বিজ্ঞাপিত পদের চেয়ে দেড় শ শিক্ষক অতিরিক্ত নিয়োগ: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগে যাচ্ছেতাই অবস্থা
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় : সরকার সমর্থকদের চাপে গণনিয়োগ চলছে
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘নিয়োগ-বাণিজ্য’
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি প্রার্থীদের ভাংচুর
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে (শিক্ষক সমিতির নির্বাচনে) সভাপতি পদে সরকার-সমর্থকদের পরাজয়
অভিভাবকহীন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
১.
এগুলো হলো গত কয়েকদিন ধরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদের শিরোনাম। এগুলো দেখেই জানতে ইচ্ছা হলো কেমন আছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়?
পত্রপত্রিকা মারফত জানতে পারলাম যে, বর্তমান বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ৪ বছরের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগ দিয়ে গণনিয়োগ দেওয়ার হিড়িক পড়ে যায়। গত ২০ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেটের ৪৪৭তম সভায় দলীয় ভিত্তিতে ১৮৪ জন কর্মচারী, ২৬ জন কর্মকর্তা, ২০ জন শিক্ষক ও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী পদে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় ৩১ জনকে নিয়োগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়। কিন্তু এতেও সন্তুষ্ট করা যায়নি চাকরি প্রত্যাশী সরকার সমর্থকদের। তারা ক্ষুব্ধ হয়ে উপ-উপাচার্যের দপ্তরে হামলা চালান। বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সহসভাপতি মাসুদ রানার নেতৃত্বে সংগঠনের ১০-১২ জন নেতা-কর্মী প্রশাসন ভবনে তালা লাগিয়ে দেন। তারপর জানা গেল শিক্ষক সমিতির নির্বাচনে সভাপতি পদে জয়লাভ করতে পারেননি সরকার-সমর্থক অর্থাত্ মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী প্রগতিশীল শিক্ষকেরা। এবং সবশেষে এখন নাকি অভিভাবকহীন হয়ে পড়েছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
২০০৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি সরকার রাবির ফলিত পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. আব্দুস সোবহানকে উপাচার্য, মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক নুরুল্লাহকে উপ-উপাচার্য এবং ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক আব্দুল বারীকে রেজিস্ট্রার হিসেবে নিয়োগ দেয় চার বছরের জন্য। সে অনুযায়ী যোগদানের দিন থেকে ২৫ ফেব্রুয়ারি তাদের মেয়াদ শেষ হয়। এদিন তারা শেষ কার্য দিবস পার করেছেন। এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অভিভাবকহীন অবস্থার সুযোগ নিয়ে নাকি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তা নিয়ে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। জামায়াত-শিবির নাকি এই পরিস্থিতি কাজে লাগিয়ে বিশৃঙ্খলা তৈরি করতে পারে। কেন? এই চার বছর কী করলেন তাহলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসীরা? কী করলেন ছাত্রলীগসহ প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনের নেতা-কর্মীরা? কেন তৈরি হলো গণমাধ্যমের এইসব লজ্জাজনক শিরোনাম?
২.
কারণ অনুসন্ধান করতে হলে আমাদেরকে পেছনে ফিরতে হবে। শুরু করতে হবে এই প্রশাসনের দায়িত্বপ্রাপ্তির সময় বা তারও কিছুটা আগ থেকে। ২০০৭ সালের আগস্ট বিক্ষোভের পর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ৮জন শিক্ষককে গ্রেপ্তার করে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার। মামলা দেয় অনেক শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে। ২০০৮ সালে গ্রেপ্তারকৃত শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মুক্তির জন্য শুরু হয় সাধারণ শিক্ষার্থীবৃন্দের আন্দোলন। ‘কর্তৃত্ববিরোধী শিক্ষার্থীবৃন্দ’ নামক একটি অরাজনৈতিক মঞ্চ থেকে। অহিংস-অসহযোগ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে কারামুক্ত হন শিক্ষার্থীরা।
১/১১ তে জরুরী অবস্থা জারির পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের যে দমবন্ধ করা ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল তার বিরুদ্ধে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মতোই ফুঁসে উঠেছিলেন রাবির তত্কালিন শিক্ষার্থীরা। পুরো দেশজুড়েই শিক্ষার্থী-জনতার ব্যপক প্রতিবাদের মুখে গদি ছাড়তে বাধ্য হয় মইনুদ্দিন-ফখরুদ্দিন সরকার।

স্মরণে রাখা দরকার যে, ২০০৮ সালে ‘কর্তৃত্ববিরোধী শিক্ষার্থীবৃন্দ’-র সংগঠকদের পক্ষ থেকে লড়াইটা ছিল একটা মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় গঠনের। যেখানে সবাই স্বাধীনভাবে মুক্তচিন্তা করার অধিকার পাবে, জ্ঞানভিত্তিক মুক্তসমাজ গঠনের পক্ষে চিন্তা-তত্পরতা জারি রাখতে পারবে। এরকম একটা বিশ্ববিদ্যালয়ই আমরা চেয়েছিলাম। ২০০৭ সালে জরুরি অবস্থা জারি করার পর বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে যে নিষেধাজ্ঞার শেকল পড়ানো হয়েছিল, সেই শেকল ছিন্ন করার তাড়ণাতেই আমরা আন্দোলন করেছিলাম। সফলও হয়েছিলাম অনেকাংশে। উবে গিয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের দমবন্ধকর পরিস্থিতি।
৩.
এরপর ২০০৯ সালের নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়লাভ করে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লিগ। গঠিত হয় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন প্রশাসন। ভিসি হিসেবে নিয়োগ পান জেলখাটা আব্দুস সোবহান। আওয়ামী লীগের “ভোট বিপ্লবের” প্রেরণায় ছাত্রলীগসহ প্রায় সবগুলো “প্রগতিশীল” ছাত্র সংগঠনই ক্যাম্পাস থেকে শিবিরকে সরিয়ে নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার তাগিদ বোধ করতে থাকেন। এবং অবশেষে মার্চের ১৩ তারিখে ছাত্রলীগ, মৈত্রী, জাসদ ছাত্রলীগের সঙ্গে শিবিরের মুখোমুখি সংঘর্ষ বেধে যায়। এই সংঘর্ষের কারণে ক্যাম্পাস বন্ধ করে দেয়া হয়। ১ জুন আবার বিশ্ববিদ্যালয় খোলার সিদ্ধান্ত নেয় প্রশাসন। কিন্তু তার আগে তারা ঘোষণা দেয় যে, বিশ্ববিদ্যালয় খোলার পর ক্যাম্পাসে কেউ কোনো রকম রাজনৈতিক তৎপরতা চালাতে পারবে না, লিফলেট-পোস্টারিং কিচ্ছু করা যাবে না। সেসময় আমরা অনেকেই এই ঘোষণা শুনে চরমভাবে ক্ষুব্ধ হয়েছিলাম। ক্যাম্পাস খোলার আগ দিয়ে আমরা শহরে একটি মানববন্ধনও করেছিলাম এই সিদ্ধান্তের বিরোধীতা করে।

বিশ্ববিদ্যালয় খোলার পর আমরা শিক্ষার্থীদের স্বাধীন তত্পরতা অব্যাহত রাখার লক্ষ্যে সেই নিষেধাজ্ঞা অমান্য করেই দুইটি কর্মসূচি পালন করেছিলাম ‘মুক্তিমুখিন প্রতিরোধ মঞ্চ’ থেকে। সেসময় আমাদেরকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের চরম বাধার মুখে পড়তে হয়েছিল। আব্দুস সোবহানের প্রশাসন আমাদেরকে দেখিয়েছিল ‘শিবির জুজু’। শিবিরকে রুখে দেওয়ার জন্যই নাকি আবার সাধারণ শিক্ষার্থীদের মুখবন্ধ করা হচ্ছে। প্রশাসনের এই সিদ্ধান্ত যে সার্বিকভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন মঙ্গল বয়ে আনবে না সেটা বলার জন্য আমরা প্রকাশনা করেছি, সেমিনার আয়োজন করেছি। নানাভাবে বলার চেষ্টা করেছি। আমাদের কথায় কান দেওয়ার কোন প্রয়োজন মনে করেননি তারা। সাধারণ শিক্ষার্থীদের মুখ বন্ধ করে দিয়ে শিবির প্রতিহত করতে গিয়েছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এমনকি প্রশাসনের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করার জন্য আমাদের কারও কারও কপালে শিবির আখ্যাও জুটেছিল।

৪.
এখন তাহলে আমি আব্দুস সোবহানের বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে প্রশ্ন করতে চাই যে, কি করলেন আপনারা ৪ বছর ধরে? শিবির প্রতিহত করতে পেরেছেন? গোটা দেশের মানুষ যখন শিবিরকে কোনঠাসা করে ফেলেছে, তাদেরকে নিষিদ্ধ করার দাবিতে পুরো দেশজুড়ে অভূতপূর্ব আন্দোলন শুরু হয়েছে, তখন আপনারা ভয় পাচ্ছেন যে, জামায়াত-শিবির বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিভাবকত্বহীনতার সুযোগ নিয়ে বিশৃঙ্খলা তৈরি করতে পারে। জামাত-শিবির প্রতিহত করা তো দূরের কথা, আপনারা শিক্ষক সমিতির নির্বাচনেও সভাপতির পদ হারিয়েছেন। কি করলেন তাহলে চার বছর ধরে? উত্তর দেওয়ার মতো কোন মানুষ কি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে আছেন?
শিক্ষক নিয়োগের সংবাদগুলো দেখে তো মনে হয়, আপনারা এই চার বছর শুধু দলীয়করণ করেছেন, অবাধে দুর্নীতি করেছেন। ভাবলে হাসি লাগে, সেটাও ঠিকমতো করার যোগ্যতাটা আপনাদের ছিল না। থাকলে কি আর শিক্ষক সমিতির সভাপতির পদটা হারাতে হয়? আর কি করেছেন? ছাত্রলীগকে দিয়েছেন অবাধ স্বাধীনতা। এর ফলে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষের খবর কতবার এসেছে পত্রপত্রিকায়? বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যে ছাত্রলীগকে একটা ফ্রাঙ্কেনস্টাইন বানিয়েছিলেন, সেটাও তারা হয়তো টের পেলেন শেষপর্যায়ে এসে, যখন এই ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরাই প্রশাসন ভবনে ভাঙচুর চালালেন। এগুলোর কি জবাব দেবেন উপাচার্য-প্রক্টর-ছাত্র উপদেষ্টারা? কেন তখন বন্ধ করেছিলেন সাধারণ শিক্ষার্থীদের মুখ? কেন আমাদের অনেককে ক্যাম্পাস ছাড়তে হয়েছিল প্রচণ্ড দুঃখ-হতাশা নিয়ে?
সন্দেহ নেই, এগুলো ক্ষোভের কথা। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এই ঘটনাগুলো আমাকে আহত করে। ভীষণভাবে। উপাচার্য আব্দুস সোবহান জেলখাটা শিক্ষক বলেই রাগ-ক্ষোভটা বেশি। ২০০৭ সালে আমরা, বিশ্ববিদ্যলয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীরাই আন্দোলন করে তাদেরকে কারামুক্ত করেছিলাম। কোন ছাত্রলীগ নেতাকর্মীকে দেখা যায়নি তাদের মুক্তির দাবিতে সোচ্চার হতে। ফলে আমি অন্তত আশা করেছিলাম যে, এই জেলখাটা শিক্ষকেরা, সাধারণ শিক্ষার্থীদের এই মুক্তিমুখিন বৈশিষ্ট্যটা মাথায় রাখবেন।
কিন্তু পরে বুঝলাম যে, এইসব প্রশাসনের লোকজনেরা আসলে ২০০৭ সালের আগস্টে বিশ্ববিদ্যলয়ের স্বাধীনতার উপর হস্তক্ষেপ হয়েছে বলে রাস্তায় নামেননি। বিশ্ববিদ্যালয়ে মুক্তচিন্তা জারি রাখার পরিবেশ বাধাগ্রস্থ হচ্ছে বলে তারা মিছিল করেননি বা মানববন্ধনে দাঁড়াননি। তারা বাস্তবায়ন করতে গিয়েছিলেন দলীয় এজেন্ডা। দেশের প্রায় সবগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ই যখন সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠেছিল, তখন তারা এটাকে নিয়েছিলেন একটা সুযোগ হিসেবে। কিভাবে সেই কর্তৃত্বপরায়ন সরকারকে দিয়ে তাড়াতাড়ি নির্বাচন দেওয়ানো যায় সেইটাই ছিল তাদের মাঠে নামার উদ্দেশ্য। সেই উদ্দেশ্য সফল। দল জয়যুক্ত হয়েছে। তারা ভিসি-ছাত্র উপদেষ্টা হয়েছেন।
কিন্তু আমরা, মুক্তিকামী সাধারণ শিক্ষার্থীরা কি পেলাম? সাধারণ শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের উপর দিয়ে তারা পুরস্কৃত হলেন। আর বিশ্ববিদ্যলয়ের স্বাধীনতা, মুক্তভাবে জ্ঞানার্জনের সুষ্ঠ পরিবেশ বজায় রাখার উদ্দেশ্যে আমাদের যে কতো বন্ধুর পথ পাড়ি দিতে হলো, সেসব কারও মাথাতেই থাকল না। উল্টো তারাই আবার আমাদেরকে বাঁধলেন নিষেধাজ্ঞার শেকলে। আব্দুস সোবহান প্রশাসনের সেইসব অন্যায়-অনায্য সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করতে গিয়ে কোন লাভ হয়নি। বা আমরা আমাদের কাজটা করতে ব্যর্থ হয়েছি। কারও কানে আমাদের এই আওয়াজটা পৌঁছে দিতে পারিনি। ফলে ক্যাম্পাস ছেড়ে যাওয়ার সময় আমাদের অনেকের চোখে ছিল বেহাত বিপ্লবের হাহাকার। যার রেশ এখনো শেষ হয়নি।