বার্মিংহামের সেই ম্যাচটি
সবাই জানেন, ১৯৭৫ সালে প্রথম ক্রিকেট বিশ্বকাপটা জিতেছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। কিন্তু এটা হয়তো অনেকেরই অজানা যে, বিশ্বকাপে তাদের দ্বিতীয় ম্যাচটাই হেরে গ্রুপ পর্ব থেকেই ছিটকে যেতে বসেছিলেন ক্লাইভ লয়েড, ভিভ রিচার্ডসরা। পাকিস্তানের বিপক্ষে সেই ম্যাচটাতে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ভালোমতোই প্রমাণ করেছিল যে, ক্রিকেট ‘অনিশ্চয়তার খেলা’। এখানে অনেক কিছু অনুমান করা সম্ভব হলেও শেষ বলটার আগ পর্যন্ত জোর দিয়ে কিছুই বলা যায় না।
এখনো পর্যন্ত বিশ্বকাপের অনেক উত্তেজনাপূর্ণ ম্যাচই তাঁবু গেড়েছে ক্রিকেটপ্রেমীদের স্মৃতিতে। স্থান করে নিয়েছে ক্রিকেট ইতিহাসে। প্রথম বিশ্বকাপে বার্মিংহামে ওয়েস্ট ইন্ডিজ-পাকিস্তানের এই ম্যাচটিকেও নিঃসন্দেহে জায়গা দেওয়া যায় সেই তালিকার প্রথম সারিতে।
বার্মিংহামের রৌদ্রজ্জ্বল সকালে নিজেদের অজান্তেই এক স্মরণীয় ম্যাচের টস করতে নেমেছিলেন উইন্ডিজ অধিনায়ক ক্লাইভ লয়েড ও পাকিস্তান অধিনায়ক মজিদ খান। টসে জিতে ব্যাট করার সিদ্ধান্ত নেয় পাকিস্তান। অ্যান্ডি রবার্টস, কেইথ বয়েস, বের্নাড জুলিয়েনদের দুর্ধর্ষ পেস আক্রমণ বেশ ভালোমতোই মোকাবিলা করছিলেন পাকিস্তানি ব্যাটসম্যানরা। অধিনায়ক মজিদ খান খেলেছিলেন ৬০ রানের এক অনবদ্য ইনিংস। পরে মুশতাক মোহাম্মদের ৫৫, ওয়াসিম রাজার ৫৭ বলে ৫৮ রানের ইনিংস দুটির সুবাদে নির্ধারিত ৬০ ওভারে পাকিস্তানের সংগ্রহ দাঁড়ায় ২৬৬ রান।
গর্ডন গ্রিনিজ, আলভিন কালিচরন, রোহান কানহাই, ভিভ রিচার্ডসের মতো বাঘা বাঘা ব্যাটসম্যান আছেন যে দলে, তাদের জন্য ২৬৭ রানের টার্গেটটা নিতান্ত মামুলিই বলা যায়। কিন্তু সে দিন সারফরাজ নেওয়াজ, নাসের মালিকদের অসাধারণ বোলিং পাল্টে দিল সব হিসেব নিকেশ। খুব বেশিক্ষণ উইকেটে টিকতে পারলেন না গ্রিনিজ, ফ্রেডরিক, কালিচরণ, কানহাই, ভিভ রিচার্ডস। তিন অঙ্কের ঘরে না পৌঁছাতেই সাজঘরে ফিরে গেলেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের প্রথম সারির এই পাঁচ ব্যাটসম্যান। আশার আলো কিছুটা জাগিয়ে রেখেছিলেন ক্লাইভ লয়েড। কিন্তু ৫৮ বলে ৫৩ রানের লড়াকু ইনিংসটি খেলে তিনি জাভেদ মিঁয়াদাদের শিকারে পরিণত হলে হতাশায় ডুবে যায় উইন্ডিজ শিবির। স্কোরবোর্ডের চেহারা শোচনীয়। ৭ উইকেটে ১৫১ রান। টেনে হিঁচড়ে স্কোরটাকে ২০৩ পর্যন্ত নিয়ে যেতেই পতন হলো আরো দুইটি উইকেটের। জয়ের জন্য তখনো দরকার ৬৪ রান।
শেষ উইকেট জুটিতে এত রান সংগ্রহের কথা কেউ স্বপ্নেও ভাবে না। একদিকে অভিজ্ঞ ব্যাটসম্যান ডারেক মারে থাকলেও আরেক দিকে আছেন নবাগত ফাস্ট বোলার অ্যান্ডি রবার্টস, একদিনের ক্রিকেটে এটি ছিল যার দ্বিতীয় ম্যাচ। পাকিস্তানের জয় উদযাপনও শুরু করে দিয়েছিলেন অনেকে। তাদের জয়টা মনে হচ্ছিল শুধু সময়ের ব্যাপার মাত্র। কিন্তু তারপর ইতিহাস গড়ার জন্যই যেন উইকেটে খুঁটি গেড়ে বসলেন উইন্ডিজ উইকেটরক্ষক ডারেক মারে আর অ্যান্ডি রবার্টস। সবাইকে হতবাক করে দিয়ে একে একে ঠিকই ৬৩ রান যোগ করে ফেললেন শেষ উইকেট জুটিতে। এরপরই এসে গেল সেই মহেন্দ্রক্ষণ। ওয়াসিম রাজার বল মিড উইকেটে ঠেলে দিয়েই অবিশ্বাস্য এক জয় ছিনিয়ে নিলেন রবার্টস। শেষ পর্যন্ত তিনি অপরাজিত ছিলেন ২৪ রানে। আর ডারেক মারের ৭৬ বলে ৬১ রানের হার না মানা ম্যাচজয়ী ইনিংসটি এখনো উজ্জ্বল হয়ে আছে বিশ্বকাপের ইতিহাসে।
৭০-এর দশকে ক্রিকেট জগতে উইন্ডিজের একক আধিপত্যের কালে প্রতিপক্ষকে দুমড়ে-মুচড়ে দিয়ে অনেক জয়ই পেয়েছিল ক্লাইভ লয়েডের নেতৃত্বাধীন ওয়েস্ট ইন্ডিজ। কিন্তু ওয়ানডে ক্রিকেটের ৪০ বছরের ইতিহাসের সবচেয়ে স্মরণীয় ম্যাচের কথা বলতে গিয়ে উইন্ডিজ কিংবদন্তী ক্লাইভ লয়েডের মনে সবার আগে ভেসে উঠেছিল এই ম্যাচটির কথাই।