
আলটাই পর্বতমালার উকক মালভূমিকে খুবই পবিত্র একটা স্থান বলে বিবেচনা করেন স্থানীয় আদিবাসীরা। ইউনেসকোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ তালিকায় স্থান করে নেওয়া আলটাই পর্বতমালার একেবারে মধ্যমনি বলা যায় উকক মালভূমিকে। কিন্তু সম্প্রতি জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে হুমকির মুখে পড়েছে এলাকাটির প্রাকৃতিক ভারসাম্য ও জীববৈচিত্র। তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে গলতে শুরু করেছে মাটির নিচে দীর্ঘদিন ধরে জমে থাকা বরফ। আলটাইয়ের আদিবাসীরা অবশ্য প্রকৃতির এই ভারসাম্যহীনতাটা টের পাচ্ছেন অন্য কারণে। তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, প্রাচীন আমলের সব সমাধিস্থল পুনপ্রতিষ্ঠা করা, যেগুলো বৈজ্ঞানিকরা তুলে নিয়ে গেছেন গবেষণার জন্য। তারা মনে করে, এই পবিত্র সমাধিস্থলগুলোই আলটাই আর তার মানুষদের সুরক্ষিত রেখেছে বছরের পর বছর।
২৪০০ বছর আগে, এক উষ্ম গ্রীষ্মের দিনে এই উকক মালভূমিতেই চিরনিদ্রায় শায়িত হয়েছিলেন যাযাবর পাজর্ক গোত্রের এক জ্ঞানী নারী। তাঁকে সমাহিত করা হয়েছিল অনেক বড় একটা সমাধিতে। নানা ধরনের ঔষধি লতাপাতা, গাছের বাকল, নরম লোমওয়ালা চামড়ার কোট জড়িয়ে বানানো হয়েছিল তাঁর মমি। একটাই বড় কাঠের গুঁড়ি দিয়ে বানানো হয়েছিল বিশালাকার কফিনটা। সঙ্গে উত্সর্গ করা হয়েছিল ছয়টি ঘোড়া। খুবই সুসজ্জিত ঘোড়াগুলো সদাপ্রস্তুত তাঁকে মৃত্যুপরবর্তী রাজ্যে নিয়ে যেতে।
১৯৯৩ সালের আরেক গ্রীষ্মে এই রহস্যময়ীর সন্ধান পান রাশিয়ার একদল গবেষক। এটাকে গত শতকের অন্যতম সেরা প্রত্নতাত্তিক আবিস্কার বলে প্রায়শই বিবেচনা করা হয়। এই আবিস্কারটার ফলেই পাজর্ক সমাজ ও জীবনের আরও গভীরে উঁকি দেওয়ার সুযোগ মিলেছে, যেটা এতদিন আধুনিক বিজ্ঞানের কাছে অজানাই ছিল। কিন্তু পাজর্ক সমাজে তাঁর অবস্থান কী? এখনকার আলটাই আদিবাসীদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কটাই বা কী? কে এই রহস্যময়ী নারী? কোনো শাসক নাকি কোনো পবিত্র আধ্যাত্মিক চরিত্র?

স্থানীয় আদিবাসীদের কাছে তিনি পরিচিত উককের রাজকন্যা কাদান নামে। আর তাদের কোনই সন্দেহ নেই যে, এই রাজকন্যার সঙ্গে আলটাইয়ের অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যত ওতোপ্রতোভাবে জড়িত। অনান্য আরও অনেক ক্ষমতাধর পুরোহিতদের মতো, আলটাইয়ের এই কন্যাকেও সমাহিত করা হয়েছিল উকক মালভূমির পবিত্র পাহাড়ি উপত্যকায়। উত্তরসূরীদের সমাজে শান্তি ও সমৃদ্ধি বজায় রাখার জন্য।
রাশিয়ার কর্তৃপক্ষ এই ধরনের আবেগকে অবৈজ্ঞানিক ও পশ্চাতপদ বলে উড়িয়ে দিয়েছে। তাদের দাবি, গবেষণা থেকে এমন কিছুই বেরিয়ে আসেনি যা থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, রাজকন্যা কাদান বা সাইবেরিয়ার বরফকুমারীর দেহাবশেষের সঙ্গে বর্তমানের আলটাই মানুষদের কোনো সংযোগ আছে। জীনগতভাবেও নয়, এমনকি রুপকার্থেও না।
অন্যদিকে কর্তৃপক্ষের এই ধরণের কথাবার্তার কোন বাস্তব ভিত্তিই খুঁজে পায় না স্থানীয় আদিবাসীরা। তাদের চোখে রাজকন্যা কাদান আর আলটাই অঞ্চলটি এক ও অভিন্ন। পূর্বসূরীদের আত্মাকে বিরক্ত না করা, তাদের সমাধিস্থল সঠিকভাবে সংরক্ষণ করতে পারা না পারার উপরেই নির্ভর করছে পুরো এলাকার প্রাকৃতিক ভারসাম্য, সমাজের সুখ-শান্তি-সমৃদ্ধি।
উকক মালভূমিতে গবেষণারত কিছু বিজ্ঞানীও আদিবাসীদের এই দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি সহানুভূতিশীল। আর হবেন না-ই বা কেন? বিষদভাবে গবেষণার জন্য কাদান রাজকন্যার সমাধি মাটি থেকে তোলার পর আশ্চর্য্যজনকভাবে নষ্ট হতে শুরু করেছে ঐ এলাকার ভারসাম্য। ঘটছে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা।
খননকার্যের সময়ই সেখানে একটা হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত হওয়ার খবর শোনা যায়। ২০০৩ সালে সেখানে আঘাত হেনেছিল ৭.৩ মাত্রার একটি শক্তিশালী ভূমিকম্প। যেটা পুরো আলটাই গ্রামকেই মিশিয়ে দিয়েছিল মাটির সঙ্গে। সেখানকার আদিবাসীরা মনে করেন, প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষা করার জন্য রাজকন্য কাদানকে অবশ্যই ফিরে আসতে হবে তাঁর জন্য নির্ধারিত সুসজ্জিত স্থানটিতে।

রাজকন্যা কাদানকে তাঁর সুরক্ষিত স্থানে ফিরিয়ে আনতে অবিরাম চেষ্টা করে যাচ্ছেন সেখানকার আদিবাসীরা। রাশিয়ান কর্তৃপক্ষ বিষয়টিকে যেভাবে দেখছে তাতে আদিবাসীদের কাজটা যে কঠিন, তা সহজেই অনুমান করা যায়। তারপরও ধরা যাক, তাঁরা সফলও হলেন। কিন্তু রাজকন্যা কী সত্যিই সুরক্ষিত থাকতে পারবেন তাঁর সমাধিস্থলে? মাটির নিচে জমে থাকা যে বরফগুলো প্রাচীন এই সমাধিস্থল সুরক্ষিত রেখেছিল, সেগুলো সম্প্রতি গলতে শুরু করেছে বৈশ্বিক উষ্ণতার কারণে। জলবায়ু পরিবর্তন আক্ষরিক অর্থেই গলিয়ে দিচ্ছে আলটাই আদিবাসীদের সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারগুলো। অন্তত এটাই এখন উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে বৈজ্ঞানিকদের কাছে।
বিংশ শতাব্দিতে আলটাইয়ের গড় তাপমাত্রা বেড়েছে ০.৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। যেসব জায়গায় উকক মালভূমির পবিত্র সমাধিগুলো সুরক্ষিত ছিল হাজার হাজার বছর ধরে, সেসব জায়গা আছে ভয়াবহ ঝুঁকির মখে। আলটাইয়ের অন্যান্য অঞ্চলগুলোতে ইতিমধ্যেই গলতে শুরু করেছে ভূগর্ভস্থ বরফ। তাপমাত্রা যেভাবে বাড়ছে তাতে বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা করছেন ২০৮০ সাল নাগাদ এখানকার তাপমাত্রা বাড়বে ৩ থেকে ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তেমনটা হলে হয়তো পুরোপুরিই গায়েব হয়ে যাবে আলটাইয়ের ভূগর্ভস্থ বরফগুলো। ভয়াবহ প্রাকৃতিক বিপর্যয় নেমে আসবে আলটাইয়ের পাহাড়ি উপত্যকায়।
বিজ্ঞানীরা এই প্রাকৃতিক ভারসাম্যটা রক্ষা করার জন্য লড়ে যাচ্ছেন প্রাণপনেই। ‘আলটাইয়ের বরফ সমাধি’গুলো সূর্যের তাপ থেকে বাঁচানোর জন্য সেগুলো ঢেকে রাখার ব্যবস্থা করতে যাচ্ছেন ইউনেসকো ও গেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক।
বৈজ্ঞানিকভাবে তো চেষ্টা চলছেই, প্রাচীনপন্থী আদিবাসী মানুষদের বিশ্বাসকে সম্মান জানালেও তো খুব বেশি ক্ষতি নেই। পার্জক গোত্রের রহস্যময়ী রাজকন্যা কাদানকেও ফিরিয়ে দেওয়া হোক তাঁর বহুদিনের পুরোনো আশ্রয়ে। তিনিও তো চেষ্টা করতে পারেন প্রকৃতির রুদ্ররোষ প্রশমনের জন্য!?