টমসনের আগুনের গোলা
ওয়ানডে ক্রিকেটের শুরুর দিকে ক্রিকেট জগতের সবচেয়ে বিধ্বংসী বোলিং জুটি হিসেবে গণ্য করা হতো দুই অস্ট্রেলিয়ান ফাস্ট বোলার ডেনিস লিলি ও জেফ টমসনকে। ওয়েস্ট ইন্ডিজ কিংবদন্তী ক্লাইভ লয়েড তাঁর দেখা সবচেয়ে দ্রুতগতির বোলারের নাম বলতে গিয়ে বলেছেন টমসনের কথা। ১৫০ কিমি বেগে থমসন যে বলগুলো ছুঁড়তেন সেগুলোকে বুলেট গতিতে ছুটে যাওয়া এক একটা আগুনের গোলার সঙ্গেও তুলনা করা যায় অনায়াসে। আর সে আমলে তো এখনকার মতো সুরক্ষা ব্যাটসম্যানদের ছিল না। হেলমেট, হ্যান্ডপ্যাড ছাড়া এই বিধ্বংসী বোলারের মুখোমুখি হয়ে অনেকেই শুধু যে উইকেটটি খুইয়েছেন তাই নয়। বরং শারিরীকভাবেও আহত হয়েছেন-এমন উদাহরণ প্রচুর পাওয়া যাবে। এ ধরণেরই একটা ঘটনা ঘটেছিল প্রথম বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে শ্রীলঙ্কার তৃতীয় ম্যাচটাতে। টমসনের গোলার আঘাতে আহত হয়ে রীতিমতো হাসপাতালে যেতে হয়েছিল দুই শ্রীলঙ্কান ব্যাটসম্যান সুনীল ওয়েট্টিমুনি ও দিলীপ মেন্ডিসকে।
টেস্ট খেলুড়ে দেশগুলোর বাইরে শুধু শ্রীলঙ্কা আর পূর্ব আফ্রিকাই অংশ নিয়েছিল প্রথম বিশ্বকাপে। অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে আগে কখনো টেস্ট না খেলার কারণে ডেনিস লিলি বা জেফ টমসনের বিধ্বংসী বোলিং সম্পর্কে কোন ধারণাই ছিল না লঙ্কানদের। বিশ্বকাপে তাদের প্রথম ম্যাচে নিউজিল্যান্ডের কাছে তারা হারে ৯ উইকেটে। দ্বিতীয় ম্যাচে অ্যান্ডি রবার্টস, বার্নার্ড জুলিয়েন, কেইথ বোয়েসদের সামনে তারা গুটিয়ে যায় মাত্র ৮৬ রানে। এই ম্যাচটাও তাদের হারের ব্যবধান ৯ উইকেট। তৃতীয় ম্যাচে এবার আর আগে ব্যাট করতে নামতে হয় নি শ্রীলঙ্কাকে। টসে জিতে প্রথমে বল করাটাকেই সুবিধাজনক মনে করেছিলেন শ্রীলঙ্কান অধিনায়ক আনুরা টেন্নেকুন। অ্যালান টার্নারের সেঞ্চুরির সুবাদে শ্রীলঙ্কাকে ৩২৯ রানের (৬০ ওভারে) লক্ষ্য বেঁধে দেয় অস্ট্রেলিয়া।
প্রথম দুই ম্যাচের মতো এবার আর অতটা হুড়মুড়িয়ে ভেঙ্গে পড়লেন না লঙ্কান ব্যাটসম্যানরা। বেশ ভালোই লড়তে লাগলেন লিলি-টমসনদের বিধ্বংসী বোলিংয়ের সামনে। ৩২ ওভারে মাত্র ২ উইকেট হারিয়ে তারা সংগ্রহ করেছিলেন ১৫০ রান। কিন্তু তারপর যেন একেবারে রুদ্রমুর্তি ধারণ করলেন জেফ টমসন। দ্বিতীয় স্পেলে বল করতে এসে যেন আগুন ঝড়াতে লাগলেন ওভালের বাউন্সি উইকেটে। ৩২ রান করে ঐ গোলার আঘাতে একেবারে হাসপাতালে চলে যেতে হয় মেন্ডিসকে। অপরপ্রান্তে দাঁড়ানো ওয়েট্টিমুনির মানসিক অবস্থাটা তখন কেমন ছিল, তা অনুমান করাই যায়। কিন্তু ৫২ রান করে তখনও বেশ ভালোই লড়ে যাচ্ছিলেন তিনি। বেশ কয়েকবার তাঁর গায়ে বল লাগলেও হার মানেন নি। কিছুক্ষণ সেবাশুশ্রুসার পর আবার ব্যাট হাতে দাঁড়িয়েছেন। এতেই যেন বলের গতি আরো বাড়িয়ে দিলেন টমসন। কিছুক্ষণ পরে এবার আর শেষরক্ষা করতে পারলেন না ওয়েট্টিমুনি। মাথায় গুরুতর আঘাত পেয়ে মেন্ডিসের পিছু পিছু তাকেও যেতে হলো হাসপাতালে। তবে তার আগে তিনি পূর্ণ করতে পেরেছিলেন ক্যারিয়ারের প্রথম অর্ধশতক।
ওয়েট্টিমুনি পরে টমসনের সেই স্পেলটার কথা স্মরণ করতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘ঐ বলগুলো ছিল একেকটা আলোর ঝলকানির মতো। আমি সেগুলো একটাও দেখতে পাই নি।’ আর মেন্ডিস বলেছিলেন, ‘সে বল করছিল ১০০ মাইল গতিতে। আমি এরচেয়ে দ্রুতগতির বল কখনো মোকাবিলা করিনি।’ টমসন অবশ্য তার বাউন্সারগুলোকে সত্যিকারের বাউন্সার বলতে রাজি নন। তাঁর মতে তিনি স্বাভাবিকভাবেই বল করছিলেন! শ্রীলঙ্কান ব্যাটসম্যানদের গড় উচ্চতা অনেক কম বলে ওগুলো নাকি বাউন্সার বলে মনে হয়েছিল! সেই ম্যাচে ১২ ওভার বল করে মাত্র ২২ রান দিয়ে একটি উইকেট নিয়েছিলেন টমসন। তাঁর উইকেট একটা গণ্য হলেও কার্যত তিনি আরো দুইজনকে সাজঘরে (হাসপাতালেই বলা ভালো) পাঠিয়েছিলেন। শেষপর্যন্ত সেই ম্যাচটা শ্রীলঙ্কা হেরেছিল ৫২ রানে।