Posts Tagged ‘ আওয়ামী লিগ ’

নতজানু আর নয়

পূর্বপরিকল্পিত পথেই হাঁটছে জামায়াত-শিবির

২০০৯ সালে জামায়াতে ইসলামীর করা কিছু পরিকল্পনা-কর্মপদ্ধতি সম্পর্কে জানা যায় উইকিলিকসের কল্যানে। এগুলো তারা বলেছিল ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে। নিজেদের লক্ষ্য সম্পর্কে জামায়াত নেতারা বলেছিল, জামায়াত পরবর্তী নির্বাচনে জয়ী হওয়া বা জাতীয় সংসদে আসনসংখ্যা বাড়ানোর মতো স্বল্পমেয়াদি অর্জন নিয়ে চিন্তিত নয়, তাদের দৃষ্টি চূড়ান্ত লক্ষ্যের দিকে। চূড়ান্ত লক্ষ্যটা কি? ইসলামি রাষ্ট্র কায়েম করা। পাকিস্তানে যেমনটা ছিল-আছে।
২০০৮ সালে আওয়ামী লিগ সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করার অঙ্গীকার নিয়ে ক্ষমতায় এলে খানিকটা কোনঠাসা বোধ করে জামায়াত-শিবির। যদি সরকার তাদের নিষিদ্ধই করে, তাহলে কী করা হবে সেটাও তখনই ভেবে রেখেছিল তারা। উইকিলিকসে জামায়াতে ইসলাম ২০১০ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রদূত মরিয়ার্টি একটি গোপনীয় তারবার্তায় লেখেন: জামায়াতের নেতা ব্যারিস্টার রাজ্জাক ১০ ফেব্রুয়ারি বৈঠকে তাঁকে বলেন, জামায়াতে ইসলামী ‘সাংবিধানিক পথে’ বিশ্বাস করে, দলটি আদালতের সিদ্ধান্ত মেনে চলবে। বাংলাদেশে যদি ধর্মভিত্তিক দলগুলো নিষিদ্ধ হয়ে যায়, তাহলে জামায়াত তুরস্কের ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর দৃষ্টান্ত অনুসরণ করবে। জামায়াত দলের নাম পরিবর্তন করবে, দলীয় গঠনতন্ত্র থেকে ধর্মীয় মতবাদগুলো বাদ দেবে; কিন্তু একই সঙ্গে তিনি বলেন যে জামায়াত রুলিংটিকে আদালতে চ্যালেঞ্জ করবে। রাজ্জাকের ভাষ্য অনুসারে, ধর্মভিত্তিক দলগুলোর ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হলে জামায়াতে ইসলামী দলের নামে ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ও ট্রাস্টে যে অর্থ আছে, দলটি তা হারাবে, কিন্তু দল টিকে থাকবে। রাজ্জাক বলেন, একটি ক্ষত সৃষ্টি হবে, তবে সেই ক্ষত সারানো যাবে। (সূত্র: উইকিলিকসে বাংলাদেশ: ‘জামায়াতে ইসলামী- খরগোশ নয়, কচ্ছপ’)
দুই বছর পরে এখন তাহলে জামায়াত কি সেই কর্মপরিকল্পনা অনুসারেই হাঁটছে না? হেফাজতে ইসলাম যে জামায়াতেরই মদদপুষ্ট এবং মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ সেকথা কি এখনো কারও বোঝার বাকি আছে? পরিস্কারভাবে দেখা যাচ্ছে যে, তারা হেফাজতে ইসলামের নামে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচাল, জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধের দাবির কণ্ঠরোধ করতে চায়।
জামায়াত তুরস্কের ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর দৃষ্টান্ত অনুসরণ করবে সেকথাও বলেছে। সকলের বোধহয় মনে আছে যে, ট্রাইবুন্যালের বিচার কার্যক্রমকে প্রশ্নবিদ্ধ করে এই বিচার বন্ধ করার প্রস্তাব দিয়েছিল তুরস্কের সরকার। ফলে তুরস্ক তো জামায়াতের আদর্শ উদাহরণ হবেই। সেই পথেই তারা এগিয়ে যাচ্ছে এবং হেফাজতে ইসলাম ব্যানারের আড়ালে নতুনভাবে সংগঠিত হতে চাচ্ছে।

হেফাজতে ইসলাম + জামায়াতে ইসলামী = হেফাজতে জামায়াতে ইসলামী

জামায়াতে ইসলামী ও হেফাজতে ইসলাম যে একই মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ এটা তাদের কর্মকা-ের মাধ্যমেও বোঝা যায়।
শাহবাগ আন্দোলন শুরুর সঙ্গে সঙ্গে এটাকে নাস্তিকদের আন্দোলন বলে মিথ্যা প্রচারণা চালিয়েছিল জামায়াত-শিবির। তারা ব্লগার রাজীব হায়দারকে হত্যা পর্যন্ত করেছে। ধর্মভীরু মানুষদের মাঝে তারা প্রচারণা চালিয়েছে যে, শাহবাগে সবাই নাস্তিক, ওখানে বেলেল্লাপনা হয়, ওরা ‘বিজাতীয় সংস্কৃতি’র ধারকবাহক। এই প্রচারণা দিয়ে এখনো সারাদেশে তা-ব চালিয়ে যাচ্ছে জামায়াত-শিবির। এদিকে ধুম করে দৃশ্যপটে হাজির হওয়া এবং সবাইকে ভীতসন্ত্রস্ত করে তোলা হেফাজতে ইসলামের দাবিগুলোও কিন্তু একই রকম। জামায়াত-শিবিরও মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্য, শহীদ মিনার, মন্দিরে মূর্তি ভাঙ্গছে, আগুন দিচ্ছে। হেফাজতে ইসলামীও তাদের মতো করে মূর্তি-ভাস্কর্য স্থাপনের বিরোধীতা করছে।
হেফাজতে ইসলামের ১৩ দফা দাবি দেখলেই বোঝা যায় যে তারা কেমন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করতে চায়। এগুলো মধ্যে কয়েকটি হলো: ব্যক্তি ও বাক-স্বাধীনতার নামে সকল বেহায়াপনা, অনাচার, ব্যভিচার, প্রকাশ্যে নারী-পুরুষের অবাধ বিচরণ, মোমবাতি প্রজ্বলনসহ সকল বিজাতীয় সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ বন্ধ করতে হবে, মসজিদের নগরী ঢাকাকে মূর্তির নগরীতে রূপান্তর এবং দেশব্যাপী রাস্তার মোড়ে ও কলেজ-ভার্সিটিতে ভাস্কর্যের নামে মূর্তি স্থাপন বন্ধ করতে হবে, পার্বত্য চট্টগ্রামসহ দেশব্যাপী ইসলাম বিরোধী কর্মকা-ে জড়িত এনজিও এবং খ্রিস্টান মিশনারীদের ধর্মান্তকরণসহ সকল অপ-তৎপরতা বন্ধ করতে হবে, কথিত শাহবাগী আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী স্বঘোষিত নাস্তিক-মুরতাদ এবং প্রিয় নবী (সা.)-র শানে জঘন্য কুৎসা রটনাকারী কুলাঙ্গার ব্লগার ও ইসলাম বিদ্বেষীদের সকল অপপ্রচার বন্ধসহ কঠোর শাস্তিদানের ব্যবস্থা করতে হবে ইত্যাদি ইত্যাদি।
এ কেমন বাংলাদেশ বানানোর দাবি জানাচ্ছে হেফাজতে ইসলাম? এটা কি বাংলাদেশকে পাকিস্তান বা আফগানিস্তান বানানোরই রুপকল্প না? এই দাবি বাস্তবায়ন হলে নারী-পুরুষ অবাধে মেলামেশা করতে পারবে না। মূর্তি-ভাস্কর্য স্থাপন করা যাবে না। মোমবাতি প্রজ্জলন এদের কাছে বিজাতীয় সংস্কৃতি। হেফাজতে ইসলামের কল্পিত বাংলাদেশে সবাইকেই এক অর্থে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে হবে। আর যদি অন্য ধর্মাবলম্বী কেউ থাকেও তাহলে তারা নিজেদের আচার পালন করতে পারবেন না। এবং এই মুসলিমটাও হতে হবে তাদের তরিকা অনুযায়ী। কারণ তারা কাদিয়ানীদেরও অমুসলিম ঘোষণা করেছে। হেফাজতে ইসলাম যে বাংলাদেশ কায়েম করতে চায় সেটা হবে চরম আকারের সাম্প্রদায়িক, রক্ষণশীল,  গুমোট একটা পরিবেশ। সেখানে কারও স্বাধীন মত প্রকাশের স্বাধীনতা থাকবে না, গণতান্ত্রিক চর্চার সুযোগ থাকবে না। ৪২ বছর আগে মুক্তিযোদ্ধারা জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করেছিলেন কি এই বাংলাদেশের জন্য?

হেফাজতে ইসলাম কেন ইসলামী নিদর্শন ধ্বংস নিয়ে কোন কথা বলে না?

হেফাজতে ইসলাম কতিপয় কিছু কথিত নাস্তিক ব্লগারদের পেছনে লেগেছে। কিন্তু যখন সৌদি আরবে মহানবী হজরত মোহাম্মদ (সাঃ) এর সময়কার, তাঁর স্মৃতিবিজরিত মসজিদসহ অন্যান্য স্থাপনা ভেঙ্গে ফেলা হয় তখন কোথায় থাকেন হেফাজতে ইসলামের লোকজনেরা? সেটাকে তাহলে তারা ইসলামের কোন ক্ষতি বলে মনে করছে না? মহানবীকে নিয়ে কটুক্তি করলে ব্লগার গ্রেপ্তার আর মহানবীর নিদর্শন, যেখানে মহানবী নামাজ পড়েছেন, সেই মসজিদ ভেঙ্গে দিলে কোন সমস্যা নেই?

Macca

বাংলাদেশেও খুবই প্রাচীন একটা মসজিদের সন্ধান পাওয়া গেছে রংপুরের রামজাপুর গ্রামে। ধারণা করা হচ্ছে এটা দক্ষিণ এশিয়ারই প্রথম মসজিদ হতে পারে। কিন্তু সেখানকার গুরুত্বপূর্ণ প্রতœতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলো সরকারী অবহেলায় নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। সে ব্যাপারে হেফাজতে ইসলামের কোন কথাবার্তা নেই কেন? তাহলে এটা কি খুবই পরিস্কার না যে, হেফাজতে ইসলাম আসলে কী হেফাজত করতে চাচ্ছে? তারা প্রকৃতঅর্থেই জামায়াতের হেফাজতকারী। যুদ্ধাপরাধীদের হেফাজতকারী। এদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর সময় এখনই।

আওয়ামী লিগ সরকারের ডিগবাজি

১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত ধর্মের নামে পাকিস্তানী ঔপনিবেশিক শাসকরা এই বাংলাদেশ ভূখ-ের মানুষদের শোষণ করেছিল, নির্যাতন-নিপীড়ণ চালিয়েছিল, খুন-ধর্ষণ করেছিল। সেই অভিজ্ঞতা থেকেই সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে যখন সংবিধান রচিত হয় তখন রাষ্ট্র পরিচালনার চারটি মূলনীতির মধ্যে স্থান দেওয়া হয় ধর্মনিরপেক্ষতাকে। কিন্তু অবাক করে দেওয়ার মতো বিষয় হলো, যে আওয়ামী লিগের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়েছিল, যে আওয়ামী লিগ ১৯৭২ সালে প্রথম সংবিধানটি রচনা করেছিল সেই আওয়ামী লিগই ৪২ বছর পর নতজানু হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধী হেফাজতে ইসলামের কাছে। সরকার নাকি জামায়াতের লেবেলধারী হেফাজতে ইসলামের বেশ কিছু দাবি আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে মেনে নিতে যাচ্ছে। কিছুতেই বোঝা যায় না যে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা হয়ে বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কিভাবে হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে আপোষ করতে পারেন। জয় বাংলার পরে জয় বঙ্গবন্ধু না বললে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ঠিকমতো প্রতিষ্ঠিত হয় না বলে মনে করেন অনেক আওয়ামী লিগার। কিন্তু এখন তো আপনারা বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলার স্বপ্নের বিপরীতেই হাঁটছেন। এ কেমন স্ববিরোধীতা?
হেফাজতে ইসলামের কাছে সরকার যেন নিজের মাথাটাই পেতে দিয়েছে। অত্যন্ত অন্যায়ভাবে গ্রেফতার করা হয়েছে তিনজন ব্লগারকে। তাঁরা কি অবমাননা করেছেন, কিভাবে অবমাননা করেছেন সেগুলো এখনো কারো কাছে স্পষ্ট না। ব্লগ-ব্লগার বলতে হেফাজতে ইসলামই বা কি বোঝেন আর সরকারই বা কি বোঝেন সেটা নিয়েও যথেষ্ট সন্দেহ আছে। সরকার আমারব্লগ বন্ধ করে দিয়েছে। হেফাজতে ইসলামের কথা বাদ দিলাম, ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়তে চাওয়া সরকার কি জানে যে ব্লগগুলোতে শুধু ঐ দুই-তিনজনই লেখেন না। আরও অনেকেই লেখেন। শুধু ধর্ম নিয়েই না, সেখানে রাজনীতি-অর্থনীতি-সমাজ নিয়েও আরও অনেক লেখা ছিল? সেগুলো তাহলে আমরা কিভাবে পড়ব? স্বাধীন মতপ্রকাশের পথ এভাবে কেন বন্ধ করা হবে?
দেশ পরিচালনায় নিযুক্ত ব্যক্তিবর্গ, আপনারা কিভাবে ভুলে যান যে, জামায়াতে ইসলাম ১৯৭১ সালে কিভাবে এদেশের সূর্য্যসন্তানদের হত্যা করেছে। এই একই ধর্মের দোহাই তুলে। ৪২ বছর পরে এবারও স্বাধীনতাবিরোধী গোষ্ঠী সেই একই কায়দায় রুদ্ধ করতে চাইছে এদেশের মুক্ত চিন্তা-স্বাধীন মতপ্রকাশের পথ। আর সরকার মহোদয়রা সেই কাজেই আরও সহায়তা করছেন। এর চেয়ে দুঃখজনক আর কি হতে পারে? বিএনপি যদি এই কাজটা করত তাহলে এটাকে দুঃখজনক বলে আখ্যায়িত করার প্রয়োজন পড়ত না। কারণ তারা তো সেটা করবেই, ঐতিহাসিকভাবে তারা এটা করে এসেছে। এখনো তারা হেফাজতে ইসলামের প্রতি, প্রকারান্তরে জামায়াত শিবিরের প্রতি নৈতিক সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আওয়ামী লিগ? তারা না মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি? এই আওয়ামী লিগই না ১৯৭২ সালে ‘গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতাকে মূল নীতি করে সংবিধান রচনা করেছিল?’ মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকার-চেতনা সব কি ভেসে গেল ভোটের চিন্তায়? পক্ষ নিন সরকার- মানবতা না মুনাফা?

নতজানু আর নয়

শাহবাগ আন্দোলনের শুরুর দিকে অনেকেই ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করে, ১৯৭২ সালের সংবিধান অনুযায়ী ধর্মনিরপেক্ষতার পথে হাঁটার আওয়াজ তুলেছিলেন। সেসময় কৌশলগত কারণে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি বাদ দিয়ে শুধু জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধের দাবিতে সরে আসা হয়েছিল। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে এতে জামায়াত-শিবিরের কর্ম-পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করার পথ প্রসারিত হয়েছে। নিষিদ্ধ হয়ে যাবে বুঝতে পেরেই তারা হেফাজতে ইসলামের ব্যানারে সংগঠিত হচ্ছে। ফলে জামায়াত-শিবিরকে শুধু নিষিদ্ধ করলেই হবে না। নিষিদ্ধ করতে হবে তাদের রক্ষণশীল-সাম্প্রদায়িক মতাদর্শকেও। যেমনটা করা হয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর হিটলারের নাৎসি পার্টিকে। এমনভাবে তাদেরকে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল যে এখনও, ৬২ বছর পরে নাৎসি ভঙ্গিতে স্যালুট দেওয়ার দায়ে আজীবনের জন্য নিষিদ্ধ করা হয় প্রতিভাবান তরুণ ফুটবলারকে। এইরকম কঠোরভাবেই বন্ধ করে দিতে হবে জামায়াত-শিবিরের এখানে সেখানে গজিয়ে ওঠার পথ। তাহলেই কেবল একটি অসাম্প্রদায়িক, মানবিকতার সমাজের পথে অগ্রসর হওয়া সম্ভব বাংলাদেশের পক্ষে। যেমন বাংলাদেশের স্বপ্ন বুকে নিয়ে মুক্তির সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন পুরো দেশের স্বাধীনতাকামী মানুষ। ফলে শাহবাগ চত্বরে দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছে, একথা যদি স্বীকার করে নিই, তাহলে বিজয় অর্জন করতে গেলে সেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নের পথেই হাঁটতে হবে শাহবাগ আন্দোলনকে। ষ্পষ্টভাবে বলতে হবে, ৭১ এ স্বাধীনতাবিরোধী গোষ্ঠী যে আদর্শ-মতবাদের প্রেক্ষিতে রাজনীতি করছে, স্বাধীন বাংলাদেশে সেই মতাদর্শ বাস্তবায়নের কোন অধিকার থাকতে পারবে না। সাংবিধানিকভাবে তাদের রাজনৈতিক অধিকার বিলোপ করতে হবে।

সরকারের স্ববিরোধীতা উন্মোচিত হচ্ছে

যুদ্ধাপরাধীদের সংগঠন জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধের দাবিতে আমরণ অনশনে বসেছিলেন রুমী স্কোয়াডের স্কোয়াডের কিছু স্বপ্নবাজ তরুণ-তরুণী। সরকারের তরফ থেকে তাদের দাবিটা উপেক্ষা করা হয়েছিল টানা ৬টা দিন। এর আগে সরকারকে জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধের প্রক্রিয়া শুরু করার জন্য এক মাসেরও বেশি সময় দিয়েছিল গণজাগরণ মঞ্চ। অনশনের সময় বেশ কয়েকজন অনশনকারী কয়েক দফায় হাসপাতালে গিয়েছে, প্রচণ্ড ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে একটি পুরো রাত পার করেছে। অনুমান করতে পারি যে, এই কয় দিনে অনেক অনেক বাধা-বিপত্তির মুখে তাদের পড়তে হয়েছে। মৃত্যুকে তুচ্ছ করে কেন করছিলেন তাঁরা এইসব? কারণ তাঁরা মনে করছেন, নতুন বাংলাদেশ গঠনের কাজে হাত দেওয়ার আগে দেশের ক্যান্সারস্বরুপ জামায়াত-শিবিরকে আগে নির্মূল করা প্রয়োজন। আর দাবি আদায়ের জন্য তাঁরা কোন জ্বালাও-পোড়াও করছেন না, কাউকে হুমকি-ধামকি দিচ্ছেন না, নিজেদের কথা সরকারের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য তারা নিজেদেরকেই কষ্ট দিচ্ছেন। গতকাল ১ এপ্রিল পরিকল্পনা মন্ত্রী ও  মুক্তিযুদ্ধের সেকেন্ড-ইন-কমান্ড এ.কে.খন্দকারের  আশ্বাসের প্রেক্ষিতে অনশন কর্মসূচি স্থগিত করেছে শহীদ রুমী স্কোয়াড।

rumi

অন্যদিকে সহিংসতা-হরতাল-অবরোধের হুমকি আসছে হেফাজতে ইসলামের তরফ থেকে। যাদেরকে অনেকেই, এমনকি ইসলামী লোকজনই বলেছেন, জামায়াতেরই অন্য রুপ। তারা আসলে ইসলাম না, জামায়াতেরই হেফাজত করতে নেমেছে। ‘নাস্তিক’ ব্লগার ও ধর্মানূভূতিতে আঘাত দেওয়ার শাস্তির দাবিতে চলছে এই আন্দোলন। তাদের ১৩টি দাবি হলো:

১। সংবিধানে ‘আল্লাহ্‌্‌র উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস’ পুনঃস্থাপন এবং কোরান-সুন্নাহ্‌্‌ বিরোধী সকল আইন বাতিল করতে হবে।
২। আল্লাহ্‌, রাসুল (সা.) ও ইসলাম ধর্মের অবমাননা এবং মুসলমানদের বিরুদ্ধে কুৎসা রোধে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে জাতীয় সংসদে আইন পাস করতে হবে।

৩। কথিত শাহবাগী আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী স্বঘোষিত নাস্তিক-মুরতাদ এবং প্রিয় নবী (সা.)-র শানে জঘন্য কুৎসা রটনাকারী কুলাঙ্গার ব্লগার ও ইসলাম বিদ্বেষীদের সকল অপপ্রচার বন্ধসহ কঠোর শাস্তিদানের ব্যবস্থা করতে হবে।

৪। ব্যক্তি ও বাক-স্বাধীনতার নামে সকল বেহায়াপনা, অনাচার, ব্যভিচার, প্রকাশ্যে নারী-পুরুষের অবাধ বিচরণ, মোমবাতি প্রজ্বলনসহ সকল বিজাতীয় সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ বন্ধ করতে হবে।

৫। ইসলামবিরোধী নারীনীতি, ধর্মহীন শিক্ষানীতি বাতিল করে শিক্ষার প্রাথমিক স্তর থেকে উচ্চ মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত ইসলাম ধর্মীয় শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করতে হবে।

৬। সরকারিভাবে কাদিয়ানিদের অমুসলিম ঘোষণা এবং তাদের প্রচারণা ও ষড়যন্ত্রমূলক সকল অপ-তৎপরতা বন্ধ করতে হবে।
৭। মসজিদের নগরী ঢাকাকে মূর্তির নগরীতে রূপান্তর এবং দেশব্যাপী রাস্তার মোড়ে ও কলেজ-ভার্সিটিতে ভাস্কর্যের নামে মূর্তি স্থাপন বন্ধ করতে হবে।

৮। জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমসহ দেশের সকল মসজিদে মুসল্লিদের নির্বিঘ্নে নামাজ আদায়ে বাধা-বিপত্তি ও প্রতিবন্ধকতা অপসারণ এবং ওয়াজ-নসিহত ও ধর্মীয় কার্যকলাপে বাধাদান বন্ধ করতে হবে।

৯। রেডিও, টেলিভিশনসহ বিভিন্ন মিডিয়ায় দাড়ি-টুপি ও ইসলামী কৃষ্টি-কালচার নিয়ে হাসি-ঠাট্টা এবং নাটক-সিনেমায় খল ও নেতিবাচক চরিত্রে ধর্মীয় লেবাস-পোশাক পরিয়ে অভিনয়ের মাধ্যমে তরুণ প্রজন্মের মনে ইসলামের প্রতি বিদ্বেষমূলক মনোভাব সৃষ্টির অপপ্রয়াস বন্ধ করতে হবে।

১০। পার্বত্য চট্টগ্রামসহ দেশব্যাপী ইসলাম বিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িত এনজিও এবং খ্রিস্টান মিশনারীদের ধর্মান্তকরণসহ সকল অপ-তৎপরতা বন্ধ করতে হবে।

১১। রাসুলপ্রেমিক প্রতিবাদী আলেম-ওলামা, মাদরাসা ছাত্র এবং তৌহিদী জনতার ওপর হামলা, দমন-পীড়ন, নির্বিচার গুলিবর্ষণ এবং গণহত্যা বন্ধ করতে হবে।

১২। সারা দেশের কওমী মাদরাসার ছাত্র-শিক্ষক, ওলামা-মাশায়েখ এবং মসজিদের ইমাম-খতিবকে হুমকি-ধামকি ও ভয়ভীতি দানসহ তাদের বিরুদ্ধে সকল ষড়যন্ত্র বন্ধ করতে হবে।

১৩। অবিলম্বে গ্রেপ্তারকৃত সকল আলেম-ওলামা, মাদরাসা ছাত্র ও তৌহিদী জনতাকে মুক্তিদান, দায়েরকৃত সকল মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার এবং আহত ও নিহতদের ক্ষতিপূরণসহ দুষ্কৃতকারীদেরকে বিচারের আওতায় এনে কঠোর শাস্তি দিতে হবে।

এই দাবি নিয়ে আগামী ৬ মার্চ ঢাকামুখী লংমার্চ করার ব্যাপক প্রস্তুতি নিচ্ছেন হেফাজতে ইসলামের নেতা-কর্মীরা। এর ভেতরে বেশ কিছু দাবিই নাকি মেনে নেওয়ার বিষয় বিবেচনা করা হচ্ছে

পরষ্পরবিরোধী দুই পক্ষই আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের চিন্তাচেতনাই শুধু না, দাবি আদায়ের লক্ষ্যে কর্মসূচি বেছে নেওয়ার ধরণেও স্পষ্ট পার্থক্য বিদ্যমান। চট্টগ্রামে একবার হেফাজতে ইসলামের নেতৃবৃন্দকে আলোচনায় বসার আহ্বানও জানানো হয়েছিল গণজাগরণ মঞ্চের পক্ষ থেকে। তারা কিন্তু সেবার আলোচনা করতে রাজি ছিলেন না। অহিংস ও সহিংস, দুই পক্ষেরই দাবি সরকারের কাছে। প্রশ্ন হচ্ছে, সরকার কাদের দাবির কথাটা আগে বিবেচনা করবে? জামায়াতের লেবেলধারী সহিংসতাপন্থী হেফাজতে ইসলামের নাকি মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারী অহিংস শাহবাগ আন্দোলনের?

জামায়াত-শিবিরকে নিষিদ্ধের বিষয়ে সরকার এখনো আনুষ্ঠানিক কোন বক্তব্য দেয়নি। সরকারদলীয় ব্যক্তিবর্গের কথাতে স্ববিরোধীতাও স্পষ্ট। দুই দিন আগেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছিলেন, পুরো দেশে দাবি উঠলে জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধ করব। আজ ২ এপ্রিল আওয়ামী লিগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল হক হানিফ বলেছেন, সমগ্র দেশে এখন জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার দাবি উঠেছে। এই দলকে নিষিদ্ধ করা এখন সময়ের ব্যাপার। তাদের নিষিদ্ধ করার প্রক্রিয়া খুব দ্রুত শুরু হবে।’
খুব দ্রুতটা যে কবে, সেটা কিন্তু এখনো জানা গেল না। শুধু তাই না, শাহবাগ আন্দোলন নিয়ে উষ্মাও প্রকাশ করেছেন দেশ পরিচালনার সঙ্গে জড়িত রাজনীতিবিদেরা।

অন্যদিকে হেফাজতে ইসলামের দাবি দ্রুত মেনে নেওয়ার উদ্যোগ দেখিয়েছে সরকার। ৬ এপ্রিলের লংমার্চের আগেই সরকার ‘আমারব্লগ’ বন্ধ করে দিয়েছে, তিনজন ব্লগারকে গ্রেফতার করে রিমান্ডে নিয়েছে। এবং এই ক্ষেত্রে জনমত যাচাইয়েরও কোন প্রয়োজনীয়তা মনে করেনি সরকার। এটা কি সরকারের স্ববিরোধীতা নয়? ত্বরিতগতিতে তিন ব্লগারকে গ্রেপ্তার-রিমান্ড, ব্লগ বন্ধ ইত্যাদি আলামত থেকে আশঙ্কা হয় যে. সরকার হেফাজতে ইসলামের দিকেই বেশি ঝুঁকে গেছে। কেন এমন হলো? আওয়ামী লিগ না মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি? আওয়ামী লিগ কি তাহলে শুধু ভোটের জন্যই তাহলে মুক্তিযুদ্ধের কথা বলে? সরকারের কর্মকাণ্ড মানুষের মনে এমন অনেক প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে। গণজাগরণ মঞ্চের পক্ষ থেকে ইমরানও ছয়টি প্রশ্ন রেখেছেন সরকারের উদ্দেশ্যে,

 ১. জামায়াত-শিবির চক্র ব্লগে এবং ফেইসবুকে মওদুদীবাদ প্রচারের মাধ্যমে ইসলাম ধর্মকে নানাভাবে যখন প্রশ্নবিদ্ধ করে, তখন কোথায় থাকে রাষ্ট্রীয় বিজ্ঞপ্তির ধর্মানুভূতি?

২. যখন জামায়াত জাতীয় মসজিদে ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ করে তখন কী রাষ্ট্রের ধর্মানুভূতি শীতনিদ্রায় থাকে?

৩. যখন চট্রগ্রামে আলেম সমাজকে হত্যার হুমকি দেয় জামায়াত-শিবিরের শ্বাপদরা, তখন কি রাষ্ট্রের অভিধানে ধর্মানুভূতি শব্দটি অনুপস্থিত থাকে?

৪. যখন জামায়াত-শিবির পুলিশের উপরে নির্বিচারে হামলা চালায়, তাদের হত্যা করে, চিকিৎসককে আগুনে পুড়িয়ে মারে, রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে গৃহযুদ্ধের হুমকি দেয়, রাষ্ট্র তখন কেন তদন্ত কমিশন বানায় না? তখন কি রাষ্ট্র আঘাতপ্রাপ্ত হয় না?

৫. হরতালের নৈরাজ্য সৃষ্টি করে জামায়াত-শিবির যখন দেশকে অস্থিতিশীলতার দিকে ঠেলে দেয়, ব্লগের ক্ষুদ্র গণ্ডি থেকে যে সব গণমাধ্যম ধর্মীয় অবমাননাকর বিষয়গুলো সামনে নিয়ে আসে, তখন রাষ্ট্র কেন কমিশন করে ‍উদ্যোগ নেয় না?

৬. যখন অনলাইন এবং ব্লগে জামায়াত-শিবির বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অপপ্রচার চালায়, তখন কেন মহাজোট সরকার তার বিরুদ্ধে উদ্যোগ নেয় না? আজ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু এবং জাতীয় চার নেতা, মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করার বিরুদ্ধে সরকার কি কোনো উদ্যোগ নিয়েছে?

সরকার এখন এইসব প্রশ্নের জবাব দেবে নাকি এই প্রশ্নগুলোর ড্রাফট কে লিখে দিয়েছে, সেটা তদন্ত করতে বসবে, সেটাই দেখার বিষয়।

সরকার শাহবাগ আন্দোলনের গণদাবির প্রতি কোন ভ্রুক্ষেপ তো করছেই না, উল্টো হেফাজতে ইসলামের রক্ষণশীল দাবিগুলোকে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করছে। সেই দাবি বাস্তবায়নের জন্য পদক্ষেপ নিচ্ছে। সরকার একটি ব্লগ পর্যবেক্ষণ কমিটি বানিয়েছে, সেখানে ইসলাম বিশেষজ্ঞ হিসেবে দুইজন আলেমকে স্থান দেওয়া হলেও কোন ব্লগার সেখানে অন্তর্ভূক্ত হননি। কেন? সরকার শুধু তাদের দিকটাই শুনবে? আর সেটা শুনে যখন যেভাবে যাকে খুশি তুলে নিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারবে? এটা তো ভয়াবহ পরিস্থিতি। ককটেলবাজি-বোমা বিস্ফোরণ, খুন, গাড়ি পোড়ানো, ট্রেনের বগি লাইনচ্যুত করা, ভিন্নধর্মাবলম্বীদের বাড়িঘরে আগুন দেওয়া এইসব সহিংস ঘটনার সঙ্গে যারা জড়িত তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে ধীরেসুস্থে। যারা এগুলো করছে, তাদের নিষিদ্ধ করা হবে ধীরেসুস্থে আর কারো সাথে পাঁচে না থেকে শুধু নিজের মতটা প্রকাশের জন্য দণ্ড পেতে হবে ব্লগারদের? বন্ধ করে দেওয়া হবে মুক্তচিন্তার প্ল্যাটফর্মগুলো? এটা কিধরণের ন্যায়বিচার হলো? এটা তো পুরোপুরি স্বেচ্ছাচারী আচরণ। ডিজিটাল ফ্যাসিবাদের আগমনবার্তা।

এইটাই কি আওয়ামী লিগ সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার নমুনা? ব্লগ বন্ধ করে দিয়ে, ইন্টারনেটের উপর নিয়ন্ত্রণ এনে কিভাবে ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠন করতে চান আপনারা? ব্লগ-ওয়েবসাইট-ফেসবুক পেজের মাধ্যমে তো জামায়াত-শিবিরও ব্যাপক মিথ্যা প্রচারণা চালাচ্ছে। সেগুলোর ব্যাপারে তো সরকারের কোন বক্তব্য নেই। সেই মিথ্যা প্রচারণাগুলো কি কারও অনুভূতিতে আঘাত দেয় না? ধর্ম ছাড়া কি মানুষের আর কোন অনুভূতি নেই?

exposed

বিষয়গুলো প্রশ্ন আকারে উত্থাপিত হলেও সরকারের অবস্থান হয়তো ইতিমধ্যেই অনেকের কাছে স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে। কারণ জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে আঁঁতাত করার ইতিহাস আওয়ামী লিগের আছে। ২০০৬ সালে খেলাফতে মজলিশের সঙ্গে তাদের চুক্তির কথাও আমরা জানি।

425125_10200974897117592_328957520_n

অতীতের এই ঘটনাগুলো আমাদের ইঙ্গিত দেয় যে, আওয়ামী লিগ সরকার আরও একবার আপোষরফা করেছে বা করতে চলেছে রক্ষণশীল গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে। দুর্ভাগ্যবশত, এই আশঙ্কা যদি সত্যি হয় তাহলে শাহবাগ আন্দোলনকে আরও কঠোর-বন্ধুর পথ পাড়ি দেওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। যেহেতু প্রত্যেক ক্রিয়ারই একটি সমান এবং বিপরীত প্রতিক্রিয়া আছে, তাই সরকারকেও বিবেচনা করতে হবে শাহবাগ আন্দোলনের বিপরীতে দাঁড়ানোর পরিনামের কথা। মুক্তচিন্তা-মত প্রকাশের স্বাধীনতার উপর হস্তক্ষেপের পরিণামটা কি হবে, সেটার কথা।

কিভাবে হবে সাংস্কৃতিক আন্দোলন?

Shahbag Square protest reaches Day 9

গণজাগরণের ঢেউ দেশের প্রতিটি প্রান্তে ছড়িয়ে দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ইমরান এইচ সরকার। ছয় দফা দাবি আদায়ের পর দেশজুড়ে একটা সাংস্কৃতিক আন্দোলন পরিচালনার পরিকল্পনাও গণজাগরণ মঞ্চের সংগঠকদের আছে বলে জানিয়েছেন তিনি। বিডিনিউজকে দেওয়া এক সাক্ষাত্কারে তিনি বলেছেন, ‘সবাই আমাদের ছয় দফা দাবি সম্পর্কে জানেন। এগুলো পূরণ হয়ে গেলে আমরা দেশজুড়ে একটি সাংস্কৃতিক আন্দোলন পরিচালনার কথা ভাবছি, যার মূল লক্ষ্য হবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সারা দেশে ছড়িয়ে দেয়া। এতে করে আমাদের দেশের রাজনীতি থেকে ময়লাগুলো সব ধুয়ে যাবে।’ নিঃসন্দেহে খুবই ভালো ও প্রশংসনীয় উদ্যোগ। সাংস্কৃতিক প্রচার চালানো অবশ্যই জরুরি। পুরো দেশের মানুষের কাছে শাহবাগের গণজাগরণ বার্তা সঠিকভাবে পৌঁছে দেওয়াটার উপরই আসলে নির্ভর করছে নতুন প্রজন্মের এই মুক্তিযুদ্ধের সাফল্য। কিন্তু এই কাজটা করা হবে কিভাবে?

যদি বিষয়টা এমন হয় যে, একেক দিন একেকটা শহরে শুধু একটা করে মহাসমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে, তাহলে কার্যকরী কোন প্রভাব ফেলা যাবে কি না, সে বিষয়ে সন্দেহ আছে। হয়তো ঐ দিনটাতে একটা শহরে একটু উত্তাপ-উত্তেজনা ছড়াবে, মানুষ কৌতুহল নিয়ে দেখতে আসবে, খুব বেশি হলে আরও কিছুদিন এলাকা সরগরম থাকবে। কিন্তু এই প্রক্রিয়ায় পুরো দেশে বিরাজমান সাংস্কৃতিক-শিক্ষাগত বৈষম্য/ব্যবধান দূর করা যাবে না। মানুষের মনোজগতে কার্যকরী প্রভাব ফেলতে গেলে হয়তো আরও জনসম্পৃক্ততামূলক পদ্ধতির কথা ভাবতে হবে শাহবাগ চত্বরকে। মানুষের মনে দীর্ঘদিন ধরে জমে থাকা অনেক সন্দেহ-সংশয়, বিভ্রান্তি দূর করার কাজটা সহজ না।

আজকে আমরা শিবিরের পেজগুলোকে এখন এত প্রকটভাবে উন্মোচিত হতে দেখছি। ছাগুদের কীর্তি-কারবার নিয়ে হাসাহাসি করছি, এগুলোর বিরুদ্ধে সাইবার যুদ্ধ করছি। কিন্তু এগুলো ক্রিয়াশীল ছিল তো অনেকদিন ধরে। এবং সরকারের নিরন্তর সমালোচনা করে তারা সত্যিই জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। সেইসব সমালোচনার পেছনে যে এই জামায়াত-শিবির আছে, সেটা আমরা খেয়ালই করে দেখিনি। কারণ সমালোচনা করার যৌক্তিক কারণ ছিল। পদ্মা সেতু কেলেঙ্কারির পর যদি কোন পেজ থেকে আবুল হোসেনের একটি কেরিকেচার-যুক্ত ছবি পোস্ট করা হতো, তাহলে কি কেউ বুঝতে পারতেন যে, সেটা জামায়াত-শিবিরের পেজ? সেইরকম সমালোচনা তো অনেকেরই ছিল সরকারকে নিয়ে। ফলে সরকার-আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগের কুকীর্তিকে পুঁজি করেই কিন্তু এতদিন ধরে অনেকের “লাইক” পেয়ে এসেছে এই ‘বাঁশের কেল্লা’গুলো। এটা তো শুধু ফেসবুকের কথা হলো। এর বাইরেও গ্রামে-বন্দরে, হাটে-বাজারে-শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে-সর্বত্রই নানাবিধ প্রচারণা চালিয়ে এসেছে, সরকার বা আওয়ামী লিগের বিরুদ্ধে। এবং সেগুলো এখনকার মতো মিথ্যা প্রচারণা দিয়েও করতে হয়নি। সরকার, তাদের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ যেভাবে গত চার বছর ধরে নানাবিধ দুর্নীতি-স্বেচ্ছাচারীতা চালিয়ে গেছে, তাতে তাদের উপরে মানুষের আস্থা প্রায় তলানিতে নেমে এসেছিল। সেগুলোর প্রভাব তো হুট করে চলে যাবে না। জামায়াত-শিবির মানুষের ভেতরে এতদিন ধরে যে প্রচারণা চালিয়েছে এবং তারা যে দীর্ঘদিন ধরে মানুষের সমর্থন আদায় করার কাজটা করে গেছে, জনসমাজে সেটার প্রভাব এক-দুইটা মহাসমাবেশ করে উড়িয়ে দেওয়া কি সম্ভব?

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করার সুবাদে খুব কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্য হয়েছে যে, শিবির কিভাবে পরিচালিত হয়, কিভাবে তারা সাধারণ শিক্ষার্থীদের আস্থা অর্জন করে। কিভাবে তারা একজন ছাত্রকে সংগঠনটির উপর নির্ভরশীল করে ফেলে। শিবিরের স্বর্ণযুগে, ভর্তিপরীক্ষার আগ দিয়ে প্রতিটা হলে ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীদের থাকার ব্যবস্থা করত ছাত্রশিবির। সেখানে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে অতি ভালো ব্যবহার করা হতো। এরপর যারা যারা ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়, তাদেরকে সেই সুখবরটা জানানোর কাজটিও করতেন ছাত্রশিবিরের নেতা-কর্মীরা। একজন গরীব বা অস্বচ্ছল শিক্ষার্থীর হলে থাকার ব্যবস্থা, প্রয়োজনে খাবার খরচটিও বহন করে সংগঠনটি। অনেক মেধাবী শিক্ষার্থীর সঙ্গে গড়ে তোলে পারিবারিক সম্পর্ক। তাদের পড়াশোনার ক্ষেত্রে সার্বক্ষণিক সহযোগিতাও করে শিবিরের নেতারা। এবং কখনোই তাদেরকে মিছিল-মিটিং-মারামারির ভেতরে ঢোকানো হয় না। ফলে এই রকম অনেক শিক্ষার্থী কৃতজ্ঞতাবশই শিবিরের প্রতি সমর্থন জানান। ক্যাডারদের জন্যও থাকে আলাদা ব্যবস্থা। সেটার ব্যবস্থাপনার পদ্ধতি অন্য ধরণের। এভাবে খুবই সুশৃঙ্খলভাবে পরিচালিত হয় ছাত্রশিবির। ভালো ফলাফল করে পাস করা শিক্ষার্থীদের চাকরির ব্যবস্থাও অনেকাংশে করে দেওয়া হয় ছাত্রশিবিরের পক্ষ থেকে। এভাবেই তারা ছড়িয়ে পড়ে পেশাগত জায়গায়। প্রভাব বিস্তার করে সমাজের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলোতে। দীর্ঘদিনের সুসংগঠিত কর্মতত্পরতা আর প্রচারণার মাধ্যমে জনমানসে শক্ত খুঁটি গেড়েছে জামায়াত-শিবির।

এবং তাদেরকে সাংস্কৃতিকভাবে মোকাবিলা করার মতো কার্যকর তত্পরতা কিন্তু এতদিন ধরে প্রগতিশীলদের দিক থেকে তেমনভাবে ছিল না। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সহিংস-বল প্রয়োগের মাধ্যমে ছাত্রশিবিরকে ক্যাম্পাস থেকে উত্খাত করা গিয়েছে বলে দাবি করা হয়। কিন্তু সফলতা কতখানি আর এই সহিংস বলপ্রয়োগের পথ বেছে নেওয়ার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কি হয় সেটা এখনকার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে তাকালেই সবাই দেখতে পারবেন। বিগত চার বছরে ছাত্রশিবিরকে রুখার নামে ছাত্রলীগকে দেওয়া হয়েছিল অবাধ স্বাধীনতা। আব্দুস সোবহান প্রশাসনের শেষসময়ে সেই ছাত্রলীগই ফ্রাঙ্কেনস্টাইন হয়ে চড়াও হয়েছে প্রশাসনের উপর। নিয়োগ বাণিজ্যে অসন্তুষ্ট হয়ে প্রশাসন ভবনে ভাঙচুর করেছে সরকারদলীয় ছাত্রসংগঠনের কিছু নেতা-কর্মী। আর উপাচার্য,-উপ-উপাচার্যবিহীন অবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে পড়েছে অভিভাবকহীন। পরিহাসের কথাটি হচ্ছে, এই অভিভাবকত্বহীনতার সুযোগ নিয়ে নাকি এখন ছাত্রশিবির ক্যাম্পাসে গোলযোগ তৈরি করতে পারে। শেষ শিক্ষক সমিতির নির্বাচনে সভাপতির পদটিও হারিয়েছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসীরা। তাহলে কী প্রতিরোধ করলেন উনারা এতদিন? আমার ধারণা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বিগত ৪টি বছর থেকে শিক্ষা নিতে পারে এখনকার শাহবাগ আন্দোলন। দুই ক্ষেত্রেই ইস্যুটা একই। জামায়াত-শিবির প্রতিরোধ। গত চার বছর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার পূর্ণ স্বাধীনতা পেয়েও শিবির উত্খাত করতে পারেনি ছাত্রলীগ ও প্রশাসন। তাদের তো পূর্ণ ইচ্ছা ছিল বিশ্ববিদ্যালয়কে শিবির মুক্ত করা। কেন পারলো না? তাহলে কী পদ্ধতিতে কোন ভুল ছিল? আমার ধারণা এই দিকটি ভাবার দাবি রাখে।

শত্রুপক্ষের প্রচারণা নিয়ে শুধু হাসাহাসি করলেই তো সমস্যার সমাধান হবে না, সেগুলো মোকাবিলার জন্য কার্যকর কি পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে, সেই কথাটা ভাবতে হবে। আর এখন যেভাবে র্যাব-পুলিশ দিয়ে সহিংসভাবে জামায়াত-শিবির রুখার বা জনসাধারণকে নিরাপত্তা দেওয়ার ব্যবস্থা করা হচ্ছে, সেটা কোন সমাধান না। ব্লগার রাজীব খুন হওয়ার পর যেমন আমরা শ্লোগান দেই যে, ‘এক রাজীব লোকান্তরে, লক্ষ্য রাজীব ঘরে ঘরে’। তেমনি তারাও ‘শহীদ’দের লাশ দেখিয়ে জেহাদে ঝাঁপিয়ে পড়তে অনুপ্রাণিত করে অন্য দশজন তরুণকে। পিঠ একদম দেওয়ালে ঠেকে যাওয়ার পর, আর কোন উপায়ান্তর না দেখলে হয়তো এই তরুণদের মধ্যেই কেউ কেউ হয়ে উঠতে পারে আত্মঘাতি বোমাবাহক। তেমন পরিস্থিতি কি তাহলে আরও খারাপ হবে না?

Somabesh

গতকাল ছিল ঐতিহাসিক ৭ই মার্চ। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ক্ষুদে যোদ্ধা অপূর্ব’র বেশে সত্যিই যেন ফিরে এসেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁর ৭ই মার্চের ভাষণটি হুবহু অনুকরণ করে অজস্র মানুষকে আবারও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অনুপ্রাণিত করেছেন অপূর্ব। আবারও মুষ্ঠিবদ্ধ হাতের ঐক্যবদ্ধতায় উচ্চারিত হয়েছে মুক্তির সংগ্রাম করার অঙ্গীকার। সত্যিই আজ আমরা আবার রাজাকার-যুদ্ধাপরাধীমুক্ত স্বাধীন ‘সোনার বাংলা’ গড়ার দৃঢ় শপথ নিয়েছি। কিন্তু প্রতিপক্ষকে মোকাবিলা করব কিভাবে, কোন পদ্ধতিতে, সেটাও আমাদের ভাবতে হবে। জামায়াত-শিবিরের গোড়া কোন পর্যন্ত বিস্তৃত, এবং এটা কেন বিস্তৃত হতে পেরেছে সেটাই আমাদের সবার আগে ভাবা উচিত্। গ্রাম-গঞ্জের, জেলা-উপজেলার সাধারণ মানুষের কাছে গণজাগরণের বার্তা সত্যিই পৌঁছে দিতে চাইলে আপামর জনসাধারণের মনে জমে থাকা অনেক অনেক প্রশ্ন, সন্দেহ-সংশয়ের সঠিক জবাব দিতে পারতে হবে শাহবাগ আন্দোলনের সংগঠকদের। শুধু জবাব না, অনেক অনেক প্রশ্নের কথাই আগে ভাবতে হবে।