‘প্রশ্ন করো সব কিছুকেই’- কেন?
কী ছিল জিনিসটা? কিছু শব্দতরঙ্গ?! কিছু ধ্বনি, কিছু শব্দ, কিছু চিৎকার, কিছু আর্তনাদ?! ‘আব্বু, তুমি কানতেছো যে’- বুক চিরে দেওয়া এই প্রশ্ন আর নিজের মৃত্যু-নিয়তি জেনে ফেলা এক বাবার নির্মম অসহায়ত্ব ফুটে উঠেছিল যে শব্দতরঙ্গগুলোতে, তা আসলে আরও অনেক কিছু ছিল।
১৪-১৫ মিনিটের ফোন রেকর্ডিং অডিওটা মানুষের কানে যেন বিষ ঢেলে দিয়েছে। সেই বিষ কারো হৃদয়ে রক্তক্ষরণ ঘটাচ্ছে, কারো মাথায় আগুন ধরিয়ে দিচ্ছে। নিদেনপক্ষে বলা যায়, অগ্রাহ্য করতে পারছেন না কেউই। রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসী বাহিনীর প্রতিটা ক্রসফায়ার-এনকাউন্টারের গল্পই যে কমবেশি এমন- সেটা এতদিন ছিল ওপেন সিক্রেট। কাউন্সিলর একরাম হত্যার অডিওটা সিক্রেসির চাদরটা সরিয়ে দিয়েছে পুরোপুরি।
ফলে জিনিসটা অগ্রাহ্য করা সত্যিই কঠিন হচ্ছে। আমাদের পিঠ দেয়ালে ঠেকিয়ে দিয়েছে অডিওটা। এমন ঘটনা গত কয়েক বছর ধরেই অনেক ঘটে গেছে। নানা কারণে সেগুলো নিয়ে তেমন সোরগোল হয়নি। কিন্তু এবার লক্ষ্য করা যাচ্ছে একধরণের গণ-চৈতন্য জাগ্রত হওয়ার মতো বিষয়। মানুষ কথা বলতে শুরু করেছেন।
কথা না বলে আর থাকা যাচ্ছে না আসলে। আমাদেরকে মনুষ্যত্বের শেষ সীমায় এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে একরাম হত্যার অডিওটা। এরপরও কথা না বললে নিজেদের মনুষ্য সত্ত্বাটাই আর থাকে না মতো অবস্থা। প্রবল সরকারপন্থী হিসেবে পরিচিত- এমন ১০ বিশিষ্ট নাগরিকও ক্রসফায়ারের নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন।
আর এই কথাবার্তা একবার যখন উঠেছে, তখন তা আরও বেশি করে হওয়া দরকার। শুধু বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডেরই বিরোধীতা করব নাকি সবধরণের হত্যাকাণ্ডেরই বিরোধীতা করব? সমাজের প্রতিটি পর্যায়ে, পদে পদে যে নীতিহীনতা, দুর্নীতি, লুটতরাজ, সন্ত্রাস, সাধারণ মানুষের সীমাহীন ভোগান্তি- এ থেকে উত্তরণের পথ কি? সব কিছু নিয়ে প্রশ্ন তুলতে শুরু করা দরকার। এক এক করে পরীক্ষা দেব, এক পরীক্ষার সময় অন্য পরীক্ষার উত্তর লিখব না- এই ধরণের যুক্তিপদ্ধতি আসলে কাজের কিছু না। দেখাই গেছে হাতেনাতে।
সব কিছুই আসলে সব কিছুর সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। ধর্ষণ কেন হয়, ক্রসফায়ারের নামে রাষ্ট্রীয় হত্যা কেন হয়, ৫ম শ্রেনীর সমাপণী পরীক্ষার প্রশ্নপত্রও কেন ফাঁস হয়, ব্যাংক থেকে কোটি কোটি টাকা কিভাবে ঋণের নামে হাপিশ হয়ে যায়, রানা প্লাজা-তাজরিন গার্মেন্টস কেন ধ্বসে পড়ে-আগুনে কয়লা হয়, বিশ্বজিৎ-এর ওপর কেন প্রকাশ্য দিবালোকে চাপাতির কোপ নেমে আসে, পাহাড়ে-সমতলে আদিবাসী-সংখ্যালঘুদের ঘরবাড়ি কেন পুড়িয়ে দেওয়া হয়, সুন্দরবন কেন ধ্বংসের পথে যায়, সরকার কেন ক্রমশ স্বৈরাচারী হয়ে ওঠে ইত্যাদি প্রভৃতি নানা প্রশ্নই আসলে একে অপরের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। কোনোটাকে এগিয়ে কোনোটার সমাধান সম্ভব না।
ক্রসফায়ারে হত্যার প্রতিবাদে শুধু একদিনের প্রতিবাদ সমাবেশ করার চেয়ে বরং এই কথাবার্তাগুলোই বেশি করে আলাপ হওয়া দরকার। কী ধরণের সমাজ চাই? সেটা কেন চাই? কিভাবে সেখানে পৌঁছানো যাবে বা সেই পথে হাঁটা শুরু করা যাবে- এ জাতীয় প্রচুর প্রশ্ন তোলা দরকার। আলাপ-আলোচনা করা দরকার।
প্রশ্ন তুলতে শুরু করা উচিৎ সব কিছু নিয়ে। ‘প্রশ্ন করো সব কিছুকেই’। এই বাক্যকেও প্রশ্ন করে বলব, ‘কেন?’ কে জানে! উত্তরও হয়তো লুকিয়ে আছে এই ‘কেন’-র মধ্যে।
No trackbacks yet.