Posts Tagged ‘ অ্যালান ডোনাল্ড ’

শফিউলের স্বপ্নযাত্রা

মাত্র দুই বছর আগেও হয়তো বাংলাদেশ জাতীয় দলে সুযোগ পাওয়াটা একটা স্বপ্নই ছিল শফিউল ইসলামের কাছে। ছোটবেলা থেকেই বাংলাদেশের জার্সি পরে পাড়ায় পাড়ায় ক্রিকেট খেলতেন আর স্বপ্ন দেখতেন, একদিন হয়তো সত্যিকারের জাতীয় দলের জার্সিটাই গায়ে উঠবে। সেই স্বপ্নটা আজ বাস্তব। এতটাই জলজ্যান্ত বাস্তব যে পুরো বাংলাদেশই শামিল হয়েছে তাঁর এ স্বপ্নযাত্রায়। ঘরের মাঠের বিশ্বকাপে দুর্দান্ত পারফরমেন্স দেখিয়ে তিনি বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষের চোখেই পুরে দিয়েছেন রাশি রাশি স্বপ্ন।

বিশ্বকাপের শুরুটা অবশ্য খুব একটা ভালো হয়নি শফিউলের। ভারতের বিপক্ষে প্রথম ম্যাচটায় খুব বেশি কিছু আসলে করারও ছিল না তাঁর। শেবাগ, টেন্ডুলকার, বিরাট কোহলিদের দুর্দমনীয় ব্যাটিংয়ের সামনে দাঁড়াতেই পারেননি বাংলাদেশের এ তরুণ পেসার। শেবাগের ক্যারিয়ার-সেরা ইনিংসের দিনে অসহায় হয়েই থাকতে হয়েছিল তাঁকে। ৭ ওভার বল করে দিয়েছিলেন ৬৯ রান। ভারতীয় ইনিংসের শেষ বলে সান্ত্বনা হিসেবে পেয়েছিলেন ইউসুফ পাঠানের উইকেটটা। কিন্তু দ্বিতীয় ম্যাচে আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে চমত্কারভাবে ঘুরে দাঁড়ালেন শফিউল। আগে ব্যাট করে ২০৫ রানেই গুটিয়ে যাওয়ার পর বাংলাদেশ যখন হারের শঙ্কায় দুলছে, সেই মুহূর্তেই জ্বলে উঠলেন তিনি। শেষ পাঁচ ওভারে মাত্র ১১ রান দিয়ে তুলে নিলেন চারটি উইকেট। বাংলাদেশকে এনে দিলেন ২৭ রানের অসাধারণ এক জয়। পুরো দেশকে মাতালেন বিশ্বকাপ উন্মাদনায়।

ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে পরের ম্যাচটা নিয়ে বলার কিছুই নেই। পুরোটাই একটা দুঃস্বপ্ন হয়েই থেকে গেছে বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষের কাছে। সেই ম্যাচে তিনি বলও করেছিলেন মাত্র দুই ওভার।

চট্টগ্রামে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে আবারও চলা শুরু করল শফিউলের স্বপ্নরথ। এবার তিনি নিজেকে চেনালেন নতুন করে। ইংল্যান্ডের ছুড়ে দেওয়া ২২৬ রান তাড়া করতে নেমে ১৬৯ রানেই ৮ উইকেট হারিয়ে বাংলাদেশ তখন দিশেহারা। অনেকেই বেরিয়ে গিয়েছিলেন স্টেডিয়াম থেকে। হার নিশ্চিত ধরে নিয়েছিলেন প্রায় সবাই। কিন্তু এবার ঝলসে উঠল শফিউলের ব্যাট। নবম উইকেট জুটিতে মাহমুদউল্লাহ সঙ্গে ৫৮ রানের অবিচ্ছিন্ন জুটি গড়ে বাংলাদেশকে উপহার দিলেন এক মহাকাব্যিক জয়। খেললেন ২৪ বলে ২৪ রানের এক লড়াকু ইনিংস। ফিরিয়ে আনলেন গত বছর ব্রিস্টলে ইংল্যান্ড বধের স্মৃতি। জোরদার করলেন টাইগারদের কোয়ার্টার ফাইনালে যাওয়ার সম্ভাবনা।

আগের ম্যাচগুলোতেই নিজেকে অপরিহার্য হিসেবে প্রমাণ করার কাজটা ভালোভাবে করে ফেলেছিলেন শফিউল। কিন্তু তিনি থামলেন না এখানেই। গতকাল হল্যান্ডের বিপক্ষে দেখা গেল অন্য এক শফিউলকে। এতটাই পরিণত বোলিং করলেন যে কখনো কখনো মনে পড়ে গেল ম্যাকগ্রা-ডোনাল্ডদের নিখুঁত লাইন-লেংথের কথা। কোনো উইকেট না পেলেও হল্যান্ডকে মাত্র ১৬০ রানে বেঁধে ফেলার পেছনে তাঁর ১০টি ওভারের মূল্য কোনো অংশেই কম না। ৯.২ ওভার বল করে তিনি দিয়েছিলেন মাত্র ১৫ রান। ম্যাচ শেষে হল্যান্ড অধিনায়ক পিটার বোরেনকেও আলাদাভাবে স্বীকার করতে হয়েছে শফিউলের বোলিং নৈপুণ্যের কথা। বলেছেন, ‘শফিউল আজ খুবই চমত্কার বোলিং করেছে। কোনো খারাপ বল করেনি। আমরা রান বের করার অনেক চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছি। আমরা আসলে অসহায় হয়ে পড়েছিলাম। সে কোনো উইকেট পায়নি বটে, কিন্তু তার বেশ কয়েকটি উইকেটই প্রাপ্য ছিল।’

তবে শফিউলের এ দুর্দান্ত পারফরমেন্সের পর অনেকেরই আফসোস একটাই। সবগুলো ম্যাচে বাংলাদেশ তাঁর হাত ধরে জয় পেলেও কোনো ম্যাচেই ম্যাচ-সেরার পুরস্কারটা ওঠেনি এই পেসারের হাতে। শফিউল নিজে অবশ্য এতে কিছুই মনে করছেন না। গতকাল হল্যান্ডের বিপক্ষে ছয় উইকেটের জয়ের পর তিনি বলেছেন, ‘ঠিক আছে। এটা কোনো ব্যাপার না। সবচেয়ে বড় কথা হলো, আমরা জিততে পেরেছি। ম্যাচ-সেরার পুরস্কারটা তো শুধুই একটা অলংকার।’

শফিউলের এ স্বপ্নযাত্রা অব্যাহত থাকুক, এটা বোধহয় শফিউলের চেয়েও এখন বাংলাদেশের মানুষই আরও বেশি করে চায়। ওয়েবসাইট।

ট্র্যাজেডির সেমিফাইনাল

১৯৯৯ সালের বিশ্বকাপ সেমিফাইনালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে দক্ষিণ আফ্রিকার ট্রাজিক বিদায়টার কথা এখনো ভুলতে পারেন নি ক্রিকেটপ্রেমীরা। ম্যাচটা ড্র হয়ে গেলেও পয়েন্ট মারপ্যাঁচের ফাঁদে পড়ে বিদায় নিতে হয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকাকে। প্রোটিয়াসদের সেমিফাইনাল ট্রাজেডি কিন্তু সেটাই প্রথম না। এর আগে ১৯৯২ সালের বিশ্বকাপ সেমিফাইনালেও জঘন্য কিছু আইন-কানুনের জালে আটকে গিয়েছিল তাদের বিশ্বকাপ জয়ের স্বপ্ন।

১৯৯২ সালেই বিশ্বকাপে প্রথমবারের মতো অংশ নিয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকা। তার আগে বর্ণবাদ বিতর্কের ঘেরাটোপে আটকে বেশ কিছুদিন আন্তর্জাতিক ক্রিকেট অঙ্গনেরই বাইরে ছিল তারা। বিশ্বকাপে তাদের প্রথম ম্যাচে স্বাগতিক অস্ট্রেলিয়াকে ৯ উইকেটে হারিয়ে শুরুটাও করেছিল দুর্দান্তভাবে। তারপর একে একে ওয়েস্ট ইন্ডিজ, পাকিস্তান, জিম্বাবুয়ে, ভারতকে হারিয়ে উঠে এসেছিল সেমিফাইনালে। অধিনায়ক কেপলার ওয়েলস, অ্যালান ডোনাল্ড, হ্যানসি ক্রনিয়ে, জন্টি রোডসরা অসাধারণ পারফরমেন্স দেখিয়ে মুগ্ধ করে দিয়েছিলেন ক্রিকেট বিশ্বকে। পাকিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচটিতে জন্টি রোডস যেভাবে ইনজামামকে রান আউট করেছিলেন তা এখনো জ্বলজ্বল করছে বিশ্বকাপ ইতিহাসের পাতায়।

দক্ষিণ আফ্রিকার এই প্রথম বিশ্বকাপে অনেককিছুই দেখা গিয়েছিল প্রথমবারের মতো। যেমন, সেবারই প্রথম প্রচলন হয় রঙ্গিন পোশাকের। সেই সঙ্গে চালু করা হয় সাদা বল। সেবারই প্রথম খেলা শুরু হয়েছিল ফ্লাডলাইটের আলোয়। কিন্তু এসবকিছুকে ছাপিয়ে ১৯৯২ বিশ্বকাপের অন্যতম প্রধান আলোচিত বিষয়ে পরিণত হয়েছিল বৃষ্টি সংক্রান্ত নতুন আইন। ৯২ বিশ্বকাপের বৃষ্টি আইনের নিয়মটা ছিল যে, প্রথমে ফিল্ডিং করা দলের সবচেয়ে কম রান দেওয়া ওভারগুলির রানসংখ্যা কমিয়ে নেওয়া হবে। ধরা যাক বৃষ্টির কারণে ২ ওভার কেটে নেওয়া হলো। তখন হিসাব করা হবে যে, প্রথমে বোলিং করা দল কোন দুই ওভারে সবচেয়ে কম রান দিয়েছে। যত রান কম দিয়েছে তত রান বাদ দিয়ে নতুন টার্গেট নির্ধারণ করা হবে। সেবার বৃষ্টিই গড়ে দিয়েছিল বিশ্বকাপের অনেকগুলো ম্যাচের ভাগ্য। আর সেই বৃষ্টির জলেই যে ধুয়ে যাবে দুর্দান্ত ফর্মে থাকা দক্ষিণ আফ্রিকার বিশ্বকাপ স্বপ্ন- তা হয়তো কেউই ভাবতে পারে নি।

ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সেমিফাইনালটিতে বৃষ্টি বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল খেলা শুরুর আগেই। খেলার দৈর্ঘ্য কমিয়ে নিয়ে আসা হয়েছিল ৪৫ ওভারে। শুরু থেকেই ভাগ্যদেবী যেন একেবারে মুখ ফিরিয়ে রেখেছিলেন প্রোটিয়াসদের উপর থেকে। যে গ্রায়েম হিকের ৯০ বলে ৮৩ রানের ইনিংসটির সুবাদে ইংল্যান্ড স্কোরবোর্ডে ২৫২ রান যোগ হয়েছিল, সেই হিক দুই দুইবার ফিরে এসেছেন নিশ্চিত আউটের দ্বারপ্রান্ত থেকে। ম্যাচের প্রথম বলেই নিশ্চিত একটা এলবিডব্লিউর আবেদনে সাড়া দেন নি আম্পায়ার। দ্বিতীয়বার হিক ক্যাচ আউট হয়েছিলেন একটা নো বলে। তখনও রানের খাতাই খুলতে পারেন নি তিনি।

২৫৩ রানের টার্গেট নিয়ে ব্যাট করতে নেমে বেশ ভালোভাবেই এগিয়ে যাচ্ছিল প্রোটিয়াসরা। উদ্বোধনী ব্যাটসম্যান অ্যান্ড্রু হাডসনের ৪৬, আদ্রিয়ান কুইপারের ৩৬, হ্যানসি ক্রনিয়ের ২৪ রানের ছোট ছোট ইনিংসগুলির উপর ভর করে ধীরে ধীরে জয়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল তারা। শেষদিকে জন্টি রোডসের ৩৮ বলে ৪৩ রানের ইনিংসটি রান-বলের ব্যবধান কমিয়ে এনেছিল অনেকখানিই। শেষ পাঁচ ওভারে তাদের দরকার ছিল ৪৭ রান। সপ্তম উইকেটে ব্রায়ান ম্যাকমিলান ও ডেভ রিচার্ডসন মাত্র তিন ওভারে অবিচ্ছিন্ন ২৬ রানের জুটি গড়ে জয়টাকে অনেকটাই নাগালের মধ্যে নিয়ে এসেছিলেন। আর তারা যেভাবে খেলে যাচ্ছিলেন তাতে সেটা খুব বেশি কঠিনও মনে হচ্ছিল না। কিন্তু ৪৩তম ওভারের শেষ বলের আগে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম সেমিফাইনাল ট্রাজেডিটার জন্ম দিতেই আবার শুরু হলো বৃষ্টি। জয়ের জন্য তখন প্রয়োজন ছিল ১৩ বলে ২২ রান। সেদিনের সেই ১২ মিনিটের বৃষ্টি একটা ক্লাসিক ম্যাচকে পরিণত করেছিল বিশ্বকাপের অন্যতম বিতর্কিত একটা ম্যাচে। ম্যাকমিলান ও রিচার্ডসন চাচ্ছিলেন খেলা চালিয়ে যেতে। কিন্তু ইংলিশ অধিনায়ক গ্রাহাম গুচ কোনক্রমেই রাজি হলেন না। আম্পায়াররা শেষপর্যন্ত খেলা বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিলেন। এরপর তারা সেই অদ্ভুত নিয়মের খাতা খুলে হিসাব করতে বসলেন নতুন টার্গেট। প্রথমে আম্পায়াররা লক্ষ্য নির্ধারণ করলেন ৭ বলে ২২ রান। মেলবোর্নের উপস্থিত দর্শক ক্ষুব্ধ হয়ে উঠল এই নির্বুদ্ধিতায়। কিন্তু পরিস্থিতি আরো নির্মম হয়ে উঠল যখন কর্মকর্তারা খেলা দুই ওভার কমিয়ে নতুন লক্ষ্য নির্ধারণ করলেন। ইলেকট্রনিক স্কোরবোর্ডে ভেসে উঠল হাস্যকর, নির্মম একটা টার্গেট। ১ বলে ২১ রান। দক্ষিণ আফ্রিকার সবচেয়ে কম রান দেওয়া দুই ওভারে ইংল্যান্ড নিয়েছিল ১ রান। সৌজন্যে রক্ষার খাতিরে অসম্ভব এই টার্গেট নিয়ে একমাত্র বলটির মুখোমুখি হতে আবার ব্যাট হাতে মাঠে নামলেন ম্যাকমিলান ও রিচার্ডসন। ক্রিস লুইসের শেষ বলে একটা রান নিয়ে ক্ষুব্ধভাবে প্যাভিলিয়নের দিকে তাকালেন দুই প্রোটিয়াস ব্যাটসম্যান। গ্যালারি থেকে হাততালি দিয়ে অভিনন্দন জানানো হলো না বিজয়ী দলকে। দুয়োধ্বনিতে প্রকম্পিত হলো সিডনি স্টেডিয়াম। বিশ্বকাপ ফাইনালে ওঠার আনন্দে মাতলেন না ইংলিশ খেলোয়াড়রাও বরং এরকম বিতর্কিত একটা জয় পেয়ে বেশ বিব্রতই হয়ে পড়েছিলেন তারা।

এর পরের কাহিনী তো সবারই জানা। ফাইনালে ইংল্যান্ডকে ২২ রানে হারিয়ে বিশ্বকাপ শিরোপাটা উঠেছিল ইমরান খানের পাকিস্তানের হাতে। আর এই জঘন্য বৃষ্টি-আইনটি কোন রকম উচ্চবাচ্য ছাড়াই সরিয়ে ফেলা হয়েছিল ক্রিকেট দুনিয়া থেকে। ১৯৯৯ সালে প্রণয়ন করা হয়েছিল অধিক গ্রহণযোগ্য ডাকওয়ার্থ-লুইস পদ্ধতি।