Archive for the ‘ গল্প ’ Category

ধ্যানমগ্ন ঋষি… এবং…

১.

বেশ কিছুকাল আগের কথা। দিকে দিকে শুধু যুদ্ধ। কোথাও শান্তি নাই। হিংসা জন্ম নিয়াছে মানুষের মনে। এক দেশের মানুষের সাথে আরেক দেশের মানুষের কোনো যোগাযোগ নাই। যেটুকু আছে, সেটা শুধুই যুদ্ধের। এইরকম পরিস্থিতিতে এক ঋষি কিছুতেই ইহা মানিয়া লইতে পারিতেছিলেন না। তিনি ইহা হইতে উত্তরণের পথ খুঁজিতে তৎপর হইলেন। অতঃপর “মানুষ পরস্পরের সহিত একটা অভিন্ন বন্ধনে আবদ্ধ হইবে”- ঈশ্বরের নিকট এই প্রার্খণা করিবার লক্ষ্যে ধ্যানে বসিলেন তিনি।

২.

বহুদিন পরে ঋষির ধ্যান ভাঙ্গিল। ঋষি স্বপ্নে দেখিলেন, ঈশ্বর তাঁকে বলিতেছেন, “বৎস দ্যাখো, পৃথিবীর মানুষ একটা অভিন্ন বন্ধনে আবদ্ধ হইয়াছে।” চরম একটা প্রশান্তি ঋষির মনে ছড়াইয়া পড়িল। ঋষি অতঃপর উঠিয়া এই নতুন দুনিয়া দেখিতে বাহির হইলেন। বন-জঙ্গল পার হইয়া ঋষি লোকালয়ে প্রবেশ করিলেন। দুনিয়া আসলেই বদলাইয়া গিয়াছে। ঋষি অবাক বিস্ময়ে এই নতুন দুনিয়া দেখিতে লাগিলেন। চারিদিকে আলো ঝলমল করিতেছে। উঁচু উঁচু বাড়িঘর। লোকজন ব্যস্ত পায়ে হাঁটাহাঁটি করিতেছে। ঋষি কোনো কিছুর মধ্যেই যুদ্ধ-বিগ্রহের কোনো ছাপ খুঁজিয়া পাইলেন না। ঋষি চরম আনন্দিত হইয়া এক সুবেশা তরুণের কাছে গিয়া এই নতুন জায়গার নাম জানিতে চাইলেন। তরুণটি কিছুক্ষণ অবাক বিস্ময়ে ঋষির দিকে তাকাইয়া তার হাতের একটা চৌকোনা যন্ত্রে কী যেন টেপাটেপি করিতে থাকিল। ঋষি বুঝিতে পারিলেন না ব্যাপারটা। তিনি অতঃপর আরো চার-পাঁচ জনের কাছে গিয়া একই কথা জানিতে চাহিলে, সেখানেও তিনি এই একই রকমের ব্যবহারই পাইলেন। ঋষি চরম বিস্মিত হইলেন। কিছুটা বিব্রতও হইলেন। ঈশ্বরের প্রতি কিঞ্চিত অভিমানও জন্মাইল তাঁর। এই নতুন দুনিয়ার আচার-ব্যবহার সম্পর্কে কেন ঈশ্বর তাঁকে কিছু বলিয়া দ্যান নাই? মানুষ কোন বন্ধনে আবদ্ধ হইয়াছে? তিনি তো তা দেখিতে পাইতেছেন না। এখন পযন্ত তিনি কোনো মানুষকে অন্য কোনো মানুষের সাথে কথা বলিতে দ্যাখেন নাই। সবাই শুধু কী একটা বাক্সের মতো জিনিস টেপাটেপি করে।

৩.

কয়েকটা দিন অতিবাহিত হবার পর… ঋষিকে দেখা গেল, তিনি ক্ষুব্ধভাবে একটা রাস্তার ধারে দাঁড়াইয়া আছেন। কিছুক্ষণ আগে তাহার সহিত এক সহৃদয় ব্যক্তির (ঋষির নিকট তিনি সহৃদয়, কিন্তু সবাই তাহাকে অর্ধ উন্মাদ বলিয়া সম্মোধন করিয়া থাকে) সাক্ষাৎ হইয়াছে। তিনি ঋষিকে এই নতুন পৃথিবী সম্মন্ধে কিঞ্চিত আলোকপাত করিয়াছেন। ঋষি তাহার নিকট হইতে জানিতে পারিয়াছেন, বর্তমান যুগের নাম “ফেসবুক যুগ”। এই যুগে সবাই একে অপরের “বন্ধু”। “ফেসবুক বন্ধু!” ইন্টারনেট নামক এক প্রযুক্তি আবিস্কৃত হইয়াছিল একসময় এই পৃথিবীতে। এবং তারপর ফেসবুক নামক একটা সাইট খোলা হয় সেখানে। এখন সবাই এই ফেসবুকের সদস্য। মানুষ এখন দোকানে গিয়ে কেনাবেচা করে ফেসবুক দিয়ে। সবকিছুর লেন-দেন হয় ফেসবুক দিয়ে। এমনকি সামনাসামনি দেখা হলেও যোগাযোগ করে ফেসবুকের চ্যাটিং অপশনে গিয়ে। এতো কিছু শোনার পর ঋষি আর শান্ত থাকিতে পারিলেন না। সামনে যে জনকেই পাইলেন, তাকেই এই অসুর দুনিয়া থেকে বেরিয়ে সত্যিকার দুনিয়ার দিকে তাকাতে বলিলেন। তিনি নানাভাবে সবাইকে বুঝাইতে লাগিলেন। কিন্তু লোকজন তাঁকে বলিল, আপনি শব্দদূষণ করিতেছেন… দয়া করে ফেসবুকে আসুন। অবশেষে কয়েকদিন ধরে নানাভাবে চেষ্টা করেও যখন তিনি এই দুনিয়ার কিছুই বদলাইতে পারিলেন না, তখন তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন ফেসবুকে প্রবেশ করেই তিনি এর একটা বিহিত করবেন। সুতরাং তিনি একটা দোকানে ঢুকিলেন মোবাইল নামক একটা বাক্স হাসিল করার উদ্দেশ্যে যার মাধ্যমে নাকি ফেসবুকে প্রবেশ করা যায়। অতঃপর মোবাইলটি হাতে পাইয়া খুশি হইয়া ভাবিলেন, এবার তিনি ফেসবুকে ঢুকিয়াই সবাইকে লইয়া ফেসবুকের দুনিয়া হইতে বাহির হইবেন।

৪.

কয়েক মাস পরের কথা। দেখা গেল ঋষি একটা মোবাইল হাতে নিমগ্ন হইয়া টেপাটেপি করিতেছেন। তার মোবাইল স্ক্রীনে লেখা উঠেছে, “কী অবস্থা”?

সহ লেখক: বাধন আহমেদ

সময়

প্রতিদিনের মতো সেদিনও অনেক রাত করে বাড়িতে ফিরেছিল লোকটা। ক্লান্ত-বিধ্বস্ত অবস্থায়। দরজা খুলে ভিতরে ঢুকতেই সে দেখতে পেল, তার ৭ বছরের ছেলেটিকে।
‘বাবা, একটা প্রশ্ন করি?’, মলিন মুখে বলেছিল ছেলেটি।
‘হ্যাঁ, বাবা। বলো।’
‘তুমি ঘন্টায় কত টাকা আয় কর বাবা?’
‘এটা নিয়ে তোমার ভাবতে হবে না সোনা। তুমি এটা জেনে কী করবে?’ কিছুটা বিরক্ত বলেছিল লোকটি।
‘আমি শুধু জানতে চাই। বলো না! তুমি ঘন্টায় কত টাকা পাও?’
‘তোমার জানতেই হবে! ঘন্টায় আমি পাই ১০০ টাকা।’
‘ওহ’! কিছুটা যেন আশাহত হলো ছেলেটা। তারপর পায়ের পাতার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে নিচু স্বরে বলল, ‘আমাকে কী তুমি ৫০ টাকা ধার দেবে, বাবা?’
এবার সত্যিই কিছুটা রেগে গেল লোকটি। ‘ও, তোমার এটা শুধু এজন্য জানা দরকার যে, তুমি আমার কাছে কত টাকা নিতে পারবে তোমার ঐসব ফালতু খেলনা কেনার জন্য? এক্ষুনি সোজা তোমার ঘরে যাও। আর চিন্তা কর যে, তুমি কত স্বার্থপর। আমি প্রতিদিন কত খাটা-খাটনি করছি, আর তুমি শুধু তোমার খেলনার কথাই চিন্তা করছ।’
আর একটি কথাও না বলে ধীর পায়ে নিজের ঘরে চলে গেল ছেলেটি। খুব আস্তে বন্ধ করে দিল দরজাটা।
ঘটনার আকস্মিকতায় কিছুক্ষণ বিমুঢ় হয়ে থাকল লোকটা। চিন্তা করতে থাকল, এত ছোট বয়সেই ছেলে এইভাবে টাকা চাইতে শুরু করেছে! ঘন্টা খানেক পর কিছুটা ধাতস্থ হলো সে। ভাবল, হয়ত জরুরি কোন দরকারেই টাকাটা চেয়েছে তার ছেলে। সে তো কখনোই এভাবে টাকা চায় না। কিছুটা অনুতপ্ত হয়ে ছেলের ঘরের দরজার কাছে আসল লোকটা।
‘ঘুমিয়ে গেছ বাবা?’, স্নেহমাখা কণ্ঠে জানতে চাইল লোকটা।
‘না, বাবা। জেগেই আছি।’
‘আমি বোধহয় তোমাকে একটু বেশিই বকা দিয়েছি। সারাদিন অনেক কাজ করতে হয়েছে, অনেক ঝামেলার মধ্যে ছিলাম। তুমি কী খুব বেশি রাগ করেছ? এই নাও তোমার ৫০ টাকা।’
সঙ্গে সঙ্গে লাফ দিয়ে বিছানা থেকে নামল ছেলেটি। উচ্ছাসিত হয়ে জড়িয়ে ধরল বাবার গলা। ‘ওহ! অনেক ধন্যবাদ বাবা!’ বলেই আবার চলে গেল বিছানায়। বালিশের নিচ থেকে বের করে আনল অনেকগুলো খুচরো পয়সা আর কিছু টাকা। সবগুলো টাকা ছোট্ট হাতটাতে নিয়ে বাবার দিকে তাকাল ছেলেটা।
এবার আবার অবাক হওয়ার পালা লোকটার। আবার কিছুটা রেগে যেতেও শুরু করল সে। ‘তোমার কাছে এতগুলো টাকা আগে থেকেই ছিল? তাহলে আবারও আমার কাছে চাইলে কেন?’
‘হ্যাঁ, কিছু ছিল। কিন্তু ঐটুকুতে আমার হতো না।’ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বাবার দিকে তাকিয়ে ছেলেটা আবার বলল, ‘বাবা, এখন আমার কাছে ১০০ টাকা আছে। আমি কী তোমার এক ঘন্টা সময় কিনতে পারি?’ কিছুটা কাতর আর্তিই ছিল বোধহয় ছেলেটার কণ্ঠে।