‘দৌড় সংস্কৃতি’র বিপত্তি

 

১৯৭৫ সালের বিশ্বকাপ ক্রিকেটের ফাইনাল। খেলা তখনো শেষ হয়নি, কিন্তু মাঠে হাজারো দর্শকের ভিড়

১৯৭৬ সালের দিকে একদিন বাসে করে দক্ষিণ লন্ডনের দিকে যাচ্ছিলেন কিংবদন্তী আম্পায়ার ডিকি বার্ড। হঠাৎ কন্ডাক্টরের মাথার হ্যাটটা তাঁর খুব পরিচিত মনে হলো। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন হ্যাটটা সে কোনখান থেকে পেয়েছে। কন্ডাক্টরের জবাব, ‘ওহ! তুমি কী কখনো ডিকি বার্ডের নাম শোনোনি? এটা তার হ্যাট। আমি এটা তার কাছ থেকে নিয়েছিলাম বিশ্বকাপের ফাইনাল ম্যাচের সময়। ম্যাচ শেষ হওয়ার পর আমরা সবাই মাঠে দৌড় দিয়েছিলাম। আর বুঝতেই পারছ, রেসটা আমিই জিতেছিলাম!’
খেলা শেষ হলে উল্লাসিত জনতার এভাবে মাঠে দৌড় দেওয়ার রেওয়াজটা এখন আর নাই। কিন্তু ওয়ানডে ক্রিকেটের শুরুর দিকে এটা ছিল খুবই নিয়মমাফিক একটা ব্যাপার। এখনকার মতো এত নিরাপত্তার কড়াকড়িও ছিল না সেসময়। খেলা শেষ হলেই বিজয়ী দলের সদস্যদের অভিনন্দন জানাতে বা সবাই মিলে একসঙ্গে জয় উদযাপন করার জন্য মাঠে দৌড় দিতেন দর্শকরা। তবে তখনকার এই ‘দৌড়-সংস্কৃতি’র ফলে খেলাটা সুষ্ঠভাবে শেষ করতে অনেক জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে, এমন উদাহরণও আছে প্রচুর। দেখা গেল, দর্শকরা ধরেই নিয়েছে যে, খেলাটা শেষ হয়ে গেছে। মুহূর্তেই তারা দৌড়ে এসে ভরিয়ে দিল গোটা মাঠ। কিন্তু আসলে হয়তো তখনও খেলা কিছুটা বাকিই থেকে গেছে। ১৯৭৫ সালের বিশ্বকাপ ফাইনালটাই এটার সবচেয়ে যুৎসই উদাহরণ। যেখানে আম্পায়ার ডিকি বার্ডকে তাঁর হ্যাট খোয়াতে হয়েছিল। অস্ট্রেলিয়ান ফাস্ট বোলার জেফ টমসন হারিয়েছিলেন তার প্যাড। আর অতিকষ্টে মাঠ ছাড়ার পর উইন্ডিজ অলরাউন্ডার কেইথ বয়েস খুঁজে পান নি তার জুতোজোড়া।
প্রথম বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়া-ওয়েস্ট ইন্ডিজের ফাইনাল ম্যাচটা শুরু হয়েছিল এক রৌদ্রোজ্জ্বল সকালে। ১১টার সময়। আর শেষ হয়েছিল প্রায় ১০ ঘন্টা পর। রাত পৌনে নয়টায়। কারণ দুই তিনবার খেলোয়াড়-আম্পায়ারদের সামলাতে হয়েছিল উৎসুক দর্শকদের জোয়ার। টসে হেরে ব্যাট করতে নেমে অস্ট্রেলিয়াকে ২৯২ রানের দুরুহ টার্গেট ছুঁড়ে দিয়েছিল ক্লাইভ লয়েড বাহিনী। ক্লাইভ লয়েড নিজে খেলেছিলেন ৮৫ বলে ১০২ রানের এক অসাধারণ অধিনায়কোচিত ইনিংস।
জবাবে ব্যাট করতে নেমে ভালোই লড়াই চালাচ্ছিল অস্ট্রেলিয়া। কিন্তু পাঁচ পাঁচটা রানআউট আর কেইথ বয়েসের আগুন ঝড়ানো বোলিং অসহায় করে দিল অস্ট্রেলিয়াকে। স্কোরবোর্ডে ২৩৩ রান জমা করেই ফিরে গেলেন নয়জন ব্যাটসম্যান। কিন্তু শেষ উইকেট জুটিতেই টানটান উত্তেজনা সৃষ্টি করে ফেললেন জেফ টমসন আর ডেনিস লিলি। এক রান, দুই রান করে আসে- আসে- স্কোরবোর্ডে ৩৩ রান জমা করে ফেললেন এই দুই উদ্বোধনী বোলার। শেষ দুই ওভারে দরকার ২৬ রান। ৫৯তম ওভারের প্রথম বলে দুই রান নেওয়ার পর দ্বিতীয় বলেই কাভারে দাঁড়ানো রয় ফ্রেডরিকের হাতে ধরা পড়লেন  থমসন। ওয়েস্ট ইন্ডিজের প্রথম বিশ্বকাপ জয়ের আনন্দ উদযাপন করতে মুহূর্তের মধ্যে জনসমুদ্রে পরিণত হলো লর্ডস স্টেডিয়াম। ২২ ইয়ার্ডের পিচটুকু বাদ দিয়ে পুরো মাঠটাই চলে গেল ওয়েস্ট ইন্ডিজ সমর্থকদের দখলে। কিন্তু ওদিকে আম্পায়ার যে একটা হাত তুলে নো বলের ইশারা করেছেন সেটার দিকে কেউ নজরই দেয় নি। মজার ঘটনাটা শুরু হলো এখানেই।
উইকেটের এক প্রান্তে ডেনিস লিলিকে সীমানার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে স্ট্যাম্প লক্ষ্য করে বল ছুঁড়লেন ফ্রেডরিক। লক্ষ্যভ্রষ্ট। বল চলে গেল দর্শকদের মাঝে। এই অপ্রত্যাশিত-লাভজনক পরিস্থিতির সুযোগটা হাতছাড়া করতে চাইলেন না লিলি। ইচ্ছেমতো দৌড়াতে লাগলেন উইকেটের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত। তিন রান নেওয়ার পর থেমে যেতে চেয়েছিলেন টমসন। কিন্তু লিলি শান্ত হলেন আরো অনেকক্ষণ দৌড়ানোর পর। শেষপর্যন্ত একসময় দর্শকরা পরিসি’তি সম্পর্কে অবগত হয়ে আবার চলে গেল দড়ির বাইরে। লিলি, আম্পায়ার টম স্পেনসারের কাছে জানতে চাইলেন তিনি কত রান পাচ্ছেন? এতবার দৌড়ানোর পরও তাকে মাত্র দুই রান দেওয়া হবে শুনে তিনি ভয়ানক চটে গেলেন। ক্ষুব্ধ হয়ে বললেন, ‘অসম্ভব, আমরা সারা দুপুর ধরে এই উইকেটের এপার-ওপার করছি।’ ডিকি বার্ডও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এগিয়ে আসলেন। লিলিকে জিজ্ঞাসা করলেন তারা আসলে কয় রান নিয়েছে। লিলি তখনো তাঁর এতখানি পরিশ্রম বৃথা যাবে, এটা ভাবতেই পারছিলেন না। বললেন, ‘এটা তো তোমাদেরই গোনার কথা। কিন্তু আমি ১৭ রানের মতো নিয়েছি।’ যদিও কিংবদন্তী এই দুই পেসারের ঐ দৌড়গুলো শেষপর্যন্ত গোনায় আসেনি। তাদেরকে দেওয়া হয়েছিল মাত্র চার রান। খেলাটাও এরপর চলেছিল আর মাত্র তিন বল। প্রথম দুই বলে দুইটা সিঙ্গেল নেওয়ার পর তৃতীয় বলে স্ট্যাম্পিংয়ের ফাঁদে পড়ে গেলেন টমসন। ওয়েস্ট ইন্ডিজ পেল ১৭ রানের জয়। এবার দ্বিগুন গতিতে মাঠের দিকে ধেয়ে আসল উল্লাসিত উইন্ডিজ সমর্থকদের স্রোত। মাঠে উপস্থিত ক্রিকেটার-আম্পায়ারদের হাল কী হয়েছিল সেটা তো শুরুতেই বলা হয়েছে। তবে পরিস্থিতি এরকম হতে পারে আন্দাজ করে বুদ্ধিমানের মতো কাজ করেছিলেন কেইথ বয়েস। চা বিরতির সময়ই তিনি তাঁর নতুন জুতাটা পাল্টে পড়ে নিয়েছিলেন একজোড়া পুরোনো জুতা। যেন জুতার মায়া ছেড়েই ভোঁ-দৌড় দেওয়া যায় সাজঘরের দিকে!

মন্তব্য করুন

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  পরিবর্তন )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  পরিবর্তন )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  পরিবর্তন )

Connecting to %s

%d bloggers like this: