Archive for the ‘ ইতিহাস ’ Category

বিপ্লব মানে আনন্দ, বিপ্লব মানে ‘টোটাল অর্গাজম’!‍

আহ! কী অদ্ভুত এক সময়ই না কাটিয়েছেন প্যারিসের মুক্তিকামী মানুষেরা। ৫০ বছর আগে, ঠিক এই সময়টাতেই স্বপ্নের এক সমাজ গড়ার নেশায় বুঁদ হয়ে ছিলেন লাখো মানুষ। ছাত্র-শ্রমিক-জনতা, এক কাতারে দাঁড়িয়ে ভাঙতে চেয়েছিলেন পুরোনো অনড়-অনায্য-অসাম্যের ঘুনে ধরা সমাজটাকে। গড়তে চেয়েছিলেন নবতর ভবিষ্যত। যেখানে সাম্যের প্রতিশ্রুতি ছিল। স্বাধীনতার প্রতিশ্রুতি ছিল।

বিপ্লব-বিদ্রোহের এক বাঁধভাঙা জোয়াড় খুলে দিয়েছিল সৃজনশীলতা, কল্পনাপ্রতিভার দ্বার। অসাধারণ সব কাব্যিক স্লোগান-গ্রাফিতিতে জীবন্ত হয়ে উঠেছিল ১৯৬৮ সালের প্যারিস। ‘সব ক্ষমতা চাই কল্পনার হাতে’ – এই স্লোগানটি থেকেও বুঝতে পারা যায়, ফ্রান্সের তরুণ সেই প্রজন্ম কল্পনাশক্তি আর সৃজনশীলতার বিকাশকে কতটা গুরুত্ব দিয়েছিলেন। তাঁরা বলেছিলেন, ‘ক্রিয়া যেন স্রেফ প্রতিক্রিয়া না হয় – ক্রিয়া মানে সৃজনক্রিয়া’।

তাঁরা বলে দিয়েছিলেন, ‘মানা করা নিষেধ’! এমন কোনো বিধিনিষেধ দেওয়া যাবে না, যা কল্পনার ডানা ছেঁটে দেয়, সৃজনশীলতার পায়ে বেড়ি পড়ায়। ৬৮-র সেই ফরাসী তরুণ প্রজন্মের উদাত্ত আহ্বান ছিল, ‘যা কিছু শিখেছ ভুলে যাও, শুরু করো তোমার স্বপ্নের হাত ধরে’।

আর তাঁরা সেই কাঙ্ক্ষিত স্বপ্নের সমাজ গড়তে চেয়েছিলেন ‘প্রেমে আর প্রেমে; প্রতিবাদে-প্রতিরোধে’**। উপলব্ধি করেছিলেন যে, ‘যত বেশি আমি প্রেম করি, তত বেশি আমি রচনা করতে চাই বিপ্লব; আর যত বেশি আমি রচনা করি বিপ্লব, তত বেশি আমি প্রেম করতে চাই।’

সর্বোপরি ১৯৬৮ সালের প্যারিস বসন্ত তুলেছিল আনন্দের অধিকারের দাবি। জীবনের সুখ আস্বাদনের আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করেছিলেন প্যারিসের শিক্ষার্থীরা। শুধু শাসন-শোসন দিয়েই না, বুর্জোয়া শাসকশ্রেণী যে মানুষের সুখহরণ করছে, সেটা খুব স্পষ্টভাবে বলেছিলেন প্যারিস বসন্তের তরুণরা, ‘সমস্ত সুখের বারোটা বাজানো ছাড়া বুর্জোয়াদের অন্য কোনো সুখ নেই।’

সাম্য-স্বাধীনতার দাবি তুলে আসলে সুখময়, আনন্দে পূর্ণ এক জীবনযাপনের আহ্বান এসেছিল ৫০ বছর আগের প্যারিস থেকে। স্বপ্নাতুর সেই প্রজন্মের কাছে ‘সুখ একটা নতুন আইডিয়া’ ছিল। তাঁরা ঘোষণা করেছিলেন, ‘স্থায়ী সুখের অবস্থা’। কমিউনিস্ট মেনিফেস্টোর আদলে তাঁরা লিখেছিলেন, ‘দুনিয়ার মজদুর- আনন্দ করো!’ ’একঘেঁয়েমি ছাড়া আমাদের হারাবার কিছুই নেই – জয় করবার জন্য রয়েছে আস্ত এক আনন্দ-পৃথিবী।’

সুখ, আনন্দ! এই-ই তো আসলে মানুষের আত্মিক আকাঙ্ক্ষা। আমরা যেন তা ভুলতেই বসেছি। তাই বারবার মুগ্ধ দৃষ্টি ফিরে যায় ৬৮-র প্যারিস বসন্তের দিকে। কী দুর্দান্তভাবেই না তারা বলেছিলেন এই মর্মকথাগুলো। পুরো বিশ্বের মানুষকে এক আনন্দময় পৃথিবীর স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন, এখনও দেখাচ্ছেন।

প্যারিস বসন্তের তরুণ প্রজন্ম ছুঁড়ে ফেলতে চেয়েছিল একঘেঁয়ে জীবনের জঞ্জালকে। ঘোষণা করেছিলেন, ‘এমন পৃথিবী আমরা চাই না যেখানে ক্ষুধায় না মরার গ্যারান্টি পেতে গিয়ে একঘেঁয়েমিতে মরার ঝুঁকি তৈরি হয়।’ তাঁরা বাঁচতে চেয়েছিলেন প্রতি মুহূর্তে। বলেছিলেন, ‘বাঁচার অধিকার চেয়ে বেড়ায়-ও না – বাঁচতে শুরু করো।’

তাঁরা চেয়েছিলেন উত্তেজনা, রোমাঞ্চ, অ্যাডভেঞ্চারে পরিপূর্ণ এক জীবন। আর যখন তাঁরা দেখেছিলেন যে, পুরোনো সমাজটা এসবের কিছুই করতে দেবে না তখন তাঁরা লিখেছিলেন, ‘সকল প্রকার অ্যাডভেঞ্চার বিলুপ্ত করেছে যে সমাজ, একটাই যে অ্যাডভেঞ্চার তার বাকি আছে তা হলো এই সমাজটাকেই বিলুপ্ত করে দেওয়া।’

কোনো মহান কেউ এসে এমন স্বপ্নের একটা সমাজ গড়ে দিয়ে যাবে, এমন ভাবনাও প্রত্যাখ্যান করেছিল প্যারিস বসন্ত। তারা আগেই বলে দিয়েছিল, ‘আমাকে মুক্ত করতে এসো না – তার ব্যবস্থা আমি নিজেই করব’। বিপ্লব-বিদ্রোহটা তাদের কাছে ছিল নিজ নিজ উপলব্ধির প্রশ্ন। তাই তারা উচ্চারণ করেছিলেন, ‘বিপ্লবের মালিক কোনো অমুক কমিটি-তমুক কমিটি নয় – বিপ্লব তোমার’। কমিটি গড়ার আহ্বানও অবশ্য ছিল, ‘গড়ে তোল স্বপ্ন দেখা কমিটি’! তাঁদের কাছে ‘স্বপ্ন থেকে বাস্তবে পৌঁছানোর সক্রিয় রাস্তাটুকুই [ছিল] বিপ্লব’।

আবার শুধু আত্মত্যাগ আর বলিদান দেওয়ার সেকেলে বিপ্লবের ধ্যানধারণাতেও আস্থা রাখতে পারেননি, বিশ্বাস স্থাপন করতে পারেননি প্যারিসের তরুনরা। তারা চেয়েছিলেন বিপ্লবের প্রতিটি মুহূর্ত উদযাপন করতে। বলেছিলেন, ‘যে বিপ্লবের জন্য দরকার আমাদের আত্মবলিদান তা আসলে আব্বুদের বিপ্লব।’ আকাঙ্ক্ষিত সমাজ আর সেই সমাজ বাস্তবে রূপ দেওয়ার লড়াই; উভয় ক্ষেত্রেই গৎবাঁধা সব ধ্যানধারণা বিসর্জন দিয়েছিল প্যারিস বসন্ত।

উদ্ধৃতিচিহ্নের মধ্যে থাকা প্রায় সব বাক্যই নেওয়া হয়েছে সেলিম রেজা নিউটনের অচেনা দাগ বইয়ের ‘বন্ধুত্ব-বসন্ত-বিপ্লব: প্যারিস থেকে শাহবাগ’ শীর্ষক অংশ থেকে। নিউটনের লেখার কিছু অংশ নিয়েই ইতি টানি।

“খোদ বিপ্লব সংক্রান্ত মুখস্থ-যান্ত্রিক-ছকবাঁধা চিন্তাপ্যারেডের পক্ষীবুলিকে বদলে দিয়েছিল প্যারিস বসন্ত। বদলে দিয়েছিল খোদ বিপ্লবের কমনসেন্স। আমরা কি কোনোদিন ফিচেল বা রাশভারি কোনো পার্টি আমলার মুখে ভুলেও শুনেছিলাম যে বিপ্লব মানে আনন্দ? হ্যাঁ। বিপ্লব মানে আনন্দ। বিপ্লব মানে ‘টোটাল অর্গাজম’। বিপ্লব চায় পূর্ণাঙ্গ পুলকে ভরে উঠুক আমাদের যাপিত জীবন – আজ, আগামীকাল, প্রতিদিন।”

——————————–

সেলিম রেজা নিউটনের অচেনা দাগ বইয়ে আরও বিস্তারিত আলাপ আছে প্যারিস বসন্ত নিয়ে। পৃষ্ঠা (৩৭-৪৪)। আগ্রহীরা চাইলে অনলাইনেও পড়তে পারেন এই লিংকে গিয়ে: https://goo.gl/o1x8QX

খুবই সংক্ষেপে প্যারিস বসন্তের ইতিহাস জানতে পড়ুন: প্যারিস বসন্ত: ‘বাস্তববাদী হও, অসম্ভবের দাবি তোলো’! ; প্যারিস ১৯৬৮ লিফলেট: “সংস্কার? না; বিপ্লব? হ্যাঁ

** মামুনুর রশিদের লেখা ‘ফিলিস্তিনের গান’ থেকে। পুরো কবিতা: https://arts.bdnews24.com/?p=4852

প্যারিস ১৯৬৮ লিফলেট: “সংস্কার? না; বিপ্লব? হ্যাঁ

১৯৬৮ সালের মে মাসে বিপ্লবের উত্তাল হাওয়ায় উড়ছিল প্যারিসসহ পুরো ফ্রান্স। বিশ্ববিদ্যালয় দখল করে নিয়েছিলেন শিক্ষার্থীরা। সমাজে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা কী, শিক্ষার্থীসমাজের ভূমিকা কী, কিভাবে বৈষম্যমুক্ত স্বাধীন জীবনযাপন করা যায়- এমন সব প্রশ্নে-বিতর্কে তোলপাড় হয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। শিক্ষার্থীদের ডাকে কলকারখানা বন্ধ করে আন্দোলনে সামিল হয়েছিলেন ফ্রান্সের শ্রমিকরা। গড়ে উঠেছিল শত শত বিপ্লবী কমিটি। ওপরের লিফলেটটি তেমনই এক Revolutionary Action Committee- থেকে প্রকাশ করা হয়েছিল। তারা দখল করেছিল প্যারিসের বিখ্যাত ওদেওন থিয়েটার।

 

আমাদের এই আন্দোলন কোনো ‘ইজম’ অনুসারী না। আমাদের কোনো তকমা নেই। আর আমরা সেটা চাইও না। আমাদের মূল কথা একটাই: বিপ্লব।

একারণেই আমাদের কোনো পতাকা নেই। ওদেওন থিয়েটারের মাথায় যে লাল পতাকাটা ঝুলছে, তার সঙ্গে কমিউনিজমের কোনো সম্পর্ক নেই। এটা একটা সতর্কতার প্রতীক মাত্র। একই রকমভাবে কালো পতাকাটাও নৈরাজ্যবাদীদের প্রতীক না। এটা দিয়ে আমরা বলতে চেয়েছি: থামো।

আমরা নিজেদের উপস্থিতি জানান দিতে চাই আর নিজেদের তৎপরতা জারি রাখতে চাই। বর্তমান এই সমাজের উদ্দেশে, এর সংস্কারকারীদের উদ্দেশে, ও এটাকে টিকিয়ে রাখতে যারা কাজ করে যাচ্ছেন তাদের উদ্দেশে আমরা বলছি: ‘যথেষ্ট হয়েছে’।

আমাদের কোনো মতবাদ নেই। আছে শুধু একটা সহজ নীতি: সমাজকে পরিচালিত হতে হবে ব্যক্তির ভালো-মন্দ ও ইচ্ছা অনুযায়ী। এর উল্টোটা না। পরিণামে, ব্যক্তির নানা পদক্ষেপই গড়বে নতুন সমাজ।

বর্তমানে সমাজই ব্যক্তিমানুষের সব কিছুর আদল গড়ে দেয়। শেষপর্যন্ত ব্যক্তি হয়ে দাঁড়ায় একটা উপকরণ মাত্র, যে কিনা শুধু পুঁজিবাদের দাসত্ব করে যায়- পরিণত হয় উৎপাদন ও ভোগের একটা কলকব্জায়।

সংস্কার দিয়ে (সেটা যত বড় আকারেরই হোক না কেন) এই সমস্যার গোড়ায় আঘাত করা যাবে না। খুব বেশি হলে সেই সংস্কার কয়েক মাস বা বছরের জন্য বদলাতে পারে ব্যক্তির শোষণ, বৈষম্য ও বিচ্ছিন্নতার চেহারা। কিন্তু এরপর মানুষ আরও বেশি করে আজ্ঞাবহ হয়ে পড়ে পুঁজিবাদী শাসনে।

আমাদের যা দরকার তা হলো: এই সমাজের আমূল পরিবর্তন। এই রূপান্তরের জন্য যা-ই করতে হোক না কেন- সেটা আমাদের করতে হবে। আমাদের অন্য কোনো বিকল্প ভাবনা বা মঞ্চ নেই। কারণ আমরা বিপ্লব চাই, সংস্কার না। আমাদের আন্দোলনের মাধ্যমে তৈরি করতে হবে সেই বৈপ্লবিক বাস্তবতা। পঙ্গু-অচল, বিচ্ছিন্নতা তৈরি করা এই সমাজটা আমাদের ধ্বংস করতে হবে।

শিক্ষার্থীরা সেই প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছিলেন তাদের বিদ্যায়তনিক জগতে নানাবিধ প্রশ্ন উত্থাপন করে। আর এখন সেই কাজটা বাস্তবে করতে চান শ্রমিক, শিল্পী, দিনমজুর, চাকরিজীবীসহ সকল স্তরের জনতা। তারা এই স্বপ্ন বাস্তব করতে চান জাতীয়ভাবে। তারপর ছড়িয়ে দিতে চান আন্তর্জাতিক অঙ্গনে।

বৈপ্লবিক বিভিন্ন ধ্বংসাত্মক কাজকে আমরা অনেক ক্ষেত্রেই সৃজনশীল বলে মনে করি। বিদ্যমান নানা কাঠামোকে চ্যালেঞ্জ জানানোর মাধ্যমে আমরা নতুন সেই সমাজের নানা তত্ত্বগত কাঠামো নির্দিষ্ট করতে পারি, যে সমাজে বিপ্লবের জন্ম হবে।

আমরা বর্তমানে আছি একটা প্রাক-বৈপ্লবিক সময়ে, যেটা একই সঙ্গে ধ্বংসাত্মক। এই স্থায়ী সংগ্রামটাই সমাজের সকল সত্যিকারের প্রগতি নিয়ে আসে। বিপ্লবের সময় এটা নিয়ে আসবে একটা ইতিবাচক বাস্তবতা। কিন্তু সেটা কোনোভাবেই সুনির্দিষ্ট কিছু হবে না। কারণ প্রথাগত বা প্রমাণিত বিপ্লব বলে কিছু নেই।

আর তাই আমরা বলি: বিপ্লব হতে হবে দীর্ঘস্থায়ী অথবা তা একেবারেই হবে না। প্রতিবাদ-আন্দোলনও একইভাবে হবে দীর্ঘস্থায়ী।”

প্যারিসের ১৯৬৮ বিদ্রোহ সম্পর্কে আরও জানতে পড়ুন: প্যারিস বসন্ত: ‘বাস্তববাদী হও, অসম্ভবের দাবি তোলো’!

প্যারিস বসন্ত: ‘বাস্তববাদী হও, অসম্ভবের দাবি তোলো’!

৫০ বছর আগের এই রকম এক বসন্তে, ফ্রান্সে উঠেছিল বিদ্রোহ-বিপ্লবের উতাল হাওয়া। সংগঠিত হয়েছিল দেশটির ইতিহাসের অন্যতম বড় শ্রমিক ধর্মঘট। প্রচলিত রাষ্ট্র-সমাজের ভিত্তি ধরে টান দিয়েছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। শ্রমিকরা দখল করে নিয়েছিলেন কারখানাগুলো। দাবি তুলেছিলেন নতুন শ্রম-সম্পর্কের। বিশ্ববিদ্যালয় দখল করে শিক্ষার ভিত্তি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন শিক্ষার্থীরা। সমাজের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সম্পর্ক কী, সমাজের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পর্ক কী- এসব প্রশ্ন তুলে পুরো সমাজকেই ঢেলে সাজানোর স্বপ্ন ছিল অনেকের চোখে।

১৯৬০-এর দশকে বিশ্বজুড়েই দেখা গেছে বিদ্রোহ-বিপ্লবের পরিস্থিতি। যুক্তরাষ্ট্রে চলছিল নাগরিক অধিকার আন্দোলন, ভিয়েতনাম যুদ্ধবিরোধী আন্দোলন। পশ্চিম ইউরোপজুড়ে উঠেছিল নারী অধিকার, সমকামীতার অধিকারের দাবি। শ্রমিক আন্দোলনও দানা বাঁধছিল নতুন তৎপরতার সঙ্গে। ১৯৬৮ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের আধিপত্য চ্যালেঞ্জ করে বিদ্রোহ শুরু করেছিলেন চেকোস্লোভাকিয়ার মানুষ। যা স্মরণীয় হয়ে আছে প্রাগবসন্ত হিসেবে। বৈশ্বিক রাজনীতির কথা চিন্তা করলে ৬০-এর দশকে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা হিসেবে হয়তো চিহ্নিত করা হবে ভিয়েতনাম যুদ্ধকে। কিন্তু ১৯৬৮ সালের প্যারিস বিদ্রোহ এখনও ভাবিয়ে তোলে সমাজচিন্তক, পরিবর্তনকামীদের। রাজনৈতিক অভিজাত শ্রেণী, কর্তৃত্বপরায়নতা ও প্রাত্যহিক জীবনের নানা রাষ্ট্রীয় আমলাতান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠেছিলেন ফ্রান্সের মানুষ।

১৯৬৮ সালের মে মাসের শুরু থেকে ফ্রান্সে দৃশ্যমান হয়ে ওঠে শিক্ষার্থীদের স্বতঃস্ফূর্ত বিদ্রোহ। যার বীজটা আসলে রোপন করা হয়েছিল ১৯৬৭ সালে। সে বছর নঁতের বিশ্ববিদ্যালয় (Nanterre University) কর্তৃপক্ষ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল মেয়েদের হলে ছেলে শিক্ষার্থীদের যাতায়াতের ওপর। এই নিষেধাজ্ঞার প্রতিবাদেই ক্ষোভ দানা বাঁধতে শুরু করেছিল বিশ্বাবদ্যালয়ের তরুণ-তরুণীদের মনে।

শিক্ষার্থী-পুলিশের সংঘর্ষ

১৯৬৮ সালের মার্চে ঘটে যায় আরও একটি ঘটনা। নঁতের বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু প্রগতিশীল চিন্তক-সংগঠক দখল করেছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি প্রশাসনিক ভবন। আর বিশ্ববিদ্যালয়ের কাউন্সিল রুমে একটি সভা করেছিলেন। যেখানে তাঁরা ফরাসী সমাজের শ্রেণী বৈষম্য, রাজনৈতিক আমলাতান্ত্রিকতা, বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার নীতি, অর্থবরাদ্দ ইত্যাদি বিষয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। প্রাণবন্ত তর্ক-বিতর্ক চালিয়েছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন পরে পুলিশ ডেকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার চেষ্টা চালায়। তবে সে যাত্রা সেখানে কোনো সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেনি। শিক্ষার্থীরা তাদের দাবিদাওয়া সম্বলিত একটি প্রকাশনা তৈরি করে বিশ্ববিদ্যালয় ভবন ছেড়ে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। এই ঘটনাটি পরবর্তীকালে পরিচিতি পায় ‘২২ মার্চের আন্দোলন’ হিসেবে।

কোনো সংঘর্ষের ঘটনা না ঘটলেও নঁতের বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন পরে এই ‘২২ মার্চ আন্দোলন’-এর নেতৃস্থানীয়দের বিরুদ্ধে শৃঙ্খলামূলক ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ নেয়। বহিষ্কারের ঘোষণা দেওয়া হয় বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থীকে। এ নিয়ে প্রশাসন ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে দ্বন্দ্ব-টানাপোড়েনের জের ধরে ২ মে নঁতের বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করা হয়। এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ফুঁসে ওঠেন প্যারিসের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। পরের দিন ৩ মে একটি প্রতিবাদ সভা আয়োজন করা হয় সরবোন বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানে তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দেওয়া ও শিক্ষার্থীদের বহিস্কারের হুমকি দেওয়ার বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলেছিলেন।

এই স্ফূলিঙ্গই পরে রূপান্তরিত হয় দাবানলে। ৫ মে থেকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দখল নিতে থাকেন শিক্ষার্থীরা। গড়ে উঠতে থাকে ছোট ছোট অ্যাকশন কমিটি। দেয়ালগুলো জীবন্ত হয়ে উঠতে থাকে স্লোগান আর ছবিতে। রাষ্ট্র-প্রশাসনের দিক থেকেও চলতে থাকে পাল্টা-প্রতিক্রিয়া। বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে সংঘর্ষে জড়ায় শিক্ষার্থী ও পুলিশ। গ্রেপ্তার করা হয় পাঁচ শতাধিক শিক্ষার্থীকে। একপর্যায়ে সরবোন বিশ্ববিদ্যালয়ও বন্ধ ঘোষণা করার পর ১০ মে রাতে পুলিশের সঙ্গে তীব্র সংঘর্ষে জড়ান শিক্ষার্থীরা। যে রাত পরে পরিচিত হয়েছে ‘ব্যারিকেডের রাত’ নামে। ১১ তারিখ সকাল থেকে আবার শুরু হয় দফায় দফায় সংঘর্ষ।

ততদিনে শিক্ষার্থীদের দাবি আর শুধু বিশ্ববিদ্যালয় বা শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কার বা যৌনতার অবদমনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি। দীর্ঘ সময় ধরে রাষ্ট্র-সমাজ নিয়ে যে ক্ষোভ শিক্ষার্থীদের মধ্যে জমা হয়েছিল, সেগুলোর বহিঃপ্রকাশ ঘটতে থাকে। পুরো সমাজটাই ঢেলে সাজানোর দৃপ্ত প্রত্যয় নিয়ে রাজপথ কাঁপাতে থাকেন তাঁরা। প্যারিসের অনেক দেয়ালে দেখা যেতে থাকে এক কাব্যিক শ্লোগান: ‘বাস্তববাদী হও, অসম্ভবের দাবি তোলো।’

ফ্রান্সের রাস্তায় লেখা: ‘বাস্তববাদী হও, অসম্ভবের দাবি তোলো।’

১০ মে’র ‘ব্যারিকেডের রাত’-এর কয়েক দিন পর থেকে ফ্রান্সের শ্রমিকরাও সাড়া দেয় শিক্ষার্থীদের আহ্বানে। লাখ লাখ শ্রমিক কাজ বন্ধ করে যোগ দেন শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে। শুরু হয় ফরাসী ইতিহাসের অন্যতম বড় শ্রমিক ধর্মঘটের। ফ্রান্সের কমিউনিস্ট পার্টি ও তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকা ট্রেড ইউনিয়নগুলো শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে শ্রমিকদের বিচ্ছিন্ন রাখার ও একটা সম্ভাব্য বিপ্লবের পথ রুদ্ধ করার যাবতীয় সব চেষ্টাই করেছিল। কিন্তু সফল হতে পারেনি।

১৩ মে ধর্মঘট ও বিক্ষোভ সমাবেশের আহ্বান করেন শ্রমিকরা। প্যারিসের রাস্তায় সেদিন একসঙ্গে হেঁটেছিলেন লাখ লাখ মানুষ। এক কাতারে দাঁড়িয়েছিল ছাত্র-শ্রমিক-জনতা। গত কয়েকদিন ধরে পুলিশের সঙ্গে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের ঘটনা চললেও সেদিন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা চলে গিয়েছিলেন দৃশ্যপটের বাইরে। প্রধানমন্ত্রী জর্জ পম্পিদ্যু (Georges Pompidou) ব্যক্তিগতভাবে ঘোষণা করেছিলেন যে, আটককৃতদের মুক্তি দেওয়া হবে আর সরবোন বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দেওয়া হবে। কিন্তু ততদিনে জল অনেকদূরই গড়িয়ে গেছে। প্রধানমন্ত্রীর এসব আশ্বাসে সন্তুষ্ট হওয়ার বদলে বরং আরও তৎপর হয়ে ওঠেন আন্দোলনকারীরা।

সরবোন বিশ্ববিদ্যালয় দখল করে সেটিকে ‘পিপলস ইউনিভার্সিটি’ নামে ঘোষণা দেন শিক্ষার্থীরা। গড়ে তোলেন অকুপেশন কমিটি অব সরবোন। প্যারিস জুড়ে গড়ে ওঠে এরকম পাঁচ শতাধিক অ্যাকশন কমিটি।

সরবোন বিশ্ববিদ্যালয়ের মিলনায়তনে শিক্ষার্থী সমাবেশে বক্তৃতা দিচ্ছেন ফরাসী দার্শনিক জঁ পল সার্ত্রে

১৪ মে থেকে শুরু হয় শ্রমিকদের কারখানা দখল। নান্তেস শহরের অদূরে একটি কারখানায় ধর্মঘট শুরু করেন শ্রমিকরা। অবরুদ্ধ করে ফেলেন কর্তৃপক্ষের লোকজনদের। একই রকম ঘটনা ঘটে রুয়েন, সেইন ভ্যালি, বুলোন-বিলানকোর্ট ইত্যাদি অনেক অঞ্চলের কারখানায়। ১৫ মে প্যারিসের ন্যাশনাল থিয়েটার দখল করে সেখানে পাকাপাকিভাবে জনতার অধিবেশন বসানো হয়। চলতে থাকে সমাজবদলের নানা রূপরেখা নিয়ে নিরন্তর তর্ক-বিতর্ক ও আলোচনা।

১৬ মে নাগাদ দেখা যায় প্যারিস ও আশেপাশের এলাকার ৫০টি কারখানার শ্রমিক ধর্মঘটে চলে গেছেন। ১৮ মে নাগাদ ২০ লাখ শ্রমিক সামিল হন ধর্মঘটে। ২০ মে আসতে আসতে দেখা যায়, সংখ্যাটা এক কোটি ছাড়িয়ে গেছে। যা ছিল ফ্রান্সের পুরো শ্রমশক্তির তিনভাগের দুইভাগ।

এই পর্যায়ে শ্রমিকদের দেওয়া হয় বেতন-ভাতা বৃদ্ধির আশ্বাস। ফ্রান্সের কমিউনিস্ট পার্টি এই শ্রমিক আন্দোলনের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করে। ট্রেড ইউনিয়নের নেতারা শ্রমিকদের আশ্বাস দেন সর্বনিম্ন মজুরি ৩৫ শতাংশ বৃদ্ধির। কিন্তু তাতেও আন্দোলন থেকে সরে যেতে অস্বীকৃতি জানান শ্রমিকরা। তাঁদের চোখে তখন যেন ছিল বিপ্লবের স্বপ্ন। নতুন সমাজ গঠনের অঙ্গীকার।

ফ্রান্সের একটি কারখানার ধর্মঘটে যাওয়া শ্রমিকরা

২৪ মে প্যারিস স্টক এক্সচেঞ্জে আগুন ধরিয়ে দেন আন্দোলনকারীরা। পুঁজিবাদের অন্যতম প্রধান এই প্রতিষ্ঠানটিতে আগুন দেওয়ার এই ঘটনা থেকে স্পষ্টই বোঝা যায় যে, তাঁরা পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থার গোড়ায় আঘাত হানতে চেয়েছেন।

শিক্ষার্থী-শ্রমিকদের এই স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন-তৎপরতায় ভীত হয়ে রাষ্ট্রও হাঁটার চিন্তা করে ভয় দেখানোর রাস্তায়। বলপ্রয়োগের মাধ্যমে প্যারিসের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার কথা ভেবে প্রস্তুত করা হয় ২০ হাজারের বেশি সেনাসদস্যকে। অন্যদিকে শ্রমিকদের শান্ত করার জন্য ২৫ ও ২৬ মে সামাজিক বিষয়াদি সম্পর্কিত মন্ত্রণালয় একটি চুক্তি সাক্ষর করে। যেখানে শ্রমিকদের সর্বনিম্ন মজুরি বাড়ানো হয় ২৫ শতাংশ। আর নিয়মিত বেতন বৃদ্ধি করা হয় ১০ শতাংশ। কিন্তু সরকারের এই প্রচেষ্টাও বিফলে যায়। এই প্রস্তাবও প্রত্যাখ্যান করে ধর্মঘট চালিয়ে যেতে থাকেন শ্রমিকরা।

ফ্রান্সের কমিউনিস্ট পার্টি ও তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন ট্রেড ইউনিয়নগুলোকে এই পুরো ঘটনায় দেখা যায় একটি প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী হিসেবে। যারা একটি সম্ভাব্য সমাজবিপ্লব ঠেকানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়েছে শুরু থেকে। শ্রমিকশ্রেণী বা গণমানুষের পার্টি বলে বিবেচিত হলেও ১৯৬৮ সালের মে বিদ্রোহে ফ্রান্সের কমিউনিস্ট পার্টি দাঁড়িয়েছিল শাসকদের কাতারে। বলা যায় একরকম বিশ্বাসঘাতকতাই করেছিল শ্রমিক-শিক্ষার্থীদের যৌথ বিদ্রোহের বিরুদ্ধে।

শ্রমিকরা যেন ধর্মঘট ভেঙে কাজে ফিরে যান, তা নিশ্চিত করার জন্য মিথ্যার আশ্রয়ও নিয়েছিলেন ট্রেড ইউনিয়নের নেতারা। উদাহরণ হিসেবে প্যারিসের মেট্রো স্টেশনের কথা বলা যায়। সেখানে একটি স্টেশনে গিয়ে নেতারা শ্রমিকদের মিথ্যা বলছিলেন যে, অন্যান্য স্টেশনের শ্রমিকরা আবার কাজ শুরু করেছে। এই মিথ্যা তাঁরা বারবার আওড়েছেন প্রতিটা স্টেশনে গিয়ে। কিন্তু এত কিছুর পরেও নেতারা ভাঙতে পারেননি শ্রমিক ঐক্য।

পরিস্থিতি এতটাই খারাপ হয়ে যায় যে, ২৯ মে পালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন প্রেসিডেন্ট শার্ল দ্য গল। সেদিন সকাল ১১টার পর থেকে কারো সঙ্গেই কোনো যোগাযোগ না করে আত্মগোপন করেন ফরাসী প্রেসিডেন্ট। এমনকি প্রধানমন্ত্রী পম্পিদ্যু ঘোষণা করেন যে, ‘তিনি দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন।’ স্থবির হয়ে পড়েছিল রাষ্ট্রীয় কার্যকলাপ। সরকারের অনেক বড় কর্মকর্তাই সেসময় ভীত হয়ে পড়েছিলেন সম্ভাব্য এক সমাজবিপ্লবের আশঙ্কায়। প্রাণ হারানোর ভয়ও চেপে বসেছিল অনেকের মনে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয় থেকে একের পর এক পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছিল পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের। কিন্তু কিছুই তাদের মনমতো হচ্ছিল না।

১০ মে রাতে (ব্যারিকেডের রাত) পুলিশ-শিক্ষার্থীদের ভয়াবহ সংঘর্ষের পরের সকালে প্যারিসের একটি রাস্তার চিত্র।

অবশেষে ৩০ মে প্রধানমন্ত্রী পম্পিদ্যুর অনুরোধ-সুপারিশে জাতীয় সংসদ ভেঙে দিয়ে নতুন নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করেন প্রেসিডেন্ট দ্য গল। এর পরপরই একটা বড় র‍্যালি রাস্তায় নামে এই ঘোষণাকে স্বাগত জানিয়ে। এটি মূলত ছিল সরকার ও দ্য গলের সমর্থকগোষ্ঠী। শ্রমিকশ্রেণীর একটা বড় অংশও এই ঘোষণাকে স্বাগত জানায়। ও নিজেদের বেতন-ভাতা বৃদ্ধি নিয়ে সন্তুষ্টি প্রকাশ করে। কমিউনিস্ট পার্টি রাজি হয়ে যায় নির্বাচনে অংশ নিতে। ফলে ধীরে ধীরে মিইয়ে যায় একটি সমাজবিপ্লবের আকাঙ্ক্ষা।

আর জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে শেষ হয়ে যায় এই আন্দোলন-বিক্ষোভ-বিদ্রোহের রেশ। শ্রমিকরা ধীরে ধীরে আবার কাজে ফিরতে শুরু করেন। সরবোন বিশ্ববিদ্যালয় দখল করে রাখা শিক্ষার্থীদের বের করে দিকে সক্ষম হয় পুলিশ।

১৯৬৮ সালের মে মাসে ফ্রান্সের শিক্ষার্থী-শ্রমিক-জনতার অনেকের বুকেই হয়তো জমা হয়েছিল বিপ্লবের স্পৃহা। চোখে জেগেছিল নতুন সমাজ গঠনের স্বপ্ন। শেষপর্যন্ত তেমনটা হতে না পারলেও এক মাসের উত্তাল আন্দোলন পাকাপাকিভাবে কিছু পরিবর্তন এনেছিল ফরাসী সমাজে।

জুনের জাতীয় নির্বাচনে আবার গলই প্রেসিডেন্ট হিসেবে ক্ষমতায় আসতে পারলেও আগের মতো দমবন্ধকরা রক্ষণশীল পরিস্থিতি তৈরি হয়নি। তৈরি হয়েছিল একটা মুক্ত পরিসর। ফ্রান্স অনেকখানি এগিয়ে গিয়েছিল একটি সহনশীল-ধর্মনিরেপক্ষ সমাজ গঠনের দিকে। নারী অধিকারের প্রশ্নে এসেছিল বড় কিছু পরিবর্তন। আগে ফরাসী নারীরা কর্মক্ষেত্রে প্যান্ট পরতে পারতেন না। ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খুলতে গেলে স্বামীর অনুমতির প্রয়োজন হতো। এই বিষয়গুলো আর থাকেনি ৬৮ সালের প্যারিস বসন্তের পর।

৫০ বছর পরে এসেও প্যারিস বসন্তের স্মৃতি শিহরণ জাগায় মুক্তিকামী মানুষের বিদ্রোহী সত্তায়। অনেক সমালোচনা-নেতিবাচক কথাবার্তা দিয়েও স্তব্ধ করে দেওয়া যায়নি ৬৮-এর লড়াকু মনোভাবকে। এখনও সেই উত্তাল দিনগুলি অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করে অনেকের মনে। অনেকেই এই ভেবে আশায় বুক বাঁধেন যে, আবার এমন এক প্রজন্ম আসবে। তরুণ সেই প্রজন্ম আবার মুষ্ঠিবদ্ধ হাতে উচ্চারণ করবে স্পর্ধার শব্দ। চিৎকার করে বলবে, “বাস্তববাদী হও, অসম্ভবের দাবি তোলো”।

প্রথম প্রকাশ: এনটিভি অনলাইন

আরও পড়ুন: প্যারিস ১৯৬৮ লিফলেট: “সংস্কার? না; বিপ্লব? হ্যাঁ

‘হক কথা’ কেউ শুনছে কি?

‘ফারাক্কা বাঁধ বাংলাদেশের জন্য হিরোশিমা-নাগাসাকির চেয়েও ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনবে।’ কথাগুলো ৩৯ বছর আগে বলেছিলেন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। মজলুম জননেতার এই ভবিষ্যৎবাণী যে এত নির্মমভাবে বাস্তবে পরিণত হবে সেটা উপলব্ধি করার মতো দুরদর্শিতা তৎকালিন সরকারের কর্তাব্যক্তিদের ছিল না বলেই প্রতীয়মান হয়। যে প্রমত্ত পদ্মা নদীর ‘সর্বনাশা’ রুপ নিয়ে লেখা হয়েছিল বিস্তর গান-কবিতা; সেই পদ্মা নদীর একটি বিশাল অংশ আজ ধুসর মরুভূমি। মাঝেমধ্যে এখানে ওখানে মরীচিকার মতো মেলে জলের দেখা।

bhasani

এমন পরিণতির কথা আশঙ্কা করেই ১৯৭৬ সালের ১৬ মে ফারাক্কা অভিমুখে লংমার্চ করেছিলেন মওলানা ভাসানী। প্রচণ্ড শারিরীক কষ্ট উপেক্ষা করে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন হাজারো মানুষের মিছিলে। ৩৯ বছর আগের এই দিনে রাজশাহীর ঐতিহাসিক মাদ্রাসা ময়দান থেকে শুরু হয়েছিল সেই লংমার্চ। সন্ধ্যা ছয়টা নাগাদ তাঁরা পৌঁছেছিলেন চাঁপাইনবাবগঞ্জ। সেখানে রাত্রী যাপনের পর পরদিন সকাল আটটায় আবার শুরু হয় শিবগঞ্জের কানসাট অভিমুখে যাত্রা। মহানন্দা নদী পার হওয়ার জন্য হাজার মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে কৃত্রিম সেতু তৈরি করেছিলেন নৌকা দিয়ে। বাংলাদেশের সীমানার মধ্যেই লংমার্চ সমাপ্ত হলেও বিপুল মানুষের ঢল দেখে সেদিন নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছিল ভারতীয় সীমান্তে। কানসাটের জনসভায় মওলানা ভাসানী বলেছিলেন, ‘আজ রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও কানসাটে যে ইতিহাস শুরু হয়েছে তা অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর নতুন অধ্যায় সৃষ্টি করবে।’

বাংলার এই মজলুম জননেতার এই কথাটি অবশ্য সত্য হয়নি। ১৯৭৬ সালেরই ১৭ নভেম্বর পরলোকে পাড়ি জমান ভাসানী। আর তাঁর প্রতিরোধের অধ্যায় থেকে যায় অসমাপ্ত। ফারাক্কা টিকে থাকে, আরও শক্তিশালী হয়। আর প্রয়োজনে পানি পান না বাংলাদেশের মানুষ। অসময়ের স্রোত আবার ভাসিয়ে নিয়ে যায় ফসলি জমি, ঘর-বসতি।

আন্তর্জাতিক পানি বন্টন ও ভাগাভাগি নিয়ে দেশে দেশে যে বিরোধ বিদ্যমান, তার মধ্যে অন্যতম হলো ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে গঙ্গা নদীর পানি বন্টন-সংক্রান্ত বিরোধ। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগেই ফারাক্কা বাঁধ নির্মানের উদ্যোগ গ্রহণ করেছিল ভারত। ১৯৫১-৭০ সাল পর্যন্ত প্রায় দুই দশক ধরে আলোচনা হলেও কোনো কার্যকর সমাধানে পৌঁছাতে পারেনি ভারত ও পাকিস্তান। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর আবার শুরু হয় আলাপ-আলোচনা। ১৯৭৫ সালের এপ্রিলে ফারাক্কা বাঁধ সাময়িকভাবে চালুর ব্যাপারে সাক্ষরিত হয় একটি অন্তবর্তীকালীন চুক্তি। এই চুক্তি অনুযায়ী বাঁধটি চালু করার কথা ছিল এক মাস ১০ দিনের (২১ এপ্রিল থেকে ৩১ মে, ১৯৭৫) জন্য। কিন্তু মেয়াদ শেষ হয়ে গেলেও ফারাক্কা বাঁধের কার্যক্রম চালিয়ে যেতে থাকে ভারত। প্রতিবেশী দেশের অনায্য আচরণের বিরোধীতা করে এক বছর পর ১৬ মে ফারাক্কা অভিমুখে লংমার্চ করেছিলেন মওলানা ভাসানী।

কিন্তু তাতে কোনো ফল আসেনি। স্থায়ী সমাধানের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ২০ বছর পর ১৯৯৬ সালে গঙ্গার পানি বন্টন সংক্রান্ত ৩০ বছর মেয়াদী চুক্তি সাক্ষরিত হয় ভারত ও বাংলাদেশ সরকারের মধ্যে। কিন্তু সেই চুক্তিরও ছিল নানান সীমাবদ্ধতা। ফলে একতরফাভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েই গেছে ভাটির দেশ বাংলাদেশ। নদীতে পানি শুকিয়ে যাওয়ায় সেচকাজের জন্য ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহার করতে বাধ্য হয়েছেন কৃষকরা। তাতে যেমন বেড়েছে কৃষিব্যয়, তেমনি নেমে গেছে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর। গত কয়েক বছরে এলাকাভেদে পানির স্তর নেমে গেছে ২৫ থেকে ৪০ ফুট পর্যন্ত। খরা, দাবদাহ বেড়েই চলেছে প্রতি বছর। আর্সেনিকে আক্রান্ত হচ্ছেন নদীপাড়ের অনেক মানুষ।

১৯৭৬ সালে মওলানা ভাসানীর লংমার্চ স্মরণে ১৬ মে পরিচিতি পেয়েছিল ‘ফারাক্কা দিবস’ হিসেবে। কিন্তু সংগ্রামী এই জননেতার শেষজীবনের কথাগুলোও আজ বিস্মৃতির পথে। ভাসানীর ‘হক কথা’ যেন হারিয়ে যেতে বসেছে কালের গর্ভে। আর এভাবে চলতে থাকলে, ২০২৬ সালে গঙ্গার পানি বন্টন সংক্রান্ত চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই হয়তো শুকিয়ে যেতে পারে খালে পরিণত হওয়া নদীগুলোর পানিও।

১৯৯৫ সালে বিশ্বব্যাংকের তৎকালিন সহ-সভাপতি ইসমাইল সেরাজেলদিন বলেছিলেন, ‘এই শতাব্দীতে মানুষ যুদ্ধ করছে তেলের জন্য। কিন্তু পরবর্তী শতাব্দীতে যুদ্ধ হবে পানির অধিকার নিয়ে।’ তেমন নিষ্ঠুর পরিস্থিতির মুখে দাঁড়ালেই কী কেবল মনে পড়বে মওলানা ভাসানীর ‘হক কথা’গুলো?

মা দিবস: ইতিহাস বিস্মৃত, বাণিজ্য মুখ্য

১৯১৪ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হওয়া মা দিবস পেরিয়ে এসেছে ১০০ বছর। আর এই শত বছরে অনেকখানিই বিস্মৃত হয়ে গেছে বিশেষ দিনটির ইতিহাস। অন্য আরো অনেক দিবসের মতো মা দিবসও পরিণত হয়েছে রমরমা বাণিজ্যের উপলক্ষে। যুক্তরাষ্ট্রে মা দিবস ঘিরে প্রায় ২০ বিলিয়ন ডলার খরচ করেন মার্কিন নাগরিকরা। অথচ যাঁর হাত ধরে এই দিবসের যাত্রা শুরু হয়েছিল, সেই আনা জার্ভিস আমৃত্যু লড়াই করে গেছেন দিনটিকে ঘিরে গড়ে ওঠা বাণিজ্যিকীকরণের বিরুদ্ধে। শেষটায় নিঃস্ব-রিক্ত অবস্থায় মারা গেছেন যুক্তরাষ্ট্রের একটি মানসিক হাসপাতালে।

Anna-Jarvis-3

মজার ব্যাপার হলো, ওয়েস্ট ভার্জিনিয়ার আনা জার্ভিস নিজে কিন্তু নিঃসন্তান ছিলেন। ১৯০৫ সালে তাঁর মা রিভস জার্ভিসের মৃত্যু আনাকে অনুপ্রাণিত করে এই প্রয়াণ দিবস উদযাপনের উদ্যোগ নিতে। ১৯০৮ সালে তিনি প্রথমবারের মতো আয়োজন করেন মা দিবসের অনুষ্ঠান। সে বছরের ১০ মে তারিখে জার্ভিসের আদিনিবাস ওয়েস্ট ভার্জিনিয়ার গ্রাফটন শহরের পরিবারগুলো একত্রিত হয়েছিল একটি চার্চে। সেই চার্চটি এখন পরিচিত আন্তর্জাতিক মা দিবসের মন্দির হিসেবে। একই সঙ্গে ফিলাডেলফিয়াতেও আয়োজিত হয় পৃথক একটি অনুষ্ঠান।

আনা জার্ভিসের অক্লান্ত পরিশ্রমের কারণে ক্রমেই অন্যান্য শহর ও প্রদেশেও আয়োজিত হতে থাকে মা দিবসের অনুষ্ঠান। ১৯১৪ সালে মে মাসের দ্বিতীয় রবিবারকে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘মা দিবস’ বলে ঘোষণা করেন যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি উড্রো উইলসন। দিনটির তাৎপর্য আনার কাছে কেমন ছিল তা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ওয়েস্ট ভার্জিনিয়ার অধ্যাপক ওয়েসলেয়ান আনতোলিনি বলেছেন, ‘জার্ভিসের জন্য এটা ছিল এমন একটা দিন, যখন আপনি বাড়ি গিয়ে মার সঙ্গে সময় কাটাবেন আর তাঁর কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবেন।’

anna jarvis

কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে দিনটি উদযাপনের গতিধারা বদলে যায় জার্ভিসের চোখের সামনে। দিনটি পরিণত হয় রমরমা বাণিজ্যের উপলক্ষে। সবাইকে উৎসাহিত করা হয় ফুল-চকলেট আর নানা রকম উপহার কিনে মাকে উপহার দেওয়ার জন্য। ব্যাপারটি গভীরভাবে আহত করেছিল আনাকে। দিনটিকে তার আদি তাৎপর্য ফিরিয়ে দেওয়ার অনেক চেষ্টা করেছিলেন তিনি। বয়কট করেছিলেন, মামলার হুমকি দিয়েছিলেন। এমনকি একবার আক্রমণ করেছিলেন ফার্স্ট লেডি এলেনর রুজভেল্টকেও। কোনো লাভ হয়নি। ১৯৪৮ সালে ৮৪ বছর বয়সে ফিলাডেলফিয়ার একটি হাসপাতালে নিঃস্ব অবস্থায় মারা যান আনা।

‘মেমোরাইজিং মাদারহুড : আনা জার্ভিস অ্যান্ড দ্য ডিফেন্স অব হার মাদারস ডে’ গ্রন্থের লেখক আনতোলিনি বলেছেন, ‘এই মানুষটা, যিনি স্মৃতিবিভ্রমে আক্রান্ত হয়ে মারা গেলেন কপর্দকশূন্য অবস্থায়; তিনি চাইলে এই মা দিবস থেকে অনেক মুনাফা করতে পারতেন। কিন্তু যারা সেটা করেছে তাদের বিরুদ্ধে তিনি আজীবন লড়েছেন। আর এ জন্য তাঁকে কড়া মাশুল দিতে হয়েছে। অর্থনৈতিকভাবে, শারীরিকভাবেও।’

মা দিবসের মূল প্রোথিত আছে ইতিহাসের আরো গভীরে- আনা জার্ভিসের মা অ্যান রিভস জার্ভিসের সংগ্রামী জীবনের জমিনে। ১৮০০ শতকের মাঝামাঝিতে ওয়েস্ট ভার্জিনিয়ার নারী সংগঠক রিভস জার্ভিস, মায়েদের সংগঠিত করেছিলেন নবজাতক মৃত্যুহার, শিশুখাদ্য-দুধের দুষণ ইত্যাদির বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলার জন্য। ১৮৬১ থেকে ১৮৬৫ সাল পর্যন্ত চলা মার্কিন গৃহযুদ্ধের সময় এই মায়েরা দুই পক্ষের সৈনিকদেরই সেবাশুশ্রূষা করতেন। যুদ্ধের পর দুই পক্ষের মধ্যে সন্ধিস্থাপন করে শান্তি ফিরিয়ে আনার জন্য জার্ভিস ও তাঁর সহযোদ্ধারা আয়োজন করতেন মাদারস ফ্রেন্ডশিপ ডে পিকনিক। ১৮৭০ সালে ‘মা দিবসের ঘোষণা’ নামে একটি প্রকাশনা প্রকাশ করেন জুলিয়া ওয়ার্ড হাওয়ে। সেখানে তিনি নারীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন, শান্তি ফেরানোর লক্ষ্যে নারীদের সক্রিয় রাজনৈতিক ভূমিকা নেওয়ার জন্য।

ann-jarvis

কিন্তু ইতিহাস বিস্মৃত হওয়ায় দিবসটি পরিণত হয়েছে বাণিজ্য করার দিনে। মার্কিনিরা এ বছর দিনটিতে প্রায় ২০ বিলিয়ন ডলার খরচ করবেন বলে জানিয়েছে ন্যাশনাল রিটেইল ফেডারেশন। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল রেস্টুরেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিবেদন অনুযায়ী বাইরে খাওয়ার জন্য মা দিবসই বছরের সবচেয়ে জনপ্রিয় ছুটির দিন। হলমার্কের তথ্য থেকে জানা যায়, ক্রিসমাসের পর মা দিবসেই সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয় শুভেচ্ছা কার্ড।

ধ্বংসের ধ্বংসাবশেষ: হুমকির মুখে মালয়েশিয়ার অতীত ঐতিহ্য

Ancient grandeur

বুজাং উপত্যকা (Lembah Bujang) মালয়েশিয়ার একটি অন্যতম প্রধান প্রত্নতাত্তিক স্থান। বর্তমান কেদাহ রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত এই ঐতিহাসিক জায়গাটির প্রায় একশ বর্গমাইল জুড়ে আছে প্রাচীন বসতি ও মন্দিরের নিদর্শন, যেগুলোর কিছু কিছু নির্মান করা হয়েছিল ২০০০ বছরেরও আগে। এই ধরনের প্রাচীন প্রত্নতাত্তিক নিদর্শনগুলো রক্ষা করার জন্য যেখানে বিশ্বের অনেক জায়গাতেই প্রচুর শ্রম, সময়, অর্থ বিনিয়োগ করা হচ্ছে সেখানে ধ্বংস করা হচ্ছে মালয়েশিয়ার আদি ধ্বংসাবশেষগুলো। বিলীন হয়ে যাওয়ার হুমকির মুখে আছে মালয়েশিয়ার অতীত ঐতিহ্য। সেখানকার ডেভেলপাররা ইতিমধ্যেই একটি প্রাচীন মন্দির ভেঙ্গেও ফেলেছে বলে খবর পাওয়া গেছে।

Bujang Valley ruins_Image1পার্শ্ববর্তী পেনাং রাজ্যের সহকারী মুখ্যমন্ত্রী পালিনাসামি রামাস্বামী সম্প্রতি বুজাং উপত্যকা ঘুরে এসে এমন দুঃসংবাদই শুনিয়েছিলেন সবাইকে। ‘১১ নম্বর মন্দির’ নামে পরিচিত স্থাপত্যটি এক মাস আগেই গুঁড়িয়ে দিয়েছে ডেভেলপাররা। খবরটি শুরুতে অনেকে বিশ্বাসও করতে পারেননি। কিন্তু পরে এর সত্যতা উপলব্ধি করার পর ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন মালয়েশিয়ার অনেক নাগরিক। এরকমই একজন নিজের টুইটারে লিখেছেন, ‘কোনো সম্মান দেখানো হয়নি। ইসলামের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত নয়- এমন কোনো কিছুর অস্তিত্ব না থাকলে তাদের কিছু যায় আসে না।’ একটি ফেসবুক পেজের মাধ্যমে সংগঠিত হয়ে প্রায় সাত হাজার মানুষ এই আগ্রাসনের প্রতিবাদ জানিয়েছেন।

নাগরিকদের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়ায় পিছু হটতে বাধ্য হয়েছে মালয়েশিয়ান সরকার ও ডেভেলপাররা। কেদাহ রাজ্যের কর্তৃপক্ষের দিক থেকে বলা হয়েছে যে, স্থাপত্যগুলো নাকি ঐতিহাসিক গুরুত্ব বিবেচনায় এখনো তালিকাভুক্ত হয়নি। আর এখন সেগুলো আছে ব্যক্তি মালিকানার অধীনে। এই ধরণের অজ্ঞ স্বীকারোক্তি মানুষের ক্ষোভ আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। তাদের তীব্র প্রতিবাদের মুখে জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে মালয়েশিয়ার কেন্দ্রিয় সরকার। বুজাং উপত্যকার অবশিষ্ট ধ্বংসাবশেষগুলো বিস্তারিতভাবে সনাক্ত ও লিপিবদ্ধ করার জন্য প্রত্নতাত্তিকদের সহায়তা করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে রাজ্য সরকারকে।

যে ম্যাচটা নাড়িয়ে দিয়েছিল ইউরোপের মনোজগত

১৯৫৩ সালের ২৫ নভেম্বর। ফুটবলের তীর্থস্থান ওয়েম্বলি স্টেডিয়ামে মুখোমুখি হয়েছিল তৎকালিন ইউরোপিয়ান ফুটবলের দুই পরাশক্তি ইংল্যান্ড ও হাঙ্গেরি। সেসময় ঘরের মাঠে ইংল্যান্ড ছিল অদম্য। ইউরোপের কোনো দেশই ইংল্যান্ডে গিয়ে তাদেরকে হারাতে পারেনি। অপরদিকে ‘মারভেলাস ম্যাগিয়ার্স’ নামে খ্যাত হাঙ্গেরি ছিল অবধ্য। টানা তিন বছর ধরে তারা ছিল অপরাজিত। হাঙ্গেরি আর ইংল্যান্ডের এই লড়াইটা বিশ্ব গণমাধ্যমে পরিচিত পেয়েছিল ‘শতাব্দীর সেরা ম্যাচ’ হিসেবে। তবে শুধু ফলাফল বা মাঠের পারফরম্যান্সের জন্যই ম্যাচটা স্মরণীয় না। ৬০ বছর আগের এই লড়াইটা নাড়িয়ে দিয়েছিল ইউরোপের মনোজগত। চূর্ণ করেছিল সাম্রাজ্যের অহঙ্কার আর নিপীড়িত মানুষের মনে জাগিয়েছিল স্বাধীন হওয়ার স্বপ্ন।

1953

ম্যাচ শুরুর আগে অধিনাক বিলি রাইট, স্ট্যানলি ম্যাথুউ, আলফ রামসেসহ অন্যান্য ইংলিশ খেলোয়াড়রা নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে ছিলেন প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাসী। ইংলিশ সাম্রাজ্যের মতো তাঁরাও তখন আছেন নিজেদের সর্বোচ্চ শিখরে। নভেম্বরে এই ম্যাচটির কয়েক মাস আগেই ইংল্যান্ড পরিচালিত অভিযাত্রায় সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ এভারেস্টের চূড়ায় উঠেছেন এডমুন্ড হিলারি। তার কিছুদিন পরেই রাজ্যাভিষেক হয়েছে রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথের। পুরো ইংল্যান্ড জুড়েই তখন বইছে সাম্রাজ্য দাম্ভিকতার হাওয়া। ১৯৪৭ সালে উপমহাদেশের শাসন ছেড়ে দিতে হলেও সেসময় আফ্রিকার একটা বড় অংশ ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের দখলে।

অপরদিকে হাঙ্গেরির অবস্থা পুরোপুরিই ভিন্ন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে দেশটি বেশ কয়েক বছর ধরেই পার করছিল দুর্বিসহ সময়। জার্মানির নাৎসি শাসন থেকে মুক্ত হতে না হতেই আবার পড়তে হয়েছিল স্টালিনের সোভিয়েত শাসনের খপ্পরে। হাঙ্গেরির তৎকালিন রাষ্ট্রপতি কমিউনিস্ট নেতা রাকোস্কি, স্টালিনের আদর্শে কায়েম করেছিলেন একটা পুলিশি রাষ্ট্র। সোভিয়েত সেনাবাহিনীর প্রত্যক্ষ উপস্থিতিও ছিল পূর্ব ইউরোপের দেশটিতে। হাজার হাজার হাঙ্গেরিয়ানকে পাঠানো হয়েছিল জেলে বা কনসেনন্ট্রেশন ক্যাম্পে। হাঙ্গেরি ও সোভিয়েত সরকারের কাছে খেলাধুলা, বিশেষত ফুটবলটা ছিল কমিউনিজমের আদর্শ প্রতিষ্ঠার লড়াই। হাঙ্গেরির জাতীয় দল ছিল পুরোপুরি সরকারের কর্তৃত্বাধীন। সেসময়ের কোচ গুসতাভ সেবেস ছিলেন সরকারের একজন সদস্য। তিনি বলেছিলেন, ‘পুঁজিবাদ ও কমিউনিজমের লড়াইটা শুধু আমাদের সমাজেই না, চালাতে হবে ফুটবল মাঠেও।’
চেকোস্লোভাকিয়ার বিপক্ষে একটা ম্যাচে হারের পর আজীবনের জন্য বহিস্কার করা হয়েছিল হাঙ্গেরির অধিনায়ক ফেরেঙ্ক পুসকাসকে। তাঁর বিরুদ্ধে আনা হয়েছিল ‘মাঠে গা ছেড়ে দিয়ে খেলার’ অভিযোগ। কয়েক মাস পরে অবশ্য ক্ষমাও করা হয়েছিল। কারণ হাঙ্গেরিকে ফুটবল জগতের শিখরে নিয়ে যাওয়ার পেছনে সবচেয়ে বড় অবদান ছিল এই বাম পায়ের জাদুকরের। শতাব্দীর সেরা ম্যাচটা ইংল্যান্ড হেরেওছিল কিংবদন্তি এই ফুটবলারের দুর্দান্ত পারফরম্যান্সের কারণে।

Soccer - World Cup Switzerland 54 - Final - Hungary v West Germany
হাঙ্গেরি আর ইংল্যান্ডের ম্যাচটা শুরুর ঠিক আগমুহূর্তে এক ইংলিশ ধারাভাষ্যকার পুসকাসকে দেখে বলেছিলেন, ‘ছোট, বেঢপ খেলোয়াড়’। তাদের তখন বিন্দুমাত্রও ধারণা ছিল না যে এই ছোট্ট মানুষটাই কিভাবে তাদের তারকা ফুটবলাদের জীবন দুর্বিসহ করে দেবে। খেলা শুরুর ৪৫ সেকেন্ড পরেই ইংল্যান্ড হজম করেছিল প্রথম গোলটা। ২৭ মিনিট পরেই স্কোর: হাঙ্গেরি ৪ : ০ ইংল্যান্ড। পরের দুইটি গোলই করেছিলেন পুসকাস। তাঁর দ্বিতীয় গোলটা এখনো ফুটবল বিশ্বে বিখ্যাত হয়ে আছে ‘ড্রাগ ব্যাক গোল’ নামে।
দ্বিতীয়ার্ধের ৫৭ মিনিট পরে হাঙ্গেরি এগিয়ে ছিল ৬-৩ গোলে। বাকি ৩৩ মিনিটে তারা আরও তিন-চারটা গোল অনায়াসেই দিতে পারত। কিন্তু ম্যাচটা শেষ হয় ঐ ৬-৩ গোলের ব্যবধানেই। লজ্জাজনক এই হারের পর ইংল্যান্ডের ডিফেন্ডার সিড ওয়েন হতাশ কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘মনে হচ্ছিল আমরা অন্য গ্রহের মানুষের সঙ্গে খেলছি।’
ওয়েম্বলির এই ম্যাচ ভেঙ্গে দিয়েছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের দম্ভ। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের পতনের শুরুর সময় হিসেবেও ৫০-এর দশকের শুরুকেই ইঙ্গিত করেন ইতিহাসবিদরা। এই একটা ম্যাচের কারণেই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের পতনের শুরু হয়েছিল এটা বলাটা হয়তো বাড়াবাড়িই হয়ে যাবে কিন্তু ইংলিশদের শ্রেষ্ঠত্বের অহঙ্কারে সত্যিই নাড়া দিয়েছিল এই হারটা। সাম্রাজ্যের পতন হয়েছিল তখন, যখন ইংল্যান্ডের নাগরিকরা নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব-অপরাজেয়ত্বের ওপর আর বিশ্বাস রাখতে পারেননি। কয়েক মাস বাদে ইংল্যান্ড ফুটবল অঙ্গনের পরিস্থিতিটা হয়েছিল আরও করুণ। ১৯৫৪ সালের মে মাসে হাঙ্গেরির মাঠে গিয়ে ইংল্যান্ড হেরেছিল ৭-১ গোলের ব্যবধানে। এটাই তাদের সবচেয়ে বড় ব্যবধানে হারের রেকর্ড। অল্প কয়েকদিনের ব্যবধানে টানা দুইটি হারের ফলে দুনিয়া সম্পর্কে নতুন করে ভাবতে বাধ্য হয়েছিল ইংলিশরা।
ফুটবলের আবিষ্কারক হিসেবে ইংল্যান্ডের ধারণা ছিল খেলাটার প্রতি স্বাভাবিকভাবেই তাদের দখল অন্যদের চেয়ে অনেক বেশি। বাইরের কোনো দেশের খেলোয়াড়দের সঙ্গে খেলাটাকেও একসময় তারা নিজেদের মর্যাদার জন্য হানিকর বলেই ভাবত। ১৯৫০ সালের আগে ইংল্যান্ড বিশ্বকাপেও অংশ নেয়নি। কিন্তু নাক উঁচু ইংলিশদের বাস্তবতার মাটিতে নামিয়ে এনেছিল হাঙ্গেরি। ইংলিশ ফুটবলে এসেছিল আমূল পরিবর্তন।
১৯৫৪ সালের আগ পর্যন্ত ইংল্যান্ড ফুটবল দল খেলত বহুদিনের পুরোনো ডব্লিউএম ফরম্যাটে (৩-২-২-৩)। হাঙ্গেরির কাছে হারের পর প্রথমবারের মতো কৌশল পরিবর্তনেও বাধ্য হয় ইংল্যান্ড। বিদেশি ফুটবলারদের বিপক্ষে আরও বেশি করে খেলার ওপরও জোর দিয়েছিলেন অনেকে। হাঙ্গেরির খেলার ধরন, কোচিং পদ্ধতি অনুসরণ করেছিল লিভারপুল, টটেনহাম ও ওয়েস্টহামের মতো ইংলিশ ক্লাবগুলোও।
ইংল্যান্ডের জ্যাত্যাভিমান যখন ধুলোয় লুটিয়েছে, তখন হাঙ্গেরির কমিউনিস্ট শাসকরা মেতেছেন বিজয়োল্লাসে। তাদের দৃষ্টিতে এটা ছিল কমিউনিস্ট সমাজব্যবস্থারই বিজয়। যদিও এই দৃষ্টিভঙ্গিটাও ছিল নিছকই ভ্রান্তধারণা। পুসকাসদের ইংল্যান্ড বধের কীর্তিটা আসলে রচনা করেছিল হাঙ্গেরির নিপীড়িত মানুষের অভ্যুত্থানগাথা। তাদের মনে জাগিয়েছিল অসম্ভবকে সম্ভব করার প্রেরণা। হাঙ্গেরির সাধারণ মানুষ ভেবেছিল যদি আমরা ওয়েম্বলিতে ইংল্যান্ডকে হারাতে পারি তাহলে হয়তো দখলদার সোভিয়েত বাহিনীকেও হটিয়ে দিতে পারব। ১৯৫৬ সালের হাঙ্গেরিয়ান বিপ্লবের সঙ্গে ওয়েম্বলির সেই ম্যাচটির প্রত্যক্ষ যোগসূত্র ছিল বলেই দাবি করেছিলেন দেশটির প্রখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক পিটার টিমার। ১৯৯৯ সালে তাঁর পরিচালিত ‘৩-৬’ সিনেমাটিতে দেখানো হয়েছিল, রেফারির শেষ বাঁশি বাজার পর রাজনৈতিক বন্দীদের সঙ্গে কোলাকুলি করে বিজয় উদযাপন করেছিলেন কারাগারের রক্ষীরা। দুই বছর পরে অনেকেই একজোট হয়ে লড়েছিলেন সোভেয়েত ট্যাঙ্কের বিরুদ্ধে।

Hungarian Revolution-C
১৯৫৬ সালের সেই গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে সোভিয়েত বাহিনীকে হটিয়েও দিয়েছিল হাঙ্গেরির সাধারণ মানুষ। দুঃখের বিষয় বিপ্লবী সেই অভ্যুত্থানটা স্থায়ী হয়েছিল মাত্র কয়েকদিন। হাঙ্গেরি ছেড়ে চলে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েও আবার ফিরে এসেছিল সোভিয়েত সেনাবাহিনী। আক্ষরিক অর্থেই গুঁড়িয়ে দিয়েছিল  মানুষের মুক্তিমুখীন আকাঙ্ক্ষা। সেটা ইতিহাসের এক বেদনাময় আর করুণ অধ্যায়।

উরুগুয়ের ‘রবিন হুড গেরিলারা’

গত সেপ্টেম্বরে জাতিসঙ্ঘের সাধারণ পরিষদে একটা সাড়া জাগানো ভাষণ দিয়েছিলেন উরুগুয়ের প্রেসিডেন্ট হোসে মুজিকা। পশ্চিমা ভোক্তাবাদের তীব্র সমালোচনা করে তিনি বলেছিলেন যে, আমরা এখন উপাসনা করি বাজার-ঈশ্বরের। লাতিন আমেরিকার আরও অনেক দেশের মতো উরুগুয়েও লড়ছে পশ্চিমা আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে। সম্প্রতি বিশ্বের প্রথম দেশ হিসেবে গাঁজাকে বৈধতা দেওয়ার কারণেও বেশ আলোচিত হয়েছে উরুগুয়ে।

লাতিন আমেরিকার এই দেশটির প্রেসিডেন্ট অবশ্য বিশ্বের নজর কেড়েছিলেন আরও আগে। ২০১২ সালে তিনি সংবাদ শিরোনাম হয়েছিলেন ‘বিশ্বের সবচেয়ে গরীব প্রেসিডেন্ট’ হিসেবে। প্রেসিডেন্টের জন্য নির্ধারিত বাড়ির বিলাসবহুল জীবনযাপনের পথ পরিত্যাগ করে তিনি এখনো বসবাস করছেন নিজের একটা সাধারণ বাড়িতে। রাষ্ট্রপতি হিসেবে প্রাপ্ত বেতনের ৯০% অর্থই মুজিকা দান করে দেন বিভিন্ন দাতব্য প্রতিষ্ঠানে। তবে পুরো বিশ্ব বললেও নিজেকে কিন্তু গরিব ভাবেন না মুজিকা। আল জাজিরাকে দেওয়া সাক্ষাত্কারে তিনি বলেছিলেন, ‘আমার কাছে গরীব হচ্ছে তারাই যারা খুবই বেশি বেশি চায়। কারণ যাদের চাওয়া অনেক বেশি, তারা কখনোই তৃপ্ত হয় না।’

Jose-Mujica

সন্দেহ নেই উরুগুয়ের এই রাষ্ট্রপ্রধান একজন কৌতুহল জাগানিয়া ব্যক্তিত্ব। তবে শুধু বর্তমানেই না, পেপে মুজিকার অতীত ইতিহাসটাও বেশ চমকপ্রদ। ধনসম্পদের প্রতি আকর্ষণহীন এই ব্যক্তি একসময় ব্যাঙ্ক ডাকাতি করতেন। সেটাও করতেন মাঝেমধ্যেই। একা একা না অবশ্য। হোসে মুজিকা ছিলেন টুপামারোস আন্দোলনের একজন সক্রিয় সদস্য। ১৯৬০-এর দশকের মাঝামাঝি থেকে ১৯৭০-এর দশকের শুরুর সময় পর্যন্ত স্থায়ী ছিল উরুগুয়ের শহরভিত্তিক এই বিদ্রোহ। ‘টুপামারোস জাতীয় মুক্তি আন্দোলন’ নামে সংগঠিত হয়েছিলেন মুজিকা, রাউল সেনডিক, জর্জ জাবালজার মতো শহুরে গেরিলারা।

এই ডাকাতি তারা করতেন সমাজে বিদ্যমান বৈষম্য দূর করার জন্য। ব্যাঙ্ক লুটের টাকা তারা বিলিয়ে দিতেন গরীবদের মধ্যে। খাদ্য পরিবহনকারী ট্রাক লুট করে সেটা বিলিয়ে দিতেন অনাহারীদের মাঝে। ১৯৬৯ সালে যে কারণে টাইমস ম্যাগাজিনে তাদেরকে আখ্যায়িত করা হয়েছিল ‘রবিন হুড গেরিলা’ হিসেবে।

মুজিকারা এই কর্মপন্থার নাম দিয়েছিলেন সশস্ত্র প্রচারণা। হাতে অস্ত্র থাকলেও সেটা দিয়ে খুনখারাবি করার চাইতে প্রচার-প্রচারণার দিকেই মনোযোগ ছিল টুপামারোস বিদ্রোহীদের। ব্যাঙ্ক ডাকাতি করে তারা জনসম্মুখে প্রকাশ করে দিতেন সন্দেহজনক গণবিরোধী দলিলপত্র। জনপ্রিয় ফুটবল খেলা চলার সময় রেডিও স্টেশন দখল করে তারা চালাতেন তাদের প্রচারণা। তাঁদের অনেক অপারেশনই সম্পন্ন হয়ে যেত একটি গুলিও না ছুঁড়ে। ১০০ জনেরও কম মানুষ নিয়ে তাঁরা সেসময় কাঁপন ধরিয়ে দিয়েছিলেন অত্যাচারী শাসকদের মনে।

jose-mujica-preso-y-presidenteসরকারের পাল্টা গেরিলা আক্রমণও শুরু হয়েছিল দ্রম্নতই। আর আস্তে আস্তে তারা এই টুমপামারোসকে গুঁড়িয়ে দিতে থাকে। মুজিকা নিজেও হয়েছিলেন এমন আক্রমণের শিকার। ১৯৭০ সালের মার্চে পরিচিত একজনের সঙ্গে দেখা করার সময় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে ছয়টি গুলি খেয়েছিলেন উরুগুয়ের বর্তমান এই রাষ্ট্রপতি। সুস্থ হতে লেগেছিল প্রায় এক বছর। সেসময়ই তাঁকে জেলে বন্দি করা হয় অন্যান্য কমরেডদের সঙ্গে। প্রায় এই সময় থেকেই এই শহুরে আন্দোলন কিছুটা দিকভ্রষ্ট হয়ে পড়ে।

উরুগুয়ের এই রবিনহুড গেরিলারা পশ্চিমা বিশ্বের কাছে বেশি পরিচিত ১৯৭০ সালেই ঘটা আরেকটি ঘটনা দিয়ে। সে বছরের আগস্টে টুমপামারোস গেরিলারা বন্দী করেছিল বেশ কয়েকজন বিদেশীকে। আর মুক্তিপণ হিসেবে দাবি করেছিল তাদের কারাবন্দী সদস্যদের মুক্তি। সরকার আলোচনা করতে রাজি না হওয়ায় বন্দী এক আমেরিকানকে হত্যা করেছিল একেবারে ঠাণ্ডা মাথায়। এই সময়ের আগ পর্যন্ত এমএলএন-এর কর্মকাণ্ড সীমাবদ্ধ ছিল সশস্ত্র প্রচারণা আর পুলিশের সঙ্গে খুবই ছোটখাট সংঘর্ষের মধ্যে। কিন্তু এরপর শুরু হয় অপহরণ। এমনকি কখনো কখনো বোমাবাজির মতো ঘটনাও ঘটেছে। এর একটা কারণ হতে পারে, নেতৃত্বের পরিবর্তন। পরবর্তী সময়ের তরুণ, অতি প্রগতিশীল ও অতি সহিংস নেতারা উরুগুয়ের সাধারণ মানুষের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলার চেয়েও বেশি মনোযোগ দিয়েছিলেন ‘শ্রেণীশত্রু’ খতমের দিকে। ক্রমবর্ধমান সহিংসতার সঙ্গে পরবর্তীতে যোগ হয় গেরিলা যুদ্ধের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় জেল পালানোর ঘটনা। সরকার এই ‘উপদ্রব’ নির্মূল করার জন্য প্রয়োগ করে সর্বশেষ অস্ত্র: সেনাবাহিনী।

মাত্র কয়েক মাসের মধ্যেই ব্যাপক ধরপাকড় ও নির্যাতন চালিয়ে ‘রবিহ হুড গেরিলাদের’ পিষে ফেলা হয়। ১৯৭২ সাল নাগাদ প্রায় নির্মুলই হয়ে যায় টুমপামারোসরা। আর ১৯৭৩ সালের জুনে এই সেনাবাহিনীই ক্ষমতা গ্রহণ করে একটি ক্যুয়ের মাধ্যমে। যার পরিণতি হিসেবে জেলে বন্দী মুজিকাদের জন্য অপেক্ষা করছিল ভয়াবহ বিভীষিকা। তাঁকেসহ মোট নয়জন টুপামারোসকে বিশেষভাবে সনাক্ত করে ছুঁড়ে ফেলা হয় সলিটারি সেলে। অন্ধকারাচ্ছন্ন, দমবন্ধকর পরিস্থিতিতে বছরের পর বছর থাকতে থাকতে কেউ কেউ উন্মাদ হয়ে গিয়েছিল। ১৯৮৫ সালের মার্চে গণতান্ত্রিক সরকার ফিরে আসার পর তাদের মুক্তি দেওয়া হয়। তার আগে ইট-লোহার বন্দীশালায় তাঁদের কাটাতে হয়েছে ১৩টি বছর।

201203050932433978d9

জেল থেকে মুক্ত হওয়ার পর খুব দ্রুতই জনপ্রিয় রাজনীতিবিদ হয়ে ওঠেন মুজিকা। সিনেটর, মন্ত্রীর দায়িত্ব পালনের পর এখন তিনি রাষ্ট্রপতি। সবার কাছে তিনি পরিচিত ‘এল পেপে’ নামে। জনপ্রিয় হয়ে ওঠার পেছনে পুরোনো দিনের সেই রবিন হুড গেরিলা ভাবমূর্তিও হয়তো একটা বড় অবদান রেখেছে। শুরুর দিকে তাদের কর্মকাণ্ডের পেছনে মতাদর্শটা ছিল অন্যরকম। তাঁরা কারো উপরে কোনো কর্তৃত্ব-কাঠামো চাপিয়ে দেওয়ার জন্য কাজ করতেন না। তাঁদের কর্মকাণ্ড পরিচালিত হতো সামাজিক বৈষম্য-অনায্যের প্রতিকার করার জন্য। তাঁরা যখন একটা ক্যাসিনো লুট করে সেটার টাকা বেতন না পাওয়া শ্রমিকদের মাঝে বিলিয়ে দিতেন, তখন অনেকে বিস্মিত হয়ে যেতেন, অনেককে সেটা অনুপ্রাণিতও করত।

দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম মসজিদটি কী বাংলাদেশে?

ধারণা করা হয় যে, বাংলাদেশে ইসলাম ধর্মের প্রচার-প্রসার শুরু হয়েছিল ১২শ শতকে। কিন্তু নতুন একটি প্রত্নতাত্ত্বিক আবিস্কারের ফলে ইতিহাসটা নতুন করেই লিখতে হতে পারে। সম্প্রতি শৌখিন এক ব্রিটিশ প্রত্নতত্ত্ববিদ রংপুরের রামজাপুর নামক গ্রামে পেয়েছেন এমন এক মসজিদের ধ্বংসাবশেষ যেটা সপ্তম শতকে নির্মিত হয়েছিল বলে ধারণা করা হচ্ছে। সত্যতা প্রমাণিত হলে এটিই হয়তো হবে দক্ষিণ এশিয়ায় নির্মিত প্রথম মসজিদের নির্দশন। সঙ্গে সঙ্গে এটাও বলা যাবে যে, মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর জীবদ্দশাতেই বা তাঁর মৃত্যুর অব্যবহিত পরেই দক্ষিণ এশিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছিল ইসলাম ধর্ম । কিন্তু এ ধরণের অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন অবহেলায় থেকে যাচ্ছে দৃষ্টিসীমার বাইরে। কখনও কখনও অর্থের লোভে দেশীয় অনেক মুল্যবান প্রত্নসম্পদ বর্হিবিশ্বে বিক্রি করে দেওয়া হচ্ছে বলেও জানা গেছে আল জাজিরার একটি প্রতিবেদন থেকে।

রামজাপুরের গ্রামটিতে নতুন একটি মসজিদ বানাতে গিয়েই গ্রামবাসীরা খুঁজে পান ৭ম শতকের এই মসজিদটি। খোঁড়াখুড়ির পরে সেখান থেকে পাওয়া যায় অনেক প্রাচীন ধনসম্পদ ও ইসলাম সংশ্লিষ্ট নৃতাত্ত্বিক নিদর্শন। কুরানের বাণী সম্বলিত একটি পাথরও পাওয়া যায় এখান থেকে। শৌখিন বৃটিশ প্রত্নতত্ত্ববিদ টিম স্টিল এই নতুন আবিস্কারটিতে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘আমরা যদি এইটা প্রমাণ করতে পারি, তাহলে হয়তো এটাই হবে দক্ষিণ এশিয়ায় নির্মিত প্রথম মসজিদ। শোনা যায় যে, মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর জীবনকালে ভারতের কেরালা ও চীনে মসজিদ নির্মান করা হয়েছিল। কিন্তু সেগুলোর কোন প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ নেই। আর আমরা এখানে একটা মসজিদ খুঁজে পেয়েছি, সেটার কথা কেউ দাবি করেনি, কিন্তু এটা সত্যিকারের একটা প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ। আর এটা নির্মান করা হয়েছিল ৭ম শতকে। মহানবীর জীবদ্দশার কাছাকাছি সময়ে।’ এই সব গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন স্থানীয় কর্তৃপক্ষ নিয়ে গেছে বলে জানায় এলাকাবাসী। রমজাপুরের বয়োবৃদ্ধ এক ব্যক্তি বলেন, ‘এখানে যত কিছু পাওয়া গিয়েছিল, সবই কতৃপক্ষ নিয়ে গেছে। আমরা এগুলোর কথা আর পরে কখনও শুনতে পাইনি।’ স্থানীয় একটি জাদুঘরে এইসব নিদর্শনের খোঁজ করতে গেলে সেখানে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি আল জাজিরার প্রতিনিধিকে।

ইন্টারনেটে একটু অনুসন্ধানের পরে অনুমান করা যায় যে, কেন কর্তৃপক্ষ এইসব প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন সম্পর্কে কোন আলাপ করতে চায় না। এইধরণের মূল্যবান নিদর্শন কেনাবেচা করা হয় ইন্টারনেটে। এমন বেশ কিছু ওয়েবসাইট ঘেঁটে দেখা গেছে যে, মিউজিয়ামের অনেক প্রত্নসম্পদ, যেগুলো ইন্টারনেটে বিক্রি করা হয়েছে তাদের প্রাপ্তিস্থান বাংলাদেশ। বাংলাদেশের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে এ বিষয়ে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেও সফল হতে পারেননি আল জাজিরার প্রতিনিধি।

ব্রিটিশ প্রত্নতত্ত্ববিদ টিম স্টিল বিশ্বাস করেন যে, রংপুরের প্রত্যন্ত গ্রাম রমজাপুরের এই মসজিদে হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবে আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নসম্পদ। এই ধরণের প্রত্নসম্পদ খুঁজে বের করা ও রক্ষণাবেক্ষণের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ সরকারকে ১২ মিলিয়ন ডলার অনুদান দিয়েছে এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাঙ্ক। এখানকার কাদামাটি প্রত্নতাত্ত্বিক খোঁড়াখুঁড়ির জন্যও আদর্শ স্থান। কিন্তু স্থানীয় গ্রামবাসীর কোনই আস্থা নেই কর্তৃপক্ষের উপরে। কেউ বিশ্বাসও করে না যে, সরকার এই স্থানটার ঐতিহাসিক গুরুত্ব বুঝে কোন কাজ করবে। তারপরও তাঁরা সযত্নে রক্ষা করে যাচ্ছে প্রত্নতাত্ত্বিক এই স্থানটিকে। কারণ তাঁদের কাছে, এটা খুবই পবিত্র একটা স্থান।
মূল রিপোর্টটি দেখতে ক্লিক করুন

মহাত্মা গান্ধী কি সমকামী ছিলেন?

গত বছর মহাত্মা গান্ধীর একটি বিতর্কিত জীবনী লিখে সমালোচনার ঝড় তুলেছিলেন জোসেফ লেলিভেল্ড। ‘মহত্ প্রাণ: মহাত্মা গান্ধী ও তার ভারত সংগ্রাম’ শীর্ষক এই বইয়ে লেলিলেল্ড ইঙ্গিত দিয়েছিলেন যে, হয়তো স্বাধীন ভারতের প্রধান স্থপতি মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী একজন সমকামী ছিলেন এবং স্ত্রীকে ছেড়ে তিনি তাঁর সেই প্রেমিক জার্মান বংশোদ্ভুত স্থপতি হ্যারমান কালেনবাখের সঙ্গে থাকতে চেয়েছিলেন। এমন দাবি আসলেও সত্য কিনা, তা জানার সুবর্ণ সুযোগও এসেছিল সবার। গান্ধী ও কালেনবাখের কিছু চিঠি আর কয়েকদিন পরেই লন্ডনে একটি নিলামে বিক্রি হতে যাচ্ছিল। কিন্তু আচমকা সেই চিঠিগুলো প্রায় ৭ লাখ পাউন্ড খরচ করে কিনে নিয়েছে ভারত সরকার। ফলে একেবারে শেষ মুহূর্তে স্থগিত করতে হয়েছে লন্ডনের সেই নিলাম অনুষ্ঠান। আর মহাত্মা গান্ধী সত্যিই সমকামী ছিলেন কিনা, সেই সন্দেহের পালে জোর হাওয়া লাগিয়েছে ভারত সরকারের এই সিদ্ধান্তটি।

গত বছরের মার্চে প্রকাশিত হয় জোসেফ লেলিভেল্ডের বইটি। এখানে পুলিত্জার পুরস্কারজয়ী এই সাংবাদিক এমন কিছু তথ্য দিয়েছিলেন যা থেকে মনে হতে পারে যে, মহাত্মা গান্ধী আসলে একজন সমকামী ছিলেন। ১৯০৪ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায় গান্ধীর সঙ্গে পরিচয় হয় জার্মান বংশোদ্ভুত স্থপতি হ্যারমান কালেনবাখের। বইয়ে এই দুইজনের একান্ত সম্পর্ক নিয়ে অনেক বিস্তারিত বর্ণনা দেওয়া হয়েছিল। এমনকি লেলিভেল্ডের মতে, মহাত্মা গান্ধী কালেনবাখের প্রেমেই পড়েছিলেন। সেই সময়ে কালেনবাখকে প্রায় ১৩টি চিঠি লিখেছিলেন ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রধান নেতা। ভারতীয় ঐতিহাসিক রামাচন্দ্র গুহ কালেনবাখের বাড়ি থেকে চিঠিগুলো খুঁজে পান।

এর আগে জোসেফ লেলিভেল্ডের বইটিও গান্ধীর নিজ প্রদেশ গুজরাটে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। তাঁদের মতে, এটা জাতির পিতাকে অপমান করার সামিল। ভারত সরকারও এর আগে গান্ধীর ব্যক্তিগত কোন জিনিস নিলামে তোলার ব্যাপারে তীব্র আপত্তি জানিয়েছে। তাদের মতে, যে মানুষটা সারা জীবন বস্তুগত সম্পত্তির বিরোধীতা করে গেছেন, এখন তাঁর সেই জিনিসগুলোই নিলামে তোলাটা গান্ধীকে অপমান করার সামিল। আর এবার কালেনবাখকে লেখা এই চিঠিগুলো কিনে নেওয়ার পর ভারতের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের জৈষ্ঠ্য এক কর্মকর্তা বলেছেন, ‘ভারতের কাছে এই চিঠিগুলো খুবই গুরুত্ব বহন করে। এখন আমরা এগুলোর মাধ্যমে গান্ধীবাদী দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে গবেষণা শুরু করব। একারণেই আমরা চিঠিগুলো কিনে নিয়েছি।’

তবে চিঠিগুলোর ক্ষেত্রে ভারত সরকারের এই তড়িত্ পদক্ষেপ পুরনো বিতর্কটাকেই আরও উস্কে দিয়েছে। আসলেই কী গান্ধী সমকামী ছিলেন? জোসেফ লেলিভেল্ডের বই অনুসারে, দক্ষিণ আফ্রিকায় থাকার সময় গান্ধী ও কালেনবাখ খুবই ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। এমনকি কালেনবাখের একটা বাড়িতে তাঁরা দুইজন প্রায় দুই বছর একসঙ্গেও ছিলেন।— ডেইলি মেইল

নেচেছিল ইস্টার আইল্যান্ডের মূর্তিগুলো!

দীর্ঘদিন ধরে বিজ্ঞানীদের হতবুদ্ধি করে রেখেছিল ইস্টার আইল্যান্ডের মূর্তিগুলো। মোয়াই নামে পরিচিত এই বিশালাকৃতি পাথরের মূর্তিগুলো কিভাবে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে আনা হয়েছিল, তা একটা রহস্য হয়েই ছিল অনেকদিন ধরে। তবে সম্প্রতি এই রহস্যের সমাধান পাওয়া গেছে বলে দাবি করেছেন একটি গবেষক দল। তাঁদের মতে মূর্তিগুলো এসেছিল নাচতে নাচতে!

ইস্টার্ন আইল্যান্ডকে বিবেচনা করা হয় দুনিয়ার প্রধানতম জনবিচ্ছিন্ন আবাসস্থল হিসেবে। দুর্গম এই জায়গায় পাওয়া গেছে ৮৮৭টি বিশালাকৃতির পাথর মূর্তি। সবচেয়ে দীর্ঘদেহী মূর্তির উচ্চতা প্রায় ৩৩ ফুট। আর ‘পারো’ নামের এই মূর্তিটির ওজন ৮২ টন। সবচেয়ে ভারী মূর্তিটির ওজন ৮৬ টন। আরও একটি অসমাপ্ত মূর্তির সন্ধান পাওয়া গেছে, যেটি সম্পূর্ণ হলে তার উচ্চতা হতে পারত ৬৯ ফুট আর ওজন ২৭০ টন। ১২৫০ থেকে ১৫০০ সালের মধ্যে এই মূর্তিগুলো বানানো হয়েছে বলে বিশ্বাস করেন বিজ্ঞানীরা। তবে কিভাবে এই বিশালাকৃতির মূর্তিগুলোকে প্রায় ১৮ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে বর্তমান অবস্থানে নিয়ে আসা হয়েছিল সেটা একটা বিস্ময় হিসেবেই ছিল এতদিন। নিশ্চিতভাবেই ইস্টার্ন আইল্যান্ডের আদিবাসীদের কাছে চাকা, ক্রেন বা বড় কোন পশুর সাহায্য নেওয়ারও সুযোগ ছিল না। এটা তারা করেছিল নিজেরাই। আর কিভাবে ইস্টার্ন আইল্যান্ডের মূর্তি কারিগররা এই আপাত অসম্ভব কাজটা বাস্তবে সম্পন্ন করেছিল সেটা নিয়ে বিভ্রান্ত হয়ে ছিলেন বিজ্ঞানীরা।

এর আগে মোটামোটি প্রতিষ্ঠিত একটা সমাধান ছিল যে, গাছের গুঁড়ি, দড়ি ইত্যাদির সাহায্যে মূর্তিগুলো টেনে আনা হয়েছিল। তবে সেটা যে কীপরিমাণ কষ্টসাধ্য কাজ তা অনুমান করতে অসুবিধা হয়না। এমনকি অনেকেই খুব জোরের সঙ্গে বিশ্বাস করেন যে, এই মূর্তিগুলোর পেছনে ভীনগ্রহের প্রাণীদের সংযোগ আছে। অন্য গ্রহের কোন বুদ্ধিমান প্রাণী বিশেষ প্রযুক্তি ব্যবহার করে কাজগুলো করেছিল। তবে নতুন একটা সমাধান নিয়ে এসেছেন হাউয়াই বিশ্ববিদ্যালয় ও ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই গবেষক। তাঁদের মতে, ইস্টার আইল্যান্ডের আদিবাসীরা মূর্তিগুলির তিন দিকে দড়ি বেঁধে একটি বিশেষ কায়দায় সেগুলোকে হাঁটিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। অনেকটা নাচের ভঙ্গিতে।

গত বছর, ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক সোসাইটির অর্থায়নে করা এই গবেষণা থেকে দেখা যায় যে, বিশালাকৃতির মূর্তিগুলোর তিন দিকে দড়ি বেঁধে সেটাকে হাঁটিয়ে নিয়ে যাওয়া যেতে পারে। অবশ্য কাজটা যারা করবে তাদের কিছুটা দক্ষতা ও অভ্যাস থাকাও অপরিহার্য। এই ধারণার সঙ্গে একমতও পোষণ করেছে ইস্টার আইল্যান্ডের আদিবাসী রাপানুইরা। তাদের কাছে জবাবটা খুব পরিস্কার। ২৫ বছর বয়সী সুরি টুকির ভাষায়, ‘আমরা সত্যটা জানি। মূর্তিগুলো হেঁটেছিল।’— ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক

দ্য ভিঞ্চির ‘কী করিতে হইবে’ তালিকা!

বিখ্যাত নোটবুকটি থেকে অনেক তাক লাগানো তথ্যই জানা গেছে লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির জীবন সম্পর্কে। ১৬ শতকের এই চিত্রশিল্পী, ভাস্কর, বিজ্ঞানীর চিন্তাধারা যে তাঁর নিজ সময়ের চেয়েও কতখানি এগিয়ে গিয়েছিলেন, তা অনুধাবন করা যায় ভিঞ্চির এই নোটবুকটি থেকে। রেঁনেসা যুগের অন্যতম সৃজনশীল এই মানুষটি যে অনেক ভুলোমনা মানুষের মতো ‘কী করিতে হইবে’ তালিকাও বানাতেন, সেটাও সম্প্রতি জানা গেল তাঁর এই নোটবুকের একটি পাতা থেকে। ১৫১০ সালের দিকে লেখা এই পাতায় অঙ্কন উপাদান চক-চারকোল-পেপার কেনার কথা নিজেকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন ভিঞ্চি। সেই সাথে মানুষের মাথার খুলি সংগ্রহ করা, কুমিরের চোয়ালের বর্ণনা দেওয়ার মতো কাজগুলোও টুকে রেখেছেন পশ্চিমা শিল্পজগতের প্রতিভাবান এই শিল্পী। বিস্তারিত পড়ুন

“অবয়বহীন” মহেঞ্জোদারো, বিভ্রান্তিতে প্রত্নতাত্ত্বিকরা

খুবই সুন্দরভাবে পরিকল্পিত রাস্তাঘাট ও একটা সুনির্মিত পানি/বর্জ্য নিস্কাশন প্রক্রিয়া আমাদের এটাই ইঙ্গিত দেয় যে, প্রাচীন সিন্ধুসভ্যতার মহেঞ্জোদারো নগরীর বাসিন্দারা খুবই দক্ষ নগর পরিকল্পনাকারী ও পানি নিয়ন্ত্রণের সামর্থ্য অর্জন করেছিল। কিন্তু বর্তমান পাকিস্তানে অবস্থিত প্রায় ৩০০০ খৃষ্ট পূর্বাব্দের প্রাচীন এই নগরের বাসিন্দা কারা ছিল, তা এখনও একটা রহস্যই থেকে গেছে। পেনসালভেনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ধুসভ্যতার গবেষক গ্রেগরি ফোসেলের ভাষায়, ‘এটা অনেকটাই অবয়বহীন।’

প্রাচীন বেশিরভাগ সভ্যতার মতো এই নগরীতে নেই কোন জমকালো প্রাসাদ, মন্দির বা ভাস্কর্য। সমাজ পরিচালনার জন্য নেই কোন কেন্দ্রীয় সরকার পদ্ধতি। এমনকি কোন রাজা বা রানী থাকারও কোন প্রমাণ পাওয়া যায় না মহেঞ্জোদারো নগরীতে। পরিমিতিবোধ, শৃঙ্খলা ও পরিস্কারপরিচ্ছন্নতা তাদের কাছে অধিকতর গ্রহণযোগ্য ছিল বলেই প্রতীয়মান হয়। মৃিশল্পের ব্যপক প্রসার ছিল সেই সমাজে। প্রচলিত ছিল পাথর ও তামার তৈরি অনেক হাতিয়ার বা অন্যান্য সামগ্রী। সিলমোহর ও ওজন মাপার ব্যবস্থা দেখে অনুমান করা যায় যে সেখানে ছিল খুবই সুনিয়ন্ত্রিত বাণিজ্যিক ব্যবস্থা। প্রাচীন এই নগরের ঐশ্বর্য্য ও উচ্চ গুনসম্পন্নতার প্রমাণ নিশ্চিতভাবেই পাওয়া যায় অনেক নৃতাত্ত্বিক নিদর্শনে। পোড়া ইটের নির্মান কাঠামোগুলো বাদেও নীলকান্তমণি, হাতির দাঁতের সামগ্রী, সোনার পুঁতিমালা ইত্যাদি পাওয়া গেছে মহেঞ্জোদারোর ধ্বংসাবশেষে।
পোড়া মাটির ইট দিয়ে ঘেরা একটি কৃত্রিম জলাশয়ই কোন প্রাচীন সভ্যতার উপাসনালয়ের কাছাকাছি নির্মানকাঠামো। গ্রেট বাথ নামে পরিচিত এই স্নানাগারটি নগরের অপেক্ষাকৃত উঁচু একটা স্থানে অবস্থিত। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের ফোসেলের মতে, ‘এ থেকে আমরা ইঙ্গিত পেতে পারি যে, মহেঞ্জোদারোর বাসিন্দারা পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতাবোধ দ্বারা পরিচালিত এক মতাদর্শ লালন করত।’ এছাড়াও পুরো নগরজুড়েই অসংখ্য কুয়া ও প্রায় প্রতিটা বাড়িতেই একটা স্নানাগার ও বর্জ্য নিস্কাষণ ব্যবস্থা ছিল।

১৯১১ সালে প্রথম এই মহেঞ্জোদারো সভ্যতার হদিশ পান প্রত্নতাত্ত্বিকরা। তবে বেশিরভাগ খোঁড়াখোঁড়ির কাজটা করা হয় ১৯২০ থেকে ১৯৩১ সালের মধ্যে। পরবর্তীতে ১৯৫০ ও ১৯৬৪ সালের দিকেও বর্তমান পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশের লারকানা জেলায় সুপ্ত প্রাচীন এই নগরের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের খোঁজে খোঁড়াখোঁড়ি চালানো হয়। ফোসেলের মতে, ২৫০০ থেকে ১৯০০ খৃষ্টপূর্ব সময়ই এই সভ্যতার স্বর্ণযুগ ছিল। এসময়ে সিন্ধু সভ্যতার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নগর ছিল এই মহেঞ্জোদারো। তবে ঠিক কী কারণে এই ঐশ্বর্য্যপূর্ণ প্রাচীন নগরটি পরিত্যক্ত হয়েছিল, তা এখনো রহস্যই থেকে গেছে। প্রত্নতত্ত্ববীদ জোনাথন নেনোয়ারের মতে, ‘সিন্ধুসভ্যতার শেষমুহূর্তে যারাই এখানে এসেছিল, তারা নিশ্চিতভাবেই এখানকার উত্তরসূরীদের মতো ছিল না বা তাদের প্রতিনিধিত্বও করেনি।’ সিন্ধু নদীর গতিপরিবর্তনের ফলেও এই কৃষিভিত্তিক সভ্যতার পতন হয়ে থাকতে পারে বলে মত দিয়েছেন কেনোয়ার। তবে কোন বন্যা বা নদীর গতিপরিবর্তনই যে এই নগরকে পরিত্যক্ত করেছে, এমন কোন শক্ত প্রমাণও পাওয়া যায় না। পুরো সিন্ধু উপত্যকা জুড়েই সংস্কৃতির অনেক লেনদেন-অদলবদল হয়েছে বলে জানিয়েছেন ফোসেল। তিনি বলেছেন, ‘১৯০০ খৃষ্টপূর্বাব্দে এই মহেঞ্জোদারো নগরী কোন না কোনভাবে একটা বড় প্রত্নতাত্ত্বিক সফলতা অর্জন করেছে। কিন্তু এটা কিভাবে সম্ভব হয়েছে, তা কেউই জানে না।’— ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক