জিন্দা-মুর্দা পার্ক: শান্তিকানন আর রাজউক উন্নয়ন!

গুগল ম্যাপের সুবাদে এখন পাখির চোখে খুব চমৎকার দেখা যায় “উন্নয়ন”-এর চিত্র। ছবিতে ধুসর হয়ে যাওয়া অংশটা হচ্ছে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অধীনে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) ‘পূর্বাচল নতুন শহর’ প্রকল্পের জায়গা। চারদিকে যথেষ্ট সবুজ। একসময় যে আরও অনেক সবুজ-শ্যামল ছিল– তা শোনা যায় মুরুব্বিদের কথায়। এখন সেসব ধু ধু মরুভূমি। এখানে নগর হচ্ছে। আধুনিক জীবনযাপন হবে। মানুষ উন্নত হবে। সভ্যতা বিকশিত হবে।

এই আধুনিক শহর প্রকল্পের ঠিক পাশেই আছে একটা সবুজঘেরা মনোরম জায়গা। যেটিকে সবাই এখন চেনেন ‘জিন্দাপার্ক’ নামে। ১০০ বিঘার মতো এই জায়গাটিরও মালিক এখন কাগজে-কলমে রাজউক। অসাধারণ কিছু চিন্তাভাবনা আর দীর্ঘদিন ধরে তিল তিল করে গড়ে ওঠা এই জায়গাটি রাজউক অধিগ্রহণ করে ১৯৯৫ সালে। এরপর এই জায়গাটির দখল নেওয়ার জন্য দফায় দফায় রাজউকের সঙ্গে সংঘর্ষ-উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে জড়িয়েছে সেখানকার এলাকাবাসী। ‘পার্ক’টিকে ঘিরে আশা-স্বপ্নের বাতি জ্বালানো হাজারো মানুষ।

‘জিন্দাপার্ক’ নামে পরিচিত এই জায়গাটি আসলে পরিচালিত হয় একটি সমিতির মাধ্যমে। অগ্রপথিক পল্লী সমিতি। ১৯৮০ সালের দিকে সেসময় স্কুলপড়ুয়া ৫ কিশোরের উদ্যোগে যাত্রা শুরু হয়েছিল এই সমিতির। মাত্র ৬০ টাকা পুঁজি আর মাসিক ১০ টাকা চাঁদা দিয়ে শুরু হয়েছিল পথ চলা। এখন সেই কম্পাউন্ডের মধ্যে আছে অসাধারণ নির্মানশৈলির একটি স্কুল-লাইব্রেরী-মসজিদ-কটেজ। আছে একটি স্বাস্থ্যসেবাকেন্দ্র। খেলার মাঠ। লেক। মন শান্ত করে দেওয়ার মতো সবুজের সমারোহ। নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত শিক্ষার উদ্দেশে তৈরি হচ্ছে নতুন আরেকটি স্কুল ভবন। চলছে একটি রেস্টুরেন্ট-রেস্ট হাউজ তৈরির কাজ। ভবিষ্যতে কাজী নজরুল ইসলামের নামে একটি সঙ্গীত বিশ্ববিদ্যালয় নির্মান ও পরিচালনার পরিকল্পনাও আছে এই সমিতির।

দেশের অনেক জায়গায় যেরকম রিসোর্ট টাইপ জিনিস দেখা যায়– এই ‘জিন্দাপার্ক’টা বোধহয় সেগুলোর চেয়ে একেবারেই আলাদা কিছু। প্রকৃতির সঙ্গে তাদের সহাবস্থানের বিষয়টি বুঝতে পারা যায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই। কোথাও কখনো কোনো গাছ কাটেননি তাঁরা। এখন সেখানে আড়াইশ প্রজাতির প্রায় ২৫হাজার গাছ আছে। শান্ত পরিবেশটা ভয়াবহভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয় বলে সেখানে কোনো পিকনিক পার্টি ঢুকতে দেয়না সমিতি।

জিনিসটা তথাকথিত পার্ক হিসেবে পরিচালনার কোনো রূপকল্প এই সমিতির আদি পরিকল্পনায় ছিল না। এখনো নেই। পুরো জিনিসটাই তাঁরা চিন্তা করেছিলেন ও তিল তিল করে বাস্তবায়ন করে যাচ্ছেন একটা কমিউনিটির স্বার্থ চিন্তা করে। একারণেই হয়তো দেখা যায়– একবার একটা চিড়িয়াখানা তৈরির উদ্যোগ নিয়েও সেটি তাঁরা বাস্তবায়ন করেননি। এখনো একটা অংশে শুধু কিছু পিলার দেখতে পাওয়া যায়। যেটা ওভাবেই পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। ঘন গাছপালা অচিরেই হয়তো গ্রাস করে নেবে সেই কনক্রিটের পিলারগুলোকে।

দেয়াল দিয়ে ঘিরে দিলে কেমন বন্দী বন্দী ভাব আসে– সেই চিন্তা থেকে পুরো কম্পাউন্ডটার তিন দিক তাঁরা পরিকল্পিতভাবে ঘিরে দিয়েছেন লেক দিয়ে। এই পেঁচিয়ে থাকা জলাধারগুলোই এলাকার সীমানা নির্ধারণ করে। সামনে একটা দিকে আছে ইটের দেয়াল। তাঁরা এই এলাকাকে ডাকতে পছন্দ করেন ‘ঐক্যতান’ হিসেবে। আদিতে এই পুরো প্রকল্পটিকে শান্তিনিকেতনের আদলে গড়তে করতে চেয়েছিলেন সমিতির উদ্যোক্তারা। এই লক্ষ্যে তাঁরা নাম ঠিক করেছিলেন ‘শান্তিকানন’। এখন সেসব ঐক্যতান, শান্তিকানন, অগ্রদূত পল্লী সমিতি– সবকিছু চাপা পড়েছে ‘জিন্দাপার্ক’-এর আড়ালে।

সেটাও তো ঠিকঠাক চালাতে পারলে হতো। রাজউক-এর উন্নয়নের ঠেলা সামলাতে হচ্ছে তাদের এখন পর্যন্ত। ২০১৪ সালে পাকাপাকিভাবে সাইনবোর্ড-ফাইনবোর্ড টাঙিয়ে এটাকে নিজেদের দখলীকৃত জায়গা বলে ঘোষণা করে দিয়ে গেছেন কর্তারা। রাজউক আর জিন্দাপার্কের এই লড়াই চলেছে দীর্ঘদিন ধরে। এখনো চলছে। তবে অনেক সংগ্রাম করে এটা পরিচালনার ভার নিজেদের দখলেই রাখতে পেরেছে সমিতি। আর এই সমিতি চালাচ্ছে বলেই মনে হয় এখনো সেটি চলছে খুব ভালোভাবে। আগ্রহীরা গিয়ে দেখে আসতে পারেন।

মোদ্দা কথা যেটা, তা হলো: কী চাই আসলে আমরা? রাজউকের পূর্বাচলের মতো অত্যাধুনিক ধুসর হয়ে যাওয়া শহর? নাকি শান্তিকাননের শান্ত, সবুজ-শীতল প্রাকৃতিক নৈসর্গ্য? কিসে শান্তি মানুষের? কিসে হয় উন্নয়ন?

  1. No trackbacks yet.

মন্তব্য করুন

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  পরিবর্তন )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  পরিবর্তন )

Connecting to %s

%d bloggers like this: