Archive for the ‘ মানবাধিকার ’ Category

আইসল্যান্ডের ইতিহাসে পুলিশের গুলিতে মারা গেছেন মাত্র একজন!

আইসল্যান্ড নামটা উচ্চারিত হচ্ছে বেশ। প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ খেলতে এসেই তাঁরা চোখ ধাঁধিয়ে দিয়েছে অনেকের। ছোট্ট এই দ্বীপটির সামাজিক রীতি-নীতিও চোখ ধাঁধানো। অন্তত আমাদের চোখ তো ধাঁধিয়েই যাওয়ার কথা, যারা প্রতিদিন অসংখ্য বন্দুকযুদ্ধ-হত্যা-গুম-খুন দিয়ে অভ্যস্ত হয়ে গেছি।
———————————————————————–


২০১৩ সালের ডিসেম্বরে অদ্ভুত ধরণের একটা সংবাদ শিরোনাম দেখেছিল আইসল্যান্ডবাসী। ‘পুলিশের গুলিতে এক ব্যক্তি নিহত’। সত্যিই অবাক হয়ে গিয়েছিল আইসল্যান্ডের মানুষ। কারণ ১৯৪৪ সালে স্বাধীনতা অর্জনের পর এমন ঘটনা ঘটেছিল সেবারই প্রথমবারের মতো।

আইসল্যান্ডিক ন্যাশনাল ব্রডকাস্ট সার্ভিসের নিউজ এডিটর Thora Arnorsdottir বলেছিলেন, ‘পুরো দেশ থমকে গিয়েছিল। এমনটা আমাদের দেশে কখনো ঘটেনি।’ সেই ঘটনায় শোক পালন করা হয়েছিল জাতীয়ভাবে।

২০১৩ সালের ডিসেম্বরে পুলিশের গুলিতে মারা গিয়েছিলেন ৫৯ বছর বয়সী এক বৃদ্ধ। পত্রপত্রিকার খবরে জানা যায়, তিনি কিছুটা মানসিক ভারসাম্যহীন অবস্থায় ছিলেন। পুলিশকে নিজের বাড়িতে ঢুকতে দেখে তিনিই আগে গুলি চালিয়েছিলেন। পরে পুলিশও আত্মরক্ষার্থে গুলি চালালে তিনি নিহত হন। সেই ব্যক্তির প্রতিবেশীরা এই অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেছিলেন যে, তাঁরা যেন হলিউডের কোনো চলচ্চিত্রের দৃশ্য দেখছেন। কারণ এমন দৃশ্য তাঁরা শুধু টেলিভিশনের পর্দাতেই দেখে অভ্যস্ত। তারপর থেকে এমন ঘটনা আর কখনো ঘটেওনি। সেটাই প্রথম, সেটাই শেষ।

ছোট্ট দেশ আইসল্যান্ডে সহিংস ঘটনা সেভাবে ঘটেনা বললেই চলে। পুলিশও সাধারণত নিজেদের কাছে কোনো অস্ত্র রাখে না। Arnorsdottir বলছিলেন, ‘আমাদের দেশে আমরা চাই না যে, পুলিশ কোনো অস্ত্র বহন করুক। কারণ এটা বিপদজনক। এটা অন্যদের জন্য হুমকির কারণ। এটা আমাদের সংস্কৃতির অংশ না। বন্দুক অনেকে ব্যবহার করে শিকারের জন্য। কিন্তু এছাড়া আপনি কোথাও বন্দুক দেখবেন না।’

সেদিনের সেই ঘটনার সঙ্গে জড়িত পুলিশ কর্মকর্তাদের পরবর্তীতে যেতে হয়েছিল মনোবিদদের কাছে। অনুশোচনা করার জন্য। পুলিশ বিভাগ সঙ্গে সঙ্গেই ক্ষমা চেয়েছিল মৃত ব্যক্তির পরিবারের কাছে। এত কিছু তারা করেছিল এটা জেনেও যে, তারা কোনো দোষ করেনি।

কেন এত বিচলিত হয়ে গিয়েছিল দেশটির পুলিশ সদস্যরা? কারণটা জানিয়েছেন Arnorsdottir, ‘এটা শ্রদ্ধা জানানোর বিষয়। কারণ এখানে কেউই আরেকজন ব্যক্তির প্রাণ হরণ করতে চায় না।’

কেন পুলিশ গুলিতে নিহত সেই মানুষটির অনুমতি না নিয়েই তাঁর বাড়িতে প্রবেশ করেছিল- এ নিয়েও আলাপ উঠেছিল বিস্তর। হয়েছিল তর্ক-বিতর্ক। কেন পুলিশ সেটা করেনি, তেমন একটা অনুমানও দাঁড় করিয়েছেন Arnorsdottir। যা থেকে দেশটির স্বাধীনতা চর্চার পরিধি সম্পর্কেও একটা ভালো ধারণা পাওয়া যায়।

তিনি বলেছিলেন, ‘এই দেশে থাকার একটা দারুণ মজার ব্যাপার হলো আপনি যে কোনো জায়গায় যেতে পারবেন। এমনকি পার্লামেন্টেও। সেখানে ঢোকার সময় আপনাকে শুধু একটা ছোট্ট অনুরোধ করা হবে। মোবাইলটা বন্ধ করা। যেন সংসদ সদস্যদের কার্যক্রমে কোনো বিঘ্ন না ঘটে। আমাদের এখানে প্রধানমন্ত্রী বা প্রেসিডেন্ট সবসময় সশস্ত্র দেহরক্ষী নিয়ে ঘোরেন না। শান্তির এই সমাজে এটা একটা দারুণ ব্যাপার। আমরা এটা পরিবর্তন করতে চাই না।’

বিশ্বশান্তি অর্জনের একটি বাস্তববাদী রুপকল্প

শান্তিতে নোবেল পুরস্কারজয়ী জোডি উইলিয়ামস এসেছেন বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার প্রতি অদম্য ভালোবাসা নিয়ে। বক্তৃতাটায় তিনি “শান্তি” প্রত্যয়টির যথার্থ অর্থ নির্ধারণ করতে চেয়েছেন তাঁর ক্ষুরধার দৃষ্টি দিয়ে আর কিছু সুনির্দিষ্ট গল্প বলে তিনি দেখিয়েছেন যে, কিরুপে সৃজনশীলভাবে সম্মিলিত সংগ্রামের মাধ্যমে দুনিয়ায় শান্তি ফেরানোর প্রক্রিয়া শুরু করা যায়।

আমি আসলে এখানে এসেছি সবার প্রতি একটা চ্যালেঞ্জ জানাতে। আমি জানি মানুষের কাছে অনেক রকম চ্যালেঞ্জই রাখা হয়েছে। আমি যে চ্যালেঞ্জটা জানাতে যাচ্ছি, তা হলো: আমাদের সময় হয়েছে শান্তি বলতে আসলেই কী বোঝায়, তা পূর্ণবিবেচনা করার। শান্তি মানে শুধু “Kumbaya, my Lord.” না। শান্তি মানে শুধু কবুতর আর রঙধনু নয়- তারা যতই আকর্ষণীয় হোক না কেন। যখন আমি রঙধনু বা কবুতরের প্রতীক দেখি, তখন আমি ব্যক্তিগত প্রশান্তির কথা চিন্তা করি। আমি ধ্যানের কথা চিন্তা করি। এগুলোর মাধ্যমে, আমি যেটাকে শান্তি বলে বিবেচনা করি, তা আমার মাথায় আসে না । যেটা হলো ন্যায়বিচার ও সমতাযুক্ত একটা অর্জনযোগ্য শান্তি। এটা একটা অর্জনযোগ্য শান্তি, যেখানে এই দুনিয়ার বেশিরভাগ মানুষের, মর্যাদাপূর্ণ জীবন যাপনের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় সবধরণের উপকরণের সহজপ্রাপ্যতা থাকবে। যেখানে এই মানুষগুলোর কাছে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার প্রয়োজনীয় উপকরণগুলো সহজপ্রাপ্য হবে। যেন তারা এমনভাবে জীবনযাপন করতে পারে, যেখানে তারা চাহিদা থেকে মুক্তি ও ভয় থেকে মুক্তি পেতে পারবে। এটাকেই বলে মনুষ্য নিরাপত্তা। আর আমি পুরোপুরি শান্তিবাদী মানুষ না, আমার খুবই অটল অহিংস বন্ধু ম্যাইরিড ম্যাকগুইরের মতো। আমি বুঝি যে, মানুষ এত তালগোল পাকানো পরিস্থিতিতে আছে — ভালো শব্দ ব্যবহার করলাম, কারণ আমি আমার মাকে কথা দিয়েছি যে, অনেক মানুষের মধ্যে কোন অশ্লীল শব্দ ব্যবহার করব না। আর আমি সত্যিই চেষ্টা করছি, মা। সত্যিই করছি।

আমাদের অল্প কিছু পুলিশ দরকার; আমাদের অল্প কিছু সামরিক বাহিনী দরকার। কিন্তু সেটা অবশ্যই প্রতিরক্ষার জন্য। আমাদের পূর্ণবিবেচনা করা উচিত্ যে, কিভাবে আমরা নিরাপত্তা পেতে পারি। নিরাপত্তা মানে এই না যে, আমাদেরকে পুরো দেশটাকেই আগাগোড়া অস্ত্রসজ্জিত করে রাখতে হবে। এর মানে এও না যে, অন্য দেশগুলোকেও সেইসব অস্ত্র দিয়ে মুড়ে দিতে হবে, যেগুলো আমরা তৈরি করি আর তাদের কাছে বিক্রি করি। নিরাপত্তা মানে এইসব টাকাগুলো খুবই যৌক্তিকভাবে ব্যবহার করা যেন, সত্যিকার অর্থেই পৃথিবীর দেশগুলোকে, পৃথিবীর মানুষগুলোকে নিরাপদ করে তোলা যায়। আমি কংগ্রেসের চলমান সাম্প্রতিক অধিবেশনের কথা ভাবছিলাম, যেখানে আমাদের প্রেসিডেন্ট START ভোট পাস করার জন্য ৮.৪ বিলিয়ন ডলারের প্রস্তাব দিচ্ছেন। আমি অবশ্যই START ভোট সমর্থন করি। কিন্তু তিনি ৮৪ বিলিয়ন ডলারের প্রস্তাব দিচ্ছেন পরমানু আগ্নেয়াস্ত্র আধুনিকীকরণের জন্য! আপনি কী জানেন সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের করার জন্য জাতিসঙ্ঘ যে অর্থের পরিমাণটা বলে সেটা ৮০ বিলিয়ন? এত অল্প পরিমান টাকা! আমি ভাবি যে, যদি আমার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে থাকত! তা নেই। কিন্তু বৈশ্বিক প্রেক্ষিতে এটা খুবই অল্প পরিমাণ টাকা। আর এটা ব্যবহূত হতে যাচ্ছে সেইসব অস্ত্রের পেছনে যেগুলো আমাদের সত্যিই কোন দরকার নেই। আর আমরা এগুলোর হাত থেকে মুক্তিও পাব না যদি না আমরা উঠে দাঁড়াই ও এগুলোর রুখে দেওয়ার জন্য সক্রিয় হই। আমাদেরকে বিশ্বাস করতে হবে যে, বিভিন্ন ধরণের যেসব কর্মকাণ্ডের কথা আমরা গত দুইদিন ধরে এখানে শুনছি, সেগুলোই হলো সেসব উপাদান যেগুলোর সমন্বয়ে গড়ে ওঠে সত্যিকারের মনুষ্য নিরাপত্তা। সেটা হতে পারে বন্য বাঘ রক্ষা, সেটা হতে পারে টার-সান্ড রুখা, এটা হতে পারে সেইসব চিকিত্সা যন্ত্রপাতির সহজপ্রাপ্যতা যা দিয়ে সঠিকভাবে ক্যান্সার নির্নয় করা যায়। এটা এরকম যে কোন কিছুই হতে পারে। এটা টাকাগুলোকে এইসব কাজে ব্যায় করার প্রশ্ন। এটা সত্যিকার অর্থেই সক্রিয় হবার প্রশ্ন।

কয়েক সপ্তাহ আগে আমি গিয়েছিলাম হিরোশিমায়। আর সেখানে মহামান্য দালাই লামা উপস্থিত ছিলেন। আমরা শহরের হাজার হাজার মানুষের সামনে বসেছিলাম, আমরা আটজন নোবেল জয়ী সেখানে ছিলাম। আর তিনি একটু বদ লোক। তিনি যেন চার্চে একটা দুষ্টু বালকের মতো। আমরা সবাই একে অপরের দিকে তাকাতাকি করছিলাম আর অপেক্ষা করছিলাম আমাদের বক্তৃতার পালা আসার জন্য। এরকম পরিস্থিতিতে তিনি আমার দিকে ঝুঁকে বললেন, ‘জোডি, আমি একজন বৌদ্ধ সন্ন্যাসী।’ আমি বললাম, ‘হ্যাঁ, মহামান্য, আপনার পোশাক দিয়েই সেটা প্রকাশ পাচ্ছে।’ (হাসি) তিনি বললেন, ‘তুমি জান, আমি কিছুটা ধ্যান পছন্দ করি আর আমি প্রার্থনা করি।’ আমি বললাম, ‘এটা খুবই ভালো। খুবই ভালো। আমাদের দুনিয়ায় এটা খুবই দরকার। আমি এটা করি না, কিন্তু এটা খুবই ভালো।’ আর তিনি বললেন, ‘কিন্তু আমি সন্দেহগ্রস্থ হয়ে পড়েছি। আমি আর বিশ্বাস করি না যে, ধ্যান-প্রার্থনা দিয়ে দুনিয়ায় বদল আনা সম্ভব। আমার মনে হয় আমাদের যা দরকার তা হলো সক্রিয় হওয়া।’ মহামান্য দালাই লামা- তাঁর পোশাকসমেত, তিনিই এখন আমার নতুন সক্রিয়তার নায়ক।

আমি কয়েকদিন আগে কথা বলেছি আং সাং সু চির সঙ্গে। আপনাদের প্রায় সবাই-ই জানেন যে, তিনি তাঁর দেশ বার্মায় গণতন্ত্রের নায়ক। আপনারা সম্ভবত আরও জানেন যে, তিনি তাঁর জীবনের শেষ ২০ বছরের মধ্যে ১৫ বছরই কারাগারে কাটিয়েছেন এই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টায়। তাঁকে মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগে মুক্তি দেওয়া হয়েছে, আর আমরা এটা দেখার জন্য খুবই আগ্রহী যে, কতদিন তিনি মুক্ত থাকতে পারবেন। কারণ তিনি ইতিমধ্যেই রেঙ্গুনের রাস্তায় নেমে পড়েছেন। বিক্ষোভ করছেন পরিবর্তনের জন্য। তিনি রাস্তায় নেমে পড়েছেন, নিজের পার্টি নিয়ে কাজ করা শুরু করেছেন সেটা পূর্ণগঠনের জন্য। আমি তাঁর সঙ্গে অনেক প্রসঙ্গ নিয়ে কথা বলেছি। তার মধ্যে একটা যেটা আমি বলতে চাই, অনেকটাই মিলে যায় মহামান্য দালাই লামার সঙ্গে। সু চি বলেছিলেন, ‘আমার দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে আরও লম্বা একটা পথ পাড়ি দিতে হবে। কিন্তু আমি প্রচেষ্টা ব্যতিরেকে কোন আশায় বিশ্বাস করি না। আমি কোন পরিবর্তনের আশায় বিশ্বাস করি না, যতক্ষণ পর্যন্ত আমরা সেটা করার জন্য সক্রিয় না হচ্ছি।’

এবার বলব আমার আরেকজন নারী নায়কের কথা। তিনি আমার বন্ধু, ড. শিরীন এবাদি। প্রথম মুসলিম নারী যিনি নোবেল পুরস্কার জিতেছিলেন। গত দেড় বছর ধরে তিনি নির্বাসিত জীবন কাটাচ্ছেন। আপনি তাঁকে জিজ্ঞাসা করবেন, তিনি কোথায় থাকেন, নির্বাসিত অবস্থায় তাঁর বাস কোথায়? তিনি বলবেন, পুরো দুনিয়ার বিমানবন্দরগুলোতে। তিনি ক্রমাগত ভ্রমণ করে বেড়াচ্ছেন কারণ তাঁর দেশে নির্বাচনের সময় তাঁকে দেশ ছেড়ে চলে যেতে হয়। আর বাড়ি চরে যাওয়ার বদলে তিনি অন্যান্য নারীদের সঙ্গে আলাপচারিতা চালিয়ে যাচ্ছেন, যাঁদের নিয়ে তিনি একসঙ্গে কাজ করেন, যাঁরা তাঁকে বলে, ‘তুমি বাইরেই তাক। আমাদের তোমাকে বাইরেই দরকার। আমরা যেন তোমার সঙ্গে কথা বলতে পারি, এখানে কী কী ঘটে চলেছে, তা যেন আমরা তোমাকে জানাতে পারি।’ দেড় বছর ধরে তিনি তাঁর দেশের নারীদের প্রতিনিধিত্ব করে কথা বলে যাচ্ছেন।

ওয়াংগারি মাথাই — ২০০৪ সালের নোবেল পুরস্কার জয়ী। সবাই তাঁকে ডাকে “গাছ-মহিলা” বলে। কিন্তু তিনি গাছ মহিলার চেয়েও আরও অনেক কিছু। শান্তির জন্য কাজ করাটা খুব সৃজনশীল। এতে প্রতিদিনই কঠোর শ্রম দিতে হয়। যখন তিনি ঐসব গাছগুলো লাগাচ্ছিলেন, আমার মনে হয় না বেশিরভাগ মানুষ সেসময় বুঝেছিল যে, তিনি মানুষজনকে এই গাছ লাগানোর সঙ্গে সংযুক্ত করার মাধ্যমে, তাদের সঙ্গে নিজ দেশের কর্তৃত্বপরায়ন সরকারের হাত থেকে কিভাবে রক্ষা পাওয়া যায়, সেই আলাপও করছিলেন। গ্রেফতার হওয়া বা জেলে যাওয়া পরিহার করে মানুষের একজায়গায় হওয়ার কোন সুযোগ ছিল না। কিন্তু তারা একজায়গায় হয়ে যদি পরিবেশের জন্য গাছ লাগায়, তাহলে সেটা ঠিক আছে। এটা খুবই সৃজনশীল। শুধু শিরিন, অং সাং সু চি, ওয়াঙ্গারি মাথাইয়ের মতো প্রসিদ্ধ ব্যক্তিরাই নন, দুনিয়ার আরও অনেক নারী এই দুনিয়ার বদলের জন্য প্রতিনিয়ত একসঙ্গে সংগ্রাম করে যাচ্ছেন।

বার্মা নারী লিগ, বার্মিজ নারীদের ১১টি স্বতন্ত্র সংগঠন একসঙ্গে কাজ করছে। কারণ সংখ্যায় শক্তি বাড়ে। একসঙ্গে কাজ করেই আমরা এই দুনিয়ার বদল ঘটাতে পারি। বার্মার ভেতরে নারীরা সম্মিলিতভাবে গড়ে তুলেছে মিলিয়ন সিগনেচার ক্যাম্পেইন, সেখানকার মানবাধিকার পরিস্থিতি পরিবর্তনের জন্য। যখন একজনকে গ্রেফতার করা হয়, জেলে পোড়া হয়, তখন আরেকজন বেরিয়ে আসে, আন্দোলনে যুক্ত হয়। তারা এটা বুঝতে পেরেছে যে, যদি তারা একসাথে কাজ করে, তাহলেই শেষপর্যন্ত তারা নিজ দেশে পরিবর্তন আনতে পারবে।

মধ্যে মাইরেড ম্যাকগুইর, ডানপাশে বেটি উইলিয়ামস — একসঙ্গে মিলে তাঁরা শান্তি আনছেন নর্দান আয়ারল্যান্ডে। খুব সংক্ষেপে একটা গল্প বলি। একজন আইআরএ গাড়ি চালককে গুলি করা হয়েছিল আর তার গাড়িটা ফেলে দেওয়া হয়েছিল পাশের সড়কের মানুষদের উপরে। ওখানে ছিল একটা মা ও তার তিন বাচ্চা। বাচ্চাগুলো ঘটনাস্থলেই মারা গিয়েছিল। তিনি ছিলেন মাইরেডের বোন। এ ধরণের সহিংসতার মধ্যে পড়ে তীব্র শোক, হতাশা, পরাজয়ের বেদনায় মুষড়ে পড়ার বদলে মাইরেড ঝুলে গেলেন বেটির সঙ্গে। একজন গোঁড়া প্রোটেস্ট্যান্ড ও একজন গোঁড়া ক্যাথলিক। আর তারা রাস্তায় বেড়িয়ে পড়েছেন, “আর কোন সহিংসতা নয়” বলতে বলতে। আর তাঁরা হাজার হাজার মানুষকে সঙ্গে পেয়েছেন। প্রথমদিকে বেশিরভাগই নারী, কিছু পুরুষ। তারা রাস্তায় নেমেছেন পরিবর্তনের জন্য। আর নর্দান আয়ারল্যান্ডে যে শান্তি এসেছে, সেটার পেছনে তাঁরাও রেখেছেন বড় ভূমিকা। আর তাঁরা এ নিয়ে এখনও কাজ করে চলেছেন। কারণ এখনও অনেক কিছু করার বাকি।

এবার রিগোবেরটা মেঞ্চু টিম। তিনিও নোবেল পুরস্কার জয়ী। তিনি এখন প্রেসিডেন্ট পদের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বীতা করছেন। তিনি তাঁর দেশের আদিবাসী মানুষদের ধারণা দিচ্ছেন যে, গণতন্ত্র বলতে আসলে কী বোঝায়, কিভাবে দেশে গণতন্ত্র আনা যায়। তিনি তাদেরকে বলছেন ভোট দেওয়ার পদ্ধতি সম্পর্কে। কিন্তু এই গণতন্ত্র মানে শুধু ভোট দেওয়াই না। এর মানে একজন সক্রিয় নাগরিক হওয়া।

আমিও এইভাবে জড়িয়ে পড়েছিলাম, ল্যান্ডমাইন নিষিদ্ধ করার ক্যাম্পেইনে। কয়েকটি ব্যাপারের মধ্যে একটা, যে কারণে এই ক্যাম্পেইনটা কাজ করে যাচ্ছে, সেটা হলো আমরা মাত্র দুইটা এনজিও থেকে বিশ্বের ৯০টি দেশের হাজারটা এনজিওতে বেড়ে উঠেছি। ল্যান্ডমাইন নিষিদ্ধ করার সাধারণ দাবিতে আমরা একসঙ্গে কাজ করছি। এমনও মানুষ আছেন যারা আমাদের এই ক্যাম্পেইনে কাজ করেছে প্রতিদিন একঘন্টা, একমাস ধরে। তারা হয়ত এটুকু স্বেচ্ছাশ্রমই দিতে পারত। আবার আমার মতো সার্বক্ষনিক কর্মীও আছে। কিন্তু যা এখানে মুখ্য বিষয়, তা হলো সক্রিয়তা, একসঙ্গে, আমাদের সবার। যে পরিবর্তনটা আমরা আনতে চাই, সেটা নিয়ে।

আমার দৃষ্টিতে, আজকের দিনে আমাদের এমন মানুষ দরকার, যে উঠে দাঁড়াবে আর শান্তি প্রত্যয়টার যথার্থ অর্থ তুলে ধরে সক্রিয় হবে। এটা খুবই বাজে একটা দুনিয়া না। এটা প্রতিটা দিনই খুব কঠোর পরিশ্রম করার প্রশ্ন। আর যদি আমাদের সবাই, যারা ভিন্ন ধরণের জিনিসপত্র নিয়ে ভাবে, আর সেগুলো কার্যকর করার জন্য যে যেটুকু সময় পারে, সেটুকু স্বেচ্ছাশ্রম দেয়, তাহলে আমরা এই দুনিয়াটা বদলাতে পারব। আমরা এই দুনিয়াটাকে রক্ষা রতে পারব। আর আমরা অন্য কারও জন্য অপেক্ষা করতে পারি না। আমাদের নিজেদেরই এটা করতে হবে। ধন্যবাদ।

চীনে জনপ্রিয় ব্লগার নিঁখোজ!

চীনের জনপ্রিয় রাজনৈতিক ব্লগার ও বিশ্লেষক ইয়াং হেনজুনকে গত রবিবার থেকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ভিন্নমত প্রকাশের জন্য চীনা সরকার তাঁকে আটক করেছে বলে অনুমান করা হচ্ছে। খুব দ্রুত তাঁর অবস্থান সম্পর্কে সবাইকে জানানোর জন্য চীনা কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল।

চীনা বংশোদ্ভূত ইয়াং হেনজুন বর্তমানে একজন অস্ট্রেলিয়ান নাগরিক। গত রবিবার তিনি গুয়ানংজু এয়ারপোর্ট থেকে তাঁর ব্লগ পরিচালককে ফোন করে জানান যে, তিনজন লোক তাঁকে অনুসরণ করছে। এরপর থেকেই তাঁকে আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। চীনা কর্তৃপক্ষই তাঁকে আটক করেছে বলে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালকে জানিয়েছেন হেনজুনের ঘনিষ্ঠরা।

হেনজুনের এই নিঁখোজ হওয়ার ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন অ্যামনেস্টির এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের সহ পরিচালক ক্যাথরিন বাবের। তিনি বলেছেন, ‘হেনজুনের উধাও হওয়ার ঘটনাটা খুবই উদ্বেগজনক। গত কয়েক মাসে শান্তিপূর্ণ সংস্কারবাদী অনেক রাজনৈতিক কর্মী এভাবে উধাও বা গ্রেফতারের শিকার হয়েছেন।’

মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার বিক্ষোভ-বিদ্রোহে অনুপ্রাণিত হয়ে গত ফেব্রুয়ারিতে চীনের ইন্টারনেট ব্যবহারকারীরা অনলাইনের মাধ্যমে ‘জেসমিন বিপ্লবে’র ডাক দিয়েছেন। তারপর থেকেই ইন্টারনেটের উপর নিয়ন্ত্রণ ও অনলাইন প্রতিরোধ কর্মীদের উপর হয়রানির ঘটনা আশঙ্কাজনক ভাবে বেড়ে গেছে।

এক মাস বিনা বিচারে আটক রাখার পর গতকাল ‘রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার বিরুদ্ধে তত্পরতা’ চালানোর অভিযোগে মামলা দায়ের করা হয়েছে চীনের আরেক জনপ্রিয় ব্লগার রান উনফেইয়ের বিরুদ্ধে। এখনও কমপক্ষে ২০ জন আইনজীবী, ব্লগার, প্রতিরোধকর্মী আটক আছেন বিনা বিচারে। ব্লগার গু চুয়ান এদের মধ্যে অন্যতম। তাঁকে সব ধরনের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন অবস্থায় আটকে রাখা হয়েছে প্রায় এক মাস ধরে। তাঁর উপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালানো হচ্ছে বলে আশঙ্কা করছে অ্যামনেস্টি।

চীনা ভিন্নমতাবলম্বীকে মুক্তির আহ্বান অ্যামনেস্টির

চীনের গণতন্ত্রপন্থী সংগঠক লিউ জিয়ানবিনকে দ্রুত মুক্তি দেওয়ার জন্য চীনা কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। চীনা সরকারের সমালোচনা করে ভিন্নমতাবলম্বী লেখালেখি করার জন্য জিয়ানবিনকে ১০ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।

‘রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার বিরুদ্ধে নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডে উসকানি’ দেওয়ার অভিযোগে চীনের শিনচুয়ান প্রদেশের একটি কোর্ট জিয়ানবিনকে এই সাজা দেয়। ভিন্নমতাবলম্বী রাজনৈতিক তত্পরতা চালানোর জন্য এ নিয়ে তৃতীয়বারের মতো তাঁকে কারাবন্দী করা হলো।

১৯৮৯ সালে শিক্ষার্থীদের গণতান্ত্রিক আন্দোলনে অংশ নেওয়ার জন্য জিয়ানবিন আড়াই বছর কারাবন্দী ছিলেন। এরপর ১৯৯০ সালে ‘রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার বিরুদ্ধে তত্পরতা’ চালানোর দায়ে আবারও তাঁকে ১৩ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। নয় বছর কারাবন্দী থাকার পর তিনি মুক্তি পান।

২০০৮ সালে শেষবারের মতো কারামুক্তির পর তিনি চীনে আইনি ও রাজনৈতিক সংস্কারের লক্ষ্যে ‘চার্টার ০৮’ প্রস্তাবে সাক্ষর করেন। নোবেল বিজয়ী লিউ জিয়াওবোও এই সংস্কার প্রস্তাবটির সহ-লেখক। চীনা সরকারের দমননীতির সমালোচনা করে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার বিষয়ে তিনি অনেক পত্রপত্রিকায় লেখালেখি করেছেন।

অ্যামনেস্টির এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের সহ-পরিচালক ক্যাথেরিন বাবের বলেছেন, ‘শুধু লেখালেখি করার জন্য ১০ বছরের কারাদণ্ড দেওয়াটা একটা আতঙ্কজনক ব্যাপার। এবং বিচারব্যবস্থার নামে একটা প্রহসনও বটে। লিউ জিয়ানবিন কোন অপরাধেই অপরাধী নন। তিনি বন্দী হতে পারেন শুধু নিজের বিবেকের কাছেই। তাঁকে খুব দ্রুত মুক্তি দেওয়া উচিত।’ তিনি জিয়ানবিনকে কারাবন্দী করার এই ঘটনাটাকে বর্ণনা করেছেন ‘কোন বার্তার প্রতি মনোযোগ দেওয়ার বদলে বার্তাবাহককেই গুলি করে ফেলা’ হিসেবে।

লিবিয়ায় আটককৃত সাংবাদিকদের মুক্তির আহ্বান অ্যামনেস্টির

লিবিয়ায় আটককৃত আল জাজিরা টেলিভিশনের চার সাংবাদিককে দ্রুত মুক্তি দেওয়ার দাবি জানিয়েছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। চার সপ্তাহ আগে লিবিয়া ছেড়ে আসার সময় তিউনিসিয়া বর্ডারের কাছে জান্তান থেকে এই দুইজন সংবাদদাতা ও দুইজন ক্যামেরাম্যানকে আটক করা হয়েছে। তাঁদের উপর শারীরিক নির্যাতন চালানো হতে পারে বলেও আশঙ্কা করা হচ্ছে।

গত সপ্তাহেই আল জাজিরার ক্যামেরাম্যান হাসান আল জাবের গুলিতে নিহত হয়েছেন। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার পরিচালক ম্যালকম স্মার্ট বলেছেন, ‘এটা লিবিয়ায় পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে হুমকির মুখে পড়ার সর্বশেষ উদাহরণ। ত্রিপোলিতে লিবিয়ান কতৃপক্ষের অবশ্যই এই সাংবাদিকদের মুক্তির ব্যবস্থা করতে হবে এবং তাদেরকে যে কোন রকম নির্যাতনের হাত থেকে রক্ষা করতে হবে।’

এই দুইজন সংবাদদাতা হলেন আহমেদ ভাল ওয়ালদ এডিন (৩৪) ও তিউনিসিয়ার লুতফি আল মাসৌদি (৩৪)। ক্যামেরাম্যান দুজন হলেন নরওয়ের আমমার আল হামদান (৩৪) ও যুক্তরাজ্যের আমমার আল তালৌ। ধারণা করা হচ্ছে যে লুতফি আল মাসৌদিকে ত্রিপোলিতে আটক করা হয়েছে।

লিবিয়ায় বিক্ষোভ শুরু হওয়ার পর থেকেই অনেক সাংবাদিক হুমকির মুখে রয়েছেন। দুই সপ্তাহ আগে বিবিসির তিনজন সাংবাদিককে আটক করে নির্যাতন করে গাদ্দাফির অনুসারীরা। যুক্তরাজ্যের গার্ডিয়ানের সাংবাদিক গেইথ আব্দুল আহাদকেও ১৫ দিন আটক রাখার পর গত সপ্তাহে মুক্তি দেওয়া হয়। নিউ ইয়র্ক টাইমসের তিন সাংবাদিককেও ছয়দিন আটক রাখার পর গতকাল মুক্তি দেওয়া হয়েছে।