Posts Tagged ‘ ওয়েস্ট ইন্ডিজ ’

‘ইংল্যান্ডকে হারাতেই হবে’

মাত্র কয়েকদিন আগেই বাংলাদেশের বিশ্বকাপ স্বপ্নে একটা বড়সড় আঘাত দিয়েছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। শুধু আঘাত বললেও কম বলা হয়। দেশের যে কোন চরম ক্রান্তিকালিন পরিস্থিতির সঙ্গেই তুলনা দেওয়া যেতে পারে সেই বিভীষিকাময় পরিস্থিতির। মাত্র ৫৮ রানেই অলআউটের লজ্জায় লাল হয়ে গিয়েছিলেন বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা। সমর্থকরা হতাশা চেপেও রাখতে পারেন নি। ওয়েস্ট ইন্ডিজ টিম বাসে ইট-পাটকেল ছুঁড়ে কলঙ্কিত করে দিয়েছিলেন বাংলাদেশ ক্রীড়া অঙ্গনের ভাবমুর্তি। কিন্তু মাত্র কয়েকদিনের ব্যবধানে সেই ওয়েস্ট ইন্ডিজই কিনা হয়ে গেল বাংলাদেশের পরম মিত্র! যে কোমার রোচ, সুলেমান বেনদের নির্মম আঘাতে বাংলাদেশ ধুলোয় লুটিয়েছিল, তারা আবারও তেমনভাবেই জ্বলে উঠুক, ক্রিস গেইল, কাইরন পোলার্ডরা ব্যাটে ঝড় তুলুক, এটাই এখন বাংলাদেশ সমর্থকদের একান্ত প্রার্থনা। ইংল্যান্ডকে যে হারাতেই হবে!

‘বি’ গ্রুপ থেকে কোয়ার্টার ফাইনালে যাওয়ার হিসাব-নিকাশটা অনেকটাই স্পষ্ট হয়ে গেছে। দক্ষিণ আফ্রিকা ইতিমধ্যেই পা রেখেছে শেষ আটের আঙ্গিনায়। ভারতেরও কোয়ার্টার ফাইনাল প্রায় নিশ্চিতই বলা যায়। হাড্ডাহাড্ডি লড়াই চলছে বাংলাদেশ, উইন্ডিজ আর ইংল্যান্ডের মধ্যে। কাগজে-কলমে তিন দলেরই জোর সম্ভাবনা আছে কোয়ার্টার ফাইনালে যাওয়ার। কিন্তু এত হিসাব-নিকাশের খাতা খুলে বসে থাকতে হবে না যদি আগামীকাল ইংল্যান্ডকে হারের স্বাদ দিতে পারে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। উপমহাদেশে আয়োজিত এবারের বিশ্বকাপ থেকে একেবারেই শূণ্য-রিক্ত হাতে ফিরে যেতে হবে এ অঞ্চলের এককালীন শাসক ইংল্যান্ডকে। তারচেয়েও বড় কথা, নিশ্চিত হয়ে যাবে বাংলাদেশের পরবর্তী রাউন্ড। এরকম অবস্থায় বাংলাদেশের মানুষ তো স্যামি, গেইল, ব্রাভোদের পেছনে দাঁড়াবেই।

ঢাকার এক হোটেল কর্মকর্তা এনামুর রহমান বলেছেন, ‘আমরা অবশ্যই ওয়েস্ট ইন্ডিজকে সমর্থন দেব। ইংল্যান্ডকে হারাতেই হবে।’ শুধু এনামুর রহমানই না, বাংলাদেশের ক্রিকেট পাগল কোটি কোটি মানুষের মুখে এখন একই কথা। ‘ইংল্যান্ডকে হারাতে হবে।’ অতি উত্সাহী দু-একজন তো বলছেন, ‘ইস, খেলাটা যদি বাংলাদেশে হতো, গলা ফাটিয়ে চিত্কার করেই ওয়েস্ট ইন্ডিজকে জিতিয়ে দিতাম।’ একেবারে কিন্তু ফেলেও দেওয়া যায় না কথাটা। বাঙ্গালীর গলার জোরের পরিচয় কিন্তু ইংল্যান্ড কয়েকদিন আগে ভালোমতোই পেয়েছিল!

তবে সমর্থকদের ভাবনা যাই হোক, বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা নিশ্চয়ই শুধু অপরের দিকে তাকিয়েই দিন পার করছেন না। ইতিমধ্যেই তাঁরা নিশ্চয়ই দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ম্যাচের জন্য জোর প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছেন। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ২ উইকেটের অসাধারণ জয় দিয়ে নিজেদের সামর্থ্য তো ভালোমতোই প্রমাণ করেছেন সাকিব-তামিমরা। হল্যান্ডের বিপক্ষেও খেলেছেন অনেক পরিণত ক্রিকেট। কাজেই গত বিশ্বকাপের মতো এবারও প্রোটিয়া-বধের স্বপ্ন তো বাংলাদেশ দেখতেই পারে। অধিনায়ক সাকিব আল হাসান বলেছেন, ‘আমরা ইংল্যান্ড-ওয়েস্ট ইন্ডিজ ম্যাচটার দিকে খুব আগ্রহভরে তাকিয়ে থাকব। এটা ঠিক। কিন্তু আমাদের নিজেদের ভাগ্য নিজেদেরই গড়ে নিতে হবে। আসল কথা হলো, দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারাতে হবে।’ বাংলাদেশের বোলিং আক্রমণের অন্যতম প্রধান ভরসা আব্দুর রাজ্জাকও গলা মিলিয়েছেন অধিনায়কের সঙ্গে। বলেছেন, ‘দলের সবাই দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ম্যাচটার দিকেই তাকিয়ে আছে। কেউই পয়েন্ট তালিকার জটিল হিসাব-নিকাশ নিয়ে ভাবছে না। আমরা পরের ম্যাচটা জিতেই কোয়ার্টার ফাইনালে যেতে চাই।’

আগামীকালের ইংল্যান্ড-ওয়েস্ট ইন্ডিজের খেলাটা বাংলাদেশের না হয়েও এক অর্থে বাংলাদেশেরই। গোটা খেলাটার উপরই নির্ভর করবে বাংলাদেশের বিশ্বকাপ সম্ভাবনা। ১২ দিন আগে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট দল এদেশ ছেড়ে যাওয়ার আগে ক্ষুব্ধ ক্রিকেট পাগল সমর্থকদের হতাশার চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ দেখেছে। আতঙ্কিত হয়েছে। কিন্তু তারপর “We are Sorry” লেখা প্ল্যাকার্ডগুলোও তো দেখেছে। আর এবার বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে বাংলাদেশের মানুষের প্রাণঢালা শুভকামনা আর ভালোবাসাও নিশ্চয়ই উইন্ডিজ ক্রিকেটাররা দেখছেন। ক্রিস গেইলরা কী এই ভালোবাসার প্রতিদান দেবেন না?

শফিউলের স্বপ্নযাত্রা

মাত্র দুই বছর আগেও হয়তো বাংলাদেশ জাতীয় দলে সুযোগ পাওয়াটা একটা স্বপ্নই ছিল শফিউল ইসলামের কাছে। ছোটবেলা থেকেই বাংলাদেশের জার্সি পরে পাড়ায় পাড়ায় ক্রিকেট খেলতেন আর স্বপ্ন দেখতেন, একদিন হয়তো সত্যিকারের জাতীয় দলের জার্সিটাই গায়ে উঠবে। সেই স্বপ্নটা আজ বাস্তব। এতটাই জলজ্যান্ত বাস্তব যে পুরো বাংলাদেশই শামিল হয়েছে তাঁর এ স্বপ্নযাত্রায়। ঘরের মাঠের বিশ্বকাপে দুর্দান্ত পারফরমেন্স দেখিয়ে তিনি বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষের চোখেই পুরে দিয়েছেন রাশি রাশি স্বপ্ন।

বিশ্বকাপের শুরুটা অবশ্য খুব একটা ভালো হয়নি শফিউলের। ভারতের বিপক্ষে প্রথম ম্যাচটায় খুব বেশি কিছু আসলে করারও ছিল না তাঁর। শেবাগ, টেন্ডুলকার, বিরাট কোহলিদের দুর্দমনীয় ব্যাটিংয়ের সামনে দাঁড়াতেই পারেননি বাংলাদেশের এ তরুণ পেসার। শেবাগের ক্যারিয়ার-সেরা ইনিংসের দিনে অসহায় হয়েই থাকতে হয়েছিল তাঁকে। ৭ ওভার বল করে দিয়েছিলেন ৬৯ রান। ভারতীয় ইনিংসের শেষ বলে সান্ত্বনা হিসেবে পেয়েছিলেন ইউসুফ পাঠানের উইকেটটা। কিন্তু দ্বিতীয় ম্যাচে আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে চমত্কারভাবে ঘুরে দাঁড়ালেন শফিউল। আগে ব্যাট করে ২০৫ রানেই গুটিয়ে যাওয়ার পর বাংলাদেশ যখন হারের শঙ্কায় দুলছে, সেই মুহূর্তেই জ্বলে উঠলেন তিনি। শেষ পাঁচ ওভারে মাত্র ১১ রান দিয়ে তুলে নিলেন চারটি উইকেট। বাংলাদেশকে এনে দিলেন ২৭ রানের অসাধারণ এক জয়। পুরো দেশকে মাতালেন বিশ্বকাপ উন্মাদনায়।

ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে পরের ম্যাচটা নিয়ে বলার কিছুই নেই। পুরোটাই একটা দুঃস্বপ্ন হয়েই থেকে গেছে বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষের কাছে। সেই ম্যাচে তিনি বলও করেছিলেন মাত্র দুই ওভার।

চট্টগ্রামে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে আবারও চলা শুরু করল শফিউলের স্বপ্নরথ। এবার তিনি নিজেকে চেনালেন নতুন করে। ইংল্যান্ডের ছুড়ে দেওয়া ২২৬ রান তাড়া করতে নেমে ১৬৯ রানেই ৮ উইকেট হারিয়ে বাংলাদেশ তখন দিশেহারা। অনেকেই বেরিয়ে গিয়েছিলেন স্টেডিয়াম থেকে। হার নিশ্চিত ধরে নিয়েছিলেন প্রায় সবাই। কিন্তু এবার ঝলসে উঠল শফিউলের ব্যাট। নবম উইকেট জুটিতে মাহমুদউল্লাহ সঙ্গে ৫৮ রানের অবিচ্ছিন্ন জুটি গড়ে বাংলাদেশকে উপহার দিলেন এক মহাকাব্যিক জয়। খেললেন ২৪ বলে ২৪ রানের এক লড়াকু ইনিংস। ফিরিয়ে আনলেন গত বছর ব্রিস্টলে ইংল্যান্ড বধের স্মৃতি। জোরদার করলেন টাইগারদের কোয়ার্টার ফাইনালে যাওয়ার সম্ভাবনা।

আগের ম্যাচগুলোতেই নিজেকে অপরিহার্য হিসেবে প্রমাণ করার কাজটা ভালোভাবে করে ফেলেছিলেন শফিউল। কিন্তু তিনি থামলেন না এখানেই। গতকাল হল্যান্ডের বিপক্ষে দেখা গেল অন্য এক শফিউলকে। এতটাই পরিণত বোলিং করলেন যে কখনো কখনো মনে পড়ে গেল ম্যাকগ্রা-ডোনাল্ডদের নিখুঁত লাইন-লেংথের কথা। কোনো উইকেট না পেলেও হল্যান্ডকে মাত্র ১৬০ রানে বেঁধে ফেলার পেছনে তাঁর ১০টি ওভারের মূল্য কোনো অংশেই কম না। ৯.২ ওভার বল করে তিনি দিয়েছিলেন মাত্র ১৫ রান। ম্যাচ শেষে হল্যান্ড অধিনায়ক পিটার বোরেনকেও আলাদাভাবে স্বীকার করতে হয়েছে শফিউলের বোলিং নৈপুণ্যের কথা। বলেছেন, ‘শফিউল আজ খুবই চমত্কার বোলিং করেছে। কোনো খারাপ বল করেনি। আমরা রান বের করার অনেক চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছি। আমরা আসলে অসহায় হয়ে পড়েছিলাম। সে কোনো উইকেট পায়নি বটে, কিন্তু তার বেশ কয়েকটি উইকেটই প্রাপ্য ছিল।’

তবে শফিউলের এ দুর্দান্ত পারফরমেন্সের পর অনেকেরই আফসোস একটাই। সবগুলো ম্যাচে বাংলাদেশ তাঁর হাত ধরে জয় পেলেও কোনো ম্যাচেই ম্যাচ-সেরার পুরস্কারটা ওঠেনি এই পেসারের হাতে। শফিউল নিজে অবশ্য এতে কিছুই মনে করছেন না। গতকাল হল্যান্ডের বিপক্ষে ছয় উইকেটের জয়ের পর তিনি বলেছেন, ‘ঠিক আছে। এটা কোনো ব্যাপার না। সবচেয়ে বড় কথা হলো, আমরা জিততে পেরেছি। ম্যাচ-সেরার পুরস্কারটা তো শুধুই একটা অলংকার।’

শফিউলের এ স্বপ্নযাত্রা অব্যাহত থাকুক, এটা বোধহয় শফিউলের চেয়েও এখন বাংলাদেশের মানুষই আরও বেশি করে চায়। ওয়েবসাইট।

৮৩ বিশ্বকাপ: অঘটনের নেপথ্যে

প্রতিটি বিশ্বকাপেই একটা দুইটা অঘটন ঘটেই থাকে। ৯৬ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ৭৩ রানে হারিয়ে সবাইকে চমকে দিয়েছিল কেনিয়া। ৯৯ বিশ্বকাপের ফাইনালিস্ট পাকিস্তানকে ৬২ রানে হারিয়ে হইচই ফেলেছিল বাংলাদেশ। ৮৩ সালে বিশ্বকাপে নিজেদের প্রথম ম্যাচেই অস্ট্রেলিয়াকে ১৩ রানে হারিয়ে বিশ্বকাপের অন্যতম বড় অঘটনটার জন্ম দিয়েছিল জিম্বাবুয়ে। আসলে ৮৩ বিশ্বকাপের শুধু ঐ একটা ম্যাচ না, পুরো বিশ্বকাপটাকেই বলা যায় একটা অঘটন। ভারতের বিশ্বকাপ জয়টাই আসলে একটা বড় অঘটন। আর এই অঘটনটাই বদলে দিয়েছিল পুরো ক্রিকেট বিশ্বের মানচিত্র। তৈরি করেছিল ক্রিকেটের সুপার পাওয়ার হিসেবে ভারতের আত্মপ্রকাশের পাটাতন। ভারতের এই পটপরিবর্তনের নেপথ্যে ভালোভাবে নজর দিলে এটা বলাই যায় যে, ৮৩ বিশ্বকাপে কপিল দেবের ১৭৫ রানের মহাকাব্যিক সেই ইনিংসটার হাত ধরেই উন্মোচিত হয়েছিল ভারতীয় ক্রিকেটের নতুন দিগন্ত।

বিশ্বকাপের প্রথম দুইটি আসরে ওয়েস্ট ইন্ডিজ, অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ডের দুর্দান্ত দাপটের কাছে একেবারেই পাত্তা পায় নি ভারত। দ্বিতীয় বিশ্বকাপেও একই অবস্থা। বিশ্বকাপের দুই আসর মিলিয়ে ভারত খেলতে পেরেছিল মাত্র ছয়টি ম্যাচ। জিতেছিল মাত্র একটিতে। পূর্ব আফ্রিকার বিপক্ষে। এইরকম অবস্থায় তৃতীয় বিশ্বকাপে কপিল দেবের নেতৃত্বে ভারতের ইতিহাস গড়া ক্রিকেটাররা যখন ইংল্যান্ডে পৌঁছালেন, তখন কেউই তাদের কোন গোনায় আনেন নি। কিন্তু এবার যে ক্রিকেট দুনিয়ায় উইন্ডিজ আধিপত্যের অবসান ঘটাতেই ভারতের আবির্ভাব সেটা তারা বুঝিয়ে দিল প্রথম ম্যাচেই। ক্লাইভ লয়েড, ভিভ রিচার্ডস, গর্ডন গ্রিনীজরা ধরাশায়ী হলো ৩৪ রানের ব্যবধানে। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে পরের ম্যাচটাতেও পাঁচ উইকেটের সহজ জয় পেল ভারত। কিন্তু তারপর অস্ট্রেলিয়া ও ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে টানা দুইটি ম্যাচে শোচনীয়ভাবে হেরে বসল কপিল-বাহিনী। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে নিজেদের পঞ্চম ম্যাচটাতে হারলে হয়তো টুর্নামেন্ট থেকেই ছিটকে যেত তারা। সেই ম্যাচের শুরুটাও ভারত যেভাবে করেছিল, তাতে হারটাই তাদের অবধারিত নিয়তি বলে ধরে নিয়েছিল সবাই। কিন্তু অকল্পনীয়ভাবে ম্যাচের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিলেন কপিল দেব। খেলেছিলেন হার না মানা ১৭৫ রানের অসাধারণ একটি অধিনায়কোচিত ইনিংস।

৮৩ বিশ্বকাপের ২০তম ম্যাচ ছিল সেটি। টসে জিতে ব্যাট করতে নেমে শুরুতেই ভয়াবহ ব্যাটিং বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ে যায় ভারত। স্কোরবোর্ডে মাত্র ১৭ রান জমা হতেই একে একে ফিরে যান গাভাস্কার, শ্রীকান্ত, অমরনাথ, সন্দীপ পাতিল ও ইয়াসপাল শর্মা। মাথার উপর আকাশসম চাপ নিয়ে ব্যাট হাতে মাঠে নামেন কপিল দেব। ষষ্ঠ উইকেটে রজার বিনিকে নিয়ে যোগ করলেন ৬০ রান। কিন্তু ৭৭ রানের মাথায় বিনি আর রবি শাস্ত্রী দুজনই সাজঘরে ফিরলে আবারও হতাশায় ডুবে যায় ভারতীয় শিবির। কিন্তু হার মানবেন না, এমন একটা পণ করেই যেন মাঠে নেমেছিলেন কপিল দেব। একাই তাণ্ডব চালিয়ে যেতে থাকলেন জিম্বাবুয়ের বোলারদের উপর। অষ্টম উইকেট জুটিতে মদনলালকে নিয়ে যোগ করলেন ৬২ রান। দলীয় ১৪০ রানের মাথায় মদনলালও বিদায় নেওয়ার পর ভারত ২০০ রানের কোটা ছুঁতে পারবে কিনা তা নিয়েই সংশয় প্রকাশ করতে লাগলেন অনেকে। কিন্তু সবাইকে বিস্মিত করে দিয়ে নবম উইকেটে কপিল দেব আর সৈয়দ কিরমানি যোগ করলেন ১২৬ রান। স্কোরবোর্ডে ভারতের রানের পাশে লেখা হল ২৬৬। ১৬টি চার ও ৬টি ছয়ে সাজানো ১৭৫ রানের ইনিংসটা কপিল খেলেছিলেন মাত্র ১৩৮ বলে। ভারতের পক্ষে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রান করেছিলেন কিরমানি। ২৪!

শুধু ব্যাট হাতেই না, বল হাতেও সেদিন জ্বলে উঠেছিলেন কপিল দেব। উইকেট পেয়েছিলেন শুধু একটি। কিন্তু তাঁর কৃপণ বোলিং ভারতের জয়ের পথে বড় একটা অবদান রেখেছিল। ১১ ওভার বল করে তিনি দিয়েছিলেন মাত্র ৩২ রান। ম্যাচটা ভারত জিতেছিল ৩১ রানে। এই অকল্পনীয় জয়টা ভারতকে এতটাই অনুপ্রেরণা যুগিয়েছিল যে, পরের ম্যাচে অস্ট্রেলিয়াকে তারা হারিয়েছিল ১১৮ রানের বিশাল ব্যবধানে। পরের ইতিহাসটা তো সবারই জানা। ফাইনালে মহাশক্তিধর ওয়েস্ট ইন্ডিজের ম্যাচটার পর লর্ডসের ব্যালকনিতে আগের দুই বিশ্বকাপের মতো ক্লাইভ লয়েডকে না, দেখা গিয়েছিল হাস্যোজ্জ্বল কপিল দেবকে।

বার্মিংহামের সেই ম্যাচটি

৭৬ বলে ৬১ রানের হার না মানা ম্যাচজয়ী ইনিংসটি খেলার পথে ডারেক মারে

সবাই জানেন, ১৯৭৫ সালে প্রথম ক্রিকেট বিশ্বকাপটা জিতেছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। কিন্তু এটা হয়তো অনেকেরই অজানা যে, বিশ্বকাপে তাদের দ্বিতীয় ম্যাচটাই হেরে গ্রুপ পর্ব থেকেই ছিটকে যেতে বসেছিলেন ক্লাইভ লয়েড, ভিভ রিচার্ডসরা।  পাকিস্তানের বিপক্ষে সেই ম্যাচটাতে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ভালোমতোই প্রমাণ করেছিল যে, ক্রিকেট ‘অনিশ্চয়তার খেলা’। এখানে অনেক কিছু অনুমান করা সম্ভব হলেও শেষ বলটার আগ পর্যন্ত জোর দিয়ে কিছুই বলা যায় না।

এখনো পর্যন্ত বিশ্বকাপের অনেক উত্তেজনাপূর্ণ ম্যাচই তাঁবু গেড়েছে ক্রিকেটপ্রেমীদের স্মৃতিতে। স্থান করে নিয়েছে ক্রিকেট ইতিহাসে। প্রথম বিশ্বকাপে বার্মিংহামে ওয়েস্ট ইন্ডিজ-পাকিস্তানের এই ম্যাচটিকেও নিঃসন্দেহে জায়গা দেওয়া যায় সেই তালিকার প্রথম সারিতে।

বার্মিংহামের রৌদ্রজ্জ্বল সকালে নিজেদের অজান্তেই এক স্মরণীয় ম্যাচের টস করতে নেমেছিলেন উইন্ডিজ অধিনায়ক ক্লাইভ লয়েড ও পাকিস্তান অধিনায়ক মজিদ খান। টসে জিতে ব্যাট করার সিদ্ধান্ত নেয় পাকিস্তান। অ্যান্ডি রবার্টস, কেইথ বয়েস, বের্নাড জুলিয়েনদের দুর্ধর্ষ পেস আক্রমণ বেশ ভালোমতোই মোকাবিলা করছিলেন পাকিস্তানি ব্যাটসম্যানরা। অধিনায়ক মজিদ খান খেলেছিলেন ৬০ রানের এক অনবদ্য ইনিংস। পরে মুশতাক মোহাম্মদের ৫৫, ওয়াসিম রাজার ৫৭ বলে ৫৮ রানের ইনিংস দুটির সুবাদে নির্ধারিত ৬০ ওভারে পাকিস্তানের সংগ্রহ দাঁড়ায় ২৬৬ রান।

গর্ডন গ্রিনিজ, আলভিন কালিচরন, রোহান কানহাই, ভিভ রিচার্ডসের মতো বাঘা বাঘা ব্যাটসম্যান আছেন যে দলে, তাদের জন্য ২৬৭ রানের টার্গেটটা নিতান্ত মামুলিই বলা যায়। কিন্তু সে দিন সারফরাজ নেওয়াজ, নাসের মালিকদের অসাধারণ বোলিং পাল্টে দিল সব হিসেব নিকেশ। খুব বেশিক্ষণ উইকেটে টিকতে পারলেন না গ্রিনিজ, ফ্রেডরিক, কালিচরণ, কানহাই, ভিভ রিচার্ডস। তিন অঙ্কের ঘরে না পৌঁছাতেই সাজঘরে ফিরে গেলেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের প্রথম সারির এই পাঁচ ব্যাটসম্যান। আশার আলো কিছুটা জাগিয়ে রেখেছিলেন ক্লাইভ লয়েড। কিন্তু ৫৮ বলে ৫৩ রানের লড়াকু ইনিংসটি খেলে তিনি জাভেদ মিঁয়াদাদের শিকারে পরিণত হলে হতাশায় ডুবে যায় উইন্ডিজ শিবির। স্কোরবোর্ডের চেহারা শোচনীয়। ৭ উইকেটে ১৫১ রান। টেনে হিঁচড়ে স্কোরটাকে ২০৩ পর্যন্ত নিয়ে যেতেই পতন হলো আরো দুইটি উইকেটের। জয়ের জন্য তখনো দরকার ৬৪ রান।

শেষ উইকেট জুটিতে এত রান সংগ্রহের কথা কেউ স্বপ্নেও ভাবে না। একদিকে অভিজ্ঞ ব্যাটসম্যান ডারেক মারে থাকলেও আরেক দিকে আছেন নবাগত ফাস্ট বোলার অ্যান্ডি রবার্টস, একদিনের ক্রিকেটে এটি ছিল যার দ্বিতীয় ম্যাচ। পাকিস্তানের জয় উদযাপনও শুরু করে দিয়েছিলেন অনেকে। তাদের জয়টা মনে হচ্ছিল শুধু সময়ের ব্যাপার মাত্র। কিন্তু তারপর ইতিহাস গড়ার জন্যই যেন উইকেটে খুঁটি গেড়ে বসলেন উইন্ডিজ উইকেটরক্ষক ডারেক মারে আর অ্যান্ডি রবার্টস। সবাইকে হতবাক করে দিয়ে একে একে ঠিকই ৬৩ রান যোগ করে ফেললেন শেষ উইকেট জুটিতে। এরপরই এসে গেল সেই মহেন্দ্রক্ষণ। ওয়াসিম রাজার বল মিড উইকেটে ঠেলে দিয়েই অবিশ্বাস্য এক জয় ছিনিয়ে নিলেন রবার্টস। শেষ পর্যন্ত তিনি অপরাজিত ছিলেন ২৪ রানে। আর ডারেক মারের ৭৬ বলে ৬১ রানের হার না মানা ম্যাচজয়ী ইনিংসটি এখনো উজ্জ্বল হয়ে আছে বিশ্বকাপের ইতিহাসে।

৭০-এর দশকে ক্রিকেট জগতে উইন্ডিজের একক আধিপত্যের কালে প্রতিপক্ষকে দুমড়ে-মুচড়ে দিয়ে অনেক জয়ই পেয়েছিল ক্লাইভ লয়েডের নেতৃত্বাধীন ওয়েস্ট ইন্ডিজ। কিন্তু ওয়ানডে ক্রিকেটের ৪০ বছরের ইতিহাসের সবচেয়ে স্মরণীয় ম্যাচের কথা বলতে গিয়ে উইন্ডিজ কিংবদন্তী ক্লাইভ লয়েডের মনে সবার আগে ভেসে উঠেছিল এই ম্যাচটির কথাই।