Posts Tagged ‘ অ্যান্ডি রবার্টস ’

হেলমেট এলো কেমন করে?

হেলমেট ছাড়া ব্যাটিং করতে নামার কথা হয়তো কল্পনাও করেন না এখনকার ব্যাটসম্যানরা। ২০১৪ সালে অস্ট্রেলিয়ান ব্যাটসম্যান ফিলিপ হিউজের মৃত্যুর পর আরও সতর্ক হয়ে গেছে ক্রিকেট অঙ্গন। ব্যাটসম্যানদের মাথায় উঠছে আরও শক্তিশালী-সুরক্ষিত হেলমেট। অথচ একটা সময় ক্রিকেটে এই হেলমেটের কোনো অস্তিত্ব ছিল না। মাথায় কোনো কিছু না পরেই জোয়েল গার্নার, জেফ থমসন, ম্যালকম মার্শালদের মতো দুর্ধর্ষ পেসারদের মুখোমুখি হতেন ব্যাটসম্যানরা। কিন্তু কবে থেকে শুরু হয়েছিল হেলমেট পরার চল? কে পরেছিলেন প্রথম হেলমেট? কেমন ছিল তার ধরনধারন?

helmets

১৯৩২-৩৩ মৌসুমের কুখ্যাত বডিলাইন সিরিজের কথা ক্রিকেটপ্রেমীরা কমবেশি সবাই জানেন। ডন ব্রাডম্যানের দুর্দান্ত অস্ট্রেলিয়ান দলকে বেঁধে রাখার জন্য সরাসরি ব্যাটসম্যানের শরীর লক্ষ্য করে বোলিং করার কৌশল গ্রহণ করেছিলেন ইংলিশ বোলাররা। সেই সিরিজে অস্ট্রেলিয়ার বেশ কয়েকজন ব্যাটসম্যান আহত হয়েছিলেন বলের আঘাতে।  তখনও ক্রিকেট অঙ্গনে আসেনি হেলমেটের ভাবনা। ১৯৩০-এর দশকে অবশ্য ইংল্যান্ডের এক ব্যাটসম্যান প্যাটসি হেনড্রেন বানিয়েছিলেন বিশেষ এক ধরণের টুপি। কাউকে কাউকে মাথায় তোয়ালে জড়িয়েও দেখা গেছে ব্যাট হাতে মাঠে আসতে। ভারতের কিংবদন্তি ব্যাটসম্যান সুনিল গাভাস্কারও মাথা বাঁচানোর জন্য বানিয়েছিলেন বিশেষ এক ধরণের টুপি। কিন্তু কোনো কিছুকেই হেলমেটের উত্তরসূরি বলা যায় না।

ব্যাটসম্যানের মাথায় প্রথমবারের মতো হেলমেট সদৃশ বস্তু দেখার জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছে ১৯৭০-এর দশক পর্যন্ত। সে সময় ক্রিকেট অঙ্গন কাঁপিয়ে তুলেছিলেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের পেসাররা। জোয়েল গার্নার, মাইকেল হোল্ডিং, অ্যান্ডি রবার্টস, ম্যালকম মার্শাল, কলিন ক্রফটরা কাঁপন ধরিয়ে দিয়েছিলেন ব্যাটসম্যানদের মনে। অস্ট্রেলিয়ার পেস জুটি ডেনিস লিলি ও জেফ থম্পসনও ছিলেন দুর্দান্ত ফর্মে। বল না, ব্যাটসম্যানদের দিকে যেন একেকটা আগুনের গোলাই ছুঁড়ে দিতেন দুর্ধর্ষ এই পেসাররা। তাঁদের ভয়ঙ্কর সব ইয়র্কার থেকে বাঁচার জন্যই মাথায় হেলমেট পরার কথা ভাবতে হয়েছিল সেসময়ের ব্যাটসম্যানদের।

dennisক্রিকেট ইতিহাসের প্রথম হেলমেট অবশ্য কোনো আন্তর্জাতিক ম্যাচে না, দেখা গিয়েছিল কেরি পেকারের বাণিজ্যিক টুর্নামেন্ট ওয়ার্ল্ড সিরিজ ক্রিকেটের সৌজন্য। ১৯৭৭ সালে ওয়ার্ল্ড সিরিজের প্রথম মৌসুমে অ্যান্ডি রবার্টের বাউন্সারে চোয়াল ভেঙে গিয়েছিল অস্ট্রেলিয়ার ব্যাটসম্যান ডেভিড হুকসের। এই ঘটনার পরেই নিজের মাথা বাঁচাতে হেলমেট পরে ব্যাট করতে আসেন ইংলিশ ব্যাটসম্যান ডেনিস অ্যামিস। সেটা ছিল একটা মোটরসাইকেলের হেলমেট। সেসময় অনেকেই কাপুরুষ বলে গালি দিয়েছিলেন অ্যামিসকে। কিন্তু অ্যামিসের সেই সিদ্ধান্তটিই অনেকটা বদলে দেয় ক্রিকেট বিশ্বকে। তার দেখাদেখি টনি গ্রেগসহ আরও অনেকে পরা শুরু করেন হেলমেট।

grahamআন্তর্জাতিক ম্যাচে প্রথমবারের মতো হেলমেট পরেছিলেন অস্ট্রেলিয়ার গ্রাহাম ইলোপ। ১৯৭৮ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরের সময়। সেটিও ছিল মোটরসাইকেলের হেলমেটের মতো। বলাই বাহুল্য যে, শুরুর দিকের সেই হেলমেট পরে খেলতে বেশ কষ্টই হতো ব্যাটসম্যানদের। অনেক ভারী সেই হেলমেটগুলোয় বাতাস চলাচলের সুবিধা ছিল না বললেই চলে। সামনে মোটা প্লাস্টিকের গ্লাস থাকায় বল দেখার ক্ষেত্রেও পড়তে হতো অসুবিধায়। তারপরও মহামূল্যবান মাথা বাঁচানোর তাগিদে সেগুলোই মাথায় দিয়ে মাঠে নামতে শুরু করেছিলেন সে যুগের ব্যাটসম্যানরা। এরপর ধীরে ধীরে গ্লাভস-প্যাডের মতো হেলমেটটাও হয়ে ওঠে ব্যাটসম্যানদের একটি আবশ্যিক সুরক্ষা উপাদান।

ভিভ রিচার্ডসের মতো কিছু ব্যাটসম্যান অবশ্য আছেন যাঁরা কখনোই মাথায় চাপাতে চাননি হেলমেট নামের এই ‘বোঝা’টিকে। ১৯৭৪ থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত ১২১টি টেস্ট ও ১৮৭টি ওয়ানডে খেলা রিচার্ডস সব সময়ই মাঠে নেমেছেন টুপি পড়ে।

বার্মিংহামের সেই ম্যাচটি

৭৬ বলে ৬১ রানের হার না মানা ম্যাচজয়ী ইনিংসটি খেলার পথে ডারেক মারে

সবাই জানেন, ১৯৭৫ সালে প্রথম ক্রিকেট বিশ্বকাপটা জিতেছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। কিন্তু এটা হয়তো অনেকেরই অজানা যে, বিশ্বকাপে তাদের দ্বিতীয় ম্যাচটাই হেরে গ্রুপ পর্ব থেকেই ছিটকে যেতে বসেছিলেন ক্লাইভ লয়েড, ভিভ রিচার্ডসরা।  পাকিস্তানের বিপক্ষে সেই ম্যাচটাতে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ভালোমতোই প্রমাণ করেছিল যে, ক্রিকেট ‘অনিশ্চয়তার খেলা’। এখানে অনেক কিছু অনুমান করা সম্ভব হলেও শেষ বলটার আগ পর্যন্ত জোর দিয়ে কিছুই বলা যায় না।

এখনো পর্যন্ত বিশ্বকাপের অনেক উত্তেজনাপূর্ণ ম্যাচই তাঁবু গেড়েছে ক্রিকেটপ্রেমীদের স্মৃতিতে। স্থান করে নিয়েছে ক্রিকেট ইতিহাসে। প্রথম বিশ্বকাপে বার্মিংহামে ওয়েস্ট ইন্ডিজ-পাকিস্তানের এই ম্যাচটিকেও নিঃসন্দেহে জায়গা দেওয়া যায় সেই তালিকার প্রথম সারিতে।

বার্মিংহামের রৌদ্রজ্জ্বল সকালে নিজেদের অজান্তেই এক স্মরণীয় ম্যাচের টস করতে নেমেছিলেন উইন্ডিজ অধিনায়ক ক্লাইভ লয়েড ও পাকিস্তান অধিনায়ক মজিদ খান। টসে জিতে ব্যাট করার সিদ্ধান্ত নেয় পাকিস্তান। অ্যান্ডি রবার্টস, কেইথ বয়েস, বের্নাড জুলিয়েনদের দুর্ধর্ষ পেস আক্রমণ বেশ ভালোমতোই মোকাবিলা করছিলেন পাকিস্তানি ব্যাটসম্যানরা। অধিনায়ক মজিদ খান খেলেছিলেন ৬০ রানের এক অনবদ্য ইনিংস। পরে মুশতাক মোহাম্মদের ৫৫, ওয়াসিম রাজার ৫৭ বলে ৫৮ রানের ইনিংস দুটির সুবাদে নির্ধারিত ৬০ ওভারে পাকিস্তানের সংগ্রহ দাঁড়ায় ২৬৬ রান।

গর্ডন গ্রিনিজ, আলভিন কালিচরন, রোহান কানহাই, ভিভ রিচার্ডসের মতো বাঘা বাঘা ব্যাটসম্যান আছেন যে দলে, তাদের জন্য ২৬৭ রানের টার্গেটটা নিতান্ত মামুলিই বলা যায়। কিন্তু সে দিন সারফরাজ নেওয়াজ, নাসের মালিকদের অসাধারণ বোলিং পাল্টে দিল সব হিসেব নিকেশ। খুব বেশিক্ষণ উইকেটে টিকতে পারলেন না গ্রিনিজ, ফ্রেডরিক, কালিচরণ, কানহাই, ভিভ রিচার্ডস। তিন অঙ্কের ঘরে না পৌঁছাতেই সাজঘরে ফিরে গেলেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের প্রথম সারির এই পাঁচ ব্যাটসম্যান। আশার আলো কিছুটা জাগিয়ে রেখেছিলেন ক্লাইভ লয়েড। কিন্তু ৫৮ বলে ৫৩ রানের লড়াকু ইনিংসটি খেলে তিনি জাভেদ মিঁয়াদাদের শিকারে পরিণত হলে হতাশায় ডুবে যায় উইন্ডিজ শিবির। স্কোরবোর্ডের চেহারা শোচনীয়। ৭ উইকেটে ১৫১ রান। টেনে হিঁচড়ে স্কোরটাকে ২০৩ পর্যন্ত নিয়ে যেতেই পতন হলো আরো দুইটি উইকেটের। জয়ের জন্য তখনো দরকার ৬৪ রান।

শেষ উইকেট জুটিতে এত রান সংগ্রহের কথা কেউ স্বপ্নেও ভাবে না। একদিকে অভিজ্ঞ ব্যাটসম্যান ডারেক মারে থাকলেও আরেক দিকে আছেন নবাগত ফাস্ট বোলার অ্যান্ডি রবার্টস, একদিনের ক্রিকেটে এটি ছিল যার দ্বিতীয় ম্যাচ। পাকিস্তানের জয় উদযাপনও শুরু করে দিয়েছিলেন অনেকে। তাদের জয়টা মনে হচ্ছিল শুধু সময়ের ব্যাপার মাত্র। কিন্তু তারপর ইতিহাস গড়ার জন্যই যেন উইকেটে খুঁটি গেড়ে বসলেন উইন্ডিজ উইকেটরক্ষক ডারেক মারে আর অ্যান্ডি রবার্টস। সবাইকে হতবাক করে দিয়ে একে একে ঠিকই ৬৩ রান যোগ করে ফেললেন শেষ উইকেট জুটিতে। এরপরই এসে গেল সেই মহেন্দ্রক্ষণ। ওয়াসিম রাজার বল মিড উইকেটে ঠেলে দিয়েই অবিশ্বাস্য এক জয় ছিনিয়ে নিলেন রবার্টস। শেষ পর্যন্ত তিনি অপরাজিত ছিলেন ২৪ রানে। আর ডারেক মারের ৭৬ বলে ৬১ রানের হার না মানা ম্যাচজয়ী ইনিংসটি এখনো উজ্জ্বল হয়ে আছে বিশ্বকাপের ইতিহাসে।

৭০-এর দশকে ক্রিকেট জগতে উইন্ডিজের একক আধিপত্যের কালে প্রতিপক্ষকে দুমড়ে-মুচড়ে দিয়ে অনেক জয়ই পেয়েছিল ক্লাইভ লয়েডের নেতৃত্বাধীন ওয়েস্ট ইন্ডিজ। কিন্তু ওয়ানডে ক্রিকেটের ৪০ বছরের ইতিহাসের সবচেয়ে স্মরণীয় ম্যাচের কথা বলতে গিয়ে উইন্ডিজ কিংবদন্তী ক্লাইভ লয়েডের মনে সবার আগে ভেসে উঠেছিল এই ম্যাচটির কথাই।