ঋণের বোঝা আমরা কেন নিতে যাব?
শেয়ারবাজারের বিশাল বিশাল ধ্বস, অস্থিরতা ইত্যাদি দেখে আঁঁচ করা যাচ্ছিল যে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি খুব একটা ভালো না। কিন্তু অবস্থা যে খুবই খারাপ, সেটা এতদিন আমাদের অগোচরেই ছিল। ৩০ অক্টোবর প্রথম আলোর একটি খবর থেকে জানা গেল যে, সরকার মহাশয় ‘চরম আর্থিক সংকটে’ রয়েছেন এবং ঘাটতি মেটাতে এবার সার্বভৌম ঋণ বা বন্ড ছেড়ে বিদেশ থেকে টাকা সংগ্রহ করতে চলেছেন। বাংলাদেশের ৪০ বছরের ইতিহাসে এমন বাণিজ্যিক ঋণের নজির আগে কখনো দেখা যায় নি।
সরকার যদি সত্যিই এই পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করে, তাহলে বিপুল পরিমাণ উচ্চ সুদযুক্ত ঋণের বোঝা এক অর্থে আমাদের অর্থাত্ বাংলাদেশের সমস্ত মানুষের উপরই চাপতে যাচ্ছে। আমাদের কী এই ভার বহন করার মতো বাস্তব পরিস্থিতি আছে? এটা কী আদৌ কোন দীর্ঘমেয়াদী সুফল বয়ে আনবে? অর্থনীতিবীদ, বিশেষজ্ঞরা কিন্তু উত্তরটা না-ই দিচ্ছেন। সরকারের এই নতুন উদ্যোগে উদ্বেগ প্রকাশ করে তাঁরা বলছেন, ‘এই জাতীয় ঋণের মধ্যে ঢুকলে মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদে তা দেশের অর্থনৈতিক কাঠামোকেই ক্ষতিগ্রস্থ করবে।’ তাহলে আমরা কেন এই ঋণের বোঝা মাথায় নিতে যাব? সরকারের এই পদক্ষেপের সঙ্গে বাংলাদেশের প্রতিটা নাগরিকেরই প্রত্যক্ষ সম্পর্ক আছে। সেক্ষেত্রে নজিরবিহীন এই বিশাল উদ্যোগটির কথা আমাদেরকে জানানো হলো না কেন? সরকার কারও সঙ্গে কোন ধরণের আলোচনা-মতবিনিময় না করেই এই বিধ্বংসী পরিকল্পনা বাস্তবায়নের দিকে এগিয়ে চলেছেন। এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে আসলে কী ধরণের পদ্ধতিতে পরিচালিত হচ্ছে, সেই প্রশ্নটা এসেই যাচ্ছে। এটা কী ধরণের গণতন্ত্র? কোথায় এখানে সরকারের জবাবদিহিতা-স্বচ্ছতা? এভাবে একদিন দেনার দায়ে লাঞ্ছিত-অপমানিত হলেও আমাদের কিছুই বলার থাকবে না? বসে থাকব আমরা, পাঁচ বছর পর পর মহান ভোটাধিকার প্রয়োগ করার জন্য?
পত্রিকা সূত্রে জানা যাচ্ছে, ইতিমধ্যেই একটি বিদেশী ব্যাংকের পক্ষ থেকে অর্থমন্ত্রী ও অর্থসচিবের কাছে এ ঋণ নেওয়ার বিভিন্ন দিক উপস্থাপনও করা হয়েছে। তারা বাংলাদেশ ব্যাংককে এ বিষয়ে একটি প্রতিবেদন তৈরি করে দিতেও বলেছে। শ্রীলঙ্কার পথ অনুসরণ করে ৬.২৫% সুদ হারে ১০ বছর মেয়াদের ঋণ আন্তর্জাতিক বাজার থেকে নিতে পারে বাংলাদেশ। ৫০ থেকে ১০০ কোটি ডলার ঋণের জন্য বণ্ড ছাড়া হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এর জন্য দেশের আর্থিক অবস্থার সূচকগুলো প্রদর্শন করে বর্হিবিশ্বে রোড শো করে বেড়াতে হবে সরকারকে। সরকারের নেওয়া ব্যাংক ঋণের কারণে মূল্যস্ফীতিসহ সামষ্টিক অর্থনীতিতে নানা সমস্যা দেখা দিয়েছে, স্থানীয় ও বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সরকারকে আর অর্থের যোগান দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না, বৈদেশিক লেনদেনের উপর চাপ পড়ছে, শেয়ারবাজারে বিগত ১ বছর ধরে চরম অস্থিরতা বিরাজ করছে— এই জাতীয় সূচকগুলোই নিশ্চয় দেখানো হবে এই রোড শো গুলোতে? এগুলো বিশ্লেষণ করেই নিশ্চয়ই বাংলাদেশকে ঋণ দেওয়ার লাভ-ক্ষতির হিসাব-নিকাশ কষবে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো। অর্থনৈতিক হিসাব-নিকাশ, আন্তর্জাতিক ঋণ দেওয়া-নেওয়ার আইনকানুনের মারপ্যাঁচের মধ্যে না গিয়েও, শুধু নিজের আত্মসম্মানের জায়গা থেকেও বলার আছে যে, এই ধরণের পরিস্থিতি আমাদের জন্য অবমাননাকর। আমি অন্তত চাই না যে, বিশ্বদরবারে এভাবে নিজেদের দুর্বলতা প্রদর্শন করে ধার চেয়ে বেড়াতে। সরকার তাহলে এ ধরণের অপমানজনক পরিস্থিতির মধ্যে আমাদের কেন ফেলে দিচ্ছে? কোন ধরণের কথাবার্তা-অবহিতকরণ ছাড়াই?
এই প্রশ্ন তোলাটা সম্ভবত এখন খুবই জরুরি হয়ে পড়েছে। সম্প্রতি খোদ গণতন্ত্রের জন্মভূমি গ্রীস নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণা করেছে। দেনার দায় শোধ করতে না পেরে। পরিস্থিতি উত্তরণে ভর্তুকি কমানো, ট্যাক্স বৃদ্ধি ইত্যাদি কারণে অবিরাম রাষ্ট্র-জনতার সংঘর্ষ চলছে সেখানে। আমাদের পরিস্থিতিও কী সেদিকেই যেতে বসেছে? ২০২১ সালে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা ঝলমল করবে নাকি দেনার দায়ে পেট শুকিয়ে থাকতে হবে? এই ঋণ যদি নেওয়াও হয়, তাহলে তা শোধ করার মতো বাস্তব-কার্যকরী পরিকল্পনা আছে কী আমাদের দিন বদলের সরকারের? কোন ধরণের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে সরকারের অবশ্যই এই প্রশ্নগুলির উত্তর দেওয়া উচিত্। আমাদেরও মনে হয় বারংবার প্রশ্নগুলো করে সরকারকে জবাবদিহি করতে বাধ্য করা প্রয়োজন।
No trackbacks yet.