বিপ্লব মানে আনন্দ, বিপ্লব মানে ‘টোটাল অর্গাজম’!
আহ! কী অদ্ভুত এক সময়ই না কাটিয়েছেন প্যারিসের মুক্তিকামী মানুষেরা। ৫০ বছর আগে, ঠিক এই সময়টাতেই স্বপ্নের এক সমাজ গড়ার নেশায় বুঁদ হয়ে ছিলেন লাখো মানুষ। ছাত্র-শ্রমিক-জনতা, এক কাতারে দাঁড়িয়ে ভাঙতে চেয়েছিলেন পুরোনো অনড়-অনায্য-অসাম্যের ঘুনে ধরা সমাজটাকে। গড়তে চেয়েছিলেন নবতর ভবিষ্যত। যেখানে সাম্যের প্রতিশ্রুতি ছিল। স্বাধীনতার প্রতিশ্রুতি ছিল।
বিপ্লব-বিদ্রোহের এক বাঁধভাঙা জোয়াড় খুলে দিয়েছিল সৃজনশীলতা, কল্পনাপ্রতিভার দ্বার। অসাধারণ সব কাব্যিক স্লোগান-গ্রাফিতিতে জীবন্ত হয়ে উঠেছিল ১৯৬৮ সালের প্যারিস। ‘সব ক্ষমতা চাই কল্পনার হাতে’ – এই স্লোগানটি থেকেও বুঝতে পারা যায়, ফ্রান্সের তরুণ সেই প্রজন্ম কল্পনাশক্তি আর সৃজনশীলতার বিকাশকে কতটা গুরুত্ব দিয়েছিলেন। তাঁরা বলেছিলেন, ‘ক্রিয়া যেন স্রেফ প্রতিক্রিয়া না হয় – ক্রিয়া মানে সৃজনক্রিয়া’।
তাঁরা বলে দিয়েছিলেন, ‘মানা করা নিষেধ’! এমন কোনো বিধিনিষেধ দেওয়া যাবে না, যা কল্পনার ডানা ছেঁটে দেয়, সৃজনশীলতার পায়ে বেড়ি পড়ায়। ৬৮-র সেই ফরাসী তরুণ প্রজন্মের উদাত্ত আহ্বান ছিল, ‘যা কিছু শিখেছ ভুলে যাও, শুরু করো তোমার স্বপ্নের হাত ধরে’।
আর তাঁরা সেই কাঙ্ক্ষিত স্বপ্নের সমাজ গড়তে চেয়েছিলেন ‘প্রেমে আর প্রেমে; প্রতিবাদে-প্রতিরোধে’**। উপলব্ধি করেছিলেন যে, ‘যত বেশি আমি প্রেম করি, তত বেশি আমি রচনা করতে চাই বিপ্লব; আর যত বেশি আমি রচনা করি বিপ্লব, তত বেশি আমি প্রেম করতে চাই।’
সর্বোপরি ১৯৬৮ সালের প্যারিস বসন্ত তুলেছিল আনন্দের অধিকারের দাবি। জীবনের সুখ আস্বাদনের আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করেছিলেন প্যারিসের শিক্ষার্থীরা। শুধু শাসন-শোসন দিয়েই না, বুর্জোয়া শাসকশ্রেণী যে মানুষের সুখহরণ করছে, সেটা খুব স্পষ্টভাবে বলেছিলেন প্যারিস বসন্তের তরুণরা, ‘সমস্ত সুখের বারোটা বাজানো ছাড়া বুর্জোয়াদের অন্য কোনো সুখ নেই।’
সাম্য-স্বাধীনতার দাবি তুলে আসলে সুখময়, আনন্দে পূর্ণ এক জীবনযাপনের আহ্বান এসেছিল ৫০ বছর আগের প্যারিস থেকে। স্বপ্নাতুর সেই প্রজন্মের কাছে ‘সুখ একটা নতুন আইডিয়া’ ছিল। তাঁরা ঘোষণা করেছিলেন, ‘স্থায়ী সুখের অবস্থা’। কমিউনিস্ট মেনিফেস্টোর আদলে তাঁরা লিখেছিলেন, ‘দুনিয়ার মজদুর- আনন্দ করো!’ ’একঘেঁয়েমি ছাড়া আমাদের হারাবার কিছুই নেই – জয় করবার জন্য রয়েছে আস্ত এক আনন্দ-পৃথিবী।’
সুখ, আনন্দ! এই-ই তো আসলে মানুষের আত্মিক আকাঙ্ক্ষা। আমরা যেন তা ভুলতেই বসেছি। তাই বারবার মুগ্ধ দৃষ্টি ফিরে যায় ৬৮-র প্যারিস বসন্তের দিকে। কী দুর্দান্তভাবেই না তারা বলেছিলেন এই মর্মকথাগুলো। পুরো বিশ্বের মানুষকে এক আনন্দময় পৃথিবীর স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন, এখনও দেখাচ্ছেন।
প্যারিস বসন্তের তরুণ প্রজন্ম ছুঁড়ে ফেলতে চেয়েছিল একঘেঁয়ে জীবনের জঞ্জালকে। ঘোষণা করেছিলেন, ‘এমন পৃথিবী আমরা চাই না যেখানে ক্ষুধায় না মরার গ্যারান্টি পেতে গিয়ে একঘেঁয়েমিতে মরার ঝুঁকি তৈরি হয়।’ তাঁরা বাঁচতে চেয়েছিলেন প্রতি মুহূর্তে। বলেছিলেন, ‘বাঁচার অধিকার চেয়ে বেড়ায়-ও না – বাঁচতে শুরু করো।’
তাঁরা চেয়েছিলেন উত্তেজনা, রোমাঞ্চ, অ্যাডভেঞ্চারে পরিপূর্ণ এক জীবন। আর যখন তাঁরা দেখেছিলেন যে, পুরোনো সমাজটা এসবের কিছুই করতে দেবে না তখন তাঁরা লিখেছিলেন, ‘সকল প্রকার অ্যাডভেঞ্চার বিলুপ্ত করেছে যে সমাজ, একটাই যে অ্যাডভেঞ্চার তার বাকি আছে তা হলো এই সমাজটাকেই বিলুপ্ত করে দেওয়া।’
কোনো মহান কেউ এসে এমন স্বপ্নের একটা সমাজ গড়ে দিয়ে যাবে, এমন ভাবনাও প্রত্যাখ্যান করেছিল প্যারিস বসন্ত। তারা আগেই বলে দিয়েছিল, ‘আমাকে মুক্ত করতে এসো না – তার ব্যবস্থা আমি নিজেই করব’। বিপ্লব-বিদ্রোহটা তাদের কাছে ছিল নিজ নিজ উপলব্ধির প্রশ্ন। তাই তারা উচ্চারণ করেছিলেন, ‘বিপ্লবের মালিক কোনো অমুক কমিটি-তমুক কমিটি নয় – বিপ্লব তোমার’। কমিটি গড়ার আহ্বানও অবশ্য ছিল, ‘গড়ে তোল স্বপ্ন দেখা কমিটি’! তাঁদের কাছে ‘স্বপ্ন থেকে বাস্তবে পৌঁছানোর সক্রিয় রাস্তাটুকুই [ছিল] বিপ্লব’।
আবার শুধু আত্মত্যাগ আর বলিদান দেওয়ার সেকেলে বিপ্লবের ধ্যানধারণাতেও আস্থা রাখতে পারেননি, বিশ্বাস স্থাপন করতে পারেননি প্যারিসের তরুনরা। তারা চেয়েছিলেন বিপ্লবের প্রতিটি মুহূর্ত উদযাপন করতে। বলেছিলেন, ‘যে বিপ্লবের জন্য দরকার আমাদের আত্মবলিদান তা আসলে আব্বুদের বিপ্লব।’ আকাঙ্ক্ষিত সমাজ আর সেই সমাজ বাস্তবে রূপ দেওয়ার লড়াই; উভয় ক্ষেত্রেই গৎবাঁধা সব ধ্যানধারণা বিসর্জন দিয়েছিল প্যারিস বসন্ত।
উদ্ধৃতিচিহ্নের মধ্যে থাকা প্রায় সব বাক্যই নেওয়া হয়েছে সেলিম রেজা নিউটনের অচেনা দাগ বইয়ের ‘বন্ধুত্ব-বসন্ত-বিপ্লব: প্যারিস থেকে শাহবাগ’ শীর্ষক অংশ থেকে। নিউটনের লেখার কিছু অংশ নিয়েই ইতি টানি।
“খোদ বিপ্লব সংক্রান্ত মুখস্থ-যান্ত্রিক-ছকবাঁধা চিন্তাপ্যারেডের পক্ষীবুলিকে বদলে দিয়েছিল প্যারিস বসন্ত। বদলে দিয়েছিল খোদ বিপ্লবের কমনসেন্স। আমরা কি কোনোদিন ফিচেল বা রাশভারি কোনো পার্টি আমলার মুখে ভুলেও শুনেছিলাম যে বিপ্লব মানে আনন্দ? হ্যাঁ। বিপ্লব মানে আনন্দ। বিপ্লব মানে ‘টোটাল অর্গাজম’। বিপ্লব চায় পূর্ণাঙ্গ পুলকে ভরে উঠুক আমাদের যাপিত জীবন – আজ, আগামীকাল, প্রতিদিন।”
——————————–
সেলিম রেজা নিউটনের অচেনা দাগ বইয়ে আরও বিস্তারিত আলাপ আছে প্যারিস বসন্ত নিয়ে। পৃষ্ঠা (৩৭-৪৪)। আগ্রহীরা চাইলে অনলাইনেও পড়তে পারেন এই লিংকে গিয়ে: https://goo.gl/o1x8QX
খুবই সংক্ষেপে প্যারিস বসন্তের ইতিহাস জানতে পড়ুন: প্যারিস বসন্ত: ‘বাস্তববাদী হও, অসম্ভবের দাবি তোলো’! ; প্যারিস ১৯৬৮ লিফলেট: “সংস্কার? না; বিপ্লব? হ্যাঁ
** মামুনুর রশিদের লেখা ‘ফিলিস্তিনের গান’ থেকে। পুরো কবিতা: https://arts.bdnews24.com/?p=4852
No trackbacks yet.