গান্ধী উত্তরাধিকারের ভার বইতে পারছেন রাহুল?
ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে কংগ্রেস আর গান্ধী পরিবারের নাম। জওহরলাল নেহরু, ইন্দিরা গান্ধী, রাজীব গান্ধী, সোনিয়া গান্ধী প্রত্যেকেই ভারতের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে রেখেছেন অবিস্মরণীয় ভূমিকা। তবে গান্ধী পরিবারের সর্বশেষ প্রজন্ম রাহুল গান্ধী এখন সেই গান্ধী উত্তরাধিকারের ভার বইতে পারছেন কি না, তা একটা বড় প্রশ্ন আকারেই হাজির হয়েছে। বিশেষত সাম্প্রতিক সময়ে ভারতের বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেসের ভরাডুবির পর রাহুলের রাজনৈতিক ক্যারিয়ার হুমকির মুখেই পড়ে গেছে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা। এমনকি উত্তর প্রদেশের নির্বাচনী প্রচারণায় প্রধান ব্যক্তি হিসেবে দায়িত্ব পালন করার পর সেখানেই তাঁর রাজনৈতিক সমাধি রচিত হয়েছে বলেও মন্তব্য করেছেন অনেকে। গান্ধী পরিবারের ঐতিহ্য অনুসারে দেশ গঠনের অঙ্গীকার নিয়ে সফল রাজনীতিবিদ হয়ে ওঠা তো অনেক দূরের কথা, রাহুল গান্ধী এখন সঙ্গে পাচ্ছেন না কংগ্রেসের নেতা-কর্মীদেরও। রাজনৈতিক অঙ্গনে কীভাবে এ রকম নিঃসঙ্গ হয়ে গেলেন সোনিয়া তনয়?
গত ৫ মার্চ ভারতের পাঁচটি রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনে মোটেই কাঙ্ক্ষিত ফলাফল পায়নি কংগ্রেস। উত্তর প্রদেশে, যেখানে রাহুল গান্ধী ছিলেন কংগ্রেসের নির্বাচনী প্রচারণার প্রধান ব্যক্তি, সেখানকার পরিস্থিতিই সবচেয়ে হতাশাজনক। মোট ৩৫৫টি আসনে নির্বাচনে অংশ নিয়ে মাত্র ২৮টি আসনে জিততে পেরেছে রাহুলের নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস। এই ফলাফল রাহুলের রাজনৈতিক বিচক্ষণতা নিয়েই যে একটা বড় ধরনের প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছে তাতে কোনোই সন্দেহ নেই। দলের কর্মীরা নির্বাচনের এই ভরাডুবির জন্য দায়ী করেছেন উত্তর প্রদেশ কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক দিকবিজয় সিং, কংগ্রেসের কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য মোহন প্রকাশ, রাজ্য কংগ্রেসের প্রধান রিতা বাহুগুনা জোশি ও রাহুলের সেক্রেটারি কানিশা সিংকে। বেশ কয়েকটি আসনে ভুল প্রার্থী মনোনয়নই এই ভোট ভরাডুবির প্রধান কারণ হিসেবে কাজ করেছে বলে অভিযোগ পার্টি কর্মীদের। এমনকি নির্বাচনের এক দিন পর ‘ভুল প্রার্থী মনোনয়ন’ই যে উত্তর প্রদেশের রাজনৈতিক ব্যর্থতার মূল কারণ তা স্বীকার করেছেন সোনিয়া গান্ধীও। আর এই প্রার্থী মনোনয়নের পুরো কাজটাই হয়েছে রাহুলের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে ও পরামর্শে। তাই নির্বাচনের ফল প্রকাশের পরে রাহুলকে যখন জনসমক্ষে দাঁড়াতে হলো, তখন তিনি ছিলেন পুরোপুরিই একা। পার্টির নেতা-কর্মীরাও যেন দূরেই সরে গেছে অনেকটা।
তবে পাঁচটি রাজ্যের এই বিধানসভা নির্বাচনে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়নি কংগ্রেস। জিতেছে দুটি রাজ্যে। মনিপুর ও উত্তরাখণ্ডে। গত ৬ মার্চ ভারতের বিধানসভা নির্বাচনের এক দিন পর সাংবাদিকদের কংগ্রেসের সাফল্য স্মরণ করিয়ে দিতে গিয়ে সোনিয়া গান্ধী বলেছিলেন, ‘ভুলে গেলে চলবে না, আমরা একটা রাজ্যে জিততে পেরেছি।’ এ সময় সোনিয়া গান্ধী গাণিতিকভাবে ভুল বললেও রাজনৈতিকভাবে যে সঠিকই ছিলেন, তা বোঝা গিয়েছিল নির্বাচনের ছয় দিনের মধ্যেই। উত্তরাখণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচন করতে গিয়েই বেসামাল অবস্থার মধ্যে পড়ে গেল কংগ্রেসের পার্টি হাইকমান্ড।
উত্তরাখণ্ডে, বিজেপির থেকে মাত্র একটা আসনে এগিয়ে থেকে জয়যুক্ত হয়েছিল কংগ্রেস। সরকার গঠন করতে প্রয়োজন ছিল আরও তিনটি আসন। ৯ মার্চ তিনজন স্বতন্ত্র প্রার্থী, একজন ইউকেডি প্রার্থী ও তিনজন বিজেপি প্রার্থীকে দলে ভিড়িয়ে ৩৯ জন বিধায়ক নিয়ে সরকার গঠনের বৈধতা অর্জন করে সোনিয়া-রাহুলের কংগ্রেস। কিন্তু এরপর মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচন করতে গিয়েই বাধে বিপত্তি। ১২ মার্চ সন্ধ্যায়, সোনিয়া গান্ধী ঘোষণা করেন বিজয় বাহুগুনার (৬৫) নাম। সঙ্গে সঙ্গেই বিদ্রোহ করে বসেন আরেক এমপি, উত্তরাখণ্ড কংগ্রেসের প্রভাবশালী নেতা হরিশ রাওয়াত (৬৩)। পরদিন বাহুগুনা যখন মুখ্যমন্ত্রীর শপথ পাঠ করছেন মাত্র ১১ জন বিধায়ক নিয়ে, তখন ১৮ জন বিধায়ক ও সমর্থক নিয়ে দিল্লিতে গিয়ে বিক্ষোভ শুরু করেছেন হারিশ রাওয়াত। তাঁর দাবি, ‘আমি কংগ্রেসের বাল্যবধূ। আমার ন্যায়বিচার চাই।’ নির্বাচনের আগে রাওয়াতই কংগ্রেসের প্রধান প্রচারক হিসেবে কাজ করা সত্ত্বেও মুখ্যমন্ত্রীর আসনটা অপেক্ষাকৃত কম অভিজ্ঞ নেতাকে দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ রাওয়াত ও তাঁর সমর্থকদের। সব মিলিয়ে ভারতের রাজনৈতিক অঙ্গনে কংগ্রেস ও গান্ধী পরিবারের সময়টা যে আসলেই খারাপ যাচ্ছে, তা সহজেই অনুমান করা যায়।
গান্ধী পরিবারের দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক ঐতিহ্য যেন এ সময়ে বজায় রাখতে ব্যর্থ হচ্ছেন রাহুল গান্ধী। ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর রাজনৈতিক সংগ্রামে স্বাধীনতা এসেছিল ভারতীয় ভূখণ্ডে। এরপর ইন্দিরা গান্ধী, রাজীব গান্ধীরা দেশের মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন দেশ গড়ার কাজে। রাজনৈতিক অঙ্গনে সোনিয়া গান্ধীর সফলতাও খুব একটা কম নয়। কিন্তু রাহুলকে সেই ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে গিয়ে রীতিমতো হিমশিম খেতে হচ্ছে। এখন দেশের আপামর জনসাধারণের কাছে পৌঁছানোর আগে নিজের পার্টির নেতা-কর্মীদের পাশে পাওয়ার সংগ্রামেই লিপ্ত হতে হবে বলে রাহুলকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন ভারতের রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা।—ইন্ডিয়া টুডে অবলম্বনে
No trackbacks yet.