Posts Tagged ‘ আইসিসি ’

ক্রিকেট বিশ্বের বর্তমান সংকটঃ থার্ড আম্পায়ারের ভূমিকা নিবে কে?

আদনান শাহরিয়ার তপু

১৯৯৩ সাল । তখন দাবা বলতে মানুষ কাসপরভকেই বুঝতো । ফিদে’র (দাবার বিশ্বসংস্থা) আয় রোজগারও বেশিরভাগ আসতো কাসপরভের অংশ নেওয়া টুর্নামেন্ট থেকেই । আর তার ব্যক্তিগত স্পন্সরেরও অভাব ছিলো না । বোধহয় সে কারনেই হঠকারী এক সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন তিনি । সেবারের বিশ্বদাবা চ্যাম্পিয়নশিপে কাসপরভের মুখোমুখি হওয়ার কথা ববি ফিশারের । ফিদে তাদের নিয়মনীতির ব্যাতয় ঘটিয়ে তড়িঘড়ি চ্যাম্পিয়নশিপ আয়োজন করলো ম্যানচেস্টারে । অপ্রস্তুত ববি ফিশার যোগাযোগ করলেন কাসপরভের সাথে । অর্থকড়ি নিয়ে বনিবনা না হওয়ায় আগে থেকেই ফিদের উপরে ক্ষিপ্ত কাসপরভ ঘোষণা দিলেন ফিদে থেকে বেরিয়ে যাওয়ার । নিজের তৈরি পিসিএ’র অধীনে ববি ফিশারের সঙ্গে আয়োজন করলেন বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ । ফিদেও কেড়ে নিলো তাদের সদস্যপদ, রেটিং পয়েন্ট ।

cricket

ডালমিয়া আইসিসির প্রধান হন ১৯৯৭ সালে । মূলত তার প্রচেষ্টাতেই বাংলাদেশ টেস্ট স্ট্যাটাস পায় সত্যি কিন্তু এর পেছনে তার ক্রিকেট বিশ্বায়ন নামের সুন্দর চেতনার আড়ালে যে অর্থকড়ির সংস্থানের ধুরন্ধর মস্তিস্কটি ছিলো তা চিরতরে বদলে দিলো ক্রিকেটকে । স্পন্সরশিপ, বাজার অর্থনীতি দিয়ে ভারত হয়ে গেলো সবচেয়ে ধনী ক্রিকেট বোর্ড আর বদলে যেতে শুরু করলো ক্ষমতার সমীকরণ । ক্রিকেটে ব্যবসা যেমন এনে দিয়েছে পেশাদারিত্ব তেমনি কেড়ে নিয়েছে নীতিবোধ । খুব স্বাভাবিকভাবেই অর্থের ছড়াছড়ি প্যান্ডরার বাক্স ভেঙ্গে বের করে এনেছে লোভ । আর সেই লোভকে পুজি করে জুয়াড়িরা পকেটে ভরছে বিশ্বাসযোগ্যতা আর বিসিসিআই চাইছে এককেন্দ্রিক ক্ষমতা । আইপিএলে যত হাজার কোটি টাকার জুয়ায় লেনদেন হয় সেটা জানার পর এটাতে আর কোনও সন্দেহই থাকেনা যে, বিসিসিআই আইসসিসির পুরো ক্ষমতা পেলে ক্রিকেট খেলাটা আসলে নিয়ন্ত্রিত হবে জুয়াড়িদের লাভক্ষতির হিসেব নিকেশে ।

Cartoon-741738


ক্ষমতার নেশায় বিসিসিআই এখন আলাদা হয়ে যাওয়ার হুমকি দিতেও পিছু হটছে না । কিন্তু তারা ভুলে যাচ্ছে তারা ক্রিকেট খেলাটার উর্ধে না । ক্রিকেটের জন্য বিসিসিআই , বিসিআই এর জন্য ক্রিকেট না । আজ তারা স্পন্সরদের ঘাড়ে পা রেখে ভয় দেখাচ্ছে, কিন্তু আলাদা হয়ে যাওয়ার পর যখন শুধু তিন দেশের মধ্যে তাদের খেলা সীমাবদ্ধ হয়ে যাবে তখন স্পন্সরাও কি সেটা ভালো ভাবে নেবে?? কে দেখতে চাইবে ঘুরে ফিরে তিন দেশের খেলা ?? কাসপরভ ফিদে থেকে আলাদা হয়ে দুই বছর কোনোওক্রমে পিসিএ চালানোর পর আবার ফিদের সাথে যুক্ত হওয়ার চেষ্টা করেন এবং পরে তিনি স্বীকার করেন, ফিদেকে ছেড়ে যাওয়া তার ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বড় ভুল ছিলো ! কারণ, ওই নির্দিষ্ট কয়েকজন প্রতিযোগীর সাথে ঘুরে ফিরে কাসপরভের খেলা কারোরই বেশিদিন আগ্রহের কেন্দ্রে থাকেনি।

আমরা মানতে যতই ঘৃণা করিনা কেনও সত্যি কথাটা হলো, ক্রিকেট অর্থনীতি ভারতের বাজারের উপর অনেক অংশেই নির্ভর । সেই বাজার হারিয়ে ফেললে, ক্রিকেটারদের আর্থিক সচ্ছলতা কমবে তবে এই চরম স্বার্থপরতার যুগে ক্রিকেটের মূল চেতনা ফিরে আসবে বলে যারা আশা করছেন তা নিতান্তই দুরাশা । বরং দুই দিকে দুইরকম আর্থিক পরিস্থিতি এক চরম বিশৃঙ্খল অর্থনৈতিক অসাম্যের জন্ম দিবে । একসময় এটিই এই খেলা থেকে দর্শক, স্পন্সর সবাইকে মুখ ফিরিয়ে নিতে বাধ্য করবে । মৃত্যু হবে খেলাটির । যেমন, কাসপরভ চলে যাওয়ার পর ফিদের উপর অসন্তুষ্ট স্পন্সরদের কারনে, ফিদের আবার নতুন করে গুছিয়ে উঠতে দীর্ঘ সময় লেগেছিলো ।


সব মিলিয়ে ক্রিকেট এখন এক কঠিন সঙ্কটে । ভারতের অসম্ভব প্রস্তাব মেনে নেওয়া যায়না , একদিন না একদিন এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ উঠতই । আবার ভারত, অস্ট্রেলিয়া এবং ইংল্যান্ড আলাদা হয়ে গেলে অন্যান্য ক্রিকেটাররা আর সেসব জায়গায় খেলতে পারবে না এটা মেনে নেওয়াও কঠিন , কারণ কে জানে একজন ক্রিকেটারের ক্রিকেট সামর্থ্যের বড় পরীক্ষাটাই হয় অস্ট্রেলিয়া আর ইংল্যান্ডে ।

যদিও আমার আবেগে টইটুম্বুর মন, বারবার বলছে, যাক বিসিসিআই জাহান্নামে ! তারপর একটা শিক্ষা হোক তাদের । কিন্তু সমস্যা হলো, তাতে ক্রিকেটেরই ক্ষতি। তাই প্রার্থনা, বর্তমানে যেমন আছে তেমনই থাক ক্রিকেট । ক্রিকেটের বড় ভাইরা বুঝুক, গৃহবিবাদে কারও লাভ হয়না । কেউ তাদের বোঝাক, জমিদারী প্রথা কিংবা দুই মেরুর ক্রিকেট বিশ্ব দুটোই চরম ক্ষতিকর ক্রিকেট খেলাটির জন্য ।

কিন্তু প্রশ্ন একটাই, এই সঙ্কটে থার্ড আম্পায়ারের ভূমিকা নিবে কে ??

বিশ্বকাপের ‘অন্ধকার’ ফাইনাল

এরকম অন্ধকারের মধ্যেই খেলা হয়েছিল ২০০৭ বিশ্বকাপের শেষ তিন ওভার

‘একটা সামান্য বৈদ্যুতিক বাতি বদলাতেও আইসিসির অন্তত পাঁচজন কর্মকর্তার একটা কমিটি লাগে। কমিটি কাজ শুরু করার পর নানাবিধ আলাপ-আলোচনা, মতবিনিময় শুরু করবে। প্রত্যেকেই নিজের ‘মহামুল্যবান’, ‘অভিজ্ঞ’ মতামত দিবে। কিন্তু কেউই বাতি বদলানোর নির্দেশিকাটা পড়ে দেখবে না। এবং মজার ব্যাপার হলো শেষপর্যন্ত সামান্য ঐ বাতিটা বদলাতে গিয়ে তারা শর্ট সার্কিট করে পুরো বাড়িতেই অন্ধকার নামিয়ে আনবে।’ আইসিসি কর্মকর্তাদের কাণ্ডজ্ঞান নিয়ে এই রসিকতাটা করেছিলেন ক্রিকইনফোর সম্পাদক অ্যান্ড্রু মিলার। রসিকতাটা শুনতে যতোই হালকা লাগুক, ২০০৭ বিশ্বকাপের ফাইনাল ম্যাচটায় সত্যিই আইসিসি কর্মকর্তাদের এধরণের আচরণের পরিচয় পেয়েছিল সবাই। সত্যি সত্যিই ক্রিকেট বিশ্ব স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল আয়োজকদের চরম অব্যবস্থাপনায়। বিশ্বকাপ ফাইনালের মতো একটা ম্যাচে সেদিন আক্ষরিক অর্থেই অন্ধকার নামিয়ে এনেছিলেন আইসিসি কর্মকর্তারা।

২৮ এপ্রিল। বারবাডোসের কেনসিংটন স্টেডিয়াম সকাল থেকেই ছিল মেঘাচ্ছন্ন। দুই অধিনায়ক টস করতে মাঠে নামার আগেই কয়েক দফায় হানা দিয়েছে বৃষ্টি। টসটা কোনমতে করে ফেলা গেলেও আবার শুরু হয় বৃষ্টির উত্পাত। বারবার করে পেছানো হতে থাকলো খেলা শুরুর সময়। শেষপর্যন্ত খেলার দৈর্ঘ্য কমিয়ে ফেলা হয় ১২ ওভার। তাছাড়া কিছুক্ষণ পর যে আবার বৃষ্টি শুরু হতে পারে এ ব্যাপারে অনেকটা নিশ্চিতই ছিলেন আবহাওয়াবিদরা। এত এত বিপত্তি সত্তেও বিশ্বকাপ ফাইনালের মতো একটা ম্যাচ এভাবে বৃষ্টির হাতে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে কেন এ নিয়ে সেসময়ই প্রশ্ন তুলেছিলেন অনেকে।

যাই হোক, শেষপর্যন্ত বিশ্বকাপ ইতিহাসের সবচেয়ে সংক্ষিপ্ত ওভারের (৩৮) ফাইনালটা খেলতে মাঠে নামলেন শ্রীলঙ্কা-অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেটাররা। টসে জিতে ব্যাট করতে নেমে শুরু থেকেই আক্রমণাত্মক ব্যাটিং করতে থাকলেন দুই অসি ওপেনার অ্যাডাম গিলক্রিস্ট আর ম্যাথু হেইডেন। গিলক্রিস্ট খেললেন তাঁর ক্যারিয়ারের অন্যতম সেরা ইনিংসটি। ১৩টি চার আর ৮টি ছয়ে সাজানো ১৪৯ রানের ইনিংসটি তিনি খেলেছিলেন মাত্র ১০৪ বলে। গিলক্রিস্টের এই ঝড়ো ইনিংসটির উপর ভর করে নির্ধারিত ৩৮ ওভারে ২৮১ রানের বড় সংগ্রহ গড়ে অস্ট্রেলিয়া।

২৮২ রানের টার্গেট নিয়ে ব্যাট করতে নেমে শুরুতেই বিপদে পড়ে শ্রীলঙ্কা। তৃতীয় ওভারেই ব্রাকেনের শিকারে পরিণত হয়ে ফিরে যান উপল থারাঙ্গা। কিন্তু দ্বিতীয় উইকেটে ১১৬ রানের জুটি গড়ে সেই ধাক্কা সামলে ভালো অবস্থান তৈরি করেন জয়সুরিয়া আর সাঙ্গাকারা। কিন্তু শেষপর্যন্ত শ্রীলঙ্কা ২৮২ রান পর্যন্ত পৌঁছাতে পারবে কিনা এই হিসাব করা বাদ দিলেন ধারাভাষ্যকাররা। সবাই হিসাব করতে লাগলেন এই মুহূর্তেই খেলা বন্ধ হয়ে গেলে জেতার জন্য শ্রীলঙ্কার স্কোর কত থাকা উচিত্। কারণ সেদিন কেনসিংটনের আকাশে সবসময়ই ছিল মেঘের আনাগোনা। সর্বোপরি ভারী বৃষ্টিপাতের আশঙ্কা। সেই আশঙ্কাটাই সত্যি হয়ে দেখা দিল শ্রীলঙ্কান ইনিংসের ২৫তম ওভারে। লঙ্কানদের সংগ্রহ তখন ৩ উইকেটে ১৪৯ রান। বৃষ্টির মধ্যেই দুই/তিন বল খেলা চলার পর আবার মাঠ ছাড়লেন সবাই। বেশ কিছু সময় বন্ধ থাকার পর আবার খেলা গড়ালো মাঠে। ততক্ষণে দর্শকদের দুয়োধ্বনিতে প্রকম্পিত হতে শুরু করেছে কেনসিংটন স্টেডিয়াম। কেউই কোন ধারণা করতে পারছিলেন না যে শেষপর্যন্ত কী হতে যাচ্ছে ম্যাচের পরিণতি। খেলা কি এখানেই শেষ করে দেওয়া হবে নাকি ওভার কমিয়ে নতুন টার্গেট নির্ধারণ করা হবে। অনেক ধরণের বিভ্রান্তি ছড়ানোর পর অবশেষে নতুন টার্গেট নির্ধারিত হলো ৩৬ ওভারে ২৬৯ রান। আবারও ‘অসম্ভবের’ পিছে ছুটতে লাগলেন লঙ্কান ব্যাটসম্যানরা। মূল বিপত্তিটা বাধল ৩৩তম ওভার শেষে। এমন অন্ধকার ঘনিয়ে আসল যে, ঠিকমতো বল দেখতে পাওয়াও কঠিন হয়ে গেল। সাধারণত এমন পরিবেশকে আমরা রাত বলেই চিহ্নিত করি। খেলা চালানো হবে নাকি এখানেই বন্ধ করে দিয়ে আগামীকাল রিজার্ভ ডেতে নতুন করে শুরু হবে, এ নিয়ে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগতে লাগলেন আম্পায়াররা। লজ্জিত-বিব্রত স্টিভ বাকনার সব সিদ্ধান্ত ছেড়ে দিলেন আলিম ডারের উপর। ওদিকে ডার্কওয়ার্থ-লুইস পদ্ধতিতে জয় নিশ্চিত জেনে টানা তৃতীয় বিশ্বকাপ জয়ের আনন্দ উদযাপনও শুরু করে দিয়েছেন রিকি পন্টিংরা। বেশ কিছুক্ষণ পর আবারও বাকি তিন ওভার খেলা চালানোর সিদ্ধান্ত নিলেন ম্যাচ রেফারি ও আইসিসি কর্তৃপক্ষ। আলো-আঁঁধারির এক বিভীষিকাময় পরিস্থিতিতে আন্দাজের উপর ব্যাট করতে লাগলেন লঙ্কান ব্যাটসম্যানরা। আয়োজকরা যে কোন উপায়ে আজকেই খেলার ফল নির্ধারণ করবে, এটা জানার পর কোনমতে শেষ তিন ওভার ব্যাট করে আনুষ্ঠানিকতা রক্ষা করতে হল শ্রীলঙ্কাকে। অস্ট্রেলিয়া পেল ডাকওয়ার্থ-লুইস পদ্ধতিতে ৪৩ রানের জয়। পন্টিং বাহিনী নিল টানা তৃতীয় বিশ্বকাপ জয়ের স্বাদ।

২০০৭ বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়ার শিরোপা জয়ের সামর্থ্য নিয়ে কোন প্রশ্নই থাকতে পারে না। নিঃসন্দেহে তারা ছিল সেবারের প্রধান ফেভারিট এবং শিরোপার যোগ্য দাবিদার। কিন্তু বিশ্বকাপের ফাইনাল ম্যাচটা যেভাবে শেষ হলো, এটা বোধহয় কারোরই কাঙ্খিত ছিল না। আইসিসিও পরবর্তীতে তাদের এই লজ্জাজনক অধ্যায়টার কথা স্বীকার করে নিয়েছিল। নিষিদ্ধ করেছিল সেদিনের ম্যাচ পরিচালনাকারী পাঁচ কর্মকর্তাকে। এই তালিকায় ছিলেন মাঠের দুই আম্পায়ার আলিম ডার ও স্টিভ বাকনার, রিজার্ভ আম্পায়ার রুডি কোয়ার্টজেন ও বিলি বাউডেন। এবং অবশ্যই ম্যাচ রেফারি জেফ ক্রো।

ফ্লাওয়ার-ওলোঙ্গার অভিনব প্রতিবাদ

ক্রীড়াঙ্গনকে রাজনীতির আওতার বাইরে রাখার আকাঙ্ক্ষাটা বোধহয় সবাই কমবেশি লালন করেন। আর বিশ্বকাপের মতো আসরে তো এই চাওয়ার পরিমাণটা অনেক বেশিই থাকে। কিন্তু এই বিশ্বকাপের আসরেই ইতিবাচক রাজনৈতিক তত্পরতা চালিয়ে একটা অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত তৈরি করেছিলেন অ্যান্ডি ফ্লাওয়ার ও হেনরি ওলোঙ্গা।

সময়টা ২০০৩ সাল। জিম্বাবুয়েতে তখন চলছে মুগাবের একদলীয় শাসন। মানবাধিকার হরণ, সামাজিক নিরাপত্তা ইত্যাদি ইস্যুতে চলছিল নিরন্তর বিতর্ক। একঘরে হয়ে যেতে বসেছিল জিম্বাবুয়ের ক্রিকেট অঙ্গনও। বিশ্বকাপ শুরুর ঠিক একমাস আগে ইংল্যান্ড বাতিল করেছিল তাদের জিম্বাবুয়ে সফর। ইংল্যান্ড এই সফর বাতিলের পেছনে নিরাপত্তার অজুহাত দেখালেও নীতিগত বিষয়ে জিম্বাবুয়ের স্বৈরশাসনের সঙ্গে একমত হতে না পারাই ছিল এর অন্যতম প্রধান কারণ। বিশ্বকাপ শুরুর আগ দিয়েও জিম্বাবুয়ের শাসকগোষ্ঠী কিছুটা ভয়ে ছিল যে, বিশ্বকাপে জিম্বাবুয়ের ম্যাচগুলোতে হয়তো গ্যালারি থেকে এই স্বৈরশাসনের প্রতিবাদ জানানো হতে পারে। এমন ভয়ের কিছুটা যৌক্তিক কারণও ছিল। কারণ এক বছর আগে বুলাওয়েতে একটা ম্যাচে এরকম প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে নিহত হয়েছিলেন এক বিক্ষোভকারী। যাই হোক, শেষপর্যন্ত সবাই ক্রিকেটের দিকেই বেশি মনোযোগ দেওয়ায় কিছুটা হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিলেন জিম্বাবুয়ের শাসকরা।

কিন্তু জিম্বাবুয়ের শাসকগোষ্ঠীকে খুব বেশি সময় স্বস্তিতে থাকতে দেন নি অ্যান্ডি ফ্লাওয়ার ও হেনরি ওলোঙ্গা। নামিবিয়ার বিপক্ষে জিম্বাবুয়ের প্রথম ম্যাচের আগে তাঁরা সাংবাদিকদের কাছে একটা লিখিত বিবৃতিতে জানালেন যে, ‘জিম্বাবুয়েতে গণতন্ত্র-হরণের শোকে’ তাঁরা হাতে কালো বাহুবন্ধনী বেঁধে মাঠে নামবেন। ফ্লাওয়ার ও ওলোঙ্গা বেশ ভালোমতোই জানতেন যে, এই প্রতিবাদ করার সাহস দেখানোর জন্য তাঁদের ক্রিকেট ক্যারিয়ারের অবসান ঘটতে পারে। এমনকি তাদেরকে দেশ থেকেও বের করে দেওয়া হতে পারে। কিন্তু তারপরও তাঁরা তাদের এই অভিনব প্রতিবাদের মাধ্যমে জিম্বাবুয়ের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে একটা বিশ্ব জনমত গড়ে তোলার সুযোগ হাতছাড়া করতে চান নি। সেই সঙ্গে অন্য কেউ যেন বিপদে না পড়ে, সেজন্য তারা খুব ভালোমতোই জানিয়ে দিয়েছিলেন যে, এই কালো বাহুবন্ধনী ধারণের সিদ্ধান্তটা তাঁদের একান্তই ব্যক্তিগত ব্যাপার। এমনকি তাঁরা যে এই কাজটা করতে যাচ্ছেন সেটা সতীর্থদেরও অনেকে জানতেন না।

খেলার শুরুতে সাংবাদিকদেরকে এই প্রতিবাদ সম্পর্কে জানানো হলেও খেলার ২২ তম ওভার পর্যন্ত আর কারোরই এ ব্যাপারে কোন ধারণাই ছিল না। ২৩তম ওভারে ব্যাট হাতে মাঠে নামলেন অ্যান্ডি ফ্লাওয়ার। দেখা গেল সত্যিই তিনি মাঠে নেমেছেন কালো একটা বাহুবন্ধনী বেঁধে। এরপর ক্যামেরার চোখ খুঁজে নিল ওলোঙ্গাকেও। হারারে স্টেডিয়ামের ব্যালকনিতে দাঁড়ানো ওলোঙ্গার হাতেও দেখা গেল একই ধরণের জিনিস। তাদের হাতের ঐ কালো ব্যান্ডগুলো সেদিন জ্বল জ্বল করে জানিয়ে দিয়েছিল জিম্বাবুয়েতে গণতন্ত্র হরণের করুণ কাহিনী।

পরবর্তী ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া বোধহয় কিছুটা আঁঁচ করতে পারছেন সবাই। যথারীতি জিম্বাবুয়ের শাসকগোষ্ঠী মরীয়া হয়ে ওঠে ভিন্নমত প্রকাশের এই অভিনব উপায়টা বন্ধ করার জন্য। তাঁরা আইসিসির কাছে দাবি জানায় ফ্লাওয়ার ও ওলোঙ্গার এই কর্মকাণ্ড অবৈধ ঘোষণা করার জন্য। আইসিসি তাদের এই ডাকে পুরোপুরি সাড়া দেয় নি। তারা শুধু প্রতিবাদী দুই ক্রিকেটারের কাছে অনুরোধ করেছিল যেন পরবর্তীতে তারা আর এ ধরণের কিছু না করে। বাকিটা তারা ছেড়ে দিয়েছিল জিম্বাবুয়ের ক্রিকেট বোর্ডের কাছে। কিন্তু আইসিসির অনুরোধে কান দেন নি ফ্লাওয়ার-ওলোঙ্গা। তারা পরবর্তীতেও কালো বাহুবন্ধনী বেঁধেই মাঠে নামার সিদ্ধান্তে অটল ছিলেন। হেনরি ওলোঙ্গা খুব পরিস্কারভাবেই জানিয়েছিলেন, ‘তারা যদি আমাকে দল থেকে বের করে দিতে চায় তো দিতে পারে। আমার কিছু যায় আসে না।’ স্বৈরতন্ত্রের চরিত্র সম্পর্কে তাঁর অনুমানটা সঠিকই ছিল। পরবর্তী ম্যাচ থেকেই বহিস্কার করা হয় ওলোঙ্গাকে। অ্যান্ডি ফ্লাওয়ারকেও বহিস্কার করার কথা উঠতেই বেঁকে বসেন দলের বাকি খেলোয়াড়রা। সবার খেলা বর্জনের হুমকির মুখে শেষপর্যন্ত দলে রাখতেই হয় ফ্লাওয়ারকে।

যে উদ্দেশ্যে এতখানি ঝুঁকি নিয়ে ফ্লাওয়ার আর ওলোঙ্গা এই প্রতিবাদ করার স্পর্ধা দেখিয়েছিলেন, তা কিন্তু অনেকখানিই সফল হয়েছিল। তাঁরা তাদের এই একান্ত ব্যক্তিগত এই উদ্যোগটা ছড়িয়ে পড়েছিল দর্শকদের মাঝেও। জিম্বাবুয়ের পরবর্তী ম্যাচগুলোতে এই কালো বাহুবন্ধনী পড়ে আসতে দেখা গিয়েছিল অনেক দর্শককেই।