Archive for the ‘ বাংলাদেশ ’ Category

জিন্দা-মুর্দা পার্ক: শান্তিকানন আর রাজউক উন্নয়ন!

গুগল ম্যাপের সুবাদে এখন পাখির চোখে খুব চমৎকার দেখা যায় “উন্নয়ন”-এর চিত্র। ছবিতে ধুসর হয়ে যাওয়া অংশটা হচ্ছে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অধীনে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) ‘পূর্বাচল নতুন শহর’ প্রকল্পের জায়গা। চারদিকে যথেষ্ট সবুজ। একসময় যে আরও অনেক সবুজ-শ্যামল ছিল– তা শোনা যায় মুরুব্বিদের কথায়। এখন সেসব ধু ধু মরুভূমি। এখানে নগর হচ্ছে। আধুনিক জীবনযাপন হবে। মানুষ উন্নত হবে। সভ্যতা বিকশিত হবে।

এই আধুনিক শহর প্রকল্পের ঠিক পাশেই আছে একটা সবুজঘেরা মনোরম জায়গা। যেটিকে সবাই এখন চেনেন ‘জিন্দাপার্ক’ নামে। ১০০ বিঘার মতো এই জায়গাটিরও মালিক এখন কাগজে-কলমে রাজউক। অসাধারণ কিছু চিন্তাভাবনা আর দীর্ঘদিন ধরে তিল তিল করে গড়ে ওঠা এই জায়গাটি রাজউক অধিগ্রহণ করে ১৯৯৫ সালে। এরপর এই জায়গাটির দখল নেওয়ার জন্য দফায় দফায় রাজউকের সঙ্গে সংঘর্ষ-উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে জড়িয়েছে সেখানকার এলাকাবাসী। ‘পার্ক’টিকে ঘিরে আশা-স্বপ্নের বাতি জ্বালানো হাজারো মানুষ।

‘জিন্দাপার্ক’ নামে পরিচিত এই জায়গাটি আসলে পরিচালিত হয় একটি সমিতির মাধ্যমে। অগ্রপথিক পল্লী সমিতি। ১৯৮০ সালের দিকে সেসময় স্কুলপড়ুয়া ৫ কিশোরের উদ্যোগে যাত্রা শুরু হয়েছিল এই সমিতির। মাত্র ৬০ টাকা পুঁজি আর মাসিক ১০ টাকা চাঁদা দিয়ে শুরু হয়েছিল পথ চলা। এখন সেই কম্পাউন্ডের মধ্যে আছে অসাধারণ নির্মানশৈলির একটি স্কুল-লাইব্রেরী-মসজিদ-কটেজ। আছে একটি স্বাস্থ্যসেবাকেন্দ্র। খেলার মাঠ। লেক। মন শান্ত করে দেওয়ার মতো সবুজের সমারোহ। নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত শিক্ষার উদ্দেশে তৈরি হচ্ছে নতুন আরেকটি স্কুল ভবন। চলছে একটি রেস্টুরেন্ট-রেস্ট হাউজ তৈরির কাজ। ভবিষ্যতে কাজী নজরুল ইসলামের নামে একটি সঙ্গীত বিশ্ববিদ্যালয় নির্মান ও পরিচালনার পরিকল্পনাও আছে এই সমিতির।

দেশের অনেক জায়গায় যেরকম রিসোর্ট টাইপ জিনিস দেখা যায়– এই ‘জিন্দাপার্ক’টা বোধহয় সেগুলোর চেয়ে একেবারেই আলাদা কিছু। প্রকৃতির সঙ্গে তাদের সহাবস্থানের বিষয়টি বুঝতে পারা যায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই। কোথাও কখনো কোনো গাছ কাটেননি তাঁরা। এখন সেখানে আড়াইশ প্রজাতির প্রায় ২৫হাজার গাছ আছে। শান্ত পরিবেশটা ভয়াবহভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয় বলে সেখানে কোনো পিকনিক পার্টি ঢুকতে দেয়না সমিতি।

জিনিসটা তথাকথিত পার্ক হিসেবে পরিচালনার কোনো রূপকল্প এই সমিতির আদি পরিকল্পনায় ছিল না। এখনো নেই। পুরো জিনিসটাই তাঁরা চিন্তা করেছিলেন ও তিল তিল করে বাস্তবায়ন করে যাচ্ছেন একটা কমিউনিটির স্বার্থ চিন্তা করে। একারণেই হয়তো দেখা যায়– একবার একটা চিড়িয়াখানা তৈরির উদ্যোগ নিয়েও সেটি তাঁরা বাস্তবায়ন করেননি। এখনো একটা অংশে শুধু কিছু পিলার দেখতে পাওয়া যায়। যেটা ওভাবেই পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। ঘন গাছপালা অচিরেই হয়তো গ্রাস করে নেবে সেই কনক্রিটের পিলারগুলোকে।

দেয়াল দিয়ে ঘিরে দিলে কেমন বন্দী বন্দী ভাব আসে– সেই চিন্তা থেকে পুরো কম্পাউন্ডটার তিন দিক তাঁরা পরিকল্পিতভাবে ঘিরে দিয়েছেন লেক দিয়ে। এই পেঁচিয়ে থাকা জলাধারগুলোই এলাকার সীমানা নির্ধারণ করে। সামনে একটা দিকে আছে ইটের দেয়াল। তাঁরা এই এলাকাকে ডাকতে পছন্দ করেন ‘ঐক্যতান’ হিসেবে। আদিতে এই পুরো প্রকল্পটিকে শান্তিনিকেতনের আদলে গড়তে করতে চেয়েছিলেন সমিতির উদ্যোক্তারা। এই লক্ষ্যে তাঁরা নাম ঠিক করেছিলেন ‘শান্তিকানন’। এখন সেসব ঐক্যতান, শান্তিকানন, অগ্রদূত পল্লী সমিতি– সবকিছু চাপা পড়েছে ‘জিন্দাপার্ক’-এর আড়ালে।

সেটাও তো ঠিকঠাক চালাতে পারলে হতো। রাজউক-এর উন্নয়নের ঠেলা সামলাতে হচ্ছে তাদের এখন পর্যন্ত। ২০১৪ সালে পাকাপাকিভাবে সাইনবোর্ড-ফাইনবোর্ড টাঙিয়ে এটাকে নিজেদের দখলীকৃত জায়গা বলে ঘোষণা করে দিয়ে গেছেন কর্তারা। রাজউক আর জিন্দাপার্কের এই লড়াই চলেছে দীর্ঘদিন ধরে। এখনো চলছে। তবে অনেক সংগ্রাম করে এটা পরিচালনার ভার নিজেদের দখলেই রাখতে পেরেছে সমিতি। আর এই সমিতি চালাচ্ছে বলেই মনে হয় এখনো সেটি চলছে খুব ভালোভাবে। আগ্রহীরা গিয়ে দেখে আসতে পারেন।

মোদ্দা কথা যেটা, তা হলো: কী চাই আসলে আমরা? রাজউকের পূর্বাচলের মতো অত্যাধুনিক ধুসর হয়ে যাওয়া শহর? নাকি শান্তিকাননের শান্ত, সবুজ-শীতল প্রাকৃতিক নৈসর্গ্য? কিসে শান্তি মানুষের? কিসে হয় উন্নয়ন?

সুবোধের বোধ ও বাংলাদেশের প্রাক-রূপায়নের রাজনীতি

ধানমন্ডির আবাহনী মাঠ সংলগ্ন এলাকায় চোখে পড়েছিল এই ছবিটি। পলায়নরত সুবোধকে এভাবে ঢেকে দেওয়া হয়েছিল পোস্টার দিয়ে। সুবোধের এই গ্রাফিতিতে লেখা ছিল, ‘এখানে সাপ ভরা চাপ চাপ রুচি! কাপ ভরা পাপ পাপ চা! সুবোধ… তুই পালিয়ে যাহ!’

তো এই ‘চাপ চাপ রুচি’র দারুণ প্রয়োগই ঘটিয়েছিলেন পোস্টার লাগানেওয়ালারা। এই একটা গ্রাফিতি ঢেকে দেওয়ার প্রয়াসে তারা সফল হয়েছিলেন খুব সফলভাবে! কিন্তু ঢাকা শহরে তো সুবোধ ছড়িয়ে গিয়েছিল ততদিনে। মানুষের মনে ততদিন প্রশ্ন উঠে গেছে যে, কে এই সুবোধ? কেন পালাতে বলা হচ্ছে তাকে? ‘এখন সময় পক্ষে না’ যে বলা হচ্ছে, তো এটা কোন সময়? কেমন সময়? যে সময়ে সূর্যকে খাঁচাবন্দী করে পালিয়ে যেতে হচ্ছে সুবোধকে? এসব প্রশ্ন আর খোদ এই সুবোধের খোঁজ করতে গিয়ে কিছু বন্ধু মিলে বানানো হয়েছিল এই ভিডিওটি।

ঢাকার রাস্তায় কে বা কারা এই সুবোধকে চিত্রিত করেছেন তা জানা যায়নি আজ অব্দি। চেষ্টা হয়তো হয়েছেও কিছু, সুবোধের ঠিকুজি-কুলজি জানার। কিন্তু সেই সন্ধান পাওয়া গেছে- এমন খবর পাওয়া যায়নি এখন পর্যন্ত। #হবেকি নামধারী এই অচেনা চিত্রকর পচে-গলে যাওয়া, দমবন্ধকরা এক মৃত্যুপুরির শহরে যেন হঠাৎ করেই কিছু ফুল ছড়িয়ে দিয়েছিল। দেয়ালে দেয়ালে পলায়নরত সুবোধকে চিত্রিত করে। মানুষ মুগ্ধ হয়েছিল এর অঙ্কনশৈলি দেখে। কী এটা? সুবোধ আবার কী?- শুরুতে এমন প্রশ্ন। এরপর একটু একটু করে প্রশ্ন গাঢ় হতে শুরু করল। সুবোধ কী তবে সু-বোধ? মানুষেরই, আমার-আপনারই বোধশক্তি? নাড়া পড়ল চেতনায়।
মনোচৈতন্যে নাড়া দেওয়ার এই কাজটা সুবোধ সিরিজের গ্রাফিতিগুলো খুব ভালোভাবেই করতে পেরেছে বলে প্রতিয়মান হয়। সুবোধ খুব অল্প সময়ের মাঝে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। সুবোধকে নিয়ে বাঁধা হয়েছে গান-কবিতা। বানানো হয়েছে টি-শার্ট*** (এ প্রসঙ্গে কিছু কথা ডিসক্লেইমার আকারে নিচে বলা আছে)। সুবোধের বোধ কাঁটাতারের গণ্ডিও পেরিয়ে গেছে অনায়াসেই। কোনো পাসপোর্ট-ভিসার ধার ধারতে হয়নি সুবোধকে।

কলকাতার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সেখানকার শিক্ষার্থীরা সুবোধকে দেখেছেন লড়াইয়ের প্রতীক হিসেবে। তারা সুবোধকে দিয়েছেন ইতিবাচকতা। সুবোধকে বলেছেন তৈরি হতে, ঘুরে দাঁড়াতে, ছড়িয়ে যেতে। হয়েছেও তো খানিকটা সেরকমই। ২০১৮ জুলাই-আগস্টে কিশোর বিদ্রোহের তোলপাড় করা সেই দিনগুলোতে একটি ছবি অনেকেরই নজর কেড়েছিল। বাংলাদেশের কিশোররা যে অসাধারণ কল্পনাশক্তির পরিচয় দিয়েছিল তাদের প্ল্যাকার্ডগুলোতে- সেখানে ঠাঁই হয়েছিল এই সুবোধেরও। একজনের হাতে ধরা প্ল্যাকার্ডে লেখা হয়েছিল, ‘সুবোধ এখন রাস্তায়’।

হ্যাঁ! সুবোধ তো ঐ কয়েকটা দিন রাস্তাতেই ছিল। সেই সুবোধগুলোকেও শেষপর্যন্ত ঘা খেয়ে পালাতে হয়েছে। কারণ “পাপবোধ (এখনও) নিশ্চিন্তে করছে বাস মানুষের হৃদয়ে।“ সুবোধকে তাই আবারও পালাতে হয়েছে। আর কত পালাবে সুবোধ? কবে আসবে সময় পক্ষে?
সময় পক্ষে আসতে পারে। সেজন্য সময়টাকে বুঝে নেওয়াটাও মনে হয় জরুরি। এই সময়ে এমন সমাজ-পরিবেশ কিভাবে গড়া যায় যেখানে সুবোধকে পালিয়ে বেড়াতে হবে না? সুবোধের ভাগ্যেই শিকে ছিঁড়বে? সব কিছু নষ্টদের দখল থেকে আবার ফিরে আসবে সুবোধের দ্বারে? মুক্তির নিশান-স্বরূপ সূর্যটা আবার খাঁচা থেকে মুক্ত করে দিতে পারবে সুবোধ? ভোরের অপেক্ষায় থাকা মোরগটা ডেকে উঠবে তীব্র স্বরে? সুবোধও তার কোলের পাশে বসে থাকা কিশোরী মেয়েটিকে বলবে, ভোর হয়ে গেছে রে পাখি! ও যে আকুল হয়ে জানতে চায়, “সুবোধ! কবে হবে ভোর?”
এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হলে আমাদের দিতে হবে নতুন দৃষ্টি। আর এখানেই আসে প্রিফিগারেটিভ পলিটিক্স বা প্রাক-রূপায়নের রাজনীতি প্রসঙ্গ। অচেনা দাগ বইয়ে এর ইতিহাস-ধারণা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন সেলিম রেজা নিউটন। “প্রিফিগারেটিভ পলিটিক্স বা প্রাক-রূপায়নের রাজনীতি: রাজনীতির অরাজপন্থা” (পৃষ্ঠা ১৭৭-১৮৬)। আগ্রহীরা অনলাইনে বসেই পড়তে পারেন এখান থেকে: https://goo.gl/zPRg1m
বিষয়টির মূল বক্তব্য হচ্ছে, যেরকম সমাজ আমরা কামনা করি, আকাঙ্ক্ষা করি—তেমন সমাজ নির্মানের লক্ষ্যে কর্মতৎপরতাটাও হতে হবে সেই কাঙ্ক্ষিত সমাজের আদলে। ১৯ শতকের অরাজপন্থী James Guillaume বলেছিলেন, “একটা কর্তৃত্বপরায়ন সংগঠন থেকে কিভাবে দেওয়া যেতে পারে সাম্য ও মুক্তির সমাজ গড়ার ডাক? এটা অসম্ভব।” ইতিহাসের পৃষ্ঠাগুলো তো এই কথারই সাক্ষ্য দিচ্ছে বারবার… বারবার। ২০১১ সালের অকুপাই মুভমেন্টে খুব বড় করে উঠেছিল এই প্রিফিগারেটিভ পলিটিক্স সংক্রান্ত কথাবার্তা। David Graeber দের লেখালেখি দিয়ে।
ভীষণরকমের কর্তৃত্বপরায়ন, পুরস্কার-তিরস্কার-বহিস্কারে মত্ত ও অভ্যস্ত; এমন সংগঠন থেকে শোনা যায় গণতন্ত্র-সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আহ্বান। দেশের সব রাজনৈতিক দল; সেটা ডানই হোক আর বামই হোক। যে বাদই হোক, যে তন্ত্রই হোক—সংগঠন বানানোর সময় প্রেসিডেন্ট-সেক্রেটারি লাগবেই। এমনকি পাড়ায় ১০ জন মিলে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা সমর্থকগোষ্ঠী কমিটি করলেও সেখানে থাকে প্রেসিডেন্ট-সেক্রেটারি। এই ফরম্যাটের বাইরেও যে কোনো সংগঠন হতে পারে— এই জিনিসটা যেন ভাবতেই পারি না আমরা।
নতুন সমাজটা যদি আমরা সাম্যেরই চাই, স্বাধীনতারই চাই—তাহলে এখনকার সংগঠনেও সেটা প্র্যাকটিস করব না কেন আমরা? প্র্যাকটিস করতে গিয়ে অনেক ভুল হবে; সেই ভুল থেকে শেখাও হবে — নতুন সমাজের রূপটা আরও মূর্ত হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা বামপন্থী ছাত্র সংগঠনে কতজন সদস্য থাকে? ৪০-৫০ জন সর্বোচ্চ? এই কয়জন মানুষ মিলে সম্মিলিতভাবে একটা সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় না?
যায়। ইচ্ছা থাকলে যায়। কিন্তু ইচ্ছাটাই বোধহয় হয় না কারও। কারণ ইচ্ছা হতে থাকলেই বেরিয়ে আসবে তাদের অনেক অজানা ইতিহাস। উঠতে থাকবে অনেক অপ্রিয় প্রসঙ্গ। সেগুলোর মুখোমুখিই হয়তো হতে চান না তারা। সংগঠনে কোনো কর্মী এসব কথা তুললেও তাই অনেককে পড়তে হয় বহিস্কারের মুখে। নিদেনপক্ষে তিরস্কারের মুখে। তিরস্কার শুনে যারা আবার সামলে নেন, লাইনে হাঁটেন—তাদের সামনে থাকে পুরস্কারের হাতছানি। এই করেই চলছে সংগঠনগুলো।
কিন্তু সুবোধের উপযোগী একটা সমাজ যদি আমরা গড়তে চাই; তাহলে আমাদের বেরোতে হবে এই চিরাচরিত চিন্তাভাবনাগুলো থেকে। করতে হবে নতুনের সন্ধান। পুরাতনকেও আবিস্কার করতে হবে নতুন করে। সুবোধ যেমন নতুন কিছু নিয়ে হাজির হয়েছে- তেমনি পরিবর্তনকামী প্রতিটি মানুষকে সক্রিয় হতে হবে। অন্ততপক্ষে চিন্তাভাবনার ক্ষেত্রে।
কেন্দ্রীয় একটা কমিটি, পদাধিকার বলে নেতা, নেতার হাতা, অনেকগুলো মুখের একজন পাত্র; (যিনি শুধু মাইকে হুমহাম করবেন আর আমাদের-মামুদের ইচ্ছেমতো ফুল-পাতা-পায়রা ওড়াবেন, মোম জ্বালাবেন) ইত্যাদি হওয়া ছাড়াও আন্দোলন-সংগ্রাম সংগঠিত হতে পারে। সফল আন্দোলন-সংগ্রাম হতে পারে। ২০০৮ সালে রাবিতে কর্তৃত্ববিরোধী শিক্ষার্থীবৃন্দ মঞ্চের কর্মী হিসেবে কাজ করার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা লাভের সৌভাগ্য হয়েছিল। সেই অভিজ্ঞতা থেকে জানি যে, একক কোনো নেতা বা নেতার বিশেষ ক্ষমতা বা কোনো কেন্দ্রীয় কমিটি ছাড়াও কিভাবে একটা আন্দোলন গড়ে উঠতে পারে এবং সেটা দারুণভাবে সফল হতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয়ে মুক্ত পরিসর তৈরি করতে পারে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এই আন্দোলন সম্পর্কে আগ্রহী হলে পড়তে পারেন: আগস্ট বিদ্রোহ।। মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় আন্দোলন : জরুরি পর্ব https://goo.gl/aVM26U

রাবির কর্তৃত্ববিরোধী মঞ্চের মূখ্য কিছু সংগঠক আগে থেকেই অরাজপন্থার ধারণার সঙ্গে পরিচিত ছিলেন। ফলে ২০০৮ সালের এই আন্দোলনটি ছিল বিকল্প কোনো পথে নামার সচেতন প্রয়াস। আর অচেতন প্রয়াসটা আমরা খুব সম্প্রতি দেখলাম কিশোর বিদ্রোহে। কিভাবে একটি কেন্দ্র না থেকেও, একক নেতৃত্ব তো দূরের কথা; দৃশ্যমান কোনো নেতৃত্ব না থেকেও কিভাবে রাজধানীর রাজপথ দাপিয়ে বেড়ানো যায়— সে শিক্ষাটা খুব দারুণভাবে দিয়েছে বাংলাদেশের কিশোররা। এবং এভাবে জনগণ সক্রিয় হয়ে উঠলে, জনগণ নিজের কাজের ব্যাপারে নিজে সচেতন হলে যে সব কিছু অনেক ভালোভাবে চলতে পারে—সেই শিক্ষাটাও দিয়েছে স্কুল-কলেজের ছেলেমেয়েগুলো।

এ প্রসঙ্গে পড়তে পারেন…
>> সবুজের অভিযান: সকল ক্ষমতা চাই শিশুদের কল্পনার হাতে (https://goo.gl/VvQteH)
>> রাস্তার পাঠশালায় চলে ‘এসো নিজে করি’ ক্লাস; বড়রা অংশ নেবে কি? (https://goo.gl/WnrsHu)
>> লাইসেন্স আছে?: কিশোর বিদ্রোহ যে বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখায় (https://goo.gl/JsVtjA)

এগুলো গেল খুব নিকট উদাহরণ। প্রত্যক্ষ উদাহরণ। পার্টি-পলিটিক্সের বাইরে স্বাধীন সংগঠন গড়ে ওঠার অজস্র নজির পৃথিবীতে দেখা গেছে। বহু প্রাচীনকালের সেসব ঐতিহাসিক উপাদানের উল্লেখ নাহয় তোলা থাকল। শিল্প-বিপ্লবের সময় থেকেও সমাজতান্ত্রিক রাজনীতির একেবারে শুরুর দিকেই অনেক আলাপ উঠেছিল কাঙ্ক্ষিত সমাজ ও তা রূপায়নের পদ্ধতি-কৌশল নিয়ে। সেসব ইতিহাসের গায়ে পড়া বহু বছরের ধুলো ঝাড়ার সময় বোধহয় চলে এসেছে। এ জায়গায় এসে আবারও সেলিম রেজা নিউটনের অচেনা দাগ বইয়ের “প্রিফিগারেটিভ পলিটিক্স বা প্রাক-রূপায়নের রাজনীতি: রাজনীতির অরাজপন্থা” (পৃষ্ঠা ১৭৭-১৮৬) এই অধ্যায়টির কথা উল্লেখ করছি। আগ্রহীরা অনলাইনে বসেই পড়তে পারেন এখান থেকে: https://goo.gl/zPRg1m

সুবোধ যেন আর পালিয়ে না বেড়ায়, সময়টা যেন সুবোধের পক্ষে আসে — সেই লক্ষ্যে কাজ করতে হবে সবাইকেই। এটা কোনো ভ্যানগার্ড, একক ব্যক্তি-সংগঠনের করে দিয়ে যাওয়ার বিষয় না। সুবোধের বোধ উদ্বোধনের সময় এখন। #হবেকি?

———————————————————————–
*** টি-শার্ট সম্পর্কিত ডিসক্লেইমার: সুবোধের এই গ্রাফিতিগুলোর আইডিয়া খুব বেশিমাত্রায় পছন্দ হওয়ায় দুইটা গ্রাফিতি দিয়ে মোট ৩০০ টি-শার্ট করার উদ্যোগটা আমি নিয়েছিলাম। কিছু বন্ধুর সঙ্গে মিলে সেগুলো বানানো হয়েছিল। এর পেছনে কোনো বাণিজ্যিক উদ্দেশ্য ছিল না। অধিকাংশ টি-শার্টই বিলানো হয়েছে বন্ধু-স্বজনদের মধ্যে। হ্যাঁ, শুরুতে এমন ভাবনা ছিল যে, যা খরচ হয়েছে- সেই টাকাটা যদি তুলে আনা যায়; তাহলে ভালো হয়। কিন্তু সেটাও শেষপর্যন্ত হয়নি। ১৫-২০ হাজার টাকা নিজের গাঁট থেকেই গিয়েছিল। এ নিয়ে অনেককে বলতে শুনেছি যে, টি-শার্ট বানিয়ে ব্যবসা হচ্ছে। সুবোধকে নিয়ে ব্যবসা হচ্ছে। আহত হয়েছিলাম। তাই এই লেখার সুবাদে এই কথাটুকু ডিসক্লেইমার আকারে দেওয়ার লোভ সংবরণ করতে পারলাম না। সুবোধকে নিয়ে ব্যবসা করার রুচি কখনো ছিল না, ভবিষ্যতেও আশা করি হবে না।

রাবি ছাত্রলীগ: মিউমিউ করা বিড়াল থেকে বাঘ হওয়ার ইতিহাস

র‍্যাব-পুলিশের মতো ছাত্রলীগেরও একটা মুখস্ত প্লট আছে। তারা শিবির প্রতিহত করতে যান। যেখানে-সেখানে তারা শিবির খুঁজে পান। এমনকি নিজেদের দলের মধ্যেও খুঁজে পান। ছাত্রলীগের মধ্যে কেউ কোনো আকাম করলে বলা হয় সেটা শিবিরের অনুপ্রবেশকারী।
———————–
র‍্যাব-পুলিশের ক্রসফায়ার গপ্পো মানুষ যেমন আর খাচ্ছে না, তেমনি ছাত্রলীগের এই ‘শিবির জুজ’ও আর খাওয়ার যোগ্য থাকছে না। সেজন্যই তারা এভাবে তোতলাচ্ছেন।
———————–

শিবির কী জিনিস দেখেছেন আপনারা? কোনোদিন গেছেন শিবির প্রতিহত করতে? শিবিরের স্বর্গখ্যাত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছি। শিবিরের রমরমার সময়। জীবনে কোনোদিন ছাত্রলীগকে শিবির প্রতিহত করতে যাইতে দেখি নাই। এখন তারা যেটা করছেন সেটা ক্ষমতার নির্লজ্জ আস্ফালন। এই জিনিস বেশিদিন টেকার না।
————————-
২০০৫ সালে ভর্তি হয়েছিলাম রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। তখন শিবিরের বিশাল বিশাল সব মিছিল দেখতাম। এ মাথায় দাঁড়ালে ও মাথা দেখা যাইত না। ক্লাস নিতে নিতে শিক্ষককে থেমে থাকতে হতো মিনিট দশেক। এখনকার এইসব লুটপাটের চেতনায় উদ্বুদ্ধ ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা সম্ভবত সেসব দেখেননি।
তো, সেই শিবির রাজত্বে ছাত্রলীগ ছিল বিড়ালের মতো। মিউমিউ করত। এখনকার ক্ষুদ্র কোনো বাম ছাত্র সংগঠন যে অবস্থায় আছে- ছাত্রলীগের অবস্থাও কমবেশি একই রকম ছিল। শিবিরের সঙ্গে গ্যাঞ্জাম কিছু হলে, সেটা হতো ছাত্রদলের।
কিন্তু রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় সেসময় সাংস্কৃতিকভাবে ছিল প্রচণ্ড তৎপর। প্রাণবন্ত-উচ্ছল একটা পরিবেশ ছিল ক্যাম্পাসের। প্রতি সপ্তাহেই এখানে-ওখানে হতো পথনাটক। শহীদ মিনারে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। সভা-সেমিনার; পত্র-পত্রিকা, গান-আড্ডায় মুখর থাকত বিশ্ববিদ্যালয়। শিক্ষার্থীদের স্বাধীনতার পরিসরটা ছিল অনেক বড়। যার ছিটেফোটাও কিছু নেই এখন মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ সরকারের আমলে।
—————————
এরপর আসল ২০০৭ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকার। এখনকার ছাত্রলীগ নেতারা, যে নেত্রীর নাম নিতে নিতে, মহামান্য বলতে বলতে মুখে ফেনা তুলে ফেলেন- সেই শেখ হাসিনা কারাবন্দী হয়েছিলেন। তাদের আরও অনেক নেতা গিয়েছিলেন গারদের ওপাশে। কিন্তু ছাত্রলীগের কোনো নেতাকর্মীকে আওয়াজ তুলতে দেখিনি। আওয়াজ কি— তারা ছিলেনই না অত্র অঞ্চলে।
এরপর আগস্ট বিক্ষোভ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রেপ্তারকৃত শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মুক্তির দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলনে তাদের কেউ কেউ যোগ দিয়েছিলেন সাধারণ শিক্ষার্থীদের তৈরি করা পাটাতনে।
আমরা, বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীরা- যারা বন্ধুত্বের সূত্রে, রাজনৈতিক চিন্তা-চর্চার সূত্রে সংগঠিত হয়েছিলাম, তারাই আওয়াজ তুলেছিলাম সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অনায্য-অগণতান্ত্রিক কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে। ছাত্রলীগের কেউ কেউ আমাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন মাত্র।
————————-
ছাত্রলীগ নামের এই বিড়ালটা দুম করে গায়ে ডোরাকাটা দাগ কেটে বাঘ হয়ে গেল ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের পর। সেই ‘ভোট বিপ্লবের’ চেতনীয় জোশে তারা মারামারি বাধিয়ে দিলেন শিবিরের সঙ্গে। কারণ তখন তাদের জানাই ছিল যে, পুলিশ তাদের সঙ্গে আছে। প্রকাশ্যে অস্ত্র নিয়ে ঘুরলেও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তাদের কিছু বলবে না। অনেক ক্ষমতার বলে বলিয়ান হয়ে তারা শিবির প্রতিহত করতে গেলেন!!!
————————-
ছাত্রলীগের কাছে ব্যাপারটা ছিল শুধুই ক্যাম্পাসে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার। শিবির প্রতিহত করার নামে সেসময় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন জারি করেছিল নয়া জরুরি অবস্থা। নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল সব ধরণের স্বাধীন তৎপরতার বিরুদ্ধে। সভা-সেমিনার-মিছিল-সমাবেশ-লিফলেট সব বন্ধ।
অন্যদিকে ছাত্রলীগকে দেওয়া হয়েছিল অবাধ স্বাধীনতা। কোমড়ে অস্ত্র গুঁজে প্রক্টরের সঙ্গে হাঁটা শুরু করেছিলেন ছাত্রলীগ নেতারা। সেই যে শুরু… ২০০৯ সালের দিক থেকে… তারপর থেকে সেভাবেই প্রশাসনের ছত্রছায়ায়-প্রশ্রয়ে দানব হয়ে উঠেছে ছাত্রলীগ। আরও বিস্তারিত জানার আগ্রহ থাকলে পড়তে পারেন: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ফ্রাংকেনস্টাইন’ কাহিনী

—————————-
কিন্তু শিবির কি প্রতিহত করতে পেরেছে তারা? ২০১৩ সালে গণজাগরণ মঞ্চের শুরুর দিকে যখন পুরো দেশ কেঁপে কেঁপে উঠছিল- তখন অভিভাবকশূণ্য হয়ে পড়ছিল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। শিবির সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করছিলেন সেসময়ের কর্মকর্তা-হর্তাকর্তারা। তারা ভয়ে ছিলেন। আরও বিস্তারিত জানার আগ্রহ থাকলে পড়তে পারেন: কেমন আছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়?

তো, এই হলো তাদের শিবির প্রতিহত করার নমুনা। এই হচ্ছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেক্ষিতে গত এক যুগে ছাত্রলীগের ইতিহাস। মিউমিউ করা বিড়াল থেকে বাঘ হয়ে ওঠার ইতিহাস।
—————————-
বিশ্ববিদ্যালয়ের সুষ্ঠ পরিবেশ, জ্ঞানচর্চা, তর্ক-বিতর্ক, গান-্আড্ডার পরিবেশ তৈরি হতে পারে শুধুমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীদের মুক্ত-স্বাধীন তৎপরতার মাধ্যমে। শিক্ষার্থীরা যত বেশি কথাবার্তা বলবেন, নানাবিধ তৎপরতার সঙ্গে যুক্ত হবেন- তত বাড়তে থাকবে স্বাধীনতার পরিসর। কমতে থাকবে দানবদের দৌরাত্ম।

বিশ্ববিদ্যালয় সংক্রান্ত আরও লেখাপত্র

মুক্ত-বিশ্ববিদ্যালয় নাকি মুক্ত-বাজার?

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা… শিখব কি?

কোনটা মাদক, কোনটা না? বাজারের বিবেচনা!

মাদকবিরোধী অভিযান চলছে। কিন্তু কোনগুলো মাদক আর কোনগুলো না- সেগুলো নিয়ে কোনো আলাপ হচ্ছে?

মাদক কী আসলে? যা নেশা তৈরি করে- সেগুলো মাদক? নেশা তো অনেক রকম আছে। ফেসবুকে ঘন্টার পর ঘন্টা স্ক্রল করে যাওয়া, ভার্চুয়াল বন্ধুদের সাথে গল্পগুজব করা- এ-ও তো নেশা। সমাজবিজ্ঞানী-মনোবিজ্ঞানীরা এ নিয়ে গবেষণা করছেন। কথাবার্তা বলছেন (https://goo.gl/dSrN1p)। টাকা কামানো, ক্ষমতা দখল- এগুলোও নেশারই মতো। এগুলো নিয়ে আলাপ হবে না?

আচ্ছা ওগুলা বাদ। মদ-ভাঙ-গাঁজা-তারি-সিগারেট-ইয়াবা-হেরোইন-কোকেন; এগুলো নিয়েই আলাপ হোক তাহলে।

বঙ্গ অঞ্চলের মানুষ প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে তালের তাড়ি, গাঁজা-ভাঙ, ভাত পচানো চোলাই- ইত্যাদি খেয়ে আসছে। এত সামাজিক অবক্ষয়, বিকারগ্রস্থ অবস্থা হয়নি তো কখনো। বরং তালের তারির অনেক উপকারের কথাই শুনেছি বয়োবৃদ্ধদের কাছ থেকে। সাম্প্রতিক সময়ে তো দেখা যাচ্ছে বর্জ্রপাত থেকে বাঁচার জন্য বেশি বেশি করে তালের গাছ লাগানোর পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।

গাঁজার ক্ষেত্রেও কমবেশি একই কথা প্রযোজ্য। গাঁজার চল চলে আসছে অনাদিকাল থেকে। সেই শিবঠাকুরের সময় থেকে। এখনও এই উপমহাদেশের অনেক জায়গায় গাঁজা খাওয়ার সঙ্গে আধ্যাত্মিক চর্চার একটা যোগ আছে। গাঁজা বৈধ করার দাবিতে ইউরোপ-আমেরিকার বিভিন্ন জায়গায় ঘোর আন্দোলন হচ্ছে। কোথাও কোথাও তো সেটা বৈধ করাও হয়েছে।

গাঁজা, তালের তারি, চোলাই- এগুলো নিয়ে কোনো রাখঢাকও ছিল না কখনো। লুকোছাপার কোনো ব্যাপার ছিল না। এগুলোকে কেউ দোষ বলেও মনে করত না। কবে থেকে এগুলোর গায়ে মাদকের ছাপ্পা লাগল? অনুসন্ধান করা দরকার।

সহজ বুদ্ধিতে যেটা বুঝতে পারি তা হলো: যখনই দেখা যায় এগুলো দিয়ে ব্যবসা করা সম্ভব না তখনই সেগুলোর বিরুদ্ধে খড়্গহস্ত হয় এই পুঁজিবাদী সমাজ। কারণ তালের গাছ তো বাড়ির পাশেই হয়। সেটা তো আর দোকান থেকে কিনতে হচ্ছে না। ফলে ব্যবসার সুযোগ কই? গাঁজার ক্ষেত্রেও একই কথা।

এগুলো খেয়ে কেউ শারীরিক অসুস্থতার শিকার হন- এমন কথাও প্রায় শোনা যায় না বললেই চলে। বরং ভালোমতো অনুসন্ধান করলে এগুলোর হাজারো উপকারিতাই বেরিয়ে আসার সম্ভাবনা আছে।

আচ্ছা… এবার মদ-সিগারেট-হিরোইন-ইয়াবা-কোকেনের প্রসঙ্গে আসা যাক। শুরুতেই এই সব কিছুর মধ্যে একটা মিল চোখে পড়ে। এই সব কিছুই উৎপাদন করার ব্যাপার। পুঁজিপতিদের পুঁজি লগ্নি আর মুনাফা কামোনোর ব্যাপার। কৃত্রিম এই নেশাগুলো এই বাংলার মাটিঘনিষ্ঠও না। বর্হিদেশীয় উৎপাদ-উৎপাত।

হিরোইন-কোকেন-ইয়াবা তো খুব বেশিদিন হয়নি এই বঙ্গ সমাজে আমদানি হয়েছে। ইয়াবা তো আসল সেই সেদিন। মেরেকেটে ১০-১৫ বছর হয়তো হবে খুব বেশি হলে। সেই ইয়াবারই এখন কী রকরমা! ইয়াবাসহ হিরোইন-কোকেন ইত্যাদি প্রভৃতি সব কৃত্রিম, কারখানায় বানানো বিকারগ্রস্থ নেশারই আগমন ইতিহাস খুব অল্প সময়ের মামলা।

লক্ষ্য করার মতো বিষয় যে, সবগুলোরই আমদানি ঘটেছে কিন্তু বড়লোকদের হাত ধরে। ‘বড় বাপের পোলারা’ ফুর্তি করার জন্য, ‘ডিফারেন্ট কিছু ট্রাই’ করার জন্য এসব শুরু করে। খুব সম্প্রতি ইয়াবার বঙ্গে আবির্ভাবের ইতিহাস ঘাঁটলে তা ভালোমতোই বুঝতে পারা যায়।

থাইল্যান্ড-ইন্দোনেশিয়া থেকে অনেক অর্থের বিনিময়ে ইয়াবা প্রথমে ঢুকেছিল বড়লোকদের ফুর্তিখানায়। সেখান থেকেই বিস্তার-বিস্তৃতি। আর এখন গ্রামেগঞ্জে ২০০-৩০০ টাকা দিয়েও পাওয়া যায় ইয়াবার প্যাকেজ। কিভাবে সম্ভব হলো? বিকৃত একটা জিনিশের আরও নানা বিকৃতি ঘটিয়ে, নিম্নমানের কেমিক্যাল মিশিয়ে বাজারে ছাড়া হলো মধ্যবিত্ত-নিম্ন মধ্যবিত্তদের জন্য।

আচ্ছা… এবার সমাজের বৈধ আর উপরিভাগে থাকা বহুল প্রচলিত দুটির নেশার প্রসঙ্গ। সিগারেট আর মদ। এগুলো ক্ষতিকর দিক নিয়ে আর নতুন করে বলার কী আছে। সবাই সব জানি-বুঝি। তারপরও সেগুলো বৈধ কেন? সেগুলো নিয়ে কথাবার্তা নেই কেন? কারণ সেগুলো বাজারে বিকোনো যায়। সেগুলো নিয়ে ব্যবসা করা যায়।

তালের তারি-গাঁজা ছোটলোকের জিনিস বলে সেগুলোর ওপর স্টিমরোলার চালাব! আর মদ-সিগারেট বড়লোকদের জিনিস বলে সমাজে বুক ফুলিয়ে চলতে থাকবে!

বারে গিয়ে গলা অব্দি মদ খেয়ে মাতলামো করবো! কোনো সঙ্কোচ হবে না। বরং বুক ফুলিয়ে গল্প করব যে, বোতলটা কোন দেশ থেকে ইনটেক এসেছিল! এক বোতলের দাম কত হাজার টাকা! আর গাঁজা খাবো চিপা-চুপায় গিয়ে! কেউ দেখে ফেললে? প্রেস্টিজ পাংচার। ছিঃ গাঁজাখোর!

আর কতো হিপোক্রেসি করব আমরা?

 

‘প্রশ্ন করো সব কিছুকেই’- কেন?

কী ছিল জিনিসটা? কিছু শব্দতরঙ্গ?! কিছু ধ্বনি, কিছু শব্দ, কিছু চিৎকার, কিছু আর্তনাদ?! ‘আব্বু, তুমি কানতেছো যে’- বুক চিরে দেওয়া এই প্রশ্ন আর নিজের মৃত্যু-নিয়তি জেনে ফেলা এক বাবার নির্মম অসহায়ত্ব ফুটে উঠেছিল যে শব্দতরঙ্গগুলোতে, তা আসলে আরও অনেক কিছু ছিল।

১৪-১৫ মিনিটের ফোন রেকর্ডিং অডিওটা মানুষের কানে যেন বিষ ঢেলে দিয়েছে। সেই বিষ কারো হৃদয়ে রক্তক্ষরণ ঘটাচ্ছে, কারো মাথায় আগুন ধরিয়ে দিচ্ছে। নিদেনপক্ষে বলা যায়, অগ্রাহ্য করতে পারছেন না কেউই। রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসী বাহিনীর প্রতিটা ক্রসফায়ার-এনকাউন্টারের গল্পই যে কমবেশি এমন- সেটা এতদিন ছিল ওপেন সিক্রেট। কাউন্সিলর একরাম হত্যার অডিওটা সিক্রেসির চাদরটা সরিয়ে দিয়েছে পুরোপুরি।

ফলে জিনিসটা অগ্রাহ্য করা সত্যিই কঠিন হচ্ছে। আমাদের পিঠ দেয়ালে ঠেকিয়ে দিয়েছে অডিওটা। এমন ঘটনা গত কয়েক বছর ধরেই অনেক ঘটে গেছে। নানা কারণে সেগুলো নিয়ে তেমন সোরগোল হয়নি। কিন্তু এবার লক্ষ্য করা যাচ্ছে একধরণের গণ-চৈতন্য জাগ্রত হওয়ার মতো বিষয়। মানুষ কথা বলতে শুরু করেছেন।

কথা না বলে আর থাকা যাচ্ছে না আসলে। আমাদেরকে মনুষ্যত্বের শেষ সীমায় এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে একরাম হত্যার অডিওটা। এরপরও কথা না বললে নিজেদের মনুষ্য সত্ত্বাটাই আর থাকে না মতো অবস্থা। প্রবল সরকারপন্থী হিসেবে পরিচিত- এমন ১০ বিশিষ্ট নাগরিকও ক্রসফায়ারের নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন।

আর এই কথাবার্তা একবার যখন উঠেছে, তখন তা আরও বেশি করে হওয়া দরকার। শুধু বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডেরই বিরোধীতা করব নাকি সবধরণের হত্যাকাণ্ডেরই বিরোধীতা করব? সমাজের প্রতিটি পর্যায়ে, পদে পদে যে নীতিহীনতা, দুর্নীতি, লুটতরাজ, সন্ত্রাস, সাধারণ মানুষের সীমাহীন ভোগান্তি- এ থেকে উত্তরণের পথ কি? সব কিছু নিয়ে প্রশ্ন তুলতে শুরু করা দরকার। এক এক করে পরীক্ষা দেব, এক পরীক্ষার সময় অন্য পরীক্ষার উত্তর লিখব না- এই ধরণের যুক্তিপদ্ধতি আসলে কাজের কিছু না। দেখাই গেছে হাতেনাতে।

সব কিছুই আসলে সব কিছুর সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। ধর্ষণ কেন হয়, ক্রসফায়ারের নামে রাষ্ট্রীয় হত্যা কেন হয়, ৫ম শ্রেনীর সমাপণী পরীক্ষার প্রশ্নপত্রও কেন ফাঁস হয়, ব্যাংক থেকে কোটি কোটি টাকা কিভাবে ঋণের নামে হাপিশ হয়ে যায়, রানা প্লাজা-তাজরিন গার্মেন্টস কেন ধ্বসে পড়ে-আগুনে কয়লা হয়, বিশ্বজিৎ-এর ওপর কেন প্রকাশ্য দিবালোকে চাপাতির কোপ নেমে আসে, পাহাড়ে-সমতলে আদিবাসী-সংখ্যালঘুদের ঘরবাড়ি কেন পুড়িয়ে দেওয়া হয়, সুন্দরবন কেন ধ্বংসের পথে যায়, সরকার কেন ক্রমশ স্বৈরাচারী হয়ে ওঠে ইত্যাদি প্রভৃতি নানা প্রশ্নই আসলে একে অপরের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। কোনোটাকে এগিয়ে কোনোটার সমাধান সম্ভব না।

ক্রসফায়ারে হত্যার প্রতিবাদে শুধু একদিনের প্রতিবাদ সমাবেশ করার চেয়ে বরং এই কথাবার্তাগুলোই বেশি করে আলাপ হওয়া দরকার। কী ধরণের সমাজ চাই? সেটা কেন চাই? কিভাবে সেখানে পৌঁছানো যাবে বা সেই পথে হাঁটা শুরু করা যাবে- এ জাতীয় প্রচুর প্রশ্ন তোলা দরকার। আলাপ-আলোচনা করা দরকার।

প্রশ্ন তুলতে শুরু করা উচিৎ সব কিছু নিয়ে। ‘প্রশ্ন করো সব কিছুকেই’। এই বাক্যকেও প্রশ্ন করে বলব, ‘কেন?’ কে জানে! উত্তরও হয়তো লুকিয়ে আছে এই ‘কেন’-র মধ্যে।

ভ্যাটবিরোধী আন্দোলনে অন্যরকম ধানমণ্ডি

সপ্তাহের প্রথম দিন রোববার ঢাকার সড়কগুলোতে থাকে সীমাহীন ব্যস্ততা। কিন্তু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ভ্যাটবিরোধী আন্দোলন সেই পরিচিত সড়কে তৈরি করেছে ভিন্ন রকম পরিস্থিতি। অবরোধের ফলে অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে ধানমণ্ডি-কলাবাগান সংলগ্ন প্রধান সড়কগুলোতে। আজ রোববার সকাল থেকে মানিক মিয়া এভিনিউ, কলাবাগান থেকে আসাদ গেট, ধানমণ্ডির ২৭ নম্বর সড়ক, পান্থপথ মোড় ও সাত মসজিদ রোডের কিছু অংশে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করছেন শিক্ষার্থীরা। দাবি জানাচ্ছেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর আরোপিত ৭.৫ শতাংশ ভ্যাট প্রত্যাহারের।

18

অন্য দিন যেখানে এই সড়কগুলোতে দেখা যায় ব্যক্তিগত গাড়ি, গণপরিবহনের দ্রুত চলাচল, সেখানে আজ রাজপথ মুখরিত হচ্ছে শিক্ষার্থীদের বিক্ষুব্ধ স্লোগানে। ‘শিক্ষা কোনো পণ্য না, শিক্ষা আমার অধিকার’, ‘শিক্ষা কি পণ্য, ভ্যাট কি জন্য’, ‘ভ্যাট দেব না, গুলি কর’ ইত্যাদি স্লোগান মুহুর্মুহু শোনা যাচ্ছে শিক্ষার্থীদের মুখে। সকাল ১০টায় শুরু হওয়া এই অবরোধ সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত চলবে বলে জানিয়েছেন আন্দোলনকারীরা।

সড়ক অবরোধের ফলে ধানমণ্ডি, লালমাটিয়া, মোহাম্মদপুর, কলাবাগানের অভ্যন্তরীণ সড়কগুলোতেও তৈরি হয়েছে যানজট। এ ছাড়া সায়েন্স ল্যাব থেকে ধানমণ্ডিগামী প্রধান সড়ক ও খামাড়বাড়ী মোড় থেকে মিরপুরগামী প্রধান সড়কেও ভোগান্তির মুখে পড়তে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। কোনো যানবাহন না পাওয়ায় অনেকেই হেঁটে রওনা দিচ্ছেন গন্তব্যের দিকে। তবে ফায়ার সার্ভিস, অ্যাম্বুলেন্স, স্কুল-কলেজগামী বাস-ভ্যান, হজযাত্রীদের গাড়ি অবরোধের আওতামুক্ত রেখেছেন আন্দোলনকারীরা।

সড়ক অবরোধের ফলে সাধারণ মানুষকে ব্যাপক ভোগান্তির মধ্যে পড়তে হচ্ছে, এটা জেনেও কেন এমন কঠোর কর্মসূচি দেওয়া হলো জানতে চাইলে ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী রাকিব বলেন, ‘আমরা এই ভ্যাট আরোপের প্রস্তাব শোনার পর নানাভাবে প্রতিবাদ জানিয়েছি। স্মারকলিপি দিয়েছি। শেষপর্যন্ত ১০ শতাংশ ভ্যাট নির্ধারণের জায়গা থেকে সরে এলেও সরকার এখন ৭.৫ শতাংশ ভ্যাট নির্ধারণ করেছে। সরকার আমাদের শান্তিপূর্ণ আহ্বানে সাড়া দেয়নি। ফলে বাধ্য হয়েই আমরা রাজপথ অবরোধ করেছি।’

অবরোধ করে রাখা সড়কের বিভিন্ন অংশে বিক্ষিপ্তভাবে সমাবেশ করেছেন শিক্ষার্থীরা। কোথাও কোথাও দেখা গেছে খণ্ড খণ্ড মিছিল। বড় আকারের জমায়েত লক্ষ করা গেছে ধানমণ্ডি-২৭ নম্বর সড়কের দুই প্রান্তে ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটি ও স্টেট ইউনিভার্সিটির সামনে।

এ ছাড়া আসাদ গেট ও পান্থপথ মোড়েও বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ জানাচ্ছেন। সামনে যে কোনো গাড়ি পড়লেই তারা সেখানে লিখে দিচ্ছেন, ‘No Vat’। কয়েক জায়গায় দেখা গেছে রিকশায় মাইক নিয়ে আন্দোলনকারী সহযোদ্ধাদের সতর্ক করছেন কেউ কেউ। বহিরাগত কেউ যেন আন্দোলনে ঢুকে পড়ে কোনো নাশকতা করতে না পারে সে জন্য সবাইকে সজাগ দৃষ্টি রাখার আহ্বান জানাচ্ছেন।

বিকেল ৫টা পর্যন্ত ধানমণ্ডি এলাকায় কোনো নাশকতা বা অনাকাঙ্ক্ষিত কোনো ঘটনা ঘটেনি। আশপাশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অনেক সদস্য দেখা গেলেও আন্দোলনকারীদের সঙ্গে তাদের কোনো সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটেনি।

সড়ক অবরোধ সোমবারও অব্যাহত রাখে শিক্ষার্থীরা। এই দিনই প্রবল আন্দোলনের চাপে ২০১৫-১৬ অর্থবছরের জন্য প্রত্যাহার  হয় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ওপর আরোপিত ৭.৫ শতাংশ ভ্যাট।

আন্দোলনকারীদের তৃষ্ণা মেটাল পুলিশ

Police Water

 

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে যেকোনো বিক্ষোভ বা আন্দোলনকারীদের মধ্যে সম্পর্কটা প্রায় সবসময়ই হয় সাপে-নেউলে। বারবার সংঘর্ষেও জড়াতে দেখা যায় দুই পক্ষকে। চলমান বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভ্যাটবিরোধী আন্দোলনের প্রথম দিনও পুলিশের সঙ্গে ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। তবে আন্দোলনের পঞ্চম দিনে আজ রোববার হঠাৎ করেই চোখে পড়েছে ভিন্ন রকম দৃশ্য। ধানমণ্ডি ২৭ নম্বর সড়কের সামনে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের পক্ষ থেকে ব্যবস্থা করা খাবার পানির গাড়ি থেকে পানি পান করে তৃষ্ণা মেটাচ্ছেন কড়া রোদের মধ্যে বিক্ষোভরত শিক্ষার্থীরা।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার ওপর আরোপিত ৭.৫ শতাংশ ভ্যাট প্রত্যাহারের দাবিতে কঠোর আন্দোলনে নেমেছেন শিক্ষার্থীরা। শুরু হয়েছে ক্লাস বর্জন ও সড়ক অবরোধ কর্মসূচি। ঢাকার বেশ কয়েকটি স্থানে সড়ক অবরোধ করে আন্দোলন করেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। ধানমণ্ডি ২৭ নং সড়কের সামনে অবস্থান নিয়েছিলেন ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটি, ইবাইস, ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি, ইউল্যাব ও ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীরা। পাশেই সতর্ক অবস্থানে ছিলেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। মূলত তাঁদের জন্যই আনা হয়েছিল একটি খাবার পানির গাড়ি।

কিন্তু কড়া রোদের মধ্যে নিজেদের তেষ্টা মেটাতে শিক্ষার্থীরাও ভাগ বসিয়েছেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের পানির গাড়িতে। পুলিশ সদস্যরাও কোনো আপত্তি জানাননি। স্টেট ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী জামিল হোসেন পানি খাওয়ার পর পুলিশদের দিকে ইঙ্গিত করে মুচকি হেসে বললেন, ‘উনাদের জন্যই এটা আনা হয়েছে। কিন্তু আমরাও এখানে ভাগ বসিয়েছি। উনারা তো এখন পর্যন্ত কিছু বলেননি।’

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভ্যাটবিরোধী আন্দোলনে পুলিশ-শিক্ষার্থী সংঘর্ষও হয়েছে গত বুধবার। সে সময় পুলিশের গুলি ও টিয়ারশেলে আহত হন বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী। তবে পুলিশের সঙ্গে সৌহার্দপূর্ণ সম্পর্কও বজায় রাখতে চাইছেন আন্দোলনকারীরা। রাজধানীর কিছু জায়গায় পুলিশের হাতে ফুল তুলে দিয়েছেন শিক্ষার্থীরা। হাসিমুখে সেলফিও তুলেছেন পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে। আর এসব ছবি এখন ঘুরে বেড়াচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে।

আগামীতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ঘেরাওয়ের হুমকি ছাত্রনেতাদের

পূর্বঘোষণা অনুযায়ী স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ঘেরাও কর্মসূচি পালন করেছে প্রগতিশীল ছাত্রজোট ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ছাত্র ঐক্য। দোয়েল চত্বরে পুলিশের একটি ব্যারিকেড ভেঙে এগিয়ে গেলেও হাইকোর্টের সামনে দ্বিতীয়বারের মতো ব্যারিকেডের মুখে পড়ে আর সামনে এগোতে পারেননি আন্দোলনকারীরা। সেখানেই সংক্ষিপ্ত সমাবেশের পর তারা ফিরে যান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারের সামনে। সমাবেশে পাঁচদফা দাবি মেনে নেওয়ার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান নেতারা। দাবি না মানা হলে ভবিষ্যতে সব ব্যারিকেড ভেঙে দেওয়া ও প্রধানমন্ত্রী কার্যালয় ঘেরাওয়ের হুঁশিয়ারিও শোনা যায় সমাবেশ থেকে।

IMG_3065

বুধবার (২০ মে) দুপুর ১২টায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয় ঘেরাও কর্মসূচিতে অংশ নেওয়ার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে জমায়েত হন প্রগতিশীল ছাত্রজোট ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ছাত্র ঐক্যর নেতাকর্মীরা। সেখান থেকে মিছিল নিয়ে টিএসসি হয়ে দোয়েল চত্বরের সামনে গিয়ে পুলিশের প্রথম বাধার মুখে পড়েন তাঁরা। এসময় সেখানে রায়ট কার ও বিপুল সংখ্যক পুলিশের উপস্থিতি ছিল।  নারী পুলিশ ছিলেন প্রথম সারিতে। বাধার মুখে পড়ে পুলিশের ব্যারিকেড সরিয়ে ফেলেন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা। সহনশীলতার পরিচয় দিয়ে এসময় তাদের কোনো বাধা দেননি পুলিশ সদস্যরা। তবে মিছিলটি আর বেশিদূর এগোতে পারেনি দ্বিতীয় দফায় ব্যারিকেডের মুখে পড়ে। হাইকোর্টের সামনে আবার ব্যারিকেডের মুখে পড়লেও সেটি আর অতিক্রম করতে যাননি আন্দোলনকারীরা। এসময় বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীদের শান্ত করতে গিয়ে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ছাত্র ঐক্যের সমন্বয়ক ও ছাত্র ফেডারেশনের সভাপতি এম এম পারভেজ লেলিন বলেন, ‘এই পুলিশ চাইছে আমরা তাদের ওপর হামলা করে এই আন্দোলনকে যেন নেতিবাচক দিকে নিয়ে যাই। আমরা এই আন্দোলন এগিয়ে নিয়ে যাব। কিন্তু পুলিশের টোপে পা দেওয়া চলবে না।’

সমাবেশে ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি হাসান তারেক বলেছেন, ‘এক মাস পার হয়ে গেলেও নিপীড়কদের গ্রেফতার করতে পারেনি আমাদের পুলিশবাহিনী। এই রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতার বিরুদ্ধে আজকের ছাত্রসমাজ একটি প্রতিকী ব্যারিকেড ভেঙেছে। আগামী দিনে নিপীড়কদের গ্রেপ্তার করা না হলে তাহলে আমরা আমাদের ক্ষোভ শুধু প্রতিকী ব্যারিকেড ভাঙার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখব না।’ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ঘেরাওয়ের হুঁশিয়ারিও দেন তিনি। দাবি না মানা পর্যন্ত আন্দোলন চলবে বলে ঘোষণা করেন সমাবেশে বক্তব্য দেওয়া ছাত্রনেতারা।

সমাবেশে আরও উপস্থিত ছিলেন সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের সভাপতি জনার্দন দত্ত নান্টু, সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের সাধারণ সম্পাদক স্নেহাদ্রি চক্রবর্ত্তী রিন্টু, বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক আশরাফুল আলম সোহেল, ছাত্র গণমঞ্চের আহ্বায়ক শান্তনু সুমন, বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রীর সভাপতি ফয়সাল ফারুক অভি, ছাত্র ঐক্য ফোরামে আহ্বায়ক সরকার আল ইমরান, বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রীর সভাপতি সালমান রহমান, বিপ্লবী ছাত্র যুব আন্দোলনের যুগ্ম আহ্বায়ক জাকি সুমন প্রমুখ।

এর আগে নববর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকায় পয়লা বৈশাখের অনুষ্ঠানে যৌন হয়রানিকারীদের শাস্তির দাবিতে ১১ মে ছাত্র ইউনিয়নের ডাকা কর্মসূচিতে হামলা করে পুলিশ। ছাত্র ইউনিয়নের নেতাকর্মীরা কাকরাইল-মগবাজার সড়কের সার্কিট হাউস মসজিদের সামনে অবস্থান নিলে পুলিশ তাঁদের লাঠিপেটা করে এবং জলকামান দিয়ে হামলা চালায়। এতে সাতজন আহত হন। এ সময় ছাত্র ইউনিয়নের তিন কর্মীকে আটক করে পুলিশ।

‘হক কথা’ কেউ শুনছে কি?

‘ফারাক্কা বাঁধ বাংলাদেশের জন্য হিরোশিমা-নাগাসাকির চেয়েও ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনবে।’ কথাগুলো ৩৯ বছর আগে বলেছিলেন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। মজলুম জননেতার এই ভবিষ্যৎবাণী যে এত নির্মমভাবে বাস্তবে পরিণত হবে সেটা উপলব্ধি করার মতো দুরদর্শিতা তৎকালিন সরকারের কর্তাব্যক্তিদের ছিল না বলেই প্রতীয়মান হয়। যে প্রমত্ত পদ্মা নদীর ‘সর্বনাশা’ রুপ নিয়ে লেখা হয়েছিল বিস্তর গান-কবিতা; সেই পদ্মা নদীর একটি বিশাল অংশ আজ ধুসর মরুভূমি। মাঝেমধ্যে এখানে ওখানে মরীচিকার মতো মেলে জলের দেখা।

bhasani

এমন পরিণতির কথা আশঙ্কা করেই ১৯৭৬ সালের ১৬ মে ফারাক্কা অভিমুখে লংমার্চ করেছিলেন মওলানা ভাসানী। প্রচণ্ড শারিরীক কষ্ট উপেক্ষা করে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন হাজারো মানুষের মিছিলে। ৩৯ বছর আগের এই দিনে রাজশাহীর ঐতিহাসিক মাদ্রাসা ময়দান থেকে শুরু হয়েছিল সেই লংমার্চ। সন্ধ্যা ছয়টা নাগাদ তাঁরা পৌঁছেছিলেন চাঁপাইনবাবগঞ্জ। সেখানে রাত্রী যাপনের পর পরদিন সকাল আটটায় আবার শুরু হয় শিবগঞ্জের কানসাট অভিমুখে যাত্রা। মহানন্দা নদী পার হওয়ার জন্য হাজার মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে কৃত্রিম সেতু তৈরি করেছিলেন নৌকা দিয়ে। বাংলাদেশের সীমানার মধ্যেই লংমার্চ সমাপ্ত হলেও বিপুল মানুষের ঢল দেখে সেদিন নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছিল ভারতীয় সীমান্তে। কানসাটের জনসভায় মওলানা ভাসানী বলেছিলেন, ‘আজ রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও কানসাটে যে ইতিহাস শুরু হয়েছে তা অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর নতুন অধ্যায় সৃষ্টি করবে।’

বাংলার এই মজলুম জননেতার এই কথাটি অবশ্য সত্য হয়নি। ১৯৭৬ সালেরই ১৭ নভেম্বর পরলোকে পাড়ি জমান ভাসানী। আর তাঁর প্রতিরোধের অধ্যায় থেকে যায় অসমাপ্ত। ফারাক্কা টিকে থাকে, আরও শক্তিশালী হয়। আর প্রয়োজনে পানি পান না বাংলাদেশের মানুষ। অসময়ের স্রোত আবার ভাসিয়ে নিয়ে যায় ফসলি জমি, ঘর-বসতি।

আন্তর্জাতিক পানি বন্টন ও ভাগাভাগি নিয়ে দেশে দেশে যে বিরোধ বিদ্যমান, তার মধ্যে অন্যতম হলো ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে গঙ্গা নদীর পানি বন্টন-সংক্রান্ত বিরোধ। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগেই ফারাক্কা বাঁধ নির্মানের উদ্যোগ গ্রহণ করেছিল ভারত। ১৯৫১-৭০ সাল পর্যন্ত প্রায় দুই দশক ধরে আলোচনা হলেও কোনো কার্যকর সমাধানে পৌঁছাতে পারেনি ভারত ও পাকিস্তান। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর আবার শুরু হয় আলাপ-আলোচনা। ১৯৭৫ সালের এপ্রিলে ফারাক্কা বাঁধ সাময়িকভাবে চালুর ব্যাপারে সাক্ষরিত হয় একটি অন্তবর্তীকালীন চুক্তি। এই চুক্তি অনুযায়ী বাঁধটি চালু করার কথা ছিল এক মাস ১০ দিনের (২১ এপ্রিল থেকে ৩১ মে, ১৯৭৫) জন্য। কিন্তু মেয়াদ শেষ হয়ে গেলেও ফারাক্কা বাঁধের কার্যক্রম চালিয়ে যেতে থাকে ভারত। প্রতিবেশী দেশের অনায্য আচরণের বিরোধীতা করে এক বছর পর ১৬ মে ফারাক্কা অভিমুখে লংমার্চ করেছিলেন মওলানা ভাসানী।

কিন্তু তাতে কোনো ফল আসেনি। স্থায়ী সমাধানের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ২০ বছর পর ১৯৯৬ সালে গঙ্গার পানি বন্টন সংক্রান্ত ৩০ বছর মেয়াদী চুক্তি সাক্ষরিত হয় ভারত ও বাংলাদেশ সরকারের মধ্যে। কিন্তু সেই চুক্তিরও ছিল নানান সীমাবদ্ধতা। ফলে একতরফাভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েই গেছে ভাটির দেশ বাংলাদেশ। নদীতে পানি শুকিয়ে যাওয়ায় সেচকাজের জন্য ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহার করতে বাধ্য হয়েছেন কৃষকরা। তাতে যেমন বেড়েছে কৃষিব্যয়, তেমনি নেমে গেছে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর। গত কয়েক বছরে এলাকাভেদে পানির স্তর নেমে গেছে ২৫ থেকে ৪০ ফুট পর্যন্ত। খরা, দাবদাহ বেড়েই চলেছে প্রতি বছর। আর্সেনিকে আক্রান্ত হচ্ছেন নদীপাড়ের অনেক মানুষ।

১৯৭৬ সালে মওলানা ভাসানীর লংমার্চ স্মরণে ১৬ মে পরিচিতি পেয়েছিল ‘ফারাক্কা দিবস’ হিসেবে। কিন্তু সংগ্রামী এই জননেতার শেষজীবনের কথাগুলোও আজ বিস্মৃতির পথে। ভাসানীর ‘হক কথা’ যেন হারিয়ে যেতে বসেছে কালের গর্ভে। আর এভাবে চলতে থাকলে, ২০২৬ সালে গঙ্গার পানি বন্টন সংক্রান্ত চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই হয়তো শুকিয়ে যেতে পারে খালে পরিণত হওয়া নদীগুলোর পানিও।

১৯৯৫ সালে বিশ্বব্যাংকের তৎকালিন সহ-সভাপতি ইসমাইল সেরাজেলদিন বলেছিলেন, ‘এই শতাব্দীতে মানুষ যুদ্ধ করছে তেলের জন্য। কিন্তু পরবর্তী শতাব্দীতে যুদ্ধ হবে পানির অধিকার নিয়ে।’ তেমন নিষ্ঠুর পরিস্থিতির মুখে দাঁড়ালেই কী কেবল মনে পড়বে মওলানা ভাসানীর ‘হক কথা’গুলো?

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ফ্রাংকেনস্টাইন’ কাহিনী

১৮১৮ সালে ইংলিশ ঔপন্যাসিক ম্যারি শেলি রচিত ‘ফ্রাংকেনস্টেইন’ বেশ সাড়া জাগিয়েছিল পশ্চিমা বিশ্বে। পরে রুপালি পর্দাও কাঁপিয়েছে এটির চলচ্চিত্ররূপ। যেখানে দেখা যায় ভিক্টর ফ্রাংকেনস্টেইন নামের এক খ্যাপা বিজ্ঞানী গবেষণাগারে প্রাণ সৃষ্টি করে কীভাবে এক দানবের জন্ম দেন। এবং পরবর্তীকালে এই দানব একের পর এক বিধ্বংসী সহিংস কর্মকাণ্ড করতে থাকে। শেষটায় এই দানবকে থামাতে গিয়ে বহু পথ ছুটতে হয় বিজ্ঞানীকে। সফল হতে পারেন না। প্রাণ হারান ক্লান্তশ্রান্ত হয়ে। চরিত্র আর পরিস্থিতি একটু ওলটপালট করে দিলে অবাক বিস্ময়ে দেখতে পাওয়া যায় যে, ঠিক ঠিক এ রকম একটা ঘটনার পুনরাবৃত্তিই হয়েছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেক্ষাপটে।

শিবির আধিপত্যের এই বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা সময় আওয়ামী লীগের অঙ্গসংগঠন ছাত্রলীগের কোনো প্রকাশ্য তৎপরতা প্রায় ছিলই না। সেখান থেকে কীভাবে এটার পুনর্জন্ম হলো; কীভাবে সে শক্তিশালী হয়ে উঠল এবং কীভাবে দানবীয় সব কর্মকাণ্ড করে নিজের পালন-পোষণকারীর অঙ্গহানি ঘটাতে থাকল; তা দারুণভাবে মিলে যায় ম্যারি শেলির ফ্রাংকেনস্টেইন উপন্যাসের সঙ্গে। যার একেবারে শেষ পর্যায়টা বোধহয় এখন রচিত হচ্ছে।

প্রাণসঞ্চার পর্ব

২০০৭ সালে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জরুরি অবস্থা জারির আগে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিল ছাত্রশিবিরের আধিপত্য। বামপন্থী ছাত্রসংগঠনগুলো যেমন সব সময়ই একটা ক্ষুদ্র অবস্থান নিয়ে থাকে তেমনটা ছিল। মাঝে কিছু সময় জাসদ ছাত্রলীগও ছিল। কিন্তু বাংলাদেশ ছাত্রলীগের তৎপরতা সেভাবে চোখে পড়ত না বললেই চলে। জরুরি অবস্থার মধ্যে নিজ দলের বেশ কয়েকজন নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা এবং পরে তাদের জেলহাজতে থাকতে হলেও ছাত্রলীগের ব্যানার সম্বলিত কোনো মিছিল বা মানববন্ধন বা অন্য কোনো কর্মসূচি ক্যাম্পাসে ছিল না। এমন একটা জিনিসে প্রাণসঞ্চার করে ২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। আওয়ামী লীগ ঘটায় ‘ভোট বিপ্লব’! আর সেই বিপ্লবী জোসে চাঙ্গা হয়ে ক্যাম্পাস থেকে শিবিরকে সরিয়ে নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার তাগিদ বোধ করতে থাকে ছাত্রলীগ।

অবশেষে ১৩ মার্চ ছাত্রলীগ (আওয়ামী ও জাসদ) ও ছাত্রমৈত্রীর সঙ্গে শিবিরের মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। মারা যান ছাত্রশিবিরের নেতা নোমানী। ক্যাম্পাস ‘অস্থিতিশীল’ হয়ে ওঠায় বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় প্রশাসন। আড়াই মাস বন্ধ থাকার পর ১ জুন খুলে দেওয়া হয় বিশ্ববিদ্যালয়।

কিন্তু শিবির মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে, আবার ক্যাম্পাসে অস্থিরতা তৈরি করতে পারে- এমন দোহাই দিয়ে ক্যাম্পাসে জারি করা হয় ‘নয়া জরুরি অবস্থা’। যে কোনো ধরনের সভা-সমিতি-সমাবেশ-সেমিনার-জমায়েত-লিফলেট-প্রকাশনা নিষিদ্ধ করা হয়।

ভয়াল মূর্তিধারণ পর্ব

ক্যাম্পাসকে শিবিরমুক্ত করার মিশন নিয়ে ছাত্রলীগকে অবাধ স্বাধীনতা দেয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। ছাত্রলীগের সশস্ত্র ছেলেদের নিয়ে ক্যাম্পাস দাবড়ে বেড়াতে দেখা গেছে সেসময়ের সহকারী প্রক্টরকে। শিবির জুজ দেখিয়ে সবার মুখ বন্ধ করে দিয়ে ছাত্রলীগকে আদতে দেওয়া হয়েছিল অবাধ স্বেচ্ছাচারের সুযোগ। তার পরিণাম কী হয়েছে সেটা বোঝার জন্য অনেক অনেক ঘটনার মধ্য থেকে অল্প কিছু উল্লেখ করা যেতে পারে :

  •  ২০১০ সালের ১৫ আগস্ট দলের অন্তঃকলহের জের ধরে খুন হন ছাত্রলীগকর্মী নাসরুল্লাহ নাসিম। এ ঘটনায় নয় ছাত্রলীগকর্মীর বিরুদ্ধে থানায় মামলা হলেও আসামিরা জামিনে মুক্তি পায়।
  •  ২০১২ সালের ১৫ জুলাই পদ্মা সেতুর টাকা ভাগাভাগির ঘটনাকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগের তৎকালীন সভাপতি আহমেদ আলী ও সাধারণ সম্পাদক আবু হুসাইন বিপু গ্রুপের কর্মীদের সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান ছাত্রলীগকর্মী আব্দুল্লাহ আল হাসান সোহেল। সেই ঘটনায় দুজনকে বহিষ্কার করা হলেও পরে তাদের বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করে নেয় কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ।
  •  ২০১৪ সালের ৩ এপ্রিল হলের রুমে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান হল শাখা ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রুস্তম আলী আকন্দ। ছাত্রলীগ এই খুনের জন্য দায়ী করে শিবিরকে। কিন্তু এটাও সংগঠনটির পদ-ক্ষমতা সংশ্লিষ্ট নিজেদের অন্তর্দ্বন্দ্বের ফল বলে অভিযোগ আরো অনেকের। (তথ্যসূত্র : সাপ্তাহিক এই সময়)

এ ছাড়া ক্যাম্পাসে অস্ত্রবাজি-টেন্ডার-চাঁদাবাজি নিয়ে অনেকবার নেতিবাচকভাবে সংবাদ শিরোনাম হয়েছে ছাত্রলীগ। প্রশাসন দেখেও না দেখার ভান করে থেকেছে। আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়েছে। বিনিময়ে নিজেরাও সাহায্য নিয়েছে এই ছাত্রসংগঠনটির। ব্যবহার করেছে শিক্ষার্থীদের স্বাধীন তৎপরতা, ন্যায্য দাবির আন্দোলনকে দমিয়ে দেওয়ার কাজে।

আত্মঘাত পর্ব

ছাত্রলীগকে এই অবাধ স্বেচ্ছাচারে মেতে ওঠার সুযোগ করে দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যে নিজেদেরই আত্মঘাতী পরিস্থিতির মধ্যে ফেলে দিয়েছিল সেটাও টের পাওয়া গেল সাম্প্রতিক সময়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ব্যক্তি উপাচার্য লাঞ্ছিত-অপমানিত হয়েছেন ছাত্রলীগ, আওয়ামী লীগের হাতে। ভিসির পদত্যাগের দাবিতে মাঠে নেমেছেন ছাত্রলীগের ‘বিতর্কিত’ নেতাকর্মীরা। (তথ্যসূত্র : ২১ এপ্রিল, ২০১৫; যুগান্তর)

কীভাবে ও কেন ছাত্রলীগ, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়াল, তা জানার জন্য আবারও একটু পেছনে ফিরতে হবে। ২০০৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি রাবির ফলিত পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. আবদুস সোবহানকে উপাচার্য, মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক নুরুল্লাহকে উপ-উপাচার্য ও ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক আবদুল বারীকে রেজিস্ট্রার হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল চার বছরের জন্য। সে অনুযায়ী ২০১৩ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি তাঁদের মেয়াদ শেষ হয়। তার আগ দিয়ে চলে গণনিয়োগের ধুম। ২০ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেটের ৪৪৭তম সভায় দলীয় ভিত্তিতে ১৮৪ জন কর্মচারী, ২৬ জন কর্মকর্তা, ২০ জন শিক্ষক ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী পদে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় ৩১ জনকে নিয়োগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়। কিন্তু এতেও সন্তুষ্ট করা যায়নি চাকরিপ্রত্যাশী সরকার সমর্থকদের। তাঁরা ক্ষুব্ধ হয়ে উপ-উপাচার্যের দপ্তরে হামলা চালান। বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সহসভাপতি মাসুদ রানার নেতৃত্বে সংগঠনের নেতাকর্মীরা প্রশাসন ভবনে তালা লাগিয়ে দেন। সে সময় কিছুদিনের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় ‘অভিভাবকত্বহীন’ অবস্থার মধ্যেও কাটিয়েছে। (তথ্যসূত্র : কালের কণ্ঠ; ২৫ ও ২৮  ফেব্রুয়ারি, ২০১৩)

নতুন করে উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয় মুহম্মদ মিজানউদ্দিনকে। এই আমলেও ছাত্রলীগ থেকে যায় বল্গাহীন ঘোড়া। ছুটতে ছুটতে একসময় তারা আবার চড়াও হয়ে বসে প্রশাসনের ওপর। ২০১৫ সালের ১৫ এপ্রিল রাজশাহী-১ আসনের সাংসদ ও রাজশাহী জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ওমর ফারুক চৌধুরী টেবিল চাপড়ে উপাচার্যকে শাসান। একদিন পর মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ডাবলু সরকারের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ নেতারা উপাচার্যের দপ্তরে ঢুকে তাঁকেসহ বেশ কয়েকজন শিক্ষককে গালাগাল ও হুমকি দেন। গায়ে হাত তোলার অভিযোগও শোনা গেছে। এতদিন যাদের ছত্রছায়ায়, প্রশ্রয়ের আলো-হাওয়া খেয়ে ছাত্রলীগ ফুলেফেঁপে উঠেছে, তারা এবার দাঁড়িয়ে গেছে সেই প্রশাসনের বিরুদ্ধেই। আর প্রশাসনবিরোধী এই তৎপরতার নেতৃত্ব দিচ্ছে বিভিন্ন সময়ে অপকর্মের দায়ে ছাত্রলীগ ও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কৃত ও অস্ত্রবাজরা। (তথ্যসূত্র : যুগান্তর; ২১ এপ্রিল ২০১৫)

সাধারণ শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ভোগান্তি-নিপীড়ন পর্ব

এই পর্বটি চলমান আছে দীর্ঘদিন ধরেই। ছাত্রলীগ-ছাত্রশিবিরের সংঘর্ষ, ছাত্রলীগের অন্তঃকলহের ফলে সংঘর্ষ, নিয়োগবাণিজ্য, নিষেধাজ্ঞার বেড়ি সব সময়ই রুদ্ধ করেছে সাধারণ শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের বিকাশ, স্বাধীন তৎপরতা। ন্যায্য দাবির কথা বলতে গিয়ে খেতে হয়েছে লাঠি-গুলি-হুমকিধমকি। তার কিছু নমুনা :

  •  ২০১২ সালের ২ অক্টোবর : ছাত্রলীগ ও ছাত্রশিবিরের মধ্যে গোলাগুলি চলাকালে পুলিশকে দর্শকের ভূমিকায় দেখা যায়। সংঘর্ষ চলাকালীন ছাত্রলীগের দুই নেতাকে পুলিশের পাশে দাঁড়িয়ে পিস্তলে গুলি ভরতে এবং গুলি করতে দেখা যায়। আহত হয় বেশ কয়েকজন। অথচ তিন-চারদিন পরেই ভর্তি পরীক্ষার্থীদের শুভেচ্ছা জানিয়ে সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্ট মিছিল করলে সেখানে বাধা দেয় ও অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে পুলিশ। ব্যানার ছিঁড়ে ফেলে এবং ছাত্রফ্রন্টের চার নেতা-কর্মীকে গ্রেফতার করে। (তথ্যসূত্র : ৩ ও ১১ অক্টোবর, প্রথম আলো)
  • ২০১২ সালের ১০ অক্টোবর : বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্ধিত ফি-বিরোধী আন্দোলনে ছাত্রলীগ ও পুলিশের যৌথ হামলার প্রতিবাদে মিছিল করলে প্রগতিশীল ছাত্রজোটের মিছিলে হামলা করে পুলিশ। আহত হয় ১০-১২ জন। গ্রেফতার করা হয় পাঁচজনকে। (তথ্যসূত্র : ১১ অক্টোবর, প্রথম আলো)
  • ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্ধিত ফি ও বাণিজ্যিক সান্ধ্যকোর্সবিরোধী আন্দোলনে প্রশাসনিক ভবনের সামনে বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থীর শান্তিপূর্ণ সমাবেশে প্রক্টরিয়াল বডির উপস্থিতিতে গুলি চালায় পুলিশ ও ছাত্রলীগ। এতে গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হন শতাধিক শিক্ষার্থী। মামলা দেওয়া হয় ন্যায্য দাবিতে আন্দোলনকারী বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থীর নামে।
  • ২০১৫ সালের ৩ মার্চ মুক্তচিন্তক অভিজিৎ রায়কে নির্মমভাবে হত্যার প্রতিবাদে মিছিল বের করলে প্রগতিশীল ছাত্রজোটের নেতাকর্মীদের বাধা দেয় পুলিশ। এ সময় পুলিশের সহকারী কমিশনার রকিবুল আলম বলেন, ‘ক্যাম্পাসে শুধুই ছাত্রলীগ মিছিল করতে পারবে, আর কেউ না।’ (তথ্যসূত্র : ৪ মার্চ, ২০১৫; যুগান্তর)

এ ছাড়া বিভিন্নভাবে বিভিন্ন সময়ে পুলিশ ও ছাত্রলীগের স্বেচ্ছাচারী কর্মকাণ্ডের বলী হতে হয়েছে সাধারণ শিক্ষার্থী ও প্রগতিশীল ছাত্রজোটের নেতাকর্মীদের। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় পঙ্গু হয়ে গেছে সাংস্কৃতিকভাবে। ক্যাম্পাসে এখন আর তেমন কোনো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, গান-পথনাটক-কবিতা-আলোচনা সভা-সেমিনার হয় না বললেই চলে। অথচ ১০-১২ বছর আগে শিবিরের রমরমার যুগে দারুণ সরব ছিলেন সাংস্কৃতিককর্মীরা। কোনো কোনো দিন একই সময়ে ক্যাম্পাসের দু-তিন জায়গায় পথনাটক আয়োজিত হতেও দেখা গেছে। আলোচনা-সেমিনার বন্ধ করে দিয়ে তর্ক-বিতর্কের মাধ্যমে মুক্তজ্ঞান চর্চার পরিবেশও রুদ্ধ করে ফেলা হয়েছে। এখানে-সেখানে এখন শুধু দেখা যায় অযাচিত নিষেধাজ্ঞার  দেয়াল-বেড়া-কাঁটাতার।

ভবিষ্যৎ পর্ব

এই পর্বটিই এখন রচিত হতে যাচ্ছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। এটা হতে পারে পচে-গলে যাওয়ার পর্ব। বা হতে পারে সাধারণ শিক্ষার্থীদের প্রতিরোধ পর্ব। প্রশাসন ও ছাত্রলীগের পাল্টাপাল্টি অবস্থানে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিস্থিতি আরো দুর্বিষহ হতে উঠতে পারে। সাধারণ শিক্ষার্থীদের ভোগান্তি আরো বাড়তে পারে। আর শিক্ষার্থীরা যদি নিজেদের ভালোমন্দের বিবেচনা করে সক্রিয় হন, কথা বলা শুরু করেন তাহলে শুরু হতে পারে নষ্ট ছাত্র-শিক্ষক রাজনীতির বিরুদ্ধে পাল্টা আঘাত, প্রতিরোধের কাল।

ম্যারি শেলির উপন্যাসের খ্যাপা বিজ্ঞানী ভিক্টর ফ্রাংকেনস্টেইন তাঁর তৈরি করা দানবটাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেননি। পিছু ধাওয়া করতে করতে শেষটায় প্রাণ হারিয়েছিলেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের পরিণতিও হয়তো তেমনটাই হতে পারে। আর সেই উপন্যাসের দানবসত্তার মতো ছাত্রলীগও শেষটায় কোথায় চলে যাবে, তা কারোরই জানা থাকবে না। একমাত্র সাধারণ শিক্ষার্থীদের মুক্ত-স্বাধীন তৎপরতাই পারে বিশ্ববিদ্যালয়কে আবার প্রাণবন্ত, মুক্ত জ্ঞানচর্চার কেন্দ্রে পরিণত করতে। সে জন্য তুলে নিতে হবে বিশ্ববিদ্যালয়ের সব ধরনের প্রশাসনিক নিষেধাজ্ঞা। বন্ধ করতে হবে ক্যাম্পাসের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ, পুলিশি নিয়ন্ত্রণ। তাহলেই কেবল আবার গান-বাজনায়, নাটক-কবিতায়, মুক্ত জ্ঞানচর্চার তর্ক-বিতর্কে মুখরিত হতে পারবে মতিহার চত্বর।

‘সে-ও কি কোথাও বসে ছবি আঁকে?’

কয়েকদিন আগে সংসদ ভবনের সামনে বসে অনেক রাজা-উজির মারছিলাম আমি আর বন্ধু সুমন। বিশ্বাস-অবিশ্বাসের তর্কে ঢেউ তুলছিলাম মানিক মিয়া অ্যাভেনিউয়ের প্রশস্ত সড়কটাতে। গল্পে-কথায় উল্টিয়ে পাল্টিয়ে দিচ্ছিলাম দেশের সমাজ-রাজনীতি। হঠাৎ করে দেখলাম এক কেতাদুরস্ত মধ্যবয়সী দম্পতি তাদের দুই সন্তান নিয়ে সিএনজি বা ট্যাক্সি ধরার নিমিত্তে সামনে এসে দাঁড়ালেন।

সুমন তার পরিস্কার প্যান্টটা বাঁচানোর জন্য পশ্চাৎদেশের নিচে একপাটি স্যান্ডেল নিয়েছে। (কেতাদুরস্ত হওয়ার জন্য না, কাপড় কাচার ভয়ে) আরেক পা খোলা… রাস্তায়। আমার দুই পায়েরই স্যান্ডেল খোলা। দুই বন্ধু খালি পায়ে সড়ক দাপিয়ে বসে আছি।
কিছুক্ষণ পর দেখা গেল, আমাদের সামনে দাঁড়ানো সেই চার প্রানী ধীক্কার-তিরস্কার আর সন্ধিৎসু জিজ্ঞাসা নিয়ে আমাদের দিকে একটু পর পর তাকাচ্ছে। তারা কদাকিঞ্চিৎ এমন করেন কিনা, সন্দেহ আছে। বাচ্চাগুলো হয়তো ভাবতেও পারে না যে এভাবে খালি পায়ে রাস্তায় বসেও থাকা যায়।

একই সময় আমাদের ঠিক বামপাশেই চায়ের দোকানের কোনা থেকে বোতল-কাগজ টোকাচ্ছে ঐ দম্পত্তির বড় কন্যার বয়সী একটি ছেলে। এই ছেলের কথা হয়তো ঐ মেয়েটা জানে না। তারা ‘বসে আঁকে’। ‘আল্পনা-লতাপাতা’ আঁকে। কদাকিঞ্চিত ‘মহেন্দ্র দত্তর ছাতা’ও আঁকে। কিন্তু যে ছেলেটা ‘কাগজ কুড়িয়ে, বস্তায় ভরে’ একা চলে যায় তার খবর মেয়েটির কাছে পৌঁছায় না।

আমাদের সমাজ-রাষ্ট্র মেয়েটিকেও যেমন বঞ্চিত করেছে খালি সড়কে-সবুজ ঘাসে নগ্ন পায়ে হাঁটার আনন্দ থেকে; ঠিক তেমনি নায্য অধিকার দেয়নি একা চলে যাওয়া ছেলেটাকেও।

এই ছেলেটাকেই হয়তো একদিন কোনো বড় রাস্তার মোড়ে লাল রঙের একটা নির্দোষ ফাঁকা কৌটো কুড়াতে দেখে বেদম মার দেবে ‘আইনশৃঙ্খলা বাহিনী’। সেই দাগ শরীরে নিয়ে নিজের পেট বাঁচানো আর সস্তা কিছু নেশার তাড়নায় ‘কদাকার’ মুখওয়ালা ছেলেটি হয়তো হাতে তুলে নেবে হাত বা পেট্রোলবোমা। কোনো একদিন যদি সেটা ঐ মেয়েটির দিকেই ধেয়ে যায়? মৃত্যু পরোয়ানা নিয়ে?

কয়েক হাতের দুরত্বে থাকা দুইটি ফুটফুটে শিশু এভাবে একে-অপরের ঘাতক হয়ে অবস্থান করছে প্রতিনিয়ত।
মেয়েটিও হয়তো ভেবেছে কখনো কখনো: ‘সে-ও কি কোথাও বসে ছবি আঁকে???’ কিন্তু সেটা শোনানোর ফুরসত হয়নি… তার আগেই তারা একে-অপরের ঘাতক বনে গেছে…

ক্রিকবোমিও পরিস্থিতি: কোন দিকে যাবে ক্রিকেট?

ক্রিকেট নিয়ে বাংলাদেশের মানুষের উত্তেজনার অন্ত নেই… এ তো জানা কথা। কিন্তু ব্যাট-বলের এই খেলাটা যে অনেক ক্ষমতাও ধরে, সেটা অদ্যই জানা গেল।
এসএসসি পরীক্ষা, ইজতেমা… সাধারণ মানুষের নাজেহাল দশা; কোনো কিছুই টলাতে পারেনি আমাদের আপোষহীন নেত্রীকে। হরতাল-অবরোধ অব্যাহত ছিল। কিন্তু হাজার হাজার মাইল দূরে মাশরাফি-সাকিবরা একটা ম্যাচ জিতে সত্যিই স্বস্তি দিয়েছেন বাংলাদেশের মানুষকে। এক দিনের জন্য হলেও হরতাল শিথিল করার ডাক এসেছে আন্দোলনরত ২০ দলের পক্ষ থেকে। ১৪ দলের সরকারি পক্ষ থেকেও এসেছে অনেক অনেক শুভেচ্ছাবার্তা, আর্থিক পুরস্কারের ঘোষণা।

team celebration

তার মানে দেশের মানুষের শিক্ষাদীক্ষা, প্রথাগত ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালন, মানুষের রোজকার বাঁচা-মরার থেকেও গুরুত্বপূর্ণ বাংলাদেশের ক্রিকেট। এ কিন্তু অনেক বড় ব্যাপার একটা দেশের ক্রীড়াঙ্গনের জন্য। প্রশ্ন হচ্ছে: আমাদের ক্রিকেটারদের কাছে এটার গুরুত্ব কতটুকু? ক্রিকেটারদের সঙ্গে সমাজ-রাষ্ট্রের সম্পর্কই বা কী? আদৌ আছে কিনা…

ইতিহাস বলে সম্পর্ক আছে। ১৯৮০ সালের দিকে স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে কথা বলার মাধ্যম হিসেবে ফুটবল মাঠকেই বেছে নিয়েছিলেন ব্রাজিলের কিংবদন্তি ফুটবলার সক্রেটিস। করিন্থিয়ান ক্লাবের মাধ্যমে সংগঠিত করেছিলেন স্বৈরতন্ত্রবিরোধী পাঠাতন। মানুষকে ভাবাতে শুরু করিয়েছিলেন যে তাদেরও বলার অনেক কিছু আছে। স্পেনে জেনারেল ফ্রাঙ্কোর একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে জোর আওয়াজ উঠত বার্সেলোনার ন্যু ক্যাম্প বা অ্যাথলেটিক বিলবাওয়ের সান মেমে স্টেডিয়ামে। নিজেদের স্বকীয়তা-স্বাধীনতার কথা জানান দেওয়ার জন্য ফুটবল ম্যাচগুলোই ছিল কাতালান-বাস্ক জাতিগোষ্ঠীর প্রধান মাধ্যম। খুব সাম্প্রতিককালেও আইভরি কোস্টের স্ট্রাইকার দিদিয়ের দ্রগবা অনেক লড়েছেন যুদ্ধবিধ্বস্ত একটা দেশে শান্তি ফিরিয়ে আনার জন্য।

কোনো স্পোর্টিং ইভেন্ট যে সত্যিই একটা জাতীয় পরিস্থিতিতে প্রভাব ফেলতে পারে, তার বড় প্রমাণ ১৯৮৩ সালে ভারতের ক্রিকেট বিশ্বকাপ জয়। অনেকের মতেই, সেটা ছিল ভারতের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া একটা মুহূর্ত। ১৯৫৩ ও ৫৪ সালে দুইটি ফুটবল ম্যাচের কারণে চূর্ণ হয়েছিল সাম্রাজ্যের অহঙ্কার আর নিপীড়িত মানুষের মনে জাগিয়েছিল স্বাধীন হওয়ার স্বপ্ন। হাঙ্গেরি ৬-৩ ও ৭-১ গোলের ব্যবধানে হারিয়েছিল ইংল্যান্ডকে। ১৯৫৬ সালের হাঙ্গেরিয়ান বিপ্লবের সঙ্গে এই ম্যাচদুটির প্রত্যক্ষ যোগসূত্র ছিল বলেই দাবি করেছিলেন দেশটির প্রখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক পিটার টিমার। ১৯৯৯ সালে তাঁর পরিচালিত ‘৩-৬’ সিনেমাটিতে দেখানো হয়েছিল, রেফারির শেষ বাঁশি বাজার পর রাজনৈতিক বন্দীদের সঙ্গে কোলাকুলি করে বিজয় উদযাপন করেছিলেন কারাগারের রক্ষীরা। দুই বছর পরে অনেকেই একজোট হয়ে লড়েছিলেন সোভেয়েত ট্যাঙ্কের বিরুদ্ধে। খুঁজলে হয়তো এমন আরও অনেক কিছু পাওয়া যাবে।

আবার ঠিক উল্টোভাবে খেলাধুলা শাসকদের লাঠি হিসেবেও ব্যবহৃত হয়েছে যুগ যুগ ধরে। ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ জয়কে ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার সুযোগ হিসেবে দেখেছিলেন দুই দেশের সামরিক জান্তারা। হিটলার জার্মান জাতির শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করার জন্য খেলাধুলাকে বেছে নিয়েছিলেন। স্পেনের জেনারেল ফ্রাঙ্কোও ফুটবলকে অনেকভাবে ব্যবহার করেছেন নিজের ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য। হাঙ্গেরি ও সোভিয়েত সরকারের কাছে খেলাধুলা, বিশেষত ফুটবলটা ছিল কমিউনিজমের আদর্শ প্রতিষ্ঠার লড়াই। হাঙ্গেরির জাতীয় দল ছিল পুরোপুরি সরকারের কর্তৃত্বাধীন। সেসময়ের কোচ গুসতাভ সেবেস বলেছিলেন, ‘পুঁজিবাদ ও কমিউনিজমের লড়াইটা শুধু আমাদের সমাজেই না, চালাতে হবে ফুটবল মাঠেও।’

তথ্যপ্রযুক্তির যুগে এসে বিশাল মাপের বাণিজ্যক্ষেত্রেও পরিণত হয়েছে খেলাধুলা। বৈশ্বিক বাণিজ্যের কথা নতুন করে বলার কিছু নেই। বাংলাদেশেও ক্রিকেটকে খুব সুচতুরভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে নিজেদের পণ্য বিকানোর জন্য। ক্রিকেট দলকে অভিনন্দন জানানোর নাম করে অমুক বিজ্ঞাপন, তমুক বিজ্ঞাপন… এমনকি ৬৪ জেলায় কনসার্ট পর্যন্ত আয়োজন করা হয়। যেটা স্রেফ ব্যবসা ছাড়া আর কিছুই না| মূলধারার গণমাধ্যমের ভাষায়, ‘ক্রিকেটটা মানুষ খায়’- তাই ক্রিকেটের মোড়ক দিয়ে সাজিয়ে নানাবিধ পণ্য পাবলিককে খাওয়ানো যায় খুব সহজে। আবেগে গদগদ হয়ে আমরা খেতেও থাকি ভোগবাদ, শাসকতা-নাশকতার বড়ি।

সবকিছু শেষে প্রশ্ন হচ্ছে একটাই: আমরা কোনদিকে এগুবো??? বাংলাদেশের ক্রিকেট কী শাসক-নাশকদের স্বৈরতন্ত্র জারি রাখার লাঠি হিসেবে ব্যবহার হবে? বেনিয়াদের ব্যবসাপাতির সামগ্রী হবে নাকি সত্যিই মুক্তির স্বপ্ন দেখাবে মানুষকে?

‘আলো হাতে আঁধারের যাত্রী’

Avijit Roy Murder Protest

মুক্তবুদ্ধি রুদ্ধ

একদিকে ৫৭ ধারা-রাষ্ট্র অন্যদিকে মৌলবাদ
নিষেধাজ্ঞা আর নিশ্চুপিকরণ
আমরা কোথায়?

এমন প্রশ্ন সামনে রেখে অভিজিৎ রায় হত্যার প্রতিবাদে রাজু ভাস্কর্যে মোমবাতি প্রজ্জলন করেছেন দমবন্ধকর ঢাকা শহরের কিছু নাগরিক। এখানে না ছিল কোনো মাইক, না কোনো ব্যানার। মুখপাত্রের ভূমিকাতেও দেখা যায়নি কাউকে। কিন্তু রাষ্ট্রীয় নিষেধাজ্ঞা-বিধিনিষেধ আর মৌলবাদের নিশ্চুপ করিয়ে দেওয়ার ভয়াল-সংস্কৃতি থেকে মুক্তি পেতে গেলে যে সাধারণ মানুষকে কোনো না কোনো উপায়ে সংগঠিত হতে হবে, সেই আর্জি স্পষ্টভাবেই ফুটে উঠেছে হাজারো মোমবাতির আলোয়।

দুর্বত্তদের নারকীয় হামলায় নৃশংসভাবে নিহত হওয়া অভিজিৎ রায়ের একটি বইয়ের নাম ‘আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী’। যেখানে তিনি বিজ্ঞানীদের জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার ধারা বর্ণনা করেছেন। যাদের হাত ধরে মানুষ আজকের এই ‘আধুনিক বিজ্ঞানে’র যুগে পৌঁছেছে, তাদের ক্রমবিবর্তন বর্ণনা করেছেন। বৃহস্পতিবার (৫ মার্চ) রাজু ভাস্কর্যের সামনে মোমবাতি প্রজ্জ্বলন কর্মসূচির নামটিও দেওয়া হয়েছিল ‘আলো হাতে আঁধারের যাত্রী’।

অনেক অনেক মানুষের মৃত্যুর মিছিলে আরেকটি নাম হিসেবে যুক্ত হয়েছেন মুক্তচিন্তক অভিজিৎ রায়। এ থেকে পরিত্রাণের উপায় কি? বিচার কি হবে আদৌ? বিচার হলেও কী সমস্যার সমাধান হবে? উত্তর সহজে মিলবে না। তবে একটা বিষয় স্পষ্ট যে সাধারণ মানুষ যতদিন বিচ্ছিন্ন থাকবে, রাষ্ট্রের শাসকতার হাতে নিজের নিরাপত্তার ভার দিয়ে বসে থাকবে ততদিন পর্যন্ত কেউই নিরাপদ থাকবে না। পেট্রোল বোমা, হাত বোমা বা চাপাতির কোপ; যে কোনোটাই ছুটে আসতে পারে ঘাড়-মাথা লক্ষ্য করে। সমাধান একটাই: জনসক্রিয়তা। নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার স্বার্থে, বেঁচে থাকার স্বার্থে সমাজের প্রতিরোধ-শক্তি বাড়ানো। যেটা ক্রমশই প্রায় শূণ্যের কোটায় নিয়ে যাচ্ছে রাষ্ট্র।

অশুভ শক্তি দমনের নাম করে রাষ্ট্র যত বেশি শুভ-স্বৈরতন্ত্র গড়ে তুলবে সাধারণ মানুষের সংকট ততই ঘনিভূত হবে। মানুষের সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টাই পারে সব অশুভ ষড়যন্ত্র রুখে দিতে। রাষ্ট্র শুধু নিজের ক্ষমতার দেয়ালটাই আরও মজবুত করতে চায়। জনগণের নিরাপত্তা বিধানের কোনো তাগিদ রাষ্ট্রের নেই।

খুবই ছোট পরিসরে, ছোট কলেবড়ে হলেও সংগঠিত কিভাবে হওয়া যায়, জনসক্রিয়তা কিভাবে বাড়ানো যায়; সেই ভাবনার খোরাক হতে পারে ‘আলো হাতে আঁধারের যাত্রী’ শীর্ষক এই মোমবাতি প্রজ্জ্বলন কর্মসূচি।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা…; শিখব কি?

কয়েকদিন আগেই আরিফ রেজা মাহমুদ লিখেছিলেন যে,

রাষ্ট্র, ক্রমাগত সমাজকে ক্ষত্রশক্তি শুন্য করে ফেলছে। সমাজের হাজার বছরের সংহতি, পারস্পারিক সহযোগিতা-প্রতিরোধ সব চুরমার করে ফেলছে রাষ্ট্র। ক্রমাগত এক নিষেধাজ্ঞারআঁধারে নিমজ্জিত করে রাখছে আমাদের। উদাহরণ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। ৭ বছর ধরে অব্যাহত আছে নিষেধাজ্ঞা। শিবির জুজু দেখিয়ে এই নিষেধাজ্ঞা চালু হলেও তা আসলে বলবৎ প্রগতিশীল শক্তিরই উপরে। শিবির এখন আউট অফ ক্যাম্পাস-চোরাগোপ্তা দল। তাহলে শিবির ঠেকাতে প্রগতিশীল সংগঠনগুলোকে কর্মকান্ড করতে না দেয়ার অর্থ খুব সোজা। শিবির বিরোধী শক্তির নিক্ষত্রীয়করণ। একই পদ্ধতি সবখানে বিস্তৃত হচ্ছে। হত্যার শিকার হচ্ছেন অভিজিৎরা। সমাজ-প্রতিরোধ না বাঁচলে যে কেউ ষড়যন্ত্র করতে পারবে।
সামাজিক প্রতিরোধ এমন দুর্বল হয়ে পড়ার পরণতি একটাই– দাসত্ব-দীর্ঘ মেয়াদী দাসত্ব।

RU1

সেই অভিজিৎ হত্যার বিচার চাইতে গিয়েই আবার পুলিশি বাধার মুখে পড়তে হয়েছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রগতিশীল শিক্ষার্থীদের। শিবির-মুক্ত ক্যাম্পাস গড়ার নামে রাবিকে নিষেধাজ্ঞার বেড়ি পড়ানো হয়েছিল ২০০৯ সালে। তারপর থেকে ঘটা এমন কয়েকটি ঘটনার বিবরণ দিয়েছেন Sohraab Hossaiin…

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এবং পুলিশ কাহিনীঃ

০২ অক্টোবর ২০১২।
ছাত্রলীগ এবং ছাত্রশিবিরের মধ্যে গোলাগুলি চলাকালে পুলিশকে দর্শকের ভূমিকায় দেখা যায়। সংঘর্ষ চলাকালীন ছাত্রলীগের ২ নেতাকে পুলিশের পাশে দাঁড়িয়ে পিস্তলে গুলি ভরতে এবং গুলি করতে দেখা যায়।

০৬ অক্টোবর ২০১২। ভর্তি পরীক্ষার্থীদের শুভেচ্ছা জানিয়ে সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট রাবি শাখা মিছিল করলে সেখানে বাধা দেয় অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে, ব্যানার ছিড়ে ফেলে এবং ছাত্র ফ্রন্ট এর চার নেতাকর্মিকে (সোহরাব, সুজন, রিহান, তৌফিক) গ্রেফতার করে।

১০ অক্টোবর ২০১২।
বাকৃবিতে বর্ধিত ফি বিরোধী আন্দোলনে ছাত্রলীগ ও পুলিশের যৌথ হামলা এবং আন্দোলনকারি সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট এর ১১ নেতাকর্মির নামে দায়ের করা মিথ্যা মামলা ও বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহারের দাবিতে রাবি ক্যাম্পাসে প্রগতিশীল ছাত্রজোট মিছিল করলে মতিহার থানার এসি হাসানাত এর নেতৃত্বে হামলা করা হয়, আহত হন ১০/১২ জন জোট নেতাকর্মি, গ্রেফতার করা হয় ৫জনকে (ছাত্র ফ্রন্ট এর সোহরাব, সুজন, সাদিক; বাসদ এর দেবাশীষ রায়, ছাত্র ফেডারেশন এর মোসাদ্দেক)

২ ফেব্রুয়ারি ২০১৪
বর্ধিত ফি ও বাণিজ্যিক সান্ধ্যকোর্স বিরোধী আন্দোলনে রাবি প্রশাসনিক ভবনের সামনে দশ সহস্রাধিক শিক্ষার্থীদের শান্তিপূর্ণ সমাবেশে প্রক্টরিয়াল বডির উপস্থিতিতে এবং নির্দেশে পুলিশ এবং ছাত্রলীগের গুলি। সাংবাদিকসহ শতাধিক আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী গুলিবিদ্ধ। ফলাফলঃ আন্দোলনকারিদের নামে মামলা।

[চলবে]

RU2

ক্যাম্পাসে রাষ্ট্রীয় কলকব্জা ঢুকিয়ে দেওয়ার, পুলিশি পাহাড়া বসানোর, নায্য কথা বলতে আসা শিক্ষার্থীদের মারধর করার পরিণামে ক্রমাগত প্রাণহীন হয়ে পড়েছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। রাজনৈতিক তৎপরতা চালাতে গিয়ে তো সরাসরি ডাণ্ডা-বেড়ির ঘা খেতে হচ্ছে। মতিহার চত্বর নিষ্প্রাণ হয়ে পড়ছে সাংস্কৃতিকভাবেও। ক্যাম্পাসে এখন কি ১০ বছর আগের মতো সেমিনার-আলোচনা সভা হয়? পথনাটক-মঞ্চনাটক হয়? গান-বাজনা হয়? হাঁফ ছাড়ার মতো মুক্ত পরিবেশ আছে? উত্তর নেতিবাচকই হওয়ার কথা।

অথচ ১০ বছর আগে শিবিরের দাপুটে উপস্থিতির মধ্যে, তাদের ভয়- ভীতি প্রদর্শনের মুখেই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় হাজার গুনে সরব ছিল রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিকভাবে…

শিবির দমনের নামে “মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী”রা নিজেদের ক্ষমতা একচেটিয়াকরণ করেছেন শুধু। স্রেফ ফায়দা লুটেছেন অন্য সবার মুখ বন্ধ করে দিয়ে। এদিকে শিবির কিন্তু মাঝেমধ্যেই জানান দিয়েছে নিজেদের উপস্থিতি। সেগুলো ঠেকাতে পারেননি রাষ্ট্রের পাণ্ডারা।

বাংলাদেশের বৃহত্তর পরিসরেও এমন ঘটনা ঘটার আশঙ্কা থাকে। জাতীয় পরিস্থিতিতে যদি সবার মুখ বন্ধ করে দিয়ে, কাউকে কোনোরকম কথা বলতে না দিয়ে, সভা-সমিতি-মিছিল-মিটিং সব বন্ধ করে দিয়ে মৌলবাদ নির্মুল বা জঙ্গি দমন শুরু করা হয়… তাহলে পরিণতি কী হতে পারে সে ধারণা পাওয়ার জন্য রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে তাকানোই যায়

ক্রিকবোমিও পরিস্থিতি: বড় অসময়ে এসেছে বিশ্বকাপ!

বাংলাদেশ ক্রিকেট পাগল একটা দেশ। অনেকটা থোরবড়িখাড়া ধরণের হলেও তাদের ‘টাইগার’দের নিয়ে গর্ব-ভালোবাসার অন্ত নেই বাংলাদেশের মানুষের। সেই বাংলাদেশ পঞ্চমবারের মতো অংশ নিয়েছে ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় আসর বিশ্বকাপে। সাধারণ একটা সিরিজের ম্যাচ হলেও যেখানে উত্তেজনার অন্ত থাকে না, সেখানে বিশ্বকাপের সময় তো নাওয়া-খাওয়া ভুলে শুধু ক্রিকেট গেলার দশা হয়। কিন্তু এবার তেমনটা হবে কিনা, বলা মুশকিল। কারণ এবারের বিশ্বকাপ যে এসেছে… বড় অসময়ে।

বিশ্বকাপ ক্রিকেট এসেছে দেশের এক ওলটানো-পালটানো সময়ে… যখন সকালে বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় মনে হয় সন্ধায় বেঁচে ফিরব তো!… হাতবোমার হাত থেকে হাত-পা বাঁচাতে পারব তো? পেট্রোলবোমার আগুনে পুড়ে যাবে না তো মুখটা? কোনো মতে খেয়েপড়ে বেঁচে থাকাও না… শুধু বেঁচে থাকাটাই যে এখন বড় সংগ্রামের বিষয়। এইরকম একটা প্রাণঘাতী-অস্থির সময়ে দুয়ারে হানা দিয়েছে বিশ্বকাপ ক্রিকেট। এই ক্রিকবোমিও পরিস্থিতির মধ্যে এবারও কী আমরা ফেটে পড়তে পারব ক্রিকেটীয় আনন্দ-উল্লাসে বা আক্ষেপ-আফসোসে; রাগে-ক্ষোভে?

Cricket Bomd Bangladesh Situation

খেলাধুলা যে জাতীয় রাজনীতি-অর্থনীতির সঙ্গে খুব ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে যেতে পারে তার প্রমাণ আমরা অতীতে অনেক পেয়েছি। কখনো বা এটা হয়েছে নিপীড়িততের প্রতিবাদের পন্থা, সংগঠিত হওয়ার উপায়। কখনো বা হয়েছে শাসকদের ছড়ি। কখনো বা মাত্র একটি খেলার প্রভাবে সাধিত হয়েছে বিশাল মনোজাগতিক পরিবর্তন।

ক্রিকেটও কিন্তু আমাদের জাতীয় জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে গেছে ওতোপ্রতোভাবে। কোন সরকারের আমলে ক্রিকেট বা ফুটবল দল কত বেশি সাফল্য পেয়েছে-এগুলো পরিসংখ্যান ব্যবহৃত হয় রাজনীতিতে। ক্রীড়াঙ্গনে কেমন টাকা বরাদ্দ করা হবে সেটাও আমাদের অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ অংশ। আর ক্রিকেট আমাদের মনোজগতে কতটা প্রভাব ফেলে সেটা নতুন করে বলার কি আছে?

ক্রিকেটের সঙ্গে আমাদের ‘দেশপ্রেম’ও জড়িয়ে গেছে খুব সুনিপুনভাবে। ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ ধারণ করা যেমন দেশপ্রেম… সবচেয়ে বড় পতাকা বানিয়ে রেকর্ড গড়াটাও যেমন দেশপ্রেম… ক্রিকেটে বাংলাদেশকে সমর্থন করাটাও তেমন দেশপ্রেমের কাতারে পড়ে গেছে। দেশপ্রেম যেমন নিঃস্বার্থ… বাংলাদেশ দশকে সমর্থন করার ব্যাপারটাও নিঃস্বার্থ। ‘টাইগাররা জিতুক আর হারুক… সঙ্গে আছি’। কোনো চাওয়া-পাওয়া নাই, শুধু ভালোবেসে যাব- টাইপ ব্যাপার। সমর্থকদের আবেগে থরথর হয়ে বলতে শোনা যায়, ‘বাংলাদেশ এগিয়ে চলো, জয় তোমাদের হবেই’ জাতীয় কথাবার্তা। ‘একাত্তরে যেভাবে হানাদার বাহিনীর হাত থেকে দেশ স্বাধীন করেছি সেভাবে আমরা এবার বিশ্বকাপ জয় করব’ এমন সংযোগ রেখাও টানতে দেখা যায় কাউকে কাউকে। ক্রিকেটারদের অনুপ্রেরণা দেওয়ার জন্য ৬৪ জেলায় কনসার্ট, নাচ-গানের আয়োজন করা হয়। ঠিক যেন ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশের’ যুগোপযোগী ভার্সন। অনেক সময় এমন অনুভূতি পাওয়া যায় যেন মনে হয় যে ঐ ক্রিকেট দলটাই পুরো বাংলাদেশ। এর বাইরে আর কিছু নেই।

কিন্তু দেশের মানুষের মরোমরো দশার মধ্যে এই গ্রামীনফোন-বাংলালিংক মার্কা আবেগীয়-ক্রিকেটীয় দেশপ্রেম দেখানো কতটা শালীন-শোভন; তা নিয়ে সংশয় জাগে। যেটা স্রেফ ব্যবসা ছাড়া আর কিছুই না| তার চেয়ে বরং ক্রিকেট আমাদের সমাজ-রাজনীতিতে কেমন প্রভাব রাখছে সেটাই দেখা যাক খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। দেখা যাক এরকম একটা অস্থির সময়ে ক্রিকেট বিশ্বকাপ আমাদের জাতীয় জীবনে…চিন্তায়… মূলধারার গণমাধ্যমে, সামাজিক গণমাধ্যমে… জাতীয় রাজনীতি, আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে কিভাবে প্রভাব ফেলছে…

ক্রিকেটীয় কূটনীতির দেখা ইতিমধ্যে পাওয়াই গেছে: মোদি-হাসিনার ক্রিকেটীয় শুভেচ্ছা বিনিময়। ক্রিকেটকে উপলক্ষ্য করে কূটনৈতিক যোগাযোগ হচ্ছে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর। ভবিষ্যতে আরও কী কী ঘটে সেটা দেখার অপেক্ষা থাকল।

মুক্ত-বিশ্ববিদ্যালয় নাকি মুক্ত-বাজার?

গত ২০ জানুয়ারী থেকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলন শুরু করেছিলেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। তাদের দাবি ছিল বর্ধিত বেতন-ফি প্রত্যাহার ও সান্ধকালীন বাণিজ্যিক মাস্টার্স কোর্স চালুর সিদ্ধান্ত বাতিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাণিজ্যিকীকরনের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলেছিলেন হাজার হাজার শিক্ষার্থী। কোনো আন্দোলনে এত বিপুল পরিমাণ শিক্ষার্থীর অংশগ্রহণ বহুদিন পর দেখা গেছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। শিক্ষার্থীদের তীব্র আন্দোলনের মুখে ১ ফেব্রুয়ারী বর্ধিত ফি বাড়ানোর সিদ্ধান্তটি সাময়িকভাবে স্থগিত করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। কিন্তু শুধু স্থগিত না, সিদ্ধান্তটা পুরোপুরি প্রত্যাহার এবং সান্ধকালীন মাস্টার্স কোর্স বন্ধের দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেয় শিক্ষার্থীরা। এই কয়দিন ‘বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ধৈর্য্য ধরে মোকাবিলা করছিল নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি’। কিন্তু এবার ভেঙ্গে গেল তাদের ধৈর্য্যর বাঁধ। বেরিয়ে পড়ল সেই চিরাচরিত নিপীড়ণমূলক চেহারা। এক দিন পরেই শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর লেলিয়ে দেওয়া হলো পুলিশ আর ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীদের। প্রকাশ্যে বন্দুক-পিস্তল নিয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর চড়াও হলো আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনী আর প্রশাসনের পেটোয়া বাহিনী। নির্বিচারে গুলি চালিয়ে আহত করা হলো শতাধিক শিক্ষার্থীকে। আর চূড়ান্ত পরিণতি হিসেবে অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হলো বিশ্ববিদ্যালয়।

8_1
ইতিমধ্যে পত্রপত্রিকা-টেলিভিশন মারফত গোটা জিনিসটা যখন জাতীয় ইস্যুতে পরিণত হলো, তখন দেখা গেল মধ্যবিত্ত শিক্ষিত সমাজের বৃহদাংশই, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল কাজটা কী, সেটাই প্রায় ভুলতে বসেছে। আলু-পটলের মতো শিক্ষাকেও, মুক্ত জ্ঞানচর্চার কেন্দ্রকেও এখন ফেলে দেওয়া হয়েছে পণ্যের কাতারে। ফলে এই যুক্তি অহরহই শুনতে পাওয়া যায় যে, ‘বেতন তো বাড়বেই। পাঁচ বছর আগে যেই জিনিসের দাম ছিল দুই টাকা এখন সেটা দশ টাকা। সেই তুলনায় তো বাড়েই নি বলা চলে।’ বা ‘সান্ধকালীন কোর্সটা তো কতজনকে উচ্চশিক্ষার সুযোগ করে দিচ্ছে, ফলে ক্ষতি কী? বরং ভালোই তো।’ আর যেভাবে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় বাড়ছে, গোটা সমাজটাই যখন শুধু কেনাবেচার উপরেই চলছে, তখন এমনটা হওয়াই যে স্বাভাবিক, তাতে অবাক হওয়ারও আসলে কিছু নাই। ফলে একটা দেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় নামের সায়ত্ত্বশাসিত বস্তুটা আছে কেনÑ এই প্রশ্নটাই এখন তোলার দরকার।

‘শিক্ষা-ব্যবসা, একসাথে চলে না’
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা লেখাপড়া করে খেটে খাওয়া মানুষের করের টাকায়। একদম গোড়ায় দেখলে দেখা যায় যেটা আসলে কৃষক-শ্রমিকদের প্রত্যক্ষ শ্রমের ফসল। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশ্নে এই মানুষগুলোর শ্রম-ঘামের কথা শুরুতেই মাথায় রাখতে হবে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ সমাজকে এমন ধরণের জ্ঞানের যোগান দেওয়া যা দিয়ে উন্নতি-অগ্রগতির পথে হাঁটা যাবে। যে জ্ঞান সহায়ক হবে মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন করা কাজে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সেই সমাজ-প্রগতি অর্জনের জন্য জ্ঞানচর্চা করার কথা, নতুন নতুন জ্ঞান সৃজন করার কথা। শুধু চাকরি-বাকরি পাওয়ার জন্য একটা সার্টিফিকেট প্রদান বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ না। প্রদান বলছি কেন, এখন তো তারা সার্টিফিকেট বেচতেই শুরু করে দিয়েছেন। কিন্তু জ্ঞান-বিদ্যা তো বিক্রির জিনিস না। শিক্ষকদের যদি উচ্চশিক্ষা না পাওয়াদের জন্য এতই উদ্বেগ থাকে, তাহলে তারা নিয়মিতভাবেই আরেকটা সান্ধকালীন শিফট চালু করুক। সরকারের কাছ থেকে বেশি টাকা দাবি করুক। কিন্তু সেটা না করে, ‘অনেককে সুযোগ করে দিচ্ছি’, এই মহান দোহাই দিয়ে তারা নগদ নারায়নের পূজা করবেন। বিশ্ববিদ্যালয়কেও বাজার বানাবেন।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের চেতনাবিরোধী এই বাণিজ্যিক পদক্ষেপের বিরুদ্ধে অনেকবারই আওয়াজ তুলেছিলেন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। ‘শিক্ষা-ব্যবসা, একসাথে চলে না’, এই শ্লোগানে এর আগেও অনেকবার মুখরিত হয়েছে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। যারই সর্বশেষ সংযোজন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এই আন্দোলন। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে নৈশ/সান্ধকালিন বা বৈকালিক; কোনো ধরণের বাণিজ্যিক কোর্সই গ্রহণযোগ্য না। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এই দাবিটাই তুলেছিলেন। তারা কোনো ‘নৈরাজ্য’ করছিলেন না। শান্তিপূর্ণভাবে নিজেদের দাবিদাওয়ার কথা তুলে ধরছিলেন।

বিশ্ববিদ্যালয় চালানোর আর্থিক ভার রাষ্ট্রকেই নিতে হবে

রাষ্ট্র যদি বিশ্ববিদ্যালয় চালানোর ব্যয়ভার পরিপূর্ণভাবে বহন না করে আর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যদি শিক্ষার্থীদের ঘাড়ে পা দিয়ে সেই টাকাটা তুলবার চেষ্টা করা হয়, তাহলে সেটাই রীতিতে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। আর্থিকভাবে অসচ্ছল পরিবারের ছেলেমেয়েদের তখন সেই টাকাটা জোটানোর সামর্থ্য নাও থাকতে পারে। ইতিমধ্যেই বিশ্ববিদ্যালয়ের বড়লোকীকরণ অনেক ক্ষেত্রেই শুরু হয়ে গেছে। কয়েক বছর আগেও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে আসা এমন শিক্ষার্থীদের দেখা যেত, যাদের আর্থিক অবস্থা খুবই অসচ্ছল। ছেলে বা মেয়েকে শিক্ষিত করার বাসনা নিয়ে অতি কষ্টে অর্থের যোগান দিতেন তাদের বাবা-মা। এখন এমন ঘরের ছেলেমেয়েদের খুব বেশি দেখা যাবে কিনা, সন্দেহ আছে। নতুন করে বেতন-ফি বাড়ানো হলে সংখ্যাটা আরও অনেক কমে যাবে। বেতন-ফি না বাড়িয়ে রাষ্ট্রকেই বরং বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্ণ ব্যয়ভার বহন করতে বলা হোক না কেন? শিক্ষকদের তো উচ্চকণ্ঠে বলা উচিৎ যে, অনুৎপাদনশীল খাতগুলোতে বরাদ্দ কমিয়ে শিক্ষাখাতে বেশি বরাদ্দ দেওয়া হোক। কিন্তু সেই দাবি, এমনকি নিজেদের বেতন-ভাতা বাড়ানোর দাবিও তারা কখনো তোলেননি। তারা রাষ্ট্রক্ষমতার পদলেহন করে চলেছেন; শিক্ষার্থীদের বলির পাঁঠা বানিয়ে। শিক্ষার্থীরা যখন ক্রমাগত চিপা খেতে খেতে ফুঁসে উঠছেন, তখন তারা পুলিশ-পেটোয়া বাহিনী নামিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়টাই দিচ্ছেন বন্ধ করে। কিন্তু এভাবে আর কত?

আর কত শিবির জুজু?
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলনে ন্যাক্কারজনকভাবে হামলা চালিয়েছে সরকার সমর্থিত ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা। প্রকাশ্যে অস্ত্র হাতে শিক্ষার্থীদের উপর চড়াও হতে দেখা গেছে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের। পুলিশ সেসময় পাশে দাঁড়িয়ে থেকেও তাদের কিছু বলেনি। ছাত্রলীগের ভাষ্যমতে সাধারণ শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলনে নাকি শিবির ঢুকে গিয়েছিল। এই শিবির জুজু দেখানো হচ্ছে দীর্ঘদিন ধরে। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়কে পচিয়ে ফেলা হয়েছে এই শিবির জুজ দেখিয়ে। শিবির দমনের নাম করে বিশ্ববিদ্যালয়ে অবাধে দুর্নীতি, দলীয়করণ করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। অবাধে সন্ত্রাস চাঁদাবাজি করে এসেছে ছাত্রলীগ। দেশের অন্যতম প্রধান একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেসব ন্যাক্কারজনক ঘটনার কথা অনেকেই জেনেছেন পত্রপত্রিকা মারফত। নতুন করে বলার কিছু নেই। আর এসবের প্রতিরোধ করতে গেলে বরাবরই দেখানো হয়েছে শিবির জুজ। এটা যে নিজেদের দুর্নীতি-লুটপাট আড়াল করার জন্যই করা হয় সেটা বুঝতে কারো আর বাকি নেই। হাজার হাজার শিক্ষার্থী, যারা নিজেদের অস্তিত্ব বাঁচানোর জন্য প্রতিবাদে সামিল হয়েছে, তারা শিবির না। শিবির প্রতিরোধের জন্য ছাত্রলীগ প্রকাশ্যে অস্ত্র হাতে মহড়া দেয় নি। প্রশাসনের সঙ্গে যোগসাজস করে শিক্ষার্থীদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলন বানচাল করার জন্যই চড়াও হয়েছিল প্রশাসনের গুন্ডারা। শিবির প্রতিরোধ তো দূরে থাক, সাধারণ শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে গুঁড়িয়ে দেওয়ার জন্য ছাত্রলীগই যদি শিবিরের সঙ্গে হাত মেলায় তাহলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই।

‘শিবঠাকুরের আপন দেশে/আইনকানুন সর্বনেশে’!
গুলি খেয়ে, স্বল্প সময়ের নোটিশে বিশ্ববিদ্যালয় ত্যাগ করেও নিস্তার পাচ্ছে না আন্দোলনরত সাধারণ শিক্ষার্থীরা। এবার তাদের ওপর নেমে আসছে আইনি সন্ত্রাসের খাঁড়া। বেআইনি সমাবেশ, মারামারি, সরকারি কাজে বাধাদান ও ভাঙচুরের অভিযোগে চারটি মামলা করেছে পুলিশ ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এমনকি প্রকাশ্যে সন্ত্রাস করা ছাত্রলীগও একটা মামলা করেছে তাদের মিছিলে হামলা করার জন্য। সবগুলো মামলায় নামে-বেনামে অসামী করা হয়েছে ৭৯০ জন শিক্ষার্থীকে। মামলায় যাদের নাম উল্লেখ করা হয়েছে, তাদের পরিচয়টুকু পর্যন্ত জানাচ্ছে মতিহার থানা। তদন্তের স্বার্থে নাকি ক্ষতি হবে। বুঝতে কিছুই বাকি থাকে না যে, ‘শিবিরের চর’, ‘চক্রান্তকারী’, ‘বিশ্ববিদ্যালয়কে অস্থিতিশীল করে তোলার চেষ্টারত বিশেষ মহল’Ñ ইত্যাদি নাম দিয়ে এখন আইনি জুলুম নেমে আসবে আন্দোলনকারীদের ওপর। পুলিশ তাদেরকে খুঁজে খুঁজে বের করবে যারা উচ্চকণ্ঠে আওয়াজ তুলেছিলেন ন্যায়ের পক্ষে। আর বেশুমার ঘুরে বেড়াবে অস্ত্র হাতে মহড়া দেওয়া সন্ত্রাসীরা। এ তো সেই ‘শিবঠাকুরের আপন দেশে/আইনকানুন সর্বনেশে’!
বরাবরই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন নিজেদের মতো করে যে কোনো সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন। হাস্যকর হলেও সত্যি যে বাংলাদেশে স্বৈরশাসন থাকার সময় পর্যন্তই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র-সংসদ চালু ছিল। ১৯৯১ সালে ‘গণতান্ত্রিক’ সরকার আসার পর থেকেই সেটা উবে গেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রমে অংশগ্রহণের একমাত্র পথ, ছাত্র সংসদ আর চালু থাকেনি। ফলে নিজেদের দাবির কথাটা জানাতে হলে এভাবেই কাসরুম ছেড়ে রাস্তায় নামতে হয় শিক্ষার্থীদের। নিজেদের স্বার্থবিরোধী কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হলে এভাবে আন্দোলন করা ছাড়া তাদের আর কোনো উপায় থাকে না। আর এই আন্দোলন করতে গিয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীরা কোনোরকম সহিংস আচরণ করেনি। মারামারি-ভাঙচুর করেনি। বরং তারাই হুমকিধামকি-মারধোরের শিকার হয়েছে, গুলি খেয়েছে। কিন্তু উল্টো এখন তাদেরই পড়তে হবে নানাবিধ নিপীড়ণের মধ্যে।

বিশ্ববিদ্যালয়ই আশা
বাংলাদেশের ইতিহাসে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বরাবরই একটা বাতিঘর হিসেবে কাজ করেছে। হাজারো অবক্ষয় সত্ত্বেও এখনো ন্যায়-সাম্য-স্বাধীনতার প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে বিশ্ববিদ্যালয়। এখনো বিশ্ববিদ্যালয়ে মুক্তিপরায়ন শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের পদচারণা আছে বলেই সমাজে কিছু আশা আছে।
ইতিমধ্যেই রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ চরমভাবে বাড়িয়ে দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্ত পরিসর অনেকটাই সংকুচিত করে ফেলা হয়েছে। রাষ্ট্রকর্তৃত্বের শুঁড় আষ্টেপৃষ্টে পেঁচিয়ে ধরেছে স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়কে। যার পরিণতি হিসেবে আমরা প্রতিনিয়তই বিশ্ববিদ্যালয়ের লজ্জাজনক সব দুর্নীতি-লুটতরাজের খবর পত্রপত্রিকায় দেখি। এত কিছুর পরও সমাজকে প্রগতির পথে নিয়ে যেতে পারে এমন একটা প্রতিষ্ঠান পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘটে যাওয়া একটা ‘তুচ্ছ ঘটনা’ই কিন্তু কাঁপিয়ে দিয়েছিল মহা দাপুটে সেনা সমর্থিক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ভিত। খুব সাম্প্রতিক কালেরটা বললাম। আগে আরও কত বড় বড় ঘটনা ঘটেছে সেটা সবাই জানেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যে আরও একবার সমাজে ন্যায় প্রতিষ্ঠার পক্ষে আওয়াজ তুলেছেন, সেজন্য তাদেরকে অভিনন্দন ও ধন্যবাদ।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সান্ধকোর্স বিরোধী আন্দোলন আরও একবার সুযোগ করে দিয়েছে সমাজে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা কী হবে সেটা নিয়ে কথা তোলার। বিশ্ববিদ্যালয়ে কী শুধু সার্টিফিকেট বিক্রি হবে? জামাত-শিবির দমনের নামে অবাধে দুর্নীতি-দলীয়করণ, সন্ত্রাস-চাঁদাবাজী হবে? নাকি এটা স্বাধীন-সায়ত্ত্বশাসিত একটা প্রতিষ্ঠান হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে? সমাজকে প্রগতির পথে এগিয়ে যাওয়ার জন্য পথপ্রদর্শক হিসেবে কাজ করবে? তেমনটা করতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বাধীনভাবে জ্ঞানচর্চা-অনুশীলনের সুযোগ থাকতে হবে। কোনোভাবেই সেটাকে পুলিশি প্রহরায় পরিচালিত একটা বাজার বানানো যাবে না।