Posts Tagged ‘ কর্তৃত্ববিরোধী শিক্ষার্থীবৃন্দ ’

সুবোধের বোধ ও বাংলাদেশের প্রাক-রূপায়নের রাজনীতি

ধানমন্ডির আবাহনী মাঠ সংলগ্ন এলাকায় চোখে পড়েছিল এই ছবিটি। পলায়নরত সুবোধকে এভাবে ঢেকে দেওয়া হয়েছিল পোস্টার দিয়ে। সুবোধের এই গ্রাফিতিতে লেখা ছিল, ‘এখানে সাপ ভরা চাপ চাপ রুচি! কাপ ভরা পাপ পাপ চা! সুবোধ… তুই পালিয়ে যাহ!’

তো এই ‘চাপ চাপ রুচি’র দারুণ প্রয়োগই ঘটিয়েছিলেন পোস্টার লাগানেওয়ালারা। এই একটা গ্রাফিতি ঢেকে দেওয়ার প্রয়াসে তারা সফল হয়েছিলেন খুব সফলভাবে! কিন্তু ঢাকা শহরে তো সুবোধ ছড়িয়ে গিয়েছিল ততদিনে। মানুষের মনে ততদিন প্রশ্ন উঠে গেছে যে, কে এই সুবোধ? কেন পালাতে বলা হচ্ছে তাকে? ‘এখন সময় পক্ষে না’ যে বলা হচ্ছে, তো এটা কোন সময়? কেমন সময়? যে সময়ে সূর্যকে খাঁচাবন্দী করে পালিয়ে যেতে হচ্ছে সুবোধকে? এসব প্রশ্ন আর খোদ এই সুবোধের খোঁজ করতে গিয়ে কিছু বন্ধু মিলে বানানো হয়েছিল এই ভিডিওটি।

ঢাকার রাস্তায় কে বা কারা এই সুবোধকে চিত্রিত করেছেন তা জানা যায়নি আজ অব্দি। চেষ্টা হয়তো হয়েছেও কিছু, সুবোধের ঠিকুজি-কুলজি জানার। কিন্তু সেই সন্ধান পাওয়া গেছে- এমন খবর পাওয়া যায়নি এখন পর্যন্ত। #হবেকি নামধারী এই অচেনা চিত্রকর পচে-গলে যাওয়া, দমবন্ধকরা এক মৃত্যুপুরির শহরে যেন হঠাৎ করেই কিছু ফুল ছড়িয়ে দিয়েছিল। দেয়ালে দেয়ালে পলায়নরত সুবোধকে চিত্রিত করে। মানুষ মুগ্ধ হয়েছিল এর অঙ্কনশৈলি দেখে। কী এটা? সুবোধ আবার কী?- শুরুতে এমন প্রশ্ন। এরপর একটু একটু করে প্রশ্ন গাঢ় হতে শুরু করল। সুবোধ কী তবে সু-বোধ? মানুষেরই, আমার-আপনারই বোধশক্তি? নাড়া পড়ল চেতনায়।
মনোচৈতন্যে নাড়া দেওয়ার এই কাজটা সুবোধ সিরিজের গ্রাফিতিগুলো খুব ভালোভাবেই করতে পেরেছে বলে প্রতিয়মান হয়। সুবোধ খুব অল্প সময়ের মাঝে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। সুবোধকে নিয়ে বাঁধা হয়েছে গান-কবিতা। বানানো হয়েছে টি-শার্ট*** (এ প্রসঙ্গে কিছু কথা ডিসক্লেইমার আকারে নিচে বলা আছে)। সুবোধের বোধ কাঁটাতারের গণ্ডিও পেরিয়ে গেছে অনায়াসেই। কোনো পাসপোর্ট-ভিসার ধার ধারতে হয়নি সুবোধকে।

কলকাতার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সেখানকার শিক্ষার্থীরা সুবোধকে দেখেছেন লড়াইয়ের প্রতীক হিসেবে। তারা সুবোধকে দিয়েছেন ইতিবাচকতা। সুবোধকে বলেছেন তৈরি হতে, ঘুরে দাঁড়াতে, ছড়িয়ে যেতে। হয়েছেও তো খানিকটা সেরকমই। ২০১৮ জুলাই-আগস্টে কিশোর বিদ্রোহের তোলপাড় করা সেই দিনগুলোতে একটি ছবি অনেকেরই নজর কেড়েছিল। বাংলাদেশের কিশোররা যে অসাধারণ কল্পনাশক্তির পরিচয় দিয়েছিল তাদের প্ল্যাকার্ডগুলোতে- সেখানে ঠাঁই হয়েছিল এই সুবোধেরও। একজনের হাতে ধরা প্ল্যাকার্ডে লেখা হয়েছিল, ‘সুবোধ এখন রাস্তায়’।

হ্যাঁ! সুবোধ তো ঐ কয়েকটা দিন রাস্তাতেই ছিল। সেই সুবোধগুলোকেও শেষপর্যন্ত ঘা খেয়ে পালাতে হয়েছে। কারণ “পাপবোধ (এখনও) নিশ্চিন্তে করছে বাস মানুষের হৃদয়ে।“ সুবোধকে তাই আবারও পালাতে হয়েছে। আর কত পালাবে সুবোধ? কবে আসবে সময় পক্ষে?
সময় পক্ষে আসতে পারে। সেজন্য সময়টাকে বুঝে নেওয়াটাও মনে হয় জরুরি। এই সময়ে এমন সমাজ-পরিবেশ কিভাবে গড়া যায় যেখানে সুবোধকে পালিয়ে বেড়াতে হবে না? সুবোধের ভাগ্যেই শিকে ছিঁড়বে? সব কিছু নষ্টদের দখল থেকে আবার ফিরে আসবে সুবোধের দ্বারে? মুক্তির নিশান-স্বরূপ সূর্যটা আবার খাঁচা থেকে মুক্ত করে দিতে পারবে সুবোধ? ভোরের অপেক্ষায় থাকা মোরগটা ডেকে উঠবে তীব্র স্বরে? সুবোধও তার কোলের পাশে বসে থাকা কিশোরী মেয়েটিকে বলবে, ভোর হয়ে গেছে রে পাখি! ও যে আকুল হয়ে জানতে চায়, “সুবোধ! কবে হবে ভোর?”
এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হলে আমাদের দিতে হবে নতুন দৃষ্টি। আর এখানেই আসে প্রিফিগারেটিভ পলিটিক্স বা প্রাক-রূপায়নের রাজনীতি প্রসঙ্গ। অচেনা দাগ বইয়ে এর ইতিহাস-ধারণা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন সেলিম রেজা নিউটন। “প্রিফিগারেটিভ পলিটিক্স বা প্রাক-রূপায়নের রাজনীতি: রাজনীতির অরাজপন্থা” (পৃষ্ঠা ১৭৭-১৮৬)। আগ্রহীরা অনলাইনে বসেই পড়তে পারেন এখান থেকে: https://goo.gl/zPRg1m
বিষয়টির মূল বক্তব্য হচ্ছে, যেরকম সমাজ আমরা কামনা করি, আকাঙ্ক্ষা করি—তেমন সমাজ নির্মানের লক্ষ্যে কর্মতৎপরতাটাও হতে হবে সেই কাঙ্ক্ষিত সমাজের আদলে। ১৯ শতকের অরাজপন্থী James Guillaume বলেছিলেন, “একটা কর্তৃত্বপরায়ন সংগঠন থেকে কিভাবে দেওয়া যেতে পারে সাম্য ও মুক্তির সমাজ গড়ার ডাক? এটা অসম্ভব।” ইতিহাসের পৃষ্ঠাগুলো তো এই কথারই সাক্ষ্য দিচ্ছে বারবার… বারবার। ২০১১ সালের অকুপাই মুভমেন্টে খুব বড় করে উঠেছিল এই প্রিফিগারেটিভ পলিটিক্স সংক্রান্ত কথাবার্তা। David Graeber দের লেখালেখি দিয়ে।
ভীষণরকমের কর্তৃত্বপরায়ন, পুরস্কার-তিরস্কার-বহিস্কারে মত্ত ও অভ্যস্ত; এমন সংগঠন থেকে শোনা যায় গণতন্ত্র-সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আহ্বান। দেশের সব রাজনৈতিক দল; সেটা ডানই হোক আর বামই হোক। যে বাদই হোক, যে তন্ত্রই হোক—সংগঠন বানানোর সময় প্রেসিডেন্ট-সেক্রেটারি লাগবেই। এমনকি পাড়ায় ১০ জন মিলে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা সমর্থকগোষ্ঠী কমিটি করলেও সেখানে থাকে প্রেসিডেন্ট-সেক্রেটারি। এই ফরম্যাটের বাইরেও যে কোনো সংগঠন হতে পারে— এই জিনিসটা যেন ভাবতেই পারি না আমরা।
নতুন সমাজটা যদি আমরা সাম্যেরই চাই, স্বাধীনতারই চাই—তাহলে এখনকার সংগঠনেও সেটা প্র্যাকটিস করব না কেন আমরা? প্র্যাকটিস করতে গিয়ে অনেক ভুল হবে; সেই ভুল থেকে শেখাও হবে — নতুন সমাজের রূপটা আরও মূর্ত হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা বামপন্থী ছাত্র সংগঠনে কতজন সদস্য থাকে? ৪০-৫০ জন সর্বোচ্চ? এই কয়জন মানুষ মিলে সম্মিলিতভাবে একটা সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় না?
যায়। ইচ্ছা থাকলে যায়। কিন্তু ইচ্ছাটাই বোধহয় হয় না কারও। কারণ ইচ্ছা হতে থাকলেই বেরিয়ে আসবে তাদের অনেক অজানা ইতিহাস। উঠতে থাকবে অনেক অপ্রিয় প্রসঙ্গ। সেগুলোর মুখোমুখিই হয়তো হতে চান না তারা। সংগঠনে কোনো কর্মী এসব কথা তুললেও তাই অনেককে পড়তে হয় বহিস্কারের মুখে। নিদেনপক্ষে তিরস্কারের মুখে। তিরস্কার শুনে যারা আবার সামলে নেন, লাইনে হাঁটেন—তাদের সামনে থাকে পুরস্কারের হাতছানি। এই করেই চলছে সংগঠনগুলো।
কিন্তু সুবোধের উপযোগী একটা সমাজ যদি আমরা গড়তে চাই; তাহলে আমাদের বেরোতে হবে এই চিরাচরিত চিন্তাভাবনাগুলো থেকে। করতে হবে নতুনের সন্ধান। পুরাতনকেও আবিস্কার করতে হবে নতুন করে। সুবোধ যেমন নতুন কিছু নিয়ে হাজির হয়েছে- তেমনি পরিবর্তনকামী প্রতিটি মানুষকে সক্রিয় হতে হবে। অন্ততপক্ষে চিন্তাভাবনার ক্ষেত্রে।
কেন্দ্রীয় একটা কমিটি, পদাধিকার বলে নেতা, নেতার হাতা, অনেকগুলো মুখের একজন পাত্র; (যিনি শুধু মাইকে হুমহাম করবেন আর আমাদের-মামুদের ইচ্ছেমতো ফুল-পাতা-পায়রা ওড়াবেন, মোম জ্বালাবেন) ইত্যাদি হওয়া ছাড়াও আন্দোলন-সংগ্রাম সংগঠিত হতে পারে। সফল আন্দোলন-সংগ্রাম হতে পারে। ২০০৮ সালে রাবিতে কর্তৃত্ববিরোধী শিক্ষার্থীবৃন্দ মঞ্চের কর্মী হিসেবে কাজ করার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা লাভের সৌভাগ্য হয়েছিল। সেই অভিজ্ঞতা থেকে জানি যে, একক কোনো নেতা বা নেতার বিশেষ ক্ষমতা বা কোনো কেন্দ্রীয় কমিটি ছাড়াও কিভাবে একটা আন্দোলন গড়ে উঠতে পারে এবং সেটা দারুণভাবে সফল হতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয়ে মুক্ত পরিসর তৈরি করতে পারে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এই আন্দোলন সম্পর্কে আগ্রহী হলে পড়তে পারেন: আগস্ট বিদ্রোহ।। মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় আন্দোলন : জরুরি পর্ব https://goo.gl/aVM26U

রাবির কর্তৃত্ববিরোধী মঞ্চের মূখ্য কিছু সংগঠক আগে থেকেই অরাজপন্থার ধারণার সঙ্গে পরিচিত ছিলেন। ফলে ২০০৮ সালের এই আন্দোলনটি ছিল বিকল্প কোনো পথে নামার সচেতন প্রয়াস। আর অচেতন প্রয়াসটা আমরা খুব সম্প্রতি দেখলাম কিশোর বিদ্রোহে। কিভাবে একটি কেন্দ্র না থেকেও, একক নেতৃত্ব তো দূরের কথা; দৃশ্যমান কোনো নেতৃত্ব না থেকেও কিভাবে রাজধানীর রাজপথ দাপিয়ে বেড়ানো যায়— সে শিক্ষাটা খুব দারুণভাবে দিয়েছে বাংলাদেশের কিশোররা। এবং এভাবে জনগণ সক্রিয় হয়ে উঠলে, জনগণ নিজের কাজের ব্যাপারে নিজে সচেতন হলে যে সব কিছু অনেক ভালোভাবে চলতে পারে—সেই শিক্ষাটাও দিয়েছে স্কুল-কলেজের ছেলেমেয়েগুলো।

এ প্রসঙ্গে পড়তে পারেন…
>> সবুজের অভিযান: সকল ক্ষমতা চাই শিশুদের কল্পনার হাতে (https://goo.gl/VvQteH)
>> রাস্তার পাঠশালায় চলে ‘এসো নিজে করি’ ক্লাস; বড়রা অংশ নেবে কি? (https://goo.gl/WnrsHu)
>> লাইসেন্স আছে?: কিশোর বিদ্রোহ যে বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখায় (https://goo.gl/JsVtjA)

এগুলো গেল খুব নিকট উদাহরণ। প্রত্যক্ষ উদাহরণ। পার্টি-পলিটিক্সের বাইরে স্বাধীন সংগঠন গড়ে ওঠার অজস্র নজির পৃথিবীতে দেখা গেছে। বহু প্রাচীনকালের সেসব ঐতিহাসিক উপাদানের উল্লেখ নাহয় তোলা থাকল। শিল্প-বিপ্লবের সময় থেকেও সমাজতান্ত্রিক রাজনীতির একেবারে শুরুর দিকেই অনেক আলাপ উঠেছিল কাঙ্ক্ষিত সমাজ ও তা রূপায়নের পদ্ধতি-কৌশল নিয়ে। সেসব ইতিহাসের গায়ে পড়া বহু বছরের ধুলো ঝাড়ার সময় বোধহয় চলে এসেছে। এ জায়গায় এসে আবারও সেলিম রেজা নিউটনের অচেনা দাগ বইয়ের “প্রিফিগারেটিভ পলিটিক্স বা প্রাক-রূপায়নের রাজনীতি: রাজনীতির অরাজপন্থা” (পৃষ্ঠা ১৭৭-১৮৬) এই অধ্যায়টির কথা উল্লেখ করছি। আগ্রহীরা অনলাইনে বসেই পড়তে পারেন এখান থেকে: https://goo.gl/zPRg1m

সুবোধ যেন আর পালিয়ে না বেড়ায়, সময়টা যেন সুবোধের পক্ষে আসে — সেই লক্ষ্যে কাজ করতে হবে সবাইকেই। এটা কোনো ভ্যানগার্ড, একক ব্যক্তি-সংগঠনের করে দিয়ে যাওয়ার বিষয় না। সুবোধের বোধ উদ্বোধনের সময় এখন। #হবেকি?

———————————————————————–
*** টি-শার্ট সম্পর্কিত ডিসক্লেইমার: সুবোধের এই গ্রাফিতিগুলোর আইডিয়া খুব বেশিমাত্রায় পছন্দ হওয়ায় দুইটা গ্রাফিতি দিয়ে মোট ৩০০ টি-শার্ট করার উদ্যোগটা আমি নিয়েছিলাম। কিছু বন্ধুর সঙ্গে মিলে সেগুলো বানানো হয়েছিল। এর পেছনে কোনো বাণিজ্যিক উদ্দেশ্য ছিল না। অধিকাংশ টি-শার্টই বিলানো হয়েছে বন্ধু-স্বজনদের মধ্যে। হ্যাঁ, শুরুতে এমন ভাবনা ছিল যে, যা খরচ হয়েছে- সেই টাকাটা যদি তুলে আনা যায়; তাহলে ভালো হয়। কিন্তু সেটাও শেষপর্যন্ত হয়নি। ১৫-২০ হাজার টাকা নিজের গাঁট থেকেই গিয়েছিল। এ নিয়ে অনেককে বলতে শুনেছি যে, টি-শার্ট বানিয়ে ব্যবসা হচ্ছে। সুবোধকে নিয়ে ব্যবসা হচ্ছে। আহত হয়েছিলাম। তাই এই লেখার সুবাদে এই কথাটুকু ডিসক্লেইমার আকারে দেওয়ার লোভ সংবরণ করতে পারলাম না। সুবোধকে নিয়ে ব্যবসা করার রুচি কখনো ছিল না, ভবিষ্যতেও আশা করি হবে না।

কেমন আছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়?

বিজ্ঞাপিত পদের চেয়ে দেড় শ শিক্ষক অতিরিক্ত নিয়োগ: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগে যাচ্ছেতাই অবস্থা

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় : সরকার সমর্থকদের চাপে গণনিয়োগ চলছে

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘নিয়োগ-বাণিজ্য’

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি প্রার্থীদের ভাংচুর

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে (শিক্ষক সমিতির নির্বাচনে) সভাপতি পদে সরকার-সমর্থকদের পরাজয়

অভিভাবকহীন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

১.

এগুলো হলো গত কয়েকদিন ধরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদের শিরোনাম। এগুলো দেখেই জানতে ইচ্ছা হলো কেমন আছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়?

পত্রপত্রিকা মারফত জানতে পারলাম যে, বর্তমান বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ৪ বছরের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগ দিয়ে গণনিয়োগ দেওয়ার হিড়িক পড়ে যায়। গত ২০ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেটের ৪৪৭তম সভায় দলীয় ভিত্তিতে ১৮৪ জন কর্মচারী, ২৬ জন কর্মকর্তা, ২০ জন শিক্ষক ও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী পদে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় ৩১ জনকে নিয়োগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়। কিন্তু এতেও সন্তুষ্ট করা যায়নি চাকরি প্রত্যাশী সরকার সমর্থকদের। তারা ক্ষুব্ধ হয়ে উপ-উপাচার্যের দপ্তরে হামলা চালান। বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সহসভাপতি মাসুদ রানার নেতৃত্বে সংগঠনের ১০-১২ জন নেতা-কর্মী প্রশাসন ভবনে তালা লাগিয়ে দেন। তারপর জানা গেল শিক্ষক সমিতির নির্বাচনে সভাপতি পদে জয়লাভ করতে পারেননি সরকার-সমর্থক অর্থাত্ মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী প্রগতিশীল শিক্ষকেরা। এবং সবশেষে এখন নাকি অভিভাবকহীন হয়ে পড়েছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

২০০৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি সরকার রাবির ফলিত পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. আব্দুস সোবহানকে উপাচার্য, মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক নুরুল্লাহকে উপ-উপাচার্য এবং ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক আব্দুল বারীকে রেজিস্ট্রার হিসেবে নিয়োগ দেয় চার বছরের জন্য। সে অনুযায়ী যোগদানের দিন থেকে ২৫ ফেব্রুয়ারি তাদের মেয়াদ শেষ হয়। এদিন তারা শেষ কার্য দিবস পার করেছেন। এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অভিভাবকহীন অবস্থার সুযোগ নিয়ে নাকি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তা নিয়ে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। জামায়াত-শিবির নাকি এই পরিস্থিতি কাজে লাগিয়ে বিশৃঙ্খলা তৈরি করতে পারে। কেন? এই চার বছর কী করলেন তাহলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসীরা? কী করলেন ছাত্রলীগসহ প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনের নেতা-কর্মীরা? কেন তৈরি হলো গণমাধ্যমের এইসব লজ্জাজনক শিরোনাম?

২.

কারণ অনুসন্ধান করতে হলে আমাদেরকে পেছনে ফিরতে হবে। শুরু করতে হবে এই প্রশাসনের দায়িত্বপ্রাপ্তির সময় বা তারও কিছুটা আগ থেকে। ২০০৭ সালের আগস্ট বিক্ষোভের পর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ৮জন শিক্ষককে গ্রেপ্তার করে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার। মামলা দেয় অনেক শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে। ২০০৮ সালে গ্রেপ্তারকৃত শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মুক্তির জন্য শুরু হয় সাধারণ শিক্ষার্থীবৃন্দের আন্দোলন। ‘কর্তৃত্ববিরোধী শিক্ষার্থীবৃন্দ’ নামক একটি অরাজনৈতিক মঞ্চ থেকে। অহিংস-অসহযোগ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে কারামুক্ত হন শিক্ষার্থীরা।

১/১১ তে জরুরী অবস্থা জারির পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের যে দমবন্ধ করা ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল তার বিরুদ্ধে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মতোই ফুঁসে উঠেছিলেন রাবির তত্কালিন শিক্ষার্থীরা। পুরো দেশজুড়েই শিক্ষার্থী-জনতার ব্যপক প্রতিবাদের মুখে গদি ছাড়তে বাধ্য হয় মইনুদ্দিন-ফখরুদ্দিন সরকার।

colag1

স্মরণে রাখা দরকার যে, ২০০৮ সালে ‘কর্তৃত্ববিরোধী শিক্ষার্থীবৃন্দ’-র সংগঠকদের পক্ষ থেকে লড়াইটা ছিল একটা মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় গঠনের। যেখানে সবাই স্বাধীনভাবে মুক্তচিন্তা করার অধিকার পাবে, জ্ঞানভিত্তিক মুক্তসমাজ গঠনের পক্ষে চিন্তা-তত্পরতা জারি রাখতে পারবে। এরকম একটা বিশ্ববিদ্যালয়ই আমরা চেয়েছিলাম। ২০০৭ সালে জরুরি অবস্থা জারি করার পর বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে যে নিষেধাজ্ঞার শেকল পড়ানো হয়েছিল, সেই শেকল ছিন্ন করার তাড়ণাতেই আমরা আন্দোলন করেছিলাম। সফলও হয়েছিলাম অনেকাংশে। উবে গিয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের দমবন্ধকর পরিস্থিতি।

৩.

এরপর ২০০৯ সালের নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়লাভ করে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লিগ। গঠিত হয় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন প্রশাসন। ভিসি হিসেবে নিয়োগ পান জেলখাটা আব্দুস সোবহান। আওয়ামী লীগের “ভোট বিপ্লবের” প্রেরণায় ছাত্রলীগসহ প্রায় সবগুলো “প্রগতিশীল” ছাত্র সংগঠনই ক্যাম্পাস থেকে শিবিরকে সরিয়ে নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার তাগিদ বোধ করতে থাকেন। এবং অবশেষে মার্চের ১৩ তারিখে ছাত্রলীগ, মৈত্রী, জাসদ ছাত্রলীগের সঙ্গে শিবিরের মুখোমুখি সংঘর্ষ বেধে যায়। এই সংঘর্ষের কারণে ক্যাম্পাস বন্ধ করে দেয়া হয়। ১ জুন আবার বিশ্ববিদ্যালয় খোলার সিদ্ধান্ত নেয় প্রশাসন। কিন্তু তার আগে তারা ঘোষণা দেয় যে,  বিশ্ববিদ্যালয় খোলার পর ক্যাম্পাসে কেউ কোনো রকম রাজনৈতিক তৎপরতা চালাতে পারবে না, লিফলেট-পোস্টারিং কিচ্ছু করা যাবে না। সেসময় আমরা অনেকেই এই ঘোষণা শুনে চরমভাবে ক্ষুব্ধ হয়েছিলাম। ক্যাম্পাস খোলার আগ দিয়ে আমরা শহরে একটি মানববন্ধনও করেছিলাম এই সিদ্ধান্তের বিরোধীতা করে।

1

বিশ্ববিদ্যালয় খোলার পর আমরা শিক্ষার্থীদের স্বাধীন তত্পরতা অব্যাহত রাখার লক্ষ্যে সেই নিষেধাজ্ঞা অমান্য করেই দুইটি কর্মসূচি পালন করেছিলাম ‘মুক্তিমুখিন প্রতিরোধ মঞ্চ’ থেকে। সেসময় আমাদেরকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের চরম বাধার মুখে পড়তে হয়েছিল। আব্দুস সোবহানের প্রশাসন আমাদেরকে দেখিয়েছিল ‘শিবির জুজু’। শিবিরকে রুখে দেওয়ার জন্যই নাকি আবার সাধারণ শিক্ষার্থীদের মুখবন্ধ করা হচ্ছে। প্রশাসনের এই সিদ্ধান্ত যে সার্বিকভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন মঙ্গল বয়ে আনবে না সেটা বলার জন্য আমরা প্রকাশনা করেছি, সেমিনার আয়োজন করেছি। নানাভাবে বলার চেষ্টা করেছি। আমাদের কথায় কান দেওয়ার কোন প্রয়োজন মনে করেননি তারা। সাধারণ শিক্ষার্থীদের মুখ বন্ধ করে দিয়ে শিবির প্রতিহত করতে গিয়েছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এমনকি প্রশাসনের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করার জন্য আমাদের কারও কারও কপালে শিবির আখ্যাও জুটেছিল।

colag2

৪.

এখন তাহলে আমি আব্দুস সোবহানের বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে প্রশ্ন করতে চাই যে, কি করলেন আপনারা ৪ বছর ধরে? শিবির প্রতিহত করতে পেরেছেন? গোটা দেশের মানুষ যখন শিবিরকে কোনঠাসা করে ফেলেছে, তাদেরকে নিষিদ্ধ করার দাবিতে পুরো দেশজুড়ে অভূতপূর্ব আন্দোলন শুরু হয়েছে, তখন আপনারা ভয় পাচ্ছেন যে, জামায়াত-শিবির বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিভাবকত্বহীনতার সুযোগ নিয়ে বিশৃঙ্খলা তৈরি করতে পারে। জামাত-শিবির প্রতিহত করা তো দূরের কথা, আপনারা শিক্ষক সমিতির নির্বাচনেও সভাপতির পদ হারিয়েছেন। কি করলেন তাহলে চার বছর ধরে? উত্তর দেওয়ার মতো কোন মানুষ কি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে আছেন?

শিক্ষক নিয়োগের সংবাদগুলো দেখে তো মনে হয়, আপনারা এই চার বছর শুধু দলীয়করণ করেছেন, অবাধে দুর্নীতি করেছেন। ভাবলে হাসি লাগে, সেটাও ঠিকমতো করার যোগ্যতাটা আপনাদের ছিল না। থাকলে কি আর শিক্ষক সমিতির সভাপতির পদটা হারাতে হয়? আর কি করেছেন? ছাত্রলীগকে দিয়েছেন অবাধ স্বাধীনতা। এর ফলে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষের খবর কতবার এসেছে পত্রপত্রিকায়? বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যে ছাত্রলীগকে একটা ফ্রাঙ্কেনস্টাইন বানিয়েছিলেন, সেটাও তারা হয়তো টের পেলেন শেষপর্যায়ে এসে, যখন এই ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরাই প্রশাসন ভবনে ভাঙচুর চালালেন। এগুলোর কি জবাব দেবেন উপাচার্য-প্রক্টর-ছাত্র উপদেষ্টারা? কেন তখন বন্ধ করেছিলেন সাধারণ শিক্ষার্থীদের মুখ? কেন আমাদের অনেককে ক্যাম্পাস ছাড়তে হয়েছিল প্রচণ্ড দুঃখ-হতাশা নিয়ে?

সন্দেহ নেই, এগুলো ক্ষোভের কথা। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এই ঘটনাগুলো আমাকে আহত করে। ভীষণভাবে। উপাচার্য আব্দুস সোবহান জেলখাটা শিক্ষক বলেই রাগ-ক্ষোভটা বেশি। ২০০৭ সালে আমরা, বিশ্ববিদ্যলয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীরাই আন্দোলন করে তাদেরকে কারামুক্ত করেছিলাম। কোন ছাত্রলীগ নেতাকর্মীকে দেখা যায়নি তাদের মুক্তির দাবিতে সোচ্চার হতে। ফলে আমি অন্তত আশা করেছিলাম যে, এই জেলখাটা শিক্ষকেরা, সাধারণ শিক্ষার্থীদের এই মুক্তিমুখিন বৈশিষ্ট্যটা মাথায় রাখবেন।
কিন্তু পরে বুঝলাম যে, এইসব প্রশাসনের লোকজনেরা আসলে ২০০৭ সালের আগস্টে বিশ্ববিদ্যলয়ের স্বাধীনতার উপর হস্তক্ষেপ হয়েছে বলে রাস্তায় নামেননি। বিশ্ববিদ্যালয়ে মুক্তচিন্তা জারি রাখার পরিবেশ বাধাগ্রস্থ হচ্ছে বলে তারা মিছিল করেননি বা মানববন্ধনে দাঁড়াননি। তারা বাস্তবায়ন করতে গিয়েছিলেন দলীয় এজেন্ডা। দেশের প্রায় সবগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ই যখন সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠেছিল, তখন তারা এটাকে নিয়েছিলেন একটা সুযোগ হিসেবে। কিভাবে সেই কর্তৃত্বপরায়ন সরকারকে দিয়ে তাড়াতাড়ি নির্বাচন দেওয়ানো যায় সেইটাই ছিল তাদের মাঠে নামার উদ্দেশ্য। সেই উদ্দেশ্য সফল। দল জয়যুক্ত হয়েছে। তারা ভিসি-ছাত্র উপদেষ্টা হয়েছেন।
কিন্তু আমরা, মুক্তিকামী সাধারণ শিক্ষার্থীরা কি পেলাম? সাধারণ শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের উপর দিয়ে তারা পুরস্কৃত হলেন। আর বিশ্ববিদ্যলয়ের স্বাধীনতা, মুক্তভাবে জ্ঞানার্জনের সুষ্ঠ পরিবেশ বজায় রাখার উদ্দেশ্যে আমাদের যে কতো বন্ধুর পথ পাড়ি দিতে হলো, সেসব কারও মাথাতেই থাকল না। উল্টো তারাই আবার আমাদেরকে বাঁধলেন নিষেধাজ্ঞার শেকলে। আব্দুস সোবহান প্রশাসনের সেইসব অন্যায়-অনায্য সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করতে গিয়ে কোন লাভ হয়নি। বা আমরা আমাদের কাজটা করতে ব্যর্থ হয়েছি। কারও কানে আমাদের এই আওয়াজটা পৌঁছে দিতে পারিনি। ফলে ক্যাম্পাস ছেড়ে যাওয়ার সময় আমাদের অনেকের চোখে ছিল বেহাত বিপ্লবের হাহাকার। যার রেশ এখনো শেষ হয়নি।