল মানুষ কিছু না বুঝেই মোল্লা-পুরোহিতদের সাথে সাথ মিলিয়ে গেছেন, পরকালের ভয়ে। অপরদিকে কিছু মানুষ এসব দেখে পুরো ধর্মটাকেই অবজ্ঞা করতে শুরু করেছেন। এটা এক ভয়াবহ দুষ্টচক্র। পুরো সমাজের কল্যানেই এর অবসান ঘটানো প্রয়োজন।
দুই পক্ষের সামজিক-সাংস্কৃতিক ব্যবধানটা ঘোঁচাতে হবে। সেটা জ্ঞান-বিজ্ঞানের দিক থেকেও, ধর্মীয় বা আধ্যাত্মিকতার দিক থেকেও। মানুষের জন্য, সমাজের জন্য বিজ্ঞানভিত্তিক অগ্রগতিটা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি মনুষ্যজন্মের মহিমা বোঝার জন্য আধ্যাত্মিক চর্চাটাও সমান গুরুত্বপূর্ণ। সেই আধ্যাত্মিকতার চর্চা ইসলাম ধর্ম দিয়েও হতে পারে, অন্যান্য ধর্ম-মতবাদ দিয়েও হতে পারে। আধ্যাত্মিক শূণ্যতা (Spiritual Vacuum) যে সামগ্রিকভাবে সমাজের জন্য ক্ষতিকর সেটা নিয়ে পশ্চিমে বেশ কথাবার্তা শুরু হয়েছে। কারণ তারা এটা টের পাওয়া শুরু করেছে। বাজার সংস্কৃতিতে সব কিছু কিনতে পাওয়া গেলেও মনের শান্তিটা এখনও পর্যন্ত কোন কোম্পানি বাজারজাত করে নাই। আর এই মনের শান্তি লাভের উপায়-উপাদানগুলো অনেকাংশে সংরক্ষিত আছে বিভিন্ন ধর্মীয় মতবাদগুলোর মধ্যে। পুরো ধর্মকেই খারিজ করে দেওয়ার প্রবনতা থেকে সরে এসে আমাদের বরং ধর্মীয় মতবাদগুলোর মুক্তিকামী উপাদানগুলো খুঁজে বের করা দরকার। সেগুলো প্রচার-প্রসার করা দরকার।
আর এটা করতে গেলে আমাদের ওঠাতে হবে মন-ইয়ার। অস্ত্রে নয়, শান দিতে হবে যুক্তিতে। মানবতার পক্ষে, সাম্য-স্বাধীনতার পক্ষে নিরন্তর প্রচারণা চালাতে হবে। সমাজের সুবিধাবঞ্চিত মানুষদের কাছে যেমন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে যেতে হবে, জ্ঞান-বিজ্ঞান অগ্রগতির খবর নিয়ে যেতে হবে, তেমনি ইসলামসহ প্রতিটা ধর্মে বিরাজমান সাম্য-শান্তি-সমবেদনার বার্তাও পৌঁছে দিতে হবে। বর্তমানে দেশের যা পরিস্থিতি তাতে, ব্যাপক আকারের সাংস্কৃতিক প্রচারণার মাধ্যমেই কেবল রক্ত নিয়ে হোলি খেলা বন্ধ করা সম্ভব।